শ্বেত ভল্লুক পর্ব
ঔপনিবেশিক চেষ্টার তৃতীয় শক্তি সোভিয়েত পরবর্তী রুশ ফেডারেশন। এই আলোচনায় রাশিয়াকে অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে এক কাতারে রাখছিনা ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসে রাশিয়ার আচরন তাদের থেকে ভিন্ন বলে। সেই সময়ে রাশিয়ার আচরন নিয়ে পুরোপুরি ভিন্ন লেখা হতে পারে (আসলে বৃহদায়তন বই হতে পারে)। বিষয়টি কম-বেশী সবার জানা এবং তা আফ্রিকা সংশ্লিষ্ট নয় বলে এখানে সেই ইতিহাস আলোচনা করার অবকাশ নেই। এখানে শুধুমাত্র বর্তমানের প্রাসঙ্গিক অংশটুকু টানবো।
অতীত থেকে শুরু করে একেবারে বর্তমান কাল পর্যন্ত রাশিয়া সব সময়ই রুশ-স্টাইলের ঔপনিবেশিকতা বিস্তারের চেষ্টা করেছে দূরপ্রাচ্য, মধ্য-এশিয়া, ফিনল্যান্ড, বাল্টিক উপসাগরীয় এলাকা এবং সমগ্র পূর্ব-ইউরোপ জুড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে আফ্রিকার কিছু দেশে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পরোক্ষ উপস্থিতি (বিপ্লব রফতানীর দুর্বল চেষ্টা ও সামরিক সরবরাহের প্রবল চেষ্টা) যতটা না আদর্শিক তারও চেয়ে বেশী ছিল তখন আস্তে আস্তে গড়ে ওঠা “ঠান্ডা যুদ্ধে”র অংশ হিসেবে।
“ঠান্ডা যুদ্ধ” চলাকালীন দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্ব এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নীতির কারনে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার জন্য সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত আফ্রিকার দেশগুলো তখন যে কোন একদিকে হেলার চেষ্টা করেছিল। ফলে, উত্তর আফ্রিকার বেশীর ভাগ দেশ, পশ্চিম আফ্রিকা, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, ইথিওপিয়া (১৯৭৭-১৯৮০) এবং দক্ষিণ আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে এবং আফ্রিকার মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝোঁকে।
সত্তরের দশক থেকে মার্কসবাদের তকমার আড়ালে বেড়ে ওঠা আফ্রিকান লুটেরা একনায়কদের সমর্থনদানের চেষ্টা তখনকার সোভিয়েত নেতৃত্বের আদর্শিক দেউলিয়াত্বের বহিঃপ্রকাশ। ফলাফলটি স্বাভাবিকভাবেই আফ্রিকার সাধারণ মানুষের পক্ষে যায়নি। এর একটি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সালে ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষে ১ মিলিয়ন মানুষের করুন মৃত্যু। এর বিপরীত চিত্রটিও আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথম রাষ্ট্র যারা সরকারীভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষদের বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামকে সমর্থন দিয়েছিল। আফ্রিকার অনেক দেশেরই মুক্তি সংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। এমনকি আফ্রিকার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাণিজ্য আজকের রাশিয়ার তুলনায় অনেক বেশী ছিল।
সোভিয়েত পরবর্তী রাশিয়ার অভ্যন্তরীন বেহাল অবস্থার দরুন আফ্রিকার সাথে বাণিজ্য ও সম্পর্ক হ্রাস পায়। বস্তুতঃ যেটুকু থাকে তা অতীতের তলানী মাত্র। এই অবসরে আফ্রিকার দিকে গণচীন, ভারত এবং অন্যান্যরা হাত বাড়াতে থাকে। রাশিয়ার বোধোদয় হতে হতে এই শতাব্দী চলে আসে, ততক্ষণে তারা বাকীদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়ে। প্রায় ৪/৫ বৎসর আগে রাশিয়া আফ্রিকার ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। আফ্রিকাতে অন্যান্য ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর প্রবল উপস্থিতির সাপেক্ষে রাশিয়ার উপস্থিতি একেবারেই নগণ্য। তবু রাশিয়া ক্রমে ক্রমে তার আফ্রিকা নীতিতে পরিবর্তন আনছে ইউরোপে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য। ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের আবির্ভাব ইউরোপের শক্তি, ক্ষমতা আর অর্থনীতির ভারসাম্যের প্রোফাইলটিকে আমূল বদলে দিয়েছে। সুতরাং রাশিয়ার বহিঃবিশ্বে নজর দেয়া ছাড়া উপায় নেই।
মে, ২০০৮ নাগাদ আফ্রিকাতে রাশিয়ার বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এটি সম্ভবতঃ শুধুমাত্র সরকারী বিনিয়োগ। এর বাইরে বেসরকারী বিনিয়োগের পরিমান মোটেও নগণ্য নয়। গণচীন, এমনকি ভারতের বিনিয়োগের সাপেক্ষেও এই বিনিয়োগের পরিমান অনেক কম। তবে গত ২/৩ বৎসরে আফ্রিকার প্রতি রাশিয়ার মনোযোগের মাত্রা বেড়েছে উল্ল্যেখযোগ্য হারে।
গণচীন বা ভারতের মত রাশিয়া জ্বালানীর অভ্যন্তরীন উৎসের সঙ্কটে নেই। তারপরও আফ্রিকার জ্বালানী যুদ্ধে রাশিয়া নেমেছে। এই অংশগ্রহন প্রাথমিকভাবে অর্থনৈতিক কৌশলগত। আফ্রিকার তেলসম্পদে ভাগ বসিয়ে রাশিয়া ইউরোপের বাজারে গ্যাস-বহির্ভূত জ্বালানীগুলোর মূল্য নিয়ন্ত্রন করতে চাইছে।
