হ্যালুসিনেশন অথবা বাস্তব

শামীম রুনা এর ছবি
লিখেছেন শামীম রুনা [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০৮/০৬/২০০৯ - ২:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জহির সাহেবের বিশ্বস্ত ছায়া সঙ্গী রাজা। নামে সে রাজা হলেও কর্মে সে প্রভু-ভক্ত পা-চাটা ভৃত্য। জহির সাহেব ঢাকায় থাকেন কি তদন্তের কাজে ঢাকার বাইরে যান তার খেদমতের জন্য রাজা সদা প্রস্তুত থাকে। সে সাহেবের মেজাজ-মর্জি যেমন বুঝে তেমনি সাহেবের সুখ-সুবিধার বন্দোবস্ত যে কোনো স্থানে যে কোনো উপায়ে চট্ জলদি করে নিতেও পারে। তাই বলা যায় সে জহির সাহেবের সেক্রেটারি কাম ড্রাইভার কাম এটসেটরা।
এবারও জহির সাহেব যখন অফিসিয়াল তদন্তের কাজে ছোট এই মফস্বল শহরে এলেন তার সঙ্গে থাকলো যথারীতি রাজা। জহির সাহেবের সারা দিন অফিসিয়াল কাজে কাটলো আর রাজা ব্যস্ত ছিল সাহেবের রাত্রি যাপনের যাবতীয় ব্যবস্থা সুনিপুণ দক্ষতায় গুছিয়ে নিতে। সে জানে সাহেব কিছুটা প্রকৃতি ঘেঁষা মানুষ। নিস্তব্ধ রাত্রিতে সে সাহেবকে দেখেছে নিবিষ্ট মনে নিকষ অন্ধকারে স্থির তাকিয়ে থাকতে। কী যে দেখে সাহেব! অন্য সব বিষয়ের মতো এই বিষয়টি নিয়েও রাজা কখনো সাহেবের কাছে কিছু জানতে চায়নি। সে কেবল অনুগত ভৃত্যের মতো জহির সাহেবের সব সুখ-ভোগের ব্যবস্থা করে, লক্ষ্য রাখে নিজ কাজে যেন কোনো প্রকার ত্র“টি না থাকে। এর আগেও জহির সাহেব এই শহরে বার দুই এসেছিলেন,তখন তিনি শহর থেকে কিছু দূরে পাহাড়ের পাদদেশে নিরিবিলি যে বাংলোটি আছে সেটিতে থাকতে পছন্দ করেছিলেন,তাই এবারও রাজা সেখানে তার থাকবার আয়োজন করে।
সন্ধ্যায় অফিসিয়াল মিটিং শেষ হলে জহির সাহেব রাজার ড্রাইভ করা গাড়ি করে নির্জন বাংলোটিতে এসে পৌঁছান। তার অফিসের সবাই জানে জহির সাহেব আজ আর কারো সাথে দেখা করবেন না, নিজের মতো করে রাত কাটাবেন তিনি। আবার আগামী কাল অফিস আওয়ার থেকে শুরু হবে তার যাবতীয় অফিসিয়াল ওয়ার্ক। এই সময় তাকে কেউ ডিস্টার্ব করবে না, শুধু মাত্র তার সঠিক সেবা যতেœর জন্য রাজাকে যাবতীয় উপকরণ যোগান দিয়ে যাবে অফিসের অধনস্তরা। তার মতো উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তরা মফস্বল শহরে দু’এক দিনের জন্য এসে সম্রাটের ন্যায় দারুণ আয়েশি জীবন-যাপন করে যান।
নিজ রুমে ঢুকে বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে জলন্ত সিগারেট হাতে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন জহির সাহেব। বারান্দার অন্ধকার কোনে ছায়ার সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে ছিল রাজা,সাহেবকে দেখে হাল্কা কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দেয় সে। জহির সাহেব বেতের আর্ম চেয়ারে আরাম করে বসে সামনের টি টেবিলে পা উঠিয়ে দিয়ে ডাক দেন- রাজা।
