সাধারণ দর্শক যারা চলচ্চিত্র দেখতে ভালোবাসেন তারা কতটা চলচ্চিত্র বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে একটি সিনেমা দেখা শুরু করেন তা বলা কঠিন। আমার ধারণা, যারা সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন তারা অন্তর্গত বোধ থেকেই সিনেমা দেখেন এবং এক একজন দর্শক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে সিনেমা প্রেমী হয়ে ওঠেন। সাধারণ দর্শকদের জন্য বোদ্ধা শব্দটি ব্যবহার হয়ত ঠিক নয় তাই অন্য কোনো সমর্থক শব্দ না পাওয়াতে সিনেমাপ্রেমী বললাম।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিভিন্ন ধরণের সিনেমা দেখতে পছন্দ করি, সেসব সিনেমার সবগুলোই যে জ্ঞান লাভ বা মনে কোনো দাগ কাটে তা নয়, ভালো একটি সিনেমা দেখে আমার মনে বিভিন্ন ধরণের মানসিক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। একটি ভালো সিনেমা শুধু বিনোদন দেয় না বরং বিনোদনের পাশাপাশি একটি ভালো বই পড়ার মতো করে সমাজের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব মহাবিশ্বসহ তাবৎ বিষয়ে ভাবনার বীজ আমাদের মগজে গেঁথে দেয়। একটি সিনেমা দেখলাম, উঠে গেলাম তারপর তার বিষয়বস্তু আমি বেমালুম ভুলে গেলাম; আমার মননে বা মগজে সে সিনেমা কোনো কম্পন বা কোনো রেখাপাত সৃষ্টি করলো না তেমন সিনেমাকে আমি সিনেমা বলবো না। একটি সিনেমা দেখার পর সেটার বিষয়বস্তুর ভালো-মন্দ-প্রেম-ক্রোধ-বিদ্রোহ-উল্লাস মগজে ভাবনার অনুরণন তুলবে, বিষয়টি নিয়ে অনুভুতির ভেতর-বাইরে পক্ষে-বিপক্ষের ভাবনা তৈরী হবে; কিছু সময়ের জন্য হলেও আচ্ছন্নতা আমাদের গ্রাস করবে- তবেই না সেটি হয়ে উঠবে একটি সিনেমা। অনেক সিনেমা আমোদিত করে, অনেক সিনেমা অনুভূতিকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে ফেলে, অনেক সিনেমা রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত করে, অনেক সিনেমা দেখতে বসে আতংকে হৃৎপি- ধড়াস ধড়াস করে লাফায় প্রবল টেনসনে; এই বিভিন্ন ধরণের প্রবল মানসিক অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারা এবং ভাবতে বাধ্য করা একটি ভালো সিনেমার মান হতে পারে বলে আমার ধারনা। সাম্প্রতিক দেখা কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ধরণের সিনেমার অনুভুতি নিয়ে আমার এই লেখা হলেও প্রতিটি সিনেমার একটি জায়গায় রয়েছে মিল, তা হলো চরিত্রদের অন্তস্থ ভালোবাসা ও নিঃসঙ্গতা।
এই সব সিনেমা দর্শককে ভীষন রকম একাকিত্বের অনুভূতি দেয়। এসব সিনামা মূলত বুঝতে দেয়; মানুষ একা (!), একই সঙ্গে তার জীবন ভালোবাসায় আক্রান্ত এবং তার চলার পথ নিঃসঙ্গ। একা আর নিঃসঙ্গ মানুষের দু-একটি সিনেমা নিয়ে আমার এই পর্যালোচনা:
