পাণ্ডবের চীন দর্শন-০৬

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৫/০৩/২০০৯ - ১০:৫৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চীনের শ্রমিক-কৃষক, চীনের শক্তি

১৯৫৪ সালে চীনা সাহিত্যিক হু ছি একজন চেকশ্লোভাকিয়ান চিত্র নির্মাতার সহকারী হিসাবে শিনজিয়াঙ-শিঝ্যাঙ জাতীয় মহাসড়কের ওপর একটা তথ্যচিত্র নির্মান করতে তিব্বত যান। শিনজিয়াঙ-শিঝ্যাঙ জাতীয় মহাসড়ক নির্মানরত শ্রমিক আর তিব্বতের গ্রামের শিশুদের নিয়ে তখন তিনি লেখেন এক চমৎকার শিশুতোষ উপন্যাস – “সাতরঙা পথ”। উপন্যাসটি লেখার বত্রিশ বৎসরেরও পরে এর বাংলা অন...চীনের শ্রমিক-কৃষক, চীনের শক্তি

১৯৫৪ সালে চীনা সাহিত্যিক হু ছি একজন চেকশ্লোভাকিয়ান চিত্র নির্মাতার সহকারী হিসাবে শিনজিয়াঙ-শিঝ্যাঙ জাতীয় মহাসড়কের ওপর একটা তথ্যচিত্র নির্মান করতে তিব্বত যান। শিনজিয়াঙ-শিঝ্যাঙ জাতীয় মহাসড়ক নির্মানরত শ্রমিক আর তিব্বতের গ্রামের শিশুদের নিয়ে তখন তিনি লেখেন এক চমৎকার শিশুতোষ উপন্যাস – “সাতরঙা পথ”। উপন্যাসটি লেখার বত্রিশ বৎসরেরও পরে এর বাংলা অনুবাদ পড়ার সুযোগ পাই। সেখানে বলা পাথর আর বরফের দুর্গম পাহাড় হাতুরী-শাবল দিয়ে কেটে গণমুক্তি ফৌজের সেনাদের পথ বানানোর গল্প তখন নিছক গল্প বলেই মনে হয়েছিল। তারও প্রায় চৌদ্দ বৎসর পর চীনে প্রথমবার গিয়েই আমি বুঝতে পেরেছিলাম হু ছি খুব সামান্যই বলেছিলেন। বাস্তবে চীনের রাস্তা বানানোর গল্প আরো অবিশ্বাস্য।

বাংলাদেশের তুলনায় চীন অনেক দূর্গম দেশ। সেখানে একটা বড় অংশ জুড়ে আছে বিশাল বিশাল পর্বতমালা, ঊষর মরুভূমি, বরফ ঢাকা প্রান্তর আর বিস্তীর্ন তৃনভূমি। এমন সব জায়গায় রাস্তা বানানো, রেললাইন বসানো খুবই কঠিন। আর সেই কঠিন কাজটিকে সম্ভব করে তুলেছেন চীনের শ্রমিকরা। কঠিন পাথুরে পাহাড়ের উপর দিয়ে রাস্তা, পাহাড় খুঁড়ে টানেল, প্রমত্তা নদীর উপর সেতু সবই সম্ভব করেছেন তারা। গোটা চীন জুড়ে জাতীয় মহাসড়ক, এক্সপ্রেস হাইওয়ে, প্রাদেশিক মহাসড়ক, স্থানীয় সড়ক আর শহর জুড়ে রাস্তার মোট দৈর্ঘ্য কয়েক লক্ষ কিলোমিটার হবে বলে মনে হয়। প্রায় সব পথই মসৃন, ঝকঝকে। চীনা শ্রমিকরা চুপচাপ এসব পথ নির্মান করেছেন, করে যাচ্ছেন। বৃষ্টি হোক, তুষারপাত হোক আর বন্যায় ভেসে যাক নূন্যতম সময়ের মধ্যেই তারা আবার সব ঠিকঠাক করে দিচ্ছেন। এ’নিয়ে চীনা শ্রমিকদের বা চীনা সরকারের শ্লাঘা প্রকাশের কোন ব্যাপার চোখে পড়েনি। শুধু রাস্তা-সেতু বানানোতে নয়, সারা চীন জুড়ে লক্ষাধিক কারখানায় চীনা শ্রমিকরা এভাবেই কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে চীন আজ একটি অর্থনৈতিক পরাশক্তি।

চীনা শ্রমিকের সকাল শুরু হয় সকাল সাতটারও আগে। কাজ শুরু হয়ে যায় আটটা বাজতে না বাজতেই। দিনের কাজ শেষ হতে হতে পাঁচটা বাজে। দিনের মাঝখানে আর শেষে সবাই মিলে খাওয়া। সে খাওয়াও খুবই সাধারণ। ভাত বা নুডুলসের সাথে সব্জী সেদ্ধ, সাথে এক টুকরো মাছ বা মাংস। সপ্তাহের ছুটি রবিবার ছাড়া আর বাকি ছয় দিনের রুটিন এই। কোন কোন ক্ষেত্রে রোস্টার ডিউটি করে ছুটির দিনেও কাজ। শারীরিক সামর্থ্য বা যন্ত্রের ব্যবহার নয়, চীনা শ্রমিকের শ্রেষ্ঠত্ব তার কাজ করার মানসিকতা নিয়ে। সেখানে ফাঁকি চোখে পড়েনি। অলস লোক দুনিয়ার সর্বত্রই আছে। তবে চীনা শ্রমিকদের মধ্যে অলসতা বিরল।

