ইতিহাস পুনর্পাঠ (১৪)

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: রবি, ০৯/১২/২০১২ - ৩:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৪.

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও ভারতের জনগণ ছাড়াও অন্য আরো অনেক দেশের অনেক মহৎহৃদয় মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই বৎসর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অমন অন্তত ৫৬৮ বিদেশী বন্ধুকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। ঐসব বিদেশী বন্ধুদের মধ্যে ৩৯ জন ব্রিটিশ নাগরিক। যাদের মধ্যে আমাদের পরিচিত জন স্টোনহাউজ, পিটার ডেভিড শো’র, জর্জ হ্যারিসন বা সায়মন ড্রিং আছেন। আজকে এমন একজন ব্রিটিশ নাগরিকের কথা জানবো যার ভূমিকা ১৯৭১ সালে ঐসব মহৎহৃদয় ব্রিটিশদের উল্টো রকমের ছিল।

গত ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০১২-তে পাকিস্তানের কুখ্যাত দালাল চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের মৃত্যুর পর ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার ভূমিকা নিয়ে নানা ফোরামে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সেখানে বর্ণিত দলিলগুলো থেকে আমরা জানতে পারি ১৯৭১ সালের ১৬ই এপ্রিল রাজা ত্রিদিব রায় তার ভগ্নিপতি কর্নেল হিউম, ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী এবং মুসলিম লীগ নেতা হজরত আলীসহ আরো কয়েকজন মুসলিম লীগারকে নিয়ে চট্টগ্রামের নতুনপাড়াস্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দপ্তরে পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে রাঙ্গামাটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা ঠেকাতে পাকিস্তানী বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। তাদের আলোচনায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঐদিনই ত্রিদিব রায়ের দল ঢাকা থেকে আসা একজন জুনিয়র অফিসারসহ পাকিস্তানী বাহিনীর অগ্রবর্তী দল নিয়ে রাঙ্গামাটিতে হাজির হয়। পরদিন সকালে স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের প্রধান মেজর জহির আলম খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানী বাহিনী রাঙ্গামাটি দখল করে নেয়। এই মেজর জহির ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করেছিল। ত্রিদিব রায় পাকিস্তানী বাহিনীকে শুধু সার্বিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়নি বরং তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী দল, ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস-এর কয়েকশ’ চাকমা সদস্য দিয়ে সক্রিয় সহযোগিতা করে। এদের সাথে ভারতের মিজো নেতা লালডেঙ্গার নেতৃত্বাধীন মিজো যোদ্ধাদের একটি ব্রিগেডও যোগদান করে। ত্রিদিব রায়ের সাহায্যে পাকিস্তানী বাহিনী ভারত থেকে আসা সদ্য ট্রেনিং পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলকে ধরতে পারে। ধৃত দলের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা আবদুস শুক্কুর, এস এম কামাল, শফিকুর রহমান, ইলিয়াস, মামুন ও ইফতিখারকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র ইফতিখারের সারা শরীর ব্লেড দিয়ে কেটে লবন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারপর তাঁকে একটা জীপের পেছনে বেঁধে সারা রাঙ্গামাটি শহরের ঊপর দিয়ে টেনে নিয়ে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানের এই বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯শে এপ্রিল বুড়িরহাটের প্রতিরোধ যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ শহীদ হন। এই যুদ্ধগুলোর প্রত্যেকটিতে পাকিস্তানী বাহিনীকে ত্রিদিব রায় ও তার বাহিনী সহযোগিতা করেছিল। এভাবে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ত্রিদিব রায় ও তার দল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে বিরুদ্ধ বাহিনী হিসাবে কাজ করেছে। ত্রিদিব রায়ের পরবর্তী ইতিহাস আমরা জানি এখানে সেটার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।

ত্রিদিব রায়ের ইতিহাসে একটি নাম স্বাভাবিকভাবেই ইতিহাসের পাঠককে আকৃষ্ট করবে সেটা কর্নেল হিউম। কে এই কর্নেল হিউম? কীভাবে সে রাঙ্গামাটিতে এলো, আর কীভাবে সে ত্রিদিব রায়ের ভগ্নীপতি হয়?