- জ্বি স্যার । রাজা দ্রুত বারান্দা থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। ফিরে আসে মিনিট কয়েক পরে ট্রে হাতে, তাতে সাজানো জহির সাহেবের প্রিয় ড্রিংকস আর বরফ,বাদাম এবং গ্লাস। জহির সাহেব রাজার পেছন পেছন শাড়ি পরিহিতা এক নারী মূর্তিকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসতে দেখেন। রাজাকে ডিঙ্গিয়ে তার দৃষ্টি নারী মূর্তির গায়ে ল্যাপটে যায়, অন্ধকারে মুখচ্ছবি-বয়স কিছুই বোঝা যায় না। তবু তার কন্ঠ দিয়ে একটি আমুদে আওয়াজ বেরিয়ে আসে। তার মগজে অশ্লীল ভাবনা সাপের মতো প্যাঁচায়, চেহারা সুরতে কী আসে-যায়, এক রাতের মামলা! নারীটির নিশ্চয় দুটি স্তন আর একটি যোনি রয়েছে।
রাজা ট্রে নামিয়ে রাখে জহির সাহেবের সামনের টেবিলে তারপর দক্ষতার সাথে দু’টি পেগ বানিয়ে ট্রেতে সাজিয়ে রেখে দ্রুত এবং নিঃশব্দে চলে যায়। জহির সাহেব একটি গ্লাস হাতে নিয়ে প্রথম চুমুক দিয়ে তাকিয়ে দেখে নারীটি তখনো দাড়িয়ে, দু’হাতে সামনের চেয়ারটি ধরে আছে। নারী যেন নিজের উপস্থিতি নিয়ে বিভ্রান্ত—। তিনি তার পাশের চেয়ারটি ইংগিত করে বললেন - বসো।
নারীটি ঝপ্ করে, গাছ থেকে ঝরে পড়া ফলের মতো জহির সাহেবের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে।
জহির সাহেব আর কোনো কথা না বলে বাদাম চিবুতে চিবুতে গ্লাসে চুমুক দেয়। সিগারেটে টান দেয়। আঁধারে মোড়া বুনো প্রকৃতির দিকে স্থির তাকিয়ে কি যেন দেখে। প্রকৃতিতে থম্ ধরা স্তব্ধতা। নারী তখনো নিজের উপস্থিতি নিয়ে দ্বিধাম্বিত এবং নিঃশব্দ। জহির সাহেব অনেক সময় পরে তার বাঁ হাতটি নারীর উরুতে রাখেন, তার মনে হয় নারীটি বুঝি চমকে কেঁপে উঠে। সে যেন এহেন স্পর্শে অভ্যস্ত নয়। তিনি ঘাঁড় ঘুরিয়ে নারীর মুখ দেখবার চেষ্টা করেণ, অন্ধকারে ঠিক দেখা যায় না কিছু, একটি ঝাপসা অবয়ব ছাড়া। তিনি হাতের আঙ্গুলের চাপ বাড়ান নারীর শীর্ণ উরুতে মাংসের খোঁজে। হাল্কা কন্ঠে নারী কাঁতরে উঠে,সে কাতরতা জহির সাহেবের কানে আঘাত করে।
- ওইটি নাও, জহির সাহেব পায়ের ইশারায় দ্বিতীয় গ্লাসটি নারীকে দেখিয়ে দেয়। নারী নিঃশব্দে গ্লাস উঠিয়ে তা ঠোঁটে ধরে।
- কী নাম তোমার?
- জুলেখা। পাতলা কিশোরী কন্ঠে নারী কথা বলে।
- জুলেখা! রাজকন্যা জুলেখা! যার বাগানে পাখিরা গান করে না বলে ফুল ফুটে না। তোমার বাগানে কি পাখিরা গান করে? ফুল ফুটে? নারী ঠোঁট থেকে গ্লাস নামিয়ে তা দু’হাতে ধরে নিরুত্তর বসে থাকে।
- কি ফুটেছে ফুল? তরল কন্ঠে জহির সাহেব জানতে চায়, কই দেখি তো , তিনি উরু থেকে হাত উঠিয়ে নারীর বুকে রাখেন। কবুতরের উষ্ণতায় ভরা ছোট স্তন দুটি তিরতিরিয়ে কেঁপে উঠে। মুহূর্তে জহির সাহেবের পঞ্চাশ ছুঁই শরীরে পাহাড়ী ঝর্ণার ন্যায় উত্তেজনা বইতে শুরু করে। তিনি বলেন, তুমি রুমে যাও, আমি আসছি।
নারী উঠে বারান্দা থেকে চলে গেলেও জহির সাহেব নিজেকে খানিকটা চাঙ্গা করবার জন্য আরো দু'পেগ ড্রিংকস শেষ করে। এই সময় বারান্দায় আবার রাজার আবির্ভাব হয়, নিচু কন্ঠে সে জানায় - স্যার, ডিনার রেডী।
