সাম্প্রতিককালের ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘সিংঘম’-এর হিন্দী ভারসান যারা দেখেছেন তারা হয়তো লক্ষ করে থাকবেন সেখানে একবার পুলিশের হাতে অপরাধীচক্রের এক সদস্য ধরা পরে। ইন্টারোগেশনে ঐ অপরাধী তার মাতৃভাষায় যা কিছু বলে তার কিছুই পুলিশ অফিসাররা বুঝতে পারেন না। তখন এক কনস্টেবল এগিয়ে এসে বলেন যে, ভাষাটা ‘তুলু’ এবং তিনি এই ভাষাটা জানেন। এই ভাষাটার নাম আগে কখনো শুনিনি। ভারত বহু ভাষার দেশ, সেখানে ‘তুলু’ নামে একটা ভাষা থাকতেই পারে। কিন্তু কোন জায়গার মানুষ এই ভাষায় কথা বলে? এই ব্যাপারে একটু আগ্রহী হয়ে খোঁজ নিতে দেখি সে এক বিরাট কারবার!
এগারোশ’ বছর আগে বান্ট ব্রাহ্মণরা এই এলাকায় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করলে বস্তুত তখনই তুলু নাড়ু স্বতন্ত্র রাজ্যের চেহারা পায়। বান্টরা আবার চার ভাগে বিভক্ত ছিল - মাসাড়িকা, নড়/নাড়াওয়া, পরিবার ও জৈন। বান্টরা মূলত যোদ্ধা ধরনের ব্রাহ্মণ হলেও হয়সালা রাজাদের প্রভাবে এদের এক গ্রুপ জৈন ধর্ম গ্রহন করে। এরাই জৈন বান্ট। ভারতের ইতিহাসে জৈন রাজবংশের দেখা খুব একটা মেলে না। তাছাড়া জৈন বান্টদের আরেকটা ইউনিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘আলিয়াসন্তানা কাত্তু’ বা ভাগিনেয় ধারা। অর্থাৎ এই প্রথায় পুত্রের সন্তানের পরিবর্তে কন্যার সন্তান ক্ষমতার উত্তরাধিকারী হবে। ভারতের ইতিহাসে বান্টরা ছাড়া শুধু কেরলের নায়ারদের মধ্যে ‘মাতৃধারা’ (মারুমাক্কাথায়াম) লক্ষ করা যায়। এর বাইরে ভারতের মাতৃধারার রাজবংশের আর কোন উদাহরণ নেই। পারস্য সম্রাট শাহ্ আব্বাসের কাছ থেকে শুনে ১৬২১-১৬২৫ সালে এই অঞ্চলে উপস্থিত হয়েছিলেন ইতালীয় পর্যটক পিয়েত্রো দেলা ভেল। পরে পিয়েত্রো দেলা ভেল লিখেছিলেন,
“কালিকট ত্যাগের আগে আমি এখানকার মানুষদের মধ্যে এক অদ্ভূত রীতি দেখতে পাই। হিন্দু নায়ার সম্প্রদায়ের মধ্যে কারো নির্দিষ্ট স্ত্রী নেই। বরং সব স্ত্রীলোক তাদের স্ত্রী বলে বিবেচিত হয়। যখন কোন পুরুষ কোন নারীর ঘরে প্রবেশ করে, তখন সে তার অস্ত্রটা দরজার বাইরে রেখে যায়। যাতে ঐ সময় অন্য কেউ ঘরে ঢুকে না পড়ে বা তাদের বিরক্ত না করে*। এই সব নারীদের ভরনপোষণ ঐসব পুরুষেরাই করে। সন্তানেরা সাধারণত জানে না বা জানতেও চায় না কে তার পিতা। মায়ের পরিচয়েই বংশপরিচয় নির্ধারিত হয়। সম্পত্তির উত্তরাধিকারও এভাবেই নির্ণিত হয়। একই নিয়ম রাজপুত্রগণ ও তাদের স্ত্রীদের জন্যও প্রজোয্য। রানি, যিনি আসলে রাজার বোন, সাধারণত প্রতিবেশী রাজাদের বিয়ে করেন। সন্তানধারণের জন্য তিনি স্বামীদের রাজ্যে যান। তার সন্তানেরা তাদের মামার রাজত্বের উত্তরাধিকার হিসাবে বিবেচিত হয়। এভাবে পিতা, মাতা উভয় দিক দিয়ে সন্তানের রাজরক্ত নিশ্চিত করা হতো। এই রানিরা তাদের স্বামীদের কাছে অত্যন্ত সম্মানের পাত্রী। তারপরও কোন রানি যদি চান তাহলে আনন্দের জন্য অন্য কোন পুরুষকে কামনা করতে পারবেন। রানি সাধারণত ব্রাহ্মণ বা তার স্বামীদের অমাত্যদের কাউকে কামনা করেন। এবং তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে কোন কানাকানি হয় না, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রও হয় না।“
(* মহাভারতে বর্ণিত, দ্রৌপদীর ঘরে কোন পাণ্ডব ঢুকলে সে তার জুতাজোড়া দরজার বাইরে রাখতো। যাতে অন্য পাণ্ডবরা বুঝতে পারে এখন ভেতরে যাওয়া যাবে না। একবার এক নালায়েক কুকুর ধর্ম্মপুত্রের জুতাজোড়াকে খাবার ভেবে নিয়ে ভেগে গিয়েছিল। পরে ইন্দ্রপুত্র বিনা নোটিশে ঘরে ঢুকে পড়ে সে কি হেনস্থা! ধর্ম্মপুত্র নাকি কুকুরকে এই বলে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে এই নালায়েকের জীবন অসম্মানের হবে। অবশ্য ধর্ম্মপুত্র পরবর্তীতে তার সঙ্গী কুকুরকে ছাড়া স্বর্গারোহনে অস্বীকৃতি জানান।)