বৃটিশ নাগরিক জন অ্যাঙ্গাস হিউম ১৯১৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী সাদাম্পটনে জন্মগ্রহন করে। তার পিতা ক্যাপ্টেন রবার্ট হিউম ছিল একজন মাস্টার মেরিনার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে রবার্ট হিউম যখন চিকিৎসা জাহাজ এস এস ব্রিটানিকের চিফ অফিসার ছিল তখন ভূমধ্যসাগরে তার জাহাজ নিমজ্জিত হয়। পিতার মৃত্যুর পর জন হিউম প্রথমে রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ড স্কুলে পড়ে। পরে সে ভূমি জরীপের ওপর পড়াশোনা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৩৯ সালে সে টেরিটোরিয়াল আর্মিতে যোগ দেয়। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৪১ সালে সে সমারসেট লাইট ইনফ্যান্ট্রিতে কমিশনপ্রাপ্ত হয়। ৯ম বাহিনীর সদস্য হিসাবে তাকে সিরিয়াতে পাঠানো হয়। এই বাহিনীতে এক ডিভিশন ব্রিটিশ সেনা ও দুই ডিভিশন ভারতীয় সেনা ছিল। জন হিউমের পোস্টিং হয়েছিল মধ্য-পশ্চিম সিরিয়ার হামাহ্‌ শহরে। ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদের ছোট ভাই জেনারেল রিফাত আল আসাদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী এই হামাহ্‌ শহরেই অভিযান চালিয়ে প্রায় ৪০ হাজার আসাদ বিরোধীকে হত্যা করেছিল।

হামাহ্‌তে জন হিউমকে স্থানীয়দের কাছ থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয়। জন স্থানীয় গ্রামপ্রধান বা মুখতারদেরকে নানা কৌশলে হাত করতে থাকে। এভাবে মুখতারদের সহায়তায় জন সেনাবাহিনীর জন্য দরকারী খাদ্যশস্যের বিপুল ভাণ্ডার গড়ে তোলে। তার এই দক্ষতা ও সাফল্য তার ভবিষ্যত নির্ধারণ করে দেয়। ১৯৪৬ সালে বৃটিশ সরকার তাকে বাংলার পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪২-১৯৪৪) পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য বাংলায় নিয়োগ দেয়। এখানেও সে দক্ষতার সাথে নানা কৌশলে স্থানীয় জমিদার ও প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার গড়ে তোলে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের জন্ম হলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জন ব্রিটিশ আর্মি ছেড়ে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করে।

১৯৫১ সালে জন পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার নিযুক্ত হয়। ১৯৫২ সালে চাক্‌মা রাজা নলীনাক্ষ রায় চট্টগ্রামে মারা গেলে জনের ওপর দায়িত্ব পড়ে তার মরদেহ চট্টগ্রাম শহর থেকে রাঙ্গামাটিতে নিয়ে যাওয়া ও পরবর্তী চাক্‌মা রাজাকে ক্ষমতায় বসানো। এই সময়েই ত্রিদিব রায়ের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ১৯৫৩ সালের ২রা মে তাকে চাক্‌মা রাজা হিসাবে অভিষিক্ত হতে সাহায্য করে। সে বছরেই জন ত্রিদিব রায়ের বোন রাজকুমারী অমিতি রায়কে বিয়ে করে। এই দম্পতির ঘরে দুই জন পুত্র জন্মায়, এবং ১৯৬৩ সালে তাদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। পরবর্তীতে জন ত্রিদিব রায়ের আরেক বোন মৈত্রী রায়কে বিয়ে করে। এই দম্পতির ঘরে এক জন কন্যা জন্মায়, এবং এই বিয়ে জনের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত টিকে ছিল। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস থেকে রিপাবলিক হবার প্রাক্কালে জন অফিসার অভ ব্রিটিশ এম্পায়ার (ওবিই) খেতাবে ভূষিত হয়।

