আমার ছোটবেলা কেটেছে ছিমছাম সুন্দর এক পাহাড়ী শহরে। যে শহরের মানুষ সবাই সবাইকে চিনতো জানতো। একে অপরের বিপদে হাত বাড়িয়ে দিত বন্ধুর মতো। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ সবার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অন্যরা ছিল আমন্ত্রিত। রাতে সবাই ঘুমাতো দরজার ছিটকিনী না লাগিয়ে। কিশোরী-তরুনী মেয়েরা ভয়হীন জড়তাহীন পায়ে রাস্তায় হাঁটতো- কেউ ওদের বিরক্ত করতো না। ওদের রিনরিনে কন্ঠের হাসি পাহাড়ী পথে ঝর্ণার ছুটে চলার মতোই বেজে উঠতো। আমি কোনো রূপকথার দেশের গল্প করছি না, আজো সে শহরটি আছে, তবে আগের মতো নেই।
বাবার সরকারী চাকুরীর কারণে এমন সুন্দর পার্বত্য শহরে তখন আমাদের বাস ছিল। আমি মাত্র তখন টলমল পা'কে স্থির করে মগজ নামক কম্পিউটারে পৃথিবীর আজব সব কারবার ডাউনলোড করতে শুরু করেছি আর আমার বড়ো তিন বোন সবাই কিশোরী কিংবা তরুনী। ওদের সময় তখন রঙিন। চারিদিকে শুধুই রঙের খেলা। ঐ যে একটা বয়স আছে না, যে বয়সে মা’র কাছে প্রচন্ড বকা খেয়েও পর মুহূর্তে দম-বন্ধ হাসিতে ফেটে পড়া তেমনি সময় আরকি। আমার বোনেরা ঐ শহরে যেয়ে স্থানীয় মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব তৈরী করে নিয়েছিল, ওদের বান্ধবীদের মধ্যে রাজকন্যা উজিরকন্যারাও ছিল। বোনদের ডেইলি রুটিন ওয়ার্ক ছিল বান্ধবীর দল নিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়ানো। কখনো নদীতে নৌকা বাইতো, কখনো বা ভর দুপুরে মগ চিতায় যেয়ে বরই কিংবা ঢেউয়া পেড়ে খেতো। কখনো লুসাই বাড়ির বাগান থেকে কেসোনাট বা পেয়ারা চুরি করতো, তাতে লুসাই বাড়ির মেয়েরাও সঙ্গী থাকতো। ওরা রাজকন্যা উজিরকন্যাদের নিয়ে সবাই মিলে বিকালে দল বেঁধে যাদি টিলার সিঁড়িতে বসে চুটিয়ে আড্ডা দিতো আর টিলার অন্য ধারে বসে তরুনের দল গিটার বাজিয়ে গান গাইতো ( সে দলেও দু’একজন রাজপুত্র কি কোটোয়ালপুত্র হয়তো ছিল )। বোনেরা আর ওদের বান্ধবীরা গান শুনে হোক অথবা নিজেদের গল্পের কারণে হোক, হেসে গড়াগড়ি যেতো। আমিও ওদের সাথে কিছু না বুঝে হ্যাবলার মতো হাসতাম। আমাকে ঠিক ভাবে ম্যানেজ না করলে মা’র কাছে ওদের সব কিছু ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে ওরা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতো, আমি ছিলাম ওদের ছায়া সঙ্গী।
আমার বোনেরা মা’র ব্যাপক বকাবকি উপেক্ষা করে গ্রীস্মের খর দুপুরে গোসল করতে যেতো ঝিরি কিংবা ঝর্ণায়। ঝিরির একটি ধারা লুসাই বাড়ির সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছিল, ওরা সেখানে যেতো গোসল সারতে। একা না বান্ধবীদের নিয়ে দল বেঁধে, পাঁচ-ছয় জনের একটি দল। ওদের হাতে থাকতো ছোট-মোট কোনো ফল বা আচার আর আমার হাতে থাকতো বোনদের কাপড়ের পুঁটলী। ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো আমি চলতাম ওদের পেছনে লাফাতে লাফাতে। যেদিন ঝিরিতে গোসলে যেতো সেদিন ওরা ঝিরির ধারে গর্ত করে নিজেদের সারা শরীর বালি দিয়ে ঢেকে শুধু মুখটা বের করে রেখে গল্প করতো। আমার কাজ ছিল ওরা ঐ অবস্থায় যে সব ফরমাস দিতো তা তামিল করা। কখনো আমি যদি বালি দিয়ে আমাকে ঢেকে দেবার কথা বলতাম, ওরা আমাকে জ্যান্ত কবর হবার ভয় দেখাতো। বড়ো হয়ে পরে এই ভাবে বালিতে শরীর ঢেকে রাখতে বিভিন্ন ইংলিশ মুভিতে দেখেছি।
ঝর্ণাও ছিল লুসাইদের নিজস্ব, ওদের বাড়ির লাগোয়া যে পাহাড় ছিল সেটির গা বেয়ে গড়িয়ে পড়তো স্বচ্ছ পানির ধারা। পরে জেনেছিলাম এটাই মিনারেল ওয়াটার, জেনে তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম, কি বোকাই না ছিলাম! যদিও তখন সে শহরে মানুষের আধিক্য ছিল না তারপরও নিজস্ব হওয়াতে বাইরের কেউ সে ঝর্ণায় যেতো না। আমাদের বাড়ি থেকে লুসাই বাড়ি ছিল অনেক পথ দূরে, তারপরও বোনেরা ঝর্ণায় গোসল করবার জন্য বান্ধবীদের সাথে রোদে হেঁটে হেঁটে বহু দূর পাড়ি দিতো । অনেক দূর থেকে ঝর্ণার ছুটে চলার ঝিরিঝিরি শব্দ শোনা যেতো। “ চপল পা’য় কেবল ধা’য়,কেবল গায় পরীর গান।” ঝর্ণার আশপাশের বাতাসটাও হতো হিম-হিম ঠান্ডা। পাহাড়ের উঁচু থেকে স্বচ্ছ পানির ধারা নেমে এসে স্লেট মাটির গামলার মতো বিশাল এক কূপে জমা হতো। বোনেরা কূপের ধারে স্লেট মাটিতে বসে প্রথমে হাতে করে আনা খাবার শেষ করতো, আমিও ভাগ পেতাম তা থেকে। তারপর চলত চিংড়ী বা কাঁকড়া খোঁজার পালা। ঝর্ণার পানিতে যে পাথরগুলো থাকতো তা সরালে পাওয়া যেতো চিংড়ী বা কাঁকড়া। দক্ষতার সাথে খালি হাতে সে সব লাল লাল চিংড়ী বা কাঁকড়া ওরা ধরে নিতো। আমি পারতাম না, শুধু ওদের পেছন পেছন দৌড়াতাম, চোখ বড়ো বড়ো করে দেখতাম বোনদের কীর্তি-কলাপ। যেদিন ওরা বেশি মাছ পেতো তা বাড়ি এনে কলা পাতায় মুড়িয়ে চুলার কয়লার আগুনে পুঁড়িয়ে তৈরী হতো মজাদার এক ডিস! আজ লিখতে বসেও যেন সে ডিসের খোশবু পাচ্ছি! কাঁকড়া পেলে তা দিয়ে দিতো ওদের উপজাতি বান্ধবীদের। তখন অবশ্য ক্র্যাব টেইস্ট-এর সাথে আমাদের পরিচয় ছিল না। মাছ ধরা শেষ হলে বোনেরা গোসলের তোড়জোড় করতো। গল্প করতে করতে ওরা সবাই মিলে ছোট আমাকে কাঁসার থালার মতো আচ্ছাসে ঘসে-মেজে ঝাঁ চকচকে করে গোসল করিয়ে দিতো। তারপর নিজেরা গোসল করতো, ওদের তখনকার গোসলের দৃশ্য ভেবে আমার এখন বাংলা একটি লোকগীতি কানে গুনগুন করে বাজছে শুধু। কোনটা? ... থাক।
কয়েকদিন আগের ঘটনা, আমরা সব বোনরা বড়োপা’র বাসায় আড্ডায় মেতে আছি, কথা প্রসঙ্গে ঝর্ণায় গোসলের বিষয় উঠে এলে এক বোন উদাস কন্ঠে বলে, “ আহ্! সেই সব দিন! ”
মন্তব্য
কল্পরাজ্যের যে চিন্তা আমরা অনেকেই করি, সেখান থেকে আপনার আগমন! পুরো লেখাতেই নস্টালজিয়ার ছাপ সুস্পষ্ট। সময় অনেক কিছুই কেড়ে নেয়!
