গল্প প্রচেষ্টা-১০

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: মঙ্গল, ২৬/০৪/২০১১ - ৪:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বসুধাকে প্রথম দেখি কলেজ রোডে মায়াবাদীদের হাসপাতালে। সেখানে গিয়েছিলাম এক রোগীর অ্যাটেন্ডেন্ট হয়ে। আমার রোগী যখন মায়াবাদীদের নানা রকম নিয়ম-কানুনে বিরক্ত হয়ে বার বার ক্ষেপে উঠছিলো, তখন কথা বলার জন্য বসুধা আমাকে সুবিধাজনক মনে করলো। তার কথা আমার কান দিয়ে ঢুকছিলো কম, চোখে দেখছিলাম বেশি। সেকথা তারও না বোঝার কথা না, সেটা নিয়ে সে বিব্রতও নয়। দিনের মধ্যে নিশ্চয়ই কয়েক ডজন বার তাকে এই পরিস্থিতি সামলাতে হয়।

আমি যে ডাক্তারের কথা ঠিক মতো শুনছি না সেটা নিয়ে আমার ভাবনা ছিলো না, কারণ পাশে বসা রোগী ডাক্তারের সবগুলো কথা ভালো মতই শুনছে। পরে ডেরায় ফিরে নিজস্ব মন্তব্য সহকারে সেগুলো সে বার বার আমাকে শোনাবে।

বসুধাকে যে আর দেখতে পাবো অমন আশা করিনি। কারণ, রোগীর অ্যাটেন্ডেন্ট বা রোগী কোনটা হয়েই মায়াবাদীদের হাসপাতালে আরেকবার যাবার ইচ্ছে আমার ছিলো না। অবশ্য তার একমাত্র রোগী হয়ে সারা জীবন থাকতে আমার আপত্তি নেই। সে আমার হাত ধরে পালস্ মাপবে, দেখবে সেটা মিনিটে ১৫০ পার হয়ে যেতে চাইছে।‌ আমার রক্তের চাপ মাপবে, দেখবে সিস্টোলিক প্রেশার ১৮০ পার হয়ে যেতে চাইছে। আমি মরো মরো হয়ে বলবো, “বসুধা, আমি মারা যাচ্ছি। তুমি আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে বুকে চেপে ধরে থাকো”। আমার এমন কাতরোক্তি শুনলে সে কী করতো? নিশ্চয়ই তার বিখ্যাত নিঃশব্দ হাসিটা দিতো। রিসোরিয়াস মাংসপেশীর কুঞ্চনে এমন প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটতে পারে সেটা তার হাসি যে দেখেনি সে বুঝবেনা।

আমি আশা করে থাকি আর না-ই করি, সময় কাটাতে মাউন্ট রোডের সুপার মার্কেটগুলোতে ঘুরে বেড়ানোর সময় বসুধার সাথে আবার দেখা হয়ে যায়। ডাক্তাররাও তো আমাদের মতো সাধারণ মানুষ - তাদেরকেও বাজার-সওদা করতে হয়। তাকে দেখে আমি পরিচিতের হাসি দেই, প্রত্যুত্তরে সেও হাসি দিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করে কেমন আছি। বুঝলাম, আমার গায়ের রঙ বা চেহারা স্থানীয়দের মতো হলেও আমি যে স্থানীয় না সেটা তার মনে আছে। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করি সে কোথায় থাকে। উত্তরে “ওয়াল্লাজাহ্‌ রোড” শুনে দাঁত বের করে বলি, “আমিও তার ধারে কাছেই থাকি, মুরুগাপ্পা স্ট্রিটে”। মূল রাস্তাটা ওয়াল্লাজাহ্‌ রোডই বটে, মুরুগাপ্পা স্ট্রিট সেটা থেকে বের হওয়া একটা আঁকাবাঁকা সরু পথ।

বসুধার পিছু নেয়ার জন্য মনে মনে একটা হিসেব কষে ফেলি। একদিন তার ডিউটি শেষ হবার সময়ে হাসপাতালের গেটের কাছে একটা চায়ের দোকানের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু সেদিন ঘন্টা দুই দাঁড়িয়ে থেকেও তার দেখা মেলে না। আরো দুই দিন অপেক্ষা করার পর চতুর্থ দিনে তার দেখা মিললো। সে হাসপাতাল থেকে বের হলে নিরাপদ দূরত্বে থেকে তার পিছু নেই। বাস স্টপেজে অপেক্ষা করার সময় কামনা করি সে যেনো এখন সোজা বাড়ি ফেরে। সে যে বাসটাতে উঠলো সেটার রুট নাম্বার দেখে খুশি হয়ে উঠি; এই রুট নাম্বারটা আমি চিনি, এটার বাস ওয়াল্লাজাহ্‌ রোড দিয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে আমিও একই বাসে উঠে দরোজার কাছে এমনভাবে দাঁড়াই যাতে সে আমাকে দেখতে না পায়। কোথায় নামতে হবে সেটা যেহেতু জানি না তাই ঝুঁকি এড়াতে বাস রুটের শেষ মাথা পর্যন্ত যাবার ভাড়া দেই। বসুধা চেপক স্টেডিয়ামের কাছে নেমে গেলে আমিও তার পিছু পিছু নেমে পত্রিকা স্ট্যান্ডের আড়াল থেকে তাকে লক্ষ করি। সে হেঁটে পাশের একটা রাস্তায় কিছুদূর গিয়ে একটা বড় অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে ঢুকে পড়লে আমি কমপ্লেক্সটাকে ভালোভাবে খেয়াল করি। এত বড় বাড়ির কোন ফ্ল্যাটে সে থাকে সেটা বোঝা মুশকিল। জানা থাকলে “সিনেমা প্যারাডিসো”র মতো একটা কাণ্ড করার চেষ্টা করা যেতো।