বেকারত্বর হার বেশি হওয়ায় চীনা শ্রমিককে সাধারণত ঘর ছেড়ে দূরে যেতে হয় কাজ খুঁজতে। প্রধাণতঃ পূর্ব আর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের শিল্পসমৃদ্ধ প্রদেশগুলোতে। কেউ কেউ ছুটি-ছাটায় হয়তো দেশের বাড়ী ফেরেন তবে একটা বড় অংশ থেকে যান নিজের কাজের জায়গাতেই। আস্তে আস্তে সেখানকার ভাষা শেখেন (যদিও ম্যাণ্ডারিন চলে সারা দেশেই), সেখানকার খাবার-দাবার আর পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেন। কেউ কেউ সেখানেই বিয়ে করে সংসার পাতেন। ক্রমে ক্রমে দেশের বাড়ী ঠাঁই পায় গল্পে-স্মৃতিতে। হঠাৎ নিজ দেশের কাউকে পেলে জমে ওঠে দেশের গল্প।

মানুষের কাজে লাগে এমন হেন জিনিষ নেই চীন বানায় না। তাই কোন চীনা শ্রমিক কোন একটা বিশেষ ইণ্ডাস্ট্রির কাজে দক্ষতা অর্জন করলে তার কাজ পেতে অসুবিধা হয় না। আবার চীনের শিল্পাঞ্চলগুলো এক এক ধরণের ইণ্ডাস্ট্রির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। যেমন যে এলাকা জুতা বানায় সেখানকার প্রায় সব কারখানাই জুতা বানায় অথবা এর ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ ইণ্ডাস্ট্রি হিসেবে ইন্টারমিডিয়েট গুডস তৈরী ও সরবরাহ করে। তাই দক্ষ শ্রমিকদের পক্ষে কাজ খোঁজা সহজ হয়। তবে ২০০৮-এর মহামন্দায় চীনে হাজার হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, আরো বন্ধ হতে যাচ্ছে। এতে প্রায় দুই কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়বেন। এই সমস্যার সমাধাণ যে কীভাবে হবে তা বুঝতে পারছিনা।

চীনা শ্রমিকের আয় কেমন? বলাই বাহুল্য তা খুবই কম। চীনা শ্রমিককে দরিদ্রই বলা উচিত। তাদেরকে আয়ের কোন শ্রেণীতে ফেলা যায় সেটা অর্থনীতিবিদদের ব্যাপার, তবে আমার চোখে তারা শুধু দরিদ্রই না হতদরিদ্র। তাদের পোশাক, তাদের খাবার, তাদের বাসস্থান তাদের জীবন-যাত্রা দেখে তাতে দারিদ্রের কোন মহত্ত্ব আরোপ করতে পারিনি। এটা হয়তো আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা।

চীনারা একটা পর্যায় পর্যন্ত সরকারী খরচে শিক্ষা পায় ঠিকই তবে তা শ্রমিক-কর্মী-কৃষক বানানোর শিক্ষা। আমাদের ভাষায় আমরা যেগুলোকে সাধারণ, বিশেষায়িত বা উচ্চশিক্ষা বলি চীনে সেটা পেতে হলে মা-বাবার ট্যাঁকের জোর থাকতে হয়। আমেরিকান বা ইউরোপীয়দের বানানো অন্য ভাষা মাধ্যমের (বিশেষতঃ ইংরেজী মাধ্যম) স্কুলও আছে। আছে ব্যয়বহুল বোর্ডিং স্কুলও। তবে সেখানে কারা পড়তে পায় তা বোধ হয় বলার দরকার পরেনা। চীনেও শ্রমিকের ছেলে-মেয়ে সাধারণতঃ শ্রমিকই হয়।

টিভি দেখা, ফুটবল খেলা, কয়েকজন মিলে গান গাওয়া, মদ খাওয়া, গল্প করা এসব সাধারণ কর্ম-কাণ্ডই চীনা শ্রমিকদের বিনোদনের উপায়। শ্রমিক দিবস, চীনা নববর্ষ আর “ড্রাগন বোট” উৎসব হচ্ছে চীনের প্রধাণ পার্বন। পার্বনের সময় একটু লম্বা ছুটি পাওয়া যায় বলে মূল আমোদ-উল্লাসটা তখনই হয়। কেউ কেউ গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যান। বাকীরা স্থানীয় উৎসবগুলোতেই অংশগ্রহণ করেন। প্রায় প্রত্যেক জেলার একাধিক নিজস্ব টিভি চ্যানেল থাকায় টিভিই সাধারণ শ্রমিকদের বিনোদনের প্রধাণ উপায়।