পাকিস্তান রিপাবলিক হবার পরও জন পাকিস্তান ছেড়ে ব্রিটেনে চলে যায় না, বরং সে স্থায়ী ভাবে রাঙ্গামাটিতেই থাকতে শুরু করে। পঞ্চাশের দশকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে রাজা ত্রিদিব রায় রাঙ্গামাটি এলাকার দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিষয়াবলীর বিচারকার্য নিজে নিজেই পরিচালনা শুরু করলে ঢাকা থেকে তাকে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করা হয়। এই সংক্রান্ত ব্যাপারে রাজার সাথে সরকারের সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হলে জন রাজার অবস্থানের সপক্ষে তার পদ থেকে পদত্যাগ করে। কিন্তু এরপরও সে রাঙ্গামাটিতেই থাকতে থাকে এবং নানা ধরনের কাজে নিযুক্ত ছিল যার বিস্তারিত জানা যায় না। রাঙ্গামাটিতে তখন খুব ভালো কোন চাকুরী পাওয়া যাবার কথা না, তাই শুধুমাত্র বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে জনের তখনকার রাঙ্গামাটির মতো পশ্চাদপদ এলাকায় অবস্থান একটু সন্দেহজনক। এই সন্দেহের ব্যাপারটি কেন সেটি বোঝার চেষ্টা করা যাক। তাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের মিজো গেরিলাদের পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করার ব্যাপারটিও পরিষ্কার হবে।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হবার কালে মেঘালয়, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ড অঞ্চল আসামের অন্তর্ভূক্ত ছিল। চল্লিশের দশকের শুরু থেকেই নাগা অধ্যুষিত অঞ্চলে আসাম থেকে আলাদা হবার আন্দোলন গড়ে ওঠে। দেশ স্বাধীন হবার আগেই নাগারা স্বাধীনতার দাবি তোলে। কিন্তু তাদের দাবি অগ্রাহ্য হওয়ায় দেশ স্বাধীন হবার পর নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিলের (এনএনসি)প্রধান আঙ্গামী জাপু ফিজো স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে। স্বাভাবিকভাবে ভারত সরকারের সাথে এনএনসি’র সশস্ত্র সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। ভারতের চিরবৈরী পাকিস্তান এই সুযোগ গ্রহন করে নাগাদেরকে সক্রিয় সহযোগিতা শুরু করে। ১৯৫৬ সাল নাগাদ ভারত সরকার এনএনসি’র বিদ্রোহীদের কোনঠাসা করে আনলে ফিজো ঢাকায় পালিয়ে আসে। পাকিস্তান সরকার তাকে পাকিস্তানী পাসপোর্ট দেয়, যা নিয়ে সে লন্ডনে পালিয়ে যায়। ১৯৯০ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত ফিজো লন্ডনেই ছিল। ১৯৫৬ সালের পরও পাকিস্তান সরকার নাগাদের সামরিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখে। পরবর্তী দশ বছরে নাগাদের ন্তত ১৭০০ জন বিদ্রোহীর আটটি ব্যাচ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়।

