গল্প প্রচেষ্টা-১৭

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: শুক্র, ০৯/১২/২০১১ - ৫:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রতিরোধ সরণি

মাঝে মাঝে এমন একটা দিন আসে যেদিন কোন কিছুই ঠিকভাবে যায় না। নবী হোসেন সকালেই সন্দেহ করেছিল যে দিনটা সুবিধার যাবে না। মাথার কাছে রাখা মোবাইলে ঠিক সময়ে অ্যালার্ম বাজা সত্ত্বেও ঘুমকে তাড়ানো যায়নি, তাই দেরি করে ওঠার মাশুল হিসেবে দিনটা শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি দিয়ে। জোরে অ্যালার্ম বাজে এমন একটা দেয়ালঘড়ি কিনেছিল একবার। কিন্তু এখনকার দেয়ালঘড়িগুলো তো আর আগের আমলের গ্রান্ডফাদার ক্লকের মতো কিছু না যে কয়েক পুরুষ ধরে চলবে। এগুলো দু’দিন চলতে না চলতে ব্যাটারী পাল্টাতে হয়, সাত দিনের মাথায় স্লো বা ফার্স্ট হয়ে চলতে থাকে, এক মাসের মাথায় মিনিট আর ঘন্টার কাঁটা একসাথে চলতে থাকে - তখন ফেলে দেয়া ছাড়া উপায় থাকেনা।

অনেক বছর আগে একদিন সকালে নবী হোসেনের ঘুম ভেঙেছিলো দেরি করে। কারণ, তার আগের রাতের গভীর পর্যন্ত কেটেছে সহযোগীদের সাথে শলা-পরামর্শ করে। তারও একদিন আগের সারা রাত ঢাকার দিক থেকে ক্রমাগত গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। কখনো কখনো ভারী গোলা বর্ষণের আওয়াজও পাওয়া গেছে। হঠাৎ হঠাৎ উত্তর-পশ্চিমের আকাশ কমলা আলোয় ভরে গিয়েছিলো। সবাই বুঝে গিয়েছিলো পাকিস্তানীরা বাঙালীদের উপর হামলা শুরু করে দিয়েছে। তারপরের দিন আর রাতটা গেছে কী করা উচিত সেটা ভেবে। যাদের পালাবার উপায় ছিল তারা পালাতে শুরু করেছিল। নবী হোসেনের পালাবার কোন উপায় ছিলনা। বাবা-মা, ঘর-দুয়ার ফেলে যাবার প্রশ্নই ওঠেনা। তাছাড়া যুদ্ধ লাগলে তার কর্তব্য কী হবে সেটাও কিছুদিন আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে। এলাকার তরুণ-যুবাদের একটা দল যাদের কেউ কেউ বাঙালীদের স্বার্থের পক্ষের রাজনীতি করে অথবা যারা কোন রাজনৈতিক দল করেনা কিন্তু শেখ সাহেবের ভক্ত, তারা মনে করে শেখ সাহেব মার্চের সাত তারিখেই তাদেরকে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন। সমস্যা হচ্ছে তাদের হাতে কোন অস্ত্র নেই, অস্ত্র চালাতে জানেও খুব কম জন। যারা অস্ত্র চালাতে জানে তাদের দৌড় টু-টু বোরের রাইফেল বা ছর্‌রা দিয়ে পাখি শিকার করা পর্যন্ত। বোমা-গ্রেনেড তারা চোখেও দেখেনি। তবে চাষাড়া পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল সোহরাব ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছিল, যুদ্ধ লাগলে ফাঁড়ি থেকে তিনি কয়েকটা থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল আর কিছু গুলি সরিয়ে তাদের কাছে পৌঁছে দেবেন। আর সুযোগ পেলে গোপনে কোথাও রাইফেল চালানোও শিখিয়ে দেবেন আগে-ভাগেই। সেভাবে রাইফেল ধরা, গুলি ভরা আর গুলি করা তার শেখা হয়ে গেছে। যুদ্ধের জন্য অপেক্ষাও শেষ, আর এখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

সকালের ক্ষিধেটা তার একেবারেই সহ্য হয়না, তবু বেশির ভাগ দিন নাস্তা খাবার সুযোগ হয়না। যেদিন সুযোগ হয় সেদিন হয়তো নাস্তার চেহারা দেখে তার খাবার ইচ্ছেটা উবে যায়। যেদিন পকেটে রেস্ত থাকে সেদিন “আদর্শ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার” বা “লোকনাথ সুইটস”-এর ছোট পরোটা আর ভাজি খাওয়া হয়। এই দোকানগুলোর নাস্তা অমৃতের মত লাগলেও এখানে চা মেলেনা। আবার রাস্তার পাশে বেঞ্চিপাতা দোকানগুলোর চা কন্ডেন্সড মিল্কের দুর্গন্ধে মুখে দেয়া যায় না। এই দেশের লোক চা-খোর অথচ এ’দেশে ভদ্রস্থ কোন চায়ের দোকান নেই। আজকাল মোড়ে মোড়ে চটকদার কফিশপ্‌ হচ্ছে, অথচ সবার পছন্দের ‘চায়ের দোকান’ আজতক জাতে উঠলনা। তাই সব দিনই চা-শূন্য মুখে কর্মস্থলে রওয়ানা হতে হয়।

