সাম্প্রতিক কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে সারা দুনিয়া জুড়ে যে তোলপাড় চলছে তার একটা মজার উপসংহার টানার চেষ্টা করা হয়েছে আইরিশ টাইমসের এই প্রতিবেদনটিতে। প্রতিবেদনটির অহেতুক বাঙলা অনুবাদ না করে এখানে প্রতিবেদক টনি কিনসেলার দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে আমার মতপার্থক্যর কথা বলার চেষ্টা করব।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক আর তাদের জুড়িদার বীমা কোম্পানীগুলোর একে একে গণেশ উলটানো, ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বিদায়ী বুশ সরকারের নগদ নারায়ণের ব্যবস্থা করে তাদের বাঁচিয়ে তোলা, ট্রেজারীর নানা কায়দায় বিশ্বজুড়ে হাত পাতার প্রয়াস, শুল্ক-কর ব্যবস্থার পূনর্গঠন আর সরকারী সংস্থাগুলোতে কাট-ছাঁটকে টনি বাঁধনহারা পুঁজিবাদ আর বাজার অর্থনীতির দিন শেষের শুরু বলে মনে করেন। কিন্তু বিষয়টা কি এতই সরল? ‘পুঁজিবাদ’ যদি নেহাৎ একটা অর্থনৈতিক ধারনা হত, ‘বাজার অর্থনীতি’ যদি নিছক একটা নখ-শিংহীন বাজার ব্যবস্থা হত, তাহলে হয়তো টনি এবং তিনি যাদের দোহাই দিয়েছেন তাদের এই যান্ত্রিক সরলীকরণের কথা মেনে নেয়া যেত। বাস্তবে ‘পুঁজিবাদ’ তো এত সীমাবদ্ধ বিষয় নয় আর তার সন্তান ‘বাজার অর্থনীতি’ও এত সহজ-সরল বিষয় নয়। ‘পুঁজিবাদ’ যতটা না অর্থনৈতিক তার চেয়ে ঢেড় বেশি রাজনৈতিক। জীবনের এমন কোন দিক নেই যেখানে পুঁজিবাদ আর বাজার অর্থনীতি নাক গলায় নি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন তথা কম্যুনিজমের পতনের (টনির মতে) ১৭ বৎসরের মধ্যে পুঁজিবাদের বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে বলে প্রতিবেদনের শুরুতে টনি যতটাই চমক দেখিয়েছেন, কিছুদূর যাবার পর সেই চমকের সপক্ষে আর জোরালো কোন প্রমান দেখাতে পারেন নি। বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটা মিশ্র ধরনের অর্থনীতির আশ্রয় নিয়ে কিভাবে টিকে যাবে সে কথা বলেছেন। টনি এও বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাকী দুনিয়ার সাহায্যে আর নিজের উদ্ভাবনী শক্তি খাটিয়ে তার অর্থনীতিকে আবারো বেগবান করে তুলবে। পাঠক টানার জন্য শুরুতে একটা চমক দিলেই কি, টনি তো জানেনই যে পুঁজিবাদ বা বাজার অর্থনীতি এতো ঠুনকো জিনিষ নয় যে তা এতো সহজে ধ্বসে পরবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিরিশের মহামন্দা পার করেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পার করেছে, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইরাক, আফগানিস্তানের যুদ্ধ পার করেছে এবং করছে, আরো দু’দশ জায়গায় যুদ্ধ বা ঠোকাঠুকি লাগানোর চেষ্টায় আছে। এহেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা রাতারাতি হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে বা পালটে যাবে? কোন সম্ভাবনাই নেই।
খোদ টনিই বলেছেন, উচ্চহারের সুদের (৩.৫%) প্রতিশ্রুতি থাকলেও মার্কিন ব্যাংকগুলোর একে অপরের প্রতি অনাস্থার দরুন আন্তঃব্যাংক লেন-দেনের বদলে নিম্নহারের (০.০৫%) সরকারী বণ্ডগুলোর উপর নির্ভর করছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র এখানে নিজেই একটা ব্যবসায়ী পক্ষ হয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে সহযোগিতা করছে। সরকার নিজেই বাজারে চলনসই পুঁজির যোগান দিয়ে ব্যবস্থাটিকে টিকেয়ে রাখছে। একে আর যাই হোক “সমাজতান্ত্রিক জাতিয়করণের” সাথে তুলনা করা যায়না। গত কয়েক সপ্তাহ জুড়ে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের নিয়ে পতিত কোম্পানীগুলোকে বাঁচানোর কর্মপরিকল্পনা করা, সংসদে “বেইল-আউটের” বিল নিয়ে বিতর্ক আর তা পাশ করানো প্রমাণ করে মার্কিন সরকার নিজে কতটুকু উদ্বিগ্ন এবং প্রয়োজনে নিজের হাত সে কতটুকু বাড়াতে পারে।
