গল্প প্রচেষ্টা-২৩

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: বুধ, ২৩/০১/২০১৩ - ১২:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সমান্তর প্রগমন

ঘুমের মধ্যে ইফতেখার শুনতে পায় কে যেন তাকে ডাকছে, “এ্যাই বাবু ওঠ্‌! ওঠ্‌!!" ডাক শুনে তার ঘুম টুটে যায়, দেখে ডাকছে তার বড় বোন। ঘরে আলো জ্বলছে, বোনের মুখে ব্যাপক উদ্বিগ্নতা, একটু কান্নাকাটিও করেছে বোধহয়। অসময়ে ঘুম ভাঙানোতে তার ঘুম থেকে উঠেই বড় বোনের মুখ দেখে ইফতেখারের মনটা তেতো হয়ে যায়। এই মেয়েটাকে ইফতেখার একেবারে সহ্য করতে পারে না। অসম্ভব লোভী, স্বার্থপর আর কুচুটে একটা মেয়ে। নিজের পছন্দের জিনিস দুই হাতের জায়গায় দশ হাতে আদায় করে নেয়, প্রাপ্যের চেয়ে অনেকগুণ বেশিই আদায় করে। আর অন্য কেউ তার নিজের পছন্দের কথা বললে ‘কেন সেটা তার প্রাপ্য নয়’ — সেই ব্যাপারে বোন তার লম্বা-চওড়া নীতিকথা শোনাতে শুরু করে। এতে একসময় ন্যায়সঙ্গত প্রার্থী বিপন্ন বোধ করতে থাকে, এবং পিছু হটে যায়। এই সময় সে বেশ গর্বের সাথে বলতে থাকে কীভাবে সে সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করেছে।

লোকে বলে বোনের বিয়ে হয়ে গেলে ভাইরা নাকি প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে ব্যাপক কান্নাকাটি করে। ইফতেখার নিশ্চিত বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেলে সে কান্নাকাটি করা দূরে থাক, কতগুলো বিষয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে! কিন্তু বিপদের কথা হচ্ছে, বোনের বয়ফ্রেন্ডটা একটা আস্ত মাকাল ফল — যার একমাত্র কাজ দিনমান মোটরসাইকেলে করে এ’পাড়া ও’পাড়া চক্কর মারা। মাঝে কিছুদিন তার বাবা তাকে কাজ করতে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। তার ছয় মাসের মাথায় সে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। বোন নিজেকে গভীর প্রজ্ঞাসম্পন্ন, অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী বলে জাহির করলেও বয়ফ্রেন্ড বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সে বিশুদ্ধ হাঁদার পরিচয় দিয়েছে। এখন এই মাকাল ফলকে বিয়ে করলে অচিরেই যে সে তার বরসহ (হয়তো সাথে দুয়েকটা বাচ্চাসহ) এই বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করবে সেই ব্যাপারে ইফতেখারের কোন সন্দেহ নেই।

— ব্যাপার কী, ডাকছো কেন? তোমার বিছানায় তেলাপোকা নাকি টিকটিকি? নাকি ঘরে বেড়াল ঢুকেছে?
— ওসব কিছু না। বাবার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে।
— কখন থেকে?
— ঘন্টা দুই হবে।
— এখন কয়টা বাজে?
— রাত সোয়া একটার মতো।
— গ্লিসারিন নাইট্রেট ট্যাবলেট দিয়েছ?
— ঘরে গ্লিসারিন নাইট্রেট নেই।

ইফতেখারের মেজাজ চড়ে যায়। সব সময় দেখা যায়, যেদিন বাসায় গ্লিসারিন নাইট্রেট ট্যাবলেট থাকে না সেদিনই বাবার ব্যথা ওঠে। বিশেষত পরবের দিনগুলোতে যখন হাটবাজার প্রায় বন্ধ থাকে তখন এই ঘটনা আরো বেশি ঘটে। এখন এই গভীর রাতে ওষুধ কোথায় পাওয়া যাবে! এই মহল্লাতে কয়েকটা ওষুধের দোকান আছে বটে, তবে তারা মাথাব্যথা-পেটের গোলমাল-অম্বল-জ্বর-সর্দিকাশি ইত্যাদি সাধারণ অসুখের ওষুধ, পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী এ’সব রাখে। যে দোকানে যে ডাক্তার বসেন সে দোকানে ঐ ডাক্তারের পছন্দের ওষুধগুলো মেলে। অবশ্য এই মহল্লাতে কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বসেন না। তাই বিশেষায়িত রোগের ওষুধও এখানে মেলে না। শোনা যায়, ডাক্তার বসেন না এমন সব ওষুধের দোকানে নাকি ফেন্সিডিল জাতীয় নেশার ওষুধ আর কুদরতী ট্যাবলেট-ক্যাপসুল-মালিশ পাওয়া যায়। ইফতেখার অবশ্য ওসবের কোনটা কখনো চেষ্টা করে দেখেনি, তাই কথাটা সত্যি কিনা তা তার জানা নেই।

