পদ্মভোজী
১.
আলমগীর রহমানের নিতাইগঞ্জের বাসা থেকে তার চারারগোপের অফিসের দূরত্ব মেরেকেটে পাঁচ কিলোমিটার হবে। হাঁটাপথে রাস্তার প্যাঁচগোজ, গলির বাঁক ছাড়াও গাড়ি-রিক্শার জটলা, উপচে পড়া ডাস্টবিন, রাস্তার উপর রাখা নির্মাণসামগ্রী, ফুটপাথের উপর গড়ে ওঠা দোকান এগুলোর জন্য ঘুরে যাওয়া হিসেবে ধরলে সেটা ছয় কিলোমিটারের বেশি হবে না। এই পথটা সকালে হেঁটে যেতে এক ঘন্টা লাগেনা। বিকেল-সন্ধ্যায় ট্রাফিক জ্যামের জন্য একটু দেরি হলেও তার জন্য এক ঘন্টা সময় যথেষ্ট। আলমগীরের অফিস দশটায় শুরু হলেও মেয়ে ফারিমাকে স্কুলে নামিয়ে দেবার জন্য আজকাল সকালে বাসা থেকে বের হতে হয় সাড়ে আটটায়। ফারিমার স্কুল মণ্ডলপাড়া ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কাছে, সেটা তার বাসা থেকে এমন কোন দূরে নয়। হেঁটেই যাওয়া যায়, কিন্তু হাঁটতে ফারিমার আপত্তি আছে - এতে নাকি তার পা ব্যথা করে। আবার বাবার কোলে চড়ে যেতেও সে নারাজ - এতে বন্ধুদের কাছে তার প্রেস্টিজ থাকে না। বিকল্প থাকে শুধু রিক্শা। শহুরে রিক্শাচালকদের বেশিরভাগ জন মেজাজ-মর্জিতে এক একজন আস্ত শাহেনশাহ্। সকালে তাদের সওয়ার হতে প্রথমে সাধ্যসাধনা করতে হয়, তারপর ভাড়া কী হবে তা নিয়ে মিনতি করতে হয়। রিক্শাযাত্রীদের কেউ কেউ আছে যারা গন্তব্য ঠিক হয়ে গেলে ভাড়ার ব্যাপারটা মীমাংসা না করেই উঠে পড়ে। সেক্ষেত্রে ভাড়া দেবার কালে “যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না” জাতীয় দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। রিক্শাচালকদের সাথে ভাড়া নিয়ে কচলাকচলি করাটা আলমগীরের কাছে অন্যায় বলে মনে হয়। তাই প্রায় প্রতিদিন সকালে তাকে দেড়গুণ রিক্শাভাড়া গুনে মেয়ের স্কুল অব্দি যেতে হয়।
ফারিমা স্কুলে ঢুকে পড়লে হাতে একঘন্টারও বেশি সময় থাকে। এসময়টাতে লোকনাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে পরোটা-ভাজির নাশ্তা, বাশারের দোকানে চা-সিগারেট খাওয়া সেরে ধীরেসুস্থে চারারগোপের অক্সিজেন গেটে অফিসে পৌঁছানো যায়। এই নগরীর রাস্তাগুলোর নাম ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত প্রধান দুই সড়কের নাম দুই ট্রাজিক হিরো বঙ্গবন্ধু আর সিরাজউদ্দৌলার নামে। এই দুইজনকে যোগ করা পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত প্রধান সড়কগুলি নবাব সলিমুল্লাহ্, শায়েস্তা খাঁ, মীর জুমলা, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে। বখতিয়ার খিলজী রোডও পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। তবে সে বঙ্গবন্ধুকে স্পর্শ করতে পারলেও সিরাজউদ্দোলাকে স্পর্শ করতে পারেনি। সিরাজউদ্দৌলার দৌড় এক নাম্বার রেল গেটের কাছে সোহরাওয়ার্দীর কাছে শেষ। এরপরে এর নাম হয়েছে এস, এম, মালেহ রোড - কে সে জন, কে জানে! নিমতলীর কাছে আবার তার দৌড় শেষ। এরপর কেরোসিনঘাট পর্যন্ত এর ঠিকঠাক কোন নাম নেই - কোথাও ডাইলপট্টি রোড, কোথাও ছুতারপাড়া রোড। ওদিকে তার সমান্তরালে বঙ্গবন্ধু’র প্রবাহ বয়েই গেছে যতক্ষণ না তিনি বখতিয়ার খিলজী, শাহ্ সুজা আর জমিদার কাচারী ত্রিবেণীর দেখা পেয়েছেন। ইতিহাসের নায়ক আর খলনায়কদের নামে রাস্তার নাম ধারণ করা এই নগর ঐসব ঐতিহাসিক চরিত্রের সম্মিলনের মতো বিচিত্র-জটিল এক চরিত্র। তার সত্ত্বাকে বুঝতে আলমগীর কৈশোরে এই রাস্তাগুলো ধরে দিনের পর দিন বিভিন্ন সময়ে বার বার হেঁটে দেখেছে। সে দেখেছে রাস্তা আর গলিগুলোর চরিত্র সময়ের সাথে সাথে কী করে বদলে যায়। এমনকি একটা দিনের বিভিন্ন সময়েও তার চেহারা ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়ে যায়। পাশাপাশি দুটো গলির বাসিন্দাদের আচরণও কেমন পার্থক্যপূর্ণ হয় সেটা সে বিস্ময়ের সাথে দেখতো। এভাবে কিশোর আলমগীর চেষ্টা করেছে একটু একটু করে এই নগরীকে নিজের সত্ত্বায় ধারণ করতে। সেটাতে সে সফল হয়েছে কিনা সেটা আরো পরের ব্যাপার।
২.
