স্বর্গের খোঁজে

সংসপ্তক এর ছবি
লিখেছেন সংসপ্তক (তারিখ: শনি, ১৭/০৪/২০১০ - ৩:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


চারপাশের নোংরামি, ব্যভিচার, প্ররোচনা, অশ্লীলতা, সব রকম ইতরামি, পাশবিকতার মাঝে জন্ম নিয়ে; বুদ্ধিহীন, অতৃপ্ত, ক্ষমাহীন, অন্ত্র ও লিঙ্গ সর্বস্ব কিছু মানুষের মাঝে বেড়ে ওঠা এক পুণ্যাত্মার সাথে কথা হল গতকাল।
বহুদিন কঠোর সাধনার মাধ্যমে স্রষ্টার বিশেষ অনুগ্রহ ও নৈকট্য লাভ করেন তিনি। যেহেতু তিনি প্রকৃত পুণ্যাত্মা ছিলেন, তিনি স্রষ্টার কাছে কোন বাসনা পূর্ণ করতে নয়, বরং স্রষ্টার প্রতি অসীম ভালবাসা থেকেই সাধনা লিপ্ত ছিলেন। তাঁর ভক্তিতে স্রষ্টা অত্যন্ত তৃপ্ত হন এবং এই পুণ্যাত্মাকে একটি অসামান্য বর দান করেন। দিব্যদৃষ্টি।

এই দৃষ্টি শক্তি তাঁকে সমগ্র পৃথিবী বা ভবিষ্যৎ দেখার তুচ্ছ জ্যোতিষ বিদ্যা নয়, বরং দান করে স্বর্গের অবর্ণনীয় সৌন্দর্যময় প্রতিটি মুহূর্ত অবলোকনের ক্ষমতা। ইচ্ছা মাত্র তিনি তাঁর চারপাশের সব ক্লেদ অগ্রাহ্য করে স্বর্গের অসীম শান্তির স্পর্শ পেতে পারতেন। তাঁর ইশারায় স্বর্গের সুবর্ণখচিত, মুক্তার কারুকাজ করা সিংহদরজা বিশাল হা করে তাঁকে গ্রাস করত, পঙ্কিল বাস্তবতা মুহূর্তে উধাও হত।

(এবং সকলেই জানেন, স্বর্গের চেয়ে সুন্দর কিছু কখনো সৃষ্টি হয় নি। কথিত আছে, স্বর্গের বর্ণনা দানের উদ্দেশ্যে স্বর্গীয় ব্যক্তি বর্গ কিছুদিনের মাঝেই পৃথিবীতে শিখে আসা অনুপযোগী বিশেষণ গুলো বর্জন করে নতুন বিশেষণ গুচ্ছ সৃষ্টি করতে বাধ্য হন।)

বলা বাহুল্য বর লাভের পর তাঁর মত সুখী ব্যক্তি এই পৃথিবীতে কেউ ছিল না। আপনার-আমার প্রাণ যখন খোলা ডাস্টবিন আর কাঁচা ড্রেনের গন্ধে ওষ্ঠাগত, তখন এই মহাপুরুষ স্বর্গের পারিজাতের অপূর্ব বর্ণচ্ছটা ও সুবাস উপভোগ করতেন। (এটাও বলা বাহুল্য যে দিব্যদৃষ্টি কেবল নামেই দৃষ্টি, একই সাথে তা পঞ্চেন্দ্রিয়ের উপর কাজ করে।)

শ্বেত-স্বর্ণ ও ময়ূরকণ্ঠী বেলোয়ারী কাঁচের পাত্রে স্বচ্ছ-সুগন্ধ পানীয় তাঁর ঠোঁট বেয়ে কলিজা পর্যন্ত হিমশীতল তৃপ্তিধারা বইয়ে দিত। আমরা তখন হয়ত শাহবাগের মোড়ে চাঁদিফাটা রোদে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সরকার প্রধানের বাপান্ত করছি। এই বাপান্ত গিয়ে আমাদের পাপের খাতায় যোগ হচ্ছে এবং আমাদের প্রায় অজান্তেই স্বর্গীয় বেলোয়ারী কাঁচ-পাত্রের সুধা আরও দূর হতে দূরে চলে যাচ্ছে।

