ছোটবেলায় নানা রকম অসুখে ভুগে আমার পায়ের জোরটা একটু কমে গিয়েছিল। সমবয়সীদের মত লাফালাফি করতে পারতাম না। এমনকি ঐ পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে স্কুলে পৌঁছনোটাও আমার পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। স্কুলে আমার বিরুদ্ধে একটাই অভিযোগ ছিল, আমি নাকি বড়োই চুপচাপ। মাষ্টারমশাইরা বলতেন, ‘ছেলেটার এনার্জি কম। ভালো করে খাওয়ান – বোর্নভিটা, ওভালটিন।’ পরে বড় হয়ে অবশ্য আমি বজ্জাতির কোটা পুরোপুরিই পূরণ করেছিলাম। তখন আবার অন্য অভিযোগ। এ জগতে কিছুতেই কাউকে খুশী করতে পারলাম না।
বেশি হাঁটতে পারতাম না বলে সুনীলকাকা রোজই আমাকে কাঁধে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন এবং আসতেন। বাবার ছিল বদলীর চাকরি। আমি আর মা থাকতাম বর্ধমানে। বাবা কখনও মেমারী, কখনও রসুলপুর করে বেড়াতেন। বাড়ি আসতেন হপ্তাশেষে। সুনীলকাকা ছিলেন মায়ের ডানহাত। বাজার করা থেকে শুরু করে, বাইরের সব কাজের ঝক্কি উনি হাসিমুখে নিয়েছিলেন।
কে যেন পরামর্শ দিল, ‘টেংরির জুস খাওয়াও’, ব্যস শুরু হয়ে গেল। কাকা রোজ বাজার থেকে ১০০ গ্রাম টেংরি নিয়ে আসতে লাগলেন। দুপুরের রান্নার পর নিভন্ত আঁচে সেই টেংরি সেদ্ধ হত। প্রথম প্রথম বেশ খুশির সাথে মাংস খেতাম। রোজ রোজ কি আর ভালো লাগে। কিছুদিন পরেই আমি কান্না তুলতাম, ‘আর মাংস খাব না।’ কিন্তু উপায় নেই। যতদিন না পা ঠিক হয় খেতেই হবে।
কাকা ঝাল খেতে পারতেন না, আর বাবা ঝাল ছাড়া খেতেনই না। একটা লম্বা বারান্দার এপারে আমরা ভাড়া থাকতাম, ওপারে কাকারা। এখনও মনে পড়ে মা আলুর দম বানিয়েছেন। কাকা দু-পিস নিয়ে নিজের ঘরে বসে খাচ্ছেন আর চেঁচাচ্ছেন, ‘মানুষ মারা ঝাল। ভদ্রলোকে খায়? উঃ আঃ ...।’ একটু পরেই আবার আমাদের ঘরে এসে, ‘বৌদি আর দুটো দিনতো। বড্ড ঝাল, কিন্তু আপনার হাতের আলুর দম ... আহা।’ মা রাগ করে বলতেন, ‘ঝাল লাগে তো খান কেন? ঘরে গিয়েই তো আবার গালাগাল দেবেন।’
- ওগুলো শুনবেন না। চেঁচালে ঝাল কম লাগে। দিন, রেবাকে আবার বলবেন না যেন।
কাকার ডায়াবেটিস ছিল। আলু খাওয়া একদম বারণ। মা হয়তো অনেক দরদস্তুর করে আরেকটা আলু দিতেন। কাকা পাশের ঘরে নিয়ে গিয়েই শুরু করতেন, “ওরে বাপরে, মেরে ফেললে রে ...।’
কাকার খাওয়ার দিকে কাকিমা ভীষণ খেয়াল রাখতেন। দুবেলা দুটো করে রুটি, প্রচুর সাকসব্জী আর বেশ বড় এক বাটি দুধ। চিনি ছাড়া চা। মাছ-মাংস তখন রোজ হত না। কিন্তু কাকার একটু মিষ্টির প্রতি লোভ ছিল। মাঝে মাঝেই বাজারের মিষ্টির দোকান থেকে দুটো রসগোল্লা বা কাঁচা সন্দেশ খেয়ে আসতেন।