বর্তমান চাকুরীটাতে ঢোকার পর আলমগীর প্রতিদিন এই নগরের একেকটা রাস্তার রুট ধরে হেঁটে হেঁটে বাসা থেকে অফিসে পৌঁছাতো বা অফিস থেকে বাসায় ফিরতো। এটা শুধু তার কৈশোরের অভ্যাসবশত অথবা এই নগরকে ভালো করে চিনে নেবার উদ্দেশ্যে করা নয়। তাহলে প্রতি নিয়ত এই রুট পরিবর্তনের হেতু কী? এক কথায় এর উত্তর হচ্ছে - একঘেঁয়েমি কাটানো। আলমগীরের গোটা জীবনে বিশেষ কোন উত্থান-পতন নেই, বিশেষ কোন ঘটনা নেই। এই নগর ছেড়ে কখনো অন্য কোথাও তার থাকা হয়নি। ছোটবেলায় একবার জলবসন্ত আর ডিগ্রী ক্লাসে পড়ার সময় একবার জন্ডিস হয়েছিল। দু’বারই সে বেশ কাবু হয়ে পড়েছিল। তার জীবনে এ’দুটো অসুখই মনে রাখার মতো বড় ঘটনা। খুব ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ায় বাবার স্মৃতি তার কাছে অস্পষ্ট, এবং সেটি তার কাছে বিশেষ ঘটনা বলে মনে হয় না। বাবার অভাব কখনো সে বিশেষ অনুভব করেনি। জয়গোবিন্দ হাইস্কুলে পড়ার সময় তার ক্লাসের অন্য ছেলেদের নানা কারণে তাদের বাবাদের হাতে মার খাবার কথা শুনে নিজেকে বরং ভাগ্যবান মনে হত। ডিগ্রী পাশ করার পর কোন চাকুরীতে ঢোকাটা যখন অত্যাবশকীয় হয়ে পড়ে তখন একবার মনে হয়েছিল যে, বাবা বেঁচে থাকলে আজ অনায়াসে তার জন্য একটা চাকুরী জোগাড় করে দিতে পারতো। বাবা বেঁচে থাকলে আদৌ অমন কিছু করতে পারতো কিনা সেটা বিবেচনা না করেই চাকুরী না পাবার জন্য আলমগীর প্রয়াত পিতাকেই দায়ী করতো। চাকুরীটা শেষ পর্যন্ত নিজের চেষ্টাতেই হয়। তবে সেই চাকুরীর যে অবস্থা সেটা দেখে তার মা ভাবল এই ছেলেকে তার বুঝি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে হবে। স্বামী মারা যাবার পর অনেকগুলো বছর ক্রমাগত লড়াই করে যাওয়া মা তাই তার জন্য আর জীবনপাত করতে রাজী হয়নি - মেজ ছেলের সাথে থাকতে রাজধানীতে চলে যায়।
আলমগীরের বন্ধুবান্ধব কখনোই বিশেষ ছিল না। ছাত্র জীবনে সে না ছিল ভালো ছাত্র, না ছিল খারাপ ছাত্র। এখানকার শিক্ষায়তনগুলোতে ভাল ছাত্র মানে ভাল ছেলে জাতীয় একটা সরল সমীকরণ আছে। ভালো ছেলে হবার যোগ্যতা বা খারাপ ছেলে হবার সাহস না থাকায় ক্রমাগত সে দলছুট হয়ে পড়েছে। চাকুরীতে ঢোকার পর একাকীত্ব তাকে ক্রমাগত গ্রাস করতে থাকে। মা মেজ ভাইয়ের কাছে চলে যাবার পর একাকীত্বের ব্যাপারটা আরো প্রকট হয়। প্রথম চাকুরীটা সুবিধার ছিল না বলে একটা ভালো চাকুরীর জন্য তার প্রাণপণ চেষ্টা ছিল। তারপর নানা জনকে বলেকয়ে এই চাকুরীটা পায়। এই চাকুরীটাও এমন ভাল কিছু নয়, তবে তার মতো মানুষের জন্য এটা ঠিকই আছে বলে মনে করে। বিয়ের বয়স হলে মা-ভাই-বোনেরা মিলে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। যেহেতু তার নিজের পছন্দের কেউ ছিল না, তাই এই ব্যাপারে সে কোন ঝামেলা করেনি। বউকে তার মন্দ লাগে না। তবে এই বিয়েতে তার বউ ফাহমিনার যে মস্ত স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে সেটা সে টের পায়। আলমগীর উচ্চাশাবিহীন একজন মানুষ। নিজের অবস্থা-অবস্থান পরিবর্তনের ব্যাপারে তার কোন ভাবনা বা উদ্যোগ নেই। এমন উদ্যোগ-উদ্যমবিহীন মানুষকে নিয়ে ফাহমিনার মতো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে কোন স্বপ্ন দেখা সম্ভব নয়। তাই বিয়ের প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে যাবার পর ফাহমিনা আর আলমগীর দু’জনই মানসিকভাবে পরস্পরের দূরে সরে যেতে থাকে।
ধূমপান ছাড়া আলমগীরের অন্য কোন নেশা নেই। সিগারেটও দিনে সাত-আটটার বেশি টানে না। বই পড়ার ধৈর্য তার কখনোই ছিল না। টেলিভিশনে খেলা বা সিনেমা দেখতে বসলে তার হাই ওঠে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিলে হাতেগোণা কয়েকদিন মদ খেয়ে দেখেছে - সেটা তার ভালো লাগেনি। অফিসে যেতে আসতে একেকদিন একেক রাস্তায় হাঁটতে তার বরং ভালো লাগতো। কিন্তু বিয়ের পর বাসায় ফিরে বিরক্তি আর হতাশায় মলিন বউয়ের মুখ ক্রমাগত দেখতে দেখতে একসময় তার মনে বউয়ের জন্য কিছুটা অপরাধবোধ আর উৎকণ্ঠা জন্মায়। তখন থেকে রাস্তায় হাঁটার বদলে সে বাসে বা রিক্শায় চেপে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরা শুরু করে। মেয়ে জন্ম নেবার পর বছর দুই চরম আনন্দে কাটে। কিন্তু মেয়ে একটু বড় হতে থাকলে দেখা যায় সেও তার মায়ের মতো আলমগীরের ব্যাপারে যথেষ্ট বিরক্ত। তখন আলমগীরের পৃথিবী আবার তার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে থাকে।
৩.
আলমগীরের বাসা থেকে অফিসে যাবার জন্য সরাসরি বাসের কোন সুবিধা নেই। এই নগরে সব বাসই বঙ্গবন্ধু রোড ধরে আসে। তবে কোন বাসই সে’পথের দুই নাম্বার রেলগেটে পৌঁছানোর পর সোজাপথে নিতাইগঞ্জ পর্যন্ত আসেনা, বাঁয়ে মোড় নিয়ে এক নাম্বার রেলগেট হয়ে বাস টার্মিনালের দিকে চলে যায়। ব্যাটারী চালিত রিক্শা ওরফে টম্টমের কোন রুটও তার বাসা থেকে অফিস অব্দি নয়। তাই নিজের ট্যাঁক হালকা করে রিক্শাচালকের ট্যাঁক ভারী করতে না চাইলে শ্রীচরণযুগলই ভরসা। বাসা থেকে বঙ্গবন্ধু রোডে উঠে সোজাসুজি হেঁটে দুই নাম্বার রেল গেট পর্যন্ত গেলে বাস পাওয়া যায়। তাতে করে রাস্তার শেষ মাথায় খাজা সুপার মার্কেটের কাছে নামলে ডানে মোড় নিয়ে মিশনপাড়া, ডন চেম্বার হয়ে কুমুদিনীর কাছে আবার ডানে মোড় নিয়ে সিরাজউদ্দৌলা রোড ধরে অফিসে যাওয়া যায়। খাজা সুপার মার্কেট পর্যন্ত যেতে না চাইলে রাস্তার মাঝপথে গলাচিপা মোড়ে নেমে উলটো দিকের এ সি ধর রোড ধরেও সিরাজউদ্দৌলা রোডে পৌঁছানো যায়। ফিরতি পথে অফিসের সামনে থেকে ধীরে চলা কোন বাসে দৌড়ে উঠে যেতে পারলে সিরাজউদ্দৌলা রোডের শেষ মাথায় এক নাম্বার রেল গেট পর্যন্ত যাওয়া যায়। তারপর হেঁটে বাড়ি ফেরা যায়।
অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে আলমগীর আজকাল বাস থেকে এক নাম্বার রেলগেটে নেমে আবার সকালের রুট ধরে বাড়ি ফেরে না। বরং এক নাম্বার রেলগেট থেকে সোজা রাস্তায় কোতওয়ালী থানা, আশা সিনেমা হল, মীনাবাজার, সাবেক হংস থিয়েটার, ডাইলপট্টি, ছুতারপাড়া পার হয়ে ডানে মোড় নিয়ে ভগবানগঞ্জের রাস্তা ধরে নিতাইগঞ্জে পৌঁছায়। রাস্তা নিয়ে আলমগীরের এমন কাণ্ড পরিচিত কেউ দেখলে একটু ভুরু কুঁচকানোর কথা। ফেরার পথে এমন ঘুরপথে যেতে কখনো সখনো বেমক্কা পরিচিত কারো মুখোমুখি হয়ে পড়েনি যে তা নয়। অমন পরিস্থিতিতে “এইদিকে একটা কাজ ছিল” বা “এক বন্ধুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে এইদিকে এসে পড়েছিলাম” এমন বলে কাটিয়ে দেয়। ভগবানগঞ্জের সরু রাস্তায় এসে পড়লে আলমগীরের হাঁটার গতি একটু শ্লথ হয়ে যায়। দুটো মোড় পার হলে হাতের ডানে রাস্তার উপরে পাঁচিল ছাড়া, সামনে উঁচু রোয়াকওয়ালা একতলা বাড়িটা পড়ে। বাড়িটার বয়স কতো সেটা বলা মুশকিল - সেটা পঞ্চাশ বছর হতে পারে, আবার একশ’ বছর হওয়াও বিচিত্র কিছু না। বড় ভূমিকম্প হবার দরকার নেই, জোরেশোরে ঝড় উঠলে এ’বাড়ি ধ্বসে পড়তে পারে। কিন্তু দুই পাশের দুই বাড়ি এই বাড়ির গায়ের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছে বলে বোধহয় এখনো এটা ধ্বসে পড়ছে না। বাড়িটার সামনে এলে আলমগীর একতলার আধখোলা দরজার দিয়ে ভেতরের দিকে একবার তাকায়, তারপর উপরের ঢালাই লোহার রেলিঙওয়ালা বারান্দার দিকে তাকায়, তারপর চলে যায়। এই তাকানোর সময় তার চলার গতি আরেকটু শ্লথ হয় কেবল, কিন্তু থেমে পড়ে না। যা দেখার জন্য আলমগীরের এই ঘুর পথে হাঁটা তার আভাস পেলে মনটা হালকা হয়ে যায়। আলমগীর তখন দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ি ফেরে। আর যদি কখনো প্রাপ্তিটা এরচেয়েও বেশি হয় তাহলে আলমগীর মনে মনে উড়তে থাকে। একাকীত্বের অন্ধকার আলমগীরকে আর গ্রাস করতে পারে না।
এই সরু রাস্তাটার জাদুতে আলমগীরের পড়াটা নিতান্তই ঘটনাক্রমে। এক বিকেলে অফিস থেকে বের হয়ে কাছের একটা ওষুধের দোকান থেকে দরকারী ওষুধ কিনতে গেলে হঠাৎ কারো গলায় ছোটবেলার সম্বোধন “আরে বাদশাহ্ নাম্দার যে!” শুনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে স্কুল জীবনের সময়কার সহপাঠী বিমল। বাদশাহ্ আওরঙ্গজেবের নামের সাথে মিল থাকায় স্কুলে থাকতে সহপাঠীরা আলমগীরকে “বাদশাহ্ নাম্দার” বলে ক্ষ্যাপাতো। মাঝখানে অনেকটা সময় পার হয়ে গেলেও আলমগীর আর বিমলের পক্ষে পরস্পরকে চিনে নিতে কষ্ট হয় না। চাকুরী বা ব্যবসায় কোনটাতে সুবিধা করতে না পেরে বিমল সাহা বছর পনের আগে ভাগ্য গড়তে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিল। তারপর আর কখনো আলমগীরের সাথে তার দেখা হয়নি। এই সময়ে আলমগীর কারো কাছ থেকে বিমলের কথা শোনেও নি। এই চাকুরীটা না পেলে আলমগীরকেও হয়তো জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান বা মালয়েশিয়াতে ভাগ্য গড়তে চলে যেতে হতো। একবার মধ্যপ্রাচ্যে যাবার কথা হয়েছিল, কিন্তু তার মন টানেনি বলে সে চেষ্টাতে আর যায় নি। এই নগর ছেড়ে কোথাও যেতে হয়নি বলে আলমগীর নিজের ভাগ্য নিয়ে একটু গর্বিত হয়। অবশ্য এ’নিয়ে পরিবারের অন্য অনেকের খেদ আছে।
- আরে বিমল! কেমন আছিস্। কতদিন পরে দেখা। তুই দেশে আসলি কবে।
- দেশে ফিরেছি বছর তিনেক হয়। বাড়ির কাছে একটা ছোট ওষুধের দোকান দিয়েছি। এখানে এসেছিলাম পাইকারী দোকান থেকে কিছু ওষুধ কিনতে। তোর খবর কী?
আলমগীর নিজের কর্মক্ষেত্র আর পরিবারের ফিরিস্তি দেয়। বিমল শুনে খুশি হয়ে বলে,
- যাক তুই তাহলে মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছিস। আমার তো জীবনটা শুরু করতেই দেরি হয়ে গেল। তবে আছি মন্দ না। গত বছর বিয়ে করেছি। শ্বশুরবাড়ি নদীর ঐপাড়ে সোনাকান্দায়। ওদের আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভালো না। তবে ভাই বউ পেয়েছি খুব ভালো। আমার আফসোস্ নেই।
বিমলের বাড়ি কেরোসিনঘাটের কাছে বলে আলমগীরকে তার সাথে এক রিক্শায় উঠতে হয়। পুরনো দিনের গল্প করতে করতে ভগবানগঞ্জের সরু রাস্তাটার মুখে আসতে সে নেমে পড়ে। একদিন বউ-বাচ্চাসহ বিমলের বাড়ি বেড়াতে যাবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে আলমগীর বিদায় নেয়। এতক্ষণ বিমলের সাথে গল্পে গল্পে ছিল বলে আলমগীর টের পায়নি যে আকাশ বেশ মেঘলা হয়ে এসেছে। সে ভেবেছিল বিকেলটা হঠাৎ শেষ হয়ে যাওয়ায় বুঝি আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ছাতা বা বর্ষাতি সাথে নেই বলে সে পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে। কিন্তু দুটো মোড় পার না হতেই বড় বড় ফোঁটায় তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বৃষ্টিতে ভেজার কোন ইচ্ছা আলমগীরের ছিল না। তাই এক দৌড়ে সামনের খোলা বারান্দাটায় উঠে পড়ে। বারান্দার দিকের দরজাটা সেদিনও আধখোলা ছিল। তবে হুট করে অপরিচিত কারো বাড়িতে ঢুকে পড়ার কথা সে চিন্তা করেনি। আলমগীর ভেবেছিল বৃষ্টি একটু ধরে আসলে একটা রিক্শা নিয়ে বাসায় চলে যাবে। কিন্তু বৃষ্টির বেগ ক্রমাগত বাড়তে থাকায় বারান্দাতে দাঁড়ানোটা আর নিরাপদ থাকে না। বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা এসে ঘর ভাসিয়ে দিচ্ছে দেখে বোধহয় কেউ একজন দরজা বন্ধ করতে আসে। আলমগীর ঘুরে তাকাতে তার সাথে দেখা হয়ে যায়। ভেতর থেকে নারী কণ্ঠের আহ্বান আসে,
- আপনি ভেতরে চলে আসুন। বারান্দায় ভিজে যাচ্ছেন তো।
- না, না! আমি এখানে ঠিক আছি। বৃষ্টি কমলেই চলে যাবো।
- না, কিছু ঠিক নেই। বৃষ্টি সহসা কমবে বলে মনে হচ্ছে না। কোন অসুবিধা নেই। আপনি ভেতরে চলে আসুন।
নিরুপায় আলমগীর সসঙ্কোচে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঘরের ভেতরটা দেখে আলমগীর একটু অবাক হয়। ভেতরটা কোন সাধারণ বসবার বা শোবার ঘরের মতো করে সাজানো নয়। একটা লম্বা টেবিল পাতা, তার দু’পাশে দুটো লম্বা বেঞ্চ। দেখলে কোচিং সেন্টারগুলোর মতো লাগে। ঘরের এক কোনে হাত-মুখ ধোবার জায়গা, আর আরেক কোনে অনেকগুলো অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন ক্যারিয়ার স্তুপ করে রাখা। আলমগীরের অবাক দৃষ্টির দিকে লক্ষ করে গৃহবাসীনি বলেন,
- এটাকে একটা রেস্টুরেন্ট বলতে পারেন।
- রেস্টুরেন্ট!
- হ্যাঁ, তবে এর কোন নাম নেই। আমার নামে কেউ কেউ এটাকে “ইয়াসমিনের হোটেল” বলে। এখানে সকালের নাশ্তা বা বিকেলের খাবার পাওয়া যায় না। দুপুরে অল্প কয়েকজন এসে খান, রাতে আরো কম জন খান। তবে দুপুরে এখান থেকে অনেকের জন্য টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার যায়।
- আমি কাছেই নিতাইগঞ্জে থাকি কিন্তু এর কথা তো কখনো শুনিনি।
- শোনার কথা না। আমাদের পরিচিত কিছু মানুষ আর তাদের কাছ থেকে শোনা আরো কিছু মানুষ এর কাস্টমার। আপনি চাইলে আজ রাতে এখানে খেয়ে যেতে পারেন। যারা রাতে খেতে চান, দুপুরেই তারা সেটা জানিয়ে যান। রাতে শুধু তাদের জন্য রান্না করা হয়। আজ এমন বৃষ্টিতে তাদের কেউ কেউ নিশ্চয় এখানে খেতে আসতে পারবেন না। অবশ্য সবাই আসলেও আপনি একজন মানুষের জন্য খাবারে কম পড়বে না।
- না, না! আমি বাড়ি ফিরে গিয়ে খাবো।
- রেস্টুরেন্টের এমন হতশ্রী অবস্থা দেখে খাবারের মান বা পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ভাববেন না। যারাই আমাদের খাবার খেয়েছে তাদের কাছে আমাদের রান্নার প্রশংসা শুনতে পাবেন, আর আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বেশ মেনে চলি।
- না, না। ওসব কিছু নয়। আমি সত্যিই বাড়ি ফিরে খাবো। রাতে খামাখা বাইরে খাবার আমার দরকার নেই।
- দরকার না থাকুক, একদিন না হয় বাইরেই খেলেন। আজ বাটা মাছের ঝোল রান্না করা হয়েছে, সাথে সর্ষে দিয়ে শাপলা ডাঁটার চচ্চড়িও আছে।
একটা রেস্টুরেন্টের সাপেক্ষে খাবারের অদ্ভূত মেনুর কথা শুনে আলমগীর এতক্ষণে প্রশ্নকর্ত্রীর মুখের দিকে ভালোভাবে তাকায়। তার বয়স ঠিক কত তা বোঝা যায় না, তবে তা ত্রিশ পেরিয়েছে বোধহয়। দেখতে সে সুন্দরী নয়, অন্তত তার নিজের স্ত্রীর সৌন্দর্যের বিবেচনায় কিছুই নয়। তবে তার সারা মুখে একটা স্নিগ্ধ জ্যোতি আছে। আর আছে গভীর করে তাকাতে পারে এমন একজোড়া চোখ। বাটা মাছ বা শাপলা ডাঁটার চচ্চড়ি কোনটাই আলমগীরের খুব প্রিয় নয়, আবার ওসব সে অপছন্দও করে না। তবু সেই বাটা মাছের ঝোল, অথবা শাপলা ডাঁটার চচ্চড়ি, অথবা মুখের স্নিগ্ধ জ্যোতি, অথবা গভীর করে তাকাতে পারা চোখের টানে আলমগীর রহমান ঘরের কোনের কলে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে পড়ে। খেতে বসে আলমগীর টের পায় এই রেস্টুরেন্টের একটা বিশেষত্ব আছে যেটা বোধকরি দুনিয়ার কোন নামী-দামী রেস্টুরেন্টেও নেই - সেটা হচ্ছে পরিবেশনার স্টাইল। খোদ রেস্টুরেন্টের মালকিন ইয়াসমিনই এখানে পাচিকা, এবং তিনিই স্বহস্তে খাবার পরিবেশন করেন। সেই পরিবেশনের স্টাইলে মায়ের মমত্ব, স্ত্রীর প্রেম, কন্যার ভালোবাসা সবই মিশে আছে। আলমগীর নিশ্চিত হতে পারে না এই পরিবেশনা কি শুধু তার জন্যই নাকি অন্য সব কাস্টমারের জন্যও। এই দ্বিধা নিয়েও আলমগীর এই নামহীন রেস্টুরেন্টের খাবারের স্বাদে, অথবা তার পরিবেশনার স্টাইলে অথবা তার মালকিনের মুখের স্নিগ্ধতা বা দৃষ্টির গভীরতায় আবিষ্ট হয়ে পড়ে। এর পর থেকে আলমগীরের অফিস থেকে ফেরার পথটা ভগবানগঞ্জ দিয়ে বেঁকে যেতে থাকে।
৪.
প্রথম প্রথম আলমগীর এক টানা কয়েকদিন সন্ধ্যায় ভগবানগঞ্জে খেতে থাকে। বিষয়টা ফাহমিনার চোখ এড়ায় না। আলমগীর রাতে কেন কম খাচ্ছে বা প্রায় খাচ্ছেই না এই ব্যাপারটা ফাহমিনার প্রশ্নের মুখোমুখি হলে, আলমগীর সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে ভগবানগঞ্জ দিয়ে ঘুরে আসলেও ইয়াসমিনের রেস্টুরেন্টে আর খেতে যায় না। আসল ব্যাপারটা কী হতে পারে সেটা ইয়াসমিনের ঠিক বোধের অগম্য থাকে না। কিন্তু সে আলমগীরকে ডেকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করে বিব্রত করে না। এরপর থেকে আলমগীর মাসে দুই-এক দিন অথবা ফাহমিনা পিত্রালয়ে গেলে প্রতিদিন সেখানে খেতে যেতে থাকে।
আলমগীর যে সময়ে ইয়াসমিনের রেস্টুরেন্টে যায় সেটা রাতের খাবারের সময় হিসাবে একটু তাড়াতাড়ি হয়। তাই অন্য কোন কাস্টমার তার চোখে পড়ে না। এটা তাকে কিছুটা স্বস্তিও দেয়। তবে এক ছুটির দিনে ফাহমিনা বাসায় না থাকায় আলমগীর রাত ন’টার দিকে রেস্টুরেন্টে গিয়ে আরেক জন কাস্টমারের দেখা পায়। দেখা গেল ইয়াসমিন তাকে খাবার পরিবেশন করছে ঠিকই তবে সামনে বসে থেকে আলমগীরকে যেভাবে পরিবেশন করে সেভাবে নয়। আলমগীর এতে বুঝতে পারে ঐ বিশেষ পরিবেশনার ব্যাপারটা ইয়াসমিন সম্ভবত শুধু তার জন্য তুলে রেখেছে। পরিবেশনের সময় ইয়াসমিন আলমগীরের পাতে নিঃশব্দে খাবার তুলে দেয়, কোন অনুরোধ বা জোরাজুরি করে না। শুধু পরিমাণে বেশি হয়ে গেলে আলমগীর যখন “আর না” বলে তখন ইয়াসমিনও দ্বিরুক্তি না করে থেমে যায়। খেতে খেতে দু’জনের অনেক কথাই দু’জনের জানা হয়ে যায়। তবে ঐ পর্যন্তই - না আলমগীর, না ইয়াসমিন, কেউই অন্য জনের ব্যাপারে নিজের বিশেষ কোন আগ্রহ বা ভালো লাগার কথা বলে না। আলমগীর নিশ্চিত না ইয়াসমিন তাকে বিশেষ চোখে দেখে কিনা, অথবা তার জন্য ইয়াসমিনের বিশেষ কোন অনুভূতি আছে কিনা। ইয়াসমিন এটা নিয়ে কী ভাবে তা জানার উপায় নেই।
৫.
ইয়াসমিনের সাথে কথায় কথায় আলমগীর এক সময়ে জানতে পারে এই বাড়িতে ইয়াসমিন আর তার বৃদ্ধা শাশুড়ি থাকে। এক সামরিক শাসকের আমলে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় যখন স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আক্রান্ত হয় তখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এই বাড়ির পূর্বতন মালিক জলের দরে বাড়িটা ইয়াসমিনের শ্বশুরের কাছে বিক্রি করে দিয়ে নিরাপত্তার খোঁজে পরিবার পরিজন নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে যায়। ইয়াসমিনের শ্বশুর তখন সবেমাত্র চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছে। সেই সুবাদে হাতে কিছু নগদ টাকা এসেছিল, কিন্তু সেটা বাড়ি কেনার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তবু বাড়ির পূর্বতন মালিক তাকে বিশ্বাস করে বাড়িটা তাকে হস্তান্তর করে। অবশিষ্ট টাকা উপার্জনের জন্য ইয়াসমিনের স্বামী বাবলুকে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিতে হয়। বাবলুর পাঠানো টাকা থেকে মাসে মাসে কিছু টাকা এ সি ধর রোডে বুলু মল্লিকের স্বর্ণের দোকানে পৌঁছে দিতে হতো। বুলু মল্লিক সেই টাকা কী করে সীমান্তের অপর পাড়ে প্রাপকের হাতে পৌঁছে দিত সেটা কারো জানা নেই। এভাবে দুই বছরে বাড়ির মূল্য পরিশোধিত হয়।
এরপরের দুই বছরে দুটো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। তার একটা হচ্ছে ইয়াসমিনের শ্বশুরের আকস্মিক মৃত্যু আরেকটা বাবলুর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। মালয়েশিয়া সরকার যখন অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদের ধর-পাকর শুরু করে তখন বাবলু আর তার সহকর্মীরা নানা দিকে ছিটকে পড়ে। কয়েক মাস পরে অন্য অনেকের খোঁজ পাওয়া গেলেও বাবলুর আর কোন খোঁজ মেলে না। সে কি মালয়েশীয় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেল খাটছে নাকি মালয়েশীয় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে তার কিছুই জানা যায় নি। ইয়াসমিন কয়েক দিন তার মতো আরো কয়েকটি পরিবারের সাথে জনশক্তি মন্ত্রণালয় আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঘোরাঘুরি করেছে। কিন্তু ভুয়া কাগজপত্র নিয়ে অবৈধভাবে যাওয়া শ্রমিকদের সন্ধান করা মন্ত্রণালয়গুলোর সাধ্যে ছিল না। অতএব চাকুরী পাবার মতো কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় জমানো টাকা ফুরিয়ে আসতে নিলে ইয়াসমিন এই ভাতের হোটেল বা রেস্টুরেন্ট খুলে বসে।
পরের দশ বছরে ইয়াসমিনকে এত ঝামেলা আর বিপদ মোকাবেলা করতে হয়েছে যে বাবলুর সাথে তার স্বল্প দৈর্ঘ্যের দাম্পত্য জীবন তার স্মৃতি থেকে অস্পষ্ট হয়ে যেতে থাকে। এই সময়ে ইয়াসমিনের মনে কোন পুরুষ ছায়া ফেলতে পারেনি। অবশ্য মনে ছায়া ফেলতে অমন করে কেউ এগিয়ে আসেনি। যারা এসেছিল তাদের অবয়বে লোভের ছায়াটা বড্ড প্রকট ছিল।
ইয়াসমিনের গল্প জেনেও আলমগীর তার প্রতি বিশেষ কোন মমতা অনুভব করে না। তার অনুভূতিতে ইয়াসমিনের বর্তমান অস্তিত্ত্বটাই প্রবল, তার অতীত সেখানে কোন ছায়া ফেলে না। আলমগীরও তার গল্প ইয়াসমিনকে করেছে। কিন্তু সেখানে এমন কোন উপাদান নেই যাতে আলমগীরের জন্য ইয়াসমিনের মন আর্দ্র হয়ে উঠবে। তবু আলমগীরের মনে হয় তার প্রতি ইয়াসমিনের একটা বিশেষ এবং দুর্বোধ্য অনুভূতি আছে।
৬.