একটু দেরী করে উঠলেও যুদ্ধের দিন সকালে তার বরাতে নাস্তা ঠিকই জুটেছিল। সকালে বানানো আটার রুটির সাথে আগের রাতের বাসী তরকারী। এই নাস্তাটা নবী হোসেনের বেশ পছন্দ। এরপর এক কাপ গুড়ের বা চিনির চা হলেই একশ’এ একশ’! আয়েশ করে চা’টুকু শেষ করতে না করতে উঠানে সোবহান ভাইয়ের ডাক শোনা গিয়েছিল, “অ নবী, তাড়াতাড়ি বাইরায় আয়। ডাক আইসা গেছে”। কিসের ডাক এসেছে সেটা নবী হোসেনকে আর ব্যাখ্যা করার দরকার ছিল না। গায়ে শার্টটা চাপিয়ে রাবারের পাম্পশু গলিয়েই সোবহান ভাইয়ের সাথে সে দিয়ে ছিল এক ছুট। এর কতদিন পরে নবী হোসেন সকালে এই রকম নাস্তা অথবা কোন প্রকার নাস্তা খেতে পেয়েছিল তা আর মনে নেই।

চাঁনমারী বস্তির কাছে রেললাইনে উঠতে কমলাপুর থেকে আসা ট্রেনটা তাকে পাশ কাটিয়ে যায়। ট্রেনের পাঁচটা কোচেই উপচে পড়া মানুষের ভীড়। যুদ্ধের দিন সকালে বেশ দেরী করে কমলাপুর থেকে প্রথম ট্রেনটা এসেছিলো। তার আগেরদিন কোন ট্রেন আসেনি, যায়ওনি। ট্রেনটা ইসদাইরের কালভার্ট বরাবর আসতে দেখা গেলো ট্রেন ভর্তি জলপাই আর খাকী রঙের পোশাক পরা পাকিস্তানী সেনার দল সাথে অস্ত্র আর গোলা-বারুদে ঠাসা কাঠের বাক্স, চটের বস্তা। যমদূতের আগমন টের পেয়ে লোকজন বাড়ি-ঘর-সংসার ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে রেল লাইন টপকে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে কায়েমপুর, লামাপাড়া, সস্তাপুর অভিমূখে দৌড় দেয়। ট্রেন থেকে পাকিস্তানীরা দেখে দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত দিয়ে পঙ্গপালের মতো শত শত সহজ টার্গেট দৌড়ে যাচ্ছে। এই জায়গাটাতে লাইন খারাপ বলে ট্রেন এমনিতেই আস্তে চলে তাই শহরে ঢোকার আগেই তারা বউনি করে নিতে ভোলেনি। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের একটানা আওয়াজে গোটা উত্তর দিক ভারী হয়ে ওঠে। কতোজন যে গুলি খেয়ে ধানক্ষতে পড়েছিল আর কতোজন যে আত্মরক্ষার্থে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেঁচে গিয়েছিল সে হিসেব আর পাওয়া যায়নি।

চাষাড়া রেলগেট পেরোতে পলিয়েস্টারের ময়লাটে সাদা পাঞ্জাবী আর কালো প্যান্টপরা শাহাদাতের সাথে দেখা হয়। নবী হোসেন এককালে করিম টেক্সটাইলে শাহাদাতের সাথে কাজ করতো। সেখানে লে-অফ চলছে আজ দুই বছর ধরে। ছয় মাস আন্দোলন সংগ্রাম করে যখন না-খাওয়া দশা তখন মহল্লার একজনের কৃপায় নবী হোসেন চিশতি টেক্সটাইলে এলডি ক্লার্কের কাজটা পেয়ে যায়। কিন্তু সাবেক সহকর্মী এখনো করিম টেক্সটাইলে চাকুরীর আশা ছাড়েননি, যদিও পেট চালাতে তাঁকে মুদি দোকান চালাতে হয়। জানা গেলো করিম টেক্সটাইলের শ্রমিক-কর্মচারীরা আজ রাজধানীতে যাবে সরকারের দপ্তরে আর শিল্পমালিকদের সংগঠনে স্মারকলিপি দেবার জন্য। এসবে কখনো কোন কাজ হয় কিনা তা কেউ জানেনা, তবু চেষ্টাতো রাখতেই হবে। নিয়ম মাফিক কুশল জিজ্ঞাসা করে নবী হোসেনকে কেটে পড়তে হয় নয়তো গল্প করতে গেলে দু’জনেরই দেরী হয়ে যাবে। ভীড় ঠেলে বাসে উঠতে পারলে সময় বাঁচে বটে, তবে তাতে পকেটটা একটু হালকা হয়ে যাবে। এখান থেকে পঞ্চবটি পর্যন্ত যেতে বাসভেদে তিন থেকে পাঁচ টাকা ভাড়া গুনতে হয়। কী দরকার! তারচেয়ে একটু পা চালিয়ে হাঁটলে আধঘন্টায় অফিসে পৌঁছে যাওয়া যায়।

রাস্তার দু’পাশে ধোপাপট্টি-জামতলা-ঈদগাহ্‌ মাঠ-স্টেডিয়াম-অক্ট্রয় পোস্ট-গার্লস্‌ স্কুল-মাসদাইর-গোরস্থান-গাবতলী যাবার লেনগুলো পার হয়ে নবী হোসেন তার সাবেক কর্মস্থল করিম টেক্সটাইলের কাছে পৌঁছে যায়। করিম টেক্সটাইলটা এখন যেখানে তার সামনের রাস্তাতেই এককালে একটা কালভার্ট ছিল। খাল-নালা ভূমি খাদকদের গ্রাসে চলে যাওয়ায় অদরকারী কালভার্টটা এখন আর নেই। চার দশকের বেশি আগে চৈত্রের এক আগুন ঝরা সকালে সেই কালভার্টটাতে তিনি আশ-পাশ মহল্লার আরো জনা পঞ্চাশেকের সাথে গাছ কেটে ব্যারিকেড দিয়েছিলেন। সকালে সোবহান ভাই এর জন্যই ডাক দিয়েছিলেন। রেললাইন বন্ধ করার কথা অন্য গ্রুপের। তারা বোধহয় কাজ শেষ করতে পারেনি। পোকামাকড়ের মত না মরে লড়াই করার ইচ্ছে নিয়ে যারা কালভার্টে ব্যারিকেড দিয়েছিল তাদের হাতের অস্ত্র দিয়ে চর দখলের চেষ্টা করা যেতে পারে মাত্র, এর বেশি কিছুনা। আসলে এর বেশি যে কী হতে পারে তা কারো ধারণাতেও স্পষ্ট ছিলনা।