ব্লু জেসমিন : আমি যখন ব্লৃ জেসমিন ছবিটি দেখি তখন সিনেমাটি কয়েক ক্যাটাগরিতে অস্কার জিতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। অবশ্য সব সিনেম াপ্রেমিরা আশা করেন দক্ষ পরিচালক উডি এ্যালানের কাছ থেকে একটি কমেডি ধাঁচের সিনেমা। দর্শক চাহিদা অনুযায়ী তিনি কমেডি ঘরানার সিনেমা দিয়ে বাজিমাত করেন যেমন ঠিক তেমনি তিনি সিরিয়াস ধাঁচের একটি বিষয় বস্তুর মধ্যে জীবনের কিছু কমেডি দর্শকদের জন্য রেখে দেন, এখানেই তাঁর ছবি পরিচালনার কারিশমা! ব্লু জেসমিন তেমনি একটি ছবি। উডি এ্যালেন বরাবর সেসব ছবি তৈরী করেন যা সব সময়ই দর্শকের মনে দাগ রেখে যায় এবং তাঁর চরিত্র সৃষ্টির কৌশল অসাধারণ। অবশ্য তাঁর সৃষ্ট সেসব চরিত্র ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব যাদের ওপর তিনি ন্যস্ত করেন সেসব অভিনেতা-অভিনেত্রীর নির্বাচনও নিঃসন্দেহে পারফেক্ট হয় বলে উডি এ্যালেনের সিনেমার মান প্রশ্নাতীত। উডি এ্যালেনের ব্লু জেসমিন ছবির কাহিনি বা পরিচালনা এক কথায় নিখুঁত এবং উপভোগ্য। উডি এ্যালেনের এই সিনেমার বিষয়বস্তু জেসমিন নামের এমন এক নারীকে নিয়ে যে সদ্য তার ধনকুবের স্বামী হ্যালকে ছেড়ে এসেছে। বিবাহিত জীবনে জেসমিন তার স্বামীর সঙ্গে নিউ ইয়র্কের অভিভজাত এলাকায় বাস করত এবং তাদের ছিল খুবই জাঁকজমকপূর্ণ আর বিলাসী জীবন যাপন। প্রতিনিয়ত পার্টি বা ভ্রমন বা অভিজাত সব খেলাধুলায় সময় কাটানো জেসমিনের জীবনের রুটিন ছিল। জেসমিন যখন জানতে পারলো ওর স্বামী আর এক নারীর সঙ্গে গোপনে ডেট করছে তখন সে তা মেনে নিতে পারে না এবং অপমানিত ও ক্ষুব্ধ জেসমিন তাকে প্রতারিত করবার অপরাধে স্বামীকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে কপর্দক শূন্য অবস্থায় নিম্নবিত্ত ছোট বোন জিনজারের কাছে এসে থাকতে শুরু করে। শুরু হয় জেসমিনের নতুন জীবন। এই জীবনে জেসমিনের ক্রাইসিস, স্ট্রাগল, মানসিক নিঃসঙ্গতা আর অস্থিরতা এবং আবার নতুন করে শুরু করতে যাওয়া জীবন ব্লু জেসমিন সিনেমার বিষয়বস্তু। আর ফিল্ম ক্যারিয়ারে বিরতির পর পুনরায় অভিনয়ে ফিরে এসে কেট ব্ল্যানচেট অসাধারণ নিপুণতায় জেসমিন চরিত্রিটি ফুটিয়ে তুলেছেন। অভিনয় করার সময় আদপেই বিষণœ জেসমিন হয়ে ওঠেছিলেন কেট ব্ল্যানচেট। কেট ব্ল্যানচেট জেসমিন চরিত্রে অভিনয় করবার সময় কোনো রকম তাড়াহুড়া বা কাটছাট বা অতিরঞ্জিত অভিনয় না করে তার পরিমিত অভিনয় দিয়ে দর্শকদের এমন একটি ভাবনায় নিয়ে ফেলেছেন যেন দর্শক কারো জানালায় উঁকি দিয়ে তার ব্যক্তিগত জীবন দেখে নিচ্ছি। কেটের অভিনয় দেখে সহজেই বুঝা যায় উডি এ্যালেন চরিত্রের চাহিদার দাবীকে প্রাধান্য দিয়ে অভিনেতা অভিনেত্রী নির্বাচনে কতটুকু পটু।
