১৩.
ভারতের ইতিহাসে মুঘল আমলকে সাধারণত নিরবচ্ছিন্নভাবে ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৭৬৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত দেখানো হলেও বাস্তবে সেটা নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। ১৫৪০ খ্রীষ্টাব্দে শের শাহ্ সূরীর কাছে হুমায়ুনের পরাজয়ের পর থেকে ভারতের উত্তর আর পূর্বে আফগানদের শাসন বিস্তৃত ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। শের শাহ সূরীর প্রতিষ্ঠিত সূরী রাজবংশ স্পষ্টতই ১৫৪৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৫৫৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা শাসন করেছে। ১৫৫৫ খ্রীষ্টাব্দে হুমায়ুন সূরীদের কাছ থেকে সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করলেও ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে আকবর ও বৈরাম খাঁর কাছে আদিল শাহ্ সূরী ও সম্রাট হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্যের পরাজয়ের আগ পর্যন্ত দিল্লী মুঘলদের কব্জার বাইরে ছিল। এমনকি আকবরের শাসনামলের শুরুর দিকেও পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা মুঘলদের কব্জার বাইরে ছিল। পূর্ব ভারতের অনেক শাসক মুঘলদের কাছ থেকে নামে মাত্র দেওয়ানী নিয়ে বস্তুত স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন করেছেন। তাদের কেউ কেউ এমনকি মুঘল আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখেও দাঁড়িয়েছেন; এবং গোটা দক্ষিণ ভারতের খুব কম অংশ কখনো মুঘলদের সরাসরি আওতাধীন ছিল।
বাবর যখন উত্তর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন বাংলায় তখন হুসাইন শাহী আমল চলছে। ১৫৩৮ খ্রীস্টাব্দে বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্ দীন মাহ্মুদ শাহ্ শের শাহ্ সূরী কর্তৃক আক্রান্ত হলে সম্রাট হুমায়ুনের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু হুমায়ুন গিয়াস উদ্ দীন মাহ্মুদ শাহ্কে সাহায্য করার অবস্থায় ছিলেন না। এই অবসরে শের শাহ্ সূরী বাংলায় কার্যত স্বাধীন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫৩৮ খ্রীস্টাব্দে সূরীদের বিরুদ্ধে হুমায়ুনের নিষ্ক্রিয়তার মাশুল গুনতে হয় তার এক বছর পরেই চৌসা’র যুদ্ধে শের শাহ্ সূরীর কাছে হেরে। তার পরের ছয় বছরের মধ্যে হুমায়ুন কার্যত ভারত থেকে বিতাড়িত হন। বাংলাকে ভিত্তি করে তার শাসকদের উত্তর ভারতীয় শাসকদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এটাই একমাত্র ঘটনা নয়। এমনটা এর আগেও ঘটেছে, পরেও ঘটেছে। ১৫৫৫ খ্রীস্টাব্দে মুঘলদের কাছে সূরীদের পতনের আগেই বাংলায় সূরীদের গভর্নর মুহাম্মাদ খান সূর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং মুহাম্মাদ শাহী রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাজবংশ ১৫৬৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন। এই সময়কালের মধ্যে তারা কখনো মুঘলদের কাছ থেকে উত্তর ভারত জয়ের চেষ্টা করছেন (যেমন, গিয়াস উদ্ দীন বাহাদুর শাহ্ কর্তৃক উত্তর প্রদেশ আক্রমণ) অথবা মুঘলদের মৌখিক বশ্যতা স্বীকার করে নিজের সাম্রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করেছেন।
১৫৬৪ খ্রীষ্টাব্দে তাজ খান কররাণী কর্তৃক তৃতীয় গিয়াস উদ্ দীন শাহের নিহত হবার সাথে সাথে বাংলায় কররাণী রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সমগ্র বাংলা বহিরাগত আফগানদের শাসনের আওতায় আসে। কররাণীরা মাত্র বারো বছর (১৫৬৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত) বাংলা শাসন করলেও এই সময়টুকু কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তাজ খান কররাণী তার জীবনের শুরুতে আরেক আফগান শের শাহ্ সূরীর অধীনস্থ কর্মচারী ছিলেন। তিনি তার প্রভুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সূরীদেরই শাসক মুহাম্মদ আদিল শাহ্ সূরীকে আক্রমণ করে উত্তর প্রদেশের কিয়দংশ দখল করেন। পরবর্তীতে মুহাম্মদ আদিল শাহ্ আর সম্রাট হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্যের সম্মিলিত আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে পূর্ব দিকে সরে যান। পরে বাংলার দুর্বল শাসক তৃতীয় গিয়াস উদ্ দীন শাহকে কৌশলে হত্যা করে বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কররাণীদের গোটা সময়টাই বিশ্বাসঘাতকতা, গুপ্তহত্যা, ষড়যন্ত্র ও সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতিতে পূর্ণ।
তাজ খান কররাণীর আগমন বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কুর্রম এজেন্সী থেকে। বাংলা আক্রমণের সময় তার সাথে তার তিন ভাই ইমাদ, সুলাইমান ও ইলিয়াস সাথে ছিলেন। সাম্রাজ্য স্থাপনের পর তিনি সেটি ভোগ করার জন্য দুই বছরেরও কম সময় পান। ১৫৬৬ খ্রীস্টাব্দে তাজ খান কররাণী মারা যাবার পর তার ছোট ভাই সুলাইমান খান কররাণী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। সুলাইমান কররানীদের মধ্যে সবচে’ দীর্ঘ সময় (প্রায় সাত বছর) শাসন করেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সুলাইমান কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন; এর মধ্যে সাম্রাজ্যের রাজধানী গৌড় থেকে পদ্মার তীরের তান্দায় স্থানান্তর করণ ও শরীয়া আইন প্রচলন অন্যতম। তান্দা প্রায় দশ বছর বাংলার রাজধানী থাকলেও এর নাম আজ প্রায় কেউ জানে না। শহরটি পরিত্যক্ত হবার পর এক সময় পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কররাণীরা বাংলার ক্ষমতায় বসার পর দলছুট আফগানেরা তাদের কাছে জড়ো হতে থাকে। গৌড়ের আবহাওয়া আফগানদের ও তাদের ঘোড়াদের জন্য সহনীয় ছিল না। তাছাড়া কৌশলগত কারণে বাংলার রাজধানী মুঘলদের কাছ থেকে একটু নিরাপদ দূরত্বে রাখা দরকার ছিল। গৌড় থেকে রাজধানী স্থানান্তরের প্রধান কারণ ছিল এইগুলো। আকবরের শাসনামলে হিন্দু সামন্ত-আমলা-সেনাপতিদের ক্ষমতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া এবং আকবরের জীবনাচরণ ও রাজ্যাচরণে ইসলাম থেকে বিচ্যুতি শরীয়াপন্থী মুসলিমদের হতাশ করে। সুলাইমান এই সুযোগটি গ্রহন করে রাজ্যে শরীয়া আইন চালু করেন। তার আশা ছিল এতে তিনি মুঘলদের মুসলিম সামন্ত-আমলা-সেনাপতিদের সমর্থন পাবেন এবং মুঘলদের দুর্বল করে ফেলতে পারবেন। বাংলায় শরীয়াহ্ আইন যখন চালু হয় ইমাম রাব্বানী শেখ আহ্মাদ আল ফারুকী আল সেরহিন্দী (মুজাদ্দিদ আলফে সানী নামে পরিচিত, এবং মুজাদ্দেদিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা) তখন মাত্র পাঁচ বছরের শিশু, এবং আকবরের বিরুদ্ধে তাঁর ধর্মীয় আন্দোলন শুরু হতে আরো বহু বছর বাকি।
