জুনের প্রথম সপ্তাহ। এখনও বর্ষা আসেনি। এই সময় দুপুরবেলা সমস্ত জানলা বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করে মেঝেতে মাদুর পেতে ফ্যান চালিয়ে ঘোলের শরবত খেতে খেতে মান্না দে-র গান শুনতে ইচ্ছে করে - প্রখর দারুণ অতি দী-ই-র্ঘ দগ্ধ দিন। জয়েন্টে ভাল রেজাল্ট করার জন্য গতকাল বাবার কাছ থেকে একটা নতুন মোবাইল পেয়েছি। নোকিয়ার লেটেস্ট মডেল। সহজে পাইনি, প্রায় দিন পনের মায়ের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে অনেক কষ্টে আদায় করা গেছে। তা হোক, শেষ পর্যন্ত পাওয়া তো গেছে। কলেজ খুললে অন্ততঃ জয়িতা, ভাস্কর, রীনাদের কাছে মুখ দেখানো যাবে। উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে মোবাইলটা নিয়েই খুটখাট করছিলাম। কি কি ফীচার আছে, কিভাবে সেগুলো খুঁজে পাওয়া যায়, কিভাবে ডিসপ্লে বদলানো যায়, এই আর কী।
নীচে কলিং বেল বাজলো। মা দরজা খুললেন শুনতে পেলাম। তারপরই খুশি খুশি গলায়, 'ও লব, আয়।' তার মানে ছোটকারও গরমের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। একটু পরেই ছোটকা ঘরে ঢুকল।
- কি রে ডঙ্কা, কি করছিস?
- এই নতুন মোবাইলটা নিয়ে খুটখাট করছিলাম।
- মোবাইল? সবে তো কলেজ যাওয়া শুরু করলি, এর মধ্যেই মেজদার পকেট কাটা শুরু করেছিস? কোন মডেল, দেখি? এমা, নোকিয়া ৭৯৫১? কেলোর কীর্তি। কালকেই এটার সম্বন্ধে একটা ব্লগে পড়ছিলাম।
- কি পড়ছিলে? আমি কিনেছি? নাকি এই মডেলটা ফ্লপ করেছে?
ছোটকাকে জানি তো। চিমটি কাটার একটু সুযোগ পেলে ছাড়বে না। আই.আই.টি থেকে এম.টেক করছে বলে এমন ভাব দেখায় যেন মাথা কিনে নিয়েছে। আর বাবা-মাও ওকে এত লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে। এটা মানি যে আমার জয়েন্টের ভালো রেজাল্টের পেছনে ছোটকার অনেকটাই অবদান আছে, কিন্তু সব সময়ে এত জ্ঞান হজম করাও পোষায় না।
'কোনটাই নয়', ছোটকা গম্ভীর মুখে বলল, 'জানিসতো ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির লোকেরা সুযোগ পেলেই আমাদের ওপর বেশ কিছু এক্সপেরিমেন্ট করে নেয়, আমাদেরকে না জানিয়েই। মানে আমাদের অনেকটা গিনিপিগের মত ব্যবহার করে থাকে আর কি। নোকিয়ার এই মডেলটাতে ওরা একটা নতুন ধরনের বিজ্ঞাপনের স্টাইল নিয়েছে। নর্মাল কথাবার্তা চলার সাথে সাথে একটা আল্ট্রাসোনিক ওয়েভে মিউজিক বাজবে। তুই সেটা শুনতে পারবি না, বা বুঝতেও পারবি না - কিন্তু তোর সাব-কনশাস মাইন্ড সেটা রিসীভ করবে।'
- তার মানে তুমি বলতে চাইছ যে আমার সাব-কনশাস মাইন্ড ওই আল্ট্রাসোনিক বিজ্ঞাপন শুনে সিদ্ধান্ত নেবে নাইকের জুতো কিনবে না আদিদাসের গেঞ্জী? তা নাইকের জুতো কি ৪৫৬ মেগাহার্জে আরে গেঞ্জী ৩২০ মেগাহার্জে সেট করা থাকবে? আর আমার সাব-কনশাস মাইন্ড সেটা জানবেই বা কি করে? কোন মেগাহার্জে কোন প্রোডাক্ট কিভাবে বুঝবো?