মৃত্যুদূত যখন হাজির হয় তখন ব্যারিকেডের কাছে কেউ ছিলনা। সবাই তখন কাছের গোরস্থান আর খালপাড়ের ঝোপের আড়ালে ছিল। ব্রাশ ফায়ারের শব্দে চারদিক কেঁপে ওঠে। ব্যারিকেড গুড়িয়ে দিতে এগিয়ে যেতে থাকা একটা জীপ খালে পড়ে যায়। মৃত্যুদূত ক্রোধে বিস্ফোরিত হয়। প্রতিরোধ যোদ্ধারা চুপ করে ছিলো না। তারা সাধ্যমত পালটা জবাব দিয়েছিল। কিন্তু সেটা খুব বেশিক্ষণের জন্য না। দেশের সবচে’ বড় নদীবন্দরটার নিয়ন্ত্রণ নেবার জন্য যে বিশাল মিলিটারী কনভয় ঢুকছিলো তাদের বিপক্ষে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রচেষ্টা নিতান্তই অপ্রতুল ছিল। হামলা শুরুর একদিন যেতে না যেতেই যে এখানে প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে পাকিস্তানীরা এমনটা ভাবতে পারেনি। এর জবাব দেবার জন্য তারা দু’পাশের মহল্লায় ঢুকে শুরু করে হত্যার উৎসব, আগুন লাগানোর উৎসব। বড় ড্রামে চাকা লাগিয়ে বানানো ঠেলাগাড়িতে কেরোসিন বেচা ওমর আলী হয় প্রথম শিকার। রাস্তার পাশের জমিতে বাঁশের টুকরিতে মাথা ঢেকে কুঁজো হয়ে থাকা মাটিকাটা শ্রমিকের দল হয় দ্বিতীয় শিকার। আহমদ চেয়ারম্যানের মেয়েজামাই জসিমুল হক সাহেবের বাড়িতে ঢুকে পরিবারের প্রায় সবাইকেই পাওয়া যায়। সবাইকে একলাইনে দাঁড় করিয়ে আবার শুইয়ে দিতে পাকিস্তানীদের এক মিনিটও লাগেনি। হক সাহেবের ছোট মেয়েটা বেঁচে যায় বাড়ির গৃহকর্মীর সহায়তায়। পাটব্যবসায়ী আবদুস সাত্তার সাহেবের ‘রংপুর হাউস’-এ ঢুকে পাওয়া গেলো তার তরুণ পুত্র তৌফিক সাত্তার আর তার এক বন্ধুকে। পাকিস্তানী সেনারা প্রশ্ন করে তাদের পরিচয় জানার কোন প্রয়োজন বোধ করেনি - ব্রাশ ফায়ারে বাড়ির আঙিনাতেই দু’জনকে শুইয়ে দিয়েছে। আজো তার সেই উঠানের মাটিতেই শুয়ে আছে।

একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো তার আগের দিনই। ছাত্রনেতা সাচ্চু ভাই তিনটা বন্দুক আর কয়েকজনকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানীদের একটা ছোট দলের উপর ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে ওদের তিনজনকে খতম করেছিলেন। পাকিস্তানীরা যে এর চরম প্রতিশোধ নেবে সেটা সবাই বুঝেছিল। তাই পরদিন ভোর হতে না হতেই ব্যারিকেড দিয়ে পাকিস্তানীদের সম্ভাব্য আক্রমণের চেষ্টা করা হয়েছিল। ব্যারিকেড ভেঙে পাকিস্তানীরা উত্তর আর দক্ষিণ মাসদাইরে ঢুকে পড়লে সাচ্চু ভাই আর তার সহযোগীরা দক্ষিণ মাসদাইর মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মের স্বঘোষিত রক্ষকদের কাছে ধর্মস্থানে আশ্রয় নেয়া কোন অর্থ বহন করেনা। তাই টেনে-হিঁচড়ে বের করে সবাইকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে মসজিদের সামনেই ব্রাশ ফায়ার করে মারা হয়। এক আক্রমণেই সাচ্চু ভাইসহ পঁয়ত্রিশ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার অনেক দিন পর কে যেন হিসেব বের করেছিল সেদিন নাকি মোট চুয়ান্ন জন শহীদ হয়েছিলেন। কে গুনেছিল যে সংখ্যাটা চুয়ান্ন জন? না হয় মহল্লার বাসিন্দাদের নাম ধরে ধরে হিসেব করে চুয়ান্ন জনের হিসেব পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু অন্য জায়গা থেকে মাটি কাটতে আসা শ্রমিকদের চিনতো কে? কে চিনতো রিক্‌শাওয়ালা আর ঠেলাগাড়িওয়ালাদের? খাল দিয়ে যে লাশগুলো ভেসে গেছে তার হিসেব কে রেখেছে? রেললাইনের ধারে শকুনে খুবলে খাওয়া লাশগুলোর পরিচয়ই বা কে জানতো? সঠিক সংখ্যাটি কি একশ’ চুয়ান্ন, নাকি পাঁচশ’ চুয়ান্ন! মাসদাইর শ্মশানঘাটে যাবার পথের বাঁয়ে মৃনাল হকের বানানো কালো-কুৎসিতদর্শন একটা ভাষ্কর্য শুধু এখন দাঁড়িয়ে আছে সেদিনের স্মৃতি হিসেবে।

