জিয়া স্যার (সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ১৯৫০-২০১৭)

সংসপ্তক এর ছবি
লিখেছেন সংসপ্তক (তারিখ: সোম, ৩১/০৭/২০১৭ - ১:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ব্যক্তিত্ব কি ছুঁয়ে দেখা যায়? অ্যাবস্ট্র্যাক্ট একটা বিষয় – ছুঁয়ে দেখতে পারার কথা না তো, তাই না? আমারও তাই ধারনা ছিল।

জিয়া স্যারের সাথে দেখা হবার আগ পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধের সুন্দরবন সাব-সেক্টার কমান্ডার, মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ। কর্নেল তাহেরের সহ-বিপ্লবী।

তাহেরের বিপ্লবের মূল্যায়ন, আদর্শের ভুল ইত্যাদি আলোচনায় না যাই আজকে। আমার বাবাও একই পথের, দলের, মুহূর্তের লোক – তাঁদের আদর্শের শুদ্ধ, ভুল নিয়ে বহু তর্ক করেছি। এখনও জবাব নাই। তাঁদের সেই বয়েসের চেয়ে আমার বয়েস এখন বেশি – একই কাজ আমি করতাম না, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি না। শুধু এটুকু ধারণা বদ্ধমূল – আদর্শ ভুল হতে পারে, কিন্তু প্রত্যেকে মাত্র দেশের জন্য নয় মাস জীবন বাজি রেখে এসেছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা। ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য তাঁরা কিছু করেন নি।

মুক্তিযোদ্ধা, মেজর জিয়াউদ্দিনকে নিয়েও আমি কথা বলার কেউ না। আমি শুধু তাঁর সাথে কাটানো কিছু মুহূর্তের সাক্ষী। মোটামুটি অন্ধ ভক্ত বলা চলে। স্রেফ গল্প শুনে।

লেখালেখি বন্ধ এক যুগ প্রায়। ও ব্যর্থ চেষ্টা বাদ দিয়ে বরং জিয়া স্যারের সাথে কাটানো কিছু স্মৃতি শেয়ার করি – ছবি আর ফেসবুক স্ট্যাটাস লেখার সীমাবদ্ধতা দিয়ে, জিয়া স্যারের বলা দুই একটা গল্প, অল্প পরিসরে মনে করার চেষ্টা করে।

ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। বছর আষ্টেক আগের কথা। আই বি এ আমার খুব পছন্দের জায়গা ছিল না – পড়া লেখাও করতাম না। দুই-তিনজনের বেশি শিক্ষকের ক্লাস সহ্য হত না – এবং ভাইস ভার্সা। যে কয়েকজনকে পছন্দ এবং সম্মান করতাম – তাঁদের একজন একবার খবর দিলেন, সুন্দরবনে ঘোরার একটা সুযোগ, তাঁর এক পরিচিতের দাওয়াত। খরচ নেই। যাবো নাকি। বলা বাকি থাকে না – এক লাফে রাজি। সেই পরিচিত ব্যক্তিই জিয়া স্যার। হয়ত শিক্ষকের মাধ্যমে পরিচয় দেখেই উনিও প্রথম দিন থেকেই ‘স্যার’।

খুলনায় নেমেই ওনার মাধ্যমেই খুলনায় বিডিআর রেস্ট হাউজে থাকা – বিডিআর কমান্ডার যিনি ছিলেন (এতদিন পরে নাম মনে নেই, তাঁর কথা শেষে আরেকবার বলবো, তাই উল্লেখ করা) তিনি নিজে এসে আমাদের দেখভাল, ঠিক-ঠাক আছি কি না নিশ্চিত করে গেলেন। আমাদের সাথে একদিন কাটালেন। একজন মেজর –সম্পূর্ণ নাম মনে নেই – মেজর দূরুল, তাঁকে সহ কয়েকজন সিপাহিকে আমাদের নিরাপত্তার জন্য সঙ্গী করে দিয়ে গেলেন। তখনই দেখলাম জিয়া স্যারকে তিনিও ‘স্যার’ ই বলছেন । অসম্ভব সম্মান দিচ্ছেন। যদিও র‍্যাংকিং এ জিয়া স্যার রিটায়ার্ড মেজর- উনি সম্ভবত কর্নেল। বিডিআরের সবার ব্যবহারে, পরের দিন পর্যটনের রেস্তোরাঁয় সবার আচরণে আস্তে আস্তে টের পাচ্ছিলাম – এই চুপচাপ ভদ্রলোক, আমাদের হোস্ট, ইনি সাধারণ কেউ নন।

