কন্ডোলিত্সা'র গণতন্ত্র আর আমাদের ‌'না' ভোট

শশাঙ্ক বরণ রায় এর ছবি
লিখেছেন শশাঙ্ক বরণ রায় (তারিখ: রবি, ২৮/১২/২০০৮ - ২:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বুশের জুতা খাওয়ার একটি দারুণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন কন্ডোলিত্সা। তাঁর মতে, মুনতাজারের জুতা নিক্ষেপ এটাই প্রমান করে যে, মার্কিনীদের ইরাক যুদ্ধের উদ্দেশ্য অর্থাত্ 'স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠা সফল হয়েছে। মুনতাজারারের জুতা আসলে ইরাকী জনগণের 'স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রকে'ই বহন করে নিয়ে গিয়েছিল বুশের দিকে। আহা, কী মধুর মার্কিনী গণতন্ত্র!

লক্ষণীয় যে, 'গণতন্ত্র' ‌মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার' কথা বলে বিরুদ্ধ মত এবং প্রতিবাদকে এভাবেই হজম করে ফেলে। এবং 'কিছু একটা তো করেছি' - এই আত্মতৃপ্তির বোধে মগ্ন রেখে প্রতিবাদের মূল লক্ষ্য থেকে বেপথু করে নাগরিকদের।

আমাদের নির্বাচনে এবার 'না' ভোটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অনেক 'সচেতন' ভোটার এবার 'না' ভোট দেবেন বলে মিডিয়াগুলো জানাচ্ছে। বিষয়টি একটু পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।

গত সরকারের শেষ সময়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার কামড়া-কামড়ি এবং এর আগের সরকারগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণ জনগণের মাঝে প্রচলিত রাজনীতির স্বার্থপরতা-লুটপাট-যথেচ্চাচার বিষয়ে একটা মাত্রার সচেতনতা সৃষ্টি করেছিল। প্রশ্নটি অনেকের কাছ থেকেই এসেছিল যে, এইসব দলকে ভোট দিয়ে আমাদের লাভ কি? বিদ্যমান রাজনীতির যেকোন উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া আর লুটপাট করার রাজনীতির চরিত্রটা স্পষ্ট হচ্ছিল মানুষের কাছে। এ থেকে ভিন্ন রাজনীতির ভাবনা আসত কি না সে ভবিষত্ সিদ্ধান্ত না দিয়েও বলা যায় এটা একটা দেশের নাগরিকদের রাজনীতি চিন্তার একটা অগ্রগতি।

'না' ভোটের ব্যবস্থা এই বাস্তবতাকেই মাথায় রেখে করা। প্রকৃত পক্ষে যে ভোটার সকল প্রার্থীকেই অযোগ্য মনে করে সে আসলে বিদ্যমান রাজনীতিতে নির্বাচন কোন গুনগত পরিবর্তন আনতে পারবে তা বিশ্বাস করে না। দলগুলো এবং প্রার্থীদের ওপর আস্থা না থাকা এটাকেই নির্দেশ করে। তাহলে তারা কি করবে? তাদেরকে 'না' ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে যারা এই নির্বাচন বা রাজনীতিকে অর্থহীন করে তাদেরকেও নির্বাচনের মধ্যে হজম করার 'গণতান্ত্রিক' পদ্ধতি হচ্ছে ‌'না' ভোট। এর মাধ্যমে সে 'কিছু তো একটা করেছি' ভেবে হয়ত আত্মতৃপ্তি পাবে, কিন্তু তার প্রতিবাদটা মূলত সে যাকে প্রত্যাখ্যান করে সে ব্যবস্থাকেই নির্ঝঞ্ঝাট রাখতে সহায়তা করবে। নিজস্ব ভাবনা বিশ্লেষণ থেকে কোন পথ খোঁজা বা পথ তৈরি করার দিকে তাকে আর কষ্ট করে যেতে হবে না।