সুলাইমান সরাসরিভাবে আকবরের বিরুদ্ধে যাবার ঝুঁকি নেননি। তাই প্রতিবেশী অঞ্চল উত্তর প্রদেশের মুঘল গভর্নর উযবেক বংশোদ্ভূত খান-ই-খানান মুনীম খান ও জৌনপুরের গভর্নর খান-ই-যামান আলী কুলী খানের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে আলী কুলী খান মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে মুঘলরা তাকে পরাস্ত করেন। এই ঘটনায় সুলাইমান আরো সতর্ক হন এবং মুনীম খানের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি করেন। তিনি আকবরের নামে মুদ্রা এবং খুৎবাহ্ও বহাল রাখেন। সুলাইমান তার রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমাংশ আপাতত নিরাপদ করতে পারলেও রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ নিরাপদ ছিলনা।
বাংলায় যখন কররাণীরা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে উড়িষ্যাতে তার আগেই ভোই রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কররাণীদের মতো ভোইদের আমলও হত্যা-ষড়যন্ত্র আর ধর্ম-কর্মে পূর্ণ। ভোইদের আমলে শেষাংশে দুর্বল রাজা রঘুরাম জেনাকে তার মন্ত্রী হরিচন্দ্র মুকুন্দ দেব গজপতি পরাস্ত করে সিংহাসন অধিকার করেন। মুকুন্দ দেব ক্ষমতায় এসেই তার ভোই বংশোদ্ভূত মন্ত্রী জনার্দন বিদ্যাধরের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। জনার্দনকে পরাস্ত করতে পারলেও মুকুন্দ দেব রাজ্যের পূর্ব দিকে বাংলার পক্ষ থেকে হামলার ব্যাপারে নিরাপদ ছিলেন না। সে জন্য তিনি আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেন। কিন্তু তার এই কৌশল কাজে আসেনি। সুলাইমান বার বার তার রাজধানী কটক আক্রমণ করেন। প্রথম দফাতে মুকুন্দ দেব যুদ্ধে জয় লাভ করে সাতগাঁও পর্যন্ত এগিয়ে আসেন। তিনি সুলাইমানের প্রতিদ্বন্দ্বী ইব্রাহিম সূরকে আশ্রয় দেন ও মুঘলদেরকে বাংলা আক্রমণের ব্যাপারে সহায়তা করার প্রস্তাব দেন। মুঘলরা তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেনি। ফলে দ্বিতীয় দফা যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন। যুদ্ধে মুকুন্দ দেব এবং তার উত্তরসূরী রামচন্দ্র ভাজিয়া উভয়ে নিহত হন। এই যুদ্ধ জয়ের অন্যতম নায়ক সুলাইমানের সেনাপতি কালা পাহাড়।
ঐতিহাসিক গুলাম হুসাইন সালিম যায়িদপুরী কর্তৃক লিখিত ইতিহাস গ্রন্থ ‘রিয়াজ-উস্-সালাতীন’-এ কালা পাহাড়কে আকবরের একজন সেনাপতি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সেটা সঠিক নয়। সুলাইমানের সেনাপতি কালা পাহাড় আমৃত্যু মুঘলদের বিরুদ্ধে ছিলেন। কেউ কেউ লোদী সম্রাট সুলতান বাহ্লুল লোদীর ভাগ্নে মিয়াঁ মুহাম্মাদ ফারমুলীকে তার হিন্দু মন্দির ধ্বংসের প্রবণতার জন্য কালা পাহাড় নামে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু এখানে আলোচ্য কালা পাহাড় মিয়াঁ মুহাম্মাদ ফারমুলীর প্রায় একশত বছর পরের মানুষ। কালা পাহাড়ের প্রকৃত নাম রাজীব লোচন রায় বা কালাচাঁদ রায় - তিনি উত্তরবঙ্গীয় ব্রাহ্মণ। ব্যক্তিগত যোগ্যতায় তিনি সুলাইমানের শাসনামলে গৌড়ের ফৌজদারের পদ লাভ করেন। এভাবে তিনি সুলাইমানের কাছাকাছি আসার সুযোগ পান এবং তার কন্যার প্রেমে পড়েন। রাজীব লোচন রায় সুলাইমানের কন্যার পাণিপ্রার্থী হলে সুলাইমান তাকে ধর্মান্তরিত হবার শর্ত দেন। কারো কারো মতে রাজীব লোচন রায়ের যুদ্ধ দক্ষতা দেখে সুলাইমান নিজেই তার নিকট নিজের কন্যার বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। উচ্চাভিলাষী রাজীব লোচন রায় সুলাইমানের প্রস্তাব গ্রহন করেন এবং ধর্মান্তরিত হয়ে সুলাইমানের কন্যাকে বিবাহ করেন। এর ফলে রাজীব লোচন রায় নিজ সমাজে জাতিচ্যূত হন। কিছুদিন পর তিনি বাংলার ধর্মগুরুদের কাছে প্রায়শ্চিত্তের বিধান চাইলে তারা কোন বিধান দিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে তিনি পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে গিয়ে প্রায়শ্চিত্তের সংকল্প করেন। কিন্তু পুরীর ধর্মগুরুরা তাকে ও তার স্ত্রীকে মন্দিরে প্রবেশ করতে বাধা দেন এবং তার কোন প্রায়শ্চিত্ত হবে না বলে জানিয়ে দেন। এতে রাজীব লোচন রায় মর্মাহত হন এবং প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সুলাইমান এই রকম সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। মুকুন্দ দেবের সাথে যুদ্ধে রাজীব লোচন রায়কে একজন সেনাপতি বানানো হয়। এতে তিনি উড়িষ্যার ধর্মগুরু ও ধর্মস্থানের উপর প্রতিশোধ নেবার সুযোগ পান।