ব্লু জেসমিন ছবির কাহিনি উপভোগ্য এবং ঠাসা বুননের পান্ডুলিপি। তদুপরি ব্লু জেসমিন দেখতে বসে বারবার মনে হয়েছে, এ যেন আমার পাশের গলির কোনো নারীর গল্প, আমার দেশের নারীর গল্প; কিংবা আমারই গল্প; শুধু ভাষা আর সামাজিকতা বা লৌকিকতা ছাড়া। হয়ত সারা বিশ্বে, সে পূর্ব কী পশ্চিম হোক; উত্তর কী দক্ষিণ হোক নারীর একই রূপ; একই অবস্থান। নারী স্বাধীনতার যুগে আমেরিকার মতো ব্যক্তিস্বাধীন দেশে জেসমিনের প্রতি স্বামীর প্রতারণা বা বিত্তবান স্বামীর বিলাস-বৈভব ছেড়ে এসে অর্থাভাবে পড়া বা একটি কাজ জোটানো এবং কর্মস্থানে নারীর অনিরাপত্তা বা পুনুরায় নতুন সম্পর্কের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা এসব যেন আমাদের দেশের চিত্র। জিনজার যেমন সহজে জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সুখী হয়ে উঠতে পারে জেসমিন তা পারেনা, বিলাসী জীবনে অবস্থ্য জেসমিন সাধারণ জীবনের রুঢ় অনেক বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনা। শেষ পর্যন্ত তাই আমরা দেখতে পাই জেসমিন নিঃসঙ্গ, কথা বলার কেউ নেই পাশে; সে নিঃসঙ্গ বেঞ্চে বসে নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলে চলেছে।
ব্লু জেসমিন একা নারীর গল্প, একাকিত্বের গল্প। সর্বপরি ভালোবাসার গল্প।
ব্লু (দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার): একটি হাই স্কুলের ক্যাম্পাসে ছেলেমেয়েদের কথা-হাসি-আর বিপরীত লিঙ্গের প্রতি বয়ঃসন্ধিকালীন আকর্ষণের চোরা চোখের চাউনি বা কোনো মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া এবং পনেরো বছরের কিশোরী আদেলের হবু বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে বন্ধুদের মাঝে চাপা আলাপ, আদেলের সম্মতিসূচক হাসি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ব্লু ছবিটি আরম্ভ হতে দেখে দর্শক। ছবির শুরুতে আদেলের যে হাসি দর্শক দেখে সে হাসি ছবির শেষে এসে দর্শক অবশ্য আর দেখতে পায় না। আদেল হাই স্কুল পড়–য়া সদ্য তরুণী। তারুণ্যের ধর্ম অনুযায়ী আদেল তার এক সুদর্শন ক্লাশমেটের প্রেমে পড়ে এবং তাদের প্রথম শারিরীক সম্পর্ক স্থাপিত হবার আগেই আদেলের কল্পনায় আসে তার চেয়ে বয়সে বড়ো আর রহস্যময়ী নীল চুলের আত্মবিশ্বাসী তরুণী এমা। এমা একজন পুরনো চিত্রশিল্পী শিক্ষার্থী, রহস্যময়ী নীল চুলের নারী; যাকে আদেল রাস্তায় দেখেছিল। প্রথম দেখায় আদেল এমার প্রতি এতটা আকর্ষণ বোধ করেছিল যে সে তার স্বপ্নে এমাকে দেখে তার বিছানায়, এমা তাকে অসম্ভব রকম শারীরিক প্রশান্তিতে আচ্ছন্ন করে তুলেছিল। ফলশ্রুতিতে বয়ফ্রে-ের সঙ্গে আদেলের শারিরীক সম্পর্ক হলেও মানসিক সম্পর্ক জমে ওঠে না এবং খুব তাড়াতাড়ি ব্রেকআপ হয়ে যায় তাদের। কাহিনীর এই পর্যায়ে এসে আদেল নিজের সুখ খুঁজতে চেষ্টা করে বিভিন্ন ভাবে এবং শীঘ্রই তার জীবনে এমার প্রবেশ ঘটে এবং সে দ্রুতই আদেলের জীবনে প্রধান ভূমিকা নিয়ে নেয় এবং শুরু হয় ভাবাবেগপূর্ণ ও জটিল এক সমকাম প্রেম কাহিনীর। কিশোরী আদেল এবং তরুণী এমা পরস্পরের প্রতি প্রবল শারিরীক আকর্ষণ বোধ করে। সে আকর্ষনের কাছে আদেলের জীবনের অন্য সবাই ম্লান হয়ে যায় এবং সে সবকিছু ছেড়ে এমার সঙ্গে বসবাস করে এবং এমার অধীনে নিজেকে সঁপে দেয়, এ সবকিছুই এক কিশোরী আর এক তরুণীর আবেগ ভালোবাসাকে তুলে ধরে। সিনেমাটিতে বেশ কিছু অন্তরঙ্গ দৃশ্য রয়েছে যা আপাত দৃষ্টিতে বিব্রতকর মনে হলেও সহনশীল দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব হয় কারণ ছবিটির মূল গল্প যৌনতা নয় বরং ভালোবাসা বলে। এমা যখন আদেলকে ভুল বুঝে ঘর থেকে বের করে দেয় তখন আবার শুরু হয় আদেলের নিজের জীবনের সুখ বা ভালোবাসা খোঁজার চেষ্টা। কিন্তু আদেল এমার মতো তেমন আকর্ষণ বা ভালোবাসা কোথাও খুঁজে পায় না। তাই সে আবার এমার কাছে ফিরতে চায়, কিন্তু ততদিনে এমার জীবনে আরেক নারীর আগমন ঘটেছে; এমা সে নারীকেও ছাড়তে পারনো; আদেলকেও ভুলতে পারেনা। মানসিক টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে ভগ্ন মনে আদেলকে যেমন এমার কাছ থেকে বিদায় নিতে হয় তেমনি সিনেমা শেষে ভরা পার্টি থেকে আদেলকে একা একা নিঃসঙ্গ রাস্তা ধরে চলে যেতে দেখে দর্শক। আর আদেলকে ভালোবাসা শূন্য হাতে ফিরে যাওয়ার ভেতর দিয়ে দর্শক এক ধরণের কষ্টে নিমজ্জিত হয়, আবার তাদের মনে অন্য রকম এক সম্ভাবনাও উঁকি দেয়, ভবিষ্যতে আদেল কি পুনরায় তার ভালোবাসা ফিরে পাবে? এই প্রশ্ন ভাবতে ভাবতে দর্শকদের সিনেমাটি শেষ করতে হয়।
ধোবী ঘাট: ধোবী ঘাট ছবিতে চারজন একাকী মানুষকে আমরা দেখতে পাই। চারজন চার আঙিকের মানুষ, আপাত দৃষ্টিতে তাদের কারো সঙ্গে কারোরই মিল নেই তারপরও তারা যেন সকলেই কোথাও একটি সূত্রে গাঁথা। এই রকম অবানিজ্যিক ছবি তৈরী করা তখনই সম্ভব হয় যখন একটি কাহিনিকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলবার জন্য একজন পরিচালকের ছবির প্রতি প্রচ- রকম ভালোবাসা কাজ করে। ধোবী ঘাটের পরিচালক কিরন রাও’য়ের ছবির প্রতি তেমন ভালোবাসা ছিল বলে দর্শক এরকম একটি মনস্তাত্বিক ছবি দেখতে পায়। ধোবী ঘাট ছবিটি যেমন চারজন মানুষের দুঃখ-বেদনা-হতাশা-অপ্রাপ্তি-অপূর্ণতার কথা বলে যায় দর্শকদের কানে কানে তেমনি আর একটি চরিত্রও দর্শকের চোখের সামনে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে থাকে, তা হলো মুম্বাই শহর। মূলত এই ছবির কাহিনিতে শহরটি প্রধান চরিত্র। এই শহরের মধ্যে প্রবল ভালোবাসায় প্রতিদিন বিপুল মানুষ বাস করে, তেমনি অনেক মানুষ এই শহরে নিঃসঙ্গ জীবন টেনে চলে। সমাজের বিভিন্ন ক্লাশের মানুষের সমস্যা, ক্রাইম, শিল্পকলা, ফটোগ্রাফি এবং একই সঙ্গে শহরের রহস্যময়তার পরও ভালোবাস আর নিঃসঙ্গতা এই ছবির গায়ে লেপ্টে থাকে।
ছবির প্রারম্ভে আমরা শহরকে নিয়ে ভিডিও’তে ইয়াসমিনের বর্ণনা আর টেক্সিওয়ালার সঙ্গে কিছু কথোপকথন শুনি। এক পর্যায়ে ইয়াসমিনের ভিডিও ডায়রি আশ্রয় নেয় ক্রমাগত বদলাতে থাকা শহরের একটি কাঠের দেরাজে। খ্যাতিমান, নির্বিকার কিন্তু জীবন থেকে পলায়ণপর শিল্পী অরুণ সে ভিডিও খুঁজে পেলে শহরে নবাগতা তরুণী বধূ ইয়াসমিনের শহুরে একাকী জীবন তার সামনে ভাঁজ খুলতে থাকে, প্রতি ভাঁজে ভাঁজে পেহেলি চিটঠি, দুসরি চিটঠি, তেসরি চিটঠি নামে ভাইয়ের জন্য তৈরী করা ভিডিও ডায়রিতে সে ইয়ামিনের জীবনের