রাশিয়ার রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত জ্বালানী সংস্থা “Gazprom”এর মাধ্যমে নাইজেরিয়ার বিদ্যমান জ্বালানীস্বত্ত্বর (তেল ও গ্যাস) প্যাটার্নটিকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। তারা সম্প্রতি কিছু সংখ্যক মার্কিন, ইউরোপীয় ও চীনা কোম্পানীকে সরিয়ে তাদের বসানোর জন্য নাইজেরীয় সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে বলে ধারনা করা হয়। নাইজেরিয়া সরকার ইতোমধ্যে তাদের জ্বালানী সরবরাহ সমস্যা বিশ্লেষন করে জ্বালানী খাতকে পূনর্গঠণ করার পরিকল্পনা করার জন্য তাদের সংসদীয় কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছে।
“Gazprom” তার নাইজেরিয়া উদ্যোগটির এই পর্ব শেষ করেছে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে যাতে নাইজেরিয়াতে একটি নতুন গ্যাস পরিবহণ পাইপলাইন বসানো হবে। এর ফলে নাইজেরিয়ার গ্যাস খাতের আরো সম্প্রসারনের সুযোগ তৈরী হবে। “Gazprom” -এর প্রধান ব্যবসায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন হলেও এর চীফ এক্সিকিউটিভ আলেক্সেই মিলার ইতোমধ্যেই ২০১২ সাল পর্যন্ত নাইজেরিয়ার তেল উত্তোলনের হার বৎসরে ৪% হারে বাড়ানোর জন্য তাদের পরিকল্পনার কথা ঘোষনা করেছেন। তিনি আরো বলেছেন তার কোম্পানীর সাথে ইউরোপীয় ক্রেতাদের দীর্ঘ মেয়াদী গ্যাস চুক্তির দরুন ভবিষ্যতে তেলের সাথে সাথে গ্যাসের মূল্যও বাড়বে। “Gazprom” -এর পরবর্তী লক্ষ্য আলজেরিয়া, ক্যামেরুনসহ অন্যান্য জ্বালানী সমৃদ্ধ দেশগুলো। তাদের সোজা-সাপ্টা ভাষ্য, আফ্রিকা নিশ্চিত ভাবেই Gazprom -এর ব্যবসার আন্তর্জাতিক সম্প্রসারনের পথ, এবং এটি করার জন্য তাদের টাকা আছে।
শুধু “Gazprom” -ই নয়, রাশিয়ার “Rosneft & Stroytransgaz” এরমধ্যেই আলজেরিয়া, নাইজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা ও মিশরের সাথে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তেল অনুসন্ধান চুক্তি করেছে। ২০০৭ সালে “Lukoil” আইভরী কোস্টের একটি তৈলখনির ৬৩% কিনে নিয়েছে “Production-Sharing Agreement”-এর ভিত্তিতে।
শুধু তেল-গ্যাসই নয়, আফ্রিকার অন্যান্য খনিজ সম্পদ, বিশেষতঃ ধাতব আকরিকের ব্যাপারে রাশিয়ার সাম্প্রতিক আগ্রহ বিপুল। ধাতু বাজারে গত কয়েক বৎসরে অস্বাভাবিক হারে মূল্যবৃদ্ধি রাশিয়ার ভারী শিল্পগুলোর জন্য প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এদিকেও তাদের নজর না দিয়ে উপায় নেই।
জুন, ২০০৮-এ রাশিয়া জাম্বিয়ার খনি শিল্পে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের ঘোষনা দিয়েছে। জাম্বিয়া আফ্রিকার সর্ববৃহৎ তাম্র উৎপাদনকারী দেশ। রাশিয়ার এই পদক্ষেপ ১৯৯৮ সালে গণচীনের সাব-সাহারান আফ্রিকার চাম্বিশী তাম্র খনি কিনে নেবার বিপরীতে। রাশিয়ার “Norilsk Nickel” ২০০৭ সালে বতসোয়ানার একটি বৃহদায়তণ নিকেল খনি কিনে নিয়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ অ্যালুমিনিয়াম ও অ্যালুমিনা উৎপাদনকারী রাশিয়ার “RusAl” ইতোমধ্যে নাইজেরিয়ার “Alscon”-এর সিংহভাগ কিনে নিয়েছে। তারা গিনির “Frie Aluminum Company” ও দায়ান-দায়ান বক্সাইট খনির পুরোটাও কিনে নিয়েছে। উল্ল্যেখ্য, দায়ান-দায়ান বক্সাইট খনিতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বক্সাইটের মজুদ রয়েছে এবং বক্সাইট অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনের প্রধান আকরিক। মে, ২০০৮-এ রাশিয়ার “Severstal Resource” লাইবেরিয়ার ৫০০ মিলিয়ন টনের লৌহ আকরিক মজুদের অনুসন্ধান স্বত্ত্ব কিনে নিয়েছে।
রাশিয়ার হীরক ব্যবসায়ের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান “Alrosa” গিনি ও গণপ্রজাতান্ত্রিক কঙ্গোর হীরক খনির ব্যাপারে নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। হীরক ব্যবসায়ের পাশাপাশি তারা রাশিয়ার রাস্ট্র-নিয়ন্ত্রিত তৈল সংস্থা “Zarubezhneft”-এর সাথে অ্যাঙ্গোলায় তেল উত্তোলনের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছে। গিনিতে ইতোমধ্যেই তারা তেল উত্তোলনের লাইসেন্সের জন্য সরকারের সাথে কথা বলা শুরু করেছে।
এমনটি ভাবার কোন কারন নেই যে, আফ্রিকা তার খনিজ সম্পদ বিক্রি করার জন্য বসে আছে আর রাশিয়া তা কিনে নিচ্ছে। যে কোন দেশে তাদের খনি বা খনিজদ্রব্যের মত জাতীয় সম্পদ বিদেশীদের পক্ষে কিনে নেয়া কঠিন। সেক্ষেত্রে অবধারিতভাবে সরকার, বিরোধী দল, বিদ্রোহী গ্রুপ, প্রেশার গ্রুপ সবাইকে কম-বেশী হাত করার প্রয়োজন হয়। কার্যতঃ রাশিয়া তাই করছে। সোভিয়েত আমল হতে আফ্রিকার অনেক দেশ অস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম এবং সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। এই সামরিক নির্ভরতার পথ ধরে রাশিয়া অন্য অনেকের চেয়ে সহজে আফ্রিকান সরকারদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে বা তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারছে।