তখনও তাঁর আসল পরিচয় পাওয়া বহু বাকি। পরের সাতটা দিনে ধীরে ধীরে, গল্পে গল্পে, কথায়, ব্যবহারে বুঝলাম - এই সম্মানের উৎস কোথায়। ‘প্রবল ব্যক্তিত্ব’ বলতে এখনও স্রেফ জিয়া স্যারের কথাই মনে পড়ে। যে ব্যক্তিত্ব, চুপ করে থাকা অবস্থাতেও, সুন্দরবনের নিস্তব্ধতার মতই তীব্র।

যে কোন মুহূর্তে গল্পের আড্ডা বসানোতে যেমন তাঁর কোন ক্লান্তি ছিল না, ঠিক তেমনই, কারো কোন কাজ-কর্মে বিরক্ত হলে তাকে প্রতিটা সুযোগে ঝাড়ি দিতে দিতে, খোঁচা দিতে দিতে জান কালা করে ফেলারও ওস্তাদ ছিলেন জিয়া স্যার। কোন মাফ নেই, হোক নতুন পরিচিত আর পুরানো।

একটা উদাহরণ দেই। নিজে থেকেই একবার জিজ্ঞেস করলেন সবাইকে,“হরিণের মাংস চলবে নাকি?” আমাদের সাথে এক ভদ্রলোক ছিলেন – আমাদের স্যারের পরিচিত, সাথে এসেছিলেন। উনি উৎসাহের সাথে লাফ দিয়ে সাথে সাথে বলে ফেলেছেন খালি রাজি। আমরা তো পোলাপান। চুপ করে আছি। জিয়া স্যার যা বলবেন তাই এর অপেক্ষা।

ঐ ভদ্রলোক খালি রাজি হয়েছেন – ব্যস। "ক্যানো? হরিণ আর খাসিতে ফারাক বোঝেন? বোঝেন তো না। খামাখা এত খাই খাই ক্যানো? সুন্দরবন দেখলেই সবার খাই খাই শুরু হয়।" এই যে শুরু – পরের কয়েকটা দিন, বেচারার জানা কালা করে ফেললেন ঝাড়ির পর ঝাড়ি দিয়ে, স্রেফ মুখ খুললেই হল। আর খুব একটা কথা বলেন নাই উনি পুরা ট্রিপ!

আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প...ভুলে গেছি অনেক, আর বাকি শুরু করলে, লিখে জাস্টিফিকেশান হবে না। ওনার বলার স্টাইলটা অন্যরকম – ও লিখে প্রকাশ করা আমার সাধ্যের বাইরে। কত গল্প! অ্যানেকডোটের সীমা নাই।

এক রাজাকারকে না মেরে গ্রামের দুইটা এতিম বাচ্চার দায়িত্ব দিয়েছিলেন – সারা জীবন সেই লোক সেই দায়িত্ব পালন করে গেছেন। অনেক গল্পের শেষে এক রাতে বলছেন, কত যুদ্ধ করলাম সুন্দরবনে। কাদা-মাটিতে, রাতের অন্ধকারে, বনে জঙ্গলে। তখন বাঘ এত কম না, মানুষ অহরহ মারা যায়। পাকি মরার ঘটনাও আছে। "কিন্তু কোনোদিন, কোন মুক্তিযোদ্ধা আহতও হয়েছে শুনি নাই। বাঘেও বাংলাদেশ চেনে," বলে মুচকি হাসি।
মুক্তিযুদ্ধের পরও তাঁর যুদ্ধ শেষ হয় নি। সুন্দরবনের ডাকাতের সাথে যুদ্ধ। "আমি এদের বাঁচায় রাখি না। কারণ কি? কারণ এরা এক কেজি চাল, একটা জাল আর এক বোতল সরিষার তেলের জন্য নৌকা থেকে জেলের হাত পা বেঁধে পানিতে ফেলে দেয়। এরা মানুষ না।"