১৫৬৭ খ্রীষ্টাব্দে মুকুন্দ দেবের বিরুদ্ধে সুলাইমান কররাণীর পুত্র বায়েযিদ খান কররাণী ও সেনাপতি সিকান্দার উযবেকের যুদ্ধে মুকুন্দ দেবের পতন হলে কালা পাহাড় উড়িষ্যা ও তার নিকবর্তী অঞ্চলের হিন্দু মন্দিরগুলোতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান। ১৫৬৮ খ্রীষ্টাব্দে কালা পাহাড় পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান, প্রতিমা ভাঙচুর করেন এবং মন্দিরের সম্পদ লুণ্ঠন করেন। জানা যায়, কালা পাহাড় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার কাঠের প্রতিমা উপড়ে নিয়ে হুগলীর তীরে আগুনে পুড়িয়ে দেন। কালা পাহাড় বালাসোরের গোপিনাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরের কাছে কোনার্ক মন্দির, মেদিনীপুর, ময়ুরভঞ্জ, কটক ও পুরীর আরো কিছু মন্দিরে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান। কালা পাহাড়ের মন্দির আক্রমণের প্রক্রিয়াটি একটু অভিনব ছিল। তিনি গরুর চামড়ার বিশাল আকৃতির ঢোল আর পিতলের বড় বড় ঘন্টা মন্দিরের ভেতরে ক্রমাগত বাজিয়ে তীব্র অনুরণন তৈরি করার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই অনুরণনের তীব্রতায় প্রতিমাদের হাতগুলো খসে পড়ত। এতে উপস্থিত লোকজন হতভম্ব হয়ে পড়লে প্রতিমা উপড়ে ফেলা হত। কালা পাহাড় মন্দির সমূলে ধ্বংস করার চেয়ে প্রতিমা ধ্বংস ও লুটপাটে বেশি আগ্রহী ছিলেন।
মন্দির আক্রমণের শেষ পর্যায়ে কালা পাহাড় সম্বলপুরের মা সমলেশ্বরীর মন্দিরে আক্রমণ করতে সম্বলপুরের উপকণ্ঠে মহানদীর তীরে দুর্গাপালীতে উপস্থিত হন। সমলেশ্বরী মন্দিরের পূজারীরা মন্দির রক্ষার্থে এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ নেন। একজন নারীকে গোয়ালিনীর ছদ্মবেশে কালা পাহাড়ের ছাউনিতে পাঠানো হয়। তিনি সৈন্যদের মধ্যে বিষ মিশ্রিত দুধ, দই, ছানা, পনির ইত্যাদি বিক্রয় করেন। পরদিন সকালে খাদ্যের বিষক্রিয়ায় কালা পাহাড়ের বেশির ভাগ সৈন্য আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তিনি অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে পলায়ন করেন। কালা পাহাড়ের মন্দির ধ্বংসের ঘটনা ঊড়িষ্যা ও মেদেনীপুরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৫৬৮ খ্রীষ্টাব্দে কররাণীরা কোচ বিহার আক্রমণ করলে সেখানে তিনি কামাখ্যা মন্দিরসহ আরো কিছু মন্দির ধ্বংস করেন। কালা পাহাড় কররাণীদের শেষ শাসক দাউদ খান কররাণীর আমল পর্যন্ত কররাণীদের সেনাপতি ছিলেন এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে অভিযানগুলোতে অংশগ্রহন করেন। ১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দে কররাণীদের পতনের পর কালা পাহাড় সম্ভবত আফগান নেতা মাসুম কাবুলীর দলে যোগ দেন এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন। সম্ভবত ১৫৮৩ খ্রীষ্টাব্দে মুঘল সেনাপতি খান ই আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মাসুম কাবুলী পরাস্ত হলে সেই যুদ্ধে কালা পাহাড়ও নিহত হন।
সুলাইমানের আমলে কররাণীদের রাজ্য পূর্বে কোচ বিহার থেকে পশ্চিমে উড়িষ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ১৫৭২ খ্রীষ্টাব্দে সুলাইমানের মৃত্যু হলে কররাণীদের মধ্যে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু হয়। সিংহাসনের দাবীদার ছিলেন সুলাইমানের জ্যেষ্ঠপুত্র বায়েযিদ খান কররাণী এবং তার ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা হানসু। প্রথমাবস্থায় বায়েযিদ সিংহাসনে বসলেও অচিরেই কিছু অমাত্যের সহযোগিতায় হানসু বায়েযিদকে হত্যা করে। কিন্তু হানসুর কপালে বাংলার সিংহাসন ছিল না। মন্ত্রী সভার বেশিরভাগ এবং স্থানীয় সামন্ত প্রভুরা হানসুকে উৎখাত করে সুলাইমানের কনিষ্ঠ পুত্র দাউদ খান কররাণীকে ক্ষমতায় বসায়। ক্ষমতায় বসে দাউদ দেখতে পায় তার অধীনে সাড়ে এগারো লক্ষ পদাতিক সৈন্য, চল্লিশ হাজার ঘোড়সওয়ার, সাড়ে তিন হাজার গজারোহী ও বিশ হাজার কামান আছে। বলাই বাহুল্য দাউদ খানের আমলের প্রায় সাড়ে চারশ’ বছর পর আজকের বাংলাদেশের সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর আকার এর অর্ধেকও নয়। এই বিপুল সৈন্যবাহিনীকে নিজ অধিকারে রাখা এবং তাদের খরচ যোগানোর জন্য দাউদের পক্ষে একের পর এক যুদ্ধে জড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না। তাছাড়া সৈন্যদের অধিকাংশ আফগান হওয়ায় তারা ভারত থেকে মুঘলদের হঠিয়ে আবার আফগান সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখতো। দাউদের পূর্ববর্তী শাসক তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বায়েযিদও সৈন্যদের মতো একই স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিজেকে স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করে নিজ নামে খুৎবাহ্ ও মুদ্রা চালু করেন। দাউদও ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বাধীন সুলতান হিসেবে নিজ নামে খুৎবাহ্ ও মুদ্রা চালু করেন। ১৫৭৩ খ্রীষ্টাব্দে বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈসা খাঁর সহায়তায় দাউদ ত্রিপুরা রাজ উদয় মাণিক্যের কাছ থেকে চট্টগ্রাম অধিকার করেন।
বিশাল সেনাবাহিনীর অধিকারী দাউদ চেয়েছিলেন দ্বিতীয় শের শাহ্ হতে। ১৫৭৪ খ্রীষ্টাব্দে আকবর যখন গুজরাত অভিযানে ব্যস্ত তখন তিনি উত্তর প্রদেশের গাযীপুর জেলার জামানিয়া আক্রমন করে শহরটি ধূলিস্মাৎ করেন। খবর পেয়ে আকবর উত্তর প্রদেশের গভর্ণর মুনীম খানকে ব্যাপারটি সামলানোর পরামর্শ দেন। দাউদের প্রধানমন্ত্রী লোদী খান ছিলেন মুনীম খানের বন্ধু। মুনীম খান পাটনাতে লোদী খানের সাথে বৈঠক করে একটি শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। এতে যুদ্ধ বন্ধ হলেও আকবর বা দাউদ কেউই এতে সন্তুষ্ট হন না। ক্ষুদ্ধ দাউদ প্রধানমন্ত্রী লোদী খানকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আকবর মুনীম খানকে আদেশ দেন দাউদকে শায়েস্তা করার জন্য। মুনীম খানের আক্রমণে দাউদ সদলবলে পাটনা পালিয়ে গিয়ে প্রতি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। দাউদের ধারণা ছিল হিন্দু সেনাপতিপ্রধান মুঘলরা আশ্বিন (অক্টোবর) মাসের দশেরা উৎসবের আগে আবার আক্রমণে যাবে না। কিন্তু আকবরের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। আকবর