আসলে পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে অভিযোজন করে টিকে থাকা। এতে যা কিছু খড়্গহস্থ হতে হবে, তা যাবে জনসাধারণের উপর দিয়ে। শুল্ক-কর বৃদ্ধি, চাকুরীতে কাট-ছাঁট বা জনকল্যানমূলক বাজেটে কুড়ুল চালানো সবই যাবে সাধারণ মানুষের উপর দিয়ে, বিশেষতঃ অভিবাসী আর নিচুতলার মানুষদের উপর দিয়ে। মিউচুয়াল ফান্ড বা বীমা কোম্পানী থেকে ট্রিলিয়ন ডলার মেরে দিয়ে সাধারণ নাগরিকদের পথে বসানো কর্তাদের কিন্তু কোন বিচারের সম্মূখীন হতে হবে না এক চাকুরী হারানো ছাড়া। তা অমন নতুন নতুন চাকুরীর বাজার তাদের জন্য খোলা আছে।
পরম মুক্তবাজার অর্থনীতি ‘সোনার পাথর-বাটি’ বই কিছু নয়। অমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদী কোন রাষ্ট্রে কস্মিন কালেও ছিলনা। দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা, আঞ্চলিক সহযোগিতা, কোটা সিস্টেম এমন হরেক নামে কঠোর সরকারী নিয়ন্ত্রণযুক্ত অর্থনীতিই সেখানে বিরাজমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এর ব্যতিক্রম নয়। এখন এর কিছু কিছু পরিবর্তন হবে মাত্র। তারপরও পুঁজিবাদের সহায়ক নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাই থাকবে। এতে উল্লসিত হবার কিছু নেই।
ফেডারেল রিজার্ভ বা ট্রেজারীর নামে যে দাতা হাতেম তাঈদের আবির্ভাব ঘটেছে তাদের পেছনে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে দুনিয়া জোড়া গোরীসেনরা। এই গৌরীসেনরা উদার হাতে বিনিয়োগ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের পেছনে। এখানে দেখুন সেই গৌরীসেন কারা! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সবসময় এদের অনুকূলে থাকে। তবে সেই ট্রেড ব্যালেন্সের সিংহভাগই আবার মার্কিন সরকারের কাছে ফেরত যায় তাদের বিনিয়োগ হিসেবে। এর সাথে মার্কিন মুলুকে ছোট-বড় বেসরকারী খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ যোগ করলে তাদের জন্য পজেটিভ ট্রেড ব্যালেন্স বলে আর কিছু থাকে না। বিনিয়োগের সুদ নিয়মিতই পরিশোধ করা যায় যেহেতু সুদ টাকার অঙ্কে কখনোই বিনিয়োগকে স্পর্শ করতে পারে না। ‘হুণ্ডি কাজল’ বা ‘পাঁচে চল্লিশে’র ব্যবসার মত এর হঠাৎ পতন হবে না কারন বাইরের বিনিয়োগ কখনো বন্ধ না হয়ে উত্তোরোত্তর তা বেড়েই চলছে। আর কখনো যদি অমন সঙ্কট তৈরী হবার সম্ভাবনা দেখাও যায় তাহলে তৃতীয় দুনিয়ার কোথাও এক-আধটা যুদ্ধ লাগিয়ে এসব দেশকে কিছু করে খাবার বা তাদের মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে মার্কিন সরকার সিদ্ধহস্ত।
অবাক হবেন না দেং-পন্থী গণচীনকে গৌরীসেনদের মোড়লদের মধ্যে দেখলে। কারন নয়া দুনিয়ার সবচে’ উঠতি ও শক্তিশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হচ্ছে গণচীন। সমাজতন্ত্রের মোড়কে এতদিন ধরে ব্যবসা করা গণচীন শীঘ্রই নিজের আসল চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হবে যখন তার স্বার্থে আঘাত লাগবে। মার্কিন মুলুকে পুঁজি বাজারের আপাত এই ধ্বসের আঁচ গণচীনের গায়ে লাগার আগেই সে তার গোপন হাত বাড়িয়ে দেবে তার “আসল কমরেড”দের বাঁচানোর জন্য। মাঝারী আর ছোট গৌরীসেনরাও নিজেদের বিশ্বস্ততা প্রমাণে পিছপা হবে না।