করিম টেক্সটাইল পার হয়ে সামনে আগাতে হাতের বাঁ দিকে কয়েক বছর আগে বানানো পুলিশ লাইন পরে। পুলিশ লাইনের কম্পাউন্ডের ভেতরেই পুলিশ লাইন স্কুল। এই স্কুলে তার নিজের বড় মেয়ের সাথে মুক্তিযুদ্ধের এরিয়া কমান্ডার শহীদুল্লাহ্‌ ভাইয়ের মেয়ে সুমিও পড়তো। কমান্ডারের অবস্থা কোনকালেই ভালো ছিলনা। মুক্তিযুদ্ধের পর কমান্ডার নানা রকম ব্যবসায়ের চেষ্টা করেছিলেন - বেকারি দেয়া, বিড়ির ফ্যাক্টরি দেয়া এমন অনেক কিছু। কিন্তু পুঁজির অভাব আর অনভিজ্ঞতায় তাঁর কোন ব্যবসায়ই দাঁড়াতে পারেনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাঁকে বার বার টানা-হ্যাঁচড়া করেছে কিন্তু তাঁর আপোষহীন মনোভাবের জন্য কোথাও টিকতে পারেননি। সব জলপাই আমলেই কিভাবে যেন তাঁকে একবার করে জলপাই বুটের লাথি আর লাল দালানের রুটি দুইই খেতে হয়েছে। নিজের ভিটে-মাটি হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে সেখানে থাকতে হয়েছে। দিনের পর দিন ক্ষিধের জ্বালা সইতে না পেরে একদিন ছোট একটা ঘটনায় কমান্ডারের ছোটমেয়ে সুমি অভিমানে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। ক্ষুধার জ্বালা নবী হোসেন আর তার পরিবারকেও সইতে হয়েছে। সেটা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তো বটেই তারপরেও আরো অনেক বছর।

কালভার্টের কাছের প্রতিরোধ যুদ্ধে পিছু হটে নবী হোসেন আর তার সহযোদ্ধারা গোরস্থানের ভেতর আশ্রয় নেয়। গোরস্থানের ভেতর এক পুরনো ভাঙা কবরে লুকিয়ে নবী হোসেন সেদিন থেকে এক বোধি অর্জন করা শুরু করেছিল। তার সেই বোধি অর্জন শেষ হতে চলে যায় আরো অনেকগুলো মাস-বছর। অর্জিত বোধি আজও অক্ষয় আছে। তাই বোকার মত পরের নানা রকম বোঝা টেনে গেছে বহুদিন। আজ কমান্ডারের মেয়ে সুমির কথা ভাবতে ভাবতে সেই বোধির কথা মনে হয়, নেতার পায়ের কাছে জমা দেয়া প্রিয় অস্ত্রটার অভাবে শূন্য শূন্য লাগার কথা মনে হয়। সহযোদ্ধাদের সবার অবস্থা তার মত নয়। কেউ কেউ রেশন বা কেরোসিনের পারমিট পেয়েছিল, কেউ কেউ এটা-সেটা বানাবার ফ্যাক্টরী দেবার টাকা পেয়েছিল। কেউ সেসব ভাঙিয়ে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে উঠতে পেরেছে, কেউ প্রাপ্ত সবকিছুই বেচে খেয়েছে। তবে তার মত কিছুই না পাওয়ার সংখ্যাই বেশি। এ’নিয়ে তার আফসোস নেই। তার বোধি তাকে আফসোস করতে শেখায়নি, লোভ করতে শেখায়নি, মুক্তিযুদ্ধ করার বিনিময়ে বৈষয়িক সুবিধা নেবার কথা ভাবতে শেখায়নি। আজ সুমি নেই কিন্তু তার বড় মেয়েটা আছে। মেয়েটা এবার মাধ্যমিক পাশ করেছে, তবে ফলাফল বিশেষ ভালোনা। তাই সরকারী কলেজে ভর্তি হতে পারার আশা নেই - কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে বেসরকারী কলেজে ভর্তি করানোর উপায় নেই। ছেলেটা স্কুলে - টেনেটুনে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকই তবে ভবিষ্যতে কী হতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তা যাই হোক, নবী হোসেন তার নিজের যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

পুলিশ লাইন স্কুল পার হলে বাঁদিকে সাবেক কাইলানী বিল। বিলটা এখন আর নেই। জাহাজ ভাঙা লোহার মার্কেট আর রি-রোলিং মিলগুলোর আড়ালে চাপা পড়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বিলের দক্ষিণ দিকের গ্রাম এনায়েতনগর, ঘোষেরবাগ, মিস্ত্রিবাগ, পশ্চিম দেওভোগ আর কাশীপুর থেকে গ্রামবাসীদের ধরে এনে এখানে লাইন ধরে গুলি করে মারা হতো। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে নভেম্বর মাসে নদীর ওপাড়ের বক্তাবলীতে একদিনেই শহীদ হন একশ’ ঊনচল্লিশ জন। শত শত মানুষের গণকবর আজ মানুষের বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, ডায়িং-ওয়াশিং-রিরোলিং মিলের নিচে চাপা পড়ে গেছে। রাস্তার যে পাশে কাইলানী বিল তার উলটো দিকে জোড়া বিল্ডিং এলাকা। বহু বছর ধরে অনেকটা ফাঁকা জায়গার মাঝখানে পাশাপাশি দুটো চারতলা বাড়ি থাকায় জায়গাটার স্থানীয় নাম জোড়া বিল্ডিং। জোড়া বিল্ডিং-এর জায়গায় আগে একটা হলুদ তিনতলা বাড়ি ছিল। সেই বাড়ির দোতলাতে মিজানরা থাকত। মে মাসের এক রাতে দু’জন পাকিস্তানী সেনাকে নিয়ে পাঁচজন রাজাকারের একটা দল মিজানদের বাড়িতে হানা দেয়। মিজানকে পাবার প্রশ্ন ওঠে না - সে তখন আগরতলার ট্রেনিং ক্যাম্পে। পাকিস্তানী আর রাজাকারের দল লুট-পাট বা ভাঙচুর কিছু করেনি, শুধু মিজানের পনের বছরের বোন বিউটিকে ধরে নিয়ে যায় এই বাড়িরই ছাদে। মিজানের বাবা একবার ছাদে ছুটে যাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আসলাম রাজাকার রাইফেলের কুঁদোর এক বাড়িতে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দিলে আর কারো ছাদে যাবার সাহস হয়নি। ভোরে পাকিস্তানী আর রাজাকারের দল বিউটিকে গলা টিপে মেরে ছাদ থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

