করমণ্ডল এক্সপ্রেস
নীল-সাদা ট্রেনটা সময় মতোই স্টেশনে এসে পৌঁছায়। তাতে উঠে নিজের সিটটা খুঁজে বের করতে সমস্যা হয় না। থ্রি-টায়ার কুপের মধ্য দিয়ে চলাচলের পথের পাশে জানালা-দীঘল সিট, তার নিচে বাক্স-প্যাঁটরা ঢুকিয়ে সুস্থির হয়ে বসে সহযাত্রীদের দিকে নজর ফেরানো গেলো। এক দ্রাবিড় পরিবার - দুই ভাই, তাদের স্ত্রীরা, তাদের দুটি অল্পবয়সী সন্তান। স্ত্রীদের দু’জনের একজন বাঙালী, তাই বাংলা, দ্রাবিড় আর রাষ্ট্রভাষা তিনটা মিলিয়ে কথপোকথন চলছে। বাচ্চারা তিনটি ভাষাতেই সড়গড়। আমার মতো অপরিচিতকে এটা-সেটা অনুরোধের কালে বাণীটা রাষ্ট্রভাষায় হয়, আমি সাহেবদের ভাষায় উত্তর দেই - তখন উভয় পক্ষ সাহেবী ভাষায় কথা বলে। ট্রেন যখন ছাড়লো তখন দুপুর পেরোতে চললো, খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে।
দুপুরে খাবার সময় হয়নি, সম্ভবও ছিলো না। সকালে বাথরুমে ঢোকার পর বোধ হলো শরীর বিগড়েছে, বেসিনে মুখ ধোবার সময় হড়হড় করে লালরঙা বমি হয়ে গেলো - গত রাতের চিকেন-তন্দুরী সহ্য হয়নি। মাথা চক্কর দিতে দু’হাতে বেসিন চেপে ধরে দাঁড়িয়ে পড়ি। কোনোভাবেই পড়ে যাওয়া চলবে না। আমার অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে - অন্ততঃ আগামী দুটো দিনে আমাকে দু’পায়ের উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। প্রথম কাজ বাথরুমটা পরিষ্কার করা। এটা আমার বাথরুম নয় - একজন ভদ্রমহিলার। সুতরাং বমির ছিটেফোঁটা পড়ে থাকা চলবে না, মেঝেতে পানি থাকা চলবেনা, বমির দুর্গন্ধ থাকাও চলবেনা। নাশ্তার টেবিলে বসে যখন কিছু গিলতে পারছিলাম না তখন উদ্বিগ্ন প্রশ্ন, “কী হয়েছে?” বাথরুমের দুর্ঘটনার কথা জানালাম।
- আমাকে ডাকোনি কেন?
- ডাকার মতো অবস্থায় ছিলাম না।
আমার আসন্ন ভ্রমণ নিয়ে উদ্বিগ্নতা আর আমার অসাবধানতা নিয়ে যে কথামালা চললো তাকে “ডাবল ধামাকা” বলা চলে। অবশ্য এই ডাবল ধামাকা আগের দিন সকাল থেকেই চলছিলো - কখনো কথায়, কখনো চাহনীতে।
এক রাতের জন্য এই বাসাতে আশ্রয় নেবার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিলো না। এতে বাসার অন্য বাসিন্দাটির নিরব অথচ প্রবল আপত্তি ছিলো। তবু কেন যেনো রায়নন্দিনীর সিদ্ধান্তের ওপর তার কথা বলার ক্ষমতা ছিলো না, আমার তো কখনোই ছিলো না। রায়নন্দিনীর আশ্রয় গ্রহন করি বা না করি, তার সাহায্য ছাড়া আমার চলতো না। পরের দিন যাওয়াটা জরুরী হলেও ট্রেনের টিকিট কাটা ছিলো না। একদিনের মধ্যে টিকিট কাটা সহজ ব্যাপার নয়। তাই কয়লাঘাটের রেল অফিসে যেতে হয়েছিলো। এই শহরে যতো বারই আসি না কেনো কোন পথের দিশাই আমার মনে থাকে না, তাই রায়নন্দিনী ভরসা। রেল অফিসে অপেক্ষার কালে কখনো আমার মূর্খতার জন্য নিচু গলায় বাক্যবর্ষণের সাথে করুণা মেশানো চাহিনীর ডাবল ধামাকা। কখনো চাহনীতে যুগপত্ ঘৃণা আর ক্রোধের ডাবল ধামাকা। এর আরো কয়েকটা কম্বিনেশন আছে সেগুলোর কথা থাক।
শেষ বিকেলে সব ঝামেলা মেটে, আমরা টুকটাক কেনাকাটা করতে বের হই। কেনাকাটা শেষে শ্রীরাম আর্কেডের কাছে রাস্তার উপরের চাঁটের দোকানে বসে মিক্সড চাঁট খাই, নিম্বু-পানি খাই। পথে-প্রবাসে পড়ার জন্য রিগ্যাল সিনেমা হলের কাছের ফুটপাথের উপর বসা পুরনো বইয়ের বিক্রেতার কাছ থেকে হালকা ধরনের পেপারব্যাক কিনি। লবনহ্রদে রায়নন্দিনীর দু’জন বন্ধুর সাথে দেখা করি। তারা মৃদুস্বরে আরেকটু বসার আর রাতে খেয়ে যাবার কথা বলেছিলো, সে ওসব কথায় কান দেয় না। সকালেই জানিয়ে দিয়েছিলো সারা দিন আমি যেখানেই যাই, যা কিছুই করি না কেন রাতের খাবারটা তার সাথেই খেতে হবে এবং রাতটা তার বাসাতেই থাকতে হবে। আমার বাক্স-প্যাঁটরা তাই সকাল থেকে তার হেফাজতে। রাতের খাবারটা তার বাসার কাছের রেস্তোরাঁয় সেরে, জয়া সিনেমা হলের কাছ থেকে সুইমিং পুলের দিকে আধো অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে ফিরি। পথে হঠাৎ গা-জুড়নো বাতাস ওঠে, সারা দিনে এই প্রথম রায়নন্দিনী তার মুঠোয় আমার বাঁ হাতটা টেনে নেয়। শীতে নাকি অন্য কোন কারণে আমার শরীর কেঁপে ওঠে। এরপর আমার আর কিছু মনে থাকে না।