কন্ডোলিত্সা যেমন প্রতিবাদকে 'গণতন্ত্রের' কথা বলে হজম করে ফেলেন, তেমনি আমাদের 'না' ভোট নির্বাচনের রাজনীতিতে নির্বাচন প্রত্যাখনকারীদেরকে হজম করে ফেলতে চাইছে।


মন্তব্য

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

না ভোট নিয়ে আপনার বিশ্লেষণের সঙ্গে পুরো একমত। যে বিদ্যমান ব্যবস্থার পক্ষে তারও নির্মোহ সমর্থন এর দিকেই থাকার কথা। কারণ সে জানে ক্ষোভের বাষ্প একটানা জমলে বিষ্ফোরণ ঘটতে পারে। তাই একটা না থাকা ভাল। কিন্তু যারা এর বিপক্ষে তারা কেন না বলে থামবে? এ বিষয়ে আমার মতামত এখানে দেয়া রয়েছে।

কিন্তু এর সঙ্গে মুনতাজারের জুতা নিক্ষেপকে মেলাতে পারি না। মুনতাজার জমাট বশ্যতাকে এক জুতা দিয়ে গলিয়ে দিয়েছে। এর দরকার ছিল। আরব ও ইরাকিদের একটা অংশের আপসকামিতাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য এর দরকার ছিল। এধরনের ঘটনা, যেমন সূর্যসেন-প্রীতিলতাদের সন্ত্রাসবাদ কিংবা মুক্তিযোদ্ধা কোনো গেরিলা কিশোরের আত্মঘাতী হওয়া এসব ঘটনা ইতিহাসের মধ্যে ঘটলেও তা ইতিহাসঅতিক্রান্ত চরম বাস্তব হিসেবে হাজির হয়। এগুলো পথ নয়, কিন্তু পথের জন্য আকুতির তীব্রতাকে প্রকাশ করে। সেকারণে প্রচলিত কার্যকারণ যুক্তি দিয়ে এসবকে বিচার করা চলে না। সক্রেটিস ঠিক করেছিলেন বিষ খেয়েই সত্য প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু এর সাধারণীকরণ করলে বিষপান=সত্য তা তো বলা যায় না। তেমনি জুতা নিক্ষেপ= দখলদারি উচ্ছেদ এমন সমীকরণও টানা যায় না। কিন্তু মুক্তির জন্য কেউ এত চরমে যেতে পারে, এটা নিপীড়িতের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার জন্য জরুরি। পাওলো ফ্রেইরির একটা কথা ছিল এরকম যে, নীপিড়িতের বড় দূর্বলতা হলো ক্ষমতার প্রতি ভীতি। মুনতাজার সেই ভীতিকে কাটাতে সাহায্য করেছেন। তিনি বীর। আর না ভোট হলো সংগ্রাম করতে না পেরে না বলে বিবেককে পরিষ্কার করার সার্ফ এক্সেল ডিটারজেন্ট। এরও বাজার আছে ইকনমি আছে আর আছে শ্রেণীগত বাসনা।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আসল কথা হইল কর্তা-ক্রিয়া-কর্ম।
কে বিধান করে-কী বিধান করে-কোন দু:খে করে।

এইবারের না-ভোটের বিধান যতদূর বোঝা যায়, কর্তার আত্মবৃত্তান্ত হালালের একটা দার্শনিক প্রয়াস।

এর বাইরে, এই নয়া তড়িকা কেন্দ্র কইরা বাদবাকি কচকচি,বিবেক খাউজানি ইত্যাদি সকলই মূলত: পুরির সাথে পাওয়া প্রাচীন ঝোল।



অজ্ঞাতবাস

রণদীপম বসু এর ছবি

auto

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

শশাঙ্ক বরণ রায় এর ছবি

''এর সঙ্গে মুনতাজারের জুতা নিক্ষেপকে মেলাতে পারি না।''

ফারুক ভাই, মুনতাজারের জুতা নিক্ষেপটা ছিল প্রতিবাদ। কন্ডোলিত্সা গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে তা হজম করতে চেয়েছে - এটা আমার বক্তব্য। কন্ডোলিত্সার কৌশলটা আমাদের না ভোটের সাথে তুলনা করতে চেয়েছি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।