পুঁজিবাদ আসলে রাষ্ট্রের সীমায় আবদ্ধ ব্যবস্থা নয়। সারা দুনিয়াই তার ক্রীড়াক্ষেত্র। কোন স্থানে, কোন কালে তার অন্তস্থঃ টানা-পোড়েন প্রকট হলে আর দশটা জায়গা থেকে সে মলম জুগিয়ে যায়। যতক্ষন পর্যন্ত না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনগণের সংগঠণের নেতৃত্বে মৌলিক অর্থনৈতিক তথা রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটছে ততদিন পর্যন্ত মার্কিন মুলুকে পুঁজিবাদ বহাল তবিয়তেই থাকবে।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের প্রতি আইরিশ টাইমসের প্রতিবেদনটির লিঙ্ক এগিয়ে দেবার জন্য।)
মন্তব্য
বেশ তথ্যবহুল আর বিশ্লেষণধর্মী একটা লেখার জন্য ধন্যবাদ। এই চরম অর্থনৈতিক নৈরাশ্যের সময়ে আরেকটু আশাবাদী হতে পারলে ভালো হত, কিন্তু সেটা তো সংগত কারণেই সম্ভব না।
আরো একটু বেশি পড়ার ইচ্ছা ছিলো। বিষয়টা নিয়ে তো জানি না কিছুই। আচ্ছা আম্রিকান এই পতনের কারণটা নিয়ে কেনো লেখা কি পেতে পারি?
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
সেইটাই কথা। এদের দূর্নীতি ঢাকার জন্য মাঝে মাঝেই রুটিনওয়র্কের মত ওকলাহোমা বোম্বিং বা টুইন টাওয়ার বোম্বিং হবে (বিল্ডিং-৭ এ কোন বিমান পড়েনি, তেলও পড়েনি, তারপরও ওয়াল স্ট্রীটের কেলেঙ্কারীর রিপোর্টের ভারে ভেঙ্গে পড়ে) .... .... ..... এছাড়া এতে সুবিধামত মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে "তুই সন্ত্রাসী" বলা যাবে যে কোন রাষ্ট্রকে।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
এবং সমস্যাটা এখানেই!
ইতোমধ্যে পড়ে না থাকলে, নেওমি ক্লেইনের 'ডিস্যাসটার ক্যাপিটালিজম' পড়ে দেখতে পারেন। গত তিন দশক জুড়ে পূঁজিবাদ কিভাবে কান ধরে - অবশ্যই শুধু একা হাতে নয়, রাষ্ট্র তো আরেক হাত বাড়িয়ে আছেই - সারা পৃথিবীর আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামোর খোল নলচে বদলে ফেলেছে আর তার মাশুল দিচ্ছে কারা, সেটার বিশ্লেষণ।
গৌরী সেনের লিঙ্কটা কাজ করছে না।
তথ্য প্রদানের জন্য ধণ্যবাদ। তবে লিঙ্কটা দিতে পারলে ভালো হত।
গৌরীসেনের লিঙ্কটা হচ্ছেঃ http://www.treas.gov/tic/mfh.txt
এরপরও যদি অ্যাকসেস করতে না পারেন তাহলে প্রথমে http://en.wikipedia.org/wiki/Treasury_security -এ যান। তারপর External links-এ গিয়ে Major Foreign Holders of U.S. Treasury Bonds-এ ক্লিক করুন।
===============================
তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
www.naomiklein.org হচ্ছে তার ওয়েবসাইট, সেখানে অন্যান্য বইগুলোরও খোঁজ় পাবেন।
লিঙ্কের জন্য ধন্যবাদ!
লেখা ভালো লেগেছে, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
"সমাজতন্ত্রের মোড়কে এতদিন ধরে ব্যবসা করা গণচীন শীঘ্রই নিজের আসল চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হবে যখন তার স্বার্থে আঘাত লাগবে। মার্কিন মুলুকে পুঁজি বাজারের আপাত এই ধ্বসের আঁচ গণচীনের গায়ে লাগার আগেই সে তার গোপন হাত বাড়িয়ে দেবে তার “আসল কমরেড”দের বাঁচানোর জন্য। মাঝারী আর ছোট গৌরীসেনরাও নিজেদের বিশ্বস্ততা প্রমাণে পিছপা হবে না।"
একটু বুঝিয়ে বলবেন কি ?
নতুন মন্তব্য করুন