পরদিন সকালে যথাসময়ে নিজের ডেরা থেকে বেশ খানিকটা হেঁটে চেপক স্টেডিয়ামের কাছের বাস স্টপেজে একটা পত্রিকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকি। আড়চোখে নির্দিষ্ট রাস্তাটাকে দেখি। বাস আসে, বাস চলে যায় কিন্তু আমি তাতে ওঠার চেষ্টা করি না। বসুধাকে আসতে দেখে আমি অন্য দিকে তাকিয়ে উদাসীন হবার ভান করি। সে কিন্তু আমাকে ঠিকই দেখতে পেয়েছে। কাছে এসে বলে, “হাই”! আমি অবাক হবার ভাণ করে বললাম, “আরে! কী খবর”!
- তুমি এখানে? তোমার ডেরা তো আরো সামনে, আর এই বাস তো সেখানেও থামে!
- আসলে সকালে হাঁটতে ভালো লাগে। আর এখানে ভীড় কম থাকে বলে বাসে জায়গা পাওয়া যায়। মুরুগাপ্পা স্ট্রিট পর্যন্ত যেতে যেতে আর জায়গা পাওয়া যায় না।
বাস চলে আসে, আমরা উঠে পড়ি। এবারও আমি বাসের শেষ মাথা পর্যন্ত যাবার টিকিট কাটি। টুকটাক্‌ কথাবার্তা চলে; সে কলেজ রোডে নেমে পড়ে, আমি অযথাই পরের স্টপেজে নামি।

এভাবে কয়েকদিন যাবার পর এক সকালে আমার একটু দেরী হয়ে যায়। বাস স্টপেজে পৌঁছানোর একটু আগে দেখি বসুধা বাসে উঠলো আর সাথে সাথে বাস ছেড়ে দিলো। আমি দৌড় দিয়েও বাসের নাগাল পেলাম না। হাঁপাতে হাঁপাতে একটা অটোতে উঠে বলি, “কলেজ রোড, মায়াবাদীদের হাসপাতাল”। আমি চাইছিলাম অটোটা বসুধার বাসের পাশে পাশে যাক আর আমি উঁকি-ঝুকি দিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করবো। কিন্তু আমার আশায় জল ঢেলে দিয়ে সকালের ফাঁকা রাস্তা পেয়ে ড্রাইভার পঙ্খীরাজের মতো করে চালাতে লাগলো। বাসের অনেক আগেই অটো গন্তব্যে পৌঁছে গেলো। আমি হাসপাতালের গেটের কাছের চায়ের দোকান থেকে চা নিয়ে আস্তে আস্তে চুমুক দেই।

বসুধা যে আমাকে দৌড়ে বাস ধরার চেষ্টা করতে দেখেছে সেটা জানতাম না। সে যে এই কয়েকদিন ধরে আমাকে লক্ষ করেছে সেটাও বুঝতে পারিনি। একটু পর সে সোজা আমার কাছে হেঁটে এসে বললো, “এমন লুকোচুরি খেলার দরকার নেই। খামোখা বেশি ভাড়া দিয়ে পরের কোনো স্টপেজেও তোমার নামার দরকার নেই। সকালে তুমি সময় মতো বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকবে, তাহলে এক সাথে বাসে করে এসে এখানে নেমে এক সাথে হেঁটে হাসপাতালে যাওয়া যাবে। আর আজ বিকেলে তোমার সময় থাকলে সাড়ে চারটায় এখানে এসো, তোমাকে নিয়ে অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে যাবো -একটা আর্ট এক্‌জিবিশন আছে”। ঘাড় কাত করে কোন রকমে, “আচ্ছা, ঠিক আছে” বলার চেয়ে বেশি কিছু বলার ক্ষমতা আমার আর থাকে না। সে একটা বক্ষভেদী হাসি দিয়ে বিদায় নিলো।

অতঃপর আমার রোগীর সাথে মায়াবাদীদের হাসপাতালে বা সূর্যদেবের হাসপাতালে যাবার ব্যাপার না থাকলে, অথবা রবিবার না হলে প্রতিদিন সকালে বসুধার সাথে বাসে করে হাসপাতালে যাই। কোনো কোনো দিন একসাথে ফিরিও।