তিনি চাইলেই তার জিভের স্বাদ গ্রাহী গ্রন্থি গুলো উপভোগ করতে পারত অপার্থিব সুস্বাদ। তিনি কিছুটা প্রাচীনপন্থী ব্যক্তি হওয়ায় আপনার বা আমার মত বত্রিশ টি গোপন মশলা ও গাছড়ায় মুড়িয়ে ভাজা মুরগি কিংবা ইতালি থেকে আমদানি করা জলপাই ও চিউয়িংগামের মত পনীর যুক্ত খাদ্য কিংবা মাস-খানেকের বাসী সামুদ্রিক প্রাণী কিংবা তেল-নুন-স্বাদ বিহীন আলু ভর্তা কিংবা হাজার টাকা দিয়ে কেনা কাঁচা সবজির স্যালাডের মর্ম বুঝতেন না। স্বর্গীয় আঙ্গুর, বেদানা, লিচু ইত্যাদি ফল-ফলাদির উৎকর্ষে এসব বিজাতীয় খাদ্যের অভাব কখনোই তিনি অনুভব করেন নি।

তিনি বাস্তব পৃথিবীতে কখনো এক কাপ চায়ের নেশাও করেন নি, কিন্তু স্বর্গের মাদক গুল্ম যেহেতু স্রষ্টার অনুগ্রহ তাই তিনি বুঁদ হয়ে থাকতেন অপার্থিব ধোঁয়াশায়। আমাদের তুচ্ছ কল্কে কিংবা শহুরে বং দিয়েই যদি হঠান স্বর্গ ছোঁয়ার অনুভূতি পাওয়া যেতে পারে তাহলে কল্পনা করুন ঈশ্বরের করুণা মণ্ডিত ঔষধিতে দম দিয়ে তিনি কোন সুউচ্চ আনন্দ মার্গে পৌঁছতেন!

ঈর্ষণীয় সৌভাগ্যের অধিকারী এই ব্যক্তির জীবনে ও একদিন দেখা দিল একেবারেই অচিন্তনীয় এক দুর্যোগ। স্রষ্টার পরম দান সেই দিব্যদৃষ্টি ই তাঁর জীবনের সব সুখ তিলে তিলে পুড়িয়ে ছাই করে দিল।

যতই তিনি স্বর্গের অপূর্ব সুখের সন্ধান পেতে থাকলেন, ততই তাঁর নশ্বর জীবন তাঁর কাছে অসহ্য বোধ হতে থাকল। তিনি সুধার হিমশীতল স্বাদ পান কিন্তু কোন তরল তাঁর কণ্ঠ বেয়ে নামে না, আপেলের লালচে-সোনালী-হলুদ বর্ণ তাঁর চোখে ভাসে, সুস্বাদ তাঁর জিভে সারা জাগায় কিন্তু কামড়ে কামড়ে সেই আপেলের কচকচে অনুভূতি তিনি নিতে পারেন না। মাদক তাঁর চেতনাকে উর্ধ্বমুখী করে কিন্তু তিনি পান না তার ধোঁয়ার স্পর্শ। প্রতিনিয়ত স্বর্গের প্রকৃত স্পর্শের আকাঙ্ক্ষায় তাঁর সব সুখ অপূর্ণ থেকে যেতে থাকে। স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের ভাবনা আর তাঁকে তাড়িত করে না।

তাও সহ্য করতে পারতেন তিনি। আসল সমস্যা শুরু হল যখন …...... অপ্সরীদের আগমন শুরু হল।

এতদিন তাঁর মনে কখনো নারীঘটিত কোন চিন্তা-দুশ্চিন্তা কিছুই আসে নি, নারী স্পর্শ বর্জিত একাকী মানুষ, টিভি সিনেমার অভ্যাস ও তাঁর কখনো ছিল না। এই পরীক্ষার মুখোমুখি তাঁকে কখনো এর আগে হতে হয়নি। এখন প্রতিনিয়ত তাঁর সামনে অপূর্ব হিল্লোল তুলে নেচে বেড়ায় স্বর্গ-সুন্দরীশ্রেষ্ঠারা। তাঁদের চলন বলনের মাধুর্য তাঁকে প্রথমত নির্বাক, পরবর্তীতে তীব্র অশান্ত করে তুলতে থাকে। তাঁর মনে নিত্য নতুন বিস্ময় ও আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিতে থাকে এই অপ্সরী-দলের সাথে তিনি ভাব বিনিময়ের ক্ষীণতম সুযোগের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন, তীব্র এক ব্যাকুলতা সৃষ্টি হয় তাঁর মাঝে।

দিন কে দিন তিনি অশান্ত থেকে অশান্ত তর হতে থাকেন, জীবন তাঁর কাছে অসহনীয় হয়ে উঠতে থাকে। এমনই এক মুহূর্তে তিনি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। নিজের মন কে প্রবোধ দেন এই বলে যে আবার যখন চোখ খুলবেন, তিনি জেগে উঠবেন প্রকৃত স্বর্গে , সব অপূর্ণ সাধ তাঁর দুহাতে ধরা দেবে। মনের আনন্দে তিনি নিজের শিরায় মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে পপি ফুলের একটি বিশেষ অ্যালকলয়েড প্রবেশ করিয়ে দেন। (ইতিমধ্যে মনের অশান্তি মেটাতে স্বর্গীয় গুল্ম ব্যর্থ হওয়ায় তিনি এই জাগতিক পাপ পুষ্পের বিশেষ অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন)

