ঘুমের ভান করে চোখ বুঁজে বিছানায় পড়ে আছে নিপা । যাকে বলা হয় ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা ।বাসার সুনসান নিরবতায় ও বুঝে মা এখন দুপুরের ভাত-ঘুমে ডুবে গেছে । সাহস করে চোখ পিটপিট করে তাকায় , প্রথমে চোখ যায় মুখোমুখি ঘুমন্ত ছোট বোন দিপার উপরে ।বেকুবটা শোয়া মাত্র গভীর ঘুম বেহুঁশ । ওকে এখন আর ডাকা সম্ভব নয় , মা জেগে যেতে পারে । ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে নিপা ঘরের অপর প্রান্তের বিছানায় তাকালো ,যা ভেবেছিল ,খাটের কিনারায় লম্বা চুল শুকোতে দিয়ে মা ঘুমাচ্ছে । ফ্যানের বাতাসে মা’র চুল কি সুন্দর উড়ছে ! শোয়া অবস্থায় নিপা নাকে জোরে বাতাস টানে-ওর মা’র চুলে কেমন একটা মিঠে মিঠে গন্ধ পায় সব সময়-এখনও যেন তা ও পেতে চাইছিল । হঠাৎ মনে পড়ে এখন মা’র চুলের ঘ্রান নিলে দেরী হয়ে যাবে , নষ্ট হয়ে যাবে বিথীর সাথে করা সব প্ল্যান । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দরজাটা খুলে এক লাফে বাইরে বেরুতে হবে । বিথীর সাথে সব কথা হয়ে আছে ।
নিপারা থাকে মফস্বল শহরের একটি কলোনীতে । কলোনীর আশ-পাশে ঘিরে রয়েছে শহরের মধ্যবিত্ত পরিবার গুলোর ঢেউ টিনে ছাওয়া আধাপাকা বসত বাড়ী ,পুকুর ,ধানী জমি আর ফলজ বাগান । এর ফলে এই কলোনীর বাচ্চারা গ্রামের বাচ্চাদের মতই পুকুর, ধানি জমি আবাদ এসব দেখে অব্যস্থ । আর অব্যস্থ , ফল বাগানের ফল চুরি করে । এসব চুরির মধ্য দিয়ে আসলে তাদের শৈশবের দুরন্তপনার বহিঃপ্রকাশ হয় মাত্র । মাঝেমাঝে এসব চুরির জন্য বাসায় আচ্ছামতন ধোলাই জুটে যায় বাচ্চাদের ঝুলিতে,তারপরও শৈশবের দুরন্তপনা থামে না । তেমনি আজ নিপা আর বিথী দু’জনে কলোনীর কম্পার্টমেন্টের লাগোয়া চৌধুরীদের বাড়ী যাবে । চৌধুরীদের পুকুর পাড়ের পেয়ারা বাগানের পেয়ারা গাছগুলো ঢাউস আকারের পেয়ারার ভারে নুয়ে পড়েছে । ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে তেমনি সবুজ পেয়ারা আর পেয়ারা ! দূর থেকেই দেখলে পানিতে জ্বীব ভরে যায় । দুপুরের এই অলস সময়টাতে চৌধুরী বাড়ীর সবাই ঘুমিয়ে থাকে । নির্জনতা নেমে আসে পুরো চৌধুরী বাড়ী জুড়ে । এই সময়টাই তাই বেছে নিয়েছে ওরা ,পেয়ারা চুরির জন্য । পা টিপে টিপে বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে এক মুহুর্ত দাড়ায় নিপা ,মা জেগে গেলে বলতে হবে ,“হিসু করবো ।” না ,দুপুরের অলস ঘুম ভেঙ্গে মা তাকায় না ।
