সচল পাণ্ডব

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: বুধ, ২৭/০৮/২০০৮ - ১০:৪১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শালবন থেকে হস্তিনাপুরে ফেরার পথে একবার অগ্রজপ্রতিম শৈলবাহু বলেছিলেন 'দূরদর্শন' তিলেকস্থায়িত্ব সম্পন্ন মাধ্যম। শুধুমাত্র 'লেখা' আর 'চলচ্চিত্র'ই ট...শালবন থেকে হস্তিনাপুরে ফেরার পথে একবার অগ্রজপ্রতিম শৈলবাহু বলেছিলেন 'দূরদর্শন' তিলেকস্থায়িত্ব সম্পন্ন মাধ্যম। শুধুমাত্র 'লেখা' আর 'চলচ্চিত্র'ই টিকে থাকে। 'চলচ্চিত্র' আমার অগম্য মাধ্যম। 'লেখা', তাও সহজগম্য নয়। তবু বোধের কাল থেকে লেখক হবার স্বপ্ন দেখেছি। প্রচেষ্টা বিশেষ ছিলনা, তবে স্বপ্নটা ছিল অজর-অমর। আমার লেখক হবার পথে প্রধান বাধা ছিল হস্তলিপির চিন্তার গতির সাথে তাল মেলাতে না পারা। পরিগণক যন্ত্রের আবির্ভাবের পর হস্তলিপির ব্যবহার যত কমতে থাকে আমার লেখক হবার পথে বাধা ততই প্রবল হতে থাকে। কারন, পরিগণক যন্ত্রে শুধু যাবনিক লিপি লেখাই শিখেছিলাম। আর্যলিপি লেখার জটিলতা কাটাতে পারিনি আজও। তারপর যখন উচ্চারণ নির্ভর মুদ্রাক্ষরণ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হল তখন আমি একটা পথ খুঁজে পেলাম। দ্বিতীয় জন্মের এই পর্যায়ে উচ্চারণ নির্ভর মুদ্রাক্ষরণ পদ্ধতিতে লিখতে পেরে লেখক হবার স্বপ্নটা বাস্তবের পথে পা বাড়াতে পেরেছে।

আমার লেখক হবার পথে দ্বিতীয় বাধা ছিল আমার কাষ্ঠবৎ প্রকাশপদ্ধতি। সাহিত্যের রস আমার অন্তঃকরণে যতই থাকুক না কেন, সেগুলো চিরকাল মূক হয়েই রয়েছে। ভাষা আর খুঁজে পায়নি। কাব্যলক্ষী আমার চির অধরা, আখ্যান রচনাও কাহিনীর পথ খুঁজে পায় না। প্রবন্ধ রচনার জন্য যে জ্ঞানের গভীরতা থাকা প্রয়োজন তা না থাকায় সব চিন্তাই ভাসা ভাসা ভাবে প্রকাশিত হয়। বিদগ্ধজন ফাঁকিটা ঠিকই ধরতে পারেন, কিন্তু বিরক্ত হয়ে কিছু বলেন না। আমার সাহস তাই ক্রমে বেড়েই চলে। যে সব বিষয়ে ভাসা ভাসা জ্ঞান আছে, বা যে সব বিষয়ের মূলসুর অনুধাবন করতে পারি না সে সব নিয়েও প্রবন্ধ রচনা করতে থাকি - এটি সাহস নয়, বরং মূর্খতার বহিঃপ্রকাশ। যেহেতু বিদগ্ধজন নিশ্চুপ থাকেন, তাই আমার মূর্খতা আরো বেড়ে চলে। আমিও ক্রমাগত প্রবন্ধ রচনা করতেই থাকি। আমার গৃহে অন্তর্জালিক সংযোগ নেই, তবু নিশীথে আমার মূর্খতার, বাচালতার শব্দরাজী দিয়ে পাতার পর পাতা ভরিয়ে তুলতে থাকে। প্রাতে কর্মক্ষেত্রে গিয়ে তা সচলায়তনে প্রকাশের আবেদন করতে থাকি। সদাশয় সচল গণপতি তা প্রকাশ করেন, আর আমি স্বীয় মূর্খতার আনন্দে আত্মহারা হই।