একটা ছোট শপিং ব্যাগে বিস্কুট, রুটি, কেক আর কলা দেয়া আছে। পঁই পঁই করে বলা আছে ট্রেনে উঠে ওখান থেকে কিছু খেয়ে যেনো পুদিনহারা ক্যাপসুল খেয়ে নেই। পুদিনহারা সকালেও একদফা চলেছে। খাবার খুলে আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। তবু চোট লেগে কলাগুলো নষ্ট হতে পারে ভেবে দুটো কলা খেয়ে ওষুধ খেয়ে নেই। ট্রেন শহর ছাড়তে বাইরের ল্যান্ডস্কেপ চেনা মনে হয়। বৈদ্যুতিক ট্রেন চলার জন্য একটু পর পর বিদ্যুতের পোস্ট। উঁচু রেল লাইনের পাশের নিচু জমিতে চেনা ফসল। কোথাও ফাঁকা মাঠে ছেলেরা টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলছে। তাদের রঙ-স্বাস্থ্য-চেহারা-পোশাক সবই চেনা। তাদের কথাগুলো শুনতে পেলে তাও চেনা লাগতো; যেমন একটু দূরে গুচ্ছ বেঁধে থাকা তাদের বাড়িগুলোও বা তার চারপাশের গাছগুলোকেও চেনা মনে হয়। ট্রেন হুগলী নদীর পাড়ের ছোট স্টেশনটা পার হয়।
আগের বছর একবার রায়নন্দিনীর সাথে লোকাল ট্রেনে করে এই ছোট স্টেশনটাতে এসেছিলাম। এই শহরের কাছে হুগলী নদীর ধার আর স্লুইসগেটের চারপাশ নাকি দ্রষ্টব্য বিষয়, কিন্তু খুব কম লোকজন সেখানে বেড়াতে যায়। ও কোথা থেকে যেনো এসব খবর পায়। জায়গাটাতে সোজা গাড়িতে করে যাওয়া যায়, তবু তার ইচ্ছেতে লোকাল ট্রেনে যাওয়া। খুব ভীড় না থাকলে লোকাল ট্রেন আমারও ভালো লাগে। ট্রেনের মশলা-মুড়ি, তেলেভাজা বা সেদ্ধ ডিম আর সেগুলো বেচে যে হকাররা তাদের কথপোকথনও ভালো লাগে। “হুগলী নদীর ধার আর কী দেখবো!” - এই ধরনের পূর্ব ধারণা নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে বুঝলাম, চারপাশে নদীর নিঃশ্বাস বন্ধ করার আয়োজন না থাকলে সব নদীই সুন্দর। এখানে নদীর ধারে গাছের সংখ্যা অন্যান্য জায়গার চেয়ে বেশি। বাঁধের কাছের কটেজগুলোও সুন্দর। তবে আমাদের ভ্রমণটা সুন্দর থাকেনি। নৌকাভ্রমণের সময় মাঝিদের অশ্লীল ইঙ্গিত থেকে শুরু করে বেড়াবার জায়গাগুলোতে থাকা স্থানীয় লোকদের নোংরা কথার তীর, অটোস্ট্যান্ডে অটোওয়ালাদের দুর্ব্যবহার ভালো লাগার অনুভূতিকে মাটি করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। সেবার ফিরতি পথে প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়েছিলাম। অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে সন্ধ্যার আলো-আঁধারীতে শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমরা হাত ধরাধরি করে প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বেড়ানোর সময় স্থানীয় লোকজনের করা নোংরা ব্যবহার মাথা থেকে দূর করে দেই।
শেষ বিকেলে ট্রেন রেল-শহরে পৌঁছালে আমি ট্রেন থেকে একদফা নামি। এই স্টেশনে ছোট কচুরীর সাথে আলুর দম আর কাঁচালঙ্কা বেচে - এটা আমার খুব প্রিয়। শরীরের এই অবস্থায় এমন খাবার পরিত্যাজ্য হলেও পেট ভরে তাই খেলাম। যা থাকে কপালে! ট্রেন চাঁদিপুর বীচে যাবার স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। আমি বাইরে থেকে মুখ ফিরিয়ে আলো জ্বালিয়ে একটা বই খুলে শুই। রাতে কিছু খাবার ইচ্ছে নেই, ডাইনিং-এও কিছু অর্ডার করিনি; আমি আস্তে আস্তে শয়তানের দ্বীপে প্যাপিলন শ্যারিয়ারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কাহিনীতে তলিয়ে যেতে থাকি।
আশে-পাশে সবাই যখন ডাইনিং-এর দেয়া অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়ানো খাবার খোলা শুরু করেছে ট্রেন তখন উৎকল দেশের পুরনো রাজধানীতে পৌঁছায়। এই স্টেশনটা দেখলে তার নামের সাথে মাথায় বাই ওঠা সংক্রান্ত একটা বস্তা-পঁচা বাক্য মনে পড়ে। কিন্তু স্টেশনটা এমন হতশ্রী আর নোংরা যে এটুকু দেখেই শহরটাতে যাবার কথা কখনো মনে হয় না। দ্রাবিড় পরিবারটি মস্ত টিফিন ক্যারিয়ার খুলেছেন, তাদের খাবারের সুবাস জিভে জল আনার বদলে অস্বস্তিই বেশি জাগায়। তারা সাথে আবার ডাইনিং-এর খাবারও নিয়েছেন। রেলকর্মী ভুল করে তাদেরকে নিরামিষের বদলে আমিষের প্যাকেট দিয়েছেন - এ নিয়ে দ্রাবিড় কর্তা মহা হৈচৈ জুড়ে দিয়েছেন। রেলকর্মী নির্বিকার, এবং তিনি প্যাকেট পাল্টাতে নারাজ। দ্রাবিড় কর্তা রাষ্ট্রভাষায় গালাগালির পাশাপাশি রেলের কোন ঊর্ধ্বতন কর্তা তার কতো আপনজন সেটা জানিয়ে উপর মহলে নালিশের ভয় দেখান। রেলকর্মী এসব হুমকি পাত্তাই দেন না। তিনি জানেন রেলের বড়কর্তাদের চেয়ে ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতা কোনো অংশে কম নয়। অভিযোগ প্রমাণ করা সহজ ব্যাপার নয়। তাছাড়া চলন্ত ট্রেনে যে সব বিষয় নিয়ে লোকে বিস্ফোরন্মূখ থাকে ট্রেন থেকে নামলে