বিডিনিউজের খবরে দেখলাম, উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যসূচীতে কিছু পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার।
২০১৫ সাল থেকে কার্যকর হওয়া এই পরিবর্তনে বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়কে সব বিভাগের (বিজ্ঞান, মানবিক ইত্যাদি) জন্য বাধ্যতামূলক করা হবে, যদিও এর একটি পত্র থাকবে (১০০ নাম্বার)। সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই, কিন্তু একই সাথে মোস্তফা জব্বার জাতীয় লোকজন যেন এর মাথা না হয়ে বসে সেদিকে দৃষ্টি রাখার অনুরোধ জানাই। যেসব মাথামোটা লোক ইউটিউব বন্ধ করে আর ফেসবুক নিয়ন্ত্রণের উদ্ভট প্রস্তাব রাখে, তাদের পরামর্শ নেওয়া থেকে বিরত থাকার অনুরোধও জানাই। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এজন্য এর পরিসর নির্ধারণের জন্য বাইরের যেসব দেশে এ ধরণের বিষয় পড়ানো হয়, তাদের অনুসরণ করা যেতে পারে। একই সাথে এই বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের (দেশে-বিদেশে) সাহায্য নেওয়া যেতে পারে যেন বিষয়টি যথাযথ মানসম্পন্ন হয়।
এই গেল প্রথম পরিবর্তন, এবার আসি দ্বিতীয় পরিবর্তনের কথায় যার জন্য আমার এই পোস্টের অবতারণা। দ্বিতীয় পরিবর্তনটা হল ‘ইসলাম শিক্ষা’ নামক আরেকটি নতুন বিভাগ খোলা হতে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত উচ্চমাধ্যমিকে পাঁচটা বিভাগ ছিলঃ বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, ও সংগীত, এর সাথে ইসলাম শিক্ষাও যোগ হবে ২০১৫ সাল থেকে। বিডিনিউজের খবরে বলা হয়েছে,
ইসলাম শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিভাগভিত্তিক আবশ্যিক বিষয় হিসাবে ইসলাম শিক্ষা, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং আরবি বিষয় পড়ানো হবে।
প্রশ্ন হল,
১) যেখানে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক, সেটা কি যথেষ্ট না ধর্ম সম্পর্কে জানার জন্য? আর ষষ্ঠ – অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আরবি শিক্ষার কথা তো ছেড়েই দিলাম (উহ্ কত আরবি শিখেছিলাম রে!), অনেকের জন্য অবশ্য সেটা বাধ্যতামূলক ছিল না।
২) জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ভাষ্যমতে,
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধর্ম শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়ার জন্যই চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে ইসলাম শিক্ষা বিভাগ খোলা হয়েছে।
খুব ভাল কথা, তো ধর্ম কি দেশে একটাই? হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধদের (এবং আরো অন্যান্য) জন্য কেন বিভাগ খোলা হচ্ছে না? না কি ‘৯০% মুসলমানের দেশে আবার অন্য ধর্ম কি’ – এই ছাগুময় যুক্তিতে এখন সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও বিশ্বাসী? ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তিদের মুখ থেকে কিছু শুনতে আগ্রহী।
৩) এই সিদ্ধান্ত কতটা সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্মত? অর্থাৎ, যেসব ছেলেমেয়ে এই বিভাগ থেকে পাশ করবে, পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজে গিয়ে তারা ইসলাম শিক্ষা বাদে আর কোন বিষয়ে ভর্তি হতে পারবে?
৪) এই বিভাগের পাঠ্যসূচী আর মাদ্রাসার পাঠ্যসূচীতে পার্থক্য কতটুকু? যেখানে মাদ্রাসার ছেলেমেয়েদেরই চাকরির পরিসর এত কম, সেখানে অনুরূপ আরেকটা কাঠামো সূচনা করা কতটা যুক্তিযুক্ত?
