দরবেশের বীজ
সত্যি বলতে কি এই প্যাঁচটা লেগেছে আমার বয়স চৌদ্দ হতে না হতেই। তার আগেই বাবা মরেছিল ষাঁড়ের গুঁতায়, আর মা জ্বরে ভুগে। ফলে বুড়ো দাদা-দাদীর হাতেই বড় হয়েছি। দাদীর ডান হাতটা কীভাবে যেনো অকেজো হয়ে গিয়েছিল, তাতে ঘরের কোন কাজ ঠিকমতো করতে পারতেন না। সুতরাং দাদা ভাবলেন দাদীকে সাহায্য করার জন্য আমাকে বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ আনা দরকার।
আমি বিয়ে করতে চাই কিনা সে আমলে তার প্রশ্নই উঠতোনা। তখন বুড়োরাই সব কিছু ঠিক করতো, পাত্র কেবল বরযাত্রীর সাথে সেজেগুজে বিয়ে করতে যেতো। একবার শুধু দাদীকে বলতে করতে শুনেছিলাম, “ও তো এখনো অনেক ছোট”। বুড়ো উত্তর দিয়েছিল, “সময় হলে ও শক্তপোক্ত হয়ে উঠবে, কিন্তু এখন কনে খুঁজে বের করাটাই সমস্যা”।
কীভাবে কী ঠিক হয়েছিল তা আমি জানিনা; শুধু দেখেছিলাম একদিন বড় কাঁচি আর ফিতা হাতে এক খলিফা এসেছিল। দাদা বললেন, “রমজান, ব্যাটা; খলিফা সাহেব এসেছেন তোমার জন্য পাজামা বানাতে। কেমন পাজামা চাও - সাদা নাকি রঙিন”? বিয়ে নিয়ে আমাকে শুধু এ’টুকুই জিজ্ঞেস করা হয়েছিল; কেমন পাজামা চাই - সাদা নাকি রঙিন?
বুধবারে খলিফা এসেছিল, বৃহস্পতিবারে পাজামা বানানো হল - রঙিন, পকেটে ঢাকনিওয়ালা আর নিচে লেস লাগানো, আর জুম্মাবারে ঢাকীরা এসে উঠোনে ঢাক-ঢোল বাজানো শুরু করলো - বিয়ের বাদ্য। ঢোল বাজতে থাকলো, তামার ডেগচিতে মাংস রান্না হতে থাকল কিন্তু তখনো জানতে পারলামনা কনেটা কে? লাজ ভুলে দাদীকে জিজ্ঞেস করলাম। দাদীর উত্তর, “এই গাঁয়ের না, পাহাড়ের ওপাড়ের খামারবাড়ির”। “কিন্তু সে কে? দেখতে কেমন”? দাদী কোন উত্তর দিলেন না।
দাদাকে একই প্রশ্ন করার সাহস হলনা, আমাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল। যখন কাজী সাহেবের ফাতেহা পড়ানো শেষ হল, ঢাকীদের বাজনাও থামল, তখন আমার বাসর ঘরে ঢোকার সময় হল। দাদা আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে বললেন, “তুমি যা কিছুই কর আর যা কিছুই ঘটুক সকালে রক্ত দেখা চাই। যদি তুমি এর মধ্যে বালেগ হয়ে থাকো তাহলে পুরুষ মানুষের মতো করবে। আর যদি বালেগ না হয়ে থাকো তাহলে তোমার আঙুল ব্যবহার করবে অথবা নখ। যাই হোক রক্ত বের হতেই হবে, নয়তো সারা গাঁয়ের লোক তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে”। দাদা আমাকে ঠেলে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
বাসর ঘরে ঢুকে আধঘন্টাতক্ আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। না আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হল, না আমি বউয়ের ঘোমটা খুলতে পারলাম। শেষ পর্যন্ত সে নিজেই ঘোমটা খুলে ফেল্লো, তাতে তার মুখ দেখতে পেলাম। আমি ভয়ে মরছিলাম এই ভেবে যে দাদা আমার জন্য কোনো বুড়ি ধরে এনেছেন; কিন্তু আমি মিছেই ভাবছিলাম। সিলভিনা ছিল এক সত্যিকারের এক প্রজাপতি, দুধের মতো সাদা গায়ের রঙ, স্বপ্নালু চোখ! আমি তাকে নিষ্পলক চোখে দেখতে থাকলাম। সেও চোখ তুলে আমার দিকে চাইলো আর ফিক্ করে হেসে বল্লো, “লজ্জা পাচ্ছো নাকি”?
“হ্যাঁ, আমি একটু লাজুক”।
“লজ্জা পাচ্ছো কেন? দেখো কী বিশাল পাজামা তুমি পরেছ আর কী অদ্ভূত তোমার কোমরবন্ধ! আচ্ছা আমরা কি লাট্টু ঘোরানো খেলবো”?
