কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে দশটায় মিটিং রুমে ঢুকেই যেন একটা বিপদের গন্ধ পেল বিদেশ। কষাইখানায় ঢুকলেই ছাগলেরাও বোধ হয় এই গন্ধটাই পায়। টেবিলের শেষ মাথায় সদা হাসিখুশী মিঃ বেয়ার ভয়ানক গম্ভীর মুখে বসে। বাকীরাও সবাই চুপচাপ। দশ মিনিটের মধ্যেই মিটিং শেষ। অর্থনৈতিক মন্দার জন্য প্রোজেক্ট তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে, সবাইকে আগামী পনের দিনের মধ্যে দেশে ফিরে যেতে হবে।
একটি কথা না বলে সবাই মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে এল। এবার দল বেঁধে বাড়ী ফেরার পালা। দেশের ম্যানেজারকে এখুনি মেল করতে হবে, গাড়ীটা বেচতে হবে, প্লেনের টিকিট বুকিং করতে হবে, বাড়ীওয়ালাকে নোটিশ পাঠাতে হবে - হাজারো কাজ। তারপর এখন থেকেই নতুন প্রোজেক্টের জন্য চেষ্টা করতে হবে, পরের প্রোজেক্টটা আবার কোথায় হবে কে জানে। ইউরোপ বা আমেরিকা হলে ভাল, আর যদি দেশে থেকে যেতে হয় তাহলেই কেলোর কীর্তি। বিদেশ জানে, আকাঙ্খাকে ফোন করলে ফোনের মধ্যেই কাঁদতে বসবে।
- হ্যালো আকাঙ্খা?
- হ্যাঁ বলো।
- একটা খারাপ খবর আছে। প্রোজেক্ট শেষ হয়ে যাচ্ছে। পনের দিনের মধ্যে বাড়ী ফিরে যেতে হবে।
- সে কি গো? হঠাত কেন?
- অর্থনৈতিক মন্দা। ক্লায়েন্টের পয়সা নেই। কাজ খতম।
- তা হলে কি করব এবার?
- কি আবার করবে? প্যাকিং শুরু কর। বাড়ীওয়ালাকে আমি মেল করে দিয়েছি। গাড়ীটা বেচার ব্যবস্থা করছি। বিকেলে টিকিট কেটে ফেলব।
- তারপর? দেশে?
- হ্যাঁ, বছর খানেক তো থাকলে। ভালই তো থেকেছ। পয়সাও কিছু হয়েছে। এবার বাড়ী।
- সেটাই তো বলছি। ফিরে গেলে সেই তো লোডশেডিং, গরম, ধূলো-ময়লা, ট্র্যাফিক জ্যাম, ভীড়, পকেটমার, কাজের লোকের অসুবিধা, ভারতীর স্কুলে ভর্তি - হাজারো একটা ঝামেলা। আমি পাগল হয়ে যাবো।
- হ্যাঁ, তারপর পরের প্রোজেক্ট আবার কোথায় পাবো কে জানে?
- মানে দেশে থাকতে হবে? অসম্ভব। আমি কিছুতেই পারবো না। তুমি আবার আরেকটা অন্য কোথাও চেষ্টা কর। হন্ডুরাস থেকে হনলুলু, যেখানে খুশি, কিন্তু দেশে কিছুতেই নয়।
- দেখি চেষ্টা করে, বিদেশ ফোন রেখে দিল।
সত্যি, দেশে ফেরার কথা ভাবলেই মাথা খারাপ হয়ে যায়। এত সমস্যা। আর কিছুদিন এই সব দেশে থাকলে বড়ই খারাপ অভ্যেস হয়ে যায়। এখানে সব কিছুই কি সুন্দর মসৃণ ভাবে চলে। আজকাল দেশে ফেরার কথা ভাবলেই গায়ে জ্বর আসে। আকাঙ্খা সেদিনও বলছিল, যদি এখানেই বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম।
কোনমতে কাজ শেষ করে বাড়ীর পথ ধরল বিদেশ। মাথা-ভর্তি দুশ্চিন্তা আর বিরক্তি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই ভারতী এল লাফাতে লাফাতে, 'বাপি, বাপি। একটা নতুন কবিতা মুখস্থ করেছি। শুনবে?'
মেয়েটাকে ভীষণ ভালবাসে বিদেশ। যত টেনশনই থাক, হাসিমুখে বলল, 'কি কবিতা মা?'
'শোন', অনেক অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে নাচতে আবৃত্তি শুরু করল ভারতী।
'সার্থক জনম আমার, জন্মেছি এই দেশে ...'
মন্তব্য
ছোটো গল্পের এই এক সমস্যা - "শেষ হইয়াও হইল না শেষ"
দারুণ গল্প। শুধু চরিত্রগুলোর নাম একটু কেমন কেমন লাগলো
বাহ্ ! এমন চমৎকার বৈপরিত্য নিয়েই তো আমাদের চলমানতা.....
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
আকাঙ্খার বিদেশ অথবা বিদেশের আকাঙ্খা, আর ভবিষ্যৎ ভারতী...
সুন্দর গল্প!
- বেশ দারুণ
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ভালো লাগলো ঠিক বলতে পারছি না, মতের বিপক্ষে কিনা, তবে লেখা ভালো, কোন সন্দেহ নাই।
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
ভাল লাগলো। এটাই বাস্তব।
আপনার গল্প সবকটাই পড়েছি এবং ভালো লেগেছে। এতো ছোটো পরিসরে এমন চমৎকার লেখা দুরূহ কাজ, মানতেই হয়।
গত সপ্তাহে বিদেশ নয়, খবরটা আমিই পেয়েছি। গল্পটা তখনই মনে এসেছিল। শুক্রবার সকালে গিন্নীকে নিয়ে এক দাঁতুড়ের কাছে যাবার কথা। আমার অবস্থা তখন অধিকাংশ সচলদের মত। গল্প শেষ হচ্ছে না, এদিকে appointment-এর সময় হয়ে গেছে। কোনমতে নামিয়েই দে ছুট।
সব্বাইকেই বিলম্বিত ধন্যবাদ।
পিপিভাই, বিদেশটাই অনেকের আকাঙ্খা থাকে। আরে আমার অনেক বন্ধুকেই দেখেছি, প্রচুর অনিচ্ছা সত্বেও বৌয়ের চাপে বিদেশে গেছে এবং থাকতে থাকতে রয়ে গেছে, যদিও তাদের মনের ভেতরে দেশের জন্য একটা টান সুপ্ত রয়ে গেছে। নামকরণগুলো ওই ভেবেই করা। পরে সুয়োগ পেলে তাদের কারো কারো কথা বলব। আর আজকাল বাবা-মায়েরা যে রকম অভিধান ঘেঁটে নাম খুঁজে বের করে, তাতে এগুলো তো অনেক সোজাসাপটা নাম।
সাইকভাই, কোথায় তোমার আমার মত মিললো না, আগে শুনি। না মেলাটাই স্বাভাবিক, আমাদের দুজনার অভিজ্ঞতাইতো আলাদা। তাই জানার ইচ্ছে রইল।
এই গরমের ছুটিতে সময় পেয়ে আপনার লেখাগুলো একটু দেরীতে হলেও পড়তে বসলাম। বেশ ভাল লাগছে।
আমরা একই বাথানের গরুরে ভাই, কারো এই গোয়ালে আর কারো ঐ গোয়ালে বাসা। আশা করি যেন খুব শীঘ্র মুনশেনেই নতুন প্রজেক্ট মিলে যায়।
নতুন মন্তব্য করুন