প্রায় দিনই সারাদিন আমার কোনো কাজ থাকে না। তাই কখনো সেন্ট্রাল রেল স্টেশনের বাইরের ফুটপাথ থেকে পুরনো বই কিনি, কখনো পেটমোটা ইংরেজী দৈনিক কিনে খবর-বিজ্ঞাপন সব পড়ি, কখনো দেবী সিনেমা হলে গিয়ে বিজাতীয় ভাষার সিনেমা দেখি, কখনো ওয়ালট্যাক্স রোডের ট্রিনিটি চ্যাপেল পাশের খাবারের দোকানগুলোর এক একটাতে ঢুকে একেক জিনিশ খাই। এই শহরটার একটা জিনিশ খুব ভালো লাগে। সব শ্রেণীর মেয়েরা দেখি জুঁই ফুলের মতো দেখতে এমন একটা ফুলের মালা খোঁপায় পরে - কেউ লাল রঙের, কেউ সাদা রঙের। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কলাপাতায় বিছিয়ে ঐ ফুল বা ফুলের মালা বিক্রি হয়। লেন-বা বাইলেনগুলোর এখানে সেখানে কড়া পানীয়ের দোকান দেখা যায়। সেখানে দিনভর সাধনা ঔষধালয়ের সারিবাদী সালসার বোতলের মতো মাঝারী সাইজের বোতলে হালকা সোনারঙা পানীয় বেচে। দোকানের ঠিক বাইরে অ্যালুমিনিয়ামের ডিশে চিরল চিরল করে কাটা আম বিক্রি করে। আমে আবার নুন-লঙ্কা মাখানো। লোকে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট প্লাস্টিকের গ্লাসে করে পানীয় নিয়ে আমসহযোগে খায় - যেমনটা আমাদের শহরে লোকে চা খায়। খুব ইচ্ছে করে ওভাবে আম দিয়ে সোনালী তরল গলায় ঢালি, কিন্তু দিনে যে প্রচণ্ড গরম থাকে তাতে ওসব খেতে সাহস হয় না। মুরুগাপ্পা স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে গেলে দুপুরের বাতাসে ফুলের গন্ধের সাথে আম, পানীয় আর রোদের গন্ধ মিলে একটা অদ্ভূত মাদকতা তৈরি করে।

বিকেল বা সন্ধ্যায় কোনোদিন বসুধার সময় হলে আমরা একসাথে কখনো কোনো শপিং মলে ঘুরি, কখনো কোনো কফিশপে বসি, কখনোবা সমূদ্রের পাড়ে হাঁটি। বৈকালিক ভ্রমণের শিডিউলটা সকালের বাসযাত্রার সময় ঠিক করা হয়। কোনো কারণে সে আসতে না পারলে মিটিং পয়েন্টে আমাকে খামোখা ঘন্টা দুই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এই সব ঘোরাঘুরির সময় দুনিয়ার তাবৎ বিষয়ে আমাদের কথা হয়, শুধু নিজেদের ব্যাপার ছাড়া। এ’ব্যাপারে আমি কখনো বিশেষ চেষ্টা করিনি। সেও আকারে-ইঙ্গিতে গণ্ডিরেখাটা বুঝিয়ে দিয়েছে - আমিও সেটা মেনে নিয়েছি।

হাসপাতালে নেমপ্লেট দেখে বসুধার পুরো নাম দেখেছিলাম “এস, বসুধা”। একবার জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নামের প্রথমাংশ এস মানে কী”?
- ওটা নামের প্রথমাংশ নয় -শেষাংশ। আর ওটার মানে তোমার না জানলেও চলবে।
- বলতে অসুবিধা কী?
- অসুবিধা আছে। আমার নামের ঐ অংশটা এতো বড়ো আর জটিল যে তুমি লেখা দেখেও উচ্চারণ করতে পারবেনা। আর আমি বললেও তুমি ঠিক বুঝতে পারবেনা।
- তা হতে পারে। তোমাদের বেশিরভাগ লোকের নামই জটিল।
- সেটা তোমাদের কাছে মনে হতে পারে। যেমন তোমাদের নাম আমাদের কাছে জটিল মনে হয়।
নাম নিয়ে আর আলোচনা আগায় না। কী করে যেনো আমার নামটা তাকে আগে কখনো বলা হয়নি। অবশ্য তার প্রয়োজনও পড়েনি। সেও কখনো আমার নাম জিজ্ঞেস করেনি। দু’জনের কেউ কারো ফোন নাম্বার বা বাসার ঠিকানা জানারও চেষ্টা করিনি। কোন কোন দিন ভেবেছি, আজ তার সাথে দেখা হলেই বলবো, “শোনো, আমার নাম পাণ্ডব। আমার ই-মেইল ঠিকানা হচ্ছে ....”। কিন্তু যখন দেখা হয়েছে তখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার আর জীভ সরেনি।

এই শহরটার রাস্তা-ঘাটে প্রায়ই অসম্ভব বড় আকারের কাটআউট দেখা যায় - মূলত তিন জন মানুষের। একজন টাকমাথার ভদ্রলোক সাদা জামার ওপর গলায় হলুদ-কমলা উড়নি, চোখে কালো সানগ্লাস - বোধকরি তিনি ট্যারা। একজন পৃথুলা প্রৌঢ়া, সাবেক চিত্রনায়িকা - যৌবনে যে ডাকসাঁইটে সুন্দরী ছিলেন সেটা বেশ বোঝা যায়। আরেকজন গুঁফো, মুশকো জোয়ান - দেখতে দূরপাল্লার ট্রাক ড্রাইভার বলে মনে হলেও আসলে নাকি জনপ্রিয় চিত্রনায়ক। প্রৌঢ়ার গায়ের রঙ পাকা আলফোন্সো আমের মতো, বসুধারটাও তাই। তাঁর বিশালাকৃতির কাটআউট দেখলে বা ফুটপাথে ফেরিওয়ালার কাঠের বাক্সে সাজানো পাকা আলফোন্সো আমের রঙ দেখলেও আমার বসুধার কথা মনে হয়। বসুধার চেহারা বা গায়ের রঙ কেনো স্থানীয়দের মতো নয় সেটা তাকে জিজ্ঞেস করা হয় না। হয়তো তার বাবা বা মা স্থানীয় নয়। অবশ্য এই শহর থেকে যে সব চিত্রনায়িকা জাতীয় পর্যায়ে অভিনয় করতে গেছেন তাদের সবাই অসম্ভব সুন্দরী, তাদের গায়ের রঙও আলফোন্সো আমের মতো। সম্ভবত স্থানীয়দের মধ্যে মানুষের সাথে অপ্সরারাও থাকে। ঐসব চিত্রনায়িকা আর বসুধা নিশ্চয়ই অপ্সরা শ্রেণীর।

কফি খেতে চাইলে বেশির ভাগ দিনে ট্রিপলিকেন পোস্ট অফিসের কাছের একটা কফি শপে বসা হয়। সেখানকার অন্য খাবার পছন্দ হলেও ওদের কফি আমার পছন্দ নয়। আমার স্থির বিশ্বাস এরা কফিতে চিকোরী মেশায়। চিকোরীর স্বাদ আমার পছন্দ না হলেও বসুধার পছন্দ। শুরুতে আমি এটা নিয়ে আপত্তি করলেও পরে আর কিছু বলতাম না। একদিন সেই অখাদ্য কফি খেতে খেতে সে ফট্‌ করে জিজ্ঞেস করে বসে, “আচ্ছা, তুমি আমার পিছু নিয়েছিলে কেন”? আমি সত্যটা স্বীকার করাকে সঠিক পন্থা মনে করলাম,
- তোমাকে দেখে আমার ভালো লেগেছিলো তাই।
- শুধুই ভালো লেগেছিল? আর কিছু না!
- আমি তো আসলে বেশি দূর কিছু ভাবিনি। সে’ উপায়ও নেই বোধ হয়। তোমার সাথে কথা বলছি, কফি খাচ্ছি, হাঁটছি - এই তো বেশ!
- তা ঠিক। নাছোড়বান্দা-বোকা প্রেমিকের চেয়ে সৎ-বুদ্ধিমান স্তাবক অনেক ভালো। এতে ঝামেলাও কম।
- আমি অবশ্য তোমার ঝামেলা হোক এমন কিছু করবো না।
- সেটা জানি। তা তুমি আর আছো কয় দিন?
- সপ্তাখানেক হয় আমার রোগীর সার্জারী হয়ে গেছে। সার্জারী পরবর্তী অল্প কিছু ফলো-আপ বাকি আছে। সব কিছু ঠিকঠাক মতো চললে আগামী সপ্তাহের মধ্যে ফিরতে হবে।

বসুধার সাথে শেষ বার দেখা হয় সমূদ্রের ধারে। এক ফুড ভ্যানওয়ালা বালির উপর প্লাস্টিকের চেয়ার বিছিয়ে রেখেছে, সেখানে পাশাপাশি বসি। এসব ফুড ভ্যানের চারপাশে ছোট ছোট ম্যাকেরেল জাতীয় মাছ লেজে সুতো বেঁধে মালার মতো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। সাথে চাক চাক করে কাটা বড় বড় পেঁয়াজ আর আলুও থাকে। চাইলেই মাছ বা আলু বা পেঁয়াজ বেসনে ডুবিয়ে ভেজে দেয়া হয়। মাছের গন্ধে বসুধার নিরামিশাষী নাক কুঁচকে ওঠে। হঠাৎ সাগরের দিক থেকে আসা দম্‌কা হাওয়া বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার সুযোগ করে দেয়। সে সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকে, আমার চোখ বসুধার দিকে। কী বলবো ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারি না। আমি ই-মেইল ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার ইত্যাদি নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করি - নিজের কানেই সেসব কেমন বোকা বোকা শোনায়। সে অভয় মুদ্রার মতো হাত তুলে বলে, “ওসব থাক। কী দরকার একে টেনে লম্বা করার? আমাদের জীবনের এই কয়েকটা দিনের মতো দিন আর কখনো হবে না। এই ভালো লাগাটুকুই থাক”। এরপর আর কারো মুখেই কোনো কথা জোগায় না।

অন্ধকার একটু গাঢ় হলে এক সময় বসুধা বলে, “তাহলে চলি। আমার সাথে তোমার আসার দরকার নেই। ভালো থেকো। আবার কখনো দেখা হয়ে যাবে নিশ্চয়ই”। আমিও বলি, “ঠিক, আবার কখনো দেখা হয়ে যাবে নিশ্চয়ই”। সে একটা অটোতে উঠে পড়ে, অটোটা ভটভট শব্দে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। আমি ধীরে-সুস্থে হেঁটে মুরুগাপ্পা স্ট্রিটের দিকে রওনা হই। আমার সামনে আবছা-অন্ধকার পথ। এই পথ চলতিতে কোথাও না কোথাও আলোর দেখা পাওয়া যাবে ঠিকই, তবে সে পথ চলাতে কখনো আর বসুধার দেখা মিলবে না।


মন্তব্য

মীর মোশাররফ হোসেন এর ছবি

ব্যাপক বর্ণনা, ভাল লাগল

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সাত্যকি. এর ছবি

গল্পের সুরই বলে দিচ্ছিল গল্পের পরিণতি।
বিষন্ন সুন্দর।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। এই গল্পে কোন ট্যুইস্ট নাই, সেই চেষ্টাও করিনি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যে আমলের কথা তখন কারো একটা হটমেইল অ্যাকাউন্ট থাকলেই সে এই কথা সেই কথার ফাঁকে নিজের ইমেইল অ্যাড্ড্রেসটা বলে দিতো। আর বসুধা'রা সব কালেই থাকে - কেউ দেখা পায়, কেউ পায়না।

উল্লম্ফন


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

চেন্নাই গেছিলাম ছোটোকালে
তখন ফেসবুক বসুধা কিছুই ছিল না ...


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যে আমলের কথা তখন কারো একটা হটমেইল অ্যাকাউন্ট থাকলেই সে এই কথা সেই কথার ফাঁকে নিজের ইমেইল অ্যাড্ড্রেসটা বলে দিতো। আর বসুধা'রা সব কালেই থাকে - কেউ দেখা পায়, কেউ পায়না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অনিকেত এর ছবি

আমি অনেক দিন ধরেই ভীষন অনিয়মিত এইখানে। আপনার অনেকগুলো লেখা মিস করে গিয়েছি। আজ এসে গল্পটা পড়ে একটা ভারী অন্যরকম অনুভূতি হল। হঠাৎ করে পথের মাঝে কারো হাসি মুখ দেখে অন্য আরেকটা হাসি মুখ মনে পড়ে যাবার মত অনুভূতি! জানিনা বোঝাতে পারলাম কি না--তবে এইটুকু বলে দিয়ে যাই, আপনার গল্পের বান্ধা কাস্টমার হয়ে গেলাম।

অনেক অনেক ভাল থাকুন।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনার ভাষা ধার করে আপনাকে "হাজার তারা ভরা রাত" উপহার দিলাম। আপনার অনুভূতি কিছুটা বুঝেছি হয়তো, তবে বলে বোঝাতে পারবো না। ভালো থাকবেন সব সময়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আয়নামতি1 এর ছবি

ঠিকই বিষন্ন সুন্দর গল্প। 'বিফোর সানসেট' মুভিটা চকিতে হানা দিয়ে গেলো হাসি
আর দেখা হয়নি পান্ডবদার সাথে বসুধার? আরে! আপনার নাম সত্যিই পান্ডব নাকি! আমি ভাবি এটা আমারই মত বানানো একটা নিক মাত্র ইয়ে, মানে...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। 'বিফোর সানসেটে'-এর সাথে মিলটা কোথায় তা ধরতে পারছিনা। বসুধা'র সাথে আর দেখা হবে কিনা সেটা তো গল্পেই বলা আছে তাই না!

আমি সত্যি সত্যি পাণ্ডব কিনা সেটা নিয়ে অনেক আগের কিছু লেখায় নানা কথা আছে। সেগুলো আপনাকে পড়তে বলাটা কি সঙ্গত হবে?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আয়নামতি1 এর ছবি

গল্পের সাথে তেমন মিল নাই হয়ত তবুও মনে এসে গেলে আমি কী করবো ইয়ে, মানে... কত কত অসাধারণ লেখাই তো আমার পড়া হয়নি ভাইয়া। কিন্তু আপনার লেখা বাবাইয়ের জন্য পোষ্টটা আমার অসম্ভব প্রিয় একটা পোষ্ট। বলেই দেখুন না কোন পোষ্টটা পড়তে হবে...অন্যের পোষ্টের লিংক দিতে তো কার্পূণ্য করেন না( সেজন্য আপনার বড় একটা ধন্যবাদ পাওনা, কারণ আপনি ফকির লালনের একটা পোষ্টে তাঁর পোষ্টের লিংক দিয়েছিলেন বলেই শুক্রবারে পোষ্টটা পড়া সম্ভব হয়েছে আমার) নিজের বেলাতে সেটা করা কী ঠিক?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনার অনুভূতিটা বুঝতে পারছি, সেটা ভুল কিছু নয়। এই গল্প পড়ে "বিফোর সানরাইজ" আর "বিফোর সানসেট" দুটো মিলিয়ে কিছু কিছু দৃশ্য হয়তো আপনার মনে পড়ে যেতে পারে, তবে মিল কিছু নেই।

অন্যের লেখার যে লিঙ্ক দিয়েছিলাম সেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নিজের লেখার কথা না হয় কখনো দেখা হলে বলবো। কতো সচলাড্ডাই তো হয় দেশে, বিদেশে - কখনো না কখনো দেখা হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আয়নামতি1 এর ছবি

হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

পূর্ণ একটা গল্প

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যাক নাট্যকার-ঔপন্যাসিকের কাছ থেকে একটা সার্টিফিকেট পেয়ে গেলাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কুটুমবাড়ি [অতিথি] এর ছবি

অসম্ভব ভালো লাগল।

পাণ্ডবদা, গল্পের পটভূমি কি চেন্নাইয়ের? চিন্তিত আমি বাঙ্গালোরেও দেখেছি মেয়েরা ফুলের মালা খোঁপায় পরে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। এখানে অনেকগুলো রাস্তার নাম দেয়া আছে। সেই ক্লু ধরে খুঁজলে পটভূমিটাও পেয়ে যাবেন আশা করি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

বসুধার নাম পড়ে সুনীলের "বসুধা ও তাঁর মেয়ে" উপন্যাসের কথা মনে পড়ে গেলো।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সারছে! এই গল্প পড়ে ঐ উপন্যাসের কথা মনে পড়লে গল্প প্রচেষ্টা ছেড়ে দেয়া উচিত।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

গল্প পড়ে না নাম পড়ে। ছাড়বেন মানে! সেঞ্চুরির আর মাত্র নব্বই রান বাকি। খাইছে

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সে আমি বুঝেছি। সব লেখা মিলিয়ে সেঞ্চুরী করতে যেখানে প্রায় তিন বছর লেগেছে, সেখানে একশ' গল্প লিখতে বাকি জীবন যথেষ্ট কিনা সন্দেহ আছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সুপ্রিয় দেব শান্ত (অতিথি) এর ছবি

আপনি কেন যে এই সুন্দর পূর্ণ গল্পগুলোকে "প্রচেষ্ঠা" বলেন বুঝিনা।

ভালো লেগেছে।

সুপ্রিয় দেব শান্ত

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। লেখাগুলো আপনাদের ভালো লাগলেই যে সার্থক গল্প হয়ে উঠবে এমনটা না কিন্তু, সেকথা ভেবেই "প্রচেষ্টা" বলা।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দময়ন্তী এর ছবি

আরেব্বাস! চমত্কার লাগল, বিশেষ করে চেন্নাইয়ের খুঁটিনাটি ডিটেল৷

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। সেসময় টানা একটা লম্বা সময় সেখানে থাকতে হয়েছিলো কিনা তাই অতো কিছু মনে আছে। তাও অনেক কিছু দুর্বোধ্য হয়ে যাবে আশংকায় বাদ দিয়েছি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

বিষদালোচনায় না গিয়ে একবাক্যে বলে দেই, অসাধারণ একটা গল্প!!!

২০০৬ সালে সস্ত্রীক চেন্নাইয়ে গিয়ে ছিলাম সপ্তাহ দুই। সম্ভবত জীবনে একনাগাড়ে এতো শান্তিপূর্ণ দুই সপ্তাহ পালন হয়ে ওঠেনি। সবকিছুই অসাধারণ, বিশেষ করে সাদাসিধে মানুষগুলো। ছিলাম মিনিষ্টার বাংলো এলাকার মধ্যে। কেয়ারটেকার হরিহরণ একদিন আমার কাছে এসে ঠকঠক করে কাঁপছে। স্যার আমি তিনতলার বারান্দায় কিছু টাকা পেয়েছি। জানিনা এগুলো কার। এখন আমি কি করবো? আমি কিছুক্ষণ পরে ট্রেনিং সেসনের মধ্যে লষ্ট এণ্ড ফাউণ্ড ঘোষনা দিতেই একসাথে দুজন নারী টাকা দাবী করে বসলেন। একজন পশ্চিমা এবং একজন ইনডিয়ান। ঘোষনা দিয়েই মহা বিপদ। শেষে দুজনকে আলাদা বাইরে ডেকে নিয়ে জানতে চাইলাম যে কার কত হারিয়েছে? দেখা গেলো ইনডিয়ান মেয়েটারই টাকা ছিলো ওটা কারণ এ্যামাউন্ট ঠিক ঠিক মিলে গেছে। পাশে বসা আমার এক বাঙালী বন্ধু হরিহরণের দিকে ইঙ্গিত করে আমার কানে কানে বললো সালা হরিহরণটাকে আচ্ছা করে পোঁদ মারা দরকার। টাকা পেয়েচিস তো পেয়েচিস, হাপিস করে দিবি। সততা মারাতে এসেচিস।

আরেকদিন, মিনিষ্টার বাংলোর সামনে একটা ট্যাক্সির অপেক্ষায় আছি। কয়েকটা শিশু ভিক্ষা করছে (চেন্নাইতে খুবই আনইউজুয়াল যদিও)। ওরা আমাদের কাছে এসে ইংরেজিতে কিছু পয়সা চাইলো। আমার স্ত্রী একগোছা ছোট নোট বের করে বড়ো শিশুটাকে দিয়ে বললো সবাইকে ভাগ করে নিতে। আমার মন বলছিলো যে বড়োটা টাকাকয়টা মেরে দেবে। কিন্তু ট্যাক্সি পাচ্ছিলাম না বলে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম শিশুগুলো একটা গাছের নিচে বসে টাকা ভাগ করে নিচ্ছে।