জানতেন আফগান যোদ্ধারা বর্ষাকালে চলাচল ও যুদ্ধ করতে অক্ষম। তাছাড়া আফগানদের নৌশক্তি ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। বর্ষাকালে ভরা নদী ও প্লাবিত এলাকাতে মুঘল নৌবাহিনী যে সুবিধাটা পাবে আফগানরা সেই সুবিধা পাবে না। তাই শ্রাবণ মাসেই তিনি পালটা আক্রমণের নির্দেশ দেন। এবার দাউদ সেনাপতি কতলু লোহানী, গুজর খান কররাণী ও শ্রীহরির নেতৃত্বে আক্রমণ শানান। মুনীম খানও প্রখ্যাত সেনাপতি রাজা মানসিংহ ও আকবরের অর্থমন্ত্রী টোডর মলকে নিয়ে হাজিপুর আক্রমণ করেন। প্রচণ্ড যুদ্ধে আফগানরা যখন জয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন তারা টের পায় যে খোদ আকবর তার নৌবাহিনীর সহায়তায় হাজিপুরের উপকণ্ঠে তাদের সরবরাহ ব্যবস্থা (supply line) অধিকার করে ফেলেছে। আফগানদের পক্ষে নৌপথে পালটা আক্রমণ করার উপায় তাদের ছিল না। তাই রসদের অভাবে বিপর্যস্ত আফগানরা ১৫৭৪ খ্রীষ্টাব্দের ৩রা অগাস্ট রণে ভঙ্গ দিয়ে বাংলায় পালিয়ে যায়। আকবর মুনীম খানকে বাংলা ও বিহারের গভর্ণর নিয়োগ করে এবং টোডর মলকে তার সহযোগী করে ফতেহ্পুর সিক্রিতে ফিরে যান এবং পরবর্তী আক্রমণ শীতকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেন।
১৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারীর শেষ ভাগে মুঘল বাহিনী মুনীম খান, দাউদ খান ও রাজা টোডর মলের নেতৃত্বে বালাসোর জেলার তুকারইতে দাউদ খান কররাণীর আফগান বাহিনীর মুখোমুখি হন। মুঘলদের প্রচণ্ড আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে আফগানরা ১৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ৩রা মার্চ উড়িষ্যার কটকে পালিয়ে যায়। এতে কার্যত বাংলা ও বিহার মুঘলদের অধীনে চলে আসে, কররাণীদের রাজ্য উড়িষ্যাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ১২ই এপ্রিল ১৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দে কররাণীরা মুনীম খানের সাথে কটকে অনাক্রমণ চুক্তি করতে বাধ্য হয়। মুনীম খান রাংলার রাজধানী তান্দা থেকে আবার গৌড়ে স্থানান্তর করেন। ১৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবরে পূর্ব ভারতে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। মুনীম খান এতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে কররাণীরা আবার বাংলা দখলের পরিকল্পনা করে। এবারে ঈসা খাঁ আর কালা পাহাড়ের নেতৃত্বে কররাণীরা মুঘলদের আক্রমণ করে বিহারের তেলিয়াগড়ি পর্যন্ত অধিকার করেন। দাউদ কটক থেকে এসে রাজধানী গৌড় পুনরাধিকার করেন, মুঘলরা পাটনায় সরে যায়। এই দফায় দাউদ উত্তর-পশ্চিম বাংলা ও উড়িষ্যা নিজের কব্জায় রাখতে পারলেও গোটা পূর্ব বাংলা কার্যত বারো ভূঁইয়াদের অধিকারে চলে আসে। ঈসা খান মুঘল নৌসেনাপতি শাহ্ বারদীর নেতৃত্বাধীন মুঘল যুদ্ধ জাহাজগুলোকে পর্যন্ত বাংলা থেকে হঠিয়ে দিতে সক্ষম হন।
আকবর পূর্ব ভারতে আফগান উত্থানকে স্থায়ীভাবে নির্মূল করতে এবং বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা-ত্রিপুরা-পশ্চিম অসম-মেঘালয়কে মুঘল শাসনের আওতায় আনতে মনস্থ করেন। তিনি খান-ই-জাহান হুসাইন কুলী বেগের অধীনে মুঘল সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠন করে তাকে কররাণীদের শায়েস্তা করার জন্য পাঠান। তেলিয়াগড়িতে দাউদ মাত্র তিন হাজার সৈন্য রেখেছিলেন; তাদের পরাজিত করে কুলী বেগের বাহিনীর রাজমহল পর্যন্ত অগ্রসর হতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। কিন্তু রাজমহলে দাউদ কালা পাহাড়, কতলু খাঁ, জুনায়েদের ন্যায় দুর্ধর্ষ সেনাপতিদের বাহিনী নিয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কুলী বেগ প্রায় চার মাস ধরে রাজমহলের পশ্চিমাংশ অবরোধ করে রাখেন। পাহাড়, পাহাড়ের সরু পাদদেশ তারপর নদী - যুদ্ধের জন্য এমন অসুবিধাজনক ক্ষেত্র রাজমহল অবরোধে কুলী বেগের জন্য সমস্যা হয়ে পড়ে। তাছাড়া মহর্রম মাস থেকে মুঘল শিবিরে শিয়া-সুন্নী বিরোধ, অপ্রতুল খাদ্য ও যুদ্ধ রসদ সরবরাহ এবং আসন্ন বর্ষাকাল মুঘল বাহিনীকে দুর্বল করে তোলে। কুলী বেগ আকবরের সাহায্য প্রার্থনা করলে আকবর বিহারের গভর্ণর মুজাফফর খান তুরবাতীকে কুলী বেগের সহায়তায় এগিয়ে আসার আদেশ দেন। মুজাফফর খান কুলী বেগের সহায়তায় পাঁচ হাজার ঘোড়সওয়ার এবং নৌকাভর্তি রসদ সরবরাহ করেন। ১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই জুলাই চাঙা হয়ে ওঠা মুঘল বাহিনী কররাণীদের আবার আক্রমন করে। দাউদ তার সৈন্যসজ্জার ডানে কালা পাহাড়ের বাহিনী, বামে জুনায়েদের বাহিনীকে রেখে এবং মাঝখানে কতলু খাঁ’র সাথে নিজেই যুদ্ধে নামেন। মুঘলদের কামান হামলায় জুনায়েদ মৃত্যুবরণ করলে আফগান সেনারা হতবল হয়ে পড়ে এবং এদিক-ওদিক পালিয়ে যেতে থাকে। কতলু খাঁ ও কালা পাহাড় পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও দাউদের ঘোড়া কাদায় আটকে যায় - ফলে দাউদ মুঘলদের হাতে ধরা পড়েন। যেহেতু দাউদ সবসময়ই মুঘলদের জন্য বড় হুমকির কারণ ছিলেন তাই কুলী বেগ ঝামেলা দূর করার জন্য অনতিবিলম্বে দাউদকে হত্যা করেন। দাউদের মৃত্যুতে কররাণী রাজবংশের পতন হলেও বাংলায় আফগানদের ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে যায় না। বারো ভূঁইয়াদের অধিকাংশই ছিলেন আফগান, ফলে বাংলা সরাসরি মুঘল শাসনের আওতায় আসলেও কার্যত তার অধিকাংশ বারো ভূঁইয়াদের দ্বারা শাসিত ছিল।