৫) মাদ্রাসার ছেলেমেয়েরা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু বিষয়ে ভর্তি হতে পারে না এবং তা নিয়ে তারা আগে ঝামেলাও করেছে (লিঙ্ক)। সেক্ষেত্রে এই নতুন পরিবর্তন কি তাদেরকে সেই সুযোগ এনে দেওয়ার জন্য? যেমনঃ কেউ কি মাদ্রাসা থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে মূলধারার উচ্চমাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বিষয়গুলোতে পড়তে পারবে? ব্রেইন ওয়াশ্ড (বেশির ভাগ) কিছু ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঢুকিয়ে দেশের ক্ষতি ছাড়া লাভ দেখি না। বর্তমান (এবং গত ৪০ বছরের) শিক্ষা ব্যবস্থায় তারা ইতোমধ্যেই অনেক উঁচু জায়গায় পৌঁছেছে (যেজন্য আজকে আমরা এ ধরণের সিদ্ধান্ত সরকারের উঁচু পদ থেকে আসতে দেখি), তাদেরকে আরো জায়গা করে দেওয়া অর্থহীন। যেখানে সরকারের উচিত তিন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার (বাংলা, ইংরেজি, আরবি) ভিন্নতা কমানো এবং সেই উদ্দেশ্যে মাদ্রাসার পাঠ্যসূচী আধুনিকায়ন করা, তা না করে বাংলা মাধ্যমকে উল্টা পেছনে টানার মানে কি? পারলে মাদ্রাসায় ২০০ নাম্বারের বাংলা, ইংরেজি চালু করুক প্রথমে।
৬) এই বিভাগের উছিলায় বাবুনগরীর চ্যালাচামুন্ডারা যে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক হয়ে ঢুকতে পারে, সেই খেয়াল কি সরকারের আছে না কি নাই? না কি এতে ওনারা কোন দোষ দেখেন না?
৭) সর্বশেষে, জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে এবং সেটা সামনে রেখে সরকার না না রকম ভোটব্যাঙ্ক নিশ্চিত করতে চাইছে, এটা বেশ স্পষ্ট। তবে এই দিন দিন না, আরো দিন আছে, নিজেদের সিদ্ধান্ত যে ব্যুমেরাং হয়ে নিজেদের ঘাড়েই পড়বে সেটা কবে বুঝতে পারবে সরকার?
আমার প্রশ্নগুলোর পাশাপাশি অন্য প্রশ্ন বা মতামত থাকলে মন্তব্যের ঘরে জানানোর অনুরোধ জানাই।
মন্তব্য
সরকার বাহাদুর, সবার আগে "বঙ্গবাণী" কবিতাটি আবার পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। দেশে এতো ধর্ম, এতো মসজিদ, এতো টুপি, এতো অনুভূতি, কিন্তু তারপরও তো পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হইলাম। ক্লাস টেন পর্যন্ত পইড়া যখন লাইনে আসতে পারি নাই আমরা, আরো দুই ক্লাস ইসলাম শিখাইলেও লাইনে আসতে পারবো না।
facebook
সংসদীয় কমিটিকে ধন্যবাদ
ভোটের রাজনীতি, আর কিছু না!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
উচ্চ - মাধ্যমিকে ধর্ম পড়াতেই যদি হয় তা হলে সব ধর্মের ইতিহাস নিয়ে পড়ানো উচিত। ডুরখেইমের 'দ্যা এলিমেন্টারি ফরমাস অব দ্যা রিলিজিয়াস লাইফ ' পড়ানো যেতে পারে। হয়তো অনুবাদ করে ..
ভালো লেখা।।।।। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা কি পাগল নাকি বুঝলাম না।।।।।।। একটা দেশে কতরকম শিক্ষাব্যাবস্থা থাকবে?