সেই এক বেড়ানো থেকেই চেন্নাইকে ভালোবেসে ফেলেছি। হয়তো আবার কখনও সময় সূযোগ হলে যাবো।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ।

আপনার দুটো অভিজ্ঞতাই ভালো লাগলো। চেন্নাইতে আমি ঢাকার মতো যত্রতত্র ভিখারী দেখিনি, শুধু ট্রেন স্টেশন আর মসজিদের সামনেটা ছাড়া।

কখনো সুযোগ পেলে অবশ্যই আবার চেন্নাই যাবো। আই লাইক চেন্নাই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কৌস্তুভ এর ছবি

আমিও চেন্নাই গেছিলুম, কিন্তু কোনো বসুধার সঙ্গে আলাপসালাপ হয়নি... মন খারাপ

গল্পে চলুক

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কপালে থাকতে হয় গো দাদা, সাথে নিজের চেষ্টা-চরিত্তিরও থাকতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দুর্দান্ত এর ছবি

মাঝে মাঝে মনে হয়, চেন্নাই বা পন্ডিচেরিতে গিয়ে কয়েকমাস থেকে আসি।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গত পনের বছর ধরে একটা লম্বা ছুটি কাটানোর আশা বুকে ধরে রেখেছি। সে আশা কবরে শোয়ার আগে পূরণ হবে বলে মনে হয় না। ছুটিটা পেলে ইটানগর, কোহিমা'র দিকে অথবা কোদাইকানাল, রামেশ্বরমের দিকে কাটিয়ে আসতাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মিলন-বিরহ তো আমার হাতে নাই। কাহিনী যেদিকে যাবার সেদিকে গেছে। যেমন পরিণতি পাবার তেমনটাই পেয়েছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

মুরুগাপ্পার নামই শুনে গেলাম বইপত্রে- দেখতে পেলাম না আজো।

... এই গল্পটার শেষ অনুচ্ছেদটা বাদ দিলে আমার খুব ভালো লেগেছে। শেষটা মিলনের হলেও ক্ষতি কিছু ছিলো না।

নীলকান্ত এর ছবি

হ, ঠিক কইছোস সুহান।
মিলনে ক্ষতি ছিল না।
ভাল লাগছে পাণ্ডবদা।


অলস সময়

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সুহান, মুরুগাপ্পা স্ট্রিটের মতো এঁদো গলির কথা কোন বইয়ে পেলে? আশা আছে শুধু মুরুগাপ্পা স্ট্রিটের বিচিত্র চরিত্র নিয়ে কখনো কিছু লেখার।

একদম শেষের অনুচ্ছেদটা হয়তো বাদই দিয়ে দেয়া যেতো, তবে তাহলে আমার দৃষ্টিতে পাঠকের উপর অহেতুক অত্যাচার করা হতো। এমনিতেই পাঠককে তার আগের পাঁচ-ছয় মিনিট ধরে বাজে বকুনি সহ্য করতে হয়েছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

গল্পের প্রকরণ সম্পর্কে আমি কমই জানি। আলাভোলা মানুষ আমি। ক্যারেক্টারাইজেশন, সিম্বলিজম, এক্সপোজিশন, কনফ্লিক্ট, ক্লাইম্যাক্স, সাসপেন্স, ফোরশ্যাডোইং, প্লট, ইউজ অব ইমাজিনেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ এগুলো আমার অসহায়ত্বকে খুবই উপহাস করে। তাই এগুলো নিয়ে আমার করা মন্তব্য নেহাতই অর্বাচীন হবে। সেদিকে না এগিয়ে এই গল্পের মন্তব্যে আমি নির্দ্বিধায় বলবো, এমন চর্চিত ও সুখপাঠ্য ভাষার রচনা আমি বহুদিন পড়িনি।

গল্পের শুরুটায় চমকে উঠেছিলাম। এজন্য যে, আব্দুল মান্নান সৈয়দের লেখা একটি গল্পের চমৎকারিত্বের সাথে সমানে সমানে এই গল্পের তুলনা হতে পারে। সৈয়দের গল্পটির নাম 'জলপরি'। শুদ্ধস্বর, দ্বাদশ সংখ্যা, নভেম্বর ২০১০-তে প্রকাশিত। 'জলপরির' দ্বিতীয় প্যারাতে, যেখানে ক্যারেক্টারাইজেশনের শুরু, সেখানের বর্ণনা এরকম,
"শম্পার সঙ্গে আমার চেনা বছর কয়েক আগে, দিন কয়েক তার সঙ্গে আলাপ পরিচয় মাত্র। কিন্তু, তার মধ্যেই শম্পা-সে আমার প্রথম প্রেম, এবং হয়তো শেষও।"
তারও আগে প্রথম প্যারাটিতে প্রথম বাক্যেই লেখক গল্পের পরিণতি ঘোষণা করেন এভাবে,
"না; শম্পাকে আমি পাইনি।"