আরব সাগরের তীরের তুলু নাড়ুর রাজ্য উলালের ক্ষমতায় ছিল জৈন বান্টদের চৌথারা। এই চৌথারা আবার কঠোরপন্থী জৈন ‘দিগম্বর’ সম্প্রদায়ের। পরিধেয় বস্ত্রকে পর্যন্ত যারা বাহুল্য মনে করে তারা কীভাবে রাজ্যক্ষমতা দখল করলো এটা একটা ধাঁধাঁ বটে। দ্বাদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত তারা নরমে গরমে এই এলাকা শাসন করেছে। চৌথাদের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজা হচ্ছে প্রথম তিরুমলরায় চৌথা (শাসনকাল ১১৬০-১১৭৯)। ১৪৭০-১৫১০ পর্যন্ত শাসন করা দ্বিতীয় ভোজরায় চৌথা হচ্ছে এই বংশের সবচে’ উজ্জ্বল তারকা। ১৮২২ সালে ব্রিটিশদের হাতে পঞ্চম চন্দ্রশেখর চিক্যরায় চৌথা’র পতনের মাধ্যমে চৌথাদের রাজত্বের অবসান ঘটে। এই লেখা চৌথা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা তিরুমলরায় বা চৌথাদের গর্ব ভোজরায় বা অপদার্থ চৌথা চন্দ্রশেখরকে নিয়ে নয়। এই লেখা ষোড়শ শতাব্দীতে উলাল শাসন করা রানি আব্বাক্কা চৌথাকে নিয়ে। তিনিই আমাদের তুলু রানি।
দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় তিরুমলরায় চৌথা’র সময় রানি ছিলেন তার বোন প্রথম আব্বাক্কা। তার মৃত্যুর পর রানি হন তারই কন্যা দ্বিতীয় আব্বাক্কা, যিনি ইতিহাসে ‘রানি আব্বাক্কা’ নামে পরিচিত। এই লেখায় আব্বাক্কা বলতে তাই তিরুমলরায়ের ভাগ্নী আব্বাক্কাকে বোঝানো হবে। রানি আব্বাক্কা ঠিক কোন সময়ে ক্ষমতায় আসেন সেটা নিয়ে মতভেদ আছে। কারো মতে তার আমল ১৫২৫ থেকে ১৫৭০ পর্যন্ত, কারো মতে ১৫৪৪ থেকে ১৫৮৬ পর্যন্ত, আবার কারো মতে ১৫৪৪ থেকে ১৫৯৮ পর্যন্ত। তবে বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ধারণা করা যায় ১৫২৫ থেকে ১৫৪৪ পর্যন্ত প্রথম আব্বাক্কা (মাতা), ১৫৪৪ থেকে ১৫৭০ পর্যন্ত দ্বিতীয় আব্বাক্কা (রানি আব্বাক্কা) এবং ১৫৭০ থেকে ১৫৯৮ পর্যন্ত তৃতীয় আব্বাক্কা (কন্যা) উলাল শাসন করেছেন।
ছোটবেলা থেকে মাতুল তিরুমলরায় আব্বাক্কাকে কুটনীতি, যুদ্ধাস্ত্র চালনা, যুদ্ধকৌশল, অশ্বারোহীবাহিনী চালনা, অসিচালনা ও ‘কালারিপায়াত্তু’র মতো মার্শাল আর্ট শিক্ষা দিয়েছিল। সে আব্বাক্কা’র বিয়ে দিয়েছিল ম্যাঙ্গালোরের বঙ্গ বংশীয় রাজা দ্বিতীয় নরসিংহ লক্ষ্মাপ্পা আরসা’র সাথে। তার আশা ছিল এতে ভবিষ্যতে উলাল আরো শক্তিশালী হবে। কিন্তু বিয়েটা বেশি দিন টেকেনি। দুই কন্যা নিয়ে আব্বাক্কা উলালে ফিরে আসলে লক্ষ্মাপ্পাতার বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে।
উলাল ছিল সমৃদ্ধ এক বন্দর। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে পণ্য, বিশেষত মশলা, নিয়ে আরব-আফ্রিকা-ইউরোপের দিকে যাত্রা করা জাহাজদের জন্য উলাল ছিল ট্রানজিট পয়েন্ট। স্বাভাবিকভাবেই পর্তুগীজ, ব্রিটিশ ও ওলন্দাজদের চোখ ছিল উলালের ওপর। তাদের প্রত্যেকেই চাইছিল এর নিয়ন্ত্রণ নিতে। ফলে উলালের ওপর ইউরোপীয়দের ছোট-বড় হামলা একটা নিয়মিত ঘটনা ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপীয়দের, বিশেষত পর্তুগীজদের, এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় রানি আব্বাক্কা চৌথার প্রবল প্রতিরোধের কারণে। এর আগে প্রথম আব্বাক্কার সময়েও একবার উলালের সাথে পর্তুগীজদের যুদ্ধ বাঁধলে তিনি পর্তুগীজদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। বোঝা যায় পর্তুগীজদের বিরোধিতা করার ব্যাপারটা রানি আব্বাক্কা তার মায়ের আমল থেকেই দেখে আসছেন। পর্তুগীজরা চাইছিল উলালকেন্দ্রিক মশলা বাণিজ্যের একচেটিয়াত্ব, একই সাথে ঐ অঞ্চল থেকে তাদের বেঁধে দেয়া অতি স্বল্প মূল্যে পণ্য কেনার অধিকার। কিন্তু আব্বাক্কা’র এতে একেবারেই সায় ছিল না। তিনি পর্তুগীজদের আশায় বাধ সাধলে পর্তুগীজরা তার বিরুদ্ধে মারমুখী হয়ে ওঠে। আব্বাক্কা ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে উলালের সবাইকে একত্রিত করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তার প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হিন্দু ও মুসলিম ছিল। পর্তুগীজদের প্রতিরোধের জন্য তিনি প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর সাথে মিলে জোট গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
