লিলুয়া বাতাসে লিলুয়া মন

শামীম রুনা এর ছবি
লিখেছেন শামীম রুনা [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ১৩/১১/২০০৯ - ৯:০৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লিলুয়া বাতাস' কারে বলে? যে বাতাস মনকে উদাসী করে তোলে? মনকে বিবাগি করে তোলে? গৃহ-ছাড়া হতে উস্কানি দেয়?
তাহলে বলতে হয়, শেষ হেমন্তের বিকালের মরা রোদের আলোয় এই বাতাস আমাকে বিবাগি-উদাসী আর বিষন্ন করে তুলেছে। আমার মন চাইছে গৃহ-ছাড়া হয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। কোনো এক নির্জন দ্বীপ নয়তবা কোনো এক অরণ্য যেখানে ঝর্ণার ধারে বসে জঙ্গলের পাতায় পাতায় সূর্যের আলোর বিলীন হওয়া দেখবো কিংবা আমলকীর বনে ঝরা পাতায় শুয়ে গাছদের গোপন কথায় আঁড়ি পাতবো। সবুজ ঘাসে চিৎ হয়ে শুয়ে উপরের নীল আকাশ দেখবো। সাদা মেঘ দেখবো। সেখানে আমার মতো আমি বাঁচবো। কাঁদবো। হাসবো। কেউ আমাকে বলবে না, তুমি কে? এখানে কী করছো?
কার্তিকের বিকালে আমি মাঝে মাঝে কেমন উতলা হয়ে পড়ি। হয়ত বা এটি আমার জন্ম মাস বলে । কোনো এক কার্তিকের হিমহিম ভোর রাতে আমি জন্মে তীব্র কন্ঠে চিৎকার করে জানান দিয়েছিলাম আমার আগমন। পরিবারে পঞ্চম কন্যা হয়ে আমার আগমন, আমার আগমনে পরিবারের সবার খুব বেশি আনন্দীত হবার কথা নয়। তারপরও আমি নিজেই হয়ত জন্মে খুশি হয়েছিলাম বলে সল্লাসে নিজের আগমন বার্তা জানিয়েছিলাম সবাইকে।
কার্তিকের বিকালের এক টুকরো রোদ, এক চিলতে আকাশ আমাকে এলোমেলো করে দেয়। বিকালের দিকে তাকালে আমি দেখি মন কেমন-করা ম্রিয়মান আলোর খেলা। হাওয়ার শিরশির স্পর্শ আমার ত্বকে আদুল এক অনুভূতি জাগায়। মৃদু হাওয়ার তোড়ে গাছের পাতাগুলো আশীর্বাদের মতো মাটিতে ঝরে পড়ে । চারিদিকে শীতের আগমনি-গান। আমি মনে মনে চলে যাই , বহু আগের দেখা সেই আমলকীর বনে । বিশাল বিশাল আমলকী গাছ হাওয়ায় দুলতো আর পাতায় পাতায় ঘর্ষণে ঝিরিঝিরি শব্দ উঠতো। সেখানে পাতাগুলো ঝরে পড়তো চলার পথে। ঝরা পাতার রুপ দেখার চেয়ে বেশি আমি ব্যস্ত থাকতাম গাছের নিচের আমলকী কুড়ানোতে। এখন অনুশোচনা হয়, কেনো তখন আরো বেশি করে দেখিনি পাতা ঝরার দিন, প্রকৃতির সেই রূপ?
বহু বছর আগে, কোনো এক কার্তিক মাসে ভ্রমনে গিয়েছিলাম মনপুরা-চর ফয়েজুদ্দিন দ্বীপে । এমনি এক মায়াময় আলোর বিকালে যখন দ্বীপে যেয়ে আমরা নামি, দ্বীপের নীল-সবুজ সৌন্দর্যে আমি অপলক তাকিয়ে ছিলাম। দেখেছিলাম,দূরদিগন্তে নীল আকাশ নুয়ে এসে মিশে গেছে মেঘনার বুকে। নদীর ঢেউগুলো অলসভাবে এসে ছুঁয়ে যাচ্ছিল দ্বীপের গাছ-জমির ফসল। হাওয়ার বয়ে যাবার শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই, নিরবতা খুব বেশি কানে লেগেছিল সেদিন। আমি হাঁটতে হাঁটতে অন্যদের থেকে কিছুটা তফাতে চলে গিয়েছিলাম, একা একা। এ রকম নির্জনতায় মানুষ একা থাকতে চায় হয়ত; নিজের ভেতর নিজে বুঁদ হয়ে যায়। গিয়েছিলাম একবার, এই বিকালে সেই বিকাল ফিরে পেতে বুকের ভেতর এমন আকুল-বিকুল করে কেনো? হাঁটতে হাঁটতে ঠাঠা নিরবতাকে আর একবার অনুভব করতে চাই।
কার্তিকের মন-উদাস করা বিকালে আমার গৃহ ছাড়া হতে ইচ্ছে করে। কী করে গৃহ ছাড়ি, পায়ে যে শৃঙ্খল। এই শৃঙ্খল আমি নিজের হাতে পড়েছি। কখনো-সখনো যদি টানাটানিতে সামান্য আলগা হয়ে যায় শৃঙ্খল, আমি তা সাথে সাথে চেপে ঠিকঠাক পায়ে পরে নেই আবার। সভ্যতা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, শৃঙ্খল আবদ্ধ হয়ে থাকতেও শিখিয়েছে। যদিও আমার মন কাঁদে আমলকীর বনের জন্য- আমি যেতে পারি না। আমার ইচ্ছে করে তেপান্তরের মাঠে হঁটি হাঁটি কেবলই হাঁটি- আমি হাঁটতে পারি না। ইচ্ছে করে এমন বিকালে ঝর্ণার পানিতে পা ডুবিয়ে লাল কাঁকড়া আর চিংড়ীদের দেখবো, আর একবার নির্জন দ্বীপে দাঁড়িয়ে মেঘনার হাওয়ায় বুক ভরে নেবো- হায়! সে সব যেন কোন সুদূর অতীতের ধ্বংশ প্রাপ্ত নগরীর স্মৃতির মতো আমি বহন করছি। ঢুকে পড়েছি জীবনের আজব গোলকধাঁধায়। পেছনে ফেরার কোনো পথ জানা নেই।


