দত্তদা

শঙ্কর এর ছবি
লিখেছেন শঙ্কর [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ০১/০৭/২০০৯ - ৯:২৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দাদার হৃদয়-দৌর্বল্য যখন বিপজ্জনক সীমানা পেরোল, কলকাতার সব ডাক্তারেরা পরামর্শ দিলেন, বাইপাসটা করিয়ে নাও। কিন্তু, কলকাতায় বাইপাস করাতে দাদার ভীষণ আপত্তি। আমাকে বলল, 'পিজির ডাক্তারেরা বছরে চারটে কেস পায়, তার মধ্যে দুটো টেবিলেই অক্কা পায়, ডাক্তারেরা আইন বাঁচাতে ICCU-তে নিয়ে গিয়ে অফিসিয়ালি মারে, একটা ICCU অবধি পৌঁছিয়ে সেখানে পটল তোলে, আর যেটা যমের অরুচি, ডাক্তারেরা শত চেষ্টা করেও কিছু করতে পারে না, সেটা বাড়ী ফিরে বিল দেখে হার্ট ফেল করে। আমি ম্যাড্রাসে (তখন মাদ্রাজই ছিল) করাব। আর তোকেও যেতে হবে। আমি তো বিছানায় ধপাস হয়ে থাকব। ডাক্তারদের সাথে ইংরিজীতে কথা বলবে কে?' অতঃপর পরিকল্পনা করে, হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করে, অফিস থেকে তিন হপ্তার ছুটি নিয়ে রাম-সীতার সাথে ভাই লক্ষ্মণও চলল মদ্রদেশের অভিমুখে।

মাদ্রাজে পৌঁছে হোটেলে ঢুকেই প্রথম কথা, 'তিন হপ্তাতো আর হোটেলে থাকার পয়সা নেই, বাড়ীভাড়া খোঁজ।' খোঁজ মানে? নতুন শহর, সন্ধ্যে বেলা কোথায় বাড়ী খুঁজব। একী এক প্যাকেট সিগারেট কেনা নাকি, যে বাইরে গিয়ে কিনে নিয়ে আসব? কে বোঝাবে? কলকাতা থেকে অনেকগুলো ফোন নং নিয়ে এসেছিলাম। আগে সবগুলো লাগালাম, মানে লাগাবার চেষ্টা করলাম। অধিকাংশ নম্বরই বেঁচে নেই। যেগুলো লাগলো, কেউ সেই আত্মীয়কে চিনতেই পারলো না, কেউ বা এখুনি বাইরে চলে যাচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি ... । পরবর্তী হুকুম, কোডাম্বাক্কাম চল, শুনেছি ওখানে অনেক বাঙ্গালী থাকে। Patient যখন impatient হয়ে যায়, তখন কী করা। একটা অটো নিয়ে গেলাম কোডাম্বাক্কাম। অটো থেকে নেমে এদিক-ওদিক ঘুরছি, হঠাত দেখি একটা বাড়ীর দোতলায় লেখা 'TO LET'। দৌড়ে গিয়ে দেখি, দালালের অফিস, বন্ধ হয়ে গেছে। নেমে এসে কানে মধুবর্ষণ হল, দুজনা বাংলায় কথা বলছে। এগিয়ে গিয়ে বললাম, 'দাদা, একটু বিপদে পড়ে গেছি।'

পরে দত্তদা আমায় বলেছিলেন যে উনি প্রথমে ভেবেছিলেন, আমি কিছু পয়সা ভিক্ষে চাইব, আর উনিও সপাটে একটি চড় কষাবেন। যাই হোক, আমার সমস্যাটা শুনে, এবং দাদার সাথে আলাপ করে, বুঝলেন কেসটা জেনুইন। অতএব বলে দিলেন, কাল সকালে আমার সাথে দেখা কর। আমার পাশের ঘরটাই খালি হয়েছে। এই নাও ঠিকানা, আর এই হল ডিরেকশন। দুই ভাই মনের আনন্দে উড়তে উড়তে বাড়ী চলে এলাম।