এই রাস্তার শেষ মাথার জায়গাটার নাম পঞ্চবটি। পাঁচটা বট গাছ এখানে কখনো ছিল কিনা তা জানা নেই। তবে এটা জানা আছে যে, পঞ্চবটির শুরুতে আজ যেখানে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা অয়েলের রিজার্ভ ট্যাঙ্কগুলো আছে তার পিছনে পাঁচটা বা তারও বেশি জল্লাদখানা ছিল। পাশেই বুড়িগঙ্গা নদী, তাই মেরে লাশ ভাসিয়ে দেয়া ছিল সহজ ব্যাপার। নদীর পাড়ের চিশতি টেক্সটাইল আর ঢাকা ভেজিটেবল অয়েল মিলে উর্দুভাষী বিহারীদের প্রাধাণ্য ছিল। মিল দুটোর কলোনীগুলোর প্রায় সব পরিবারই ছিল বিহারী। আবার মিল দুটোর কাছের শীশ্‌মহল এলাকা ছিল হিন্দুপ্রধান। খাদ্য আর খাদকের এমন নিকটাবস্থানের দরুণ ঐ নয় মাস ধরে নদীর পাড়ের জল্লাদখানাগুলোতে তাই মানুষ সরবরাহতে কোন অসুবিধা ছিল না। মিল এলাকার বাসিন্দাদের কাছে শীশ্‌মহলের কালী ডাক্তারের চিকিৎসার বেশ সুনাম ছিল। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত হোক আর এই দুঃসময়ে অন্য কোন ডাক্তার পাওয়া যাবেনা ভেবেই হোক বিহারীরা কালী ডাক্তারকে কিছু বলেনি। কিন্তু কালী ডাক্তারের ভাই-ভাতিজা কেউই তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে শীশ্‌মহল থেকে মানুষ ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা বন্ধ হয় ঠিকই, তবে তার কয়েক বছর পর থেকে সেখানে অন্যসব উপদ্রব শুরু হয়। ফলে শীশ্‌মহল এলাকা থেকে তার আদি বাসিন্দারা আস্তে আস্তে সরে পড়তে বাধ্য হয়, আর ভূমিখাদকেরা একটু একটু করে শীশ্‌মহল গ্রাস করতে থাকে।

নবী হোসেন এতক্ষণে চিশতি টেক্সটাইলের গেটে পৌঁছে যায়। আজ পৌঁছাতে একটু দেরি হয়ে গেছে, হয়তো আধাবেলার বেতন কাটা যাবে। সে’কথা মনে হতে মুখটা আবারো তেতো হয়ে ওঠে। মিলটার এখন হতশ্রী দশা। অচিরেই এর অবস্থা করিম টেক্সটাইলের মতো হয়ে যেতে পারে। মিলের পেছন দিকের সাবেক কলোনীগুলো এখন অফিস আর গোডাউন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ষোলই ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর এসে দেখা গেছে হানাদারদের সহযোগী বিহারী পরিবারগুলো এখানে আশ্রয় নিয়েছে। জল্লাদ বাহিনীর সদস্য পুরুষগুলো কোথায় যেন পালিয়েছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ আর অসুস্থরা পড়ে আছে। কমান্ডার শহীদুল্লাহের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল এদেরকে কিছু বলা যাবে না। শুধু পাহারা দিয়ে রাখতে হবে যেন পালাতে না পারে। এদের ব্যাপারে যা কিছু সিদ্ধান্ত নেবার সেটা নাকি সরকারই নেবে। সরকার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলে এদেরকে র্যা লে ব্রাদার্সের পাটের গুদাম এলাকার বিহারী পাড়ায় রেখে আসা হবে। ঠিক অমন সময়ে কোত্থেকে যেন হামিদ মুন্‌শীর ছেলে মোতালেব হাজির হয় একটা এলএমজি হাতে। গোটা মুক্তিযুদ্ধের সময় মোতালেব কোথায় ছিল আর কী করেছিল সেটা কেউ নিশ্চিত ছিলনা। সরকারের লোক এসে বিহারীদের নিয়ে যাবার আগের সময়টাতে কারো উপর নজর রাখার অবস্থা কারোই ছিলনা। সেই সুযোগে মোতালেব কলোনীর এক ঘরে ঢুকে পরে। তার একটু পরে হঠাৎ ব্রাশ ফায়ারের শব্দে সবাই সচকিত হয়ে কলোনীতে ঢুকতে দেখে নারকীয় কাণ্ড। মোতালেবের হাতে উদ্যত এলএমজি, সামনে রক্তের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে কয়েকজন নারী-শিশু। কমান্ডার শহীদুল্লাহ্‌ আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারেন না, এক লাথিতে মোতালেবকে মাটিতে ফেলে চেঁচিয়ে বলতে থাকেন, “আমি কই নাই যে কোন গোলাগুলি না! কই নাই যা করার সরকারে করবো! হের পরেও তুই গুলি করলি ক্যা? কার হুকুমে গুলি করলি?” মাটি থেকে উঠতে উঠতে মোতালেব চেঁচিয়ে বলে, “এই বেজন্মার জাত একটারেও রাখতাম না। শুয়োরের জাত!” মোতালেব আবার গুলি করতে উদ্যত হলে কয়েকজন তাকে জাপটে ধরে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মোতালেবের কোমর থেকে একটা কাপড়ের পোঁটলা খুলে পড়ে। দেখা গেলো পোঁটলা ভর্তি সোনার গয়না। হঠাৎ করে মোতালেবের উদয়ের রহস্য সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। ঐদিনটাই মোতালেবের জন্য শেষদিন হতে পারতো কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেনো মোতালেব সেদিন প্রাণে রক্ষা পায়। মোতালেব এরপর বেঁচেছিল অনেকগুলো বছর। তার পেশা ছিল ঐদিনের মতোই অন্যেরটা ছিনিয়ে নেয়া। মোতালেব মরেছিলো অতিরিক্ত মদ খেয়ে লিভার পঁচে। কমান্ডার শহীদুল্লাহ্‌রও লিভারটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল - তবে সেটা হেপাটাইটিসের যথাযথ চিকিৎসা করতে না পারায়।