ছোট শহর। সবাই সবাইকে চেনে। কাজেই কাকার মিষ্টি খাওয়ার খবর হপ্তাশেষে বাবার কাছে পৌঁছে যেত। বাবা বাজার থেকে ফিরেই হাঁক পারতেন, ‘রেবা, গত বুধবার সুনীল আবার হারাণের দোকান থেকে মিষ্টি খেয়েছে।’ তারপর, আধঘণ্টা কাকা মাথা নিচু করে চুপচাপ বকুনি খেতেন। পরে বাবা বাজারের সব দোকানদারকে বলে দিয়েছিলেন, কেউ যেন কাকাকে মিষ্টি বিক্রি না করে। কাকা তখন দোকান থেকে লজেন্স কিনতেন। বলতেন, ‘এই শঙ্করের জন্য কিনছি।’
কয়েক মাস ধরে টেংরির জুস খাওয়ার পরেও তেমন উন্নতি হল না যখন, তখন প্রতিবেশীদের পরামর্শ হল, ছেলেকে কড লিভার অয়েল মাখাও। ব্যস বাড়িতে ঢুকলো সেভেন সীজ কড লিভার অয়েল। কি বিকট গন্ধরে বাবা! আমার গায়ে গন্ধ, মায়ের গায়ে গন্ধ, কাকার কাঁধে চড়ে যাই, কাজেই তাঁর গায়েও গন্ধ। শেষকালে যখন স্কুল থেকে আপত্তি জানানো হল, তখন ঠিক হল, শুধু ছুটির দিনে মাখানো হবে। কিছুদিন পর, হঠাত কড লিভার অয়েল বাজার থেকে উঠে গেল। কাকা ঠিক এপাড়া-ওপাড়া করে এমনকী কখনও ব্যান্ডেল পর্্যন্ত গিয়ে আমার জন্য কড লিভার অয়েল নিয়ে আসতেন।
আমি যখন ক্লাস সিক্সে উঠি, বাবা তখন বদলি হয়ে এলেন নদীয়ায়। যোগাযোগটা কমে গেল। কাকা মাঝে মধ্যে আসতেন, দুয়েকবার কাকিমাও এসেছিলেন। চিঠি-চাপাটি চলতো। বাবা মারা যাওয়ার পরে, শ্রাদ্ধের সময়ও এসেছিলেন কাকা। দু-চোখ মুছতে মুছতে ভাঁড়ার সামলেছেন।
আমি চাকরি পাওয়ার পরেও যোগাযোগ ছিল। একবার আমার অফিসে এসেছিলেন।
‘বুঝলে শঙ্কর, একটা এল.আই.সি. করিয়েছিলাম। এতদিনে ম্যাচিওর করেছে। তা তোমার কাকিমাকে তো কোনদিন কিছুই দিতে পারলাম না। এবার আমি অনেকদিনের পুরনো একটা সাধ মিটিয়েছি। একটা গোদরেজের আলমারী কিনেছি।’
বছর খানেক বাদে বর্ধমানে গিয়েছিলাম। কাকার নতুন গোদরেজের আলমারী দেখলাম। কাকা রোজ সেটাকে ঝেড়ে-পুঁছে তকতকে করে রেখেছেন।
আমাদের কলকাতার বাসাতেও এসেছিলেন কাকা। তখন দুরদর্শনের যুগ। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে, বিছানা তুলে টিভিটা খুলে বসে থাকতেন। টিভিতে তখন বর্ণালী দেখাচ্ছে। অনেকক্ষণ পর শুরু হত। আর সেই রাত সাড়ে দশটার পর যখন টিভি হাই তুলে বলতো, ‘এবার ছেড়ে দিন, কাকু। ঘুমোতে যাবো।’ তখন তার ছুটি।
***********************************************************
গল্পটা শেষ করে চানে যাবার জন্য উঠছি। শুনি, পাশের ঘরে ফোন বাজছে। বৌ কর্ডলেসটা হাতে নিয়ে এল, নম্বর ডিসপ্লে করছে – সুনীলকাকা।