মনিপুরীদের একাংশ স্বাধীনতার লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে ২৪শে নভেম্বর ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (ইউএনএলএফ) গঠন করে। শুরু থেকেই ইউএনএলএফ-এর বিদ্রোহীদেরকে বার্মা (মায়ানমার) ও পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৫৯ সালে মিজোরাম জুড়ে বাঁশগাছে ফুল (মাউতাম) আসলে ‘ইঁদুর বন্যা’ শুরু হয় যার ফলে মিজোরামে অবধারিতভাবে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। ৪৮ বছর পর পর এই ঘটনা ঘটে থাকে। দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর ব্যাপারে ভারত সরকারের যথেষ্ট প্রস্তুতি না থাকায় মিজো জনগণ সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ে। ফলে তাদের মধ্যকার অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে ১৯৬১ সালের ২২শে অক্টোবর মিজো ন্যাশনাল ফেমিন ফ্রন্টের নেতা পু লালডেঙ্গা তার সংগঠনকে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টে (এমএনএফ) পরিণত করে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৬৬ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী রাত সাড়ে দশটায় লুঙ্গলেই সাব-ট্রেজারিতে আক্রমণের মাধ্যমে মিজোরা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। ভারত সরকার এই বিদ্রোহ দ্রুততার সাথে কঠোর হাতে দমন করে। এই ক্ষেত্রে ভারত সরকার প্রথম বারের মতো নিজ ভূখণ্ডে বিমান আক্রমণ পর্যন্ত চালায়। মার্চের ২৫ তারিখের মধ্যে ভারত মিজোরামকে এমএনএফ-এর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে সমর্থ হয়। লালডেঙ্গা তার প্রধান নেতাদেরসহ পূর্ব পাকিস্তানে পালিয়ে যায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হবার চেষ্টা করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে লালডেঙ্গার নেতৃত্বাধীন মিজোরা বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসাবে সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠলে ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষ নাগাদ লালডেঙ্গা বার্মা হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। আশির দশকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ পরিহার করে ভারত সরকারের সাথে আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করলে লালডেঙ্গা ভারতে ফিরে যাবার সুযোগ পায়।

পাকিস্তান গঠিত হবার পর থেকেই পাকিস্তান সরকার নিজ দেশে ভারতবিরোধী কার্যক্রমকে সক্রিয় সহযোগিতা দিয়ে আসছিল। বিক্ষুদ্ধ উত্তর-পূর্ব ভারত ছিল পাকিস্তানের কাছে ব্যাপক সামরিক সম্ভাবনাময় স্থান। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল পাকিস্তান সরকারের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট। জন হিউমের মতো সামরিক অফিসারকে তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে রাখা তাদের জন্য দরকার ছিল। জন ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ায় সে কিছুটা সন্দেহের তালিকার ঊর্ধ্বে থাকার কথা। ফলে ভারতের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া বা স্থানীয় হেডম্যান ও কার্বারীদের হাত করে প্রয়োজনীয় রসদ জোগানোর কাজে তাকে লাগানো সম্ভব ছিল। এটি দীর্ঘকাল তার পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করার কারণ হতে পারে। ত্রিদিব রায়ের সহযোগী হিসাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের পক্ষে তার ভূমিকা তার পাকিস্তানপ্রীতির পরিচয় বহন করে। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগের পর থেকে জন হিউমের কাজের দায় শুধুমাত্র তার ওপরেই বর্তায়। এর জন্য ব্রিটিশ সরকার বা ব্রিটেনের জনগণকে কোনভাবে দায়ী করা যায় না।

১৯৭১ সালে জন ‘পাকিস্তান টি অ্যাসোসিয়েশন’-এ কর্মরত ছিল। অসামরিক পদে কর্মরত থাকলেও পাকিস্তানীদেরকে রাঙ্গামাটিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে খতম করার ব্যাপারে সে উদ্যোগী ছিল। ত্রিদিব রায়ের ঘনিষ্ট থাকলেও ১৯৭১-এর নভেম্বরে তার শ্যালক তাকে ফেলে রেখেই পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কালে বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ (পারসোনা নন্‌ গ্রাটা) ঘোষণা করলে সে বাংলাদেশ ছাড়তে অস্বীকৃতি জানায়। নিরাপত্তা আইনে ১৯৭৩ সালে তাকে গ্রেফতার করা হলে সে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য হয়। জন ওমানে চলে যায়। ওমান সালতানাত তখন তাদের দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রদেশ জ্বোফারের বিদ্রোহীদের দমনে ব্যস্ত। এই গৃহযুদ্ধে ব্রিটেন সালতানাতের পক্ষ নিয়েছিল। ফলে জনের পক্ষে ওমান সালতানাতে কাজ জোটানো সহজ হয়।