মহল্লার কোন দোকানেই যে ওষুধটা মিলবে না সেটা ইফতেখার জানে। তাই ঐ সব দোকানের কাউকে ডাকাডাকি করে দোকান খোলানো মানে সময় নষ্ট করা। অতএব তাকে যেতে হবে নতুন হাসপাতাল এলাকা পর্যন্ত। সেখানে নতুন হাসপাতাল ছাড়া বেশ কয়েকটা প্রাইভেট ক্লিনিক থাকায় কিছু ওষুধের দোকান সারা রাত খোলা থাকে। কিন্তু নতুন হাসপাতাল পর্যন্ত যাবার উপায়টা কী? এই বাসায় কারো মোটরসাইকেল বা বাইসাইকেল নেই, গাড়ি থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। এত রাতে রিকশা পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। বিরক্তিতে গজ্‌গজ্‌ করতে করতে কাপড় পালটে বাবার ঘরে ঢুকতে ইফতেখার ভয় পেয়ে গেল। বিছানাতে বালিশ উঁচু করে বাবাকে শোয়ানো হয়েছে। তিনি মুখ হাঁ করে বোয়াল মাছের মতো নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করছেন। ঘরে সাঁই সাঁই করে ফ্যান চললেও ঘামে তার কপাল, মুখ, গলা, বুক ভিজে যাচ্ছে। ছোট বোনটা একটা গামছা দিয়ে বাবার ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছে আর কষ্টে নিজের চোখের পানি চাপছে। মা যথারীতি বাবাকে বকাবকি করে যাচ্ছেন খাওয়াতে আর শোবার কায়দায় বাবা কী কী অনিয়ম করেছেন সেসব নিয়ে। ইফতেখারের মন বললো, এই কেস গ্লিসারিন নাইট্রেট-এ সমাধা হবার নয়। কিন্তু হাসপাতালে যাবার জন্য গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করা নিয়ে নিয়ে যে বিরাট হাঙ্গামা পোহাতে হবে আর ইমার্জেন্সীতে ডাক্তার খুঁজে পাওয়া আর চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য যে রঙ্গ সহ্য করতে হবে তার কথা ভেবে ওষুধের খোঁজে যাওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করলো। ঘর থেকে বের হবার মুখে বড় বোন তার দিকে নিঃশব্দে একটা একশ’ টাকার নোট বাড়িয়ে দেয়। টাকাটা প্যান্টের ডানদিকের সাইড পকেটে পুরতে পুরতে ইফতেখার চপ্পল পড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে।

শুনসান গলিটা পার হয়ে বড় রাস্তায় আসতে দেখা গেলো সেটার অবস্থাও তথৈবচ। রিকশা দূরে থাক, একটা মানুষ বা কুকুর পর্যন্ত নেই। স্ট্রীটলাইটের এক আধটা জ্বলছে, দুয়েকটা দপ্‌দপ্‌ করছে, আর বাকিগুলো চোখবন্ধ করে অনন্তঘুমে ঘুমিয়ে আছে। নিজের দুর্ভাগ্যকে শাপশাপান্ত করতে করতে ইফতেখার পা চালিয়ে হাঁটে। অল্প দূরে যেতেই তার উরু আর পায়ের পেশী মুচড়ে ব্যথা করে ওঠে, নিকোটিনে দংশিত ফুসফুস ফেটে যেতে চায়। এমন সময় পেছনে টিং টিং করে সাইকেলের ঘন্টি বেজে ওঠে। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের ফর্সা, মোটা গোঁফ, ভারী জুলফিওয়ালা সাইকেল আরোহী ইফতেখারের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাঁ পায়ে ভর দিয়ে সাইকেল থামিয়ে জিজ্ঞেস করে,

— কোথায় যাবেন?
— নতুন হাসপাতালের দিকে। জরুরী ওষুধ দরকার।
— পেছনে উঠে পড়ুন।
— না, আপনি আবার কোন দিকে যাচ্ছিলেন। খামাখা আপনার অসুবিধা হবে। আমি রিক্‌শা খুঁজে নেবো’খন।
— না, না অসুবিধা হবে না। আমি যাচ্ছি মাত্‌লা ঘাটের দিকে। আপনাকে নতুন হাসপাতালের কাছে নামিয়ে দিতে কোন অসুবিধাই হবে না। যাবার পথে এই সময়ে রিক্‌শা পাওয়া মুশকিল আছে, তবে ফেরার পথে হাসপাতালের সামনে রিক্‌শা পেয়ে যাবেন।

সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা ঠিক হবে না ভেবে ইফতেখার দ্বিরুক্তি না করে অপরিচিত লোকটির পেছনে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে পড়ে। সাইকেল সাঁই সাঁই করে বাতাস কেটে আধো অন্ধকার রাস্তায় ছুটতে থাকে। ভদ্রতাবশত ইফতেখারই কথা বাড়ায়। বাতাস ওদের যাত্রার অভিমুখে থাকায় সাইকেল চালকের কথা পেছনে বসা ইফতেখারের কানে ঠিকমতো পৌঁছায় না। তাই কোন কোন কথা দু’বার করে বলতে হচ্ছিল।