আফ্রিকানদের মন ও মগজে গণচীন ও রাশিয়া উভয়েই “সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা”দের বিপক্ষে নিজেদেরকে “আফ্রিকার বন্ধু” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। গণচীন যেখানে নিজেদের ঔপনিবেশিক আমলের প্রসঙ্গ তুলে আফ্রিকাতে এই বলে হাত বাড়ায় যে তারা তাদের “আফ্রিকান ভাই”দের সাহায্য করতে এসেছে, সেখানে রাশিয়া নিজেকে ঔপনিবেশিকতার বিরূদ্ধ শক্তি হিসেবে দেখিয়ে সাবেক “ঠান্ডা যুদ্ধ”কালীন মিত্রদের কাছে যেতে চাইছে। অবশ্য দু’জনের উদ্দ্যেশ্যই এক প্রকার। আফ্রিকানদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে, পশ্চিমা-বিরোধী ভাব দেখিয়ে, তাদের সম্পদ লুন্ঠন করা।
সোভিয়েত আমলে ক্ষমতাসীন প্রবীন নেতারা শুধুমাত্র আদর্শিক কারনে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আফ্রিকা যাবার বিশেষ প্রয়োজন বোধ করতেন না। এমনকি ভিন্ন হাওয়ার মানুষ মিখাইল গরবাচেভ বা বরিস ইয়েলৎসিনও যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের তুলনায় আফ্রিকার জন্য এমন কিছুই করেননি, না সহায়তা, না বাণিজ্য। সেই তুলনায় তাদের উত্তরসূরী ভ্লাদিমির পুতিন অনেক বেশী দূরদর্শী। কেজিবির বৈদেশিক গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক এই সদস্য বহিঃবিশ্বে আধুনিক রাশিয়ার প্রভাব বলয় প্রতিষ্ঠা ও বৃদ্ধির জন্য করণীয় ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। তাই নূন্যতম অভ্যন্তরীন সুস্থিতি অর্জনের সাথে সাথেই তিনি বাইরের দিকে নজর দিতে শুরু করেছেন। আফ্রিকা তার নজর এড়িয়ে যায়নি, এবং তিনিও আফ্রিকা সফর করে সেখানে নতুন কায়দায় রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের বুনিয়াদটি স্থাপণ করে এসেছেন।
আফ্রিকায় বর্তমান পর্যায়ের রুশ উত্থানের প্রায় পুরোটাই শুরু হয়েছে ২০০৬ সালে। সে বৎসর আফ্রিকা সফরকালে পুতিন সাথে নিয়ে যান প্রায় ১০০ জন প্রধান রুশ ব্যবসায়ী নেতাকে। সে সময় নিউক্লিয়ার জ্বালানী বাণিজ্যে পশ্চিমা প্রতিপক্ষদের কাছে রাশিয়ার পিছিয়ে পড়ার ব্যাপারে পুতিন সহযোগীদের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। পুতিনের সেই উদ্বেগ এবৎসর (২০০৮) কিছুটা প্রশমিত হয়েছে যখন সোমালিয়ার তরফ থেকে তাদের ইউরেনিয়াম মজুদ, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের ব্যাপারে রাশিয়ার অংশগ্রহন চাওয়া হয়েছে। কিন্তু ১৯৯১ সাল থেকে বিরাজমান সোমালিয়ার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দরুন রাশিয়ার “সোমালিয়া বাণিজ্য” সহসা কাঙ্খিত ফল না ও দিতে পারে। পুতিনের পাঁচ দিনের দক্ষিণ আফ্রিকা ও মরক্কো সফরের সময় তার সহযোগীরা আফ্রিকায় তাদের বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত দেখতে পেয়েছিলেন। বিশেষতঃ খনিজ সমৃদ্ধ দক্ষিণ আফ্রিকাতে রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সহযোগীতা শুরু হওয়ায়।
মরক্কো সফরে পুতিন আলজেরিয়ার কাছে ৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র সরবরাহের যে ডিলটির সূচনা করেছিলেন তা ২০০৮-এ সমাপ্ত হয়। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে এই যে, আলজেরিয়ার এই অস্ত্রের একটি ভাগ নিশ্চিত ভাবে যাবে পশ্চিম সাহারার পলিসারীওদের কাছে মরোক্কান অধিগ্রহনের বিরূদ্ধে লড়াই করার জন্য। ফসফেট সমৃদ্ধ পশ্চিম সাহারার দিকে নজর মরক্কো আর আলজেরিয়ার সাথে সাথে মৌরিতানিয়ানদেরও। আলজেরিয়া বা মরক্কো যার মাধ্যমেই হোক পরিনামে ফসফেটের হিস্যা রাশিয়ানদের কাছে পৌঁছাবে। মাঝখান থেকে বেঘোরে প্রান হারাবে আফ্রিকানরা, পলিসারীওদের স্বাধীনতার সংগ্রামও কেবল দীর্ঘায়িত হবে।
পুতিন তার সফর শুরু করার আগেই তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই লাভরভকে অ্যাঙ্গোলা পাঠান রাশিয়ার “Vneshtorgbank” -এর প্রতিনিধি অফিস খোলার জন্য। এটির মাধ্যমেই আফ্রিকাতে রাশিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠানদের ব্যবসার সূচনা হয়। অ্যাঙ্গোলা থেকে লাভরভ পুতিনের বিশেষ বাণী নিয়ে সাবেক মিত্র ইথিওপিয়াতে যান। ইথিওপিয়াতে প্রধান মন্ত্রী মেলেস যেনাবীর সাথে দেখা হলেও তার তৎপরবর্তী নাইজেরিয়া সফরটি হতে পারেনি নাইজেরীয় সহযোগীদের ব্যর্থতায়। তবে তাতে রাশিয়ার নাইজেরিয়া অভিযাত্রা কিছুমাত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। পুতিন নিশ্চিত করেছেন যে আফ্রিকার ব্যাপারে রাশিয়ার সিরিয়াস পরিকল্পনা আছে এবং রুশ ব্যবসায়ীরা আফ্রিকাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবেন।
পুতিনের এই নিশ্চয়তা শুধু কথার কথা নয়। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে রাশিয়া আফ্রিকার ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋন মওকুফ করেছে, ৫০ টি আফ্রিকান দেশকে বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা দিয়েছে। ২০০৬ সালে রাশিয়া বিশ্ব ব্যাংকের সাব-সাহারান এলাকার প্রকল্পগুলোতে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের “উন্নয়নের জন্য ঋন” দিয়েছে। এই সুবিধাগুলো রাশিয়ার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো বিষয়কে মাথায় রেখে করা হয়েছে। যেমন, গত দুই বৎসরে তামার আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে এবং ওঠা-নামা করেছে। এখন তামার বাজার মূল্য যদি আবার অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে, তবে আফ্রিকাতে গণচীন আর রাশিয়ার তৎপরতাকে পশ্চিমারা যেই সতর্কতার সাথে দেখছে তখন সেই প্রেক্ষিত পুরোটাই পালটে যাবে।