কররাণী আমলে বাংলা মুঘলদের অধিকারমুক্ত থাকলেও তা বহিঃশাসনমুক্ত ছিল এমনটা বলা যায় না। তখন মূল শাসক, প্রশাসকেরা, অধিকাংশ সৈন্য ও সেনাপতি ছিল আফগান। তাই কররাণী আমলে বাংলা স্বাধীন ছিল এমনটা বলা যায় না। তাদের সময়কালের বড় অংশ কেটেছে দেশের সব দিকে ছোট-বড় যুদ্ধ করে। ফলে তাদের শাসন ক্ষমতা হয়েছে দুর্বল আর স্থানীয় ভূস্বামীরা হয়েছে প্রবল ক্ষমতার অধিকারী। বারো ভূঁইয়ারা কার্যত দেশের মূল শাসক ছিলেন। শরীয়াহ্ আইন প্রচলনের দুষ্কৃতি ছাড়া প্রশাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, নগর, ভৌত অবকাঠামো, স্থাপত্য কোন বিষয়েই কররাণীদের কোন সুকৃতির কথা জানা যায় না। কররাণীরা যুদ্ধবাজ হলেও তাদের নৌশক্তি ছিলনা। অর্থাৎ, কররাণীরা বাংলাকে স্বদেশ মনে করে সেটার উপযুক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও গড়ে তোলেনি - যেখানে মুঘলরা নিয়মিত নৌবাহিনী গড়ে তুলেছিল। রাজনীতিতে অভিজ্ঞ আকবর যখন দেশীয় রাজ্যগুলোকে স্বপক্ষে টেনে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছেন তখন রাজনীতিতে দুর্বল কররাণীরা স্থানীয়দের সাথে বিরোধ বাড়িয়েছেন। বিরাট আকারের সেনাবাহিনী আর কিছু দিন পর পর যুদ্ধের আয়োজনের ব্যয় দেশের সাধারণ মানুষকে বইতে হয়েছে। প্রসাশনে অনভিজ্ঞ, যুদ্ধবাজ আফগান সেনানায়কদের দিয়ে দেশ চালানোর চেষ্টার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে। ফলে উত্তর ভারতের আধিপত্যমুক্ত থাকলেও কররাণী আমল বাংলার মানুষের জন্য ঔপনিবেশিক সামরিক শাসনের মত একটা সময় ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় দু’টি কথা যোগ করছি। এক, কোন কোন ফ্যানাটিক লেখক কালা পাহাড়কে ইসলামের মহান সেনাপতি এবং তার মন্দির ধ্বংস করাকে ইসলামসম্মত বলে বর্ণনা করা চেষ্টা করেন। মন্দির ধ্বংস করা ইসলামী বিধান হলে তাদের পছন্দ এমন অনেক মুসলিম শাসক (যেমন, আওরঙ্গজেব) কেন গণহারে মন্দির ধ্বংস করেননি সেই ব্যাখ্যা তারা দেন না। কালা পাহাড়ের কার্যক্রম ব্যক্তিগত ক্ষোভপ্রসূত ও সাম্প্রদায়িক কররাণীদের সমর্থিত। দুই, কোন কারণে কররাণীরা মুঘলদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে পারলে ভারতে মুঘল আমলের পরিবর্তে দীর্ঘ আফগান আমল স্থাপিত হতে পারতো কিনা। এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, একমাত্র শের শাহ্ সূরী ছাড়া কোন আফগান শাসকই রাজনীতি ও প্রশাসনে দক্ষ ছিলেন না। ফলে সম্ভাব্য আফগান আমলে স্থানীয়ভাবে শত শত আফগান ও স্থানীয় শাসকদের অধীনে ছোট ছোট রাজ্য উদ্ভব হবার সম্ভাবনা ছিল। তাছাড়া উত্তর ও পশ্চিম ভারতের শক্তিশালী হিন্দু (রাজপুত, গুজরাতী, মারাঠা, কাশ্মিরী) রাজাদের সাথে আফগানরা কৌশলে এঁটে ওঠার কথা না। ফলে ভারতে প্রাথমিক পর্যায়ে আসা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিদের (পর্তুগীজ, ফরাসী, ওলন্দাজ, দিনেমার) পক্ষে আরো আগেই আরো বৃহত্তর পরিসরে ভারত দখল করা সম্ভব হত।
মন্তব্য
ছোট বেলায় প্রাতঃ নমস্য আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়ার বই পড়তে যেমন রোমাঞ্চ লাগতে তাই যেন ফিরিয়ে নিয়ে এল আপনার অপূর্ব এই লেখা। কালাপাহাড়ের সম্পর্কে প্রায় সবকিছুই নতুন করে জানলাম।
শের শাহ্ কে নিয়ে এমন একটি তথ্যপূর্ণ লেখার আব্দার থাকল।
facebook
আমি ঐতিহাসিক নই, ইতিহাসবেত্তা হবার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমি ইতিহাসের নগন্য পাঠক মাত্র। বাল্যকালে বাবার মুখে ভারতবর্ষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুনতে শুনতে ইতিহাস পাঠ ভালোবেসেছি। এখানে আমার ইতিহাস পাঠলব্ধ কিছু কথা (পুনর্ঝালাইসহ) আপনাদের বলি কেবল।
শের শাহ্ সূরীর জীবনের বাংলা পর্ব নিয়ে পরে কখনো লেখার আশা রাখি। তাঁর সমগ্র জীবন নিয়ে লেখার উপায় আমার নেই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
চমৎকার । ।
। খুব মজা পাইছি।
ডাকঘর | ছবিঘর
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
চমৎকার পাণ্ডব্দা। সমাজ বইয়ে ইতিহাস সাল তারিখ সহ মুখস্ত করতে হত বলে, ইতিহাস ছিল আমার সবচেয়ে অপ্রিয়। আপনার এই সিরিজটা বেশ মন দিয়ে পড়ি আমি। মুখস্ত করতে হয়না এখন আর, এখন কিন্তু বেশ লাগে।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ধন্যবাদ। আসলে সন-তারিখ মুখস্থ করার দরকার হয় না। ভালোবেসে কোন বিষয় পড়লে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো এমনিতেই মনে থাকে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
উঃ, ওয়াঙ্গাফু! পাণ্ডবদা,
খটকা - কোনটা ঠিক? আমার জানা মতে বায়েজিদ সুলাইমানেরই ছেলে, তাজ খানের নয়।
এই জিনিসটা যখন আপনি সময়ের হিসাবে লিনিয়ারলি লিখেছেন, তখন ফেসবুকের মত টাইমলাইন স্টাইলে লম্বালম্বি হলে দারুণ হত। লেখার ফাঁকে-ফাঁকে সাল-তারিখ আমার কেমন গুলিয়ে যায়...
সংযোগ ১: মানচিত্রর কথাটা আমার মনেও আসছিল - হাজিপুর কোন জায়গায়, তার কি এমন স্ট্র্যাটেজিক লোকেশন, যে মুঘলরা নৌপথ বন্ধ করে দিয়েছিল, এগুলো চোখে দেখতে পারলে অনেক গুণ সুবিধা হত।
সংযোগ ২: স্নেহভরে যখন লেখাটা আমাকে দিলেনই, তখন আপনার কথা কি আর ঠেলতে পারি? খুবই সঙ্কোচের সঙ্গে কররানীদের উপর আমার অপরিণত গল্পখানা লিঙ্কিয়ে দিলাম।
বায়েযিদ সুলাইমানের পুত্রই বটে। তাজ খান কররাণী তার পিতৃব্য। এটা টাইপো, পরে ঠিক করে দিচ্ছি।
বাম দিকে সন-তারিখ আর ট্যাব মেরে ঘটনা লিখতে গেলে শুধু ঘটনাই লেখা যায়। তাতে ব্যাখ্যা যোগ করলে বেমানান লাগে। আর আমি তো এখানে নিরেট ইতিহাস লিখতে নেইনি। ইতিহাসের এক-আধটা ঘটনা বা ব্যক্তিকে নিয়ে মূল ইতিহাসের সাথে ব্যাখ্যা-মতামত যোগ করে লিখছি। তাই এই স্টাইলটাই আমার জুতসই লাগে।
ঠিকঠাক মানচিত্র পাওয়াটা একটু মুশকিল। কপিরাইটের ব্যাপার তো আছেই। তাছাড়া ম্যাপ এমবেড করার হ্যাপাটা এখনো কায়দা করে উঠতে পারিনি। গঙ্গার দক্ষিণ পাড়ে যেখানে পাটনা, তার ঠিক উত্তর দিকেই হাজিপুর। একটু কষ্ট করে গুগল ম্যাপে দেখে নিন।
আপনার গল্পটা পড়লাম। গল্পটার কী কী ঝালাই করতে হবে সেটা আপনার ভালোই জানার কথা। ঐটুকু কষ্ট করে গল্পটা সচলে পোস্টিয়ে দিন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কানেকানে বলেই ফেলুন না, কী ঝালাই লাগবে...