সময় অনেক কিছু কেড়ে নিলেও স্মৃতিটা কেড়ে নিতে পারে না।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)
চমৎকার লাগল স্মৃতিচারণ।
----------------------------------------
শুধু শরীরে জেগে থাকে শরীরঘর
মধ্যবর্তী চরকায় খেয়ালী রোদের হাড়
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
খোমাখাতা
ধন্যবাদ।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)
আপনি খুব ভাগ্যবান - দিগন্তে যেখানে পাহাড়ের ঘুম ঘুম নীল চূড়া দেখা যায় সেরকম শহরে বেড়ে ওঠা। সমরেশের উপন্যাস পড়ে আর অঞ্জনের গান শুনে অনেক ইচ্ছে হত পাহাড়ী এলাকায় বেড়ে ওঠার। আপনি সেই ইচ্ছেটা আবার মনে করিয়ে দিলেন।
লেখা ভালো লেগেছে।
" গর্ভধারিনী" পড়ে আমিও এক সময় ভেবেছিলাম, ঐ বিশাল পাহাড়ের চূড়ায় চড়ে আমিও একদিন জয়িতার মতো অজানায় চলে যাব। যাওয়া আর হলো কোথায়? কংক্রিটের শহরে ঘুরে-ফিরে এখন বসবাস।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)
প্রথমে মনে হচ্ছিল কোন ধর্ম বইয়ের "বেহেশত" চ্যাপ্টার থেকে কপি মারছেন! এখন মনে হচ্ছে, আহারে ! আহারে... !!
___________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
সত্যিই, ছিল এক শহর! নিঝুম রাতে সে শহরের দীর্ঘশ্বাসে এখন মন আনচান করে।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)
ভালো লাগলো লেখাটা। জ্যন্ত কবর
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
লেখা ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)
আপনার স্বপ্নের মতো শহরের স্মৃতিচারণ খুব ভাল লাগল।
ধন্যবাদ।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)
আপনি ভাগ্যবান...
--------------------------------------------------
একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী...
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
সত্যি কি?????????????
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)
আহারে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
কিরে...ভাই! আমার লেখার জন্য একটা মাত্র শব্দ!
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)
এরপর যে বিষণ্ন হয়ে গেলাম...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার "আহা! সেই সব দিন" আবার কি? হা-হা-হা---
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)
চমৎকার লাগলো। লীল মজুমদারের "পাকদন্ডী" মনে করিয়ে দিলেন। সেও এক পাহাড়ী দেশের ছোটোবেলা, সরল বনের হাওয়া, ঝর্ণা, আকাশে রুপালী পর্বতশিখর!
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ধন্যবাদ। "পাকদন্ডী" পড়া হয়নি। পড়ার ইচ্ছা জাগলো।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)
হুম সেই সব দিন
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
সত্যি সেই সব দিন!
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)
মনে হলো রুপকথা পড়ছি
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
নতুন মন্তব্য করুন