এখন পর্যন্ত সরকারীভাবে আফ্রিকার সাথে রাশিয়ার বাণিজ্য তার মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ১% ও নয়। তবে এই হিসাব সঠিক নয়। প্রথমতঃ রাশিয়ার তৈরী ট্রাক, ট্রাকটর, ভারী যন্ত্রপাতি, শিল্প কারখানার নানা উপকরণ বিপুল পরিমানে আফ্রিকাতে রফতানী হয় অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ বা দুবাই হয়ে। মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা বেশিরভাগ ফরাসী, বেলজীয় বা খোদ রুশ বৈদেশিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। এর সঠিক হিসাব সরকারের কাছে থাকা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়তঃ আফ্রিকা রাশিয়ার অস্ত্রের বড় ক্রেতা। আর অস্ত্র ব্যবসায়ের প্রকৃত হিসাবের খুব কমই বাইরের দুনিয়া জানতে পারে। তৃতীয়তঃ রাশিয়ার আফ্রিকা বাণিজ্যের অন্যতম একটি পণ্য হচ্ছে প্রযুক্তি। সুতরাং পশ্চিমা দেশগুলোতে জ্বালানী আর ভোগ্যপণ্য রফতানী করে বা লাতিন আমেরিকা বা এশিয়াতে বিনিয়োগ করে রাশিয়া যেই হারে লাভ করতে পারে তার অনেকগুন রিটার্ন আফ্রিকাতে তাদের বিনিয়োগ থেকে পাওয়া যাবে।
এখানেও রাশিয়ার নীতি তার সাবেক মিত্র গণচীনের মত। সাম্প্রতিককালে (২০০৮) জিম্বাবীর ঘটানাবলীর প্রেক্ষিতে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত অবরোধের প্রস্তাবের বিপক্ষে রাশিয়া আর গণচীন একযোগে ভেটো দিয়েছে। নিঃসন্দেহে এধরনের অবরোধ প্রস্তাব ভাল কোন বিষয় নয়। কারন, পরিনামে সকল প্রকার অবরোধ ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের বিপক্ষে যায়। তবে, রাশিয়া আর গণচীনের ভেটোর উদ্দ্যেশ্য তা নয়। তাদের উদ্দ্যেশ্য তাদের মিত্র মুগাবেকে রক্ষা করা। আফ্রিকার বাণিজ্যে এই দুই শক্তির রেষারেষি থাকলেও অভিন্ন আধিপত্যবাদী ইচ্ছা থাকায় এখানে তারা এক বিন্দুতে এসে মিলেছে।
আফ্রিকার নেতারা, যারা দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমের সাথে বাণিজ্য করেছেন বা পশ্চিমা উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করেছেন, তারা দেখতে পেয়েছেন দশকের পর দশক পার হয়ে গেলেও তা তাদের ঝুড়িতে কিছু দেয়নি। সুতরাং তারা নতুন কিছু চাচ্ছেন যা তাদের ঝুড়িতে কিছু দেবে। অন্ততঃ দ্রুত কিছু নগদ নারায়ণের ব্যবস্থা করবে। এই নগদ নারায়ণ তাদের সেই ফুর্তির খরচ যোগাবে, যেই ফুর্তির এক সন্ধ্যা ডিসকো আর ককটেলের খরচ কেনিয়ার একজন শ্রমিকের অর্ধেক মাসের রোজগারের সমান।
নব্বই-এর দশকের শুরুতে নাইজেরিয়ার জিডিপি রাশিয়ার জিডিপির সমান ছিল। স্বাধীনতা লাভের কালে ঘানা আর মালয়েশিয়ার জিডিপি সমান ছিল। আফ্রিকার জিডিপির পালে নতুন হাওয়া লাগলেও আজ নাইজেরিয়া রাশিয়া থেকে বা ঘানা মালয়েশিয়া থেকে অলঙ্ঘনীয় দূরত্বে বাস করে। রাশিয়ার নয়া ঔপনিবেশিক পদক্ষেপগুলো তার পারমানবিক জ্বালানী, খনিজ জ্বালানী আর শিল্প কাঁচামালের যোগানের নিশ্চয়তা দেবে। সেখান থেকে আফ্রিকার প্রাপ্ত আয় আবার রাশিয়া থেকে তৈরী পণ্য, প্রযুক্তি এবং বিশেষভাবে অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র আরো ব্যাপকভাবে আমদানীতে ব্যয়িত হবার নিশ্চয়তা দেবে। নিশ্চয়তা দেবে “কালো মানুষের ছুরিটা কালোর তলপেটে চমকাবার”।
ঈগল পর্ব
ঔপনিবেশিক চেষ্টার চতুর্থ অইউরোপীয় শক্তি “বিশ্ব-মোড়ল” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দুনিয়ায় নয়া ঔপনিবেশিকতার সূচনাকারী আমেরিকা তার ঔপনিবেশিক প্রচেষ্টায় কোন কোন দেশে কি কি করেছে তা এত বেশী আলোচিত যে সেগুলো বলার প্রয়োজন নেই। সে সব দেশে পরিনতিতে আমেরিকার প্রকৃত চেহারাটা কি হয়েছে তাও সবার জানা। আমেরিকা আফ্রিকার সবচেয়ে বড় “ডোনার” হওয়া সত্ত্বেও এতদিন পর্যন্ত তারা খুব কমই আফ্রিকার বিষয়গুলোতে সরাসরি নাক গলিয়েছে। যা কিছু করার, খাবার দেয়া থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী পাঠানো, তার বেশীর ভাগ করেছে জাতিসঙ্ঘের নানা প্রতিষ্ঠান আর বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে।
আমেরিকার বাণিজ্যের ধরন বাকীদের চেয়ে ভিন্ন। বিশেষতঃ গত নব্বই-এর দশক থেকে আমেরিকার প্রধাণ বানিজ্য যুদ্ধ, দ্বিতীয় প্রধাণ বাণিজ্য যুদ্ধাস্ত্র। এরপর যথাক্রমে শেয়ার মার্কেট (ব্যাপক অর্থে), ড্রাগস এবং সেক্স। মধ্যপ্রাচ্যে গত ত্রিশ বৎসর ধরে আমেরিকা আস্তে আস্তে যে যুদ্ধ-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে তার সুফল সে আরো কিছুদিন ভোগ করতে পারবে। তবে নতুন সেক্টরে এই যুদ্ধ-বাণিজ্য শুরু করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে তার ক্রমবর্ধমান এই উৎপাদন ও বাণিজ্য খাত সঙ্কটে পরতে পারে। যুদ্ধ-পীড়িত আফ্রিকা তাই তার পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে। আফ্রিকার যে সম্পদ আছে, এবং সেখানে নতুন নতুন শক্তিরা যে বিনিয়োগ করছে তাতে আরো অনেক দিন পর্যন্ত আমেরিকা সেখানে এই বাণিজ্য চালাতে পারবে।