তিষ্ঠ ক্ষণকাল, বছর শেষের হিসাব-নিকাশ মিলাতে কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে এখন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এই লেখায় এখন শুধু দরকার একটা মানচিত্র।
মানচিত্রের ব্যাপারে উপরে কৌস্তুভকে ব্যাখ্যা করেছি। সম্ভব হলে একটু হেল্পান।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অনেক কিছু জানলাম। খুব ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কালাপাহাড় নিয়ে ভুল ধারণাটা ভেঙ্গে গেলো।
... এই সিরিজটা অনেক ভালো লাগে।
ধন্যবাদ। তোমার কাজটার খবর কী? আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ধন্যবাদ,ইতিহাসের অনেক নাজানা ঘটনা জানা হল। ইতিহাস বিষয়ক ঘটনায় আমার যথেষ্ঠ আগ্রহ।
রাজা টোটরমল শুরুতে শের শাহ্ এর অর্থমন্ত্রী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সম্রাট আকবরের অর্থমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্তি পান। সম্রাট আকবর যোগ্য ব্যক্তির সমাদর করতে জানতেন।
ধন্যবাদ। আকবর ইতিহাসের সেরা রাজনীতিবিদদের একজন। নিজের ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য যা করার দরকার তিনি তাই করেছেন - নিয়ম, নীতি, আচার, বিবেক, ধর্ম, জনমত কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
১০০% সহমত। আকবর ভারতের সর্বকালের সেরা রাজনীতিক।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
তোডরমল কিন্তু বাংলার কুখ্যাত জমিদারী প্রথার প্রবর্তক, বা বলা ভাল উনি জমিদারী প্রথাকে মুঘল-সাম্রাজ্যের সাথে সহাবস্থানের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এর হাত ধরেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী পরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
ইংরেজরাও কিন্তু প্রথমে মুঘলদের কাছ থেকে দেওয়ানী নিয়েই শুরু করেছিল। টোডর মলের চেয়েও কঠিন জিনিস ছিল মুর্শিদ কুলী খান। এই ফার্সী ভদ্রলোক জমি, ফসল ইত্যাদির উপর যেমন নয়া কর ব্যবস্থা চালু করেছিলেন যে তাতে ভারতবর্ষের কৃষিজীবীদের মুখে রক্ত তুলে খাটতে হতো। এবং খাটুনীর অধিকাংশ আয় রাজকোষে চলে যেত। ঐ আমলেই কোটি কোটি টাকার মুঘল স্থাপত্য আর শিল্পকলা তো আর এমনি এমনি হয়নি!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
চমৎকার হয়েছে! কিন্তু ইতিহাস পড়তে গিয়ে আমার সবসময় যা হয় আজো তাই হল, অর্ধেক পড়ার পর মনে হল প্রথমটুকু ভুলে গেছি, সো, আবার প্রথম থেকে শুরু...এইভাবে কয়েকবার পড়া হয়ে গেছে।
যাইহোক, আপনি যদি ইতিহাসের আরেকটু (৫০০-৭০০বছর) পেছনে গিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের আগ্রাসন সম্পর্কে একটা পোস্ট দিতেন তাহলে আমরা হয়ত অনেক গুরুত্বপূর্ন তথ্য জানতে পারতাম। আশা করি ভবিষ্যতে এই বিষয়ে লেখা আসছে।
ধন্যবাদ। মুহম্মদ বিন কাশিম, সুলতান মাহমুদদের নিয়ে লেখার পরিকল্পনা আপাতত নেই। তবে আপনার অনুরোধ আমার মনে থাকবে, পরে চেষ্টা করবো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বাংলার ইতিহাসে এদের খুব একটা প্রভাব আছে বলে আমার মনে হয় না।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
ঠিক। এ'জন্য এদের ব্যাপারে আমার আগ্রহ কম।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
খাইছে। এতো দেখি কালাপাহাড়দের আস্তানায় আরেক ধলাপাহাড়ের আক্রমণ...
০২
রূপকথায় পড়তাম পুত্রহীন রাজার উত্তরাধিকারী খুঁজে না পেলে হাতি ছেড়ে দেয়া হতো। হাতি যারে ধরে আনতো তাকেই মানুষজন নতুন নেতা বলে মেনে নিতো
মুসলমানদেরতো মনে হয় এখন এরকম অবস্থা। বর্তমানে কোনো মুসলমান নেতা খুঁজে না পেয়ে ইতিহাসে পাগলা হাতি ছেড়ে দেয়া হয়েছে নেতার সন্ধানে। আর হাতিগুলাও কালাধলা বান্দর ধরে এনে বলছে- এই নে তোর নেতা। আর তখনই কেউ কেউ লাফিয়ে উঠছে- পেয়ে গেছি পেয়ে গেছি নেতা। এবার সবাই চলো তারে অনুসরণ করি
(সাদ্দাম গাদ্দাফি দিয়ে তো কিছু হলো না আর জোব্বাপরা সৌদিগুলারে তো মুসলমানরাই মোল্লার বেশি কিছু ভাবতে পারে না)
কেউ কাউকে আক্রমণ করে নাই - ঐতিহাসিক সত্যটা শুধু জানার চেষ্টা করছি।
নেতা তো আরোহী পদ্ধতিতে তৈরি হবার কথা। উপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে স্বৈরশাসক পাওয়া যেতে পারে, নেতা না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কালাপাহাড়কে নিয়ে মোহিতলাল মজুমদারের এক বিখ্যাত স্তুতিকাব্য আছে। আমার অবশ্য তাকে এক সাইকো ছাড়া কিছু মনে হয় না, সম্ভবত দক্ষ রণকৌশলী তবে চরম্ভাবে বিকারগ্রস্ত।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
মোহিতলাল মজুমদারের কবিতাটি বহু আগে পড়েছিলাম, তার কিছুই মনে নেই। এই লেখাটা লেখার সময় কবিতাটি খুঁজেছিলাম, পাইনি। মোহিতলাল মজুমদারের কবিতাটি কালা পাহাড়ের স্তুতি হলে উনি কেন যে কালা পাহাড়ের স্তুতি করলেন সেটা একটা রহস্য হবে।
ক্রোধান্ধ মানুষ কিছুটা বিকারগ্রস্থ তো বটেই। মন্দির ধ্বংসের আগে পর্যন্ত কালা পাহাড়ের সাথে যা কিছু হয়েছে তাতে তার প্রতি কিছুটা সমবেদনা জাগে। কিন্তু প্রতিক্রিয়ায় তিনি যা করেছেন সেটা কোন বিচারেই গ্রহনযোগ্য নয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কালাপাহাড়
মোহিতলাল মজুমদারের
শুনিছ না---ওই দিকে দিকে কাঁদে রক্ত পিশাচ প্রেতের দল!
শবভুক্ যত নিশাচর করে জগৎ জুড়িয়া কী কোলাহল !
দূর-মশালের তপ্ত-নিশাসে ঘামিয়া উঠিছে গগন-শিলা !
ধরণীর বুক থরথরি কাঁপে --- একি তাণ্ডব নৃত্য লীলা !
এতদিন পরে উদিল কি আজ সুরাসুর জয়ী যুগাবতার ?
মানুষের পাপ করিতে মোচন, দেবতারে হানি' ভীম প্রহার,
---কালাপাহাড় ! ...
কতকাল পরে আজ নরদেহে শোনিতে ধ্বনিছে আগুন গান !
এতদিন শুধু লাল হ'ল বেদী --- আজ তার শিখা ধূমায়মান !
আদি হ'তে যত বেদনা জমেছে --- বঞ্চনাহত ব্যর্থশ্বাস---
ওই ওঠে তারি প্রলয়-ঝটিকা, ঘোর গর্জন মহোচ্ছাস !
ভয় পায় ভয় ! ভগবান ভাগে ! ---প্রেতপুরী বুঝি হয় সাবাড় !
ওই আসে---তার বাজে দুন্দুভি, তামার দামামা, কাড়া-নাকাড় !
---কালাপাহাড় !
কোটি-আঁখি-ঝরা অশ্রু-নিঝর ঝরিল চরণ-পাষাণ-মূলে,
ক্ষয় হ'ল শুধু শিলা-চত্তর --- অন্ধের আঁখি গেল না খুলে !
জীবের চেতনা জড়ে বিলাইয়া আঁধারিল কত শুক্ল নিশা !
রক্ত-লোলুপ লোল-রসনায় দানিল নিজেরি অমৃত-তৃষা !
আজ তারি শেষ ! মোহ অবসান ! ---দেবতা-দমন যুগাবতার !