বিয়ের পর রানি আব্বাক্কা রাজা লক্ষ্মাপ্পা’র সাথে বেশ কিছু দিন থাকলেও তাদের সম্পর্কটা মধুর ছিলনা। লক্ষ্মাপ্পা ছিল কাপুরুষ টাইপের। সে চাইতো পর্তুগীজদেরকে বাণিজ্য সুবিধা ও ভর্তুকি দিয়ে তাদের আক্রমণের হাত থেকে রাজ্য বাঁচাতে। অন্যদিকে আব্বাক্কা পর্তুগীজদের কোন বিশেষ সুবিধা বা ভর্তুকি দিতে একেবারেই নারাজ ছিলেন। এতে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। তাদের মধ্যকার ব্যক্তিত্বের সংঘাত যখন চরমে ওঠে, তখন আব্বাক্কা একদিন দুই কন্যা আর যাবতীয় ধন-রত্ম-গহনা নিয়ে নেত্রবতী নদী দিয়ে উলালের উদ্দেশ্যে পাল তুলে দেন। লক্ষ্মাপ্পা খবর পেয়ে তাঁকে ধরে আনতে বাহিনী পাঠায়। পলাতকা রানিকে ধরে এনে তার সামনে হাজির করা হয়। এরপর কী ঘটেছিল সেটা স্পষ্ট নয়। শুধু দেখা যায় শেষমেশ লক্ষ্মাপ্পা আব্বাক্কাকে উলালে ফিরে যেতে দেয়। তাদের বৈবাহিক সম্পর্কের এখানেই ইতি ঘটে।
উলালের শাসন ক্ষমতায় বসে আব্বাক্কা প্রথমে বেদনুরের কেলারী রাজা ভেঙ্কটপতি নায়েকের সাথে মৈত্রী গড়ে তোলেন যাতে ম্যাঙ্গালোর আক্রমণে তার সাহায্য পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে লক্ষ্মাপ্পা পর্তুগীজদের সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। বেদনুরের সাহায্যে আব্বাক্কা লক্ষ্মাপ্পাকে পরাজিত করেন, তার দুর্গ আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়। ঐ অঞ্চলে তখন দুই রাজ্যের মধ্যকার যুদ্ধে পরাজিত রাজাকে হত্যা না করা এবং তার রাজছত্রে আঘাত না করার রীতি থাকায় লক্ষ্মাপ্পা প্রাণে বেঁচে যায়। লক্ষ্মাপ্পার পরাজয়ের পর আব্বাক্কার সামনে মূল বাধা অর্থাৎ পর্তুগীজরা উপস্থিত হয়। এই সময়ে তিনি সুবিধাবাদী বেদনুরের উপর নির্ভর না করে মালাবারের মুসলিম মোপলা সম্প্রদায় আর কালিকটের যামোরিনদের সাথে জোট বাঁধেন। পর্তুগীজরা ছোট-বড় নানা রকম হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৫৫৫ সালে পর্তুগীজরা উলালের কাছ থেকে কর আদায়ের জন্য অ্যাডমিরাল দোম আলভারো দ্য সিলভিয়েরাকে পাঠায়। কিন্তু রানি পর্তুগীজদের কর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যুদ্ধে পর্তুগীজদের হারানো না গেলেও তাদের অগ্রযাত্রা ঠেকানো যায়। ১৫৫৭ সালে লুই ডি’ মেলো’র নেতৃত্বে পর্তুগীজরা ম্যাঙ্গালোর দখল করে ব্যাপক লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
পর্তুগীজরা যামোরিনদের সাথে উলালের মৈত্রী ও পারস্যের সাথে তাদের বাণিজ্যকে অবৈধ ঘোষণা করে। তাদের দাবি আরব সাগর দিয়ে বাণিজ্য করার একমাত্র অধিকার কেবল পর্তুগীজরা সংরক্ষণ করে। উলাল পর্তুগীজদের এ’সব অভিযোগ উপেক্ষা করে চললে ১৫৬৬ সালে জেনারেল খাওয়া পিশাতোর নেতৃত্বে পর্তুগীজরা আবার আক্রমণ চালায়। আব্বাক্কা তাদের বিরুদ্ধে মুসলিম ধীবর সম্প্রদায় বিয়ারী আর জনজাতি সম্প্রদায় মোগাবীর যোদ্ধাদের পাঠান। তাদের হঠাৎ আক্রমণে পর্তুগীজ ফ্রিগেট সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। এই পরাজয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে স্বয়ং পর্তুগীজ গভর্নর আন্তোনিও দ্য নোরোনহা মাঠে নামেন। পর্তুগীজরা প্রথমে সিন্দুক বোঝাই রূপা দিয়ে রানির কিছু বিশ্বাসঘাতক সেনানায়কদের কিনে নেয়। ফলে পরবর্তী যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আব্বাক্কার বাহিনী পরাস্ত হয়। পর্তুগীজরা উলালের রাজপ্রাসাদ দখল করে। রানি প্রথমে একটা মসজিদে আশ্রয় নেন। একই রাতে তিনি শ’দুয়েক যোদ্ধা নিয়ে পর্তুগীজদের অতর্কিতে আক্রমণ করে জেনারেল পিশাতোকে