আমি খেলতে চাই নাকি চাইনা তার তোয়াক্কা না করেই সে আমার কোমরবন্ধ ধরে সামনে-পিছনে টানতে শুরু করলো। এতে আমি লাট্টুর মতো কোমরবন্ধে একবার পাক খেয়ে প্যাঁচাই আবার প্যাঁচ খুলে বের হই। আমারও মজা লাগতে লাগলো আর এভাবে আমরা রাতভর খেলে গেলাম। যখন মোরগ ডেকে উঠলো তখন আমার রক্তের কথা মনে হল। ভুরু কুঁচকে ভাবলাম, “একটু পরেই সকাল হয়ে যাবে, তখন সবাই এসেতো রক্তের কথা জিজ্ঞেস করবে, তখন কী বলবো”? আমাকে দেখে সে বুঝলো কিছু একটা হয়েছে। সে জিজ্ঞেস করলো, “ কী হয়েছে”? আমি তাকে রক্তের ব্যাপারটা বললাম। সে বলল, “কোনো ব্যাপার না! আমি এক্ষুনি রক্ত বের করে দিচ্ছি”। এ’কথা বলে সে খাটের উপর শরীর রেখে মাথা নিচে ঝুলিয়ে দিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে একটু পর পর জোরে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগলো। এতে তার মুখ বেগুনী হয়ে গেলো আর নাক দিয়ে রক্ত বের হয়ে এলো।
সুতরাং রক্ত নিয়ে আর কোনো কথা উঠলোনা, এটা কীভাবে হল সেটাও কেউ জিজ্ঞেস করলোনা। এবং আমি আর সিলিভিনা স্বামী-স্ত্রীরূপে স্থিত হলাম।
যদিও সিলভিনার বয়স কম ছিল কিন্তু বুদ্ধি আর আচরণে সে একজন প্রাপ্তবয়স্কা মহিলার মতোই ছিল। গায়ে-গতরে বালিকা হলেও সে আসলে ছিল একজন মহিলা। ছেলেমানুষী স্বভাব হঠাৎ হঠাৎ বের হয়ে আসলেও সেটা কোন সমস্যা ছিলনা। তাই মেয়েমহলেও তাকে সেভাবেই দেখতো। এক্ষেত্রে পুরুষেরা ভিন্ন রকম। একজন পুরুষের দাঁড়ির খোঁচায় একজন নারীর গাল রক্তাভ না হওয়া পর্যন্ত তাকে পুরুষ বলে গণ্যই করা হবেনা। কিন্তু একজন পুরুষের মন যখন একজন নারীতে মজে তখন তার দাঁড়ি আছে কি নেই সেটা আর কোন ব্যাপার থাকেনা, যেমনটা আমার হয়েছিল। যখন আমরা নিজেদের মধ্যে লাট্টু ঘুরানো বা অন্য কিছু খেলতাম, হাসাহাসি-চিৎকার করতাম তখন উত্তেজনায় আমার হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে উঠে আসতো। প্রতিবার লাট্টু ঘুরানোর খেলায় আমার হৃদয়টা জড়সহ উপড়ে আসতে চাইতো।
এটা কী করে সম্ভব! কিন্তু এটা সম্ভব হয়েছিল এবং কেউ এটা খেয়াল করেনি। সব কিছু শান্ত নদীতে তর তর করে নৌকা যাবার মতো যাচ্ছিল। কেউ আঁচও করতে পারেনি নদীর তলায় এমন একটা পাথর আছে যেটাতে ধাক্কা খেয়ে আমাদের নৌকাটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে।
সিলিভিনার বেশির ভাগ সময় কেটে যেতো দাদীর দেখা শোনা করতে আর গৃহস্থালী কাজ-কর্ম করতে। মাঠ থেকে যখনই দাদা আর আমি ফিরতাম তখনই সে আমাদের জন্য গরম স্যুপ নিয়ে আসতো। ঘর-বাড়ি ঝাঁট দিয়ে, পরিষ্কার ঝক্ঝকে করে রাখতো; ফুল আর লতা দিয়ে সাজিয়ে রাখতো। আমাদের ঘরের ছোট জানালাটাই সে দিনে তিনবার ঝাড়-মোছ করতো। সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়নায় সে নিজেকে দেখতো আর চুল বাঁধতো। আর কেমন ছিল তার চুল! একদিক থেকে তাকালে মনে হবে ধুসর, একটু ঘুরলে মনে হবে না ওটা লাল্চে। আরো ঘুরলে মনে হবে চুল তার রঙ পাল্টাচ্ছে - কখনো হলুদ, কখনো সোনালী! যখন সে চুলে চিরুণী চালাতো, আমি পাশে দাঁড়িয়ে অপলক চোখে দেখতাম। আমি তাকিয়েই থাকতাম যতক্ষণ না দাদা’র ডাকে আমার হুঁশ ফিরতো, “রমজান! তাড়াতাড়ি আসো! ছাগলগুলো অনেকক্ষণ ধরে না খেয়ে আছে”! এই গ্রীষ্মকালের গরমে ছাগলগুলোর দুর্দশার অন্ত ছিলনা। সূর্যটা মনে হত মাঝ আকাশে থানা গেড়ে বসে আছে। ব্যাটার হুঁশ নেই যে ঘরে আমার বউ আছে। ইচ্ছে করতো একটা আঁকশি দিয়ে সূর্যটাকে পেড়ে মাটিতে পুঁতে রাখি যেন পরদিন আর উঠতে না পারে।
তারপর যথারীতি রাত আসতো, আর আমি সিলভিনার পাশে শুয়ে তার ভুরু আর চোখের পাঁপড়িতে ফুঁ দিতাম যতক্ষণ না সেগুলো ঠিক্ঠাক হতো। এটা এক রকমের মজা ছিল, যখনই আমার ঘুম ভাঙতো তখনই আমি তার ভুরু আর চোখের পাঁপড়িতে ফুঁ দিতাম। সিলভিনাকে কথা দিয়েছিলাম দাদার সাথে ফিলিবে’র হাটে গেলে ওর ভুরু আর চোখের পাঁপড়ি আঁচড়ানোর জন্য শিঙের চিরুণী আনবো। কিন্তু সে’কথা কেবল কথাই ছিল। একদিন দাদা আর আমি মিলে সারা দিনে খড়ের পালা তৈরি করে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে দেখি ঘর অন্ধকার - সিলিভিনা নেই। দাদী বললেন সিলভিনার ভাইয়েরা এসে ওকে নিয়ে গেছে। উনি তাদেরকে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তারা দাদীকে ধাক্কা মেরে ফেলে সিলভিনাকে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে। সিলভিনার ভাইয়েরা ওকে আর ওর কনেপণের বাকি জিনিষপত্র ঘোড়ার পিঠে তুলে বীচ বনের ভেতর দিয়ে ছুটে চলে গেছে।