কোন সন্দেহ নাই যে এটা ভোটের রাজনীতি। কিন্তু কে না জানে, এতে ভোটের সংখ্যা আওয়ামী পাল্লায় এক ছটাকও বাড়বে না।
বাংলাদেশে দিনকে দিন স্কুল আর মাদ্রাসার পার্থক্য ঘুচে যাচ্ছে। শুধু বিভাগের পার্থক্য দিয়ে কদ্দুর কি হবে জানি না। অন্তত ইদানিং আউটপুটগুলি দেখে অনেকটা সেরকমই মনে হয়। আমার মনে হয় আরও মৌলিক জায়গায় হাত দেয়া দরকার।
অন্ধকার যুগে প্রত্যাবর্তনের জোয়ার ঠেকাতে হলে আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয় বা নীতিগুলি অতি দ্রুত মৌলিক ও সিস্টেমিক ভাবে ইন্টিগ্রেট করা অপরিহার্য বলে বোধ করি, সেগুলি হল-
১। শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবন, আচরণ ও চিন্তায় ভয়-ভীতি-সংস্কার-আবেগ ও বায়াস-অতিক্রমী 'যুক্তি'-র চর্চা শিক্ষা দেয়া, ইনফিউস করা, সেই ক্ষমতাটা জাগ্রত করা,
২। শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা ও তার প্রবণতাকে উৎসাহিত, সক্ষম ও ক্ষমতায়িত করা,
৩। দৈনন্দিন, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক জীবনাচরণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, চিন্তাপদ্ধতি ও আচরণ শিক্ষার্থীদের মানসে আমূলে প্রোথিত করা,
৪। শিক্ষার্থীদেরকে মনুষ্যত্ব ও বাস্তবতার একটা ইঙ্কলুসিভ, শেয়ার্ড ও এম্প্যাথেটিক উপলব্ধিতে উপনীত হওয়া এবং তাতে সচেতনে ও অবচেতনে আত্নস্থ হওয়া এবং এসব হওয়ার প্রক্রিয়াতে সক্ষম ও অভ্যস্ত করে তোলা।
এই চারটা মৌল নীতি বা বিষয় স্রেফ কোন পঠিতব্য বিষয় নয়, সিস্টেমিকভাবে ও মেথোডলজিকালি কার্যকরীরূপে অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে না পারলে স্কুল আর মাদ্রাসা, বাংলাদেশ আর হাফগানিস্তান, ২১ শতক আর মধ্যযুগের মধ্যে কোন পার্থক্য, অবস্থাদৃষ্টে, আর বেশিদিন থাকবে না বলেই ভয় হয়।
****************************************
কৃষি শিক্ষা নেই দেখে অবাক হলাম।
খবর থেকে যা বোঝা গেল তা হল মোটামুটি প্রত্যেক বিভাগের শিক্ষার্থীরা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে কৃষিশিক্ষা নিতে পারবে।
--------------------------------
বানান ভুল থাকলে ধরিয়ে দিন!
এই বিভ্রমটা অনেক শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই দেখেছি। ধর্ম বলতে শুধুই ইসলামকে বুঝে। কিন্তু বাংলাদেশেতো হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ছাড়াও আদিবাসীদের ধর্মও আছে। সরকার যদি জনগণের করের টাকায় ধর্মীয় শিক্ষার দায়িত্ব নেয় তাহলে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের ধর্ম শিক্ষার সমান সুযোগ বিধান করাটাইতো ন্যায় সংগত।
মাধ্যমিকে এমন একটি পাঠ্যবই কি করা যায় না যেখানে সকল ধর্মের মুল নৈতিক শিক্ষা ও ধর্ম প্রচারকদের জীবনী থাকবে? অন্য ধর্ম ও তার অনুসারীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতার চর্চাটা শিশুকাল থেকেই থাকা উচিত। একই সঙ্গে ধর্ম বিশ্বাস/অবিশ্বাস যে একটি ব্যাক্তিগত বিষয় এই বোধটাও জাগ্রত করা উচিত।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
ইন্টারেস্টিংলি বিদেশে এসে ইসলামিক স্কলারদের থেকে জানলাম যে (ইসলাম) ধর্মকে ইনহেরিট করা যায় না। ধর্ম বুঝে পালন করার বিষয়। চাপাচাপির তো প্রশ্নই আসে না। আরো জানছি যে কোরআন শুধু পড়ার জন্যই না, পড়ে প্রশ্ন করার জন্যও।
যারা দুনিয়ার সব বইই পড়েন, তাদেরকে অনুরোধ করছি কোরআনটাও কষ্ট করে ব্যাক-টু-ব্যাক পড়ে দেখার জন্য।
নতুন মন্তব্য করুন