তার বেশির ভাগ ভুলে যায়। ট্রেন কোশল-উৎকলের নতুন রাজধানী পার হতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার তোড়জোর শুরু করে দেয়। কনিষ্ঠ দ্রাবিড়পুত্র একটু কাটা কাটা ভাষায় আমাকে আলো নেভানোর হুকুম দেয়। তার মা তাকে ভাষার ব্যবহার নিয়ে উপদেশ দেন, আমাকে ‘পিতৃব্য’ সম্বোধন করতে বলেন। দ্রাবিড়পুত্র সে উপদেশ গায়ে মাখে না। সম্মান রক্ষার্থে আমি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ি। ট্রেনের গতি বাড়তে থাকে, একসময় ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালের ঠাণ্ডা ভাব কেটে গিয়ে চারপাশ যখন গরম হয়ে উঠছে তখন বিশাখ বর্মার রাজধানীতে পৌঁছলাম। এতোটা দেরি হবার কথা না, এতক্ষণে চালুক্য রাজা নরেন্দ্র’র শহর পার হয়ে যাবার কথা ছিলো। সহযাত্রীদের কাছে শুনলাম রাতে চিল্কার কাছে কোথায় যেনো কী এক সমস্যার কারণে ট্রেন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো। এখন সময় গোলমাল হয়ে যাওয়ায় উলটো দিক থেকে আসা ট্রেনগুলোকে সময় ছাড় দিয়ে দিয়ে যেতে হবে। মানে কপালে দুর্ভোগ বাড়লো। চিল্কার কাছে ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিলো অথচ তার কিছুমাত্র দেখতে পেলাম না বা চিল্কার বাতাস বুক ভরে টানতে পারলাম না - এ’নিয়ে আফসোস্ হলো। ট্রেভর্তি মাখনবিহীন টোস্ট আর ডিম অমলেট নিয়ে হকাররা হাজির হলো। এক প্লেট চাইতে টোস্ট-অমলেটের ওপর একগাদা তেঁতুলগোলা জল ঢেলে এগিয়ে দিলো। এমন সুস্বাদু কম্বিনেশন আমার রুচির সাথে যায় না বলে সেটা পালটে নিলাম। একটা স্থানীয় ইংরেজী দৈনিক কিনে তাতে পড়ার মতো কিছু না পেয়ে পাশের কুপে’র বাঙালী ভদ্রলোকের সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম।
সহযাত্রী নবাবী আমলে বাংলার রাজধানী শহরে স্টীলের ট্রাঙ্ক বানানোর ব্যবসা করেন। এখনো যে লোকে স্টীলের ট্রাঙ্ক ব্যবহার করে এই তথ্যটা জানতাম না। কিশোর বয়সে হোলীর দিনে রঙ খেলার সময় কারো ছুঁড়ে মারা রঙ তার দু’চোখে ঢুকে গিয়েছিলো। সে রঙে কী মেশানো ছিলো কে জানে! তখন থেকে তার দু’চোখেই নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে থাকে। সে সমস্যা বাড়তে বাড়তে তিন দশক পর আজ একটা চোখ প্রায়-অন্ধ আর আরেকটা চোখের রেটিনার অবস্থাও খারাপ। নিজ শহরে আর রাজ্যের রাজধানীতে ব্যর্থ চিকিৎসা করিয়ে বিরক্ত-হতাশ-ক্ষুদ্ধ ভদ্রলোক এখন চলেছেন মায়াবাদীদের হাসপাতালে। তার অ্যাটেন্ডেন্ট ভদ্রলোকের পেশাও অদ্ভূত! একটা বিমানবন্দরে হাইজ্যাক ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন। তিনি যে বিমানবন্দরে কাজ করেন সেখানে আজতক কোন হাইজ্যাক করা বিমান আসেনি, অথবা সেখান থেকে কোন বিমান কেউ হাইজ্যাক করে নিয়ে যায়নি। তাকে যে অফিসে কোন কাজ করতে হয় না এটা নিয়ে স্টীলের ট্রাঙ্ক সুযোগ পেলেই খোঁচা মারছেন। হাইজ্যাক ডিপার্টমেন্ট তাতে পাত্তা না দিয়ে গুহবাবুর বাংলা নরম-পানুতে মন দেবার চেষ্টা করেন, অথবা দরোজার কাছে গিয়ে পাতার বিড়িতে কষে টান দেন।
এক ছট্ফটে তরুণ উৎকলনন্দন রাতে কখন যেনো সহযাত্রী হয়ে এসেছে। সেও যাচ্ছে দক্ষিণে বৈশ্যবিদ্যা বা পরিগণকবিদ্যায় উচ্চ শিক্ষা নেবার সুযোগ খুঁজতে। সারাক্ষণ উৎকল দেশের দ্রষ্টব্য সব স্থান আর মন্দিরের গুণগান করছে। সেই সাথে এক-আধটা স্থানীয় কিংবদন্তীর কথাও বলছে। বেশ দেশপ্রেমিক ছেলে। আমিও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার কাছ থেকে জগন্নাথ দেবের কিংবদন্তীর কথা শুনি।
গোটা ট্রেনজুড়ে নানা ধরনের রোগী আর বিদ্যার্থীর ভীড়। রোগীদের কেউ মায়াবাদীদের হাসপাতালে যাবেন, কেউ সূর্যদেবের হাসপাতালে কেউ বা আশ্রমের হাসপাতালে। বিদ্যার্থীরাও উৎকলনন্দনের মতো মূলত বৈশ্যবিদ্যা বা প্রকৌশলবিদ্যা পড়তে দক্ষিণে ছুটছেন। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান ছাড়া এখনকার সময়ে শিক্ষা-চিকিৎসা-বিনোদনকেও মৌলিক চাহিদা হিসেবে ধরা হয়। দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় ধাপের মৌলিক চাহিদার তিনটির মধ্যে দু’টির সন্ধানে লোকে দক্ষিণে ছুটছেন, তৃতীয়টির জন্যও দক্ষিণের সুনাম সুবিদিত। প্রথম ধাপের চাহিদাগুলোর অন্ন আর বস্ত্রের জোগানের জন্যও দেশের পশ্চিমাভিমুখী বা দক্ষিণাভিমুখী হতে হয়। তাহলে হাতে রইলো কী? পেনসিল!