বক্ষ্যমাণ গল্পের শুরুটা অনুরূপ সুরে,
"বসুধাকে প্রথম দেখি কলেজ রোডে মায়াবাদীদের হাসপাতালে। সেখানে গিয়েছিলাম এক রোগীর অ্যাটেন্ডেন্ট হয়ে।"
কিন্তু সেখানে পরিণতির ঘোষণা নেই। পুরো গল্পে পাঠকের মনোযোগ টিকিয়ে রাখার স্বপ্রণোদিত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ষষ্ঠ পাণ্ডব পরিণতির ঘোষণাকে শেষ অবধি টেনে নিয়ে গেছেন। আব্দুল মান্নান সৈয়দের সার্থকতা অধিকতর নাটকীয়তায়, ষষ্ঠ পাণ্ডবের সার্থকতা ছেদহীন ও কুশলী বর্ণনার চমৎকারিত্বে পাঠকের মনঃসংযোগ ধরে রাখায়। কোথাও এতটুকু ছেদ খুঁজে পাই না।

দুটি গল্পই প্রেমের এবং একই সঙ্গে দুটি গল্পের পরিণতিই মিলনান্তক নয়। বরাবরের মতোই আব্দুল মান্নান সৈয়দ-কে ইংরেজি বাক্য-বন্ধের অনুসরণ ও ইংরেজি শব্দের রূপান্তরের প্রবণতায় প্রবল হতে দেখি। ষষ্ঠ পাণ্ডব-কে দেখিনা। আমার ক্ষুদ্র বিচারে এখানে ষষ্ঠ পাণ্ডবের-কে অধিকতর বান্ধব মনে হয়। আমার বিচার ভুল হতে পারে, প্রেমান্ধ নয়।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গল্পের ব্যাকরণ মেনে গল্প লিখিনা। যদি তাই লিখতাম তাহলে "প্রচেষ্টা" বলতাম না। আমি গল্পকে নদীর মতো বইতে দেই। কাহিনীর জলপ্রবাহ ফুরিয়ে গেলে আমার গল্পও থেমে যায়।

আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্প পড়েছি বলে মনে হয় না। আমার দৌড় উনার কবিতা আর প্রবন্ধে সীমাবদ্ধ। গল্পের শুরুতে পরিণতি ঘোষণা করার উপায় আমার নেই। কেন নেই সেটার কৈফিয়ত প্রথম অনুচ্ছেদে দিয়েছি। নূন্যতম বুদ্ধিমান পাঠক বুঝবে আমার পুঁজি বর্ণনার খুঁটিনাটিতে, সেগুলোর প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব বর্ণনায়। কাহিনীতে ক্রমাগত ক্লাইমেক্স আনা, পাঠককে শিহরিত করা, ট্যুইস্টের প্যাঁচে পাঠককে বিহবল করা এসব ক্ষমতা আমার নেই - সেই অপচেষ্টা করিও না। আমার লেখা কুশলী নয়, তাই রোগীর পথ্যের মতো সহজে গেলা বা হজম করা সম্ভব। রাঁধুনীর মুন্সিয়ানা না থাকায় সেই লেখা অতিথির সামনে বা উৎসবে পাতে দেবার যোগ্যতা নেই।

গল্প পড়ার ও সময় করে বিস্তারিত মন্তব্য করার জন্য কৃতজ্ঞতা। আপনি ভুল কি ঠিক সেটা নিয়ে ভাবছেন কেন? সময়ই ঠিক করে দেবে পাণ্ডবের এই প্রচেষ্টার জায়গা বুকশেলফে হবে নাকি আস্তাকুঁড়ে যাবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সজল এর ছবি

শরৎচন্দ্রের মত খালি বিয়োগান্তক গল্প লিখেন কেন, কিছু হ্যাপিলি এভার আফটার গল্পও দেন চোখ টিপি

গল্প ভালো লেগেছে।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমি পরিণতি আগে ভাগে ভেবে রেখে গল্প লিখিনা। কাহিনী যেদিকে যাওয়া শুরু করে সেদিকে হালটা ধরে পাল উড়িয়ে দেই। আর শরৎচন্দ্রের মিলনাত্মক গল্পও তো আছে!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হিমু এর ছবি

খুব সিনেমেস্ক গল্প। পাণ্ডবের চরিত্রে একবার ছোটি সি বাতের অমোল পালেকারকে, আরেকবার ঘুড্ডির রাইসুল ইসলাম আসাদকে দেখতে পাচ্ছিলাম যেন।

প্রচেষ্টাকে মুরুগাপ্পা স্ট্রিটে পাঠিয়ে গল্প চালিয়ে যান।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

একটু লজ্জায় ফেলে দিলেন। গল্পটার চিত্ররূপ আপনি যদি দেখতে পান তাহলে আমার এই প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে বলতে হবে। এক কালে কোন গল্প-উপন্যাস পড়ে ভালো লাগলে সেটা নিয়ে এভাবে ভাবতাম। পড়ে তার কিছু কিছুর চিত্রায়ণ দেখে হতাশ হয়েছি।

প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আপনাদের পাতে দেবার মতো হলেই আপলোড করা হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ধৈবত(অতিথি) এর ছবি

চলুক বস...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।