সচলত্ব প্রাপ্তির পর গিলগামেশ-বয়স্য বিশাল আখ্যান রচনা করেছিলেন তাঁর সুহৃদদের নিয়ে। বুঝতে পারি তিনি সুহৃদ-প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আমি যখন তাঁর বয়সকালে ছিলাম, তখন আমি তাঁর চেয়েও অধিক মাত্রায় সুহৃদ-প্রেমে নিমজ্জিত ছিলাম। আত্মীয়-পরিজন বা প্রতিবেশীদের চেয়ে তারাই তখন আমার অধিক প্রিয় ছিলেন। কালের সংঘাতে সম্পর্কগুলো যখন পরীক্ষিত হতে থাকে, প্রিয় মুখগুলোর বেশির ভাগের রঙ তখন ক্রমে ক্রমে ফিকে হতে থাকে। মধ্য-যৌবনের দিবা-নিশি গ্রাস করতে থাকে ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা। একাকীত্বের একধরনের আনন্দ আছে। মানুষ যখন তাতে অভ্যস্ত হতে থাকে সীমাহীন বিচ্ছিন্নতা তাকে গ্রাস করতে থাকে। বিদুরের ভাষায়, “রক্তের ভেতর যার নিঃসঙ্গতার বীজ ঘোরে, সহস্র গোপা কি তাকে সঙ্গ দিতে পারে”? দারা-পুত্র-পরিবার কর্মকালকে গ্রাস করলেও অন্তরের হাহাকার থেকেই যায়।

নিঃসঙ্গতার কালে অনুভব করি আমি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে, চিত্রকর্ম করতে, কাব্য রচনা করতে বা গীত গাইতে পারিনা। এর সবগুলোই নিঃসঙ্গ মানুষের পরম আশ্রয়। বাকী তিনটি নিশ্চিতভাবে পারবোনা বলে পরিকল্পনা করি তারযন্ত্র বাজানো শিখবো। স্বপ্নের হুতাশন দাবানল জ্বালালেও বাস্তবে আয়ান-জায়ার নৃত্যের উপযুক্ত ঘৃতের সংস্থান হয় না। তাই শেষ পর্যন্ত মূর্খতার মুদ্রাক্ষরণ চলতেই থাকে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব মার্তন্ডপুত্র রাধেয় নয়। বরং পঞ্চম পাণ্ডবের অকাল মৃত্যুর পর অচ্ছুৎ জন্মে সে ষষ্ঠ পাণ্ডব হয়ে জন্মায়। এই জন্মেও সে কালচক্র ভেদ করতে পারে না, তাই তার নির্বাণও হয় না। অধম পাণ্ডবের সচলত্বপ্রাপ্তি তার মূর্খতা প্রকাশের সাহসিকতার স্বীকৃতি। তবু আশা এই স্বীকৃতি তাকে বালখিল্যতা থেকে সংবেদনশীলতার পথে উত্তরণ ঘটাবে। মৃত্যুপথযাত্রী মৃত্যুঞ্জয়ের বিষমুক্তির জন্য নিরুপায় গুণীনকুল যেমন শেষকালে অশ্রাব্য গালিগালাজের আশ্রয় নিয়েছিল, আমার বালখিল্যতা ঘুচানোর জন্যও তেমন মহৌষধী প্রয়োজন। তবে সচলের সুশীল সদস্যরা যে প্রক্রিয়ায় তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তাতে মনোযোগী হলে বোধিপ্রাপ্তি হয়। আর সচল গণপতি তার রাজ্যে প্রবেশের যে বিধি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তাতে আজীবন অচল থাকার লক্ষ্য না থাকলে নিয়মিত আত্মপ্রকাশ করা ছাড়া গতি নেই। গড্ডল-প্রবাহের ন্যায় পাণ্ডবের নিত্য আবির্ভাব তাকেও একসময় স্পর্শাতীত রাজ্যের প্রবেশাধিকার দিয়ে দেয়।

এই পর্যায়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সচল গণপতিদের প্রতি, তাঁদের এই বিবেচনার জন্য। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সকল সচল-অচলদের প্রতি তাঁদের সময় নষ্ট করে এই মূর্খতা সহ্য করার ও তাতে সৎ মনোভাব প্রকাশ করার জন্য। দণ্ডকারণ্যে নির্বাসিত ধর্ম্মপুত্র প্রথম পাণ্ডবের প্রতি, আমাকে পরিগণক যন্ত্রে আর্যলিপি লেখা শেখানোর জন্য। শ্বেতযবন রাজ্যে নির্বাসিত অভিমন্যুর প্রতি, আমাকে সচল রাজ্যের খোঁজ দেবার জন্য। উক্ষতারণের নিকটে নির্বাসিত বিদুরের প্রতি, আমার প্রতিটি লেখা পড়ে উৎসাহ দেবার জন্য। দিশার প্রতি, আমার অশেষ অত্যাচার সহ্য করার জন্য।