স্টেশনগুলোর নামফলক রাষ্ট্রভাষা ও সাহেবী ভাষার পাশাপাশি স্থানীয় ভাষাতেও লেখা থাকে। সেটা লক্ষ করলে একটা মজার ব্যাপার দেখা যায়। প্রথম স্থানীয় ভাষাটি মাতৃভাষা বলে অনায়াসে পড়তে পারি। এমনকি ট্রেন খুব জোরে ছুটলেও বা নামফলকের অর্ধেকটা দেখতে পেলেও অসুবিধা হয় না। ট্রেন উৎকলে পৌঁছালে নামফলকের স্থানীয় ভাষাটিকে চেনা চেনা লাগে, তবে একটু বেশি গোল গোল মনে হয়। পড়তে পারি পারি করে আর পুরোটা পারা হয় না। কাগজ আবিষ্কারের আগে তালপাতায় লিখতে গিয়ে অক্ষরগুলো নাকি এমন গোল গোল হয়ে গেছে - যেনো পাতা ছিঁড়ে না যায়, এটা সত্য কি মিথ্যা জানি না। উৎকল ছাড়িয়ে তেলেগু-তেলেঙ্গানা এলাকায় ঢুকলে দেখা যায় বর্ণগুলো আরো গোল হয়ে গেছে। অক্ষরগুলো লতা-পাতা ডিজাইনের মতো একটা আরেকটার সাথে এমন জড়িয়ে আছে মাঝে মাঝে সত্যি সত্যি ডিজাইন বলে মনে হয়। কখনো কখনো আরবী বলেও বিভ্রম হয়। আরো দক্ষিণে আমাদের সাপেক্ষে দুর্বোধ্য দ্রাবিড় ভাষার এলাকা শুরু হলে অক্ষরের এমন জড়ানো-প্যাঁচানো আরো বাড়তে থাকে। কন্নড়ের প্যাঁচ তেলেগুর কাছাকাছি, তামিলে চারকোনা ভাবটা বেশি। তবে প্যাঁচানোতে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে মালায়ালম। সে যে কী প্যাঁচানো - জিলিপিও হার মানবে!
চালুক্য রাজা নরেন্দ্র’র শহরে যখন পৌঁছাই তখন ট্রেনের জানালাটাকে ঊনুনের মুখ বলে মনে হচ্ছিলো। বাইরে থেকে হু হু করে বাতাস নয় যেনো আগুনের গোলা ঢুকছিলো। মাথার কাছে ফ্যান ঘুরছে ঠিকই কিন্তু জানালার বাতাসের তোড়ে সে আর পাত্তা পাচ্ছে না। জানালা বন্ধ করে রাখারও উপায় নেই, তাতে দমবন্ধ হয়ে মারা পড়তে হবে। জানালা খুললে গরম বাতাসের সাথে বাড়তি উপদ্রব যোগ হচ্ছিলো দুর্গন্ধ। সে দুর্গন্ধ মূলত মানব বিষ্ঠার। সরকারী জমিতে অনির্দিষ্ট কাল প্রায় বিনামূল্যে বাসের সুযোগ থাকে বলে রেললাইনের ধারের বেশির ভাগ জায়গায় দরিদ্র মানুষেরা এসে জোটেন। বস্তিবাসীরা যথারীতি রেললাইন আর তার আশ-পাশকে উন্মূক্ত শৌচাগার বানিয়ে রেখেছেন। উপমহাদেশজুড়ে রেললাইনের অবস্থা এমন হলেও এই দফাতে দুর্গন্ধ আগের সকল অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে উঠে আমার অন্নপ্রাশনের ভাত উগড়ে দেবার মতো অবস্থায় এনে ফেললো। এই অবস্থা চলতে থাকলো পরের স্টপেজ না আসা পর্যন্ত।
ইন্দ্রপুত্রের বিজয়ের স্মৃতি বিজড়িত নগরের কাছে কৃষ্ণা তার পথ পরিক্রমা শেষ করেছে। নদী হিসেবে কৃষ্ণা গোদাবরীর মতো বিপুলা-ভীষণ নয়, তার সৌন্দর্য শঙ্খিনীর মতো। দক্ষিণের কৃষ্ণা বা গোদাবরীর তুলনায় উৎকলের মহানদী নিতান্তই ম্রিয়মান। তবে বর্ষায় তার রূপ যে যথেষ্ট প্রমত্ত হয় সেটা শুকনো নদীর প্রশস্ততা থেকে বোঝা যায়। মহানদীর বুকে কচুরীপানার ভীড় দেখে আপন আপন লাগে। একটা বিষয় চোখে লাগে এই যে, গোদাবরীর উপর বিশাল লম্বা বা মহানদীর উপর তারচেয়ে ছোট রেল ব্রীজগুলো হয়তো খুব শক্ত-পোক্ত, কিন্তু সেগুলো নির্মাণে নান্দনিক মনের ব্যবহার খুব কম। সেখানে বাহ্যিক প্রয়োজনের সাথে মনের খোরাকটাকে যোগ করলে কোন ক্ষতি হয় বলে মনে হয় না। অবশ্য মহানদীর উপরের রেল ব্রীজটাকে শক্ত-পোক্ত মনে হয়নি। কোথাও কোথাও ছোট রেল ব্রীজগুলোতে রেলিং পর্যন্ত নেই - বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেবার মতো।
তৃতীয় পাণ্ডবের স্মৃতির শহরকে ছাড়িয়ে যাবার পর পথের দু’ধারে অজানা সব গাছ আর ঝোপঝাড় বাড়তে থাকে। এক ঝলক বৃষ্টি এসে চারপাশটা একটু সহনীয় করে তোলে। কথা ছিলো গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে আর কোথাও থামাথামি নেই, কার্যত সেটা হয় না। ট্রেনকে বার বার নানা কারণে থামতে হচ্ছিলো। ফলে গরমের প্রকোপ কমলেও বিনা নোটিশের যাত্রা বিরতিতে সবার মেজাজের পারদ চড়ছিলো। সূর্য ডুবে যখন চারপাশ আঁধার হয়ে এলো তখন এন্নোরে এসে ট্রেন একেবারেই নিশ্চল হয়ে গেলো। ট্রেনের কর্তা ব্যক্তিরা