— আপনার চেহারা পরিচিত লাগছে কিন্তু আপনার সাথে আগে কোথায় দেখা হয়েছে সেটা মনে করতে পারছি না।
— এদিকেই কোথাও হয়তো দেখেছেন।
— আপনি কোন মহল্লার?
— লামাপাড়ার।
— ও, তাহলে হয়তো আপনাদের মহল্লাতেই দেখেছি। ওখানকার অ্যাডভোকেট মোখলেস সাহেবের ছেলে মুকিত আমার বন্ধু। ওদের বাসায় প্রায়ই যাওয়া পড়ে।
— আমি শহীদ। মোখলেস সাহেবের বাসা ছাড়িয়ে মহল্লার আরো ভেতরে গেলে আমাদের বাসা।
— আমি ইফতেখার। জালকুড়িতেই আমাদের বাসা। এরপর এ’দিকে আসলে আমাদের বাসায় আসবেন।
— হুঁ, নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই!

ইফতেখার বোঝে এই “নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই!” বলাটা নিতান্ত ভদ্রতা, শহীদ কোনদিনই তাদের বাসায় আসবে না। এরচেয়ে ইফতেখার পরে একদিন নিজেই লামাপাড়ায় গেলে শহীদকে ধন্যবাদ জানিয়ে আসবে। আলাপে শহীদকে বিশেষ আগ্রহী না দেখে আর ক্রমাগত কথা বললে শহীদের মনোযোগে ব্যাঘাত হয়ে অন্ধকার রাস্তায় কোন দুর্ঘটনা হতে পারে আশংকায় ইফতেখার আর কথা বাড়ায় না। শহীদও যেচে পড়ে কিছু জিজ্ঞেস করে না। বড় রাস্তা থেকে বাঁয়ে মোড় নিয়ে সাইকেল সামনে এগোতে মূল শহরের আলোকচ্ছ্বটা আর প্রাণের স্পর্শ টের পাওয়া যায়।

মিশনপাড়া পার হয়ে ডন চেম্বারের কাছাকাছি হাসপাতাল-ক্লিনিক এলাকায় আসতে কয়েকটা খোলা ওষুধের দোকান চোখে পড়ে। ইফতেখার শহীদকে সাইকেল থামাতে বলে। শহীদকে ধন্যবাদ জানাবার আগেই সে “আচ্ছা, আবার দেখা হবে” বলে হুশ্‌ করে কুমুদিনীর দিকে সাইকেল টান দেয়। তিনটা দোকান ঢুঁড়ে চতুর্থ দোকানে গ্লিসারিন নাইট্রেট ট্যাবলেট পাওয়া যায়। প্যান্টের ডানদিকের সাইড পকেটে থেকে একশ’ টাকার নোটটা বের করে দাম শোধ করার পর ট্যাবলেটের স্ট্রিপ আর ভাঙতি টাকা একই পকেটে রেখে সে হাসপাতালের সামনে সারি সারি দাঁড়ানো রিক্‌শাকে জালকুড়ি যাবার জন্য মিনতি করা শুরু করে। শেষমেশ দ্বিগুণ ভাড়া কবুল করলে একজন রিক্‌শাওয়ালা জালকুড়ি যেতে রাজী হয়।

রিক্‌শা যখন ইফতেখারদের বাসার কাছে পৌঁছে তখনই কানে ছোট বোনের মর্মভেদী চিৎকার ভেসে আসে। ঘটনা কী সেটা বুঝতে ইফতেখারের কোন অসুবিধা হয় না। গত এক-দেড় ঘন্টায় ইফতেখার আর তার পরিবারের সদস্যদের জীবনে আসলে কী ঘটে গেল সেটা ভাবতে গিয়ে তার বোধ-বুদ্ধি কেমন ভোঁতা হয়ে আসে। এরপরে বাকি রাত আর পরের কয়েকটা দিন একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে কেটে যায়।

বাবার মৃত্যুর জন্য ইফতেখারের মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করে। সেদিন রাতে সে ওষুধ আনতে না গিয়ে বাবাকে যদি হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারতো তাহলে হয়তো বাবা বেঁচে যেতেন। ইফতেখার অবশ্য হিসেব করে দেখেছে। সেদিন রাতে বাসা থেকে বের হবার পর ওষুধ নিয়ে ফিরে আসতে ঘন্টা দেড়েক সময় লেগেছিল। বাবা অবশ্য সে ফিরে আসার আরো আধঘন্টা আগেই চলে গিয়েছিলেন। তার মানে সে যদি কোন বেবিট্যাক্সী বা অ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করার চেষ্টা করতো তাহলেও তার কম করে হলেও একঘন্টা সময় লাগতো। তাতে বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই হয়তো বাবা মারা যেতেন। কিন্তু এই হিসেবও ইফতেখারের অনুশোচনা হ্রাস করে না। ভেতরে ভেতরে সে নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকে।