দরজা খুলে শেষ দুপুরের এক তাল গনগনে গরম রোদ্দুরে এসে দাড়ায় নিপা । তীব্র দুপুর চারিদিক জর্দার চোখ ধাঁধাঁনো রঙে রাঙানো। কলোনীর ঘাসে ছাওয়া ইট বিছানো সরু রাস্তায় আর কারোকে দেখা যায় না । এলোমেলো চুলগুলো দু’হাতে আঁকড়ে হাতে প্যাঁচানো রাবার ব্যান্ড দিয়ে যেনতেন একটা পনি টেইল ঝুঁটি করে নিজেকে বিন্যাস্ত করে নেয় নিপা । তারপর দ্রুত বিথীদের কোয়ার্টারের দিকে পা বাড়ায় । একটু পথ যেয়েই দেখতে পায় বিথী রোদের আয়না ভেঙ্গে ওর দিকে এগিয়ে আসছে ,এসেই লবন-মরিচের পুঁটলিটা হাফ প্যান্টের কোঁচড় থেকে বের করে নিপাকে দেখায় । তারপর হাত ধরাধরি করে দু’জন ছুটে স্কুল ভবনের দিকে , স্কুলের পেছনে টয়লেটের ছাদ ওদের গন্তব্য । প্রথমে টয়লেটের ছাদে উঠতে হবে ,ওখান থেকে কলোনীর বাউন্ডারী ওয়ালে , তারপর চৌধুরী বাড়ীর ওপাশে ডুমুর গাছ বেয়ে নেমে যেতে হবে নীচে । চুপিসাড়ে যেতে হবে পুকুর পাড়ে । সেখানে কাঁচা-পাঁকা পেয়ারার ভারে গাছগুলো ঝুঁকে আছে তালপাতার মাথাল পরা কৃষকের মতন । পেয়ারা পারার জন্য গাছেও উঠতে হয় না তেমন , লাফ দিয়েই ধরা যায় পেয়ারাগুলো । স্কুল ভবন হয়ে ডুমুর গাছ বেয়ে চৌধুরীদের পুকুর পাড়ে পৌঁছাতে দেরী হয় না দুই দুরন্ত বন্ধুর । পুকুর পাড়টা বেশ নির্জন । আশেপাশে কেউ নেই । ওদের হাল্কা-পাতলা দেহগুলো গাছের মগডালে উঠে যায় নিঃশব্দে । বিথী নিপাকে ফিসফিসিয়ে বলে ,“বেশী পাড়িস না । তাহলে ধরা পড়ে যাব । ”নিপাও নিরবে বিথীর কথার সায় দেয় । বেশী পেয়ারা নিয়ে যে দ্রুত দৌড়াতে পারবে না-তা ও জানে । তাছাড়া পেয়ারা নিয়ে বাসায় গেলে মা জেনে যাবে, পেয়ারা চুরির ব্যাপারটা - তাহলে আর পিঠে ছাল রাখবে না ।
দুপুরের আয়েসী থম্ ধরা নিস্তব্ধতা চারিদিকে । এক মুঠো জোরালো হাওয়া কোথা থেকে উড়ে এসে স্তব্ধ পুকুরের বুকে আছড়ে পড়ে বৃত্তের ঢেউ তোলে । সে হাওয়া নিপা আর বিথীর ছোট আর চঞ্চল দেহ কেবল ছুঁয়ে যায় , হাওয়ার তোড় ওদের বিচলিত করে না ।ওরা পেয়ারা পাড়ায় মগ্ন হয়ে উঠে । প্রথমে দু’টি লোভনীয় পেয়ারায় কামড় বসায় ওরা ।তারপর বেছে বেছে কয়েকটি পেয়ারা কোমরের সাথে আটকানো ঝোলায় ঢুকিয়েছে মাত্র অমনি হাজী চৌধুরীর হুংকার ভেসে আসে Ñ“কে রে পেয়ারা গাছে ?” শোনা মাত্র ওরা পাতার ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখে নেয় , এখনো হাজী চৌধুরী বেশ দূরে , তবে বাতাসে মেহেদী রাঙানো কমলা দাড়ি উড়িয়ে এদিকেই আসছে ।তড়তড়িয়ে মগডাল থেকে নীচে নেমে আসে ওরা , কয়েকটি পেয়ারা ছিটকে পড়ে এদিক ওদিক Ñকে তা তোলে ! হাজী চৌধুরীর হাতের কঞ্চিটি হাওয়ায় শিস কাটছে যে ! জামা গুটিয়ে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে দে দৌড় ! দে দৌড় ! পুকুর পাড় ধরে ছুটে দু’বন্ধু , চঞ্চল পাগুলো ঠিকঠাক ডুমুর গাছ বেয়ে উঠে যায় দেয়ালের উপর তারপর এক লাফে স্কুলের টয়লেটের ছাদে । পরিস্থিতি নিজেদের অনুকুলে মনে হওয়ায় এবার পেছন