মন্তব্য

শুভপ্রসাদ এর ছবি

আপনার লেখাটি পড়ে রবীন্দ্রনাথের একটি গান বেজে উঠল ভেতরে।

আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী
............................................
ওগো সুদূর বিপুল সুদূর,
তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি
কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার সে কথা যে যাই পাশরি

শামীম রুনা এর ছবি

সুন্দর একটি গানের কথা মনে করিয়ে দিলেন।
ধন্যবাদ।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

মুস্তাফিজ এর ছবি

পথ বের করতে চাইলেই পারা যায়। দুদিন, তিনদিন না হোক অন্তত একদিন বা একবেলার জন্য হলেও সময় করে নিন। অবসাদ দূর করতে এর বিকল্প নেই।
.........................................
I think what I think because that's how I am. You think what you think because that's how you are.

...........................
Every Picture Tells a Story

শামীম রুনা এর ছবি

আপনার মতো ক্যামেরা হাতে যদি ঘুরতে পারতাম পথ থেকে পথে,সুন্দরবন থেকে বান্দরবানে........
লেখা পড়বার জন্য ধন্যবাদ।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

সুমন সুপান্থ এর ছবি

লিলুয়া বাতাস' কারে বলে? যে বাতাস মনকে উদাসী করে তোলে? মনকে বিবাগি করে তোলে? গৃহ-ছাড়া হতে উস্কানি দেয়?
___ জ্বি, সেটাকেই বলে ।

হুম , লেখা খুব ভালো লাগলো ।

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

শামীম রুনা এর ছবি

ধন্যবাদ।
লিলুয়া বাতাসের লেখা---ভালো লাগারই কথা।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

তানবীরা এর ছবি

শৃঙ্খল আবদ্ধ হয়ে থাকতেও শিখিয়েছে। যদিও আমার মন কাঁদে আমলকীর বনের জন্য- আমি যেতে পারি না। আমার ইচ্ছে করে তেপান্তরের মাঠে হঁটি হাঁটি কেবলই হাঁটি- আমি হাঁটতে পারি না। ইচ্ছে করে এমন বিকালে ঝর্ণার পানিতে পা ডুবিয়ে লাল কাঁকড়া আর চিংড়ীদের দেখবো, আর একবার নির্জন দ্বীপে দাঁড়িয়ে মেঘনার হাওয়ায় বুক ভরে নেবো- হায়!

খুব নিজের মনে হলো একথাগুলোকে

**************************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

শামীম রুনা এর ছবি

কথাগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আমাদের সবারই মনের কথা তাই না?
অনেকদিন পর আমার লেখায় আপনাকে পেলাম....

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

অতিথি লেখক এর ছবি

এই প্রাত্যহিক জীবনে লিলূয়া বাতাস ও খুব কিপটে হয়ে গেছে। ধরা দিতে চায় না।

স্বপ্নদ্রোহ

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

চার দেয়ালের জীবনে লিলুয়া বাতাস কোথায়? আমাদের জীবনে প্রতিদিনই আরো বহু অদৃশ্য দেয়ালের উচ্চতা বাড়ে।
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।