বাবা মারা যাবার সপ্তাহখানেক পরে ঐ রাতে পরা প্যান্টটা ধুতে দেবার সময় প্যান্টের ডানদিকের সাইড পকেটে হাত দিতে ইফতেখারের মেরুদন্ড দিয়ে হিমস্রোত বয়ে গেল। পকেট থেকে গ্লিসারিন নাইট্রেটের স্ট্রিপের বদলে একটা একশ’ টাকার নোট বের হয়ে আসলো। ইফতেখারের স্পষ্ট মনে আছে সে ওষুধ কেনার সময় ঐ পকেট থেকে টাকা বের করে দাম শোধ করে ওষুধের স্ট্রিপ আর ভাঙতি টাকা ঐ পকেটেই রেখেছিল। ফেরার রিক্‌শা ভাড়া প্যান্টের পেছনের পকেটে রাখা তার মানিব্যাগ থেকে দিয়েছিল। বাসায় ফেরার ঘন্টা তিনেক পড়ে ওজু করার আগে প্যান্টটা খুলে সাদা পায়জামা পরার সময় প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। ওষুধের স্ট্রিপ আর ভাঙতি টাকা অবশ্য প্যান্টের সাইড পকেট থেকে বের করার দরকার পড়েনি। প্যান্টটাও ঐ দিনের পর আর পরা হয়নি।

হতবুদ্ধি ইফতেখার একশ’ টাকার নোটটা দ্রুত নিজের মানিব্যাগের একটা খালি পকেটে রেখে দিল। এরপর বহু চেষ্টা করেও সে মনে করতে পারে না গত কয়েকদিনে ঐ পকেটে সে আর কোন টাকা রেখেছিল কিনা — কিন্তু অমন কিছু তার মনে পড়ে না। তাছাড়া খুলে রাখা প্যান্টের পকেটে কেউ টাকা রাখতে যাবেই বা কেন! এই ঘটনায় ইফতেখার সেদিন রাতের সব ঘটনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবতে লাগলো।

সেদিন রাতের কথা ভেবে ইফতেখার একটু ধন্দে পড়ে গেল। জালকুড়ি থেকে বড় রাস্তা ধরে নতুন হাসপাতাল যেতে পথিমধ্যে লামাপাড়া পড়ে। সে তাদের জালকুড়ির বাসা থেকে যতটুকু হেঁটে এসেছিল তাতে লামাপাড়া তখনও অনেক দূরে ছিল। তার মানে শহীদ আসলে লামাপাড়া থেকে নয়, হয় জালকুড়ি বা আরো পেছনের নন্দলালপুর, দেলপাড়া, সরদারবাড়ি বা ভুঁইগড় থেকে আসছিল। এত রাতে ওদিকে তার কী কাজ ছিল? আর ঐসময়ে মাত্‌লা ঘাটেই বা তার কী কাজ? ঘাট এলাকায় মাল নামানো শুরু হয় তো ভোররাত চারটা-সাড়ে চারটার পরে! ইফতেখার একবার ভাবে, যাকগে! আমার অতকিছু ভাবার কী দরকার! ঘাট এলাকা কখনোই নির্জন হয়ে পড়ে না। কাজ না থাকলেও লোকজনের আনাগোনা, বাদ্‌শাহ্‌ হোটেল আর মাউড়া হোটেলে লোকের ভীড় লেগেই থাকে। সুতরাং জালকুড়ি বা তার পেছনের কোন জায়গায় অন্য কোন কাজ সেরে নিশ্চয় শহীদ মাত্‌লা ঘাটে যাচ্ছিল। কিন্তু এই ব্যাখ্যাতেও তার মন ভরে না। আর সবচে’ অস্বস্তিকর ব্যাপার হচ্ছে ওষুধের স্ট্রিপের বদলে পকেটে একশ’ টাকার নোট পাওয়া।

ইফতেখারের মাঝে মাঝে মনে হয়, সে কি আসলেই সেদিন ওষুধ আনতে গিয়েছিল? যদি ওষুধ আনতে গিয়েই থাকে তাহলে টাকাটা আসলো কোথা থেকে? তার স্পষ্ট মনে আছে, সে তার মানিব্যাগ থেকে না সাইড পকেট থেকেই একশ’ টাকার নোটটা বের করে ওষুধের দাম দিয়েছিল। সেক্ষেত্রে পকেটে টাকাটা থাকার কথা না। আবার সে যদি ওষুধ আনতে না গিয়েই থাকে তাহলে ঐ ঘন্টা দেড়েক সময় সে কোথায় ছিল? সে তো ঐ রাতের সব কথাই স্পষ্ট মনে করতে পারে — শহীদের সাইকেলে যাওয়া, ওষুধ খুঁজে বের করে কেনা, রিক্‌শাওয়ালাদের সাথে দরদাম, রিক্‌শায় ফেরা — সবই তার মনে আছে। তাহলে ভুলটা কোথায় হচ্ছে?