দুপুরে নবী হোসেন বুঝতে পারে তার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। শরীরটা কয়েকদিন ধরে এমনিতেই তার ভালো যাচ্ছিল না। জ্বর আসায় সে আরো কাহিল হয়ে পড়ল। দুপুরে খেতে বসে এক লোকমা খাবার মুখে তুলতেই গা গুলিয়ে বমি চলে আসল। খাবার শেষ না করে তাই ম্যানেজারের রুমে গিয়ে ছুটির আবেদন করতে হল। সকালে দেরি করে আসায় ম্যানেজার এমনিতে তার উপর রুষ্ট ছিল, কিন্তু নবী হোসেনের লালচে চোখ আর পাণ্ডুর মুখ দেখে অনিচ্ছায় ছুটি দিতে বাধ্য হল। ছুটি পেয়ে নবী হোসেন হাঁটতে হাঁটতে পঞ্চবটি মোড়ে আসতে দেখা গেল মূল রাস্তার দু’পাশে সারি ধরে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, পুলিশ রাস্তা ফাঁকা করছে – কোন যানবাহন চলতে দিচ্ছে না, কাউকে রাস্তা পার হতে দিচ্ছে না। শোনা গেল বিসিক শিল্পনগরী পরিদর্শনে মাননীয় শিল্পমন্ত্রী আসছেন। সেই উপলক্ষে বিসিকের দিকে যাবার পথের উপর সদ্য বানানো একটা তোরণও চোখে পড়লো। তোরণে ব্যানার ঝুলছে “মাননীয় শিল্পমন্ত্রীর আগমন – শুভেচ্ছা, স্বাগতম”। জ্বরে নয়, এসব দেখে নবী হোসেনের সারাটা শরীর প্রচণ্ড ক্রোধে কেঁপে উঠলো। মনে পড়ল সময়ের পালাবদলে আলবদর কমান্ডারটা এখন মন্ত্রী হয়ে গেছে। একদিন যে পতাকা কারো কাছে পেলে তাকে কতল করতে আলবদর কমান্ডার দ্বিধাবোধ করতোনা আজ সেই পতাকাই তার গাড়ির সামনে পতপত করে ওড়ে।

ক্রোধেই হোক অথবা জ্বরের ঘোরেই হোক নবী হোসেনের দৃষ্টি ঝাপ্‌সা হয়ে আসে। চোখে ভাসে উপুর হয়ে তার পাশে শুয়ে ক্রমাগত গুলি করে যাওয়া নূরুল আলমের মুখ – যে মুখ পাকিস্তানীদের গুলিতে একপাশ উড়ে গিয়েও কেমন বিস্ময়মাখা ছিল। কানে আসে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়া সহযোদ্ধা সালামের চীৎকার – “নবী ভাই গো, আমারে বাঁচান”। নবী হোসেনের বোধটা আবার জেগে ওঠে। বৃষ্টির আসতে পারে এমন আশংকায় সহকর্মীর কাছ থেকে চেয়ে আনা জরাজীর্ণ ছাতার কালো কাপড়টা সে একটানে ফর্‌ফর্‌ করে ছিঁড়ে ফেলে। তারপর সেটা ভাঙা ছাতার বাঁটে পতাকার মতো করে বাঁধে। পুলিশের তীব্র হুইস্‌ল আর গাড়ির সাইরেনের শব্দে কানের পর্দা ফেটে যেতে চায় – মন্ত্রী মহোদয়ের গাড়ি আসছে। পুলিশ আরো শশব্যস্ত হয়ে লাঠি দিয়ে গুঁতিয়ে রাস্তার দু’পাশের মানুষজন সরানোর চেষ্টা করে। ছাতার বাঁটে বাঁধা কালো কাপড়টাকে মাথার উপর তুলে পতাকার মতো দোলাতে দোলাতে নবী হোসেন হঠাৎ মানুষের ভীড়-পুলিশের বাধা ঠেলে রাস্তার মাঝখানে চলে আসে –মন্ত্রীর গাড়ি ততক্ষণে সামনে চলে এসেছে।