কৌতুহল, হাসি, চমক বা প্রতীক্ষা ইত্যাদি আবিষ্কার করে অচেনা-অজানা ইয়াসমিনের জন্য অন্য রকম ভালোবাসা বোধ করে। তাই তো দেরাজে খুঁজে পাওয়া ইয়াসমিনের রূপোর চেইন ঘষে পরিষ্কার করে হঠাৎ করেই নিজের গলায় পরে নেয় অরুণ। আবার আমেরিকার ব্যাংকের চাকরী ছেড়ে আসা অ্যামেচার ফটোগ্রাফার শাই’র সঙ্গে এক রাত্রি যাপন করেও অরুণের কাছে তা জীবনের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। যদিও শাই অরুণের সঙ্গে সম্পর্ককে একটি গন্তব্য দিতে চেয়েছিল। অন্যদিকে তরুণ ধোবী মুন্না, যার কাজ বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাপড় সংগ্রহ করা, স্বপ্ন ফিল্মস্টার হওয়ার; তার সঙ্গে শাই’র যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাতে শাইর পক্ষ থেকে মুন্নার জন্য কোনো প্রত্যাশা বা দায়িত্ববোধ ছিলনা। কিন্তু মুন্নার মনে ফিল্মস্টার হওয়ার স্বপ্নের মতো, রূপকথার মতো; আর একটি স্বপ্ন দানা বাঁধে শাইকে নিয়ে। তাই তো সে অরুণের ঘরে শাইকে দেখে ঈর্ষাম্বিত হয়ে পড়ে। আবার রাতের অন্ধকারে ইঁদুর মেরে বিক্রির জন্য দৌড়াতে থাকা মুন্নাকে শাই দেখে ফেলেছিল বলে বিব্রত মুন্না শাই’র কাছ থেকে পালাতে থাকে কিংবা নিজের কাছ থেকে পালায়।
অরুণ ভিডিও ডায়রির মাধ্যমে জানতে পারে ইয়াসমিনের মানসিক যন্ত্রনার কথা, শোহরের আরেক নারীর সঙ্গে প্রেম আছে জেনে ইয়াসমিন তা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার চিহ্ন হয়ে ঝুলতে থাকা ছোট্ট এক টুকরো দড়ির প্রান্ত, অরুণকে ওর ঘরের সামনে বসে থাকা পাশের ফ্ল্যাটের স্থবির বৃদ্ধার মতো স্থবির করে দেয়। জীবন থেকে বারবার পালাতে থাকা অরুণ ইয়াসমিনের স্মৃতি জড়ানো ঘর ছেড়ে আবার পালায়।
ঠিকানা বদলে ফেলা অরুণকে শাই খুঁজে বেড়ায়। ঈর্ষাম্বিত মুন্না ঠিকানা দেবে কি দেবেনা’র দোলাচালে দুলতে দুলতে ঝট করে পকেট থেকে বের করে এনেছিল অরুণের বদলে যাওয়া ঠিকানা।
অরুনের চিত্রশিল্প, শাই’র সাদা-কালো ফটোগ্রাফি, ইয়াসমিনের ভিডিও ডায়রি এবং মুন্নার স্বপ্ন- একটি মালার পুঁতির মতো এক সূতোয় গাঁথা হলেও এসবকিছু নিঃসঙ্গ শহরটিকে কেন্দ্র করে ডালপালা মেলতে থাকে। তেমনি এই সব ক’টি চরিত্র ভালোবাসায় যেমন বাঁচতে চায় তেমনি নিঃসঙ্গতায়ও ক্রমাগত ডুবতে থাকে।
লাঞ্চবক্স : এক অসম প্রেমের গল্প লাঞ্চবক্স। দু’জন অসম চরিত্র, অসম বয়স এবং অপরিচিত মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা প্রেমের গল্প বলে লাঞ্চবক্স। না দেখে না চিনে কী করে দু’জন মানুষ এত কাছাকাছি চলে আসে এবং পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভর করে উপেক্ষিত হয়ে ওঠা জীবন বা অবসরের অপেক্ষায় দিন গুনা জীবন পেছনে রেখে পুনরায় বেঁচে ওঠার আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবার কথা বলে লাঞ্চবক্স। ছবিটি দেখে মনে হয় না এটি পরিচালক রিতেশ বাত্রার প্রথম তৈরী সিনেমা। সিনেমাটি দেখতে