- গুড। জহির সাহেবের এই এক আশ্চর্য খেয়াল, সব সময় তিনি রাতের খাবার তার স্বল্প সময়ের সঙ্গিনীদের সাথে খেতে পছন্দ করেন। খেতে বসে তিনি এই সব নারীদের খাবারের প্রতি বুভুক্ষ টান দেখেন। তার ভেতরে এক ধরণের মায়ার জন্ম হয় তখন এই সব নারীদের জন্য। তিনি পেট পুরে ওদের খাবার খেতে দেন, ওরা রোজ খেতে পায় কি পায় না কে জানে! তার সহজ হিসাব, পেট শান্তি থাকলেই তো ওরা অন্যকে শান্তি দিতে পারবে।
জহির সাহেব ডাইনিং রুমে যেয়ে বসেন,কাচ্চি বিরিয়ানী,টিকিয়া সাথে আলু বোখরার চাটনী টেবিলে পরিপাটি করে সাজানো। খাবারের খোশবু জহির সাহেবের নাকে এসে লাগে। তিনি মনে মনে রাজার কর্ম তৎপরতার প্রশংসাও করেন, শহরে কি নগরে, বনে কি মরুভূমিতে সব জায়গাতে রাজা নিজ কাজে সমান দক্ষ। সেই সাথে জহির সাহেব মৃদু একটি দীর্ঘশ্বাসও ফেলেন, এ সকল খাবার তার জন্য নয়,তার খাবার ডাক্তারের সাজেশন মতো দু’টি রুটি আর ছোট মুরগীর ঝোল। খোশবুদার বিরিয়ানীর এক পাশে তার খাবারও সুন্দর করে সাজানো রয়েছে।
রাজার পেছন পেছন নারীটি এসে ডাইনিং টেবিলের সামনে শংকুচিত ভাবে দাঁড়ায়। প্রথম বারের মতো জহির সাহেব তার আজ রাতের সঙ্গিনীর মুখ দেখতে পান। একেবারে বাচ্চা একটি মেয়ে! ঘন শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ,সস্তা প্রসাধনে মুখ-মন্ডল সয়লাব। তেল দিয়ে পরিপাটি চুল আঁচড়ে টানটান বেনী করাতে ওর চেহারায় কৈশরের নমনীয় সারল্য ফুটে উঠেছে। বয়স কতো হবে? আঠারো কি উনিশ? একেবারে মাহ্জাবিনের বয়সী। নিজ মেয়ের সাথে এই সস্তা বাজারি নারীর তুলনা মনে হওয়াতে তিনি নিজের উপর খানিক বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে চিন্তাটি দূর করে দিলেন। রাজা কখন যেন নিঃশব্দে চলে গেছে,তাকে দেখা না গেলেও জহির সাহেব জানেন সে আশেপাশে আছে। তার কন্ঠের মৃদু ডাকে রাজা বাতাসের মতোই এসে সামনে দাঁড়াবে। নারীটি তখনো জড়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে, তিনি ইশারায় তাকে বসতে বলে যতœ করে প্লেটে বিরিয়ানী টিকিয়া তুলে দেয়, নরম কন্ঠে খেতে বলেন। তিনি নিজের জন্য বরাদ্ধ খাবার প্লেটে নিয়ে নারীটির সাথে টুকটাক কথা বলেন। নারীটি খেতে শুরু করে, একজন ক্ষুুধার্তের মতো সে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে গ্রাসের পর গ্রাস মুখে তুলে নেয় আর মাঝে মাঝে মাথা তুলে লজ্জিত চোখে জহির সাহেবের দিকে তাকায়। জহির সাহেবের খাওয়া হয়ে গেলে তিনি উঠে বারান্দায় চলে আসেন, নারীটি যেন তার অনুপস্থিতিতে স্বাচ্ছন্দে খেতে পারে।