চীনের অধিকাংশ মানুষের কোন ধর্ম বিশ্বাস না থাকায় শ্রমিকদের বেশির ভাগের জীবনে ধর্মপালন বলে কিছু নেই। বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে যাদের দেখেছি তাদের বেশির ভাগই অবস্থাপন্ন। দক্ষিণাঞ্চলের কারখানাগুলোতে বাস্তু দেবতার প্রতিমা আর তার সামনে ফল, ফুল, মদ আর প্রদীপের ভোগ দেখেছি। ধর্ম বিশ্বাস না থাকায় শ্রমিকরা নিজের ক্ষমতার ওপরই বেশি আস্থাশীল। তাই শ্রমিকরা যখন কথা বলে, মত প্রকাশ করে, তখন তা বেশ জোরে-শোরেই করে। আপনি তাই কোথাও চীনাদের মধ্যে কোন দলকে উচ্চস্বরে প্রায় ঝগড়া করার মত করে কথা বলতে দেখলে বুঝবেন সেখানে চীনা শ্রমিক আছেন। অবশ্য অধিকাংশ চীনারাই জোরে জোরে কথা বলতে, উচ্চস্বরে হাসতে বা হল্লা করতে পছন্দ করেন। এটি তাদের প্রাণের বহিঃপ্রকাশ। উন্নাসিকরা এতে নাক কুঁচকাতে পারেন, কিন্তু এটি তাদের সরল মনেরই পরিচায়ক।

চীনা শ্রমিকরা সাধারণতঃ সৎ, পরিশ্রমী, অনুগত এবং নির্লোভ। খারাপ মানুষ যে নেই এমন তো হতে পারে না, তবে দুর্নীতিটা উপরতলাতেই বেশি। এরা বেশ বন্ধুপরায়ণ এবং অতিথিবৎসল। এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের কথা বলি। লী’র গাড়ি ভাড়া নিয়েছিলাম দিনচুক্তিতে। প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত আটশো ইউয়ান হিসেবে। লী কিন্তু ট্যাক্সির মিটার বন্ধ রাখেননি। মিটারে দেখেছি হাজার ইউয়ানের বেশি বিল উঠেছে, এর মধ্যে লী আবার রাস্তার টোলগুলোও দিয়েছেন, তবু দিনশেষে সে সেই আটশো ইউয়ানই নেবেন। বখশিশ দিতে জোরাজুরি করলেও নেবেন না। একদিন দুপুরে কেবল একসাথে ম্যাকডোনাল্ডস-এ খেতে রাজী করাতে পেরেছিলাম। সিগারেট সেধেছি, বিয়ার সেধেছি, রাতের খাবারের দাওয়াত দিয়েছি, সব হাসিমুখে প্রত্যাখান করেছেন। অথচ আমাকে নিয়ে চায়না মোবাইলের অফিসে গিয়ে আমার মোবাইলের সমস্যা দূর করে দিয়েছেন। দূরের কারখানাগুলোর সাথে মোবাইলে কথা বলে পথ খুঁজে খুঁজে ঠিক গন্তব্যে নিয়ে গেছেন। আমাকে নিয়ে শপিং-এ গিয়ে সুবিধাজনক দামে ভালো জিনিষ কোথায় পাওয়া যাবে তা দেখিয়ে দিয়েছেন। আমার হয়ে দোকানদারের সাথে দরাদরি করেছেন। আমার পাসপোর্টে আমার জন্মসাল দেখে উল্লাসধ্বনি দিয়ে নিজের আইডি কার্ড বের করে দেখিয়েছেন আমরা একই বৎসরে জন্মেছি। শেষের দিন দূরের এক জেলায় নেমে তাকে বিদায় দিতে হয়েছে, তবু ফেরার ভাড়া নিতে চাননি। তার চুক্তির সেই আটশো ইউয়ানই নিয়েছেন। অথচ ফিরতে তার বিল উঠবে আরো অনেক বেশি। উষ্ণ আলিঙ্গন করে বিদায় জানিয়েছেন। ইউহান ভাষা আমার পক্ষে দুর্বোধ্য হলেও তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠা কৃতজ্ঞতা থেকে তার মনের কথা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি।

চীনে যেমন পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী সেলসিয়াসের গরম দেখেছি তেমন হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রাও দেখেছি। মোটামুটিভাবে চীনের অধিকাংশ জায়গাতেই শীত পড়ে। উত্তর আর পশ্চিমাঞ্চলের শীত তো ভয়াবহ মাত্রার আর দীর্ঘ। তাই বেশিরভাগ জায়গায় ঘর-বাড়ি তৈরি করার সময় শীত ঠেকানোর কথা মাথায় রাখতে হয়। অবস্থাপন্নদের বাড়িতে হিটিং সিস্টেম থাকলেও বেশির ভাগ বাড়ীতেই সেই ব্যবস্থা থাকে না। আমি এমনকি তারকাওয়ালা কিছু হোটেলও দেখেছি যাতে হিটিং সিস্টেম নেই। একবার জানুয়ারীর প্রচণ্ড শীতে কুনমিঙ-এ তাপমাত্রা যখন হিমাঙ্কের নিচে তখন হোটেল বুকিং ছাড়াই সেখানে হাজির হয়েছিলাম। রাতে বহু কষ্টে একটা দুই তারা হোটেলে ঠাঁই পেলাম। রুমের চাবী দেবার সময় রিসেপশনের মেয়েটা বলল, “বাট হ্যাভ নো এয়ারকুলার”। আমি ভাবলাম পাগল নাকি? এই শীতে এয়ারকুলার আমার কী কাজে লাগবে! রুমে ঢুকে বুঝলাম আসলে সে কী বোঝাতে চেয়েছে, রুমে হিটিং সিস্টেম নেই। সেই ভয়াবহ রাতে মনে হয়েছিল পরদিন বিছানা থেকে উঠে আর এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবো না। দুই তারা হোটেলের যেখানে এই অবস্থা সেখানে শ্রমিকদের বাড়ি-ঘরের কথা মনে হয় বর্ননা করার দরকার নেই। ইট সিমেন্টের ফ্রেমে কাঁচ বা ফাইবার গ্লাস লাগিয়ে, অথবা কোথাও শুধু পলিথিন পেপার মুড়িয়ে শীত ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। প্রচণ্ড গরমের এলাকাগুলোতে এয়ারকুলারের বিলাসিতা কম জনই করতে পারেন। সে সংখ্যাটা বাংলাদেশের তুলনায় বেশি অনুপাতের হলেও তা আসলে কমই।