এক ডাকাতের গল্প বলছিলেন। নাম ঠিক মনে নেই। সম্ভবত ময়না ডাকাত। এই নামেই গল্পটা বলি। তাঁর ডাকাত ধরার সাথীরা ছিলেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কমরেডরাই অনেকে। যুদ্ধের পরও তাঁরা জিয়া স্যারের সাথেই ছিলেন। ময়না ডাকাত কুখ্যাত ছিল অনেক কারণে। শয়ে শয়ে জেলে খুন করার, জেলে-পল্লীতে ইচ্ছামত মেয়েদের তুলে নিয়ে ধর্ষণ করার মত বহু জঘন্য কাজের হোতা। পুলিশ ঢুকতে পারে না। কোস্ট গার্ডের প্রতি জিয়া স্যারের কেমন একটা তাচ্ছিল্যই শুনতাম বারবার। "কোন কাজের না।"

সেই ডাকাতকে তার আস্তানায় ঢুকে ধরে আনার পর, ময়না ডাকাত জিয়া স্যারকে তাঁর দলের সামনে অফার দিয়েছে, তার ২০ কেজি স্বর্ণের গয়না লুকানো আছে – তাকে ছেড়ে দিলে সে সেই গয়নার হদিস দিয়ে দেবে। জিয়া স্যার তাঁর বন্ধুদের বললেন, কিরে, কি করা যায়? দিবো নাকি ছেড়ে? অনেক টাকা।

বন্ধুরা কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ ভাবতে শুরু করলো। সাথে সাথে জিয়া স্যার গুলি করে ময়নাকে মেরে ফেললেন - তোরা এই জিনিস নিয়ে ভাবতে পারলি কীভাবে? এত লোভ সোনার? এই নে, জিজ্ঞেস কর ময়নাকে।

এরকম অজস্র গল্প, প্রতিদিন রাতে খাবারের পর, গভীর রাত পর্যন্ত।

কিছুদিন আগে, ধানমন্ডি কফি ওয়ার্ল্ডে ওনার সাথে বহুদিন পর দেখা হয়েছিলো। ছেলেপেলে পরিবেষ্টিত। গল্প করছেন। দেখে চেনতে পারেন নি – কিন্তু নামটা বলার সাথে সাথে চিনলেন। “আরে, তোমাদের মনে আছে। থাকবে না কেন?”

এরকম স্বল্প পরিচয় কত মানুষের সাথে হয়েছে। সবার কথা মনে থাকে না, নেই ও। কিন্তু আজকে থেকে আরও বিশ বছর পরেও, পঞ্চাশ বছর পরেও, বৃদ্ধ বয়েসে কোন অচেনা দেশের, অচেনা গ্রামে, বাইরে তুষার, আগুনের পাশে বসে গরম কফির কাপ হাতে, ঝাপসা দৃষ্টিতে ঠিকই মনে থাকবে বোটের সামনে, সারেং এর ঘরের সামনে, এক ক্রেইট হাইনেকেন পাশে রেখে, গভীর রাত্রে, চোখ বন্ধ করে জিয়া স্যার বলে যাচ্ছেন – “এই, বাঁয়ে চরা আছে একশ ফিট পর। সাবধান। ডানে কাটো সারেং!” নয়তো দুবলার চরে ভোর বেলা লাল সিল্কের ওপর সোনালী ড্রাগনের ছাপ দেয়া ড্রেসিং গাউন আর লুঙ্গি পরে জিয়া স্যার তার পোষা ঈগল জোড়াকে খাওয়াচ্ছেন। পোষা কুমিরের বাচ্চাটার ট্যাংকে উঁকি দিচ্ছেন।