বারান্দায় অন্ধকারে বসে তিনি আবারো পেগ বানিয়ে দেবার জন্য রাজাকে ডাকেন। গভীর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে শেষ পেগ আর একটা সিগারেট শেষে তলপেটে পানির চাপ অনুভব করলে তিনি উঠেন। নিজ রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখতে পান ঘরের সব ক’টি বাতি জ্বলছে, সেই ধাঁধাঁনো আলোর মাঝে নারীটি ডবল বেডের মধ্যখানে পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে এলোমেলো ভঙ্গিতে অকাতরে ঘুমোচ্ছে। পরনের লাল প্রিন্টের জর্জেট শাড়ীটি ভাঁজ করে সোফায় রাখা। জহির সাহেবের ঠোঁটে মৃদু হাসির ঢেউ খেলে যায়, দেখা যাচ্ছে যতটা আনাড়ী ভেবেছিলেন তিনি এই নারীকে ততটা সে নয়। এর আগে কখনো তিনি এমন ঘুমন্ত সঙ্গিনী পাননি। নিষ্পাপ একটি মুখ, নারীর ঘন শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ তাকে প্রবল ভাবে আকর্ষণ করে। গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে নারীর পাতলা শরীর বাঁশ পাতার মতো কেঁপে কেঁপে উঠা-নামা করছে। নারীর বুকের স্ফিতি, নিতম্বের উচ্চতা জহির সাহেবকে প্রলুব্ধ করে। তিনি কিছুটা দ্রুত গতিতে বাথরুমে ঢুকে পরেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসবার তাড়নায়।
বাথরুম থেকে জহির সাহেব ফুড়ফুড়ে মুডে বেরিয়ে আসেন, বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে গায়ের টিশার্ট খুলে দূরে চেয়ারের উপর ছুঁড়ে দেন। বিছানার কাছে এসে তিনি আর একবার ঘুমন্ত নারীর মুখের দিকে তাকান, তাকিয়ে জহির সাহেব চমকে উঠেন! বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। পাহাড়ের চূড়া হতে গভীর খাদে নিমজ্জিত হতে হতে তিনি দেখতে পান মাহ্জাবিনকে। তার কন্যা মাহ্জাবিন, বিছানার মাঝে পরিচিত ভঙ্গিতে শুয়ে রয়েছে - চিৎ হয়ে শুয়ে, মুখটা সামান্য এক পাশে কাঁত হয়ে আছে। ডান হাত কপালের উপর আড়াআড়ি রাখা, বাঁ হাত বাঁ কানের পাশে পরে আছে। ঘাড় অব্দি কাটা চুলে মুখের কিছু অংশ ঢেকে আছে, উপরের ঠোঁটের ডান কোনে ছোট তিলটিও জাজ্বল্যমান। তিনি অভিজ্ঞ লোক, মুহূর্তে নিজেকে গুছিয়ে নিতে চান, বুঝতে পারেন আজ কিছু বেশি পান করা হয়ে গেছে। বিভ্রম। তিনি চোখ বুজে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করেন, তারপর বিছানায় শায়িত নারীর দিকে আবার তাকান - একি! এ যে মাহ্জাবিন! অতি আদরের প্রিয় কন্যা মাহ্জাবিন! ও এখানে এলো কোথা থেকে? জহির সাহেব বিভ্রান্ত বোধ করেণ। বিচলিত দৃষ্টি মেলে ঘরের চারিদিকে দৃষ্টি বোলান। তিনি কোথায় আছেন তা আর একবার যাচাই করে নিতে চান - এটাতো বাংলোরই ঘর। ঐ তো সোফা, টেলিফোন সেট, বিবর্ণ কার্পেট, রাইটিং টেবিল-চেয়ার, চেয়ারের হাতলের উপর ফ্যানের হাওয়ায় দুলছে একটু আগে ছুঁড়ে দেওয়া তার টিশার্ট। দু’টি সিঙ্গেল খাট জোড়া দিয়ে তৈরী ডবল বেডের মাঝে কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে মাহ্জাবিন। মাহ্জাবিনের ক্যাপ্রি প্যান্টের নিচে পায়ের গোড়ালিতে গত জন্মদিনে জহির সাহেবের গিফ্ট করা সোনার নূপুরটি কি মৃদু শব্দে এক বার বেজে উঠলো? জহরি সাহেব