আমার চীন ভ্রমণগুলি পেশাগত কারনে হওয়ায় আর আমার পেশার সাথে কৃষিকাজের সম্পর্ক কম থাকায় চীনের কৃষকদের খুব কাছে যেতে পেরেছি কম। তবে ধান-গম-ভুট্টা ক্ষেতে, আঙ্গুর আর চায়ের বাগানে, চা গাছের মত খাটো করে কাটা কমলা বাগানে, সব্জি ক্ষেতে, ফুলের ক্ষেতে চীনা কৃষকদের কাজ করতে দেখেছি। তাদের দেখেছি প্রচণ্ড গরমে মাটির পাত্রে করে রাখা শরবত আর কুলফি কিনে খেতে। রাস্তার পাশের ফুড-ভ্যান থেকে সাধারণ খাবার কিনে খেতে। ভ্যান ভরে নিজের ফসল ঠেলে নিয়ে যেতে। রাস্তার পাশে নিজের ফসল স্তুপ করে ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করতে।

পূর্ব দিকের হাইয়ান এলাকা কমলা চাষের জন্য বিখ্যাত। একবার কমলার মৌসুমে সেখানে গিয়েছিলাম। সাপের মত মসৃন আর আঁকাবাকা পথের দুধারে মাইলের পর মাইল কমলা বাগান। কমলা গাছগুলো কোমর থেকে বুক সমান উঁচু। একেবারে পাতি লেবুর সাইজ থেকে বিরাট জাম্বুরা সাইজের নানা জাতের কমলা ফলে আছে। যার যার ক্ষেতের সামনে লাল কাপড় বা পলিথিনের সামিয়ানার নিচে কাঠ আর কাগজের প্যাকিং বাক্সে কমলা নিয়ে কিষানী বসে আছেন। সামনে টেবিল, সেখানে মাপার জন্য স্কেল আর অন্যান্য প্যাকিং সরঞ্জাম। পেছনে কমলা বাগানে কিষান আর মজুররা কমলা তুলছেন, গাছের পরিচর্যা করছেন। পথের একদিকে কমলা বাগানের পর নদী আর পথের আরেক দিকে কমলা বাগানের পর পাহাড় যার চূড়া ধোঁয়ার মত মেঘে ঢাকা – ঠিক যেন “আ ওয়াক ইন দ্য ক্লাউডস”-এ দেখা দৃশ্যের মত। গাড়ি থামিয়ে এক কিষানীর কাছ থেকে কমলা কিনলাম প্রতি কেজি দুই ইউয়ান দরে। অথচ তার আগের দিন দু’শ কিলোমিটারের চেয়ে কম দূরের নিঙবোতে কিনেছিলাম প্রতি কেজি দশ ইউয়ান দরে। বুঝলাম ফড়িয়া-পাইকার-খুচরা বিক্রেতার মূল্য বাড়ানোর চক্র এখানেও সমান সক্রিয়।

চীনের কৃষকদের জীবন কেমন? কাছ থেকে তাদের রোদে পোড়া চেহারা, মলিন-জীর্ন পোশাক আর অপুষ্টিতে ভোগা শরীর দেখে বুঝেছি এর কোনটাই আমার কাছে অপরিচিত নয়। এসব আমি আপনি কোটি কোটি দেখেছি আমাদের নিজেদের দেশ জুড়ে। তাই চীনের কৃষকের অবস্থা বুঝতে, তার দিন যাপন বুঝতে আমার বা আপনার তাদের সাথে না মিশলেও চলবে।

বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে নাকি উন্নয়নের ধারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে দেবার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে দু’টো কাজ করা হয়েছিল। এক, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। দুই, দেশের প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত বিদ্যুত পৌঁছে দেয়া। সোভিয়েত দেশে তা কতটুকু হয়েছিল তা বলতে পারবো না, তবে চীনে এ’কাজ দু’টো বেশ ভালোভাবেই হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামেও বিদ্যুত দেখেছি। চীনে ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিং হতে দেখেছি, তবে তা মূলতঃ গরমের দিনে এবং অবশ্যই আগে বলে কয়ে। আসলে গরমে পাখা-এয়ারকুলারের বাড়তি বিদ্যুত চাহিদা মেটানোর জন্য কারখানা এলাকায় কিছুটা লোড ম্যানেজমেন্ট করা হয়।