মন্তব্য

দুর্দান্ত এর ছবি

পড়লাম কিছুটা সময় চুপ করে বসে রইলাম।

কি হবে আর কাগুজে পরিচালনা কৌশল কপচে? এখানে গলপের নামে যা পড়লাম, সেটাই যে ঘটনা। এটা বোঝাই যে সবচাইতে জরুরি।

ফোন করেছিলাম। পাইনি।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সত্য স্বীকার করি। এটা নামেই গল্প। এই আখ্যানে বর্ণিত মৎকৃত সামান্য সাহিত্যিক অপকীর্তি ছাড়া বাকি পুরোটাই সত্য ঘটনা। চরিত্রদের প্রায় সবাই আমার বহু পরিচিত। তাঁদের মধ্যে আমার আত্মীয়-স্বজনও আছেন।

অটঃ বিকাল আর সন্ধ্যায় দুই দফা দেখলাম 1234567 নাম্বার থেকে কল আসছে। দুই বারই ফোন ধরলাম, অপর প্রান্ত থেকে কোন শব্দ শুনতে পাইনি। ভেবেছিলাম প্রবাসে ট্যুরে থাকা সহকর্মী ফোন করেছেন কিনা। তাকে কল করতে তিনি বললেন, "নাহ্‌, খামাখা তোমারে ফোন করবো ক্যান"? ফেসবুক বা জিটকে কথা বলতে চাইলে আমার মোবাইলে মেসেজে জানাও।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আশফাক আহমেদ এর ছবি

আপনার গল্পগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ি।

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

পথিক পরাণ এর ছবি

পড়লাম। এই নিয়ে তিনবার। মন্তব্য করার সাহস পাচ্ছিলাম না। খুব কাছ থেকে না দেখলে আর অনুভব না করলে এতো নিখুঁত বর্ণনা দেয়া বোধকরি কঠিন।

''জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন!!''

--------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বাংলাদেশের চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী সবাই তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বা মুক্তিযুদ্ধে অন্যভাবে অবদান রেখেছেন আরো কোটি কোটি জন। আর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে দেখেছেন তো সবাই। জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শুনলে, তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা জানলে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচে' বড় মহাকাব্যটা লেখা সম্ভব।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

চরম উদাস এর ছবি

অসাধারণ লাগলো চলুক

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তাপস শর্মা এর ছবি

অসাধারণ প্রকাশ পাণ্ডব দা। চলুক

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনাদের ভালো লাগলেই আমার প্রচেষ্টা সার্থক।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কর্ণজয় এর ছবি

তরতর করে এগুনো গেল। অনায়াসে। আপনি চাইলে বড় উপন্যাস লিখতে পারবেন।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। উপন্যাস মানে আমার কাছে 'হুমায়ুন আহমেদ' সাইজ না, 'তলস্তয়-শলোখভ' সাইজ। অমন সাইজের আখ্যান লেখার ক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারিনি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

সারারাত জেগে আছি। সকালটা শুরু হল আপনার আর দ্রোহীদার অসাধারণ দুটো লেখা দিয়ে, জারি থাকুক আপনার গল্প প্রচেষ্টা। কিন্তু একটা কথা পাণ্ডব্দা, আপনার গল্পের শিরোণাম খুব মিস করি,কদ্দিন আর 'গল্প প্রচেষ্টা' দিয়ে চালাবেন?

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। গল্পের শিরোনাম আছে তো! উপরে দেখুন, এই গল্পটার নাম 'প্রতিরোধ সরণি'। সিরিজটার নাম 'গল্প প্রচেষ্টা'।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

চলুক চলুক

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ওডিন এর ছবি

তাইলে কই, শোনেন। এইটাও গল্প না, সত্যি ঘটনা।

বছরবিশেক আগে এক লোক নিউমার্কেটে মুরগি কিনতে গিয়া দেখে তার পাশেই ল্যান্ডক্রুজার থামায়া দেলু রাজাকার টিপে টিপে যাচাই করে মুরগি কিনছে। সে কাঁপতে কাঁপতে বাসায় এসে বলেন- যেই #### রে মারার জন্য ট্রেনিং লইছি যেই ####-ই আমার লগে খাড়ায়া মুরগি কিনে- এইটা আর সহ্য করতে পারলাম না। সেইদিন থেকে উনি মুরগি খান না।

তখন ছোট ছিলাম- উনার ছেলেমানুষি দেখে মনে মনে হাসতাম। হেহ, হুদাই ট্রেনিং এর গপ্পো করে খালি, আর মুরগির ওপর গরম দেখায়। কিছুই তো করতে পারলো না। সাহস থাকলে দেখাক কিছু করে।

এখন আর হাসি না অবশ্য। মন খারাপ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সত্তরের দশকের শেষভাগে নম্র-ভদ্র-বিনয়ী-পড়ুয়া ছেলের ভেক ধরে শিবির রাজশাহী আর চট্টগ্রামের শিক্ষায়তনগুলোতে ঢুকে পড়েছিল। অজ্ঞতাবশত তখন তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন অনেকেই। সময় তাদের পক্ষে সুবিধাজনক হয়ে উঠতেই তাদের শিং-নখ-দাঁত-থাবা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষকে কখনোই আন্ডারএস্টিমেট করতে নেই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের মানুষ। লেখাটি পড়ে মনে হয়েছে, এতো আমার নিজের চোখে দেখা ঘটনাবলী।
যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে গ্রেনেড হামলার পরে নোটবইতে লিখেছিলাম, 'এখনই যথাযথ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে, অন্যথায় একদিন আমাদের জাতীয় পতাকাও গ্রেনেডবিদ্ধ হবে।'
অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতার সাথে এই আখ্যানের ব্যতয় হবার তো কোন উপায় নেই। মুক্তিযুদ্ধ ঐতিহাসিকভাবে সত্য, তার বাস্তবতা এখনো বিদ্যমান। উদীচীর ঘটনার আরো বহু বহু আগে আশির দশক থেকেই তারা কিন্তু পালটা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তারেক অণু এর ছবি