দুর্বোধ্য দ্রাবিড় ভাষায় কী যেনো জানিয়ে সবাইকে ট্রেন থেকে নেমে পড়ার নির্দেশ দিলেন। সেই নির্দেশ কানে শুনে না বুঝলেও চোখে দেখে বুঝতে পেরে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে নেমে পড়লাম। দশজনের যা গতি, আমারও সেই গতি - এমন ভাবতে চেষ্টা করলেও অনিশ্চয়তার উদ্বেগ চেপে ধরলো। তার ওপর স্টেশনের পাশেই একটা কারখানার চিমনী থেকে গল্গল্ করে সাদা ধোঁয়া বের হচ্ছিলো। ধোঁয়াতে মনে হয় সালফার-ডাই-অক্সাইড মেশানো ছিলো, নাক-চোখ-গলা সব জ্বলতে লাগলো। আগের সহযাত্রীরা সব কোথায় কোথায় যেনো চলে গেছেন। পাশে একদল কিশোর, তাদের লটবহর দেখে বোঝা যায় শিক্ষাসফর শেষে ফিরছে। দলের সবচে’ বিশাল বপুধারীকে সবাই ঠাট্টা-তামাশা করছে। দলের সবচে’ রোগা-পাতলা জন বিশাল বপুর উপর কী নিয়ে যেনো চোটপাট করছে। তবে এই অসম দেহধারীদ্বয়ের মধ্যে হৃদ্যতা যে বেশ সেটা বোঝা যায়। দুনিয়ার সর্বত্রই বোধহয় এই বয়সীদের দলে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে।
অবশেষে গন্তব্যে যাবার লোকাল ট্রেন আসে। ট্রেন ছাড়তে হকারের দল কম্পার্টমেন্ট জুড়ে ছন্দোময় বিচিত্র ভাষায় কলম আর জল বিক্রি করতে লাগলো। চারপাশ অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় কিছু দেখাও যাচ্ছিল না। আমি নোটবুক খুলে সেখানে রায়নন্দিনীর লেখা আগামী দিনগুলোর জন্য আমার অস্থায়ী ডেরার ঠিকানা মুখস্থ করলাম। অপরিচিত শহরে গিয়ে কোথায় থাকা হবে, খাওয়া-দাওয়ার কী হবে - সেটা নিয়ে পাণ্ডবের বিশেষ ভাবনা না থাকলেও দীপা রায়ের ভাবনার অন্ত ছিলো না। নানা জনকে জিজ্ঞেস করে খোঁজ খবর নিয়ে বের করেছিলো কোন জায়গাটা আমার মতো ভ্যাগাবন্ডের জন্য উপযুক্ত হবে। আমার নোটবুকে সেই অস্থায়ী ডেরার ঠিকানা লিখতে লিখতে বলেছিলো, “ভগবানের কী অন্যায় দেখো! কতো মানুষ আছে যারা কোন উদ্যোগ নেয় না, সাহস করে না, দায়িত্ব নেয় না। অথচ তাদের কথা ভেবে কেউ কেউ যে সাগরে ঝাঁপ দেয় সে কথাটুকু বোঝার ক্ষমতাও তাদের থাকেনা”। আমি মাথামোটা মানুষ হলেও এই কথার অর্থ না বোঝার মতো না। আমি কিছুই বলিনি, কারণ এর পুরোটাই সত্যি। নিজের এই সৌভাগ্যে আমার আনন্দ হয় না; অনুশোচনা যতোটা হয় তারচেয়ে বেশি নিজের জন্য করুণা হয়।
নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে বিধ্বস্ত দেহে গন্তব্যের স্টেশনে পৌঁছলাম। বিশাল-ব্যস্ত-গোছানো স্টেশন। ধীরে সুস্থে স্টেশনের বাইরে বের হয়ে একটা অটোকে ডাকতে আমাদের অটোওয়ালাদের মতো বেগড়বাই না করেই যেতে রাজী হয়ে যায়। অটোতে উঠে ড্রাইভারকে বললাম, “মুরুগাপ্পা স্ট্রীট, ট্রিপলিকেন - নিয়ার চেপক স্টেডিয়াম”।
মন্তব্য
দাদা, আপনার লেখা অসাধারণ। আচ্ছা দাদা আপান কি বাংলাদেশী? ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে পারলাম না বলে দু:খিত।
ধন্যবাদ মীর মোশাররফ হোসেন।
পোস্টের কমেন্টে ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দেয়া বিব্রতকর। তবু জিজ্ঞেস যখন করেই ফেলেছেন তখন জানাচ্ছি যে, আমি বাংলাদেশী। তবে আমি অন্য কোন দেশের নাগরিক হলেও গল্পটা পাল্টাতো না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অসাধারণ! গল্পগুলোর একটা সংকলন চাই পাণ্ডব'দা এবারের বইমেলায়।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
গল্পের সংখ্যা কতোটি? বারোটি। ছাপার অক্ষরে সেগুলোর দৈর্ঘ্য কতটুকু? মেরে কেটে বিশ পৃষ্ঠা। তাহলে এবার তুমিই বলো কোনো গল্প সংকলন কি বের করা সম্ভব?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অবশ্যই সম্ভব। ফেব্রুয়ারির এখনো কত্তো দেরি। সারা বছর পড়ে আছে লেখার জন্য।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
নামসহ গল্পগুলো মলাটবন্দী হলে ভালো লাগবে খুব।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
আপনি খুঁটিনাটি এত সুন্দর করে আঁকেন!