ফিরে তাকায় ওরা , হাজী চৌধুরী গালাগালির তুবড়ী ছুটিয়ে ঠিক ওদের পেছন পেছন দেয়ালের নীচে এসে দাড়িয়েছে । রাগ আর দৌড়ানোর পরিশ্রমে তার ফর্সা মুখ মাটির হাড়ির মত লালচে । রঙিন দাড়ি থেকে টপ টপিয়ে ঘাম ঝরছে । নিপা হাজী চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটে , দেখাদেখি বিথীও । তা দেখে সদ্য হজ্ব করে ফেরা হাজী চৌধুরী হজ্বের সব করনীয়-বর্জনীয় ভুলে অশ্রাব্য ভাষায় গাল দেয় ওদের । হঠাৎ নিপা হাতের বড় একটি পেয়ারা ছুঁড়ে মারে হাজী চৌধুরীর কপাল বরাবর , ল্য মোটেও ব্যর্থ হয় না । এর পরের টুকু আর দেখে না , শুধু “ঠক্ ” করে একটি শব্দ শুনে ওরা সুপারম্যান সিনেমা স্টাইলে “ইয়া--” বলে টয়লেটের ছাদ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে বিকল হয়ে পড়া বিমানের মত । বিথী ঠিক ভাবে নামলেও নিপার ল্যান্ডিংয়ে সমস্যা হয় , ও মাটিতে আছড়ে পড়ে তিন মাথা বুড়ো হয়ে । দু’হাঁটু সজোরে ওর চোয়ালে আঘাত করে ,ফলে একটু পর ওর মুখাকৃতি চৌকোনা হয়ে যায় । তা নিয়ে অবশ্য নিপার ভাবার ফুরসত হয় না। সফল পেয়ারা চুরির আনন্দে ওরা দু’জন হাসতে থাকে ,তাড়া খেয়েও ওদের পেয়ারার সংগ্রহ খারাপ নয় । নিপার ছোঁড়া পেয়ারা কিভাবে হাজী চৌধুরীর কপালে ঠক্ করে লেগেছে তা বলে এবং অভিনয় করে দু’জনে আবার স্কুল মাঠে হেসে গড়িয়ে পড়ে । এর মাঝে জুটে যায় অন্যান্য বন্ধুরাও , সবাই মিলে স্কুল মাঠে পা ছড়িয়ে বসে পেয়ারা খেতে খেতে হাজী চৌধুরীর গল্পে আবারও জমে উঠে । তারপর সবাই মিলে গোল্লা-ছুট খেলতে শুরু করে । খেলতে খেলতে বিকেল যখন শেষের দিকে তখন ছোট বোন দিপাকে দৌড়ে আসতে দেখে নিপা ।কোমরের ঝোলায় দিপার জন্য যে বড় পেয়ারাটি রেখেছে তা হাত দিয়ে একবার দেখে নেয় ঠিক আছে কিনা । ভেবে নেয় , প্রথমেই দিপাকে পেয়ারা দেওয়া যাবে না , একটু ভাব দেখাতে হবে ,তারপরে দেবে । নিপা দিপাকে দেখেও না দেখার ভান করে খেলায় মনোযোগী হয়ে উঠে । দিপা নিপার খেলাকে পাত্তা না দিয়ে হড়বড় করে জানায় ,“হাজী চৌধুরী আর অনেক মানুষ আমাদের বাসায় এসেছিল একটু আগে । তার কপালে এত বড় এক ব্যান্ডেজ ।মা’কে নালিশ করে গেছে , তুমি নাকি ইট মেরে তার মাথা ফাটিয়েছ । মা খুব রেগে গেছে ,বাসায় যাও মজা টের পাবে । তোমাকে খোঁজার জন্য মা আমাকে পাঠিয়েছে ।”
দিপার কথা শুনে নিপা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকায় । দিপা বোনের ভয় বুঝতে পেরে আবারও কলকল করে উঠে , “জালি বেত দুইটা রেড়ী । মা বলেছে ,বাসায় গেলেই তোমার পিঠে ওই দুইটা ভাঙ্গবে ”
মা’র রাগী রাগী মুখটা চোখের সামনে দেখতে পায় নিপা । ভয়ে ওর হাত-পা অসাড় হয়ে আসে ।মা রেগে গেলে ভয়ংকর হয়ে উঠে , তখন তাকে আর নিপার মা মনে হয় না । স্কুলের হেড মিস্ট্রেস আপার মত কঠিন হয়ে উঠে মা’র মুখ । দোষ করলে তখন নিপাকে খুব মার খেতে হয় । দিপা অবশ্য ওর মত এত মার খায় না । মা বলে , নিপা নাকি ভীষন দুষ্ট , তাই বেশী মার খায় । আজও কি নিপা তেমনি ভাবে খুব বেশী দুষ্টুমী করে ফেলেছে ? ইশ্ , কেন যে পেয়ারাটা হাজী চৌধুরীর কপালে ছুঁড়ে মারতে গেল ! বদ্ লোকটা আবার মাকে নালিশ করতে এসে বলল -ইট মেরেছে নাকি ও । কত বড় মিথ্যুক লোকরে বাবা ! নিপা নিরবে ছোট বোনকে ওর জন্য রাখা পেয়ারাটি এগিয়ে দেয় । হাতে পেয়ারা পেয়েই তাতে কামড় বসাতে দেরী করে না দিপা । “মিথ্যাবাদী পাজি লোক ।মিথ্যা বলার জন্য আল্লা ওকে শাস্তি দেবে । নিপা তো ইট মারেনি,পেয়ারা ছুঁড়ে মেরেছে ।” বিথী দিপাকে বলে ।
“মেরেছি খুব ভাল করেছি ।লোকটাও তো আমাদের মারতে এসেছিল তাই নারে বিথী ?”নিজের পে সমর্থন চায় যেন নিপা।
“তবু পেয়ারাটা তোর মারা ঠিক হয়নি। এখন যে নালিশ করে গেল ,বাসায় জানলে আমারও খবর হয়ে যাবে।”বিথী নিজের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ে। ওরা খেলার অন্য সঙ্গীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের একটু পরে কি অবস্থা হবে সে ভাবনা এবং মনোচ্ছবিতে মশগুল হয়ে উঠে । ওদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল অফিস ফেরত , নিপাদের বিল্ডিংয়ের তিন তলার যুবায়ের সাহেব। তিনি কোন এক সরকারী অফিসে কর্মকর্তা পদে রয়েছেন । এছাড়াও শোনা যায়,বেনামে তার রয়েছে নিজস্ব ব্যবসা । অফিসের গাড়ী করে অফিস-বাসা যাতায়ত করলেও তার একটি লাল রঙের মটর-সাইকেল আছে ,যেমটি কেবল সিনামার নায়ক বা ভিলেনদের চালাতে দেখা যায় । অফিস সময়ের বাইরে তিনি সেটি করেই চলাফেরা করেন । কলোনীর সব বাচ্চা এবং কিশোর যুবকের স্বপ্নের মটর সাইকেল ঐটি। সবার যুবায়ের সাহেবের মটর-সাইকেলে চড়ার খুব শখ হলেও কেউ কখনও তাতে চড়ার সুযোগ বা সাহস পায়নি । কেন না কলোনীর অন্য আংকেলদের থেকে যুবায়ের সাহেবের ব্যক্তিত্ব এবং স্টাইল সম্পূর্ণ আলাদা ।বলা যায় উনার ফুটানী একটু বেশী -যেমনটা বাচ্চারা তাদের বাবা মা’দের বলতে শুনে । ইস্ত্রি করা ভাঁজ ভাঙ্গা প্যান্ট-শার্ট এবং ঝাঁঝালো পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে হাঁটেন এবং কড়া দামী সিগারেট সব সময় তার ঠোঁটে তারার মত মিটমিটিয়ে জ্বলে ।