আসে ওই ! তার বাজে দুন্দুভি---বাজায় দামামা, কাড়া-নাকাড় !
---কালাপাহাড় !
বাজে দুন্দুভি, তামার দামামা---বাজে কী ভীষণ কাড়া নাকাড় !
অগ্নি-পতাকা উড়িছে ঈশানে, দুলিছে তাহাতে উল্কা-হার !
অসির ফলকে অশনি ঝলকে---গলে যায় যত ত্রিশূল চুড়া !
ভৈরব রবে মুর্ছিত ধরা, আকাশের ছাদ হয় বা গুঁড়া !
পূজারী অথির, দেবতা বধির---ঘন্টার রোলে জাগে না আর !
অরাতির দাপে আরতি ফুরায়---নাম শুনে হয় বুক অসাড় !
---কালাপাহাড় !
নিজ হাতে পরি' শিকলি দু'পায় দুর্বল করে যাহারে নতি,
হাত জোড় করি' যাচনা যাহারে, আজ হের তার কি দুর্গতি !
কোথায় পিনাক ? ---ডমরু কোথায় ? কোথায় চক্র সুদর্শন ?
মানুষের কাছে বরাভয় মাগে মন্দির-বাসী অমরগণ !
ছাড়ি' লোকালয় দেবতা পলায় সাত-সাগরের সীমানা-পার !
ভয়ংকরের ভুল ভেঙে যায় ! বাজায় দামামা, কাড়া-নাকাড়,
---কালাপাহাড় !
কল্প-কালের কল্পনা যত, শিশু-মানবের নরক-ভয়---
নিবারণ করি' উদিল আজিকে দৈত্য-দানব-পুরঞ্জয় !
দেহের দেউলে দেবতা নিবসে---তার অপমান দুর্বিষহ !
অন্তরে হ'ল বাহিরের দাস মানুষের পিতা প্রপিতামহ !
স্তম্ভিত হৃৎপিণ্ডের 'পরে তুলেছে অচল পাষাণ-ভার---
সহিবে কি সেই নিদারুণ গ্লানি মানবসিংহ যুগাবতার
---কালাপাহাড় ?
ভেঙে ফেল' মঠ মন্দির-চূড়া, দারু-শিলা কর নিমজ্জন !
বলি-উপচার ধূপদীপারতি রসাতলে দাও বিসর্জ্জন !
নাই বাহ্মণ, ম্লেচ্ছ-যবন, নাই ভগবান---ভক্ত নাই,
যুগে যুগে শুধু মানুষ আছে রে ! মানুষের বুকে রক্ত চাই !
ছাড়ি' লোকালয় দেবতা পলায় সাত-সাগরের সীমানা-পার !
ভয়ংকরের ভয় ভেঙে যায়, ---বাজায় দামামা, কাড়া-নাকাড়,
---কালাপাহাড় !
ব্রাহ্মণ যুবা যবনে মিলেছে, পবন মিলেছে বহ্নি সাথে !
এ কোন্ বিধাতা বজ্র ধরেছে নবসৃষ্টির প্রলয়-রাতে !
মরুর মর্ম বিদারি' বহিছে সুধার উত্স পিপাসাহরা !
কল্লোলে তার বন্যার রোল ! ---কূল ভেঙে বুঝি ভাসায় ধরা !
ওরে ভয় নাই ! ---মুকুটে তাহার নবারুণ-ছটা, ময়ূখ হার |
কাল নিশীথিনী লুকায় বসনে !---সবে দিল তাই নাম তাহার
কালাপাহাড় !
শুনিছ না ওই--- দিকে দিকে কাঁদে রক্তজপিশাচ প্রেতের পাল !
দূর-মশালের তপ্ত-নিশাসে ঘামিয়া উঠিছে গগন-ভাল !
কার পথে-পথে গিরি নুয়ে যায় ! কটাক্ষে রবি অস্তমান !
খড়্গ কাহার থির-বিদ্যুৎ ! ধূলি-ধ্বজা কার মেঘ-সমান !
ভয় পায় ভয় ! ভগবান ভাগে ! প্রেতপুরী বুঝি হয় সাবাড় !
ওই আসে ! ওই বাজে দুন্দুভি---বাজায় দামামা, কাড়া-নাকাড়
---কালাপাহাড় !
****************************************
ধন্যবাদ মনমাঝি। কিন্তু কবি'র এই স্তুতির মানে বুঝতে পারলাম না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সবসময়ের মতই অসাধারণ।
শুরী/কাররানীদের আলাদা করে কেন 'আফগান'কেন বলব? ১৫ শতকে পখতুন বা পাঠান ইত্যাদি জনগোষ্ঠি যত বড় ও সুসংগঠিত সেই তুলনায় 'আফগান'রা তো মাত্র কয়েকটি মাত্র গ্রাম। এমন কি হতে পারে যে পাকিস্তানের উদ্ভবের সাথে সাথে এবং পাকিস্তানের সাথে পাঠান-দের সাযুজ্যতার কারনে পশ্চিমা ভারত বিজয়ী হিসাবে আফগান নামটিই বেশী গ্রহনযোগ্যতা পায়?
আরব-তূর্কী-পারসিক ঐতিহাসিকেরা যে অর্থ-ফসলের সমৃদ্ধ বাংলার গুনগান করেন, সেটা কি ভাগীরথের পশ্চিম পাড়ে? তাহলে এই সময়ের ইতিহাসে মোঘল-আফগানদের কীর্তিকেচ্ছা বেশীরভাগে ভাগীরথির পূর্বদিকে। নাকি মূলত এই সমৃদ্ধ পূর্ববাংলার প্রবেশমুখেই এইসব যুদ্ধ সেগুলোর পশ্চিম-উত্তর সীমানাতেই রাখা হয়েছে?
একটা গল্প হচ্ছে এমন যে, ফেরাউন-তাড়িত বনি ইসরাইলের বারোটি দল নীল পার হবার পর বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। একটি দল মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণে এক বিরান ভূমিতে এসে পড়ে। এই দল তখন প্রকৃতির এমন বিরূপতা দেখে তারা এ'কোথায় চলে এলে এমন ভেবে বিলাপ শুরু করে। হিব্রু ভাষায় 'বিলাপ'কে নাকি 'ফগান' বলা হয়। তাই বনি ইসরাইলদের এই গ্রুপের নাম হলো আফগান। খোদ পাকিস্তান (P-A-K-I-STAN) নামটির ইলাবোরেশনের দ্বিতীয় বর্ণটিতে পাখতুনিস্তান/পাখতুনখোয়া'কে কিন্তু আফগান-ই বলা হয়েছে।
সমৃদ্ধ বাংলার গুণগান যিনি বাংলার যে অংশ দেখেছেন সে অংশ দেখি করেছেন। বাংলায় আফগানদের বিস্তার এখনকার বাংলাদেশের প্রায় পুরোটা জুড়েই হয়েছে। একই কথা মুঘলদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে বাংলার কোন অংশকেই একটানা তাদের তাবে রাখা যায়নি। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং উত্তরবঙ্গের যুদ্ধগুলোর গল্প বেশি শোনা যায় বটে, তবে দক্ষিণবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকার শাসক ও জনগণের দীর্ঘ প্রতিরোধ সংগ্রামের কথা মোটামুটি চাপাই পড়ে গেছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমিও ইতিহাস বইতে পড়েছি তুর্কী-আফগান আমলে সমৃদ্ধির কথা। তখন চোখে ঠুলি পড়ে পরীক্ষায় উত্তর দেবার জন্য ইতিহাস পড়তাম। এখন পড়লে দেখতাম - ১৫৪২ সালে আইজ্যাক নিউটন জন্ম নিয়ে মহাকর্ষ ও ক্যালকুলাস নিয়ে যখন গবেষণা করছেন তখন বাংলার ঐতিহাসিকেরা বছরের বছরে ঘরে ফসল ওঠাটাকেই সম্মৃদ্ধির লক্ষণ বলে ধরে নিচ্ছেন। বাস্তব হল, ১৪০০-১৮০০ সালে বাংলা তথা ভারত সারা পৃথিবীর তুলনায় এতটাই পিছিয়ে পড়ে যার মাশুল আমরা এখনও দিয়ে চলেছি।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
বাংলার ঘরে ঘরে গোলাভরা ধান, গলাভরা গান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ - এগুলো একেবারে ফালতু বাত। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন, গণতন্ত্রে উত্তরণ, ভৌত বিজ্ঞানে গবেষণার সুযোগ, চিন্তার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের সুযোগ - এগুলোর কোনটাতে ঊনবিংশ শতকের আগে প্রায় দুই হাজার বছরে বাংলায় কোন উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পড়লাম। মন্তব্যের গরীমা না করি।
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
মন্তব্য করাতে 'গরিমা'র কী আছে?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সন-তারিখ মনে রাখতে পারতাম্না, এই জন্য ইতিহাস রীতিমত পেইন লাগত দাদা। কিন্তু আপনার বর্ণনা গল্পের মত, আর এখন তো দিন খন মনে রাখার দরকার নাই, তাই পড়তে ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কত অজানা রে! কালাপাহাড়ের নাম শুনেছিলাম কেবল। আসল ঘটনা আজ জানলাম।
একটা প্রশ্ন: সম্রাট আকবরের দ্বীন-ই-ইলাহি জনপ্রিয়তা লাভে ব্যর্থ হওয়ার কারণ কী?