চমৎকার! চমৎকার!
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
ধন্যবাদ ফাহিম। আগের গল্পগুলোর নাম দেয়া এখন একটু মুশকিল বৈকি, তবে কোন একদিন নামকরণ পর্ব সেরে ফেলবো। ভবিষ্যতের গল্পগুলো নামসহই আসবে।
ফাহিম/অনার্য সঙ্গীতঃ মাসের হিসাবে ফেব্রুয়ারী আসতে এখনো ঢেড় বাকি আছে সত্য, তবে আমার পক্ষে তো সপ্তাহে সপ্তাহে গল্প লেখা সম্ভব না। সেই ক্ষমতা থাকলে এই লানতের জীবন যাপন না করে সাহিত্যিকের জীবন যাপন করতাম।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এক কথায় অসাধারণ একটা ট্রেন ভ্রমণ হয়ে গেলো!!! কেবল ইতিহাস-ভূগোলে আরো কিছুটা জ্ঞান থাকলে গল্পের কথকের, "চিল্কার বাতাস বুকভরে টানতে না পারার" আফসোসে্র মত খানিকটা আফসোস্ নিয়ে ট্রেন থেকে নামতে হতো না (এটা পাঠকেরই ষোলোয়ানা ব্যর্থতা ) খুব সত্যিটা বলি? অসাধারণ লেগেছে! কিন্তু একদম গল্পের শুরুতে দীপা রায়কে 'অনাত্নীয়া ভদ্রমহিলা' সম্বোধন শেষ প্যারাতে এসে কেমন মন খারাপের সুরে বেজেছে, এটা ঠিক কার উদ্দেশ্যে সেটা জানিনা! শুভেচ্ছা।
উল্লম্ফনজনিত ঘ্যাঁচাং
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ধন্যবাদ, আয়নামতি। গল্পটা পড়ে পুরো স্বাদ নেবার জন্য ইতিহাস-ভূগোলের জ্ঞান কিছুটা হয়তো দরকার, তবে সেটা না থাকলেও ক্ষতি নেই। গল্পের মধ্যে জ্ঞানের কথা ঢোকানো আমার তো বটেই বেশির ভাগ পাঠকেরই অপছন্দ। এটা যদি উপন্যাস হতো তাহলে সেগুলো বিস্তারিত বলে দেয়া যেতো।
আপনার পরামর্শটা ভাবলাম এবং "অনাত্মীয়া" শব্দটাকে বিদায় করে দিলাম। শব্দটা থাকলে গল্প কথকের অবস্থানটা পরিষ্কার করে দেয়া হয়। তবু আপনার পরামর্শটাই মানলাম। আবারো ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
একজন সাধারণ পাঠকের অনুভূতিকে মূল্য দেবার জন্য অসীম কৃতজ্ঞতা ভাইয়া!
কি ভালো আমার লাগলো ...