১৯৭৬ সালে জ্বোফার বিদ্রোহ পুরোপুরি দমন করা হয়ে গেলে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ জনকে আর ওমান সালতানাতের আর দরকার ছিল না। ফলে ১৯৭৯ সালে জন পাকাপাকিভাবে লন্ডনে চলে যায়। এরপরে তার কার্যক্রম সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না। ২০০৫ সালের ২৮শে অগাস্ট ৯১ বছর বয়সে জন ব্রিস্টলে পরলোক গমন করে। ২০০৫ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর দুপুর একটায় ব্রিস্টলের ওয়েস্টবেরি’র কেনফোর্ড ক্রিমেটোরিয়ামে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

১৯৭১ সালে জনের ভূমিকা নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন আছে। আরও প্রয়োজন আছে ১৯৫৪-১৯৭১ সাল পর্যন্ত তার কার্যক্রম ও গতিবিধির বিস্তারিত জানা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বার্মা, মিজোরাম, ত্রিপুরা’র সাথে সীমান্ত আছে। তার দক্ষিণে সমূদ্রে বের হবার পথও আছে। সুতরাং স্ট্র্যাটেজিক বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের গুরুত্ব অনেক। পাকিস্তান সরকার শুরু থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে উত্তর-পূর্ব ভারতে অস্থিতিশীলতা ও যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরির যে অপচেষ্টাগুলো করেছিল সেগুলো আমাদের জানা থাকতে হবে। আমাদের নিরাপদ বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যই জন হিউমদের ইতিহাস জেনে সতর্ক থাকতে হবে।


মন্তব্য

স্যাম এর ছবি

অসাধারণ! জন হিউম এর নাম শুনেছিলাম চাকমা বন্ধুদের কাছে - কিন্তু খুব বেশি কিছু জানতাম না - অনেক ধন্যবাদ পান্ডব দা তথ্যপূর্ণ দারুন এই লেখাটির জন্য।

লালডেঙ্গা তো ব্যাপক কুফা চোখ টিপি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করবেন তাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে জন হিউম সম্পর্কে আর কোন তথ্য জানা যাবে কিনা। বিশেষত ১৯৭১ সালে তার অ্যাকটিভিটি সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য দরকার।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অরফিয়াস এর ছবি

ইতিহাসগুলো জানা প্রয়োজন। লেখার জন্য ধন্যবাদ পান্ডবদা।

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। নিজেদের দরকারেই ইতিহাসগুলো জানতে হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

তোমার ইতিহাস বিষয়ক লেখা বা মন্তব্যগুলো পড়ে অনেক কিছুই জানতে পারি। ধন্যবাদ জেনো পাণ্ডব।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। তোমার বিরল অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে লেখা পোস্ট থেকে আমরাও অনেক কিছু জানতে পারি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অমি_বন্যা এর ছবি

খুব দরকারি লেখা। জন হিউম সম্বন্ধে জানা ছিল না ।
অসংখ্য ধন্যবাদ পাণ্ডব দা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পোস্ট পড়া আর মন্তব্য করার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তারেক অণু এর ছবি

খুব দরকারি লেখা

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

লেখাটা দেবার উদ্দেশ্য হচ্ছে জন হিউম সম্পর্কে আর কেউ আরো বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেন কিনা সেটা। এখনো অনেক কিছু জানা বাকি রয়ে গেছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তানিম এহসান এর ছবি

ধন্যবাদ পাণ্ডবদা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পোস্ট পড়া আর মন্তব্য করার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দুর্দান্ত এর ছবি

কিছু প্রশ্ন করি।

"বছরে নাগাদের ন্তত ১৭০০ জন বিদ্রোহীর আটটি ব্যাচ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়।"

তারাও কি 'মুক্তিযোদ্ধা' নয়? মিজোদের মোটিভ তো বাংলাদেশীদের মতই ছিল। পার্থক্য একটাই, ওদের ঊবানের মত ভারতীয়র বদলে জিয়া-তাহের-এরশাদের মত পূর্ব পাকিস্তানী স্পেশাল ওয়ারফেয়ার স্পেশালিস্টেরা প্রশিক্ষন দিয়েছে।