বিছানার কাছ থেকে ছিটকে সরে আসেন, দু’হাতে মুখ ঢেকে সোফায় ধপ্ করে বসে পড়েন। তিনি প্রচন্ড রকম পানির তৃষ্ণা অনুভব করেন, কিন্তু পানি খাওয়ার কথা মনে হয় না। ঘটনা কি জহির সাহেব আর একবার ভাবতে চেষ্টা করেন, এই বাংলোতে মাহ্জাবিনের উপস্থিতি তাকে উদভ্রান্ত করে তোলে! এখানে তো কোনো ভাবে মাহ্জাবিনের আসার কথা নয়। যদি সে আসতোও তবে অবশ্যই তা তিনি জানতেন। নাকি তিনি এখন একটি দুঃস্বপ্ন দেখছেন? মুখ থেকে হাত সরিয়ে তিনি পাশে রাখেন, জর্জেটের লাল প্রিন্টের শাড়ীর উপর তার হাত পরে। তিনি মুখ ঘুরিয়ে নারীর খুলে রাখা শাড়ীর দিকে বিহ্বল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন কয়েক মুহূর্ত। এই তো শাড়ীটি, যা সন্ধ্যায় ঐ বেশ্যা মেয়েটি পরে এসেছিল। যে মেয়েটিকে বাথরুমে যাবার আগেও তিনি তার বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখেছিলেন। কি যেন নাম মেয়েটির------? জহির সাহেব নিজের স্মৃতির উপর কিছুটা আস্থা হারিয়ে ফেলেন, কেননা তিনি সন্ধ্যায় আগত নারীর নাম মনে করতে পারেন না। তিনি মনে-প্রানে ভবতে চেষ্টা করেন, এটি একটি দুঃস্বপ্ন, যে স্বপ্ন তিনি জেগে জেগে দেখছেন। কিছু সময় পরে রিল্যাক্স হলেই তিনি এই ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পাবেন। তিনি বিছানার দিকে না তাকিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন ,নিকষ কালো অন্ধকার। এই ব্যবস্থা জহির সাহেবেরই করা, তিনি অন্ধকারে বসে থাকতে পছন্দ করেন বলে কখনো বারান্দায় লাইট জ্বালানো হয় না। আজ তিনি বাতি জ্বালানোর জন্য দেয়ালে এদিক-সেদিক হাতড়ান, কোথাও সুইচ বোর্ড খুঁজে না পেয়ে মৃদু কন্ঠে রাজাকে ডাকেন, রাজাও অনুপস্থিত। স্যারকে রুমে ঢুকতে দেখে সে ভেবে নেয় আজকের মতো ওর ছুটি।
হঠাৎ জহির সাহেব একটি ভাবনায় উদ্বেলিত হয়ে উঠেন - তিনি কি ভয় পাচ্ছেন? সামান্য একটি চোখের ভুলের কারণে এতোটা উদ্বিগ্ন হওয়া কি তার মতো জাঁদরেল অফিসারকে মানায়? তিনি সিগারেট ধরান, বাইরের আঁধারের দিকে তাকিয়ে সিগারেটে ধীরে ধীরে টান দিতে দিতে হারানো মনোবলের সব টুকু নিজের ভেতরে সঞ্চয় করে নেন।
নতুন মনোবলে উদ্দীপিত জহির সাহেব রুমের দরজায় দাড়িয়ে বিছানার দিকে তাকান, নারীটি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। দৃষ্টিকটু লাল রঙের পেটিকোট হাঁটুর উপরে উঠে গেছে, ব্লাউজের লাল রঙটাও কেমন কটকটে, নিঃশ্বাসের তালে তালে ওর শীর্ণ শরীরটির উঠা-নামা দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে পান। কিছু আগে নিজের চোখের বিভ্রম বা দুঃস্বপ্নের জন্য তার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখা দেখা যায়। তিনি দীর্ঘ ভারী পা ফেলে বিছানার কাছে এগিয়ে আসেন, তীক্ষè দৃষ্টি মেলে তাকান নারীর মুখের দিকে। গ্রাম্য সরলতা জড়ানো এক কিশোরী, ব্যবসায় আসার আগে হয়ত ঠোঁটে