বিষয়টি এমন নয় যে, আফ্রিকার অন্যান্য সম্পদের দিকে আমেরিকার নজর নেই। আফ্রিকার তেল, গ্যাস, ধাতু, কাঠ সব দিকেই তাদের শ্যেন দৃষ্টি আছে। তার ভাগও তারা যথাসময়ে বুঝে নেবে। তবে আন্তর্জাতিক পুলিশের ভুমিকায় নামা আমেরিকা অন্য শক্তিদের বিনিয়োগের লাভ উঠে আসার নিশ্চয়তা দিতে চায়। যেন বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তাদের হিস্যা বুঝে নিতে পারে। এ প্রসঙ্গে নব্বই-এর ঊপসাগরীয় যুদ্ধের পর জাপানের কাছ থেকে যুদ্ধের বিল আদায় স্মর্তব্য। বিনিয়োগকারীদের লাভের জন্য আমেরিকা এজন্য আফ্রিকার কোথাও কোথাও আপাতঃ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করতে চায়।
আমেরিকার এই পুলিশী ভুমিকার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে ১লা অক্টোবর, ২০০৭ হতে “United States Africa Command - AFRICOM” গঠণের মাধ্যমে। এখনো এটি U.S. European Command -এর অধীনে একটি “Sub-Unified Command” হিসেবে কাজ করছে। ৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ থেকে এটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে কর্ম-কান্ড শুরু করবে। হেড কোয়ার্টার আপাততঃ জার্মানীর স্টুটগার্টের Kelley Barracks।
আফ্রিকমের আওতায় আফ্রিকার মূল ভুখন্ড ও দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর সব দেশই পড়বে। সুতরাং আয়োজনটা যে কি বিশাল তা বোধগম্য। শুরুর পূর্ববর্তী বৎসরে আফ্রিকমের প্রস্তুতি টিমের বার্ষিক বাজেট ছিল ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চলতি প্রথম বৎসরের বার্ষিক বাজেট ৭৫.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পরের বৎসরই বাজেট হয়ে যাবে ৩৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাজেটের উল্লম্ফনটি লক্ষ্যণীয়।
আফ্রিকম হঠাৎ করে গড়ে ওঠা কিছু নয়। বিগত বৎসরগুলোতে নানা পর্যায়ে আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে আমেরিকার সামরিক তৎপরতা আফ্রিকম গড়ার গ্রাউন্ডওয়ার্ক হিসেবে কাজ করেছে। ২০১৫ সাল নাগাদ আমেরিকার চাহিদার ২৫% তেল আসবে আফ্রিকা থেকে। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত তেলের চালানও আফ্রিকার কোন না কোন উপকূল ঘেঁষে আসতে হয়। তাই ২০০২ সালেই “African Oil Policy Initiative Group”-এর তরফ থেকে গিনি উপসাগরীয় এলাকায় একটি সাব-কমান্ড গঠণের প্রস্তাব ওঠে। তার আগে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর আমেরিকা জীবুতির “Camp Lemonier” সংস্কার করে একটি নৌ-ঘাঁটি গড়ে তোলে।
২০০২ সালের অক্টোবরে গঠিত হয় “Combined Joint Task Force - Horn of Africa” ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া, জীবুতি, সোমালিয়া ও কেনিয়ায় কথিত স্থিতিশীলতা আনতে সহায়তা করতে ও মানবিক সাহায্য সরবরাহের জন্য। এডেন উপসাগরও এর আওতায় আসে, এর হেড-কোয়ার্টার হয় “Camp Lemonier”। একই সাথে এই ফোর্স “Operation Enduring Freedom - Horn of Africa” নামে “ইসলামী সন্ত্রাসবাদে”র বিরূদ্ধে জিহাদে নামে। ২০০২ সালের নভেম্বরে “Pan-Sahel Initiative” গঠিত হয় আলজেরিয়া, শাদ, মালি, মৌরিতানিয়া, আর নাইজারে সম্ভাব্য ড্রাগ আর অস্ত্র চোরাচালান ঠেকানোর জন্য। ২০০৪ সালে এর কার্যক্রম শেষ করা হয়।
তবে তার আগেই, ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে গঠিত হয় “Joint Task Force Aztec Silence” উত্তর আফ্রিকায় সন্ত্রাসবাদ ঠেকানোর জন্য। ২০০৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী থেকে এই ফোর্স “Operation Enduring Freedom - Trans Sahara” নামে অপারেশন শুরু করে আলজেরিয়া, শাদ, মালি, মৌরিতানিয়া, নাইজার, সেনেগাল, নাইজেরিয়া এবং মরক্কোতে আল-কায়েদার কথিত হুমকির বিরূদ্ধে। ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই অভিযান চলবে ছয় বৎসর ধরে।
এই তিনটি আনুষ্ঠানিক সামরিক পদক্ষেপ ভবিষ্যতে আফ্রিকমের মত ব্যাপক আয়োজনের পূর্বাভাষ দিয়েছিল। আল-কায়েদা তথা “ইসলামী সন্ত্রাসবাদ” এবং আফ্রিকাতে গণচীনের সম্ভাব্য সম্প্রসারন ঠেকানো আফ্রিকমের প্রধাণ কাজ।
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ক্ষমতায় বসার পর প্রথম আফ্রিকা সফর করেন ২০০৩ সালে। সেবারের কথিত লক্ষ্য ছিল এইডসের বিরূদ্ধে সংগ্রাম। ফেব্রুয়ারী, ২০০৮ -এ প্রেসিডেন্ট বুশের দ্বিতীয় সফরের কথিত লক্ষ্য ছিল আফ্রিকার মানুষের ব্যাধি, দারিদ্র্য আর নিরাপত্তা সমস্যায় আমেরিকার নিবিড়ভাবে সহায়তা। সফরের ক্রনোলজি লক্ষ্য করলে বোঝা যায় প্রথম সফরের আসল লক্ষ্য ছিল আফ্রিকায় স্থায়ী মার্কিন সামরিক উপস্থিতির ভিত্তি স্থাপণ করা। আর দ্বিতীয় সফরে তা নিশ্চিত করা। মরিশাস আর দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জগুলোতে মার্কিন সামরিক স্থাপণাগুলো আফ্রিকাতে খবরদারীর জন্য যথেষ্ঠ ছিল না। প্রেসিডেন্ট বুশ এই দফায় সেই ঘাটতি পূরণ করলেন।