কেমন ক'রে বলি।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
কেন বলতে পারবেন না? ভাব প্রকাশ কবির কাছে কি কোন ব্যাপার!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
চমৎকার লাগলো। বই বের করার ব্যাপারটাতে অনার্যদার সাথে সহমত
ধন্যবাদ। অনার্যের সাথে তাল দিলে তো হবে না, সেটা সম্ভব কিনা তাও ভাবতে হবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আগামী বইমেলা আসতে আসতে গল্পের সংখ্যা আশা করছি অন্তত চল্লিশ ছাড়িয়ে যাবে
বইমেলার আগে আরো চল্লিশটা গল্প লিখতে হলে প্রতি সাত দিনে একটা গল্প লিখতে হবে। বলাই বাহুল্য আমার সেই ক্ষমতা নেই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
গল্পটার মাঝে স্থান-পুরাণ-ঐতিহাসিক নামের আধিক্যে একটা প্রচ্ছন্ন ভ্রমণ কাহিনী উঠে এসেছে। গল্পকার সেটাই চাইলে ঠিক আছে, না হলে প্রায়ই কিন্তু 'গল্পে'র চেয়ে 'ভ্রমণ'এ মন চলে যায় পাঠকের।
এটা যেমন গল্পের কথক বা পাণ্ডবের গল্প, এটা একই সাথে ট্রেনটা বা করমণ্ডল এক্সপ্রেসেরও গল্প। গল্পের পরিসর কমানোর জন্য ট্রেনের ভাষ্যগুলো বাদ দেয়া হয়েছে। তাই ট্রেন যে যে জায়গা দিয়ে গেছে, সেখানকার নদী বা সেতু সবই কাহিনীতে চলে এসেছে। খোদ ভারতেই আমার এমন অভিজ্ঞতা আছে যে, যেখানে যাবো সেখানে ট্রেন পৌঁছানোর আগেই গন্তব্যের শহরের নাম পালটে গেছে। ফলে টিকিটে লেখা এক নাম, পৌঁছে দেখি আরেক নাম। গতকালের কলিকাতা-বোম্বাই-পুনা-মাদ্রাজ, আজকের কোলকাতা-মুম্বাই-পুনে-চেন্নাই আগামীকাল কী নাম ধারণ করবে কে জানে? এর চেয়ে ইতিহাসের উপর নির্ভর করি - ইতিহাস তো আর পালটানো যাবে না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ভালো লেগেছে। ৯২ সালে ইন্ডিয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলাম (১৯ বছর আগে, কিন্তু মনে হচ্ছে এই সেদিনের কথা), ট্রেনের বর্ণনা গুলো মনে হলো একদম নিজের অভিজ্ঞতার সাথে মিলে গেল।
পড়ে একটা ধাক্কা খেলাম। কেন খেলাম সেটা আর বললাম না।
ধন্যবাদ রু। আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো কম-বেশি একই প্রকার তাই অনেক জায়গায়ই মিলে যায়। আর কেন ধাক্কা খেলেন সেটার গল্পটা আশা করি কোন একদিন এক ফাঁকে আমাদের জানিয়ে দেবেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
চমৎকার লাগল...।
ধন্যবাদ বস্! আপনার গল্প মিস্ করি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
খুব ভালো লেগেছে, ভ্রমন কাহিনী সাগ্রহে পড়ি। বর্ননা গুনে মনে মনে লেখকের সাথে সাথে নিজেরও দেশ দেখা হয়ে যায়। বই হিসেবে বের হলে ভালো হবে। অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ। গল্পটা দেখি মাঠে মারা গেছে। শেষ পর্যন্ত এটা "রেলগাড়িতে ভ্রমণ" জাতীয় রচনা হয়ে গেছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
করমন্ডলে যে কত কত ভ্রমন স্মৃতি রয়েছে, কিছু কিছু মনে পড়ে গেল এই লেখা পড়ে। ঝরঝরে লেখা, পড়ে আনন্দ হল প্রচুর!
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
কলেজে পড়ার সময় রোজ সকালে চাষাড়া থেকে কমলাপুর ট্রেনে আসতে হতো। তখন প্রতিদিনই সাধারণ বা মজার, আনন্দের বা কষ্টের নানা রকম গল্প তৈরি হতো। প্রায় সবারই নিয়মিত পথযাত্রায় এমন সব গল্পের দেখা হয়ে যায়। কোনো একদিন কোনো এক অবসরে পাঠকরা আপনার ঐ সব গল্পের কিছু শুনতে পাবে নিশ্চয়ই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দীপা রায়ের আগের গল্পগুলি পাঠকের পড়া থাকলে, হয়তো একটা অন্যরকম ভাল লাগা তৈরি হবে, চলতি পথে আচমকা প্রিয় মানুষের সাথে দেখা হলে যেমন লাগে। আর না পড়া থাকলেও কোন ক্ষতি নেই। আলাদা একটা গল্প হিসেবেই পড়তে চমৎকার লাগল।
এই গল্পে দীপা রায়ের সাথে পাণ্ডবের সম্পর্ক কী ধরনের সেটা যদি পাঠকের কাছে স্পষ্ট না হয়ে থাকে তাহলে সেটা আমার ব্যর্থতা। উপন্যাসের ক্ষেত্রে আগের অধ্যায়গুলো পড়া আবশ্যিক, কিন্তু ছোটগল্পে অন্য কোনো গল্প পড়া থাকার পূর্বশর্ত থাকতে পারেনা। এই গল্পে আমি পাঠককে স্বাধীনতা দিতে চেয়েছি এই সম্পর্কটার ব্যাপারে তাদের মতো করে ভেবে নেবার। কারণ, শেষ পর্যন্ত গল্পটা একা পাণ্ডবের অথবা করমণ্ডল এক্সপ্রেসের।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দীপা রায়ের সাথে পাণ্ডবের কী সম্পর্ক সেটা পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয় নি, তা তো বলিনি। আমার মন্তব্য থেকে যদি তাই মনে হয়, তাহলে দুঃখিত। আমি শুধু বলেছি, দীপা রায় কে এই গল্পে দেখে আমার ভাল লেগেছে, আর কিছু না।
দুঃখিত হবার কিছু নেই, আমিই তোমার কথা ঠিকমতো ধরতে পারিনি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
...সহমত।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
ধন্যবাদ কবি। হয়তো কোনো একদিন, হয়তো সত্যি সত্যি একটা গল্প সংকলন বের করে ফেলতে পারবো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বেশ বেশ
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অনেক হয়েছে, এবার শিরোনাম থেকে প্রচেষ্টা শব্দটা কতল করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।
এই পর্ব থেকে গল্পের শিরোনাম কিন্তু চলে এসেছে। সুতরাং সিরিজের শিরোনামে প্রচেষ্টা থাকা আর না-থাকা আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নেই। অনেক দিন ধরে এই শিরোনামটা ব্যবহার করায় এর প্রতি একটা মায়াও জন্মেছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দারুন ! কোথায় যেন আমার প্রিয় কোন এক লেখকের স্টাইলের ছোঁয়া পাচ্ছি।
তবে বনলতা সেন কবিতার মত প্রাচীণ নাম অনুসরনের কারনে মাঝেমধ্যে খেই হারিয়ে যাচ্ছিল।
****************************************
ধন্যবাদ। জীবনে যা পড়েছি তার লক্ষ ভাগের এক ভাগও লিখিনি (আমার সব রকমের লেখা মিলিয়ে)। আর শুধু আমার লেখা গল্প ধরলে আগের বাক্যে লক্ষ শব্দটার জায়গায় নিযুত বসাতে হবে। তাই আমার লেখায় প্রতিষ্ঠিত কারো লেখার টোন থাকাটা স্বাভাবিক। তবে আপনাকে একটা বিষয়ে নিশ্চিত করতে পারি, অনুসরণ যদি কিছু হয়ে থাকে তাহলে সেটা অবচেতনভাবে হয়েছে - সচেতনভাবে নয়।
নামের ব্যাপারে উপরে সুহান রিজওয়ানকে একটা ব্যাখ্যা দিয়েছি, দেখুন। জীবনানন্দ দাশ আমার মাথাজুড়ে থাকলেও এখানে তাঁকে অনুসরণ করার মতো ধৃষ্টতা দেখাইনি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কথাটা প্রশংসার্থেই বলা।
আর অবচেতনে যে, সেটা আমিও বুঝি। হয়তো এটা অনুসরনই না, স্রেফ কাকতাল মাত্র। আর নামকরনের সময় আমার মত অর্ধশিক্ষিত পাঠকের কথা একটু বিবেচনায় রাখার অনুরোধ তবুও জানিয়ে যাচ্ছি।
ও হ্যাঁ, একটা কৌতুহলঃ আপনার প্রেমেন মিত্তির, কালকূট, আর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা কেমন লাগে ?