তার হাতঘড়ি বা চশমা’র কাঁচে অন্য দশজনের মত অফিসের কান্তির ছাপ থাকে না,সেখানে প্রখর বুদ্ধিমত্তার ঝিলিক দেখা যায়। তিনি যখন দাম্ভিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে মটর-সাইকেলে চলেন তখন পিছনে অনেকে ঈর্ষাকাতর ফোড়ন কাটে । সে সব মূল্যায়নবার্তা হয়ত যুবায়ের সাহেব শুনে না ,নয়ত পাত্তা দেয় না । কেন না যুবায়ের সাহেবকে কখনো কারো সাথে যেচে কথা বলতে দেখা যায়নি,বরং অন্যরা তার সাথে কথা বলতে আগ্রহী হয়ে থাকে । যুবায়ের সাহেবের স্ত্রী মাসুদা স্বামীর উল্টো,তিনি একটি স্কুলে বাংলার শিকিা। তাকে কেউ কখনো স্বামীর মটর-সাইকেলের পিছনে দেখেনি । ভীষন রকম ধার্মিক মহিলা, বোরখা আর হেজাব ছাড়া বের হন না ।স্কুল সময়ের বাইরে তার রয়েছে এক আজব শখ- কলোনীর বাচ্চাদের বাসায় ডেকে নিয়ে রুপকথার গল্প শুনান ।আমাদের রুপকথা গুলো হারিয়ে যাচ্ছে বলে তার ভীষন আপে । তিনি গল্পও বলেন চমৎকার ,সুয়োরাণী-দুয়োরাণী,তুলারাশির কন্যা,রাজকুমার-রাজকুমারী,পঙ্খীরাজ ঘোড়া,ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী আর রাস কত যে বর্ননা আর এত নিখুঁত করে বলেন যে বর্ননা আর কল্পনা একাকার করে তৈরী করেন গল্পের অমোঘ আকর্ষণ । নিপা মাসুদা আন্টির গল্পের ভীষন রকম অনুরাগী । যখন নিপা মাসুদা আন্টির কাছে গল্প শোনে তখন সে তাবৎ দুষ্টুমী ভুলে এক লী মেয়ে হয়ে যায়। ও ডাগর ডাগর চোখ জোড়া গোল করে মাসুদা আন্টির গল্প গিলে গোগ্রাসে। মাসুদা প্রায়ই নিপার চিবুক টিপে বলেন,“লী একটা মেয়ে।”
গল্পের মোহে নিপা মাসুদা আন্টির ফ্যাটে অন্যদের থেকে বেশী যায়। ওদের গল্পের সময় মাঝে মধ্যে যুবায়ের সাহেব বাসায় উপস্থিত থাকেন,কখনো কখনো তিনি দোকান থেকে নিপাকে দিয়ে সিগারেট কিনিয়ে আনায় আর আনায় চকলেট বা আইসক্রিম যা তাদের চার বছরের মেয়ে তিতলী আর নিপাকে ভাগ করে দেয় যুবায়ের সাহেব । নিপা যদিও আনন্দের সাথে দোকানে যায় কিন্তু মাসুদা আন্টি ওর দোকানে যাওয়া একদম পছন্দ করেন না। যুবায়ের সাহেব স্ত্রী’র বিরক্তি দেখে হাসতে হাসতে বলেন,“নিপার মা’কে বলো তোমার মত একটি কালো বোরখা মেয়েকে বানিয়ে দিতে।তা না হলে,তুমিই একটা বানিয়ে দিও।” নিজের রসিকতায় যুবায়ের সাহেব নিজেই হো হো করে হেসে উঠেন,সে হাসিতে নিপাও যোগ দেয়।এভাবে নিপার সাথে যুবায়ের সাহেবের একটি ভাল সম্পর্ক তৈরী হয়েছে, যে কারনে অন্যান্য বাচ্ছাদের মত যুবায়ের আংকেল ওর কাছে তেমন ভয়ের মানুষ নয়।
“আজকেও কি পেয়ারা চুরি করেছিস?”চলে যেতে যেতে হঠাৎ দাড়িয়ে যুবায়ের সাহেব জানতে চায়।
“শুধু পেয়ারা চুরি না,পেয়ারা ছুঁড়ে হাজী চৌধুরীর কপালও ফাটিয়ে দিয়েছে। হাজী চৌধুরী মা’র কাছে নালিশ করে গেছে,বাসায় গেলে মা ওকে খুব মারবে।”দিপা পেয়ারা চিবুতে চিবুতে বলে । হেসে চলে যায় যুবায়ের সাহেব। নিপার দুরন্তপনার কথা কলোনীর সবাই কম-বেশী জানে।