“EUCOM”-এর সাব-কমান্ড আফ্রিকমের প্রধাণ কার্যালয় এখনো জার্মানীতে। আফ্রিকার মাটিতে এখনো তার হেড-কোয়ার্টার বসানোর জায়গা পাওয়া যায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা এবং নাইজেরিয়া একাজের জন্য তাদের মাটি দিতে অস্বীকার করেছে। তবে লাইবেরিয়া এব্যাপারে রাজী আছে। আশা করা যায় শীঘ্রই আমেরিকা আফ্রিকার মাটিতে তার পছন্দমত জায়গায় আফ্রিকমের হেড-কোয়ার্টার বসাতে পারবে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় আমেরিকান ঈগল একবার যেখানে থাবা বসিয়েছে সেখানে সে আস্তে আস্তে সকল বিষয়ে নাক গলিয়েছে। সেখানকার মানুষের স্বাধীনতা ক্রমান্বয়ে পরাধীনতায় পরিনত হয়েছে। নিজেদের সম্পদ-সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আমেরিকার করুনাপ্রার্থী হয়েছে। ভিয়েতনামের মত স্বল্পকিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সেখান থেকে তাকে পুরোপুরি উৎখাত করাও যায়নি।
উপসংহার
প্রশ্ন হচ্ছে ইউরোপীয়রা ছাড়া আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক প্রচেষ্টায় কেবল কি এই চার দেশই জড়িত? দুঃখজনক উত্তরটি হচ্ছে না। এই তালিকায় একে একে যোগ হচ্ছে ব্রাজিল, জাপান, মালয়েশিয়া ইত্যাদি নতুন নতুন নাম। তাদের অনুপ্রবেশের প্রক্রিয়াটিও কাছাকাছি ধরনের। কেউ তেলের, কেউ গ্যাসের, কেউ ধাতুর খনিতে বিনিয়োগ দিয়ে শুরু করছে। তারপর আস্তে আস্তে আফ্রিকান ব্যাংক কিনে নিচ্ছে, খনি কিনে নিচ্ছে। তার দেশের কাছে আফ্রিকার ঋন মওকুফ করছে, একতরফাভাবে বাণিজ্য কর তুলে দিচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি সামাজিক খাতে সহযোগিতার নামে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পথ খুলছে (স্মর্তব্য আফ্রিকা মুম্বাই চলচিত্রের বিশাল বাজার)। সামরিক সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণের নামে সামরিক অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়তার নামে নিজস্ব কৌশলগত অবস্থান সুসংহত করছে। নিজেদের অনুকূল আচরন করার জন্য বা নিজেদের সুবিধ অনুযায়ী বিধান করা ও পরিকল্পনা নেয়ার জন্য আফ্রিকার সরকার, রাজনীতিবিদ, বিদ্রোহী গ্রুপ, প্রেশার গ্রুপ সবাইকে ঘুষ দিচ্ছে, প্রভাবিত করছে। এক কথায় আফ্রিকাকে নয়া কায়দার উপনিবেশ বানানোর সব শর্তই তারা একে একে পূরণ করছে।
প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে রোমান, গ্রীক, আরব, তুর্কী, ইউরোপীয় এমন কোন পরাশক্তি (তাদের সময়কার) নেই যারা আফ্রিকায় নিজের উপনিবেশ স্থাপণ করেনি বা করার প্রবল চেষ্টা করেনি। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো যেমন আফ্রিকাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-জোক করে নিয়েছিল, একবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়দের পাশা-পাশি অইউরোপীয় নতুন শক্তিগুলোও তেমন আরেকবার আফ্রিকাকে ভাগ-জোক করে নিতে চাইছে। “অন্ধকার মহাদেশ”কে সারা জীবনের জন্য “অন্ধকারে” রেখে বিশ্বের প্রায় ১৫% জনগণকে আবারো সীমাহীন বঞ্চনা আর শোষণের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে।
তথ্যসূত্রঃ
1. China's African Policy, January 12, 2006, Ministry of Foreign Affairs, People’s Republic of China (http://www.fmprc.gov.cn/eng/zxxx/t230615.htm)
2. President Hu Jintao to Visit Three African Countries, Embassy of the People's Republic of China in Botswana (http://bw.china-embassy.org/eng/xwdt/t246749.htm)
3. CHINA: Oil, Global Influence Driving Hu Jintao's Africa Trip, Moyiga Nduru, January 29, 2007, IPS (http://ipsnews.net/africa/nota.asp?idnews=36351)
4. Chinese President Hu Jintao wraps up successful African tour, February 10, 2007, Xinhua (http://news.xinhuanet.com/english/2007-02/11/content_5724926.htm)
5. Roundtable probes the politics of China's large-scale investments in Africa, Annie Jia, May 16, 2007, Stanford Report (http://news-service.stanford.edu/news/2007/may16/crgp-051607.html)
6. China cancels Africa's debts, Peter Efande, December 17, 2003, The Tribune (http://www.warmafrica.com/index/geo/1/cat/5/a/a/artid/439)
7. China-Africa Cooperation from an African Perspective, Keynote Address by Mr. Fola Adeola, mni, OFR, Chairman, FATE Foundation Commissioner, Commission for Africa, Presented at a Seminar on Supporting Africa’s Development: Sharing Experiences To Reduce Poverty, September 23, 2004, Beijing, China (http://www.commissionforafrica.org)