মাসখানেক পরের কথা। মুকিতের সন্ধানে একটা ভালো বেতনের টিউশনী আছে জেনে ইফতেখার লামাপাড়ায় তার সাথে দেখা করতে যায়। টিউশনীর ব্যাপারটা একটা রফা হতে ইফতেখার মুকিতকে শহীদের কথা জিজ্ঞেস করে। মুকিত প্রথমে কিছুক্ষণ শহীদকে চিনতেই পেরে ওঠে না। এরপর একটু ভেবে বললো,

— কেমন দেখতে বল্‌ তো।
— এই ধর আমার চেয়ে একটু লম্বা, আমাদের চেয়ে বয়সে কিছুটা বড়, ফর্সা, মোটা গোঁফ আর ভারী জুলফি আছে।
— ও চিনেছি, শহীদ ভাই! উনি তো বছর তিনেক আগে ভুঁইগড়ের কাছে সাইকেল চালাতে গিয়ে ট্রাকের ধাক্কায় মারা গেছেন। তুই এমন ভাবে তার কথা বলছিস্‌ যেন কালই তোর সাথে তার দেখা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ তার কথা জিজ্ঞেস করছিস্‌ কেন?

ব্যাপারটা সামাল দিতে ইফতেখারকে একটা বড়সড় ঢোক গিলতে হয়।

— না, এমনিই। অনেকদিন আগে একবার উনি আমাকে সাইকেলে লিফ্‌ট দিয়েছিলেন। কথাটা মনে পড়ায় জিজ্ঞেস করলাম। কেমন মানুষ ছিলেন?
— লোকটা মানুষ হিসাবে খারাপ ছিলেন অমন কথা কেউ বলতে পারবেন না। তবে কাজকর্ম কিছু করতো বলে শুনিনি। তা তার সাথে তোর পরিচয় কীভাবে?
— উনি তো আপাদের সাথে রজ্জ্বব আলী স্যারের ব্যাচে পড়তেন। আপাকে ব্যাচে নামিয়ে দিয়ে আসার সময় বা নিয়ে আসার সময় দেখেছি।
— ধুর, তা কী করে হয়? তোর বড় বোন আমাদের মোটে চার বছরের সিনিয়র। আর শহীদ ভাই কম করে হলেও আমাদের থেকে দশ বছরের সিনিয়র ছিলেন।
— আমার ভুল হতে পারে। তাহলে বোধহয় তাকে মেজমামার সাথে দেখেছি।
— সেটা হয়তো হতে পারে। তবে শহীদ ভাই বয়সে তোর মেজ মামার চেয়ে বেশ ছোট হবার কথা।

ব্যাপারটা আরো ঘোলা হবার আগেই ইফতেখার প্রসঙ্গ পালটে ফেলে। মুকিতের সাথে আলাপে তার সমস্যার সমাধান না হয়ে ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে যায়। লামাপাড়ার শহীদ যদি তিন বছর আগেই মারা গিয়ে থাকে তাহলে ঐ রাতে কে তাকে সাইকেলে লিফট দিয়েছিল? লামাপাড়ায় যদি শহীদ নামের অন্য কেউ জীবিত থেকেও থাকে তাহলে ইফতেখারের দেয়া দৈহিক বর্ণনা মৃত শহীদের সাথে মিলে যায় কী করে? তাহলে কি ঐ রাতে সে ওষুধ আনতে কোথাও যায়নি? হয়তো না। মৃত শহীদকে সে তিন-চার বছর আগেই লামাপাড়া বা অন্য কোথাও দেখেছিল যা তার অবচেতন মনে রয়ে গিয়েছিল। হয়তো সে রাস্তার কোথাওই দাঁড়িয়েছিল, অথবা বাসার ধারেকাছে কোথাও ঘুমিয়ে পড়েছিল। এই ব্যাখ্যাটা কোনভাবেই ইফতেখারের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। তবুও এই ভাবনাটা বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে তার নিজের দায়িত্বে অবহেলা সংক্রান্ত অনুশোচনার আগুন আরো বাড়িয়ে দেয়। এখন এই আগুন নিভতে পারে যদি কোনভাবে প্রমাণ করা যায় সে আসলেই ওষুধ কিনে এনেছিল। একবার ভাবে, ঐ দোকানে গিয়ে তার ওষুধ কেনার সত্যাসত্য যাচাই করবে। কিন্তু কোন দোকানদারের পক্ষে এক মাস আগের এক রাতে কার কাছে কী বেচেছিল সেটা কি মনে রাখা সম্ভব? আবার ভাবে, বাসায় মা-বাবার ঘরে খুঁজে দেখবে ওষুধের স্ট্রিপটা পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু বাসায় খুঁজতে গেলে পরিবারের বাকি সদস্যদের কাছে গ্লিসারিন নাইট্রেট তার কেন দরকার পড়লো এই প্রশ্নের উত্তর কী দেবে? বাবা ছাড়া এই বাসায় আজ পর্যন্ত অন্য কারো এই ওষুধের দরকার পড়েনি।