হত্যা করেন। সত্তর জন পর্তুগীজকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তী আক্রমণে তিনি ৫০০ মুসলিম সৈন্যের বাহিনী নিয়ে ম্যাঙ্গালোর দুর্গে থাকা অ্যাডমিরাল মাসকারেনহাসের বাহিনীকে পরাস্ত হরেন। যুদ্ধে মাসকারেনহাস নিহত হন। ফলে ম্যাঙ্গালোর তো বটেই উলালেও আবার আব্বাক্কার ক্ষমতা পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৫৬৯ সালের মধ্যে পর্তুগীজরা ম্যাঙ্গালোর আর কুন্দপুর আবার দখল করে নেয়। পর্তুগীজরা লক্ষ্মাপ্পা’র ভাগ্নে তৃতীয় কামরায়কে নিজেদের দলে টেনে নিয়ে তাকে ম্যাঙ্গালোরের মসনদে বসানোর লোভ দেখায়। মসনদ রক্ষার্থে নিরূপায় লক্ষ্মাপ্পা উলালের বিরুদ্ধে পর্তুগীজদের সাহায্য করতে প্রতিশ্রুত হয়। লক্ষ্মাপ্পার সহায়তায় পর্তুগীজরা বার বার উলাল আক্রমণ করতে থাকে। ১৫৭০ সালে আব্বাক্কা বিজাপুরের সুলতান প্রথম আলী আদিল শাহ্ আর কালিকটের যামোরিনদের সাথে আবার জোট গড়ে তোলেন। এই দফায় যামোরিন অ্যাডমিরাল দ্বিতীয় কুনহালী মারাক্কার কুট্টি পোক্কার আলী নিজেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে পর্তুগীজদের পরাস্ত করে ম্যাঙ্গালোর পুনর্দখল করেন। কিন্তু কালিকটে ফেরার পথে পর্তুগীজদের অতর্কিত আক্রমণে মারাক্কার নিহত হন। লক্ষ্মাপ্পার সাহায্যে পর্তুগীজরা আবারও উলাল আক্রমণ করে আব্বাক্কার বাহিনীকে পরাজিত করে। হেরে গিয়ে আব্বাক্কা কী করেন সেটা নিয়ে নানা মতভেদ আছে। কারো মতে রানি কারাগারে বিদ্রোহ করে কারারক্ষীদের সাথে সংঘর্ষে মারা যান, কারো মতে রানি পশ্চিমঘাট পার্বত্য অঞ্চলে পালিয়ে যান, আবার কারো মতে তিনি আত্মহত্যা করেন। এরপরেও ১৫৯৮ সাল পর্যন্ত উলালের শাসনকর্তা হিসাবে আব্বাক্কার নাম শোনা যায়। সম্ভবত এই আব্বাক্কা দ্বিতীয় আব্বাক্কার কন্যা, যিনি ১৫৮১ সালে পর্তুগীজদের সাথে যুদ্ধে একবার পরাজিত হন। বস্তুত পর পর তিন আব্বাক্কার শাসনামলেই পর্তুগীজদের সাথে উলালের প্রতিরোধ যুদ্ধ অব্যাহত থাকে।
পিয়েত্রো দেলা ভেল যার দরবারে হাজির হয়েছিলেন তিনি সম্ভবত প্রথম আব্বাক্কা। পিয়েত্রো যখন তাকে প্রাসাদের বাইরে প্রথম দেখেন তখন তার সাধারণ পরিধেয়, জুতাবিহীন খালি পা দেখে তাকে উলালের এক সাধারণ নারী মনে করেছিলেন। রানি তখন একটা সেচ প্রকল্প পরিদর্শন করে ফিরছিলেন। এই সাধারণত্ব তার কন্যা রানি আব্বাক্কার মধ্যেও ছিল। আব্বাক্কা অন্য রানিদের মতো সাদা রাজছত্র ব্যবহার করতেন না - তালপাতা বা সুপারী পাতা দিয়ে বানানো ছাতা ব্যবহার করতেন। আব্বাক্কা তৎকালীন দক্ষিণী যোদ্ধাদের মতো অগ্নিবাণ নিক্ষেপে পারদর্শী ছিলেন। এই অগ্নিবাণের আরও উন্নত সংস্করণ দেখা যায় ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধে টিপু সুলতানের বাহিনীর ব্যবহৃত মহীশুর রকেটে। আব্বাক্কা শুধু নিজেই যুদ্ধ করতেন না, তার সাথে তাঁর দুই কন্যাও সমান তালে যুদ্ধ করে গেছেন। দক্ষিণের লোককথায়, যক্ষাজ্ঞা পালায়, ভুত কোলা নৃত্যে আব্বাক্কার গাঁথা আজও আব্বাক্কা মহাদেবীর গল্প হিসাবে বর্ণিত হয়।
সাম্প্রতিক কালে স্থানীয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রানি আব্বাক্কাকে কিছুটা স্মরণ করা হলেও ভারতের ইতিহাসে তাকে ঝাঁসীর রানি, বেগম যিনাত মহল বা রানি ভবানী’র মতো স্বাধীনতাসংগ্রামীদের কাতারে জায়গা দেয়া হয়নি। এমনকি তাঁর সমসাময়িক কালের বিজাপুরের চাঁদ সুলতানা, যিনি মুঘল সম্রাট আকবরের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে পেরেছিলেন, তাঁর কাতারেও জায়গা দেয়া হয় না। এই জন্য আমরা আরও তিনশ’ বছর আগে দিল্লীর মসনদে বসা সুলতান রাযিয়ার নাম জানলেও রানি আব্বাক্কার নাম জানি না, তাঁর কীর্তি সম্পর্কে জানি না। তাঁর ইতিহাস যাচাই করার জন্য নির্ভর করতে হয় পর্তুগীজ বয়ানের ওপর। কিন্তু প্রায় তিয়াত্তর বছর ধরে চলা তিন তিন জন আব্বাক্কা ইতিহাসে এমন চাপা পড়ার কারণ কী?