দেখতে আমরা একদম ঠিকঠাক পরিচালকের ম্যাসেজ ক’টি পেয়ে যাই, ভুল ট্রেনে চেপেও সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানো অনেক সময় সম্ভব হয়। কিংবা সম্পর্ক তৈরীর জন্য পরিচয়, বয়স বা দেখা হওয়া জরুরী কোনো ব্যাপার নয়, পারস্পরিক ভাবনার, আশ্বাস বা সহানুভূতির ভেতর দিয়ে দু’জন মানুষের বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে । সিনেমাটি দেখতে যেয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া পত্রমিতালীর কথাও মনে পড়ে যায়।
সিনেমাটির কাহিনি বিন্যাসে দর্শক যা দেখে তা অনেকটা এই রকম, ইলা সাধারণ গৃহবধূ; এক সন্তানের মা; স্বামীর মনোযোগ পাচ্ছে না বলে স্বামীর ভালোবাসা ফিরে পাবার আশায় প্রতিবেশী দেশপান্ডের আন্টির পরামর্শে স্বামীর জন্য দুপুরের লাঞ্চে নতুন রেসিপিতে রান্না করা খাবার পাঠায় অফিসে, ডিব্বাওয়ালার ভুলে সে লাঞ্চবক্স বা ডিব্বা অন্য অফিসে কর্মরত বিপত্নিক সাজান ফার্নান্ডেজের কাছে পৌঁছায়। ইলার পাঠানো খাবার বহুদিন পর বয়স্ক সাজান ফার্নান্ডেজ অমৃতজ্ঞানে খেয়ে নেয় পুরোটাই। লাঞ্চবক্স ফেরত আসলে ইলা ভাবে, নতুন রেসিপিতে রান্না করা খাবার স্বামীর পছন্দ হয়েছে কিন্তু রাতে স্বামী ফেরার পর ইলা ভুল বুঝতে পারে। পরের দিন ইলা কী এক মোহে সে ভুলের পুনরাবৃত্তি করে তবে এবার খাবারের সঙ্গে একটি ছোট্ট চিঠিও পাঠায় যেখানে সে সাজানকে পুরোটা খাবার খাওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানায় এবং আর সেদিনের খাবার কেমন হয়েছে জানতে চায়। সাজান খুব বেশি কিছু না লিখে শুধু জানায়, খাবার সল্টি হয়েছে। এভাবে ইলা আর সাজান ফার্নান্ডেজের মাঝে চিঠি চালাচালি শুরু হয় এবং ইলা প্রতিদিন যত্ন করে রান্না করে তা লাঞ্চবক্সের মাধ্যমে অচেনা-অজানা সাজানের জন্য পাঠাতে থাকে। যদিও স্বামীর প্রতি রয়েছে ইলার ভালোবাসা (হয়ত স্বামীকে ভালোবাসতে হয়, ভারতীয় নারীর এই বোধ থেকে ইলার এই ভালোবাসার উৎপত্তি), স্বামীর শার্ট ধূতে যেয়ে সে হঠাৎই বুঝে যায়, স্বামীর অন্য আর এক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, যা জেনেও ইলা চুপ করে থাকে; কারণ তার ধারণা প্রতিবাদ করেই বা সে কোথায় যাবে? পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাই ইলার মা তার দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ্য স্বামীর মৃত্যুর পর হঠাৎ করে নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার স্বাধীনতা পেয়ে যান, তিনি মেয়েকে জানান; তার খুব পরোটা খেতে ইচ্ছে করছে। মা’র এই কথা থেকে ইলা নিজেও স্বাধীনতার স্পৃহা খুঁজে পায় আর এই সব কিছু সাজান জানতে পারে ইলার চিঠির মাধ্যমে। যখন ইলা স্বামী-সংসার-সন্তানের কাছ থেকে চলে যেতে চায়, অন্য দিকে বন্ধনহীন একাকী সাজান ফার্নান্ডেজ; ঠিক হয়, ওরা দেখা করবে। সিনেমার শেষ প্রান্তে এসে দর্শক যখন ভাবতে শুরু করে, ওদের মিলন হতে আর