চীনের এই সারা দেশব্যাপী বিদ্যুত নেটওয়ার্ক কিন্তু খুব সহজে তৈরি হয়নি। উত্তাল নদীতে বাঁধ দিয়ে, তেল, কয়লা, গ্যাস আর পারমানবিক জ্বালানী পুড়িয়ে তৈরি হয় সেই বিদ্যুত। বাড়ির ছাদে সোলার সেল, সোলার হিটিং সিস্টেমও চোখে পড়ে। কোথাও কোথাও উইণ্ডমিলও আছে। তবে বড় বড় বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রগুলো নিরবচ্ছিন্ন চালানোর পেছনেও কিন্তু সেই চীনা শ্রমিকের দলই আছে। কয়লা খনিগুলো থেকে যোগানো হয় বিদ্যুত তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানী। চীনের খনি শ্রমিকের জীবনে “জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য”। এমনকি বাংলাদেশে থেকেও সংবাদ মাধ্যমে চীনের খনিগুলোতে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা প্রায়ই শোনা যায়। বলাই বাহুল্য এসব দুর্ঘটনার সবচে’ বেশি বলি চীনের শ্রমিকরা।

তবে একটা বিষয়ে চীনে বিদ্যুতের অপব্যয় দেখে অবাক হয়েছি। চীনে এমন দোকান, শপিং মল, রেস্তোরাঁ কমই দেখেছি যেখানে নিওন-সাইন নেই। বিলবোর্ড, হোর্ডিং, নাইট ক্লাব আর ডিসকোগুলোর তো কথাই নেই। অথচ শহরে স্ট্রীট লাইট নেই এমন রাস্তাও দেখেছি। আপনারা যদি কোন মুভিতে কোন চীনা শহরের রাতের দৃশ্য দেখে থাকেন তবে তা দেখবেন অবশ্যই নিওন আলোয় ঝলমলে। আমার ধারণা গোটা চীনে শুধু নিওন আলোয় যে পরিমাণ বিদ্যুতের অপচয় হয় তা দিয়ে গোটা বাংলাদেশকে আলোকিত করে ফেলা সম্ভব।

চীনের শ্রমিক-কৃষক নিজেকে নিয়ে, নিজের প্রিয়জনদের নিয়ে কী স্বপ্ন দেখে তা ঠিক জানতে পারিনি। ভাষার বাধা আর চীনে থাকা কালে আমার শ্রেণী অবস্থান আমাকে চীনের শ্রমিকের বা কৃষকের মনের কথা জানার মত নিকটে পৌঁছুতে দেয়নি। চীন আজ বিশ্বে সব দিক বিবেচনায়ই পরাশক্তি। চীনের অর্থনৈতিক উন্নতি আর প্রবৃদ্ধির হার ঈর্ষনীয়। কিন্তু পরিসংখ্যানের হিসেবে তো মানুষের প্রকৃত অবস্থার উন্নতি হয় না। ধনী-গরিবের দিন দিন বেড়ে যাওয়া ব্যবধানের দূরত্বটা না কমলে প্রকৃত উন্নতি “দূর অস্ত”। তাই চীনের শ্রমিকের-কৃষকের স্বপ্ন আরো একটু ভালোভাবে টিকে থাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকার কথা।


মন্তব্য

কীর্তিনাশা এর ছবি

অনেক দিন পর আবার চীনের গল্প চলুক

আবারো পড়লাম আর মুগ্ধ হলাম। হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো এই দফা কয়েকটা পর্ব নামানোর।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

চীন সম্পর্কে এ জানাটা কাজে লাগবে বেশ। তবে সেখানে ইদানিং ওপরতলার বিরুদ্ধে তলায় বিক্ষোভের কথা শোনা যাচ্ছে, সেগুলো কতটা সত্য?

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বিক্ষোভ সংক্রান্ত এই তথ্যগুলোর অথেনটিসিটি যাচাই-এর আসলে কোন উপায় নেই যদি না আপনি তার প্রত্যক্ষদর্শী হন। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম বা সংবাদকর্মীদের কাছ থেকে সরকারী ভাষ্য ছাড়া কিছুই জানতে পারবেন না। স্থানীয় জনগণের কাছ থেকেও জানতে পারবেন খুব কম। বিদেশি সংবাদমাধ্যমের খবরগুলো কোথাও ওভার স্টেটেড, কোথাও আণ্ডার স্টেটেড।

কমিউনিকেশন সমস্যা বড্ড বেশি। কারন, আমাদের দেশে শিক্ষা-বঞ্চিত মানুষও যে রাজনৈতিক ব্যাপারগুলো বোঝেন সেখানে অনেক শিক্ষিত লোকও সেসব বোঝেন না। ২০০৭ সালের গোড়ার দিকে আমার চীনা সহকর্মীকে বাংলাদেশের তখনকার রাজনৈতিক সমস্যা বোঝাতে আমাকে গলদঘর্ম হতে হয়েছে। তবুও তিনি বিশেষ কিছু বুঝেছেন বলে মনে হয়নি।