সন্ধ্যার হাওয়ায় সুরের কাঁপন তুলে চারিদিকে মাগরেবের আযান শোনা যায়।মুহূর্তে মাঠ জুড়ে খেলতে থাকা বাচ্চারদল খেলা ভেঙ্গে ঘরমুখী হয়ে যায়, অল্প সময়ের মধ্যে মাঠের সকল কোলাহল স্তিমিত হয়ে পড়ে।বিথী নিঃশব্দে উঠে চলে যায়।দিপা,বোনের হাত ধরে বাসায় ফেরার জন্য টানে, নিপার শরীর ভয়ে খিঁচিয়ে উঠে Ñমা আজ ভীষন মারবে ।অন্য অনেক দিনের অন্যায়ের মত আজকের অন্যায় নয়,আজ হাজী চৌধুরীর মাথা ফাটানোর মত একটি ভয়ানক কান্ড সে করেছে ! এই প্রথম নিজের কৃতকর্মের জন্য নিজেকে নিপা ধিক্কার দেয়। নিপাকে অনড় বসে থাকতে দেখে দিপা আবার বাসায় ফেরার তাগদা দিলে নিপা বলে, “তুই যা,একটু পর আমি আসছি। ততণে বাবা চলে এলে মা আর বেশী মারতে পারবে না।”
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে আসছে প্রায়,দেরী হলে মা ওকেও মারতে পারে এই ভয়ে দিপা আর দেরী করে না। বোনের দিকে করুন দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে দ্রুত বাসায় ফিরে যায়। দিপা চলে গেলে দিনের পরিচিত মাঠটা যখন ছোপ ছোপ আঁধারে ছেয়ে যায় নিপাও তখন গুটিগুটি পা করে নিজেদের বিল্ডিংয়ের দিকে এগোতে থাকে। নিজের সব দ্বিধা নিয়ে ও ফ্যাটের দরজায় এসে কান পাতে, দেরীতে ফেরার জন্য মা দিপাকে তুমুল বকাবকি করছে যেমন তেমনি নিপা ফিরলে যে ছাল উঠিয়ে ছাড়বে তাও বার বার বলছে। নিপার বুকের খাঁচার ভেতর কেমন কাঁপে, ও গুটিয়ে যায়,ও দ্রুত আবার বিল্ডিংয়ের বাইরে চলে আসে । বিল্ডিংয়ে ঢোকার সদর গেইটের পাশে ছায়ায় সাথে নিজের ছোট শরীরটা মিশিয়ে দাড়িয়ে থাকে বাবার ফেরার প্রতীায়। বাবার হাত ধরে বাসায় ফিরলে মা আর মারতে পারবে না।
সারা দিনের মুখরিত কলোনী এই সময়টাতে এসে কিছু সময়ের জন্য মৌন হয়ে যায়। আজও তেমনি মৌনতা চারপাশে,কোথাও কারোকে দেখা যায় না। এই নিরবতায় দাড়িয়ে নিপার কেমন ভয় ভয় লাগে। মা বলেছে,সন্ধ্যার এ সময়ে জ্বীনরা এক জ্য়গা থেকে অন্য জায়গায় আসা যাওয়া করে। মাগরেবের এই সময়ের বাতাস খারাপ,বদ্ জ্বীনদের দৃষ্টি যদি পছন্দ মত কারো উপর পড়ে তবে তার উপর আছর করে। তাই এসময় খোলা জায়গায় থাকতে নেই ।উৎসুক হয়ে ও বার বার রাস্তা দেখে বাবা এলো নাকি, আজ যেন বাবা অন্য দিনের চেয়ে ফিরতে দেরীই করছে।
সিঁড়ি ঘর থেকে ঘুটঘাট আওয়াজ শোনা গেলে নিপার কান সজাগ হয়ে উঠে,মা কি ? ওর দেরী দেখে খুঁজতে বেরিয়েছে ? অন্ধকার কোন থেকে আলগোছে মাথা বাড়িয়ে উঁকি দেয় নিপা,না যুবায়ের আংকেল । মটর-সাইকেল ঠেলে তিনি সিঁড়িঘর থেকে বেরিয়ে আসে, বাইরে এসে হেলমেট মাথায় পরে নেয়। তারপর মটর-সাইকেল স্টার্ট দেবার আগে কি মনে করে পিছনে তাকায়,তাকিয়ে নিপাকে জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে দাড়িয়ে পড়ে,হেলমেটে মুখ ঢেকে রেখে প্রশ্ন করে “ তুই এখানে ?বাসায় যাসনি ?”