কোনো বাঁধা নেই; তখনই দর্শক আরেক অনিশ্চয়তার মাঝে নিক্ষিপ্ত হয় কারণ, দেখা করবার মতো মানসিক জোর ইলার থাকলেও সাজানের থাকে না, বেরুবার আগ মুহূর্তে নিজেকে আয়নায় দেখে সাজানের বৃদ্ধ ঠাকুরদা’র মতো লাগে নিজেকে। আবার নিজেকে ঠাকুরদা’র মতো লাগলেও ইলাকে দেখার লোভ সামলাতে পারে না সে, তাই লুকিয়ে ইলাকে দেখে তার মনে হয়; ইলা অনেক বেশি তরুণ আর খুব বেশি সুন্দর, ইলার পাশে নিজেকে বেমানান ভেবে সে নিজেকে ইলার কাছ থেকে সরিয়ে নিতে চায়। ছবিটির আর এক চরিত্র শেখের কাছে নিজের কাজের জায়গাটুকু ছেড়ে দিয়ে সাজান ফিরে যায় নিজের পুরনো বাড়িতে। আর ইলা তার স্বপ্নের দেশ ভূটান যাবার জন্য নিজের গয়না বেঁচে প্রস্তুতি নেয়।
লাঞ্চবক্স সিনেমাটিও আমাদের শেষ করতে হয় মনের ভেতর এক অনিশ্চয়তা নিয়ে, ইলা কি সাজানের ঠিকানা খুঁজে পাবে বা সাজান কি কখনো ইলার সামনে দাঁড়ানোর মতো মানসিক জোর পাবে নিজের ভেতর? দু’জন নিঃসঙ্গ মানুষের ভালোবাসার ভেতর দিয়ে দর্শককে ছবিটি শেষ করতে হয় কাহিনির এমন এক মোচড়ে এসে যেখানে দর্শকের মনে আশার হাওয়া দোলা দিয়ে যায় আবার যায় না- সাজান আর ইলার কি শেষ পর্যন্ত দেখা হবে কি হবে না’র মাঝে।
এই যে সেলুলয়েড জগতের হাজার রকম চরিত্র, সব চরিত্র মন কাড়ে না; আবার কিছু চরিত্র মনের গভীরে নোঙর করে বসে চিরকালের জন্য। চরিত্রদের এই সব নাটকীয়তায় দর্শকদের কখনো কখনো আসল নকলের তফাৎ করতেও ভ্রম হয়। আর উল্লেখিত এইসব চরিত্রদের দেখে আমাদের একটি কথাই মনে হতে পারে, মানুষ সব সময় একা। যেমন তার জন্মমুহূর্তে কিংবা মৃত্যুকালে। আবার জন্ম মৃত্যুর মাঝের কিছু সময়ও তাকে একা আর নিঃসঙ্গ পথ চলতে হয়। চরিত্রের এই নিঃসঙ্গতায় দর্শকও চরিত্রে নিমজ্জিত হয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়।
মন্তব্য
ধোবি ঘাট আর লাঞ্চ বক্স দেখেছি। বাকী দুটো দেখার তালিকায় রাখলাম। লাঞ্চ বক্স বেশি ভালো লেগেছে। কন্সেপ্টটা অনেক সুন্দর ।মন ছুঁয়ে যায় এমন।
এ্যানি মাসুদ
ছবিগুলো কাছে পিঠেই ছড়ানো ছিটানো আছে দেখা হয়নি। ব্লু ইজ দ্যা ওয়ার্মেষ্ট কালার এর কিছু অংশ পর্যন্ত দেখা হয়েছে শেষ করে উঠতে পারিনি। ইদানীং সময়ের বড় আকাল পড়েছে, ছবি দেখা হয়ে উঠছেনা। আগে কি ভিষন পাগল ছিলাম ছবি দেখার। এই ছবি গুলো দেখার ইচ্ছে তৈরী হয়ে গেলো নতুন করে। আর এই লেখাটা, এই লেখাটা আর লেখকের অনুভবের শৈল্পিক প্রকাশের জন্য যে মুগ্ধতার সময় পার করলাম তার জন্যই আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। খুব সুন্দর লেখেন আপনি।
সোহেল ইমাম
প্রথম দুটো ছবি দেখবো একসময় সময় করে।
পোস্ট পছন্দ হয়েছে।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
একটা সিনেমার রি-ভিউ লিখতে চাচ্ছি কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না, আপনার লেখাটা পড়ে কিছুটা সাহস পেলাম ।
ধোবি ধাটের রি-ভিউ ভালো লাগছে অনেক ।
নতুন মন্তব্য করুন