ইফতেখারদের বাসার চিত্র এখন পালটে গেছে। ভোরে উঠে তাকে সাইকেল চালিয়ে টিউশনীতে যেতে হয়। সেখান থেকে কলেজ হয়ে আরো দুটো টিউশনী সেরে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবার পাট চুকে গেছে। শিবু মার্কেটে আলীমুল্লাহ্‌ ভাইয়ের দেয়া ‘ম্যাথ কনসেপ্ট’ কোচিং সেন্টারের সাথে কথা হয়েছে। সামনের মাস থেকে সেখানে সকালে একটা ব্যাচ পড়াতে পারবে। তাতে মোটামুটি একই খাটুনিতে কিছু বাড়তি আয় হবে। বাসা গরম করা মায়ের কণ্ঠ এখন আর শোনা যায় না। মা এখন নিজের ভেতরে গুটিয়ে গেছেন। সংসারের কর্তৃত্ব এখন বড় বোনের হাতে। ছোট বোনটা দিনরাত বাসার সব কাজ সামাল দেয়। বড় বোন কেবল খবরদারী করে বেড়ায়। কিছুদিন হলো বড় বোন বলা শুরু করেছে রাতে মাকে দেখা শোনা করার জন্য ছোট বোনকে মায়ের ঘরে থাকা দরকার। অর্থাৎ, বোনদের ঘরটা সে একা দখল করতে চায়। ইফতেখার বোঝে মোটরসাইকেলে টো টো করা মাকাল ফলটার এই সংসারে ঢোকা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কাজেই, একদিন বোনদের ঘরের সিঙ্গেল খাটদুটো মায়ের ঘরে আর মায়ের ঘরের ডাবল খাটটা বোনদের ঘরে আনার উদ্যোগ করা হয়।

মায়ের ঘর থেকে ডাবল খাটটা সরানোর সময় ভারী জাজিমটা তুলতে যেতে জাজিম আর খাটের মাথার মাঝখানের ফাঁক থেকে গ্লিসারিন নাইট্রেট ট্যাবলেটের একটা আনকোরা স্ট্রিপ মেঝেতে খসে পড়ে। ইফতেখার স্ট্রিপটা মেঝে থেকে তুলতে গেলে বড় বোন বলে,

— দেখি, দেখি কী ওষুধ!
— গ্লিসারিন নাইট্রেট।
— আহা! ওষুধটা আর কোন কাজে লাগলো না। ঐ দিন রাতে খামাখাই তুই ছুটে গিয়ে ওষুধটা আনলি।
— আমি ওষুধ আনলাম মানে!
— বারে, এর মধ্যেই তুই ভুলে গেলি! ঐ দিন রাতে আমি তোকে টাকা দিলাম, তুই গিয়ে ওষুধ আনলি। তুই যখন বাবার কাছে এসেছিলি তখন নিশ্চয়ই তোর হাত থেকে ওষুধের স্ট্রিপটা বাবার মাথার কাছে জাজিমের ফাঁকে পড়ে গিয়েছিল।

ইফতেখার আর কিছু বলে না। ওষুধের স্ট্রিপটা ভাঁজ করে তার মানিব্যাগের একটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখে, যেখানে বেশ কিছুদিন ধরে একটা একশ’ টাকার নোট রাখা আছে।


মন্তব্য

আইলসা এর ছবি

চলুক

ভালো হইছে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

তাইলে শহীদের ব্যাপারটা কী? ওইটা কি ধান্দাই থাকল?

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

শহীদ তো পরের ব্যাপার, একশ' টাকার নোট আর ওষুধের স্ট্রিপের ব্যাপারটাই পুরোপুরি পরিষ্কার হলো না!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

লাবণ্যপ্রভা  এর ছবি

আপনার গল্প প্রচেষ্টার সবগুলি খুববেশি বস্তবমুখী, এমনকি প্রতিটা গল্পের বর্ননা এত নিখুঁত যে মাঝে মাঝে মনে হয় এটা কি গল্প না কারো জীবন থেকে নেয়া। তবে বাকিগুলর তুলনায় এই গল্পটা বেশ দুর্বল মনে হল। মজার কথা হল, আপনার মৃতভোজী পড়ে বেশ কিছুদিন মাছ খেতে পারিনি, আর পদ্মভোজী পড়ে আশপাশে সবাইকে কেমন যেন অন্যভাবে ভাবতে শুরু করি। তারপর, থেকে খুব সাবধানে পড়ি আপনার সব গল্পগুল।

আপনি অনেক বেশি ভাল লিখেন এবং এর পেছনে সময়ও যথেষ্ট ব্যয় করেন সেটা বোঝা যায়। যাইহোক,ধন্যবাদ আপনাকে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ। গল্পটার কাহিনী নিয়ে আরেকটু কাজ করার সুযোগ পেলে বোধহয় আপনার আক্ষেপ কিছুটা কমাতে পারতাম।