***

ধরা খাওয়ার পরে নিজেদের লোককে ব্রিটেন ওমানে 'বদলী' করে নিয়ে গেল, তারপরেও ৭১ এ হিউমের কীর্তিকলাপে ব্রিটেনের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই বলছেন? হিউম যে রাঙ্গামাটির র‍্যাম্বো ছিলনা, সেটা কিভাবে নিশ্চিত হই? ঐ সময়ে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম-মিজোরাম-নাগাল্যান্ড এলাকায় আমেরিকান/ব্রিটিশ স্যাল্ভেশান আর্মির বা কেয়ার-ইউএসেইডের কর্মততপরতা খেয়াল করেন। সিকিমে তো ওরা খোলাখুলিভাবে আমেরিকান-বেলজিয়ান মেয়ে এজেন্টদের লেলিয়ে দিয়েছিল রাজা-রাজপুত্রদের ঘায়েল করতে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১. এমএনএফ-এর বিদ্রোহ, সহিংসতা বিশেষত ১৯৬৬ সালের মার্চের ঘটনাবলীকে কি ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বলা যায়? এই ব্যাপারে আমার দ্বিধা আছে। দ্বিধা বলছি এই জন্য যে, এমএনএফ-এর ভাষ্যগুলো বিস্তারিত জানতে পারিনি। তবে ভারতীয় সোর্সগুলোর বাইরে অন্য নিরপেক্ষ সোর্সগুলো থেকে যা জানতে পারি তা হচ্ছেঃ

(ক) ভারতের স্বাধীনতার আগে (১৯৪৬-১৯৪৭) বৃহত্তম মিজো রাজনৈতিক সংগঠন মিজো কমন পিপলস্‌ ইউনিয়ন ‘গোপীনাথ বরদলুই কমিশন’-এর কাছে মিজো অধ্যুষিত সকল এলাকাকে ভারতের অন্তর্ভূক্তির জন্য দাবি করেছিল। দ্বিতীয় বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড মিজো ফ্রিডম অরগানাইজেশন স্বাধীনতার পর মিজো অধ্যুষিত লুসাই হিলস্‌ এলাকাকে বার্মা’র অন্তর্ভূক্তির দাবি করেছিল। সুতরাং মিজোরা মনিপুরীদের মত প্রথম থেকে স্বাধীনতা চেয়ে এসেছিল ব্যাপারটা এমন নয়।

(খ) স্বাধীনতার পরও মিজো ইউনিয়ন বা ইউনাইটেড মিজো ফ্রিডম অরগানাইজেশন কখনও স্বাধীনতার দাবি তোলেনি। তারা ভারতের ভেতরে আসাম থেকে স্বতন্ত্র মিজো রাজ্য - ‘মিজোরাম’-এর দাবি করতো মাত্র।

(গ) ১৯৫৯ সালের মাউতম-এর সময় গঠিত মিজো ন্যাশনাল ফেমিন ফ্রন্টও শুরুতে স্বাধীনতার দাবি তোলেনি। সংগঠনের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৬১ সালের ২২শে অক্টোবর লালডেঙ্গা মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও তার আন্ডারগ্রাউন্ড আর্মড ফোর্স গড়ে তোলে। মিজো ন্যাশনাল ফেমিন ফ্রন্টের যে জনপ্রিয়তা ছিল সেটা যে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টেরও ছিল তা কিন্তু নয়। ১৯৬৬ সালের ঘটনায় সাধারণ জনসাধারণের অংশগ্রহন ছিল না - যেটা একটা যুদ্ধের সাথে মুক্তিযুদ্ধের পার্থক্য গড়ে দেয়।

(ঘ) এমএনএফ স্থানীয় চাক্‌মা জনগোষ্ঠীর সাথে শুরু থেকে বৈরি আচরণ করেছে। ১৯৬৬ সালের ঘটনায় তারা চাক্‌মা অধ্যুষিত অঞ্চলে হামলা চালিয়ে হত্যা-লুটপাটের ঘটনাও ঘটিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা এমনটা করার কথা না। ভারত থেকে আলাদা হতে চাইলে তারা মিজোদের মধ্যে রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ার সাথে সাথে স্থানীয় চাক্‌মাদেরকেও নিজেদের দিকে টানতো। কিন্তু তারা এই দুইটি কাজের একটিও করার চেষ্টা করেনি।