- বলে দাও নেই। ট্যুরে গেছে। ফিরতে দশদিন লাগবে।
বন্ধুদের কাছে স্মৃতিকথা লিখে হাততালি পাওয়া যায়। তাবলে এখন সত্যি সত্যি যদি এসে পড়েন, তাহলে তো মুশকিল। রান্নার লোকটা ছুটি নিয়েছে। আমরা আজ নুডল, কাল পিজা, পরশু হোটেল করে চালাচ্ছি। কে এখন রুটি বানাবে, আর অতখানি তরকারী কুটবে। কাকাতো আর বাইরের খাবার খান না। তার ওপর যদি বায়না ধরেন, ‘ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল।’
মন্তব্য
সময় বড় কঠিন চিজ, শঙ্কর দা। লেখা যথারীতি ঝাক্কাস।
লেখা তো চমৎকার, তবে সুনীলকাকা শেষটায় গিয়ে অনিলকাকা হয়ে গেলো? এমনকি শিরোনামেও তো দেখি তাই।
আর বর্ণালী তো রেডিওতে হতো, সাড়ে ছটা থেকে বোধ হয়, তারপরে হতো মঞ্জুষা। দূরদর্শনেও ঐ নামে অনুষ্ঠান ছিলো নাকি?
আপনার লেখা মিস করি না, এটাও খুব ভালো লাগলো।
সত্য বড় নির্মম।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
এরকমই হয়।
কামরুল হাসান রাঙা
আমার চেনা এক সর্বজ্ঞেয় নমস্য ব্যক্তি বলতেন, নাটক নভেল হবে আনন্দের। দেখব, হাসবো, উড়িয়ে দেব। মন খারাপ করা লিখা কোন "জাতের" লিখাই না।
কেন জানি জাতকুলহীন লিখা পড়ে মন ভার করে বসে থাকতে আমার খুব ভাল লাগে।
সাত্যকি
সবাইকে ধন্যবাদ।
রাজর্ষি ভাই, গল্পটা অনিলকাকার। ভেবেছিলাম নামটা বদলে দেব। লিখতে লিখতে আর খেয়াল নেই। সত্যি নামটাই চলে এসেছে।
সুদূর অতীতে সকালবেলা দূরদর্শনের প্রোগ্রাম চালু হবার আগে টিভিতে বিভিন্ন রঙের কয়েকটা ভার্টিকাল স্ট্রাইপ দেখাত।
প্রথমে পড়লাম সুনীল শেষে এসে দেখি অনিল। এটুকুই যা খটকা। এটা বাদে পুরো গল্পটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। দারুন লেগেছে।
পাগল মন
উপাদেয়। স্বাদু। (সেভেন সীস'টা নয়!)
তাহলে এগুলো উপাদেয়ঃ হারাণের দোকানের মিষ্টি, লজেন্স আর আলুর দম? সবগুলোই বিশেষ করে শেষেরটা বড় মিস করি আজকাল।
করেছেন কী! শেষ প্যারার আগেতো বুঝতেই পারিনি এটা গল্প।
আচ্ছা 'টেংরি' জিনিষটা কী?
ঠ্যাং / পা। পায়া কারি খেয়েছেন? সেই জাতীয় ব্যাপার। প্রচলিত ধারণা, ওতে শরীরে গত্তি লাগে।
ও তাই বলেন, আমরা বলি- খাসির নেহারি অথবা গরুর পায়া।
এহ্হেরে দিলেনতো মনে করিয়ে। মাত্রই কুরবানীর ঈদ গেল, দেশে থাকলে এখন পায়া দিয়ে চালের আটার রুটি মেরে দিতুম গোটা বিশেক
ভালো লেগেছে।
দারুণ লাগলো!
নতুন মন্তব্য করুন