8. Events in 2007, October 24, 2007, The Industrial and Commercial Bank of China (ICBC) (http://www.icbc.com.cn)
9. Standard Bank confirm China deal, October 25, 2007, The Rand Today (http://www.therandtoday.com/2007/10/25/standard-bank-confirm-china-deal/)
10. China to develop Sudan offshore oil, Brian Turner, June 7, 2007, Oil Marketer (http://www.oilmarketer.co.uk/2007/07/06/china-to-develop-sudan-offshore-oil/)
11. The Elephant and the Dragon, Jonathan Gregson, May, 2008, Global Finance (http://www.gfmag.com/index.php?idPage=858)
12. India, Mozambique sign MoU in defense cooperation, March 07, 2006, The People’s Daily (http://english.peopledaily.com.cn/200603/07/eng20060307_248396.html)
13. Banquet Speech by the President in honour of H.E. Joaquim Alberto Chissano, President of the Republic of Mozambique, May 12, 2003, Visit of Mozambique President to India 10-15 May 2003 (http://www.meaindia.nic.in/speech/2003/05/12spc01.htm)
14. India - Mozambique, Joint Statement, May 12, 2003, Visit of Mozambique President to India 10-15 May 2003 (http://www.meaindia.nic.in/speech/2003/05/12spc01.htm)
15. Visit to India by H.E. Mr. Joaquim Alberto Chissano, President of Mozambique, May 09, 2003, UNI (http://www.uniindia.com)
16. India Coal Mining Company to Study Coal Mine Purchase in Mozambique, October 10, 2006, The Hindu (http://www.thehindu.com/2006/10/10/stories/2006101006471700.htm)
17. Bharti Group to launch 3G network in Seychelles, 15 Dec 2005, Times of India (http://www1.timesofindia.indiatimes.com/articleshow/1332804.cms)
18. Seychelles keen on trade pact with India, August 02, 2005, The Hindu – Business Line (www.thehindubusinessline.com/2005/08/02/27hdline.htm)
19. India, Iran set to seal gas pipeline deal, July 3, 2008, AFP (http://www.arabianbusiness.com/523752-india-iran-to-seal-gas-pipeline-deal-by-next-month-oil-minister?ln=en)
20. India, Iran to talk energy during Ahmadinejad visit, April 30, 2008, The China Daily (http://www.chinadaily.com.cn/world/2008-04/30/content_6654500.htm)
21. A promising deal, The India-Sudan oil pact is, among other things, a significant step towards ensuring India's long-term oil security, John Cherian, July 20 - August 02, 2002, Volume 19 - Issue 15, Frontline (http://www.hinduonnet.com/fline/fl1915/19150500.htm)
22. India eyes Sudan oil investment, 18 June, 2002, BBC (http://news.bbc.co.uk/1/low/business/2051604.stm)
23. Sudan invites India to invest in oil, gas Sector, June 2, 2007, Sudan Tribune (http://www.sudantribune.com/spip.php?article22168)
24. Bharti Airtel disengages merger talks with MTN, Sandeep Joshi, May 25, 2008 The Hindu (http://www.thehindu.com/2008/05/25/stories/2008052559661500.htm)
25. Reliance, MTN Extend Merger Talks, John Ribeiro, Jul 9, 2008, IDG News Service (http://www.infoworld.com/news/feeds/08/07/09/Reliance--MTN-extend-merger-talks.html?source=gs)
26. First India-Africa Forum Summit opens, Feng Tao, April 8, 2008, Xinhua (http://news.xinhuanet.com/english/2008-04/08/content_7939210.htm)
27. India doubles credit to Africa, Sandeep Dikshit, April 9, 2008, The Hindu (http://www.thehindu.com/2008/04/09/stories/2008040957940100.htm)
28. India Announces 5.4 Billion-Dollar Credit Line For Africa, April 9, 2008, Ghana Government Website (http://ghana.gov.gh/ghana/india_announces_5_4_billion_dollar_credit_line_africa.jsp)
29. Africa: Exim Bank of India to Give $30m Credit Line to Continent, Kiganda Ssonko, 24 March 2008, New Vision (http://allafrica.com/stories/200803250051.html)
30. India’s Foreign Aid Program, Dweep Chanana, February 5, 2007, The Discomfort Zone (www.planetd.org/2007/02/05/indias-foreign-aid-program/)
31. Putin’s Afrika Korps, Roman Kupchinsky, July 8, 2008, The Jamestown Foundation (http:// www.jamestown.org/edm/article.php?article_id=2373206)
32. Russian firm to invest $30 billion on gas pipeline project in Nigeria, Du Guodong, June 12, 2008, Xinhua (http://news.xinhuanet.com/english/2008-06/12/content_8351007.htm)
33. Russia Returns to Africa, Mark Radulich, September 20, 2006, PCLIVE (http://progressiveconservatism.blogspot.com/2006/09/russia-returns-to-africa.html)
34. Russia-Africa: Putin Promises Development, But Promotes Business, Kester Kenn Klomegah, September 11 2006, Inter Press Service (http://en.civilg8.ru/2334.php)
35. Racing for New Riches, Owen Matthews, November 19, 2007, Newsweek (http://www.highbeam.com/Newsweek/publications.aspx?pageNumber=3&date=200711)
36. Russia eyes Africa with renewed interest, August 9, 2006, Pravda (http://english.pravda.ru/russia/politics/08-09-2006/84338-Africa-0)
37. Africa: Russia Behind China And Brazil in Building Relations, Kester Kenn Klomegah, 12 July 2008, Inter Press Service (http://ipsnews.net/news.asp?idnews=43161)
38. Africa Analyst: Russia And China Failed, Not Security Council, Akwei Thompson, July 12, 2008, Voice of America (http://www.voanews.com/english/2008-07-12-voa22.cfm)
39. Bush visits Africa to promote image, strategic interests, Sun Yunlong, February 15, 2008, Xinhua (http://news.xinhuanet.com/english/2008-02/15/content_7608612.htm)
40. Bush Books it to Africa - Humanitarian visit? Bush? There’s nothing human about him! February 16, 2008, World Press
41. Brazil repaying its 'debt' to Africa, President's tour of Southern Africa strengthens South-South ties, Ernest Harsch, January 2004, Volume 17, Africa Recovery (www.un.org/ecosocdev/geninfo/afrec/vol17no4/174brazil.htm)
42. Africom Website (http:// www.africom.mil)
43. The Found Continent, Laurence Neville, June, 2008, Global Finance (http://www.gfmag.com)
44. আফ্রিকা সংক্রান্ত প্রাথমিক তথ্যের জন্য সাহায্য নেয়া হয়েছে Wikipedia (http://en.wikipedia.org) আর Microsoft Encarta (http:// encarta.msn.com) থেকে।
45. ধাতুর বাজার মূল্য সংক্রান্ত তথ্যের জন্য সাহায্য নেয়া হয়েছে London Metal Exchange (http://www.lme.co.uk) আর Shanghai Non-ferrous Metal Exchange (http://www.smm.com.cn ) থেকে।
মন্তব্য
এক পাঠে মন্তব্য করা সহজ নয়।
তবে আপনার চালিয়ে যাওয়া উচিত ।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশে থাকি বলে রুশ-স্টাইলের ঔপনিবেশিকতা বিস্তারের প্রয়াস কাছ থেকে অনুভব ও অবলোকন করছি দীর্ঘদিন ধরে।। রাশিয়া প্রসঙ্গে আপনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণ খুবই নিখুঁত।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
অসাধারণ সিরিজ!
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
যেমন আপনার বিশ্লেষণ, তেমনি সমৃদ্ধ আপনার তথ্যসূত্র!
এধরনের আরো লেখা আশা করছি।
এই সিরিজটি মনোযোগ দিয়ে অনুসরণ করেছি। এ ধরনের শ্রমসাধ্য লেখা পেলে খুব ভালো লাগে। ষষ্ঠ পান্ডবকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই। তবে রেফারেন্সগুলি যদি পর্বপিছু বিতরণ করা যেতো তাহলে বোধহয় ভালো হতো।
পর্বগুলো পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেলো দ্য গোস্ট অ্যান্ড দ্য ডার্কনেস সিনেমাটির কথা। কর্ণেল প্যাটারসন নয়, চার্লস রেমিংটনও নয়, সিনেমার নায়ক কিন্তু সেই দুটি সিংহই। উন্নয়ন আর প্রগতির নাম করে কর্ণেল প্যাটারসন সাভোতে সেতু নির্মাণ করতে গেলেন, কিন্তু সেই সেতু দিনের শেষে কেবল লুণ্ঠনের শকটের জন্যেই পথ খুলে দেয়। ভূমিপুত্ররাও মুখ বুঁজে যোগ দেয় ভিনদেশী আগ্রাসীদের সাথে। নিজেদের শেষ সম্বলটুকু বাঁচাতে ঐ সিংহ দু'টিই রুখে দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত, এবং পরাজিত হয়। আফ্রিকাকে নিয়ে সিনেমাঅলাদের চিন্তাও লুটেরাদের সমান কম্পাঙ্কেই কাঁপে।
শেষ পর্যন্ত মানুষের সব কীর্তিই বোধহয় লুণ্ঠনকে ঘিরে।
হাঁটুপানির জলদস্যু
প্রিয় হিমু, ধণ্যবাদ আপনিসহ আরো যারা কষ্ট করে এই বৃহদায়তণ লেখাটি পড়ার সময় করেছেন। আরো ধণ্যবাদ আপনারা যারা আরো কষ্ট করে মন্তব্য করেছেন। রেফারেন্স সংক্রান্ত ব্যাপারে আপনার পরামর্শ ভবিষ্যতে মেনে চলব। এব্যাপারে সুবিনয় মুস্তফী প্রথম পর্বের পরই ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে আমার সীমাবদ্ধতার জন্য তা করতে পারিনি। আবারো ক্ষমা চাইছি এজন্য।
আফ্রিকার ব্যাপারে আপনার অনুধাবণ যথার্থ। "গডস মাস্ট বি ক্রেজী" সিরিজের সিনেমাগুলির কথা মনে করুন। আফ্রিকার সম্পদের পাশাপাশি জাতির অস্তিত্ত্ব, ভাষা, নৈতিকতাকে লুট করে বলপূর্বক পরিবর্তন করে তাদের মূল পরিচয়কে বিলুপ্ত করে দিচ্ছে। যারা আফ্রিকার আসল মানুষ তাদেরকে জাদুঘরের বস্তুতে পরিনত করছে।
লুণ্ঠনকে যদি "সারভাইভাল অভ দ্য ফিটেস্ট" বলে মনে করেন তাহলে আমাদের ইতিহাস আসলেই লুণ্ঠনের।
================================
তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নতুন মন্তব্য করুন