যাকগে, আমার গল্পের ব্যাপারে আপনি যে প্রতিক্রিয়া জানালেন তাতে একটু ঘাবড়ে গেছি। পাঠক যদি এইভাবে ভাবতে থাকে তাহলে আমাকে আরো অনেক সতর্ক হতে হবে। তাছাড়া পাঠকের প্রত্যাশা একটা নূন্যতম পর্যায়ে চলে গেলে নিজের ওপর চাপও বেড়ে যায়।

আপনার প্রতিক্রিয়ার জন্য আবারো ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

আপনার গল্প প্রচেষ্টার সবগুলি খুববেশি বস্তবমুখী, এমনকি প্রতিটা গল্পের বর্ননা এত নিখুঁত যে মাঝে মাঝে মনে হয় এটা কি গল্প না কারো জীবন থেকে নেয়া। তবে বাকিগুলর তুলনায় এই গল্পটা বেশ দুর্বল মনে হল।

আমার বক্তব্যও অনেকটা একই। কেবল দুর্বল শব্দটার জায়গায় আমি আলাদা শব্দ ব্যভার করবো। গল্পটায় পান্ডবদার অন্যান্য গল্পগুলোর মতো ডিটেইলিং এর কাজ নেই দেখে অবাক হয়েছি। কিন্তু আরো অবাক হয়েছি, ভালো লেগেছে এই গল্পটার মসৃণতায়, অন্য গল্পগুলো একটু সময় নিয়ে পড়তে হয়েছে স্বাদ নিতে। কিন্তু এটা অনেক ঝরঝরে হয়েছে।

ফাহিম হাসান এর ছবি

একমত। এই গল্পে খুঁটিনাটি বিবরণ খুব একটা দরকার ছিল না। বরং না থাকাতে গতিটুকু বজায় ছিল।

লাবণ্যপ্রভা  এর ছবি

পান্ডবদার গল্পগুল আমার কাছে এর নিখুঁত বর্ননার জন্যই আলাদা, এটা একটা দুর্লভ গুন।তবে আপনিও ঠিক এটার টেস্ট আলাদাই হয়েছে হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই গল্পটাতে ডিটেইলিং-এর কাজটি ইচ্ছাকৃতভাবে কম করা হয়েছে। তাছাড়া এর কাহিনী যা তাতে ডিটেইলিং বাড়ালে সেটা কিছুটা আরোপিত হয়ে যাবার শংকা ছিল। কাহিনীটিকে আরো বাড়ানোর (ব্রাঞ্চিংসহ) একটা বদখেয়ালও ছিল। ঝুলে যাবার ভয়ে সেটা বাদ দিয়েছি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

প্যান্ট পরা'টা কয়েক জায়গায় 'পড়া' হয়ে গেছে...
গল্পটা ভালো লেগেছে...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। বানান ঠিক্‌ করা হলো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

গল্পটা ভালো লেগেছে। অনেক স্মুথ একটা গল্প। কিন্তু শহীদ আর ওষধ আর টাকার ব্যাপারটা পরিষ্কার না হওয়াতে একটু খচখচানি রয়েই গেল। পাঠক হিসেবে ব্যর্থতা

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এটা নীতিশিক্ষামূলক গল্প নয় যে একটা পার্টিকুলার মেসেজ পৌঁছে দেবার জন্য গল্প লেখা হয়েছে। গল্পটা পড়ে পাঠক তার নিজস্ব ইন্টারপ্রেটেশন দাঁড় করাবেন। সেটাকে ভুল বলার উপায় নেই। সুতরাং আপনি যা বুঝেছেন সেটা ঠিক। আপনার কোন ব্যর্থতা নেই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

পথিক পরাণ এর ছবি

আপনার গল্পের অমীমাংসিত রহস্যপূর্ণ অংশটুকু খুব টানে আমাকে। রহস্যময় অংশটুকু মিসির আলীর মতন সমাধান পেয়ে গেলে মন্দ হত না, তবে রহস্যটুকুও কিন্তু চমৎকার মানিয়ে যায়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমাদের চারপাশে অনেক অমীমাংসিত ঘটনা থাকে যেগুলো আসলে রহস্যময় কিছু নয়। সেগুলোর যৌক্তিক ব্যাখ্যাও থাকে। ইনফরমেশনের ঘাটতি বা অজ্ঞতার জন্য সেগুলোর কিছু কিছু রহস্যময় বলে মনে হয়। আমার গল্পে সেই আপাত রহস্যের ব্যাপারগুলো না হয় অমনই থাকুক। আমি চাই গল্পকে পাঠক তার নিজস্ব বিবেচনায় বিশ্লেষণ করুন, এবং সে অনুযায়ী তিনি নিজেই উপসংহার টানুন। ডয়েল-ক্রিস্টি'র বাঁধানো পথে নাইবা হাঁটলাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