আমি ঠিক বোঝাতে পারবোনা আমার অবস্থা কেমন হয়েছিল। কিন্তু দাদা যখন দেখলেন আমি ছুরি হাতে বের হতে যাচ্ছি তখন আমাকে শক্ত হাতে ধরে দাদীকে বললেন, “শিগ্গির দড়ি নিয়ে আসো”। দাদী দড়ি আনলে দাদা আমাকে একটা থামের সাথে বেঁধে বললেন, “তোমাকে আমার দরকার আমার বংশ রক্ষার জন্য! সুতরাং তুমি কোথাও যাচ্ছ না! যতক্ষণ পর্যন্ত না এই আসান দরবেশ তার নাতির ঘরের ছেলের কান্না শুনছে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার কোথাও যাওয়া চলবেনা। তারপর তুমি আত্মহত্যা করতে পারো বা যা খুশি করতে পারো”। দাদা লাফ দিয়ে তাঁর খচ্চরটার পিঠে চড়ে দাদীকে বললেন, “দরবেশ বংশের বীজ রক্ষা করার ভার তোমাকে দিয়ে গেলাম। এর কিছু হলে তোমার ঘাড়ে আর মাথা থাকবেনা”।
দাদী দাদাকে ভালো জানতেন, তাই তিনি আমার বাঁধন আর খুললেন না। আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি সেই বোধ ছিলনা। কখনো মনে হল হাজারোটা জোঁক আমার হৃদপিণ্ডটা প্যাঁচিয়ে ধরে চুষে খাচ্ছে; কখনো মনে হল যাকগে, ওরাতো সিলভিনার ভাই - বাইরের কেউতো নয়! নিশ্চয়ই ওরা বাকি কনেপণের জন্য এসেছিল। এভাবে পরদিন সকালে দাদা না ফেরা পর্যন্ত নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিয়ে গেলাম।
দাদা যখন ফিরলেন তখন খচ্চরটার কষ দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছিল, দাদার বিধ্বস্ত অবস্থা, কাপড়-চোপর ছিন্ন-ভিন্ন - দেখে মনে হয় কেউ যেন তাকে কাঁটাঝোপের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে গেছে। দাদা আমার বাঁধন খুলে এক ধাক্কায় আমার ঘরে ঢুকিয়ে দরজায় বাইরে থেকে তালা মেরে দিলেন। আমি আমার আর দাদা-দাদীর ঘরের মাঝখানের দেয়ালে যেখানে ফায়ারপ্লেস ছিল তার চিমনী বেয়ে যেখানে দেয়াল পাতলা সেখান পর্যন্ত উঠলাম যেন তাঁদের আলাপ শুনতে পাই। দাদা ফিস্ফিসিয়ে কথা বলছিলেন তবু সবটা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।
“ওর বউ গেছে! সিলভিনার অকম্মা ভাইগুলো কীভাবে যেন যেনে জেনে গিয়েছিল সিলভিনা এখনো কুমারী আছে। তাই ওরা এখন রৌফেতের কাছ থেকে দুটো রামছাগল কনেপণ নিয়ে তার কাছে সিলভিনাকে বিয়ে দেবে”।
“তাহলে এখন কী হবে”?
“ওরা এখন সিলভিনাকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। যখন ওরা ফিরবে তখন আর কী লাভ! ততক্ষণে তো ওর গর্ভে অজাতের বীজ ঢুকে যাবে”।
“তাহলে তুমি এখন এটা নিয়ে কী করতে চাও”?
“কী করতে চাই? আমার এই ডাবল ব্যারেলের শটগানটা দিয়ে রৌফেতদেরকে খতম করতে চাই! আর সেটা আমি করবোও। কিন্তু এখন না। আগে রমজানের বিয়ে দিয়ে নেই, ওর ঘরে ছেলে হোক তারপর আমি এমন কিছু করব যে রৌফেতের মা নিজে যেদিন জন্মেছিল সেদিন যেভাবে চিৎকার করেছিল সেভাবে যেন কাঁদে”।
দাদা ঠিক এই কথাগুলিই বলেছিলেন। আমার হাত-পা জমে যাবার দশা হয়, আমি চিমনী থেকে নামতে ফায়ারপ্লেসের ছাইগাদার মধ্যে পড়ে গেলে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন সকালে দরজা খুলে তারা আমাকে অমন অবস্থায় দেখতে পায়। ঐদিন সকালেই দাদা মৌলভী সাহেবকে ডেকে আমাকে তওবা পড়ালেন আর কসম কাটতে বললেন যে আমি আত্মহত্যা করবোনা, কারো সাথে ঝগড়া বা মারামারি করবোনা; এবং আমি আমার নিজের খুলি উড়ানোর আগে দাদাকে আমার সন্তান উপহার দেব।
সেদিন থেকে প্রত্যেকটা ঘটনা ঠিক আমার কলিজায় ছুরির মতো বিঁধে আছে। প্রথম ছুরিটা বিঁধলো সেদিন যেদিন রৌফেত সিলভিনাকে নিয়ে গাঁয়ে ফিরল। রৌফেতদের বাড়ি আমাদের বাড়ির গা-লাগোয়া ছিল, একটা হালকা ওক কাঠের বেড়া দিয়ে কেবল দুই বাড়ির সীমানা আলাদা করা ছিল। জানোয়ারটা ওর গাল, মুখ আর সারা শরীর পিটিয়ে ফালা ফালা করে ফেলেছিল, তাই সিলিভিনাকে পরের এক মাস বা তারও বেশি সময় ধরে কেউ দেখতে পায়নি। তারপর একসময় সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে এলো, সিলভিনারও যা হবার তাই হল।
রৌফেত ঘরের দেয়ালে একটা ছিদ্র করে তাকে উঠানে কাজ করার আর ঘোরার জন্য ছেড়ে দিল। দেয়ালে ছিদ্রটা করেছিল যেন তার উপর নজর রাখতে পারে। রৌফেত আমার চেয়ে সাত বছরের বড় আর নিষ্কর্মা। সে মাঠে কাজ করতোনা বা জঙ্গলে কাঠ কাটতে যেতোনা। মাঝে মাঝে তার বাবার কসাইয়ের দোকানে কাজ করতো। সুযোগ পেলেই তাড়ি গিলতো, দাঁত বের করে হাসতো আর দেখাতো সে কত টাকার মালিক। তার লম্বা দাঁড়িওয়ালা দুটো রামছাগল ছিল, ওগুলোর গলায় বড় বড় ঘন্টা বাঁধা ছিল। যখন ঘন্টাগুলো বাজতো তখন দশ পাহাড় দূর থেকেও তা শোনা যেতো। সিলভিনার দুই ভাই রজ্জ্বব আর যুমার ছিল খুব লোভী। কাজ করতো রাখালের, তাদের চোখ ছিল রৌফেতের রামছাগল দুটোর উপর। যেহেতু সিলভিনা কুমারী ছিল, তাই তারা রৌফেতকে জানিয়েছিল যদি রৌফেত তাদেরকে ছাগল দুটো দেয় তাহলে তারা তাদের বোনকে রৌফেতের হাতে তুলে দেবে।
তখন সিলভিনাকে এক নজর দেখার জন্য আমি মরে যাচ্ছিলাম, কিন্তু রৌফেত তাকে তালাবদ্ধ করে রাখতো। ভাবছিলাম কীভাবে তার দেখা পাওয়া যাবে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আমি আমাদের বাড়ির চালের উপর উঠে চিমনীর পেছন থেকে লক্ষ রাখলাম। সেখান থেকে রৌফেতের বাড়ির ছোট গোল একটা জানালা দিয়ে ভেতরটা দেখা যেতো। যখন তারা কুপি জ্বাললো তখন ভেতরের সব কিছু প্রায় স্পষ্ট হল। দেখতে পেলাম তারা একটা টেবিলের পাশে বসে আছে; বা জিনিষপত্র পরিষ্কার করছে; বা বিছানা ঠিক করে শুয়ে পড়ছে। রৌফেত তার পাজামা খুলছে এবং ......। আমি সিলভিনার চোখ দেখতে পাইনি। তার মাথা এমন ভাবে ঝুলে পড়েছিল যেন তার ঘাড় ভেঙে গেছে। রৌফেত তখন তার চুলের মুঠি ধরে মাথা তুলে জানোয়ারের মতো তাকে মারতে লাগলো।
যতক্ষণ তাদের ঘরে আলো জ্বলছিল ততক্ষণ আমার হৃদয় মোমের মতো গলে গলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। এভাবে একের পর এক সন্ধ্যা যেতে লাগলো, আমিও একই ভাবে চিমনীর পেছন থেকে উঁকি দিয়ে একই দৃশ্য দেখে যেতে থাকলাম। দাদী দেখে ফেলেছিলেন যে আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় চিমনীর পেছন থেকে ওদের ঘরে উঁকি দেই। দাদী দাদার কাছে এ’নিয়ে নালিশ করলে দাদা বললেন, “ওকে শক্ত হতে দাও। ওর জায়গামতো রাগ বাড়তে দাও যেন শিখতে পারে একটা মেয়েমানুষের নাক থেকে কীভাবে রক্ত ঝরাতে হয়”।
দাদা ঠিক ছিলেন কি ভুল ছিলেন সেটা কিছু বলতে চাইনা, তবে রাগ বাড়ার ব্যাপারে তার ধারনাটা ঠিক ছিল। যখন কষ্ট বয়ে বেড়ানো দুষ্কর হয়ে পড়ে তখন তীব্র ক্রোধ কেবল তাকে বয়ে নিয়ে যেতে পারে। একটা কাকতাড়ুয়ার ভেতর যেমন কোন হাড়-মাস কিছু থাকেনা, শুধু খড় থাকে - আমার ভেতরও তখন তীব্র ক্রোধ ছাড়া অন্য কিছু ছিলনা। রৌফেত আমার মাথা জুড়ে ছিল। আমি যখন ঘুমাতে যেতাম বা মাঠে কাজ করতে যেতাম; দিন হোক বা রাত হোক সারাটা ক্ষণ আমি শুধু ভাবতাম কীভাবে ওকে শেষ করবো। মনে মনে ওকে আমি কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করতাম, পেটের ভেতর ছুরি ঢুকিয়ে দিতাম যেন কষ্ট পেয়ে একটু একটু করে মরে, মাঠের উপর দিয়ে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে গিয়ে পা দিয়ে দলে পিষে শেষ করতাম বা নখ দিয়ে চিড়ে ফালাফালা করতাম। ভাবতাম ছুরি দিয়ে কাজটা করলে ব্যাপারটা বড্ড তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে, তাতে ও বেশি কষ্ট পাবেনা। এরচেয়ে ভাল হবে ওকে গলা টিপে মারবো, আস্তে আস্তে, মাঝখানে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে। পরে বুঝলাম ওর গলাটা আমার হাতের ভেতরে পেলে আমি ধৈর্য রাখতে পারবোনা, এরচেয়ে অন্য কোন উপায়ে আরো কষ্ট দিয়ে ওকে মারতে হবে। দিনে তিনশ’ বার ওকে আমি মারতাম, আবার তিনশ’ বার ওকে বাঁচিয়ে তুলতাম নতুন করে মারার জন্য। আমার মাথায় আগুন জ্বলত। এক হাজার বার আমি ওকে জবাই করতাম, গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নিতাম। আমার হাত দুটো থর থর করে কাঁপতো, দাঁতে দাঁত ঘষতাম আর শেষে প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়তাম। শেষমেশ আমি প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লাম।
আমি অসুস্থ হয়ে পড়ায় দাদা দরবেশ বংশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। আমাকে ধরে-বেঁধে ত্রিগ্রাদের মোটা কবিরাজ আয়েশার কাছে নিয়ে গেলেন। আয়েশা আমাকে তেতো সব পাঁচন খাইয়ে আর গায়ে নানা রকম মলম মালিশ করে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আমার জ্বর নামিয়ে ফেললো। আমি সেরে উঠলেও দাদা আমাকে আর গাঁয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন না। তিনি আমাকে ত্রিগ্রাদের দেলি যুমারের বাড়িতে ছাগল পালনের কাজে লাগিয়ে দিলেন। আয়েশাকে বলে দিলেন আমাকে যত খুশি পাঁচন খাওয়াতে যাতে আমার দাঁড়ি-গোঁফ তাড়াতাড়ি গজায়। আর আমাকে বললেন দাঁড়ি-গোঁফ না গজানো পর্যন্ত আমি যেন গাঁয়ে ফিরে না যাই।
আয়েশার পাঁচনের জন্যই হোক আর আমার বয়সের জন্যই হোক কয়েক মাসের মধ্যে খুব বেশি না হলেও দাঁড়ি-গোঁফে আমার মুখ ভরে উঠল। পাঁচন বা জীবনের শিক্ষার কারণে হোক আমার মনটাও নরম হয়ে উঠল। তখন যা দিয়ে আমার হৃদয় পূর্ণ হল তাকে মনে হয় “ভালোবাসা” বলা যায়।
এরপর দাদা একদিন এসে বললেন, “এসো, এবার তোমার বিয়ে দিতে হবে। রৌফেতের মাকে তার জন্মের দিনের মতো কাঁদানোর জন্য আমার হাত নিশপিশ করছে”। আমি বললাম, “আপনি চাইলে আমার বিয়ে দিতে পারেন বা আমাকে কবর দিতে পারেন - যা খুশি; শুধু আপনি রৌফেতের কিছু করতে পারবেন না। ও শুধু আমার জন্য”। আমি তাকে প্রতিজ্ঞা করালাম, এবং ত্রিগ্রাদেই বিয়ে করলাম। এবার বাসরঘরে কোন খেলাধুলা হলনা, সেখানে যা যা হওয়া উচিততার সবকিছু ঠিকমতো হল। এর নয় মাস না, সাত মাসের মাথায় আমি সন্তানের বাবা হলাম। বাচ্চাটা মনে হয় জানতো যে আমার দাদার তাড়া আছে, তাই সে দু’মাস আগেই ভূমিষ্ঠ হল।
আমার মনে পড়েনা শেষ কবে আমি দাদাকে হাসতে দেখেছিলাম। কিন্তু আমার সন্তানকে দেখে তাকে হাসতে দেখলাম। তার ঠিক তিনদিন পর দাদা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটলেন, মিনিটখানেক হা-হা করে হাসলেন, তারপর বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তার ভুরু কাঁপতে লাগলো। আমাকে ডেকে বললেন, “রমজান ব্যাটা, আমি দরবেশ বংশের নতুন বংশধর দেখে গেলাম। এখন তোমার বাবার কাছে গিয়ে এই সুসংবাদ দিতে পারবো। আর রৌফেত তোমার জন্য রইল”। এর পরই দাদা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন - আমার জন্য আমার বউ, আমাদের বাচ্চা আর রৌফেতের ভার দিয়ে। আমি নিজেকে নিজে বললাম, “এইবার রমজান! দেখি তুমি কীভাবে তোমার এই দুই হাত দিয়ে একটা বউ, একটা বাচ্চা আর একটা দুশমন সামলাও”। কাকতাড়ুয়াটা এখন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে, ছাগল চরাতে, হাল চাষ করতে বা খেতে পারে। কিন্তু তার কলিজা আর হৃদপিণ্ডটা কসাই রৌফেতের হাতে - যখন খুশি তখন সে ওগুলো মোচড়াতে পারে।
প্রথমে ভাবলাম বাচ্চাটা একটু বড় হোক, মায়ের দুধ খাওয়া ছাড়ুক, তারপর রৌফেতের ভুঁড়ি ফাঁসাবো। তারপর ভাবলাম, নাহ্! বাচ্চাটা হাঁটতে শিখুক তারপর দেখা যাবে। কিন্তু আমার বাচ্চাটা হাঁটতে শুরু করার আগেই সিলভিনা তার বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে ওদের উঠানে হাঁটা-হাঁটি করতে লাগলো। সিলভিনা খুব আস্তে হাঁটতো। দেখে মনে হতো ও অনেকটা পথ হেঁটে ক্লান্ত। লম্বা ঘোমটা টানা থাকায় ওর মুখ দেখা যেতোনা, কিন্তু এদিক ওদিক তাকাতো যদি কোনভাবে আমার দেখা পাওয়া যায়। আমি আবার বেড়াতে ছিদ্র করলাম ওকে দেখার জন্য। রৌফেত জানালা দিয়ে ওর উপর নজর রাখতো, আর আমার বউ আমার উপর নজর রাখতো। ভাগ্যিস আমার বউ ছিল শান্ত-নম্র-বোকা ধরনের, সাত চড়ে রা কাড়েনা এমন। সে কখনই আমার সাথে চিৎকার-চেঁচামেচি করতোনা, খালি নিরবে চোখের পানি ফেলতো।
দিনগুলো সব একইভাবে কেটে যাচ্ছিল। আমি হাল চষতাম বা গর্ত খুঁড়তাম বা ছাগল চরাতাম; যা-ই করতাম না কেন সন্ধ্যা নামার আগেই তাড়াহুড়া করে বাড়ি ফিরে বেড়ার ছিদ্রে চোখ রাখে অপেক্ষা করতাম - যদি সিলভিনার দেখা মেলে। তার দেখা পেলে সারা দিনের ক্লান্তি-শ্রান্তি নিমিষে দূর হয়ে যেতো। আর তার দেখা না পেলে রৌফেতের কথা মনে হতো আর সারা রাত রাগে দাঁতে দাঁত ঘষতাম। মনে মনে তার গলা টিপে ধরতাম, তাকে বিষ খাওয়াতাম, তার চামড়া ছাড়িয়ে ফেলতাম - তবু মনে শান্তি আসতোনা। বহু বার আমি তাকে শেষ করে দিতে চেয়েছি কিন্তু যখনই মনে হতো জেলখানার দেয়ালেতো এমন কোন ছিদ্র নেই যা দিয়ে আমি সিলভিনাকে দেখতে পাবো, তখনই আমি দুর্বল হয়ে পড়তাম আর রৌফেতকে মেরে ফেলার চিন্তা থেকে সরে আসতাম।
এবং এভাবে জীবন কাটতে লাগলো - দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। যদি আমার বাচ্চারা বড় হয়ে বিয়ে করে তাদের বাচ্চারাও না জন্মাতো আমি হয়তো বুঝতেই পারতামনা কত বছর পার হয়ে গেছে। রৌফেত আর আমাদের বাড়ির মাঝের ওক কাঠের বেড়া পঁচে গলে গেছে অনেক দিন কিন্তু আমাদের দুশমনি শেষ হয়নি। রৌফেতের জন্যও প্রতিদিন রাতে এক চাঁই বরফের মত বউ নিয়ে ঘুমানো আর সকালে সেই বরফের ছুরি নিয়ে জেগে ওঠাটা সহজ ছিলনা। রৌফেত আগেও মদ খেত, তবে দিনে দিনে তার মদ খাবার মাত্রা বেড়ে যায়। এটা নিয়ে সে যত ভাবতো, তার পানের মাত্রা ততই বেড়ে যেতো। তার মাংসের দোকান বেচে ফেলতে হয়েছিল। এর বদলে জীবিকার জন্য আরো যা কিছু সে করতে চেয়েছে সব কিছুই অবশেষে তাড়ি গেলাতে শেষ হয়েছে। তাড়ি তার মেরুদণ্ড ধ্বসিয়ে দিয়ে শেষ তক্ তাকে শয্যাশায়ী করে ছাড়ে। তাদের মেয়ে বিয়ে করে আরেক গাঁয়ে চলে গেলে সিলভিনা ছাড়া তার সাথে থাকার আর কেউ ছিলনা।
মাসখানেক আগে আমি পঁচা কাঠের বেড়া ডিঙিয়ে ওদের উঠানে সিলভিনার কাছে পৌঁছে যাই। আমি ওর চারপাশে এমনভাবে ঘুরতে থাকি যেন সিলভিনা শুধু আমারই। উঠান থেকে আমরা রৌফেতের ঘরে গিয়ে বসি। জীবনে এই প্রথম আমরা তিনজন মুখোমুখি হই। চল্লিশ বছরের মধ্যে এই প্রথম সিলভিনাকে মাঝে রেখে আমি আর রৌফেত পরস্পরের দিকে সরাসরি তাকালাম। আমি পাপী মন চাইছিল রৌফেতের সামনেই সিলভিনাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরি। যেন রৌফেত আমার বাহুবন্ধনে সিলভিনাকে দেখতে পায়, যেমনটা আমি সারাটা জীবন ধরে সিলভিনাকে ওর বাহুবন্ধনে দেখেছি। কিন্তু সিলভিনা তা হতে দিলনা। “এটা যথেষ্ট যে আমরা এখানে আসতে পেরেছি। রৌফেত একটা জানোয়ার, তোমারও ওর মতো হবার কোনো দরকার নেই”। কিন্তু এখন? এখন কী হবে? সিলিভিনা জানালো রৌফেতের শরীর সারাক্ষণই ঠাণ্ডা হয়ে থাকে; আর ওদের গাধা নেই বলে সারাক্ষণ চুলা জ্বালিয়ে রাখার জন্য সিলভিনাকে জঙ্গল থেকে পিঠে করে কাঠ বয়ে আনতে হয়। এটা ওর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এখন সিলভিনার জন্য আমাকে এই কাজটা করতে হবে।
এরপর থেকে প্রতিদিন আমি এক গাধা বোঝাই কাঠ বয়ে নিয়ে আসি, তবুও সেটা রৌফেতের জন্য যথেষ্ট হয়না। বনপ্রহরী এরমধ্যে আমাকে একবার হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। এমন চলতে থাকলে এরপর সে পুলিশকে খবর দেবে। তাই রাতে বনপ্রহরী ঘুমিয়ে থাকলে আমি কাঠ কাটতে যাই। আমার চোখ, হাত টনটন করে, খাদের ভেতর দিয়ে কাঠ টেনে নিয়ে যেতে আমার সারা শরীর ছিঁড়ে পড়তে চায়। আমার পিঠ ভেঙে পড়তে চায় এমন একজনের জন্য কাঠ টানতে টানতে যার জন্য আমার ভেতরটা পুড়ে খাক হয়ে গেছে। এমন একটা মানুষের শরীর গরম রাখার জন্য আমাকে খাটতে হচ্ছে যে আমাকে চল্লিশটা বছর কখনো আগুনে পুড়িয়েছে, কখনো বরফে ডুবিয়েছে।
কিন্তু আমার পক্ষে এই কাজ বন্ধ করার কোনো উপায় নেই। কারণ, এ’কাজ আমি না করলে সিলভিনাকে কাঠ কাটতে জঙ্গলে যেতে হবে। মাঝে মাঝে রৌফেতকে খাওয়াতে হয়, ওর বিছানার মলমূত্রও পরিষ্কার করতে হয়। ওর শরীর এত ভারী যে তুলতে কষ্ট হয়। কিন্তু কোনো উপায় নেই, সিলভিনা একজন মেয়েমানুষ. ওর পক্ষে জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে আনা সম্ভব না, রৌফেতের ভারী শরীর তোলা সম্ভব না। সুতরাং কে রৌফেতকে সাহায্য করবে, এই এক রমজান ছাড়া! সুতরাং আমাকে এটা করতেই হবে, এবং আমি সিলভিনাকে একা ছেড়ে যেতে পারিনা।
আমি শুনতে পাই গ্রামের লোকেরা বলাবলি করে, “দেখো, এই না হল প্রতিবেশি! এই না হল মানুষ”! কিন্তু তারা যা দেখতে পায় না সেটা হচ্ছে আমার ভেতরটা। আমার ভেতরটা গরম পীচের মতো টগবগ করে ফোটে। আমি অপেক্ষা করছি ব্যাটা কবে মরবে, তাহলে আমি সিলভিনাকে বিয়ে করতে পারবো। কিন্তু এই বুড়ো ডাকাতটার মরার কোন লক্ষণ নেই। এতে আমার ভেতরের ফুটন্ত পীচ আরো জোরে ফুটতে থাকে। আমি দুনিয়াটাকে রসাতলে পাঠিয়ে দিয়ে সিলভিনাকে নিয়ে এক কম্বলের নিচে স্বামী-স্ত্রীর মতো শুয়ে থাকতে চাই। আমি আমার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনীদের সবাইকে ভুলে সিলভিনার কাছে চলে যেতে চাই। কিন্তু রৌফেত আমাদের দু’জনের মাঝে অনড় পাথরের মতো বসে আছে।
দিন চলে যাচ্ছে, বয়সের ভারে আমার শরীর ক্রমে ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আমি যদি সিলভিনার সাথে স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকার সুযোগ না পাই তাহলে কী লাভ! মাঝে মাঝে ভাবি রৌফেত কষ্ট পাচ্ছে, আমরাও কষ্ট পাচ্ছি, তাহলে ব্যাটার জন্য নরকের দ্বার খুলে দেইনা কেন? অন্ততঃ গত একটা বছর ধরে মউত তো ব্যাটা দোরে কড়া নাড়ছে। আমার ওর গলা টিপে ধরার বা ওকে পানিতে ডুবিয়ে দেবার দরকার নেই - দু’দিন ঠাণ্ডায় ফেলে রাখলেই কাজ হয়ে যাবে। আমার কাছে এটাই উদ্ধারের উপায় মনে হয়। কিন্তু যখনই এটা করার কথা ভাবি তখনই দেখতে পাই সিলভিনা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তখন এসব ভাবনা সরিয়ে রেখে রৌফেতের জন্য কাঠ আনতে জঙ্গলে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারিনা।
সুতরাং আমি এখন এই চার রাস্তার মোড়ে পড়ে আছি, জানিনা কোনদিকে যাব। আপনি যদি জানেন তাহলে আমাকে পথের দিশা দিন। আর আপনার না জানা থাকলে দয়া করে এই কাঠের বোঝাটা গাধার পিঠে তুলতে আমার সাথের একটু হাত লাগান। কারণ, শীতে ঐ বুড়ো ডাকাতটা এতক্ষণে ঠক্ঠক্ করে কাঁপতে লেগেছে - আর আমাকে অবশ্যই তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।
মূল গল্পঃ নিকোলাই হেইতভ
ঠ্যাঙনোটঃ
বুলগেরিয়ান সাহিত্য পড়ার সুযোগ পেয়েছি খুব কম। এক
গিওর্গি কারাসলাভোভের “ট্যাঙ্গো” ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছুই পড়া হয়নি। একটা ভালো বুলগেরিয়ান গল্পের এই বাজে রূপান্তরটা পোস্ট করলাম বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে
নিকোলাই হেইতভের নামটা পৌঁছে দেবার জন্য। মূল গল্পটাকে ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন মাইকেল হলম্যান। সেটা পাওয়া যাবে
এখানে। আমার এই দুষ্কর্মটা ঠিক মাইকেল হলম্যানের অনুবাদের অনুবাদ নয়। কিছু কিছু জায়গায় রূপান্তরের স্বাধীনতা নিয়েছি। পাঠকের নিশ্চয়ই “জামিলা”, “প্রথম শিক্ষক” আর “বিদায় গুলসারী”র লেখক
চিঙ্গিস আইৎমাতভের কথা মনে আছে। কম পড়া কিরঘিজ ভাষার এই লেখকের সাথে আমার কেন যেন আরো কম পড়া বুলগেরিয়ান লেখক নিকোলাই হেইতভের অনেক মিল আছে বলে মনে হয়।
মন্তব্য
ব্যক্তি ও সমাজের মাঝে মানসিক টানাপোড়ন, রিপুর তাড়না, মানবিকতার উন্মেষ আর সব ছাপিয়ে ভালোবাসার ফুল্লরী বিকাশী, সমাজের কুহেলীভেদী এই দ্বান্দ্বিক চিত্রণের প্রাঞ্জল অনুবাদ পড়ে কিছু সময়ের জন্য যেন পবিত্র হয়ে উঠি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে এই আর্তিটি,
নিকোলাই হেইতভের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ, পাণ্ডব দা।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
গল্পটি পড়া ও মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ বস্। তবে অনুবাদটি পাঠকের কাছে বিশেষ সুবিধার হয়নি বলে মনে হচ্ছে। ভবিষ্যতে কখনো অনুবাদ করার পরিকল্পনা করলে ব্যাপারটা মাথায় রাখবো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এই পাঠকের কাছে বিশেষ সুবিধার মনে হয়েছে। ভবিষ্যতে কখনো অনুবাদ করার পরিকল্পনা করলে এই পাঠকের আগ্রহের কথা মাথায় রাখবেন।
কোন কারণে গল্পটা চোখে পড়েনি। ...
গল্পটা যথেষ্ট 'ইন্টারেস্টিং', ইংরেজী ব্যবহার করলাম কারণ যা বলতে চাচ্ছি তার ঠিক বাংলা পেলাম না। গল্পের চলনেবলনে পূর্ব ইউরোপের একটা ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম, আমার মনে হচ্ছিলো গল্পটি বাশেভিচ সিঙ্গারের। ঠ্যাংনোটে দেখলাম অঞ্চল একই হলেও লেখকের নাম কস্মিনকালেও শুনিনি।
... আরো অনুবাদের আশায় রইলাম।
সে কী, লেখকের নাম দেখি গল্পের শুরুতেই দেয়া আছে !! আমি কেবল দরবেশের বীজ অংশটা দেখেই পড়তে শুরু করেছিলাম।
হেইতভের নাম না শোনার কারণ গোটা বুলগেরিয়ান সাহিত্যই বিশ্ব বাজারে বিশেষ ঠাঁই পায়নি, অনেকটা বাংলা কবিতার মতো। সিঙ্গার পোল্যান্ডে জন্মালেও তাঁর লেখা পূর্ব ইউরোপীয় ঘরাণার বলে আমার মনে হয় না। তাঁকে অনেক বেশি মধ্য ইউরোপীয় বা জার্মান ঘরাণার বলে মনে হয়। হেইতভ বা কারাসলাভোভ বিশুদ্ধ পূর্ব ইউরোপীয় ঘরাণার, আরো ভালো করে বললে বলকান-ওয়ালাচিয়ান-তুর্কী ঘরাণার।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
গ্রেট।
জামিলা-র অনুবাদ পড়তে ইচ্ছে করছে।
'জামিলা'তো আরো ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে বাংলায় অনুবাদ হয়ে গেছে। সম্ভবতঃ অরুণ সোম (অথবা হায়াৎ মামুদ) অনুবাদ করেছেন। সেই অনুবাদ এতো অসাধারণ যে সেটা আবার করার চিন্তা করাটাই বাতুলতা। আপাততঃ হেইতভের আরো একটা বা দুটো গল্প এবং আরো দু'একটা বুলগেরিয়ান গল্প অনুবাদের ইচ্ছে আছে। গিওর্গি কারাসলাভোভের গল্প পাচ্ছিনা। পেলে চেষ্টা করে দেখতাম।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আপনার পুরো বুলগেরিয়ান গল্পসমগ্রই পড়ে এলাম। দারুণ সব গল্প, আর ঝরঝরে অনুবাদ।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
ধন্যবাদ সজল।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এই গল্পে এত কম কমেন্ট? গল্পটা অসাধারণ, অনুবাদও ভালো হইছে
ধন্যবাদ। কষ্ট করে কমেন্ট করলেন আর নিজের নামটা দিলেন না!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ধন্যবাদ পান্ডবদা "ইন্টারেস্টিং" গল্পের জন্য| কিন্তু পড়ে এতো রাগ হচ্ছে, সমস্ত মানবিক গুনাবলী রমজানের মধ্যে ভর করলেও রমজানকে মনুষ্য পদবাচ্য মনে করবোনা| আরেকটা কথা নামগুলো মূল বইয়ে কি এমনই ছিল নাকি অনুবাদের সময় পরিবর্তন করা হয়েছে? যদি তাই হয় তাহলে সবগুলো নামই কেন বাংলা করলেন না অথবা সবগুলো নামই কেন বুলগেরিয়ান রাখলেন না?
ধন্যবাদ ঈগল। রমজান কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ বই কিছু না। তাকে অপছন্দ করতে পারেন, কিন্তু তার দেখা পাবেন আশে পাশেই। মূল গল্পের কোনো নাম আমি পাল্টাইনি। বুলগেরিয়া এক কালে ওসমানীয় সালতানাতের অধীনে থাকায় সেখানে আরবী/তুর্কী নাম ও মুসলিমদের দেখা পাওয়াটা স্বাভাবিক। এখনো সেখানে ১২%-এর বেশি মানুষ মুসলিম।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সব কটি চরিত্র এত স্বাভাবিক! আর তাদের যাপিত জীবন কি অবধারিতভাবেই না আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় সমাধানহীন নিয়তির সামনে। পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদের একেকজনকে দিয়ে একেক ভূমিকায় কাজ করিয়ে নেয়। আর, আমাদের চারপাশের সাধারণ জীবনগুলোতে কত না অসাধারণ গল্প জমে ওঠে! হেইতভের মত অসাধারণ লেখকরা এই জীবনগুলোতে যখন আলো ফেলেন তখন আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি তাদের।
বনকর্মী হিসেবে কাজ করার সময় যে মানুষগুলিকে নিকোলাই অত্যন্ত কাছে থেকে দেখেছিলেন, তাদের জীবনের সাথে মিলেমিশে গিয়েছিলেন তিনি। কর্মী হিসেবে করণীয় কাজ আর মানবিকতার দাবীর মধ্যে সম্ভবতঃ সামঞ্জস্য ঘটিয়ে উঠতে পারেননি। আট বছরের জেল হয়ে গিয়েছিল। কয়েদীজীবন আশীর্বাদ হয়ে জন্ম দিয়েছিল ভবিষ্যতের অসাধারণ লেখকের। ১৯৬৭-তে প্রকাশিত হেইতভের বিখ্যাত গল্প সংকলন জঙ্গলের গল্প (Wild Stories - Диви разкази)-তে এই জীবনগুলি ঘুরে ফিরে এসেছে। সেই সংকলনের শেষ গল্প এই অসাধারণ কাজটি।
সচলায়তনের হাতে গোণা কয়েকজন নিয়মিত লেখকদের একজন এবং নানা বিষয়ের লেখায় এই অসাধারণ মঞ্চটিকে সমৃদ্ধ করা গুণী মানুষটিকে প্রশংসা করলে গুটিয়ে যান, বিব্রত বোধ করেন। তাই সে পথে না গিয়ে ষষ্ঠপাণ্ডবকে শুধুমাত্র ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর অনুবাদে বুলগেরিয়ার বাকি গল্পগুলির পাঠে মন দেয়া যাক।
'মনের মুকুরে' জিন্দাবাদ।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আজ সকালে মনের মুকুরেতে এই গল্পটার লিঙ্ক যখন দেখলাম তখন নিজেই গল্পটা আরও একবার পড়লাম। ছোট ছোট কিছু ভুল চোখে পড়লো, কিন্তু সেগুলো শোধরাতে ইচ্ছে করলো না। এবং আমার কেন যেন মনে হলো আজ আপনি এখানে মন্তব্য করতে পারেন। ঝড়ে পড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে।
হেইতভের গল্প নিয়ে আরও কাজ করার ইচ্ছে আছে, অন্তত মরার আগে হলেও 'ইব্রাহিম আলী' বাংলায় রূপান্তর করতে চাই। আর কখনো সুযোগ হলে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়েও যৎসামান্য লিখতে চাই। পরবাসী বুলগেরিয় সাহিত্যিক এলিয়াস কানেতি'র সাহিত্যকর্মের স্বাদও নিতে চাই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বেড়াতে বেরিয়েছি। আন্তর্জাল সংযোগ সীমিত। সকালে অনেক্ষণ ছিলনা। সংযোগ পেতেই এই মুক্তোটি ভেসে উঠল!
সেরে ফেলো। ভাল কাজ একদম ফেলে রাখতে নেই।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
দক্ষ একজন অলংকারী দরকার এ গল্পটার জন্যে। লেখক প্রয়োজনে একটু গবেষণা করে কিছু জিনিস গুছিয়ে দিতে পারেন (বুলগেরিয়ার গ্রাম্য সাধারণ মানুষের চেহারা, পোশাক, পরিবেশ, ঘরদোরের ছবি, ভূপট...)।
যদি কোন সহৃদয় অলঙ্করণশিল্পী এই গল্পে অলঙ্করণ করতে আগ্রহী হন, তাহলে সচলবার্তায় আমাকে তাঁর ফরমায়েশ জানালে আমি তদানুসারে বুলগেরিয়ার ছবি-বিবরণ যোগাড় করে দেবার চেষ্টা করবো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নতুন মন্তব্য করুন