নিজের বঞ্চনার ব্যাপারটা পাগলও বোঝে। গিনি রেশিওর ক্রম অধোগতি (মানে মানবৃদ্ধি) সমাজে বা মানুষের মনে কী অবস্থা সৃষ্টি করে তা আপনাকে ব্যাখ্যা করা নিষ্প্রয়োজন। চাকুরি হারানো দুই কোটি শ্রমিক, সার্স-এভিয়ান ফ্লু-অন্য দেশে কৃষিতে সাবসিডি'র ধাক্কায় বিপর্যস্ত কৃষক আর স্যালারী কাটের ধাক্কায় পড়া আধুনিক কেরানীকুল কী চুপচাপ ঘরে বসে থাকবে? হয়তো থাকবে যদি গণপ্রজাতন্ত্র আসলেই তাদের বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা নেন।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

http://news.bbc.co.uk/2/hi/asia-pacific/7925193.stm

সবচেয়ে কঠিন বছর আসছে। ওদেরই কথায়।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

পান্ডবদার চোখ দিয়ে আমার চীন দেখা হচ্ছে সারা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পাণ্ডবের চোখ দিয়ে পৃথিবীকে পাণ্ডবীয়ই দেখা যায়। আর প্রিয়দর্শনের চোখ দিয়ে পৃথিবীকে সুন্দর দেখা যায়।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

Vanu Vaskor এর ছবি

কি আর বলি, চীনে গল্প আমার আগা গোড়া ই ভাল লাগে। তাই না পড়া গল্পটির মন্তব্য যে গল্পের পক্ষে ই যাবে, তা আর নতুন কি?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনাদের ভালো লাগলেই আমি ধন্য।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

যদি কোনোদিন চীনে যাই তবে আপনার লেখাগুলো প্রিন্ট করে নিয়ে যাবো গাইড হিসেবে

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

শুধু গাইড বই পড়ে কোন লাভ হবে না। আমার কাছে দুই মাস কোচিং করতে হবে। তাতে দুই মাস পর একটা শিওর এণ্ড শর্ট সাজেশন পাবেন। সেই সাজেশন ছাড়া পরীক্ষা দিতে গেলে সোজা ফেল।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

চলুক
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। এইসব হাবিজাবি লেখা পড়ে সময় নষ্ট করেন কেন? এরচেয়ে যেসব বিষয়ে অনুরোধ করেছিলাম সেগুলোতে সময় দেন। তাতে আখেরে আমার মত মানুষ লাভবান হবে।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

বাউলিআনা [অতিথি] এর ছবি

আমার চাইনিজ ল্যাব অফিসারকে একদিন প্রশ্ন করছিলাম, "জীবনের মানে কী?"
ও বল্ল, "কাজ করা, খাওয়া আর ঘুমানো"-এটাই নাকি ওর কাছে জীবন।
আপনার চীনকে নিয়ে এই লেখা যখনই পড়ি, তখনই কথাটা মনে হয়।
আরেক মহিলা চাইনিজ ল্যাব অফিসার এখানে কাজ করছে ৩৫ বছর। বয়স প্রায় ৬৫।
একদিন ওর বাচ্চাদের কথা বলতেই ও বল্ল, "আমি সিংগেল, তাই এখনও নির্ঝন্ঝাটে কাজ করে যেতে পারছি"।
চাইনিজদের কাছে বোধহয় কাজ আর জীবন সমার্থক শব্দ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কাজ আমাদের সবাইকেই করতে হয়, বেঁচে থাকার জন্য বা টিকে থাকার জন্য। কাজের ফলাফল যখন অন্যদেরও কাজে লাগে, কাজ করা তখনই সার্থক হয়। মনযোগী চীনা কর্মীরা তাদের কাজের ফল হিসেবে দেশের উন্নতিটা সাদা চোখেই দেখতে পায়। এককালে আফিমের নেশায় বুঁদ জাতি যখন নিজেদের কাজের জন্য দেশকে পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে তখন কাজ আর জীবন সমার্থক হতে বাধা কোথায়? যে জীবন অন্য মানুষের কাজে আসেনা তার সার্থকতা কোথায়?



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রানা মেহের এর ছবি

ষষ্ঠ পান্ডবের লেখা পড়লে মনে হয়
উনি আধা চিঙ্কু হয়ে গেছেন খাইছে

লেখা সুন্দর
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

দিদি, সত্যি বলতে কী চীনের কাছে আমার অন্ন দায় আছে। ওদের সাথে কাজ-কর্ম করে খাই। এক দশক ধরে চীনা অন্ন পেটে পড়লে আধখানার বেশিই চিঙ্কু হয়ে যাবার কথা।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তানভীর এর ছবি

চীন সম্পর্কে জানা হোল অনেক কিছু চলুক

চীন-ভারতের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখায় কেন এগিয়ে যাচ্ছে এটা নিয়ে আমেরিকানদের বেশ কৌতুহল আছে। কিছুদিন আগে চীনের পড়ালেখা নিয়ে কোন একটা চ্যানেলে (সম্ভবত PBS নইলে CNN) তথ্যচিত্র দেখেছিলাম। দেখে মনে হয়েছে ভাগ্যিস চীনে জন্মাইনি। পড়ালেখায় এত কম্পিটিশন চীনে! আমি ওইখানে মারাই পড়তাম খাইছে

ছেলে-মেয়েদের ঠিকমতো পড়ালেখা করানোই চীনে বাবা-মাদের প্রধান প্রায়োরিটি। জীবনের সব সঞ্চয়, সব শ্রমই ঢালে তারা এই লক্ষ্যে, যেটা আমেরিকা তো বটেই আমার মনে হয় না আর কোন দেশে এমন হয়। ফলে চীনে ছেলে-মেয়েদের ছোট থেকেই পড়াশোনা করার জন্য দৌড়ের উপর থাকা লাগে। আমি ভাবতাম বাংলাদেশের বাপ-মায়েরাই বোধহয় মেট্রিক, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার সময় উদ্বিগ্ন থাকে। উরে! চীনের একটা পাবলিক পরীক্ষার দৃশ্য দেখানো হয়েছিল- মেয়ের যেন পরীক্ষা দিতে অসুবিধা না হয়, সেজন্য বাবা-মা পরীক্ষা কেন্দ্রের পাশেই হোটেল ভাড়া করেছিল, অথচ একই শহরেই তাদের বাসা এবং তারাও একটা শ্রমিক পরিবার! চীনে পার্টির নেতাদের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখায় বিশেষ সুবিধা পায়, সেটাও দেখানো হয়েছিল। তবে একদম গরীব ঘরের মেধাবী ছেলেমেয়েরাও যে উপরে উঠে আসতে পারে সেটাও দেখানো হয়েছে। এক একটা পরীক্ষা এক একটা হার্ডল ক্রস করার মত। এক কৃষক ছেলের জীবন ফলো করা হচ্ছিল। সরকারের টাকায় সে শহরে হোস্টেলে পড়ে। রেজাল্ট ভালো করার জন্য তার প্রাণপন চেষ্টা। কারণ সে জানে ভালো রেজাল্ট না হলে বৃত্তি বন্ধ হয়ে যাবে, তাকে তার বাবার মত তখন সারাজীবন কৃষিকাজ করতে হবে। তার জন্য তার কৃষক পরিবারের যে সাপোর্ট দেখলাম তা অবাক করার মত। আমাদের দেশেও হয়তো অনেক কৃষক পরিবার তাদের সন্তানদের এমন সাপোর্ট দেয়। কিন্তু কীর্তিমান (!) সন্তানরা সেগুলো গায়ে মাখে বলে মনে হয় না।

তবে পাবলিক পরীক্ষাগুলো যে তাদের জীবন-মরণ তার আরেকটা কারণ হলো- এর রেজাল্টের উপর ভিত্তি করেই কে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, বা আদৌ পড়বে কিনা তা ঠিক করা হয়। যাদের রেজাল্ট উপরের দিকে তারা পড়বে ড়্যাংকিনে এক নম্বর ইউনিতে এরপর ক্রমান্বয়ে। বিষয়টা আমার কাছে ভালোই লেগেছে, বাড়তি ভর্তি পরীক্ষার কোন বালাই নেই। আর পরীক্ষার সাবজেক্টও দেখলাম মাত্র তিনটা- ম্যাথ, সায়েন্স আর একটা কী যেন ভুলে গেছি। আমাদের মত এত খিচুড়ির পরীক্ষা নাই। আর পাবলিক পরীক্ষারও বিকল্প আছে। সেটা হল গণিত অলিম্পিয়াড। চীনে জাতীয়ভাবে সব স্কুলে গণিত অলিম্পিয়াড হয়। যারা মেডাল পায় তাদের পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয় না। গোল্ড মেডালিস্টরা যায় টপ ড়্যাংক ইউনিতে, সিলভাররা তার পরেরটাতে, ব্রোঞ্জরা তারপরে। কিন্তু এই ম্যাথ অলিম্পিয়াড পাবলিক পরীক্ষার চাইতেও অনেক কঠিন হয়। চীনের টিম যে প্রতি বছর গণিত অলিম্পিয়াডের টপে থাকে তার এটাই একমাত্র কারণ। আমাদের সৌখিন গণিত অলিম্পিয়াড টিম কি আর এদের ধারে-কাছে আসতে পারে!!

চীনকে স্যালুট।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

শ্রমিক পরিবারের ছেলে-মেয়েদের জন্য দু'টো উপায় আছে। এক, অসম্ভব মেধাবী হওয়া, যাতে অধিক সুবিধাপ্রাপ্তদের মেধার জোরে ঠেলে উচ্চ শিক্ষার পথ খোলা যায়। দুই, হান পরিবারের সদস্য হওয়া, যাতে প্রান্তিক জাতি-গোষ্ঠির প্রদেশগুলোর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বৃত্তি পাওয়া যায়। এতে আমার আগের পর্বে বলা "নৃতাত্ত্বিক সাম্রাজ্যবাদের" ব্যাপারটা সফল করা যায়।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হিমু এর ছবি

আগের পর্বগুলোর মত এ পর্বটিও আগ্রহ নিয়ে পড়ে মুগ্ধ হলাম।

চলুক।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। চালানোর চেষ্টা করছি।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সবুজ বাঘ এর ছবি

আবার গেলে আমারে বস্তায় ভইরা নিয়া যাইয়েন। মাগনা চীম দর্শমডা হইয়া যায় তেলে। আর চৈনিক রমণীর নগে ইটিশপিটিশ কি গর্হিত অফরাদ?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এইসব হাবিজাবি পৈড়া চীম সম্পক্কে ভ্রান্ত ধারমা লওয়া ঠিক না। চীমে বাগেরা মাইনকা চিপায় আছে। বুইড়া নেতারা সক্কলে বাগ সাজতে চায়। আর আসোল বাগেরা খাইতেই পায় না তায় আবার ইটিশ-পিটিশ!



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

অনেকদিন, প্রায় দু'মাস, পর সিরিজটা চালু হলো আবার। খুবই ভাল লাগল এজন্য।

লেখা বরাবরের মতোই খুবই চমৎকার। অসম্ভব প্রাঞ্জল আপনার বর্ণনা। একটানে পড়ে ফেলা যায়। পড়লামও, এবং ভীষণ উপভোগ করলাম।

শ্রমিক দিবস, চীনা নববর্ষ আর “ড্রাগন বোট” উৎসব হচ্ছে চীনের প্রধাণ পার্বন।
"স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল" নামে ওদের যে একটা উৎসব হয়, ওটাই নাকি সবচেয়ে দীর্ঘ ও সবচেয়ে আকর্ষণীয় উৎসব!

অদ্ভুত একটা ব্যাপার জানেন? আজ সন্ধ্যা থেকে মনটা প্রচন্ড খারাপ, অনেকদিন পর। আমার খুবই পছন্দের একটা ডিভিডিতে- হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম- কে যেন মাঝে বেশ বড়সড় চিড় ধরিয়েছে। কোন সিনেমার ডিভিডি ওটা, জানেন? আ ওয়াক ইন দ্য ক্লাউডস! এখন পড়তে গিয়ে, আপনার পোস্টেও সিনেমাটার উল্লেখ দেখে খুবই অবাক হলাম। অদ্ভুত কোইনসিডেন্স।

পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম। একটু তাড়াতাড়ি দাদা...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

চীনা নববর্ষ আর বসন্ত উৎসব একই জিনিষ। পনের দিন ধরে চলে। শেষের দিনটাকে বলে "লন্ঠণ উৎসব"। ২০০৯ সাল হচ্ছে ষাঁড়ের বৎসর, শুরু হয়েছে জানুয়ারী ২৬ থেকে।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সচল জাহিদ এর ছবি

আরিফ ভাই ( আমি ধারনা করে নিচ্ছি আপনি আরিফ ভাই, আমার ধারনা ভুল হলে ক্ষমা করবেন )

আপনার লেখাটা পড়লাম। আসলে চৈনিক সভ্যতার উপর স্কুলে থাকতে পাঠ্য একটা লেখা ছাড়া আর বিশেষ কিছু কখনো পড়া হয়ে উঠেনি। মাঝখানে চীনা অলিম্পিক খেলোয়াড়দের নিয়ে কিছু করুন লেখা পড়েছিলাম আন্তর্জালে, বোধকরি শেষ অলিম্পিক গেমস এর সময়। আপনার চীনের উপর বাকী লেখাগুলো পড়ে ফেলতে হবে শীঘ্রই।

জাহিদ
_____________________
জাহিদুল ইসলাম
এডমনটন, আলবার্টা, কানাডা
http://www.ualberta.ca/~mdzahidu/


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পাণ্ডবদের পরিচয় জানাটা জরুরী নয়। তারপরও তোমার আগ্রহ থাকলে এই লেখাটা পড়ে দেখতে পার। চীন দর্শনের আগের সিরিজগুলো তোমার সময় হলে পড়ে মন্তব্য কর।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আপনে কিন্তু পরের বার যাওনের কালে মেশিন যন্ত্রর বস্তায় আমারে ভইরা নিয়া যাইতে পারেন... ভাইবা দেখেন...
ঘুষ দিমুনে... চোখ টিপি
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমার মাথা খারাপ যে আপনাকে সাথে নিয়ে যাব! অন্য কেউ হলে না হয় কথা ছিল না। আপনাকে সাথে নিয়ে নিজের কপাল খোয়াবো নাকি?



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রণদীপম বসু এর ছবি

আপনার কলম-কব্জিটার দিকে আমার খুব ঈর্ষা হচ্ছে পাণ্ডবদা ! অসম্ভব ভালো লিখছেন আপনি...!!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ দাদা। আমার সিরিজ তো আমি আবার শুরু করলাম, আপনার ইয়োগা সিরিজের কী হল?



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

যুধিষ্ঠির এর ছবি

মাঝখানে কঠিন কঠিন লেখা শুরু করে দিয়েছিলেন দেখে চীনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। তাগাদা দেবো কি না ভাবছিলাম, কিন্তু ঝাড়ির ভয়ে দেইনি দেঁতো হাসি

যাহোক সিরিজ আবার শুরু হওয়াতে স্বস্তি বোধ করছি। পূর্ণোদ্যমে চলুক।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আহা ধর্ম্মপুত্র! আপনি আবার ব্লগিং শুরু করেছেন। মকরকন্যার রুটিনে বুঝি অভ্যস্ততা এসেছে? সাধু, সাধু। এবার নিজের অভিজ্ঞতাগুলো পোস্টানো শুরু করুন। এই দুষ্কালে জ্বালানী বাণিজ্যের অবস্থা, আশা, শংকা, সংশয় নিয়ে শুনতে খুব ইচ্ছে করছে।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

চীন্দেশের ভেতর্টা দেখেয়াসা হচ্ছে আপ্নার্লেখার্দৌলতে হাসি
অ্যাত্তো চমত্কার গদ্য আপনার! পাঠে পরম তৃপ্তি!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যৌনদুর্বলতায় ভুগছি দীর্ঘকাল। দুর্বল হয়ে পড়ি রূপময়ী নারী দেখলেই...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।