দীন-ই-ইলাহী নিয়ে লিখতে গেলে একখানা গোটা পোস্টও যথেষ্ট নয়। পরে কখনো সুযোগ হলে লিখব। তখন শুধু দীন-ই-ইলাহী'ই নয় "আকবর দ্য গ্রেট"-এর তথাকথিত গ্রেটনেস নিয়েই লিখব।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দ্বীন-ই-ইলাহীতে রাজাকে ঈশ্বরের স্থানে বসানো হয়েছে, সুতরাং আকবরের মহানুভবতার কিছু দেখি নি এর মধ্যে। দ্বীন-ই-ইলাহী জনসমক্ষে প্রচারের কোনো চেষ্টা আকবর করেন নি, করলে জনপ্রিয় হতে পারত। এখনও অবধি ইতিহাসে প্রচলিত সব ধর্মই রাজানুগ্রহের কারণেই শাখা-প্রশাখা বিস্তারে সক্ষম হয়েছে - ভাল উদাহরণ কনস্টান্টাইনের খ্রীষ্টধর্ম (রোম), অশোকের বৌদ্ধধর্ম (ভারত), অজাতশত্রুর (ভারত) হিন্দুধর্ম আর মহাপ্রজাপতির ইসলাম (ইন্দোনেশিয়া)।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
দাউদের এগার লক্ষ সেনা - এই তথ্যের সূত্র কি? ওই সময়ে অনেক রাজকীর্তিই অতিরঞ্জনমাত্র, তাই সংখ্যাগুলো আমার মনে হয় একটু ভেবে নেওয়া উচিত। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা-আসামের জনসংখ্যা ১৮০০ সাল নাগাদ ছিল তিন কোটি (উইলিয়াম জোন্স অনুমাণ), এবং ১৫৭৪ সাল নাগাদ হওয়া উচিত দেড় কোটি। সেই ক্ষেত্রে জনসংখ্যার প্রায় আট শতাংশ সরাসরি সামরিক-বাহিনীতে - এরকম ভাবা শক্ত। পুরো বাংলা তাদের অধীনে ছিল না - এটা ভাবলে আরো অবিশ্বাস্য লাগে সংখ্যাটাকে।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
আপনার প্রশ্নের জবাব খুঁজতে একটু ইন্টারেস্টিং তথ্যের সন্ধান মিল্ল। আমার তিনটা সোর্সের দুইটাতে বলছে পদাতিকের সংখ্যা ১,১৪০,০০০ আর একটাতে বলছে ১,৪০,০০০। কোনটাই ভেরিফাই করার সুযোগ পাইনি। আমরা বরং সংখ্যা দুটোর সম্ভাব্যতা যাচাই করি।
১,৪০,০০০ জন পদাতিকঃ আপনার দেয়া মোট জনসংখ্যার হিসাব অনুযায়ী এই সংখ্যাটি সঠিক হয়। তবে আপনার ভাবনাতে একটু সংযোজন দরকার বলে মনে করি। সেটা হচ্ছে কররাণীদের সৈন্যবাহিনীর প্রায় পুরোটাই ছিল বহিরাগত আফগানেরা। হাতে গোনা অল্প কয়েকজন বাঙালী সেনাপতি যারা ছিলেন তাদের অধীনে কেবল কিছু স্থানীয় সৈন্য ছিল।
১,১৪০,০০০ জন পদাতিকঃ দাউদকে দক্ষিণ-পূর্বে ত্রিপুরার সাথে, উত্তর-পূর্বে কোচদের সাথে, উত্তর-পশ্চিমে মুঘল দেওয়ান/সুবাদারদের সাথে, দক্ষিণ-পশ্চিমে উৎকল-কোশলের স্থানীয় সামন্তদের সাথে প্রায় একসাথে লড়তে হয়েছে। তাছাড়া দেশের ভেতরে বারো ভূঁইয়াদের নিয়ে মাথাব্যথা তো ছিলই। দেশের আকার যখন বড় তখন এই এতগুলো সেক্টরে প্রায় একসাথে লড়তে গেলে মিলিয়ন খানেক পদাতিক আবশ্যক। তাছাড়া দাউদ আকবরের মতো মুঘল সম্রাটকে হঠিয়ে ভারত জয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন। দাউদ যতই মাতাল-লম্পট হোন না কেন লাখ দেড়েক সৈন্য নিয়ে আকবরের সাথে যুদ্ধ করতে যাওয়া যে বাতুলতা সেটা তার বোঝার কথা। সেক্ষেত্রেও সৈন্যবাহিনীর আকার বড় হবার কথা। এর বাইরে আরেকটা অনুকল্প হচ্ছে, আকবরের আমলে আফগানরা সারা ভারতে মার খেতে খেতে কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল। সেক্ষেত্রে সকল দলছুট ও উচ্চাভিলাষী আফগান সৈন্যরা দাউদের পতাকাতলে জড়ো হওয়াও স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রেও তাদের মোট সংখ্যাটা বড় হবার কথা।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দাউদের এগার লক্ষ সেনা - এই তথ্যের সূত্র কি? ওই সময়ে অনেক রাজকীর্তিই অতিরঞ্জনমাত্র, তাই সংখ্যাগুলো আমার মনে হয় একটু ভেবে নেওয়া উচিত। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা-আসামের জনসংখ্যা ১৮০০ সাল নাগাদ ছিল তিন কোটি (উইলিয়াম জোন্স অনুমাণ), এবং ১৫৭৪ সাল নাগাদ হওয়া উচিত দেড় কোটি। সেই ক্ষেত্রে জনসংখ্যার প্রায় আট শতাংশ সরাসরি সামরিক-বাহিনীতে - এরকম ভাবা শক্ত। পুরো বাংলা তাদের অধীনে ছিল না - এটা ভাবলে আরো অবিশ্বাস্য লাগে সংখ্যাটাকে।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
উদরতান্ত্রিক এবং সঙ্খ্যাবণিকের সঙ্গে 'কুন্তল-গবেষক' উপাধি যোগ করাও 'সময়ের দাবী'।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন