মুখবন্ধ
বুনো ঘাসের শিকড় মাটির গভীরে যায় না। যদিও এটা শিশির, জল আর মৃতের রক্ত-মাংস পান করে, জীবনকে শুষে নিতে চেষ্টা করে তবুও এতে পাতা বা সুন্দর ফুল জন্মায় না। যতদিন এটা জীবিত থাকে - হলফল করে বেড়ে ওঠে আর একে ক্রমাগত কাটা হয়। এরপর যখন এর মৃত্যু হয়, সে নিঃশেষিত হয়ে যায়। কিন্তু এতে আমি দুঃখিত নই, আমি আনন্দিত। আমি বরং উল্লাসে ফেটে পড়বো এবং গান গাইবো।
আমি বুনো ঘাস ভালোবাসি, কিন্তু বুনো ঘাসে ভরা জমি অপছন্দ করি। মাটির গভীরে আদিগন্ত বিস্তৃত এক আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, গর্জে উঠছে। যখন একদিন গলিত লাভা মাটির বুক ফুঁড়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়বে, তখন সে বুনো ঘাস, বৃক্ষ সবকিছুকে গ্রাস করবে। সেদিন কিছুই আর নিঃশেষিত হবে না।
কিন্তু এতে আমি দুঃখিত নই, আমি আনন্দিত। আমি বরং উল্লাসে ফেটে পড়বো এবং গান গাইবো। স্বর্গ ও পৃথিবী এতো শান্ত-নিস্তব্ধ যে আমি সেখানে জোরে হাসতে বা গান গাইতে পারি না। এগুলো অমন নিস্তব্ধ না হলেও আমি মনে হয় সেখানে জোরে কোন আওয়াজ করতে পারতাম না। আলো ও আঁধারের মাঝে, জীবন ও মৃত্যু মাঝে, অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝে আমার এই বুনো ঘাসের গুচ্ছ নিবেদন করছি আমার বন্ধু ও শত্রুদের, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের, যাদেরকে আমি ভালোবাসি আর যাদেরকে ভালোবাসি না তাদের সবাইকে।
আমি, আমার বন্ধু ও শত্রুরা, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীরা, যাদেরকে আমি ভালোবাসি আর যাদেরকে ভালোবাসি না তাদের সবার দোহাই দিয়ে আমি এই বুনো ঘাসের আশু মৃত্যু আর ধ্বংস কামনা করছি। নয়তো এটা থাকলে মনে হবে যে আমি কখনো বেঁচে ছিলাম না; এবং তাহলে সেটা হবে মৃত্যু ও ধ্বংসের চেয়েও করুণাকর।
অতএব, হে বুনো ঘাস! আমার এই ভূমিকার সাথে সাথে তুমিও জাহান্নামে যাও!
২৬শে এপ্রিল, ১৯২৭
বেইউন লোউ শ্যাঙ, কুয়াঙচৌ
আমার বাড়ির পেছনের আঙিনার দেয়ালের ওপারে দুটো গাছ আছে। এর একটি খেজুর গাছ, অন্যটিও একটি খেজুর গাছ। রাতের আকাশ অদ্ভুত আর উঁচু। এতোটা অদ্ভুত আর উঁচু আকাশ আমি আগে কখনো দেখিনি। এটা মনে হয় মানুষের পৃথিবীকে ছেড়ে এতোটা উপরে উঠতে চাইছে যেন লোকে উপর দিকে তাকিয়ে আকাশ দেখতে না পায়। এক সময় মনে হয় এটা শুধুই নীল, যেখানে অগণিত তারা দিয়ে বানানো ঠাণ্ডা চোখ মিটমিট করে জ্বলছে। তার ঠোঁটে ম্লান, গভীর অর্থপূর্ণ হাসি। আর আমার আঙিনার বুনো লতাদের সে ভারী কুয়াশায় ঢেকে দিচ্ছে।
আমি জানি না এই লতাগুলোর নাম কী, তাদেরকে সাধারণত কী নামে ডাকা হয়। মনে পড়ে তাদের একটাতে ছোট ছোট গোলাপী ফুল ছিল। ফুলগুলো এখন শুকিয়ে গিয়ে আরো ছোট হয়ে গেছে। রাতের ঠাণ্ডা বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে তারা অনাগত বসন্তের স্বপ্ন দেখে, অনাগত হেমন্তের স্বপ্ন দেখে। যে শীর্ণ কবি তাদের শেষ পাপড়িতে নিজের অশ্রু বিসর্জন করে বলেছিল, “হেমন্ত আসবে, তারপর শীত আসবে এবং শেষে বসন্তও আসবে; তখন প্রজাপতিরা ছটফটিয়ে উড়ে বেড়াবে, মৌমাছিরা গুঞ্জন তুলে বসন্তের গান গাইবে” - এরা তারও স্বপ্ন দেখে। তারপর ছোট্ট গোলাপী ফুলেরা হেসে ওঠে - যদিও তারা শুকিয়ে কেমন লাল হয়ে গেছে আর তখনো শীতে কাঁপছে।
খেজুর গাছদুটোতে আর কোন পাতা অবশিষ্ট নেই। কয়েকদিন আগে কারা যেন গাছদুটোর সব ফল পেড়ে নিয়ে গেছে। তারও পরে দুটো ছোট ছেলে ঢিল ছুঁড়ে যে দুয়েকটা খেজুর অবশিষ্ট ছিল সেগুলোও পেড়ে নিয়ে গেছে। এখন গাছদুটোতে না আছে কোন পাতা, না আছে কোন ফল। তারা জানে বসন্তের গোলাপী ফুল মানে হচ্ছে এরপর হেমন্তের আগমনী, আর হেমন্তের পাতা ঝরে যাওয়া মানে হচ্ছে বসন্তের পদধ্বনি। ফলশূন্য গাছেদের পত্রশূন্য শাখাগুলো আকাশে আয়েশী ভঙ্গীতে হাত-পা ছড়িয়ে টানটান হয়ে আছে। খেজুরের কতগুলো লম্বা ডাল শক্তি হারিয়ে নুয়ে পড়ে তাদের শুকনো পাতার পরশ বুলিয়ে গাছের বাকলের পরিচর্যা করছে। লোকজন লাঠি দিয়ে আঘাত করে খেজুর পাড়ার সময় গাছের বাকলকেও ক্ষত-বিক্ষত করেছে। এই ডালগুলো যখন ইস্পাতের মতো দৃঢ়, সরল আর লম্বা ছিল তখন তারা অনায়াসে, নিঃশব্দে ঐ অদ্ভুত আর উঁচু আকাশটাকে ফুঁড়ে দিতে পারতো। তাতে আকাশটা আঁতকে উঠতো আর তার বুকে বিদ্যুৎ চমকে উঠতো। ডালগুলো এমনকি পূর্ণিমার চাঁদটাকেও ফুঁড়ে দিতে পারতো। তাতে চাঁদটা ধীরে ধীরে ম্লান আর রোগা হয়ে পড়তো।
আকাশটা আঁতকে উঠতে উঠতে নীল থেকে আরো নীল হয়ে যেতো। কেমন একটা অস্বস্তিতে পড়ে মানুষের পৃথিবী আর খেজুর গাছদুটোর হাত থেকে বাঁচার জন্য আকাশটা চাঁদটাকে পেছনে ফেলেই পালাতে চাইতো। চাঁদটাও তখন পূর্বদিকে লুকিয়ে পড়তো। আকাশ তার ছেনালীভরা চাহনী দিয়ে যতোই ভোলাতে চাক - নিরব, ইস্পাত-কঠিন, পত্রশূন্য ডালগুলো আজো আকাশকে ফুঁড়ে দিয়ে তার পার্থিব ক্ষতের একরকম প্রতিশোধ নিয়ে যায়।
সহসা একটা রাতজাগা পাখি আকাশচেরা ডাক দিয়ে উড়ে যায়। তখনই আমি মধ্যরাতের উল্লাসধ্বনি শুনতে পাই। আওয়াজটা তীক্ষ্ণ নয়, যেন সুপ্ত সবার ঘুম টুটে না যায়। তবু বাতাস সেই উল্লাসের প্রতিধ্বনি করে যায়। মধ্যরাত - কোথাও কেউ নেই। অবাক হয়ে অনুভব করলাম আমিও হাসছি, আমার ঘরে হাসিতে ভেঙে পড়ছি। আমি প্যারাফিনের প্রদীপ জ্বালালাম। জানালার শার্শিতে পোকাদের আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। জানালার ফোকর গলে তাদের কেউ কেউ ঘরেও ঢুকে পড়েছে। সেখান থেকে তারা আবার প্রদীপের চিমনীতে আছড়ে পড়তে লাগলো। তাদের একজন চিমনীর উপর দিয়ে আলোর শিখাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো - বুঝলাম শিখাটা প্রহেলিকা নয়। তাদের দু’তিনটে প্রদীপের কাগজের শেডটাতে বসে জিরোতে লাগলো। শেডটা গতকাল রাতে নতুন লাগানো হয়েছে। তুষার-ধবল শেডটার ভাঁজগুলো ঢেউয়ের মতো, তাতে রক্ত-লাল গার্ডেনিয়ার মতো ছোপ ছোপ।
যখন রক্ত-লাল গার্ডেনিয়ারা ফোটে, খেজুর গাছদুটো তখন উজ্জ্বল-সবুজ পাতায় ভরে যায়। আবারও তারা ছোট্ট গোলাপী ফুলের স্বপ্ন দেখে আর আমি তখন আবারও মধ্যরাতে উল্লাসধ্বনি শুনতে পাই। আমার চিন্তার রেশ টুটে গেলে কাগজের শেডের উপরের ছোট্ট সবুজ পতঙ্গটাকে দেখি। একটা গমের দানার অর্ধেক আকারের পতঙ্গটাকে সূর্যমুখীর বীজের মতো মনে হয়। অমনই বড় মাথা আর ছোট্ট লেজ তার। কি করুণ সবুজ রঙ তার, দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে।
হাই তুলে আমি একটা সিগারেট ধরাই, ধোঁয়া পাফ করি। এই প্রদীপ আর তার শেডে বসে থাকা অকুতোভয় সবুজ সংশপ্তকের প্রতি নিরব শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৪
১। প্রথম পর্ব পোস্টানোর পর দেখছি সোয়া দুই বছর পার হয়ে গেছে! বইটা আমার কাছে না থাকায় আর কোন পর্ব এতোদিন নামাতে পারিনি। কল্যানীয়েষু শুভাশীষ দাশ বইটা জোগাড় করে দিলে এই পর্বটা নামানো সম্ভব হলো। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। কামনা করি অচিরেই সে আবারও লেখালেখির তাগিদ অনুভব করুক।
২। গোটা বইটার রূপান্তর করার সদিচ্ছা আমার নেই। বাংলা ভাষায় এর একাধিক অনুবাদ আরও আগেই প্রকাশিত হয়ে গেছে। শুধুমাত্র কম বয়সে হাতে নেয়া একটা কাজের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই বিচ্ছিন্ন প্রয়াস।
৩। মূল চীনা (ম্যান্ডারিন) ভাষায় লেখা গদ্য কবিতাকে ইংরেজীতে অনুবাদ করার সময় তা বিশুদ্ধ গদ্যে পরিণত হয়েছে। আর এই ‘স্যুপের স্যুপ’ বাংলা রূপান্তরটা শিবের ঠ্যাঙও হয়নি - বিশুদ্ধ বাঁদর হয়েছে। বাংলা রূপান্তরের সময় নেয়া লেখকের স্বাধীনতার নামে যে যথেচ্ছাচার করা হয়েছে তার সম্পূর্ণ দায়ভার আমার।
মন্তব্য
সবজান্তার কাছ থেকে ল্যু স্যুনের অনুবাদ নিয়ে পড়েছিলাম একবার। ভালো লাগে নি।
আপনার এই লেখাসহ অন্যগুলোও পড়তে শুরু করলাম।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
চলুক
facebook
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
****************************************
হুম চলুক পাণ্ডবদা।
গদ্য কখনো কখনো কাব্যময় হয়ে উঠে, কবিতাও গদ্যময়। তবে কি, কবিতা কখনও গদ্য কিম্বা গদ্য কখনও কবিতা হয় না।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
একদম ঠিক! আমি আসলে বোঝাতে চেয়েছি যে, ইংরেজী অনুবাদ করার সময় গদ্যকবিতাগুলো গদ্যের মতো চেহারার একটা জিনিস হয়েছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কঠিন
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
নতুন মন্তব্য করুন