আলমগীর নিজেকে অনেক বার প্রশ্ন করেছে - কেন সে ইয়াসমিনের কাছে যায়। এটা নিশ্চিত ভাবেই ইয়াসমিনের রান্না করা খাবারের লোভে নয়। ইয়াসমিনের সান্নিধ্য তার কাছে ভালো লাগে, তার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে। তবে ইয়াসমিনের প্রতি সে বিশেষ কোন মায়া বা দায়িত্ব বোধ করে না - যেটা ফাহমিনার জন্য তার পুরো মাত্রায়ই আছে। সে বোঝে ফাহমিনা তাকে ভালোবাসে না। আলমগীর আরো জানে, ফাহমিনার জন্যও তার কোন প্রেম তৈরি হয়নি। তবু ফাহমিনাকে ছাড়া অন্য কোন নারীকে গ্রহন করার কথা তার ভাবনায় আসে না। ফাহমিনা তাকে সন্তান উপহার দিয়েছে বা তার সংসারটিকে টিকিয়ে রেখেছে - এর জন্য সে ফাহমিনার প্রতি এক প্রকার কৃতজ্ঞতাবোধ করে। আলমগীরও ফাহমিনাকে যথাসাধ্য স্বাচ্ছন্দ্য আর তুষ্টির মধ্যে রাখার চেষ্টা করে। তাদের এই সম্পর্কটা মিথোজীবীতা, ভালোবাসা নয়। ইয়াসমিনের আচরণের পেছনে সে কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য সে খুঁজে পায় না। কারণ, আলমগীর ইয়াসমিনের ব্যবসায় সম্প্রসারণের ব্যাপারে কোন প্রকার সাহায্য করতে অক্ষম, এটা যে কেউ বুঝবে। হয়তো ইয়াসমিনও আলমগীরের সান্নিধ্য, তার সাথে কথা বলা পছন্দ করে - তাই কিছুটা অভিনয় করে। এই অভিনয়টা মিথ্যে হতে পারে তা জেনেও আলমগীর সেটা উপভোগ করে, যেমন কালেভদ্রে ফাহমিনার করা উষ্ণ আচরণও সে উপভোগ করে।
কখনো কখনো আলমগীরের মনে হয় ইয়াসমিন কি সত্যিকারের কোন মানুষ, নাকি এই নগরীর সৃষ্ট এক প্রহেলিকা মাত্র? এটা যাচাই করতে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তিকে নিয়ে ইয়াসমিনের কাছে যেতে তার ভয় হয় - যদি তাতে ইয়াসমিন হারিয়ে যায়! আলমগীর আমৃত্যু এই নগরের সুধায় নিমজ্জিত থাকতে আগ্রহী। উন্নতির জন্য রাজধানী বা বিদেশে গমনের সম্ভাবনাকে সে কোন সময়ই বাড়তে দেয়নি। এটা তার ইচ্ছায় ঘটেছে নাকি নগরীটির নিজস্ব মায়ায় ঘটেছে সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আলমগীর আমৃত্যু ইয়াসমিনের কাছাকাছিও থাকতে চায়। ইয়াসমিন বাস্তব কি কল্পনা তাতে কী যায় আসে! মিথ্যে করে হলেও ইয়াসমিন তাকে ভালোবাসে এই ভাবনাটাই সুখের। সেই সুখ কল্পনায় বাড়ি ফেরার পথটা ভগবানগঞ্জ দিয়ে একটু না হয় বেঁকেই গেল।
মন্তব্য
আগ্রহী পাঠকের জন্য গল্পের শিরোনামে লিঙ্ক দেয়া আছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পেমপিরিতি কিছু না। এইটারে কয় দৌড়ের উপ্রে জিরানো
হ। যাকে বলে "দু'দণ্ড শান্তি"। এই দুই দণ্ডের দৈর্ঘ্য কারো ক্ষেত্রে আধ ঘন্টা, কারো ক্ষেত্রে গোটা জীবন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পড়লাম।
আপনার গল্পর প্লট আর বর্ননা বরাবরের মতই অসাধারণ। সবগুলো বাক্য খুব যত্নে সাজানো।
লীলেন দার মন্তব্যটা বেশ জুতসই।
দাম্পত্যের দেয়াল নড়বড়ে হয়ে উঠলে ইট কাঠ কমাইয়া বাইরে উকিঝুকি মারার মতন ঘুলঘুলি বানাইয়া নেয়াই মনে হয় স্বাস্থ্যকর!
--------------
পথিক পরাণ
ধন্যবাদ। যে লেখা পাঠকের পাতে দেয়া হবে তার প্রত্যেকটা শব্দ আর বাক্যকে নিয়ে লেখককে ভাবতেই হবে। এর বিকল্প নেই।
দাম্পত্যটাকে দেয়াল মনে করলে তাতে ঘুলঘুলি বানানোর দরকারটা পড়বে। আর সেটাকে বাগান ভাবলে সেখানে অনেক বৈচিত্র্যই সব সময় অবশিষ্ট থাকবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
খুব ভাল লেগেছে গল্প।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তবে নামটা কেন যেন ঠিক যুতসই লাগল না।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
গল্পটার এই নামটা ছাড়া কোন বিকল্প খুঁজে পাইনি। সেটা কেন তা কিছুটা বোঝা যাবে শিরোনামে দেয়া লিঙ্কটা থেকে টেক্সটটা অনুসরণ করলে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পড়ে দেখব
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
দাদার বাড়ি কি নারায়াণগাঞ্জ?
দিপন
বলতে পারেন। জীবনের একটা লম্বা সময় সেখানে কাটিয়েছি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এই গল্প নিয়ে একটা চমৎকার নাটক হতে পারে।
__________
সুপ্রিয় দেব শান্ত
নাটক লেখা বা বানানোর যোগ্যতা তো আমার নেই, সেটা আপনার আয়ত্বে থাকলে ভেবে দেখতে পারেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দারুণ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বরাবরের মতোই দারুন।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নতুন মন্তব্য করুন