দিয়েছিল লাল রঙের লিপ্স্টিক তা মুছে এখন সেখানে কালচে খয়েরী রঙ ফুটে উঠেছে। কাজল কয়লার কালির মতো চোখে ল্যাপ্টে আছে। গলায় সস্তা মালা -------। একি! নারীর মুখ-মন্ডল ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করে। নারীটি এখন টানটান চিৎ হয়ে শুয়ে, মাথা ডান দিকে কাঁত করে ফেরানো, সুর্মা দেওয়া চোখের পাতা হাল্কা ভাবে বুজে আছে, দু’ ঠোঁটের মাঝে সামান্য ফাঁক হয়ে আছে তাতে করে লালচে দাঁতের সারির কিছু অংশ দেখা যায়। নারীর পরনের লাল পেটিকোট ব্লাউজ কোথায়? সাদা কাফনে শরীর জড়িয়ে শায়িত জহির সাহেবের মৃতা মা! অসাড় হয়ে আসা বোধ নিয়ে তিনি ভাবতে চেষ্টা করেন, তের বছর আগে যে মা মারা গেছে সে কি করে এই জঙ্গলের বাংলোতে ফিরে আসে? তিনি আতংকে ঘামতে ঘামতে হাত দিয়ে চোখ-মুখ মোচেন। তিনি আর একবার ঘরের চারদিকে তাকান, এতো বাংলোরই সেই ঘরÑবিবর্ণ কার্পেট আর সাদা দেয়ালের ঘরের মাঝে ডবল বেডের বিছানার মাঝে শায়িত মায়ের কাফন পরা মৃতদেহ। অন্তিম যাত্রার জন্য মা তৈরী। কিন্তু মা'কে তো নিজ হাতে তিনি তের বছর আগে কবর দিয়েছেন! তিনি কি পাগল হয়ে যাচ্ছেন?
জহির সাহেব হাত বাড়িয়ে মায়ের মুখ স্পর্শ করতে যেয়েও টেনে সে হাত সরিয়ে নেন। তিনি জানেন তার হাত অস্পৃশ্য। এই হাতে তিনি মা’কে স্পর্শ করতে পারেন না। তার অনৈতিক হাতের ছোঁয়া মা বেঁচে থাকতেও কখনো গ্রহন করেননি। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে উঠে। পা জোড়া প্রবল ভাবে কাঁপতে আরম্ভ করে, নিজের ভর বইবার ক্ষমতা হারিয়ে তিনি মেঝেতে হাঁটু ভেঙ্গে পরে যান। বুকে ভয়ানক তৃষ্ণা নিয়ে তিনি মা'কে ডাকবার চেষ্টা করেন, জ্বীবটা আড়ষ্ট হয়ে নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় তার কন্ঠ দিয়ে একটি জান্তব গোঙ্গানোর আওয়াজ বেরিয়ে আসে। সে শব্দ কারো কানে পৌঁছায় না।


মন্তব্য

তানবীরা এর ছবি

বরাবরে মতো এটিও দারুন লেখা রুনা। এটা হ্যালুসিনেশন। আমার মনে হয় না এসব জহির সাহেবদের কোন চোখ - কান - নাক বা কোন পঞ্চ বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে। জন্তু হতে হতে এগুলো মানুষের মতো আকার নিয়ে জন্মায়। ডারউইন থাকলে জানা যেতো এগুলো কোন বিবর্তনের ফসল।

---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

স্নিগ্ধা এর ছবি

খুব সুন্দর প্রতিশ্রুতিশীল একটা গল্প! কিন্তু, শেষটা একটু ক্লিশে মতো হয়ে গেলো না? হাসি

কীর্তিনাশা এর ছবি

অসাধারণ গল্প পড়লাম একটা, অসাধারণ !!

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো লাগলো।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

সম্ভব হলে আরেকবার রিরাইট করে নেন।

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখা সত্যিই অসাধারন...
আমি মুগ্ধ....

(জয়িতা)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।