- আমি তো এগুলো কিছু বলতে চাইনি। তুই অফ-ট্র্যাক রেলগাড়ী ছুটিয়েছিস, তাও কোন স্টেশনে না থেমেই দৌড়চ্ছিস তো আমি কি করতে পারি। মোবাইলে একটাই বাজনা থাকবে। তুই রোজ শুনতে শুনতে ওই বাজনাটার নেশায় পড়ে যাবি। তখন তোর কাজে-অকাজে সব-সময় মোবাইলটা চালাতে ইচ্ছে করবে। কথা বলবি, রেডিও শুনবি, গান শুনবি - একটার পর একটা। আর যত মোবাইল অন রাখবি, ততই ওদের ইনকাম।
'রান্না হয়ে গেছে, তোরা এবার চান করে নে' বলতে বলতে মা ঘরে ঢুকলেন। আমি এই সুযোগে মোবাইলটা বুক-পকেটে ঢোকালাম। ছোটকাও হাঁ হাঁ করে আমার বুক-পকেট আক্রমণ করল, 'মোবাইল কখনো বুক-পকেটে রাখতে আছে? জান মেজবৌদি, যখন কল আসে, তখন কোন ওয়েভ-লেংথে আসে কে জানে? বৈজ্ঞানিকরা এখনও মনে করেন, রেগুলার হার্টের কাছে এই ধরনের কল আসা ভাল নয়। এখনও রিসার্চ চলছে, এতে হার্ট এটাকের সম্ভাবনা কতটা বেড়ে যেতে পারে।' এই বলে আমি কিছু বলার আগেই মোবাইলটা নিয়ে নিজের জিনসের পকেটে ঢুকিয়ে নিল।
খেয়েদেয়ে একটু গড়িয়ে নেওয়ার পর ছোটকা প্রস্তাব করল একবার গড়িয়াহাট যাবে। আমার কোনও আপত্তি নেই। বিকেলবেলা গড়িয়াহাটে সুন্দরী মেয়েরা ভিড় করে থাকে। করুণাময়ী থেকে একটা শাটল মারুতি ভ্যানে চাপলাম। এখন অফিস ছুটির সময়। দু-মিনিটের মধ্যে গাড়ী ভরে গেল। সবার শেষে উঠলো একটা মেয়ে। আমার থেকে দু-এক বছরের বড়ই হবে। মনে হয় কোন কল-সেন্টারে চাকরী করে। সে একটা মোবাইল কানে নিয়ে বকবক করতে করতে উঠল। একদম আমার মোবাইলের মডেল। আমি ছোটকার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে হাসলাম। ভাবখানা, দেখেছ, একই মডেল।
গাড়ী ছেড়ে দিল। প্রায় আধ ঘন্টার পথ। গাড়ীতে সবাই চুপ। শুধু ওই মেয়েটা বকবক করেই চলল। কোন এক বন্ধুকে সারাদিনের ডায়েরী শোনাচ্ছে। কার সাথে কি কথা হয়েছে, কি দিয়ে লাঞ্চ করল, বস আজ ওকে কি বলেছে, ও তার জবাবে কি শুনিয়ে দিয়েছে। নন-স্টপ বাংলা র্যাপ। আশেপাশের লোকজনের যে অসুবিধে হচ্ছে, সে ব্যাপারে পুরো উদাসীন। গাড়ী গড়িয়াহাট পৌঁছলে আমরা নেমে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সে কথা বলতে বলতেই ভাড়া মিটিয়ে চলে গেল। এবার ছোটকার হাসবার পালা। কি রে কি বলেছিলাম।
রাতে খাবার টেবিলে বসে বুঝলাম, কলেজে ঢোকার পর থেকে বাবা আমাকে একটু বড় বলে ভাবছেন। ছোটকাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'লব, তোর তো এখন সামনে পরীক্ষা, তুই কি ফ্রী আছিস?'
- তেমন নয়, তবে কি করতে হবে বল?