পরের দিনই গৃহপ্রবেশ করলাম। পাশের ঘরটাই দত্তদার। সামনে কমন বারান্দা। দত্তদা
একাই থাকেন। ওনার রান্নাঘরটাও বৌদিকে ছেড়ে দিলেন, আর আমরা এক বর্ণ তামিল না জেনেও কি সুন্দর মেথির শাক, পটলের ঝোল, বেগুনের ঝাল খেতে লাগলাম। দত্তদার একটু জলপথে গমনের অভ্যেস ছিল। দাদাকে প্রায়ই বোঝাতেন, 'ডাক্তারবাবু, সিগারেটটা ছেড়ে দিন। বরং একটু হুইস্কি ধরুন।'

দাদা হাসপাতালে ভর্তি হলেন, আর দাদাকে দেখতে গিয়ে দত্তদার মনে পড়ল ওনার নিজের পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে কিছুদিন ধরে কয়েকটা কালো স্পট দেখা যাচ্ছে। ডাক্তারবাবু যদিও ওগুলো কিছুনা বলে উড়িয়ে দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু দত্তদার পীড়াপিড়িতে একটা রক্ত পরীক্ষা করার ব্যবস্থা হল, সাধারণ TC, DC ইত্যাদি। দত্তদা নিমরাজী হয়ে সেই প্রেস্কৃপশনটা পকেটে নিয়ে বেড়িয়ে এসে নিজে হাতে তার পাশে লিখে দিলেন, and Cholesterol. হাস্পাতালের ল্যাবেই রক্তদান করে রসিদটা আমাকে দিয়ে গেলেন, বিকেলে রিপোর্ট আনার জন্য। বিকেলে রিপোর্ট নিয়ে এলাম। সব ঠিক আছে। দত্তদা রিপোর্ট দেখে আমাকে ভয়ানক আওয়াজ দিলেন, 'কি রিপোর্ট নিয়ে এলে হে শঙ্কর। সবই দেখছি নীল।'

খুব রাগ হল। রোজ রোজ আওয়াজ খাই। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, 'দাঁড়ান, কাল
আপনাকে লাল দেখাব।'

পরের দিন বিকেল চারটে নাগাদ রিপোর্ট নিয়ে দেখি কোলেস্টেরল ৪১০। সাধারণ টাইপ-রাইটারে টাইপ করা। দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'এটা কি খুব বেশী?' দাদা বলল, 'দত্তদা জানতেন না, কোলেস্টেরল পরীক্ষা করতে গেলে বারো ঘণ্টা উপোস করে থাকতে হয়। সংখ্যাটা ভীষণ বেশী।'

মনে মনে বললাম, 'দাঁড়াও, এবার তোমার নীল রিপোর্ট লাল করে দেব।'

রিপোর্ট হাতে বেরোলাম। অনেক খুঁজে একটা টাইপরাইটার পাওয়া গেল। টাইপিস্ট
ভদ্রলোক বাড়ী যাচ্ছিলেন। তাকে বোঝালাম, আমার এক বন্ধুর অত্যধিক মদ্যপানের
নেশা। সংসারটা ভেসে যাচ্ছে। এই তার রক্ত পরীক্ষার ফল। যদি তিনি দয়া করে এক
লাইন লিখে দেন, "মদ্যপান করা বারণ" তাহলে হয়তো সংসারটা বেঁচে যাবে।' ভদ্রলোক আমার বিনয়ে গলে গিয়ে টাইপ করে দিলেন। পাছে ওটা হাতে হাতে দেওয়ার সময় হেসে ফেলি, তাই বৌদিকে দিলাম হস্তান্তরের জন্য। বৌদি বেচারী ভালো মানুষ। কিছু না জেনেই ভালো মনে দত্তদাকে কাগজটা ধরিয়ে দিলেন।

'ব্যাটারা জানলো কি করে, যে আমি মদ খাই?' এই বলেই দত্তদা চুপ। দাদার কাছে গিয়ে একবার জিজ্ঞেস করলেন, 'ডাক্তারবাবু, কোলেস্টেরলটা কি খুব বেশী?' আমি যদি কাঠি হই, তো আমার দাদা গোটা বাঁশ। হাসপাতাল থেকে রোগীদের অনেক কাগজপত্র দেয়। সেগুলো দেখিয়ে প্রমাণ সহকারে বুঝিয়ে দিলেন, ভীষণ বেশী। দত্তদা মনের দুঃখে বলতে বলতে বাড়ী চললেন, 'আর কি রইল এ জীবনে (দীর্ঘশ্বাস)।'

বাড়ী ফিরেও চুপ করে বসে রইলেন। এক ছোকরা আসলো। জলপথের সঙ্গী।
- কি খবর দত্তদা, একশ চার জ্বর নিয়ে শুয়ে ছিলাম, একবার তো খোঁজও নিলেন না
- তোমার তো ভাই, একশ চার, আমার চারশ দশ।
বেচারী জ্বরের ডিগ্রী শুনে পালিয়ে গেল। ধীরে ধীরে সবাই জেনে গেল, দত্তদা মদ্যপান
ছেড়ে দিয়েছেন। ঠেকটাই উঠে গেল।

পাঁচ বছর পর দাদাকে দেখতে দত্তদা কলকাতায় এসেছিলেন। তখন দাদা তাকে আসল গল্পটা খুলে বলে। কিন্তু ততদিনে দত্তদা নিরামিষাশী হয়ে গেছেন।

নীতিকথা - পরের উপকার কর না। দত্তদা আমাদের উপকার করেছিলেন, আমি তার জবাব দিয়েছি। আমি এত বড় একটা কাজ করলাম, একটা মদের ঠেক তুলে দিলাম, সরকার আমাকে এক বোতল হুইস্কিও দিল না!!!!


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

সেই বাড়ি থেকে কারণবারি অকারণে বাড়ি মেরে বার করে দিলেন।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

ফকির লালন এর ছবি

খাসা।

খেকশিয়াল এর ছবি

হাহাহা জটিল!

------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

সাইফ তাহসিন এর ছবি

'ডাক্তারবাবু, সিগারেটটা ছেড়ে দিন। বরং একটু হুইস্কি ধরুন।

জটিলস্য জটিল গড়াগড়ি দিয়া হাসি

ব্যাপারটা অনেকটা এরকম হয়ে গেল না? ২ দোস্ত আড্ডা মারছে, "দোস্ত, সিগারেট খাইস না, ফুসফুসে ক্যান্সার হয়!! অন্যজন বলে, দোস্ত, এজন্যেই তো খালি গাঞ্জা খাই!!"

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

...অসমাপ্ত [অতিথি] এর ছবি

হাসি ... আহারে দত্তদা।

এনকিদু এর ছবি

একটা মদের ঠেক তুলে দিলাম, সরকার আমাকে এক বোতল হুইস্কিও দিল না!!!!

আপনি বেকারত্ব বাড়িয়েছেন, উল্টা জরিমানা করা দরকার ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

পড়তে মাঝে মাঝে যদিও অমসৃন ঠেকছিল, গল্পটা ভালো লাগলো।

ওয়াইল্ড-স্কোপ [অতিথি] এর ছবি

হে হে! নিলক্ষেত-ই আমাগো বাঙ্গালির চরিত্র নস্টের মুলে। জালিয়াতির জব্বর গল্প। থ্যাঙ্কস ফর শেয়ারিং।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

হা হা হা
ভাল্লাগলো।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

তুলিরেখা এর ছবি

লেখা খুব ভালো লাগলো।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

রণদীপম বসু এর ছবি

হা হা হা ! কোলেস্টেরল কী !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

শঙ্কর [অতিথি] এর ছবি

রণদীপম, কোলেস্টেরল অনেকটা স্বর্গরাজ্যের আপেলের মত। যতদিন জানতে না পারবেন, ততদিনই ভাল। হঠাত করে একদিন এক শয়তান ডাক্তার আপনাকে জানিয়ে দেবে, আর আপনিও রেওয়াজী খাসির মাংস আর ভাজাভুজির স্বর্গ থেকে নির্বাসিত হয়ে প্যালারামের মত শিঙ্গি মাছ দিয়ে পটলের ঝোল খাওয়া শুরু করবেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।