আর মনে থাকবে অসম্ভব যত্ন করা সেই খুলনার বিডিআর কমান্ডার, যার নামটাও এই দুর্বল মাথায় অকৃতজ্ঞের মত নেই। আর বন্ধুর মত হয়ে যাওয়া মেজর দূরুলের কথা। আমাদের সাথে ঢাকা এসেছিলেন। পরের দিন ছিল তাঁদের সেই ভয়াবহ বিডিআরের দরবার। তাঁদের কথা ভোলার উপায় নেই তো।

স্মৃতিগুলোর জন্য, গল্পগুলোর জন্য ধন্যবাদ জিয়া স্যার। ইট ওয়াজ আ প্রিভিলেজ অ্যান্ড অ্যান অনার।

এরাটা: বীর উত্তম খেতাবের তথ্যটা ঠিক করে নিলাম। ধন্যবাদ হিমু ভাই!


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি
মুস্তাফিজ এর ছবি

ছবি দেখা যায় না।

...........................
Every Picture Tells a Story

সংসপ্তক এর ছবি

আবার চেষ্টা করলাম। এখন কি দেখা যাচ্ছে? আমি নিজে সম্ভবত ব্রাউজারের ক্যাশ থেকে এম্নেই দেখতে পাই - তাই বুঝছি না।

.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা

মুস্তাফিজ এর ছবি

যাচ্ছে

...........................
Every Picture Tells a Story

হিমু এর ছবি

অনেক বছর আগে আলবদর সরকারের আমলে টিভিতে এক চালিয়াতি টক শোতে এসেছিলেন। কথাগুলো হুবহু মনে নেই। টক শোর চালিয়াত তাঁকে প্রস্তাব দিলেন, জামাতের কারো মুখোমুখি আগামী কোনো পর্বে বসতে, অন্যেরা নাকি ভয়ে বসতে চায় না। জিয়াউদ্দিন কাঁধ ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলেন। চালিয়াত বাঁকা হেসে জিজ্ঞাসা করলো, এ জন্যে আপনার দলের অনুমতি লাগবে না? জিয়াউদ্দিন মৃদু হেসে বললেন, রাজাকারের কথার প্রতিবাদ করার জন্যে কারো অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন তো নেই।

মেজর জিয়াউদ্দিনের সাহস আর সংকল্প উত্তরপ্রজন্মের মাঝে সঞ্চারিত হোক।

হিমু এর ছবি

মেজর জিয়াউদ্দিন বীর উত্তম ছিলেন না। বীর উত্তম ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউদ্দিন, যাঁকে শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে ১৯৭৪ সালে বাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়। বাংলা উইকিপিডিয়ার ভুক্তিতেও দুই জিয়াউদ্দিনকে গুলিয়ে এক করা হয়েছে দেখলাম।

সংসপ্তক এর ছবি

ধন্যবাদ হিমু ভাই। ঠিক করে নিলাম।

.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা

সোহেল ইমাম এর ছবি

শ্রদ্ধাঞ্জলি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

একজন মুক্তিযোদ্ধা লিডার সম্ভবত এমনই হন। কে কী বললো, কে কী করলো সেসব কিছুর তোয়াক্কা না করে নিজের বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে মানুষের জন্য যা ভালো মনে করেন সেটা করে যান। কর্তা-ডাকাত-খুনী-লুটেরাদের সম্মিলিত ছোটবড় চক্র যখন সুন্দরবন উজাড় করে দিচ্ছে, সাধারণ মানুষ হত্যা করছে, বনের প্রাণী হত্যা করছে তখন তিনি একা রুখে দাঁড়িয়েছেন। আগের বারের মতো দল সংগঠিত করেছেন। খুব সহজে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বা বাইরে, দেশের ভেতরে বা বাইরে নিরুপদ্রব আরামের জীবন বেছে নিতে পারতেন, কিন্তু সেসবকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে যুদ্ধের জীবনকে বেছে নিয়েছিলেন। আসলেই, একজন মুক্তিযোদ্ধা এমনই হন।

আভূমি প্রণাম!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।