- না বড় কাজ নয়। মনে হয় ডঙ্কাই করতে পারবে। ওর তো এখন 'ফার্স্ট ইয়ার, ডোন্ট কেয়ার' চলছে।
- 'মানে?' আমি প্রতিবাদ জানালাম 'আজ সন্ধ্যেবেলাতেও ফিরে থার্মোডিনামিক্সের ছটা অঙ্ক নামিয়েছি।'
- আচ্ছা, আচ্ছা। আমি কি বলেছি তুই পড়াশুনো নেগলেক্ট করছিস? আমি বলতে চাইছি, লবর সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা, তোর তো এখনও দেরী আছে।
- 'কাজটা কি সেটা বলবে তো', মায়ের উষ্মা প্রকাশ পেল, 'তখন থেকে তুমি খালি ভূমিকাই করে চলেছ।'
- 'জার্মানী থেকে আমার বিজনেস ক্লায়েন্ট হের ড্রেক্সলারের মেয়ের বান্ধবী আসবে কালকে। দিন তিনেক থাকবে কলকাতায়। আমাদের বাড়ীতেই থাকবে। ও ফুড টেকনোলজি নিয়ে পড়াশুনো করছে। এখানকার কিছু কিছু খাবার-দাবারের ব্যাপারে বোধ হয় খোঁজ খবর করবে। ওকে একটু কলকাতাটা দেখিয়ে দিতে হবে। মানে কোথায় কি ভাবে যেতে হবে ও তো আর জানে না।'
আমি তো টাশকি খেয়ে পড়লাম। এক কথায় জার্মান ছুকরী। এই সুযোগ কেউ ছাড়ে?
- কোন অসুবিধা হবে না, বাবা। দু-তিন দিনেরই তো ব্যাপার। আর আমার তো এখন কলেজ ছুটি-ই চলছে।
- আমারও তাই মনে হয়। আর এখন তো তোর অসুবিধা নেই। ঝামেলা হলে আমাকে তোর মোবাইল থেকেই কল করে নিবি।
- ও হরি। এই জন্য তুমি মোবাইল কিনে দিতে আপত্তি করনি, বিজনেস বেনিফিট।
বাবা মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। ছোটকা গম্ভীর মুখে খেতে লাগলো। যেন এই সব তুচ্ছ বিষয়ের সে একদম উর্দ্ধে। আমি তো জানি, ভেতরে ভেতরে কি হিংসেটাই না হচ্ছে।
পরের দিন সন্ধ্যেবেলায় ক্যারোলিন ফুক্সের সাথে পরিচয় হল। আমার থেকে দু-তিন বছরের বড়। স্টেপ-কাট সোনালী চুল, নীল চোখ দুটো সব সময় যেন হাসছে। ও এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এসে বাবার অফিসে উঠেছিল। বাবার সাথেই আমাদের বাড়ীতে এল। উত্তর দিকের গেস্ট রুমে তার থাকার বন্দোবস্ত করা আছে। পরিচয় শেষ হলেই সোজা ঘরে ঢুকে গেল। বাবা বললেন, 'বেচারী টানা দশ ঘন্টার জার্নি করে এসেছে। নিশ্চয়ই ভীষণ টায়ার্ড।'
খাবার টেবিলে ভালো করে কথা হল। ও ফুড-টেকনোলজি নিয়ে বি-টেক পড়ছে। জার্মানীতে এখন ইন্ডিয়ান ফুডের ভীষণ কদর। প্রায় প্রতি পাড়ায় একটা ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ। কিন্তু সেগুলো সব ইন্দো-জার্মান খানা বানায়। মানে ঝাল কম, মশলা কম - অনেকটা জার্মানদের উপযুক্ত করে বানানো। ও এখানে এসেছে, এই সব খাবারের আসল স্বাদ পেতে এবং এদের লোকাল রেসিপি জানতে।
'কিন্তু, রেসিপি তো আপনি ইন্টারনেটেই পেয়ে যেতেন', ছোটকা ফুট কাটলো। আমি তো জানি, সঙ্গ দেবার এমন সুযোগটা ফস্কে যাওয়ায় ও আমার বেড়াবার পথে এখন কাঁটা মারতে উঠে পড়ে লেগেছে। 'আর সেগুলো সেই অনুযায়ী বাড়ীতেই বানিয়ে নিতে পারতেন।'
- 'ঠিক কথা। কিন্তু একেই আমি জঘন্য রাঁধুনী। তার ওপর অরিজিন্যাল স্বাদটা না খেলে বুঝবো কি করে ঠিক রাঁধলাম না ভুল রাঁধলাম?'
- 'অকাট্য যুক্তি', বাবা বলে উঠলেন, 'তাহলে ক্যারল, তুমি এখানে কি কি টেস্ট করবে তার কি কোন লিস্ট করে এনেছ, নাকি শঙ্করের সাথে বসে ঠিক করবে?
- না মিঃ গাঙ্গুলী। আমি লিস্ট করেই এনেছি। শুধু শঙ্করের সাথে কাল সকালে বসে ট্যুর প্ল্যানটা ফাইনাল করে নেব।
'দেখতে মন্দ নয়। আমার ছোটকাকিমা হলে মন্দ হত না, কি বল?' রাতে শোয়ার সময় ছোটকাকে একটা ছোট্ট চিমটি দিলাম।
- তোদের হয়েছে এই এক দোষ। মেয়ে দেখলেই প্রেমে পড়ে যেতে হবে। এতোক্ষণে বোধহয় তিন-চারটে খুড়তুতো ভাই-বোনেরও স্বপ্ন দেখে ফেলেছিস। আরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানীর অধিকাংশ পুরুষই পটল তুলেছিল। ওদেশে এখনও ছেলের থেকে মেয়ের সংখ্যা বেশি। ও সব দেশে ছেলেরা মেয়ে পটায় না, মেয়েরাই ছেলেদের পেছনে ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়ায়। সারারাত এখন নীল চোখের স্বপ্ন দেখ, সকালে চায়ের টেবিলে দেখা হবে।
******************************************************
আজ সকালে হৈ হৈ খবর। কে.এফ.সি. নাকি খাবারে প্রচুর পরিমাণে প্রিজারভেটিভ দিচ্ছে, তাই দিল্লীতে জনগণ কে.এফ.সি-র দোকানে ভাংচুর করেছে। খাবার টেবিলে আমরাও এই নিয়ে প্রচুর বকবক করলাম, ছোটকা, ক্যারোলীনকে জি্জ্ঞেস করল, আজিনোমোতো জিনিসটা কি, তার অতিরিক্ত ব্যবহারে মানবদেহে কি কি ক্ষতি হতে পারে। সে দেলাম এই ব্যাপারে বেশি কিছু জানে না। বলল, জার্মানীতে এই ধরণের প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা বে-আইনী, কাজেই তার এই সব বিষয়ে বেশি জানা নেই।
ব্রেকফাস্টের পর ছোটকাকে আরো গম্ভীর বানিয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। ক্যারোলীন মাকে বলে এল, সব খাবারই তো অল্প করে টেস্ট করা হবে, বাকিটা আমরা প্যাক করে বাড়ীতে নিয়ে আসবো। কাজেই মা যেন রাতের রান্না না করেন, ওই খাবারেই চলে যাবে। মা তো খুব খুশি। এই কদিনের রান্নার ঝামেলা থেকে মুক্তি।
সারাদিন ধরে দক্ষিণ কলকাতার প্রায় পনের-ষোলটা রেস্তোরাঁ ঘুরলাম আমা। সব জায়গাতেই বিভিন্ন ধরণের খাবারের অর্ডার দিল ক্যারল। ও একটা অদ্ভুত ধরণের মোবাইল এনেছে। সব খাবারের ছবি তুললো, একদম কাছ থেকে, স্ক্রীনে টাচ করে করে। এটা নাকী একটা নতুন ধরণের মোবাইল। এতে একটা বিল্ট-ইন পকেট মাস স্পেক্ট্রোমিটার আছে, খাবারের কেমিক্যাল এন্যালিসিস করে তাতে কি কি কম্পোনেন্ট আছে, বের করে ইন্টারনাল কম্পুটারে রেকরড করে রাখে। আমরা ভবানীপুরের ল্যাচা, বাঞ্ছারামের পরোটা, কে.সি.দাশের রসগোল্লা, বেদুইনের চিকেন রোল এবং আরো অনেক কিছু খেয়ে, আর বেশির ভাগটাই প্যাক করে সন্ধ্যে বেলা বাড়ী ফিরলাম।
রাতের খাওয়াটা একটু অদ্ভুত ধরণের হল। বিভিন্ন দোকানের অল্প অল্প স্যাম্পল সব। সবাই এক টুকরো পরোটা, সিকি খানা ল্যাচা, আধখানা পুরি, এক কামড় চিকেন রোস্ট এই সব মিলিয়ে মিশিয়ে খেলাম। ছোটকা ক্যারলকে জি্জ্ঞেস করল, সে জার্মানীর কোথা থেকে এসেছে। ক্যারল মিউনিখ থেকে এসেছে শুনে বললো, আজ নাকি মিউনিখে একটা ছোট খাটো ভুমিকম্প হয়ে গেছে। ক্ষতি তেমন কিছু হয় নি। শুধু পশ্চিম মিউনিখে, চিড়িয়াখানার পাশে, আঞ্জেল অফ পিস নামে একটা মুর্তি ভেঙ্গে পড়েছে। ক্যারল খেতে খেতে নির্বিকার মুখে সব শুনলো। এদের বোধ হয় দেশপ্রেম ব্যাপারটা আমাদের মত নয়। আমরা এই সব শুনলেই কেমন আঁতকে উঠি, খোঁজখবর করি, তেমন কিছুই দেখলাম না।
খাওয়ার পরে ছোটকা বলল, ও একটু রাত জাগবে। আমি ঘুমিয়ে পড়তে পারি। আমিও সারাদিন ঘুরে ঘুরে বেশ ক্লান্ত বোধ করছিলাম। সোজা বিছানায়। দেখলাম, ছোটকা আমার পিসিটা খুলে ইন্টারনেট চালিয়ে গুগুলবাজি করছে।
রাতের ঘুমটা ভালো হয় নি। ছোটকা অনেক রাত অবধি পিসি খুলে বসেছিল। মনিটরের আলোয় মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল। ঘুমের ঘোরে বোধ হয় ওকে কয়েকবার ফোন করতেও শুনলাম। তারপর, কখন যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছি, খেয়াল নেই। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেলাম, ক্যারল আর আমি একটা দূর দ্বীপে বসে আছি। আমার খুব খিদে পেয়েছে। আর ও হেসে হেসে বলছে, 'এই মোবাইলটার স্ক্রীণটা চেটে নাও, খিদে মিটে যাবে।'
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখি, ছোটকা অনেক আগেই উঠে পড়েছে। ওর দাঁতমাজা, দাড়ি কামানো সব শেষ। একটু উত্তেজিত লাগলো। বারান্দায় পায়চারি করে, আর বারে বারে ক্যারলের ঘরের দিকে দেখে। আমি বুঝলাম, আজকে আর ছোটকা আমাদের সঙ্গ ছাড়বে না। কোন না কোন একটা উপায় ঠিক আমাদের সাথে জুড়ে যাবে।
ব্রেকফাস্ট শেষ হতে না হতেই কলিং বেল বাজলো। আমিই গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দরজার সামনে একগাদা পুলিশ। একদম সামনের ভদ্রলোকই জি্জ্ঞেস করলেন, 'আপনিই মিঃ সংকর্ষণ গাঙ্গুলী?'
'আমি সংকর্ষণ। আপনাদের আমিই ফোন করেছিলাম', পিছন থেকে ছোটকা বলল, 'আর উনিই হচ্ছেন ক্যারোলীন ফুক্স।'
'গুড মর্ণিং মিস ফুক্স। আপনাকে একটু আমাদের সাথে পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে। কিছু কথা-বার্তা জানার আছে আপনার কাছ থেকে', পুলিশ অফিসার ক্যারলের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আমরা কাল রাতেই আপনাদের কনসুলেটের সাথে যোগাযোগ করেছি।'
- 'থ্যাঙ্কিয়ু, মিঃ গাঙ্গুলী' ছোটকার দিকে ফিরে বললেন তিনি, 'এই ধরণের হেল্পই তো আমরা চাই।'
- ও কিছু না। আমার একটু সন্দেহ হয়েছিল মাত্র। তারপর আমাদের ইন্সটিটিউটের প্রফেসর শর্মা, আর এল.এম.ইউয়ের প্রোফেসর ল্যাস্কের কথায় পুরো ব্যাপারটাই পরি্ষ্কার হয়ে গেল।'
পুলিশরা চলে গেছে। আমরা সবাই তখনও হাঁদার মতো তাকিয়ে আছি দেখে ছোটকা মুচকি হেসে বলল, 'বাকি কথাটা না হয় জল-খাবারটা খেতে খেতেই বলা যাবে।'
'ক্যারল এখানে সত্যি এসেছিল খাবারের খোঁজে। তবে সে কোন ফুড-টেকের ছাত্রী নয়। কোন এক কোম্পানীর হয়ে ও খবর নিচ্ছিল। ভারতীয় খাবারের চাহিদা তো এখন বিশ্বজোড়া। ওরা এই সব খাবারের, রেসিপি, স্বাদ, গন্ধ সব কপি করে পেটেন্ট নেওয়ার চেষ্টা করছিল। একবার পেটেন্ট নিতে পারলেই, মহারাণীর সিঙ্গাড়া বেচতে গেলে খোদ মহারাণীকেই ওদের অনুমতি নিতে হত। অন্যে পরে কা কথা। আমার প্রথম সন্দেহ হল, ও যখন দেখলাম আজিনোমোতোর নামই জানে না। এটা একটা খুব কমন প্রিজারভেটিভ। মেজবৌদিকেও বোধ হয় মাঝে মাঝে ব্যবহার করতে শুনেছি। আর ফুড-টেকের একটা মেয়ে নামই শোনেনি? তারপর, কাল মিউনিখের খবরেও ওর কোন ভাবান্তর দেলাম না। আমি ইচ্ছে করেই দুটো মি্থ্যে কথা বলেছি। মিউনিখের চিড়িয়াখানা শহরের দক্ষিণে আর আঞ্জেল অফ পিস-এর মুর্তি শহরের মাঝখানে। ও দেখলাম কিছু বললো না। তার পর ডঙ্কা যখন ওর স্পেশ্যাল মোবাইলের কথা বললো, মনে হল ইন্টারনেটে ব্যাপারটা কি দেখা যাক। জি-টকে আমাদের প্রোফেসরের সাথে কথা বললাম। উনিই মিউনিখের প্রোফেসর ল্যাস্কের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। ওঁরাই আমাকে বললেন, পুলিশের সাথে কথা বলতে। ব্যস, গল্প শেষ।'
এল.এম.ইউ = লুডউইগ-ম্যাক্সিমিলিয়ান ইউনিভার্সিটি (মিউনিখ)
মন্তব্য
হুমমম। গল্প তাহলে এটা? ট্যাগ খেয়াল করি নি... প্রথমে সত্যি সত্যি মনে করেছিলাম।
--------------------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়...
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
খুবই অপ্রাসঙ্গিক হলেও লেখার শেষে ম্যাক্সিমিলিয়ান শব্দটা আমাকে কার্ল ম্যাক্সিমিলিয়ান এরলিখ -এর নামটা মনে করিয়ে দিলো। মেন এগেইনস্ট দ্য সী'র সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন। নাকি ভুল করছি? মেন এগেইনস্ট দ্য সীতে মনে হয় উইলিয়াম ব্লাই! তাহলে ম্যাক্সমিলিয়ান কোন গল্পের
আপনার গল্পও সুন্দর হয়েছে।
পিপিদা মেন এগেইনস্ট দ্য সী'র ক্যাপ্টেনের নাম ক্যাপ্টেন ব্লাই
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
পিপিদা- "ম্যান এগেইনস্ট দা সী" তে ছিলো লর্ড উইলিয়াম ব্লাই।
'ম্যাক্সমিলিয়ান' ছিলো ভিক্টোরিয়া হল্টের 'স্বপ্নসখা' বইয়ের একটা চরিত্র।
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!