(ঙ) লালডেঙ্গা আইয়ুব খানের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে পাকিস্তানের অফিসিয়াল সমর্থন আদায় করার চেষ্টা করেনি।

(চ) ১৯৬৬ সালের ঘটনার পর থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত সাধারণ মিজো জনগণ এমএনএফ-এর হুমকি-চাঁদাবাজি-হামলা আর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোরতার শিকার হয়েছে। এমএনএফ সাধারণ মিজো জনগণকে এই দুর্গতি থেকে রেহাই দেবার চেষ্টা না করে সেই আগুনে কেবল ঘি ঢেলে গেছে।

২. নাগাদের ‘নাগালিম’-এর জন্য আন্দোলনকে বরং স্বাধীনতার আন্দোলন বলা যায়। এক্ষেত্রে ন্যাশনাল সোশালিস্ট কাউন্সিল অভ নাগাল্যান্ড (এনএসসিএন)-এর অবস্থান বরং অনেক বেশি জনগণের কাছাকাছি ছিল। তবে বিপুল পরিমাণ সাধারণ জনগণের সমর্থন অর্জনের আগেই ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেয়াটা তাদেরকে বেকায়দায় ফেলেছিল। ১৯৫৬-১৯৬৬ সময়কালটিতে নাগারা মূলত চীন ও পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক দাবা খেলার বোড়ে হয়ে পড়েছিল। এই সময়ে বছরে গড়ে ১৭০ জন যোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে পাকিস্তান নাগালিমের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করেছে এমনটা ভাবার উপায় নেই। ১৭০ জন দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো যায়, মুক্তিযুদ্ধ নয়। তাছাড়া ১৯৬০ সালের জুলাইতে নাগা পিপলস্‌ কনভেনশনে বেশিরভাগ রাজনৈতিক গোষ্ঠী ‘নাগাল্যান্ড’ রাজ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমে ‘নাগালিম’-এর দাবি থেকে সরে এসেছিল।

৩. কেয়ার, ওয়ার্ল্ড ভিশন, স্যালভেশন আর্মি, ইউএসএইডের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে নয়া সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপের অভিযোগ উত্থাপন নতুন কিছু নয়। তবে তারা ভারতের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতার আগুনে জ্বালানী যুগিয়ে গেছে এমনটা প্রমাণ করা কঠিন। স্বাধীন ভারত বা পাকিস্তান কখনোই যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের পক্ষ্মপুটের বাইরে যাবার চেষ্টা করেনি। ভারতের সোভিয়েতঘেঁষা পথচলাও যুক্তরাষ্ট্রকে না চটিয়েই করা হয়েছে। সিকিমে যা কিছু করা হয়েছিল সেটা ভারতের স্বার্থ রক্ষার্থে। সুতরাং হিউম র‍্যাম্বো হয়ে থাকলেও সেটা পাকিস্তান-চীনের ফেভারে। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য ভারতবিরোধী এমন অপারেশন চালানোর কথা না। আর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান যুক্তরাজ্যকে তার খুব বড় মিত্র হিসাবে পায়নি। সেটা হলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে লন্ডনে এতো রাজনৈতিক তৎপরতা, অর্থসংগ্রহ - এ’সব সম্ভব হতো না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কাজি মামুন এর ছবি

লেখাটি পড়ে অনেক কিছু জানলাম, পান্ডবদা! যেমনঃ
(১) পাকিস্তান তার জন্মলগ্ন থেকেই ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা দিয়ে আসছে, যে কাজ তাদের বাংলাদেশি বশংবদেরাও করে যাচ্ছে আন্তরিকতার সাথে।
(২) খারাপ লোকের দোস্তি আসলে কোন জাত মানে না। নইলে জন হিউম, পাইক্কা মেজর জহির আর ত্রিদিব রায় - তিনজন তিন জাতের হলেও কি সুন্দরভাবে এক জোট হয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইফতেখারের সারা দেহ ব্লেড দিয়ে কেটে লবন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারপর তাকে একটি জিপের পেছনে বেধে সারা রাঙ্গামাটি শহরে টেনে হত্যা করা হয়।

শিউরে উঠলাম। সবচেয়ে দুঃখজনক হল, আজও এক নব্য রাজাকারের আস্ফালন শুনতে হয়েছে। সাঈদির আশু বিচারের সংবাদে আনন্দ প্রকাশ করায় সে হুমকি দিচ্ছিল যে, আওয়ামী লিগারদের সে ধোলাই দেবে। বলাই বাহুল্য, রাজাকার বিরোধীরা তার কাছে আওয়ামীলিগার হিসেবেই পরিচিত।
অসাধারণ তথ্যে ভরপুর লেখাটির জন্য অনেক সাধুবাদ। তবে কিছু প্রশ্ন রয়ে গেলঃ
(১)জন হিউম ত্রিদিব রায়ের এক বোনের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর আরেক বোনকে কি করে বিয়ে করতে পারলেন? ত্রিদিবের পরিবার এতে সম্মতি দিয়েছিল?
(২) জন হিউমকে শাস্তি দেয়া হয়নি কেন? বিদেশী বলে সে মাপ পেয়ে গিয়েছিল?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পোস্ট পড়া আর মন্তব্য করার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনার প্রশ্নের উত্তরঃ

১। অমিতি রায় আর মৈত্রী রায় সহোদরা কিনা সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তবে ত্রিদিব রায়ের রাজা হওয়া ছাড়াও সম্ভবত অন্য আরও কিছু বিষয়ে জন হিউমের ওপর তাদের নির্ভরতা ছিল। তাই এই পলিটিক্যাল ম্যারেজ সম্ভব হয়েছিল। এমনসব ব্যাপার না থাকলে অমিতি রায়ের সাথে বিয়েটাই তো হবার কথা না।

২। ১৯৭১ সালে জন হিউম পাকিস্তানী সেনা বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানানোর ঘটনাটি ছাড়া কোন যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন, হত্যা-লুটপাট-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ জাতীয় ঘটনায় জড়িত ছিল বলে কোন তথ্য পাইনি। তাছাড়া যেখানে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস-এর কয়েকশ’ চাকমা সদস্য যারা সরাসরি পাকিস্তানীদের সহযোগী হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তারাই মাফ পেয়ে গেছে সেখানে জন হিউম এক ফাঁকে পার পেয়ে যাওয়া বিচিত্র কী।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রংতুলি এর ছবি

আপনার কল্যাণে অনেক অজানা অথচ জরুরি ইতিহাস জানলাম পাণ্ডবদা, ধন্যবাদ নিয়েন!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পোস্ট পড়া আর মন্তব্য করার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কৌস্তুভ এর ছবি

পাণ্ডবদা অ্যাজ ইউজুয়াল গুরু গুরু

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। আজকাল তোমার পোস্ট পাচ্ছি সে'কথা সত্য; তবে এগুলো নয়, গোনাগুনতি নিয়ে তোমার লেখার অভাব অনুভব করি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দিগন্ত এর ছবি

সুন্দর ও সহজপাচ্য লেখা। অনেককিছু জানা গেল হাসি


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

অনেক অজানা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস জানতে পারলাম। খুব ভালো লাগলো পাণ্ডবদা।
সঠিক ইতিহাস সবার জানা প্রয়োজন।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যেটা ভুল, সেটা ইতিহাস নয়। হয় সেটা গল্প, নয়তো মিথ্যাচার।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ, অনেক অজানা তথ্য জানা হল।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

ইতিহাসের দারুণ মাস্টার আপনি। অনেক কিছু জানি আপনার কাছ থেকে পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমি মাস্টার তো দূরে থাক, ইতিহাসের ছাত্রও না। আমি ইতিহাসের পাঠক মাত্র।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রানা মেহের এর ছবি

চম‌তকার লেখা পান্ডব দা

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

রানা মেহেরের অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে মনে হচ্ছে! কে করলো? বিস্ময় নিরিখ নাকি?!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।