আরো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি হস্তিনাপুর নিবাসী পবনপুত্র দ্বিতীয় পাণ্ডব, হরিকেল নিবাসী ইন্দ্রপুত্র তৃতীয় পাণ্ডব, দন্ডকারন্যে নির্বাসিত গন্ধর্বের বরপুত্র চতুর্থ পাণ্ডব ও উজ্জয়নীপুরে প্রবাসী দ্রুপদ কন্যা কৃষ্ণার প্রতি, যারা আমাকে পূর্বজন্মে পাণ্ডব হতে সাহায্য করেছিলেন।


মন্তব্য

ইমরুল কায়েস এর ছবি

অভিনন্দন ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনিই প্রথম।

===============================
তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

শুভকামনা এবং অভিনন্দন হাসি
_________________________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ, আপনার জন্যও শুভকামনা।

===============================
তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কীর্তিনাশা এর ছবি

সু স্বাগতম এবং অভিনন্দন । দেইখেন সচল হওয়ার আনন্দে আবার হারাইয়া যাইয়েন না। নিয়মিত লিখতে হইবো কিন্তু!!

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

দারুন লেখা দিসেন ভাই! শওকত আলী সাহেবও ফেল!
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

সবজান্তা এর ছবি

গ্যালো, আরো একজন ডুবলো।


অলমিতি বিস্তারেণ

অনিকেত এর ছবি

তোফা হয়েছে বস।

আর সচলায়তনে সু-স্বাগতম।

মনজুরাউল এর ছবি

শভকামনা পাণ্ডব।

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

স্নিগ্ধা এর ছবি

স্বাগতম এবং অভিনন্দন!

দুর্দান্ত এর ছবি

সুস্বাগতম।
আয়ুস্মান ভবেহ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যারা অভিনন্দন জানিয়েছেন, যারা লেখাটা পড়েছেন, সবাইকে ধণ্যবাদ। আশীর্বাদ করুন যেন লেখা অব্যাহত রাখতে পারি।

===============================
তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

যুধিষ্ঠির এর ছবি

প্রিয় শুদ্ধ বন্ধু, এ তো অসাধারণ লেখনী! কি মাধুর্য! কি গতি! অবশেষে এই অবিরাম নিস্তব্ধতার দেশে থেকেও সরব হতে বাধ্য করলে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধর্ম্মপুত্র, আপনার নীড়পত্র অনুসন্ধান করলাম। পাঠে অবগত হলাম যে, আপনি এই স্পর্শাতীত রাজ্যে আসার পর ষাটটি দিবস গত হয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে আপনার কার্যকলাপ আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেল কীভাবে? দণ্ডকারণ্যের বাত্যাতাড়িত যে অংশে আপনি নির্বাসিত সেখানে চিত্রকলা বা কাব্যকলা থেকে দূরে থাকা কি করে সম্ভব? সংশয়ের আর সম্ভাবনার যে কথা বলেছেন সেগুলো তো পাণ্ডবদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এ না হলে তো পাণ্ডবত্ব থাকে না। নিশ্চুপ থাকবেন না। এই স্পর্শাতীত সচল রাজ্যে সচলতাই প্রাণের বহিঃপ্রকাশ। পাণ্ডবদের একবার মৃত্যু হলে অচ্ছ্যুৎ জন্ম নিতে হয়। এটি কাম্য নয় যে ধর্ম্মপুত্র পরজন্মে সপ্তম পাণ্ডব হয়ে জন্মান।

===============================
তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍আপনাকে সচলাভিনন্দন।
লিখতে থাকুন আপনার "ভাসা ভাসা" লেখা হাসি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও। - হুমায়ুন আজাদ

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ষষ্ঠ পাণ্ডব না
আপনি বোধ হয় প্রথম কৌন্তেয় কর্ণ

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

হাততালি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।