অসাধারণ ! এ লজ্জা আমাদের মন খারাপ, কিন্তু যারা এই লজ্জা আমাদের গায়ে মেখে দিলে, তাদের কি হবে!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

লজ্জা আমাদের সেটা ঠিক। যারা আমাদের গায়ে এই লজ্জা মাখিয়েছে তারা আসলে প্রতিপক্ষের অংশ। এখন অন্য ভেক ধরে আছে কেবল। সময় আসলে সবাই আসল রূপে প্রকাশিত হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

এই জিনিস একবার হইছে, এনাফ। আরেকবার হইতে দেয়া যাবে না।

এমনিতে কতগুলা জায়গা মনে পড়ল। সম্পর্কিত না। দেশবন্ধু সুইটস। বাওয়ানী জুটমিল। ইত্যাদি।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

নানা জায়গায়, নানা ফর্মে এই ঘটনা কিন্তু চলছেই। মন্ত্রী হলে যা আমাদের চোখে পড়ে এমপি-সচিব-জেনারেল-মেয়র-চেয়ারম্যান হলে তা আমাদের চোখে পড়ে না। এই অন্ধত্ব বরদাশ্‌ত করা উচিত না।

অসম্পর্কিতঃ দেশবন্ধু সুইটস তো ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন রোডে। সেটার পরোটা-ভাজি এখনো বিখ্যাত (তবে আমার আর সহ্য হয় না)। বাওয়ানী জুটমিল এলাকা আমার আখ্যানের ভৌগলিক সীমার বাইরে পড়ে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

গল্প প্রচেষ্টা হলেও এটাকে ইতিহাসের ধারাবর্নন মনে হয়েছে আমার। সেই প্রেক্ষিতেই বলি।

ওই জানোয়ারগুলো গত চল্লিশ বছরে মানুষের ছদ্মবেশে ফাঁকফোকর বের করে ঢুকে পড়েছে সমাজের প্রতিষ্ঠিত আস্তানাগুলোতে। আমাদের সাথে মিশে গেছে। রাজনীতি বাদ দিয়েও সমাজের স্তরে স্তরে তাদের বীজ রোপিত হয়েছে। ডালপালা মেলে মহীরূহ হয়ে উঠেছে কেউ কেউ। অনিয়ন্ত্রিত প্রবৃদ্ধি।

আমরা কি তাদের আলাদা করে চিহ্নিত করার শক্তি রাখি না? আর কিছু না হোক আমরা তাদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে অন্তত বলার সাহস রাখি না তুই রাজাকার??!!!! অবশ্যই পারি। অবশ্যই বলবো!! শুধু সেকালের রাজাকার নয়, একালের নব্য রাজাকারগুলোকেও আমরা যেন প্রকাশ্যে বলতে পারি 'তুই ব্যাটা রাজাকার, তোর চোদ্দগুষ্টি রাজাকার!!!!!'

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অন্যকেউ এর ছবি

অনুভব করলাম নিজের ভেতরে। চলুক

_____________________________________________________________________

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

এই লেখাটা গল্প প্রচেষ্টা'র ট্যাগে রাখা উচিত না হয়তো... এটা তো গল্প না! অন্তত একাত্তরের ট্যাগটা আসা দরকার।

আজকে বাড়ি ফেরার পথে একটা বাড়ি দেখায়ে আব্বা ঐ বিহারী রাজাকার ধরে রাখা আর তার পরবর্তী একটা প্রায় একই ঘটনা বললো।

একদিন যে পতাকা কারো কাছে পেলে তাকে কতল করতে আলবদর কমান্ডার দ্বিধাবোধ করতোনা আজ সেই পতাকাই তার গাড়ির সামনে পতপত করে ওড়ে।

চল্লিশ বছর অনেক বেশি সময় এতকিছু মনে করে রাখার জন্যে কারও কারও কাছে, আবার চল্লিশ বছর শুধু গতকালকের মতোই স্পষ্ট কারও কারও কাছে।

অটঃ ঘড়িগুলোকে "গ্র্যান্ডফাদার" ক্লক বলে সম্ভবত।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

লেখাটি পড়ে শামসুর রাহমানের 'একটি মোনাজাতের খসড়া'র ক'ছত্র মনে পড়ে গেল,

বিবরে লুকিয়েছিল যারা গীর্জের ইঁদুর হয়ে...

আচ্ছা, 'ব্রাশ ফায়ার' শব্দটি কি সঠিক? নাকি 'বাস্ট ফায়ার (burst fire)'?

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

'ব্রাশ ফায়ার' শব্দটি সঠিক কি সঠিক না সেটা কি আপনি আমকে প্রশ্ন করবেন, নাকি আমি আপনাকে প্রশ্ন করব?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

সারাজীবন ব্রাশ ফায়ার শুনে এসেছি। আপনার প্রশ্নটা ভাবালো। খোঁজাখুঁজি করে যা পেলাম তাতে মনে হচ্ছে বার্স্ট ফায়ার সঠিক শব্দ। ব্রাশ ফায়ারের মানে হচ্ছে ঝোপঝাঁড়ে আগুন লাগা কিংবা গৌণ সমস্যা।

ভালো জ্ঞান লাভ হইলো আপনার কল্যাণে। চলুক

কল্যাণ এর ছবি

অসাধারণ

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।