ভারতের ইতিহাসের পাঠগুলো লক্ষ করলে দেখা যায় সেটা মূলত উত্তর ও পশ্চিম ভারতের এবং পূর্ব ভারতের কিয়দংশের ইতিহাস। সেখানে দক্ষিণ ভারত প্রায় এবং উত্তর-পূর্ব ভারত পুরোপুরি অনুপস্থিত। আর্যরক্তগর্বে গর্বিত উত্তরের মানুষের কাছে দক্ষিণের অনার্য দ্রাবিড়দের দেশ কখনো হচ্ছে রাক্ষসদের দেশ, কখনো বানরদের দেশ। আর উত্তর-পূর্ব হচ্ছে ডাকিনী-যোগিনীদের দেশ, বর্বর পাহাড়ীদের দেশ। তাই দক্ষিনের চোলা বা পল্লব সাম্রাজ্য ও কামরূপের বর্মণ বা ম্লেচ্ছ সাম্রাজ্যের ইতিহাস আমাদের পাঠ্যপুস্তকে দেখা যায় না। এ’কারণেই ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা দক্ষিণের সংগ্রামীদের খুব কম জনের নাম আমরা জানি।
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, ঐতিহাসিকদের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী। চৌথারা ভাগিনেয় ধারার রাজবংশ এবং সেখানে মূল নির্বাহী ক্ষমতা রানি’র হাতে থাকলেও তাদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে রাজাদের নামে। তাই আমরা চৌথাদের কালানুক্রমিক শাসনামল তিরুমলরায়, ভোজরায়, চন্দ্রশেখর চিক্যরায়দের নামে চিহ্নিত হতে দেখি -তাদের সময়কালের রানিদের নামে নয়। তিন আব্বাক্কা রানি’র গৌরবময় প্রতিরোধকালের ইতিহাসকে ঠিকভাবে বর্ণনা করতে গেলে স্বাভাবিকভাবে সমসাময়িক রাজাদের চেয়ে তাঁদের নাম বেশি ভাস্বর হবে। হয়তো সেটা এড়ানোর জন্য তিন আব্বাক্কা রানি’র সময়কালগুলোকে পর্যন্ত পৃথক করা হয়নি। এইক্ষেত্রে পর্তুগীজ ভাষ্যকারদের ওপর নির্ভর করা যায় না। তারা তিনজনকেই ‘বুকা দেভি’ হিসাবে বর্ণনা করেছে। অবশ্য তাদের কাছ থেকে এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না।
রানি আব্বাক্কা’র নাম না জানার আরেকটি কারণ হচ্ছে ধর্মবিশ্বাসে তিনি হিন্দু বা মুসলিম নন্। সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিকদের অনেকে একজন উপনিবেশিকতা বিরোধী বীর যোদ্ধা, যিনি জৈন ধর্মাবলম্বী, তাঁকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত হন। রানি আব্বাক্কা যেহেতু মুসলিম ছিলেন না তাই এক শ্রেণীর হিন্দু ঐতিহাসিকের মধ্যে তাঁকে হিন্দুভাবাপন্ন বা হিন্দু হিসাবে দেখানোর প্রবল চেষ্টা দেখা যায়। এই চেষ্টায় তাদের লেখা আব্বাক্কার ইতিহাস নানা রকম ধারণা, মীথ আর কল্পিত গালগল্পের চর্বিত-চর্বণে পরিপূর্ণ। কেউ তাঁকে সোমনাথেশ্বরের পূজারী হিসাবে দেখিয়েছেন, কেউ তাঁকে দেখিয়েছেন রুদ্রশিবের পূজারী হিসাবে, কেউ তাকে দেখিয়েছেন মহাদেবী হিসাবে।
গল্প ফাঁদা ঐতিহাসেকেরা তাঁকে যা খুশি বলুন সত্য হচ্ছে এই যে, ষোড়শ শতাব্দীতে আব্বাক্কা নামের উলালের তুলু রানিরা এই উপমহাদেশে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার প্রথম দিককার ছোবলের বিরুদ্ধে আমরণ লড়ে গেছেন, প্রতিরোধ করে গেছেন।
মন্তব্য
দারুন, খুব ভালো লাগলো।
তাহসিন রেজা
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
লাফাং ঘ্যাঁচাঙ
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
একদম অজানা কাহিনী। পড়াশোনা আজকাল একদম কমিয়ে দিয়েছি, তবু সিলেবাসের অনেক বাইরের জিনিস পড়িয়ে নিলেন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
কাহিনী আমারও অজানা ছিল। ছোট সুতা দেখে টানতে গিয়ে দেখি সে এক অজগর সাপ! পড়াশোনা শুরু করে দিন বস্! এর কোন বিকল্প নেই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নতুন কিছু জানতে পেয়ে ভালো লাগল। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
পোস্ট পড়া আর মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দারুন! সত্যি, পরিচিত ভারতীয় বীরাঙ্গনাদের চেয়ে তিনি কোন অংশেই কম নন, অথচ তাঁর সম্পর্কে তেমন উচ্চবাচ্য নেই। তাঁর ভাদাইম্যা স্বামীটার নামের উচ্চারন কি লক্ষনাপ্পা হবে? তুলু রাণীর একটা ছবি থাকা দরকার ছিল-
আব্দুল্লাহ এ.এম.