সময় মেতে জেগে ও ওঠেন তিনি, কিন্তু চারদিকের পরিবেশের উত্তাপের তীব্রতা তাঁকে দ্রুত মেনে নিতে বাধ্য করায় যে তিনি ভুল পথে চলে এসেছেন। স্বর্গ-বঞ্চিত হতভাগ্য প্রতিদিন ই দরখাস্ত করার চেষ্টা করেন, আসে-পাশের নারকীয় জীবগুলোকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে তিনি দাপ্তরিক ভুল বোঝাবুঝির শিকার, স্রষ্টার বরপুত্র তিনি, অন্যতম প্রিয়পাত্র। এই মুহূর্তে তাঁর, আর যাই হোক, উত্তপ্ত সাঁড়াশী ও লোহার হাতুড়ির সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ থাকার কথা নয় এবং যেহেতু তিনি উদ্ভিদ জগতের সদস্য নন, তাঁর খাদ্য বস্তু তাঁর নিজের দেহ থেকেই উৎপাদনের কোন রকম প্রয়োজন তিনি বোধ করছেন না। নরকের কীট গুলো কেবল খ্যাক্ষ্যাক করে হাসে আর নিজেদের কর্মকাণ্ডে দ্বিগুণ উৎসাহে আত্মনিয়োগ করে।

বহু বছর চেষ্টার পর তিনি জানতে পারেন তাঁর অপরাধ; আত্মহত্যা মহাপাপ এবং এই কাজের কারণে তাঁর পূর্বোক্ত সকল উপাসনা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। তিনি হতভম্ব হয়ে জানতে পারেন তাঁর ভবিষ্যৎ এখন কেবল অনন্ত নরক। প্রথমে উন্মত্ত ক্রোধ তাঁকে গ্রাস করে, তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন , “আলোর দেবদূতের অনুসারী আমি ও! ঈশ্বরের বিরুদ্ধে আমিও বিদ্রোহ ঘোষণা করছি!” পাশে থেকে এক গাট্টা-গোট্টা চেহারার পিশাচ তাঁকে এক থাবড়ায় চিৎপাত করে দিয়ে ধমকে ওঠে , “চোপ, শালা! মচ্ছর!” অসীম হতাশায় এরপর তিনি স্থবির হয়ে থাকেন বহুকাল।

তাঁর চেয়ে বড় শাস্তি আর কাউকে পেতে হয় নি কখনো। নরকের কষ্টও ম্লান হয়ে যায় স্বর্গ হারানোর বেদনার কাছে। আদম স্বর্গ হারিয়ে পেয়েছিল মর্ত্য। ইবলিশ স্বর্গ কাকে বলে জানেও না, সে চিরকালের নরকবাসী।

বহু যুগ পেরিয়ে যাবার পর স্রষ্টার খানিকটা দয়া হয়। তাঁর প্রাক্তন এই প্রিয়পাত্র কে তিনি সুযোগ দেন অনন্ত নরকের পরিবর্তে লক্ষ বছরে পাপ-স্খালনের সুযোগ। এবং এ জন্য বেছে নেবার সুযোগ দেন মর্ত্য জগত কে। সেই থেকে তিনি পৃথিবীতে আছেন, আমাদের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাঘরে পরিযায়ীর মত। রোগ , একাকীত্ব , ক্ষুধা , তৃষ্ণা , জরা সবই তাঁকে স্পর্শ করে, কেবল মৃত্যু তাঁর কাছে আসে না। লক্ষ বছরের চাপিয়ে দেয়া সাধনা তিনি সুনির্দিষ্ট ভাবে করে যান, একমনে। সেই অধরা স্বর্গের আশায়।

গতকাল তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছিল নাজিমুদ্দিন রোডের শেষ মাথায়। একটা জীর্ণ ছেঁড়া ছাতা হাতে খুব মনোযোগ দিয়ে ড্রেনে ভেসে যাওয়া শ্যাওলা, ছোট ছোট গাপ্পি মাছ, কাগজের নৌকা, সিগারেটের প্যাকেটের রাংতা আর ভাঙ্গা একটা ঝিনুকের ছুড়ি দেখছিলেন তিনি, উপুড় হয়ে, একমনে।


মন্তব্য

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ভাল্লাগলো

-------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

সাইফ তাহসিন এর ছবি

৫ তারা
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

ফাহিম এর ছবি

আগে মিস করে গেসিলাম। জটিল লেখা!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।