নিপা কোন উত্তর দেয় না,পায়ের আংগুলে মাঠি উপড়ায়।
“ও বুঝেছি, আজ তো তোর পিটুনী খাওয়ার কথা ।সে ভয়ে বাসায় যাসনি।----মটর-সাইকেলে চড়বি ?” হঠাৎ কন্ঠ নরম করে যুবায়ের সাহেব জানতে চায়।
নিপা তবু কোন কথা বলে না।এখন মটর-সাইকেলে চড়ে আরো দেরী করে বাসায় ফিরলে মা নির্ঘাত ওকে আলু ভর্তা বানিয়ে তবে ছাড়বে। যুবায়ের আংকেলের মটর-সাইকেলে চড়ার লোভী প্রস্তাবেও তাই নিপা নিরব থাকে।
“ আমি দোকানে যাচ্ছি।চল্ আমার সাথে। অনেক চকলেট কিনে দেবো।তারপর ফিরে এসে মা’কে বলে দেবো যেন তোকে না মারে ।---চড়বি মটর-সাইকেলে ?” যুবায়ের সাহেব ভীষন রকম নরম গলায় নিপার সাথে কথা বলে। এক সাথে তিনটি আনন্দময় প্রস্তাব পেয়ে নিপা রাজী হয়ে যায়। মটর-সাইকেলে চড়া,চকলেট তারপর যুবায়ের আংকেল যখন মাকে ওকে মারতে না করবে তখন নিশ্চয় মা আর মারবে না। আনন্দিত নিপা ভীরু পায়ে যুবায়ের সাহেবের পিছনে মটর-সাইকেলে উঠে বসে। কাল বন্ধুদের বলার মত একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।
যুবায়ের সাহেব মটর-সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে গতি আনে তাতে, পেছন থেকে ছোট দু’হাতে নিপা তাকে জড়িয়ে ধরে। ও মনে মনে ভাবে আজকের দিনটা ততটা খারাপ নয় যতটা মনে হয়েছিল।কলোনীর সবাই যেখানে যুবায়ের সাহেবের মটর-সাইকেলের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে সেখানে নিপা কিনা তাতে আজ চড়ছে ! যুবায়ের আংকেলের সাথে ও যখন বাসায় ফিরবে তখন নিশ্চয় বাবাও ফিরে আসবে।বাবা ফিরলে মা কখনও নিপাকে মারতে পারবে না। খুব বেশী হলে কান মলা খাবে-এটা তো কোন ব্যাপারই না।
যুবায়ের সাহেব কলোনীর গেইটের দোকানে মটর-সাইকেল থামান না, এগিয়ে যান মেইন রোড় ধরে।এপথ সেপথ করে বেশ দূরে কিছু আলো ঝলমলে দোকানের কাছে তার মটর-সাইকেলের গতি শ্লথ করেন , মটর-সাইকেলে বসেই রংচঙে মোড়কের অনেক গুলো চকলেট চুইং গাম কিনে তা নিপার হাতের মুঠোয় গুঁজে দেয় যুবায়ের সাহেব ।
“ সব তোর। খুশী তো ?আর একটু মটর-সাইকেলে চড়বি নাকি ?”
সত্যি বলতে কি এখন আর নিপার মটর-সাইকেলে চড়ার ইচ্ছা নেই। বাসা ওকে ভীষনভাবে টানছে,আজ অনেক সময় ধরে সে বাসার বাইরে। তাছাড়া মটর-সাইকেলে করে বেড়ানো তো হলোই,চকলেটও পাওয়া হলো এখন মা’র পিটুনী থেকে বাঁচতে পারলেই নিপা খুব লী মেয়ে হয়ে যাবে। ওর এত ভাবনা যুবায়ের সাহেব হয়ত বুঝতে পারে না,তাই তিনি আবার বলেন,“চল্ তোকে আর একটু ঘুরিয়ে আনি।”
যুবায়ের সাহেবের মটর-সাইকেল প্রবল গতিতেছুটে যায়। নিপা মুঠো ভর্তি চকলেটর প্যাকেট নিয়ে যুবায়ের সাহেবের কোমর আঁকড়ে ধরে। ওর ভাবনা হাতের চকলেট গুলোকে ঘিরে চলতে থাকে,এত চকলেট দিপা দেখলে কি রকম হিংসা করবে ওকে। নিপা কিন্তু ভালো মেয়ের মত বোনের সাথে সমান ভাগ করে তবে খাবে।