****************************************
প্রশংসা বা নিন্দা নিয়ে ভাবিনা মাঝি ভাই! "ভাবনার ঐক্য" বলার সাহস বা যোগ্যতা নেই। অনুরণন - সেতো হরহামেশাই ঘটছে।
আমার জন্য নামকরণ একটু ঝামেলারই বটে। দেখলেন না এতোদিন ধরে নাম ছাড়াই চলছিলাম। একটা গল্প পড়ে পাঠককে যদি একটু এদিক-ওদিক খোঁজ খবর করতে হয় তাহলে মন্দ কি! গল্পে ফুটনোট দেয়াটা মানায় না - যদিও আমি নিজেই একাধিকবার এই দুষ্কর্মটা করেছি।
প্রেমেন মিত্র কিছু কিছু চলে, কালকূট পুরোমাত্রায় চলে - কেমন অপার্থিব লাগে, আশুতোষের "আবার আমি আসবো" ছাড়া কিছু ভালো লাগেনি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নর্থের দিকেও যাবেন নাকি?
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
মোগল আমলে একটা কথা প্রচলিত ছিলো না - "দক্ষিণে যে যায়, সে-ই হয় বাগী"। আমি তো চির বাগী। দিল্লী - সে তো "দূর অস্ত্"!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
১ গল্পে বর্তমান থেকে অতীত এবং অতীত থেকে বর্তমানে আসা যাওটা সেতারের একই তারে যে কোন একটা সুর বাজিয়ে তারটা টেনে চড়া বা ছেড়ে খাদের দিকে সুরের উঠানো নামানোর মতো লাগল। অথচ শিল্পীর আঙ্গুল যেন ঐ একটা নির্দৃষ্ট সুর থেকে নড়ল না। গায়ক-বাদকরা একে মীড়-রের কাজ বলেন সম্ভবত। খুব পরিপক্ক বাদকেরাই তা পারেন। দুর্দন্ত!
২ আমার কাছে একটা গল্পের বিস্বাস যোগ্যতা (আওথেনটিসিটি) খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনার গল্পে (গল্প প্রচেষ্টায়) বিষয়টা এতো পরিচ্ছন্ন ভাবে আসে যে, মনে হয় এটা গল্প নয়, জীবন থেকে নেয়া।
৩ ভাষার পরিমিত ব্যবহার গল্প গুলো সত্য ঘটনার মতো জীবন্ত করে তোলে।
৪ লেখায় তাড়াহুড়া কমেছে।
ভীষণ ভীষণ ভাল লাগল গল্পটা। এমন আরো অনেক গল্প আসুক পাণ্ডবদার করকমল থেকে।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
১. একটু বেশি হয়ে গেলো বস্!
২. ভালো গল্পকারেরা মন থেকে নিজেই ছবি আঁকতে পারেন। হাতুড়েরা জীবনকে কাট-ছাঁট করে কাহিনী ফাঁদার চেষ্টা করে মাত্র।
৩. + ৪. লেখায় পরিমিতিবোধ থাকাটা গুরুত্বপূর্ন, ধৈর্য ধরে নির্মাণটা আরো জরুরী। চেষ্টা চালিয়ে যাই। কখনো পারি, কখনো পারি না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
গল্পটা সেদিন একবার পড়ে জায়গাগুলো চেনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। আজকে আরেকদফা চেষ্টা করে মন্তব্যে বসলাম। গল্পের আপনার এই নিজস্ব স্টাইলটা অচেনা জায়গাগুলোকেই পরিচিত করে দিল খুটিনাটি সুক্ষ্ণ বর্ননায়। তবে ভাবছি ইতিহাসের মিষ্টির ভেতর ভুগোলের ট্যাবলেট গিললাম, নাকি ভুগোলের মিষ্টিতে ইতিহাসের ট্যাবলেট।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমি মাস্টার মানুষ না দাদা! মিষ্টির ভেতর ট্যাবলেট গেলানো আমার কর্ম না। গল্পের জায়গা গল্পের মতো করেই বুঝুন, একেবারে আপনার মতো করে। এই গল্প নিয়ে আপনাকে তো আর পরীক্ষায় বসতে হবে না। আপনার ভালো লাগলেই যথেষ্ট।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নতুন মন্তব্য করুন