শাড়ি-ব্লাউজে তুলু-রানি = টি-শার্ট-জিনসে সিরাজুদ্দৌলা।
পিয়েত্রো দেলা ভেল বলছেনঃ
ভারতের সাধারণ নারীরা এখন যে ধরনের ব্লাউজ পরেন সেটা সম্ভবত ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের আবিষ্কার। অর্থাৎ, এই ব্লাউজের বয়স দেড়শ' বছরের কম। অবশ্য সেমিজ (বর্তমান অর্থে নয়, বরং স্লিভলেস ব্লাউজ + পেটিকোট অর্থে) পরার প্রচলন ছিল আরো আগে থেকে। আর পুরাকাল থেকে কাঁচুলী প্রচলিত ছিল।
ছবিতে তুলু রানি'র শাড়ি-ব্লাউজে অবাক হও কেন। পিটার ব্রুকের মহাভারতে দ্রৌপদী আর গান্ধারীকে দেখো। তাদের ড্রেস দেখলে তোমার জবান বন্ধ হয়ে যাবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দ্বিতীয় আব্বাক্কার স্বামীর নাম রাজা দ্বিতীয় নরসিংহ লক্ষ্মাপ্পা আরসা - লক্ষনাপ্পা নয়। তুলু রানি'র ছবি দিতে পারিনি কপিরাইট সংক্রান্ত ঝামেলা এড়ানোর জন্য। আপনি যে ছবি দিয়েছেন সেটা ব্যবহার করার অনুমতি কি আপনার আছে?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ছবি বলাই বাহুল্য ইন্টারনেট থেকে গৃহীত, সেখানে এ ছবির কপিরাইট বিষয়ে কোন কিছু বলা নেই। তা ছাড়া আমি তো এ ছবি বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছি না, সে ক্ষেত্রেও কি কপিরাইট সংক্রান্ত ঝামেলা আছে?
যে কোন ইতিহাস পান্ডু'দার হাতে পড়লে তা অত্যন্ত উপাদেয় হয়ে ওঠে। এটাও তার ব্যাতিক্রম নয়। আরো নতুন নতুন ইতিহাস জানার অপেক্ষায় রইলাম পান্ডু'দা।
আর ইতিহাসে উপেক্ষিত তুলু রানিদের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা !!
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ধন্যবাদ। আমি চেষ্টা চালিয়ে যাবো। কিন্তু গল্পের ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিয়ে তার ভোক্তাদের ভাতে মারার ব্যবস্থা করেছেন কেন?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
এক কথায় অসাধারণ
ডাকঘর | ছবিঘর
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।
ঠিক, এমন বীরকে আভূমি প্রণাম জানানোই যায়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ধন্যবাদ ষষ্ঠ পান্ডবদা। আপনার এবং সত্যপীর ভাইয়ের বদৌলতে ইতিহাসের ওপর পিঠটাও আমাদের দেখা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ইতিহাস পাঠ্যবইগুলো যে কেন এত নীরস ভাষায় লেখা হতো আল্লাহ মালুম। সন-তারিখে জীবন জেরবার হয়ে যেতো আর দেখলেই বুক কাঁপতো। এই ভাষায় লেখা হলে শুধু মুখস্থবিদ্যার উপর ভরসা করে পাশ করতে হতোনা।
ফারাসাত
প্রদত্ত শিক্ষা কী উদ্দেশ্যে দেয়া হচ্ছে, কী উপায়ে দেয়া হচ্ছে এই ব্যাপারগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যাপারগুলো বিচার করলেই বুঝতে পারবেন কেন আমরা ক্লাসে হাই তুলি, কেন শিক্ষকেরা পড়াতে গিয়ে বিরক্ত হন, কেন পরীক্ষাতে এতো টুকলিফাই চলে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমার মনে হয় প্রাক আর্য ভারতীয় উপমহাদেশের অনেকগুলো জনপদ 'মাতৃধারা'য় পরিচালিত ছিল, যাদের 'লাস্ট অব দা মহিকান্স' এর মত আব্বাকার কথা আমরা শুনলাম এখানে। ভৌগলিকভাবে সুবিস্তৃত ও সমাজ-সংস্কৃতি-আচার-ধর্মে সুপ্রথিত স্থানীয় মাতৃধারা ফিরে ফিরে আসে মহাভারতের দ্রৌপদিতে, রামায়নে শূর্পনখায়, অথবা কংস-কৃ্ষ্ণের লড়াইয়েও।
প্রশ্ন জাগে, উপমহাদেশের দেশগুলোতে প্রকারান্তরে ইচ্ছা/অনিচ্ছায় আজকে যে 'মাতৃধারা' প্রচলিত আছে, সেটা কি নিতান্তই কাকতালীয়? নাকি মজ্জাগতভাবে আমরা স্ত্রীশক্তির পুজারী?
ভালো প্রশ্ন। পৌরাণিক যুগ নিয়ে ঘাঁটতে চাই না, মহাজনপদ নিয়ে বকেয়া ঘাঁটাঘাঁটিটা শুরু করবো। তুলু নাড়ুতে রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের যে সাম্য-ব্যবস্থা ছিল সেটা ইতিহাসে অনিয়মিতভাবে অনেকবার ফিরে এসেছে। মেল শভিনিস্ট ঐতিহাসিকেরা যে সরকারগুলোকে 'পেটিকোট গভর্নমেন্ট' হিসাবে চিহ্নিত করেছেন সেগুলোকে একটু ভালোভাবে লক্ষ করলে তার সত্যতা বোঝা যায়। তবে প্রতিষ্ঠিত রীতি বা ধারা হিসাবে মাতৃধারা বা ভাগিনেয়ধারা আর কোথায় ছিল সেটা আরও খুঁজতে হবে। হিমালয়ান আমাজন উইম্যানদের দেশ কামাখ্যা দিয়ে শুরু করা যেতে পারে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
মেগাস্থিনিসের 'ইন্ডিকা' থেকেঃ
সাগর (বঙ্গপোসাগর) তীরের রাজ্যে রাজা না থাকা মহাজনপদকে নির্দেশ করে। Pandaean জাতি মাতৃধারায় শাসিত। অর্থাৎ, যে আমলে মহাজনপদ বিদ্যমান ছিল, সে আমলে কোথাও কোথাও মাতৃধারা বিদ্যমান ছিল।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অসাধারণ লাগলো। ইতিহাস জেনে এবং তার চাইতেও বেশি আড়ালে পড়ে যাওয়ার কারণ চিহ্নিতকরণের কারণে। এই প্রসঙ্গ অনেকেই এড়িয়ে যায়। ষষ্ঠপাণ্ডবের কাছে একটা অনুরোধ রইল, পুরানের দেবীদের যাদের শক্তির আধার হিসেবে দেখানো হয়েছে, বিশেষত কালি, দূর্গা, পেুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভিতরে হয়েও তারা কি করে দেবী হয়ে উঠলেন, এই বিষয়টা ইতিহাসের আলোকে আলোচনা করতে। কি এমন বিষয় তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক বলয় ছিঁড়ে েএই কজনকে দেবীর মর্যাদা দিচ্ছে? অন্য কেউও লিখতে পারেন।
ইতিহাসের পাঠ চমৎকাল লাগলো, যদিও চরিত্রগুলোর নাম খটমটো লেগেছে। মাথায় কতটা থাকে কে জানে। না থাকুক জানাতো হলো গর্ব করার মতো তুলু রানিকে।
স্বয়ম
ধন্যবাদ স্বয়ম। খুব ভালো পর্যবেক্ষণ আপনার। তবে পুরাণ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আমার নেই। এই ব্যাপারে যারা অথরিটি তাদেরকে, অর্থাৎ রণদীপম বসু, মাহবুব লীলেন আর প্রৌঢ় ভাবনা'কে অনুরোধ জানিয়ে গেলাম।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আপনার শেষ তিনটে পয়েন্টের প্রত্যেকটিতে সহমত। দক্ষিণি, অ-হিন্দু এক মহিলার অবদান মনে রাখে না আমাদের ইতিহাস। এই বায়াসগুলো আমাদের ইতিহাসে সব জায়গায় লুকিয়ে আছে। লেখাটার জন্য ধন্যবাদ।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন পাঠ পড়ে পড়ে আমি এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। আপনার এনডোর্সমেন্ট আমাকে শক্তি যোগালো। ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বাহ্, দারুণতো ! অনেক কিছু জানা হলো।
ধন্যবাদ। আপনার কাছ থেকেও আমাদের আরও অনেক কিছু শোনার ও জানার বাকি আছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
লাফাঙ ঘ্যাঁচাঙ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
খুব ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানতে পারলাম!
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দুর্দান্ত পোস্ট!
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, পাণ্ডব দা একখানা পোস্ট লেখার জন্য কতোগুলো রেফারেন্স বই পড়েন
facebook
আমার ও একই কথা মনে হয় - অসাধারণ সব পোস্ট - পান্ডবদা'র লেখা মানেই নতুন কিছু জানা বা পুরনো কিছুর সত্য দিকটা আবিস্কার - পান্ডব দা হাতে গোণা কয়েকজন ব্লগার এর একজন যার শুধু ব্লগ নয় মন্তব্য পড়েও শেখা যায়, জানা যায় অনেক কিছু - একজন ষষ্ঠ পান্ডব যুগে যুগে আসুক!
একটা পোস্ট লেখার জন্য আসলে বেশি বই ঘাঁটার দরকার হবার কথা না। কিন্তু গালগল্প, মিথ্যা বয়ান, উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা - এইসব আবর্জনা পরিষ্কার করতে গেলে যাচাই করা ছাড়া উপায় থাকে না। আর তাতে খাটাখাটুনিটা একটু বেড়ে যায়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দারুণ।
রাণীসাহেবার নেভির ব্যাপারটা ক্লিয়ার করেন পাণ্ডবদা। জেনারেল পিশাতোর বিরুদ্ধে রাণী "মুসলিম ধীবর সম্প্রদায় বিয়ারী আর জনজাতি সম্প্রদায় মোগাবীর যোদ্ধাদের পাঠান। তাদের হঠাৎ আক্রমণে পর্তুগীজ ফ্রিগেট সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়।" এই ফ্রিগেট পরাস্তকারী ধীবর সম্প্রদায় কি রাণীর রেগুলার নৌবাহিনী? জলে ক্ষমতা পোক্ত করার জন্যই কি যামোরিনদের অ্যালাই বানানো?
..................................................................
#Banshibir.
এখানে দুটো লক্ষণীয় বিষয় আছে।
এক, বিয়ারী, মোগাবীর, মোপলা বা এদের মতো আরও যারা ছিল তাদের যোদ্ধা গোষ্ঠীগুলো আসলে মার্সেনারি। এদেরকে যারা মটিভেট করতে পারতো এরা তাদের পক্ষ হয়েই যুদ্ধ করতো। এই প্রকার মার্সেনারি গ্রুপগুলোর সহায়তায়ই ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো থানা গাড়তে পেরেছিল। আব্বাক্কা রানি'র নিয়মিত নৌবাহিনী এতটা শক্তিশালী ছিল না যা পর্তুগীজদেরকে আরব সাগরে একাই ঠেকাতে পারে। যামোরিনদের সাথে মৈত্রীর উদ্দেশ্য সেটা। পশ্চিম ঘাটের পার্বত্য এলাকায় যুদ্ধে সুবিধা করার জন্য বিজাপুরের সুলতানের সাথে মৈত্রী করেছিলেন। আর উপকূল ও নদী অববাহিকায় যুদ্ধে সুবিধার জন্য (অ্যাম্ফিবিয়ান ফোর্স) বেদনুরের সাথে মৈত্রী করেছিলেন।
দুই, ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে খুব কমের প্রশাসন শক্তিশালী ছিল। কে যে কার দেওয়ানী মানে, কে যে কাকে কর দেয় আর কে যে কার গলা কাটে সেটা বোঝা মুশকিল। বড় মাপের সাম্রাজ্যগুলোও ছিল আসলে শিথিল কনফেডারেশন। বিদ্রোহ নিয়মিত ব্যাপার ছিল। তাই রেগুলার ফোর্স বলতে আমরা যা বুঝি সেগুলো আসলে কনফেডারেট ফোর্স ছিল।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমার পড়া থিয়োরী অনুসারে সারা ভারতে অসংখ্য এরকম "যোদ্ধা" - জাতি ছিল যাদের তুলনামূলক স্বাধীনতার বিনিময়ে আনুকূল্য অর্জন করেছিল ঔপনিবেশিকেরা। এসব অনেকটা ভারতের বর্ণাশ্রমের বাই-প্রোডাক্ট।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
একদম ঠিক। নিজেদের সীমিত/তুলনামূলক স্বাধীনতা, অর্থ-সম্পদ, ভূমি, সম্মান লাভের মোহ অথবা অহেতুক প্রতিশোধপরায়ণতার জন্য এমন ত্রিশটিরও বেশি তথাকথিত 'মার্শাল রেস' ভারতে ঔপনিবেশিকতা ত্বরান্বিত করেছে বা সহজ করেছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ইতিহাসের খোঁজ না নিয়ে খুব গর্বের সাথে ঐ'সব জাতি নাম নিজের নামের শেষে ব্যবহার করেন। অহেতুক কলহ এড়ানোর জন্য এর কোন উদাহরণ দিলাম না। মজার ব্যাপার হচ্ছে খোদ বান্টরাও শেষে এই গাদ্দার 'মার্শাল রেস'-এর দলে নিজেদের নাম লেখায়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দারুণ
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কত অজানারে । তুলু রানিকে
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আপনার ইতিহাসভিত্তিক এই লেখাগুলা খুব ভালো লাগে পাণ্ডবদা।
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
চমৎকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দাদা
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কত কী জানার আছে... ভাল লাগল
ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অনেক ধন্যবাদ, তুলু রানিকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য।
তুলু রানিকে আমার মনে ঠাঁই দিয়েছি, আপনার এই লেখা পড়ে। ভবিষ্যতে তুলু রানিকে আরো মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব আপনার এই লেখার সৌজন্যে।
ভালো থাকবেন।
আপনার মন্তব্যে আপ্লুত হলাম। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করলাম না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পড়ে খুব ভাল লাগলো, আমি জানতাম আমদের দেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে নৃতাত্তিক জনগোষঠীদের মাঝে মাএিতাত্তিক সমাজব্য্স্থা আছে কিন্তু রাজ্য আছে তা জানা ছিলনা, আপনা কে ধন্যবাদ এই অজানা কে জান্তে সাহায্য করার জন্য। আমার জানা যদি ভুল না হয়ে থাকে তবে মৌরয বংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা চান্দ্রগুপ্ত (রাজ্যকাল ৩২০-২৯৮ খৃষ্টপূব) ছিলেন যৈন ধরমের অনুসারী পরবরতীকালে তার স্নতান রাজা বিম্বিসার পিতার ধরম ত্যাগ করেন।
ভারতের অনেক জায়গায় (যেমন লাদাখ, উত্তর হিমাচল, উত্তর অরুণাচল) এখনো মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা আছে।
ঠিক, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মাত্র ৪২ বছর বয়সে তার পুত্র বিন্দুসার (অজাতশত্রু)-এর হাতে রাজ্যভার তুলে দিয়ে, হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে, জৈনগুরু আচার্য্য ভদ্রবাহুর শরণ নিয়ে শ্রাবণবেলাগোলা আশ্রমে চলে যান (বর্তমান কর্ণাটকের হাসান জেলায়)। চন্দ্রগুপ্ত কেন এমনটা করলেন সেটা ভিন্ন গল্প।
দুইটা তথ্য জানিয়ে দেই। এক, চন্দ্রগুপ্তের পুত্র বিন্দুসার ছিলেন অজীবক। এটিও জৈন ধর্মের অনুরূপ মতবাদ। হিন্দু পণ্ডিতেরা চার্বাক, অজীবক, জৈন ও বৌদ্ধ - চারটি পন্থাকেই নাস্তিকপন্থা বলে চিহ্নিত করেছেন। দুই, মগধরাজ বিম্বিসার হচ্ছেন মগধরাজ অজাতশত্রুর পিতা। সেটা মৌর্যদের আরো শ'দেড়েক বছর আগের কথা। বিম্বিসার ছিলেন বৌদ্ধ, কিন্তু অজাতশত্রু কি বৌদ্ধ ছিলেন নাকি জৈন ছিলেন সেটা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক আছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নতুন মন্তব্য করুন