হঠাৎ করে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে মটর-সাইকেল অন্ধকারে জড়ানো কোন একটি স্থানে দাড়িয়ে যায়,নিপার ছোট ভাবনাও সাথে সাথে থেমে যায়। ও অন্ধকারে তাকিয়ে চিনতে চেষ্টা করে কোথায় এসেছে ওরা,চিনতে পারে না ঘুটঘুটে আঁধারে ঢাকা জায়গাটি। যুবায়ের সাহেব স্টার্ট বন্ধ করে একটু সময় বসে থাকে সিটে । নিপা পেছন থেকে তার কোমর ছেড়ে দিয়ে নিজেকে যেন বা গুটিয়ে নেয়। চারপাশের আঁধারের তীব্রতা নিপাকে অবশ করে তুলে,সন্ধ্যার হারিয়ে যাওয়া ভয়টা ভয়ংকর হয়ে ওর বুকের খাঁচায় আবার ধপ্ধপ্ করে। শুকিয়ে উঠা গলায় নিপা করুণ কন্ঠে বলে,“আমি বাসায় যাব।মা’র কাছে যাব।”
মটর-সাইকেল থেকে নেমে দাড়ায় যুবায়ের সাহেব,“ যাবি তো মা’র কাছে। ভয় করছে নাকি তোর ?কিসের ভয়,আমি আছি না?”খসখসে চাপা কন্ঠে যুবায়ের সাহেব কথা বলে মটর-সাইকেল থেকে নিপাকে নামাতে চাইলে নিপা নামে না , জেদীভাবে বসে থাকে।
“ আহ্ নাম না।চল্ সামনে ,আমার একটু কাজ আছে ।”
“আংকেল আমার ভয় করছে।মা’র কাছে যাব আমি ।”
“কোন ভয় নেই।চল্ তো।”নিজেই দু’হাতে শূন্যে তুলে নিপাকে মটর-সাইকেল থেকে নামিয়ে নেয় যুবায়ের সাহেব ।কান ফাটানো নির্জনতা আর ঘন আঁধারে যুবায়ের সাহেবের কি কাজ থাকতে পারে তা নিপার মাথায় আসে না। যুবায়ের সাহেব নিপার হাত শক্ত করে চেপে ধরে আরো অন্ধকারের দিকে টানে। হিংস্র থাবার চাপে নিপার হাত থেকে চকলেটের প্যাকেট পড়ে যায়,তার জন্য নিপার কোন টান অনুভূত হয় না,এ মুহূর্তে ও যুবায়ের সাহেবের সাথে ছোট দু’টি হাত দিয়ে নিজেকে রার জন্য প্রতিরোধের চেষ্টা করতে থাকে। দু’জনের মাঝে মৃদু হাতাহাতি শুরু হয়,নিপা নিজেও বুঝতে পারে না কেন সে হঠাৎ করে যুবায়ের আংকেলকে ভয় পাচ্ছে ! কেনই বা আংকেলকে ওর পাতালপুরীর রাস মনে হচ্ছে বার বার। গা হিম করা ভয় ওকে গিলে ফেলে ,যখন যুবায়ের সাহেবের অন্য একটি হাত নিপার মুখে চাপা দেয়। নিজেকে মাসুদা আন্টির মুখে শোনা রুপকথার রাজকন্যা মনে হয় ,যে কিনা দৈত্যের হাতের মুঠোয় বন্দী। দৈত্য ওকে নিয়ে যাচ্ছে পাতালপুরীতে লোহার সিন্দুকে বন্দী করে রাখবে বলে। উদ্ধারকারী রাজকুমারের জন্য নিপা ওর ডাগর চোখ জোড়া আরো বড় করে এদিক-ওদিক তাকায়--কোথাও কেউ নেই,শুধু অন্ধকার আর বিকট নিরবতা !
সারা রাত নিপা ঘরে ফিরে আসে না। দিশাহারা মা-বাবা কলোনীর ফ্যাটে ফ্যাটে মেয়েকে খোঁজে,কেউ নিপার খোঁজ দিতে পারে না। শোকে ব্যাকুল মা সন্তানকে অতিরিক্ত শাসন করার জন্য নিজেকে অভিশাপ দেয়। স্তব্ধ নির্বাক হয়ে যায় নিপার বাবা,ভাবতে পারে না,এতটুকুন ছোট্ট মেয়েটি মা’র পিটুনীর ভয়ে কোথায় লুকাতে পারে !
পরের দিন দুপুরে থানা থেকে পুলিশ আসে নিপার বাবা মা’র কাছে , কিছু দূরে ন্যাড়া পাহাড়ের পাদদেশে নয় কি দশ বছরের এক মেয়ের ত-বিত ডেড বডি পাওয়া গেছে ,মেয়েটি কি এই বাবা মা’র সন্তান নাকি, তা শনাক্ত করতে যেতে হবে তাদের ।
মন্তব্য
...........................
Every Picture Tells a Story
আপনার গদ্যের হাত ভালো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
লেখাটা পড়ে মনটা কেমন করে উঠলো! আমাদের দেশে বালিকারা খুব অসহায়।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ভালো লাগলো।
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.
মন খারাপ হলো।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
নতুন মন্তব্য করুন