আজিনোমোতো
বাংলাদেশে এক সময় এই শব্দ লেখা টি-শার্টের ব্যাপক প্রচলন ছিল। আমরা চট্টগ্রামের ভাষায় সেটাকে ভেঙে ভেঙে পড়তাম-
আজিয়া ন মুতো
ভাইয়ে, আপনে পারেনও, আরেক খানা অসাধারণ সৃষ্টি
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
এই গল্পটার সাথে ছোটবেলায় পড়া জনপ্রিয় সাহিত্যিক শংকরের একটা গল্পের মিল পাচ্ছি। গল্পটার নাম মনে নেই তবে সেখানে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে কোলকাতার "গন্ধম্যাপ" বানানোর একটা ব্যাপার ছিল।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
গল্পটা ভালো...
তবে এর একটা অংশ পড়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটার কথা মনে পড়ে গেলো... সে মোবাইল রাখতো বুকপকেটে। তার মা বলেছিলো বুক পকেটে রাখিস না, প্যান্টের পকেটে রাখ... ভাইব্রেশনে হার্টের ক্ষতি হয়। সে বলেছিলো হার্টের ক্ষতি হলে চিকিৎসা হবে... কিন্তু প্যান্টের পকেটে রাখলে ভাইব্রেশনে অন্য যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে তো সমস্যা...
বন্ধুটা আড়াই বছর আগে মারা গেছে। হার্টের অসুখেই... যদিও এটা মোবাইল ঘটিত না... তবু মনে পড়ে গেলো...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
বেশ লাগলো রহস্যগল্পটা।
ভারী চমৎকার গল্প। রীতিমত দুর্ধর্ষ! প্লট ভালো, গল্পের বাধুঁনী ভালো।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
"ল্যাচা' কি ল্যাংচা? ভবানীপুরের যখন, তারমানে শ্রীহরির ল্যাংচা তো? আহাহা শ্রীহরির লুচি, ছোলারডাল আর ল্যাংচা খেতে হত৷ আর ক্যারলকে বাঞ্ছারামের দই খাওয়ালেন না? কে সি দাশের অমৃতকুম্ভও খাওয়ানো উচিত্ ছিল৷ হটকাটির রোল ফেলে কিনা, বেদুইনের রোল? না মশাই গল্প দুর্দান্ত লিখলেও খাওয়াদাওয়ার ব্যপারে আপনার ওপর ঠিক ভরসা করা যায় না দেখছি৷
---------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
আজি-নো-মোতোকে ঢাকায় আমরা টেস্টিং সল্ট বলতাম। এটা যে স্বাদবর্ধক আর ষষ্ঠ স্বাদ উমামির উতস, সেটা জানতাম। তবে এটা যে প্রিজারভেটিভ আর জার্মানীতে যে এটা বেআঈনী, তা জানতাম না। তবে এলার্জির কারনে খেয়াল করে খাই বলে হল্যান্ডের কিছু খাবারে যে E621 (মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট বা টেস্টিং সল্ট) থাকে তা দেখেছি।
---
সুলিখিত গল্প।
- এতো সুন্দরীরে শ্রীঘরে পাঠিয়ে দেয়ায় তীব্র নিন্দা!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
শুধু ছবি দিয়েই কেমিকেল অ্যানালিসিস হয়ে যাবে? বেশ মোবাইল সেট তো! তবে মাঝ রাতে খাবার লিস্ট পড়ে সমস্যাই হল।
টেস্টিং সল্ট কিন্তু ইংল্যান্ডেও নিষিদ্ধ দেখেছিলাম
'এই মোবাইলটার স্ক্রীণটা চেটে নাও, খিদে মিটে যাবে।'
আজগুবি একটা স্বপ্ন দেখব মনে হয় আজকে!
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
নতুন মন্তব্য করুন