স্যাম এর ছবি

পান্ডব দা - দুইবার পড়লাম - প্রথমবার পাঠক হিসেবে - দ্বিতীয়বার শার্লক হয়ে - লাভ হয় নাই - চোখ টিপি
পড়তে ভাল লেগেছে ২ বার ই -
শহীদের মত লোক যাকে সঙ্গ দেয় তার পকেটে টাকা/ওষুধের স্ট্রিপের ফিরে আসা কোন ব্যাপার ই না খাইছে

আসলে কি হয়েছিল?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আসলে কী হয়েছিল তার একটা ব্যাখ্যা তো আপনিই দিয়ে দিলেন। আরো ব্যাখ্যা তো দাঁড় করানো যায়ই। কেউ কানে একটু ভুল শুনে থাকলে, কেউ একটু মিথ্যে কথা বলে থাকলে, কেউ একটা-দুটো ব্যাপার ভুলে গিয়ে থাকলে, দুয়েকটা জিনিস কারো জানা না থাকলে এমন আরো কত কিছুই তো হতে পারে তাই না?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রচেষ্ঠা স্বার্থক দেঁতো হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ক্রেসিডা এর ছবি

যেটা বেশী ভালো লাগলো, তা হলো- পড়া শুরু করতেই পড়বো কি পড়বো না.. এই দ্বিধা কাজ করেনি; বরং অল্প একটু পড়ে বাকিটা পড়ার আগ্রহ অনায়াসেই তৈরী হয়ে গেছে; সো.. লেখা বা লেখনী যে যথেষ্ঠ আগ্রহ জাগাতে সক্ষম তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পকেটে আবারে ১০০ টাকার নোট পাবার ঘটনার সাথে সাথে শহীদের মৃত হবার অনুমান তা আগেই ধরে ফেলা গেল, পড়তে পড়তে মিলেও গেল।

ভালো লাগলো অনেক।

ভালো থাকা হোক।

__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখতে পারাটা কঠিন একটা ব্যাপার। এটা না পারলে লেখাই বৃথা। বুদ্ধিমান পাঠক লেখার গতিধারা ধরে ফেলতে পারবেন সেটাই স্বাভাবিক। আপনার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।

ভালো থাকবেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

আপনার ক্ষেত্রে মনে যা আসছে হড়বড় করে বলে ফেলি।
গল্পের গতি ভালো লাগেনি। তাল মিলিয়ে চলতে পারিনি।
একটা প্যারার শেষ লাইনে কাল বদলে গেছে। আচমকা খটকা লাগে। এখানে:

বাতাস ওদের যাত্রার অভিমুখে থাকায় সাইকেল চালকের কথা পেছনে বসা ইফতেখারের কানে ঠিকমতো পৌঁছায় না। তাই কোন কোন কথা দু’বার করে বলতে হচ্ছিল।

আমি মনে মনে চাইছি, আপনি এই গল্পটা আবার লিখবেন অথবা সম্পাদনা করবেন।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মনোযোগী পাঠকের সৎ মন্তব্য পাওয়া লেখকের বড় অর্জন। তোমার মন্তব্য তার প্রতিফলন।

বাক্য গঠনে যা কিছু ব্যাকরণগত ভুল আছে সেগুলো সারিয়ে তুলবো। আর গতির ব্যাপারটা ঠিক করতে আরো কিছু এক্সপেরিমেন্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

আমার লেখা সবগুলো গল্প প্রচেষ্টাকেই সম্পাদনার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। অন্তত কখনো পুনঃপ্রকাশের কথা ভাবলে সেটা করতেই হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

বন্দনা এর ছবি

আপ্নার গল্প প্রচেষ্টা সিরিজটা খুব ভালো লাগে পাণ্ডবদা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গল্প পড়া ও মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কুমার এর ছবি

মিসির আলি আমেজ আছে একটা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কারো প্রভাব প্রকাশিত হয়ে থাকলে সেটা আমার ব্যর্থতা।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দুর্দান্ত এর ছবি

সুন্দর। বেশ একটা 'টোয়াইলাইট জোন' ভাব পেলাম।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

স্টেফানি খালা যেসব গোষ্ঠী নিয়ে লেখেন তাদের ধারে কাছেও তো যাইনি!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দুর্দান্ত এর ছবি

এই টোয়াইলাইট, সেই টোয়াইলাইট না রে ভাই। অনেক অনেক কাল আগে বিটিভিতে একটা সিরিজ দেখাইতো। "তাইলে-ঐ-টাইমে-আমি-কুথায়-গেছিলাম" টাইপের প্রশ্ন সম্বলিত ঘটনা নিয়া। ঐটার টাইটেলে আবার হেব্বি মিস্টিরিয়াস একটা বাজনাও বাজতো।

http://en.wikipedia.org/wiki/The_Twilight_Zone_(1959_TV_series)

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই সিরিজ কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

গল্প তো আগাগোড়াই ঠিক আছে। ইফতেখার ওষুধ কিনতে বেরিয়েছিলো এবং তার বড় বোনের ভাষ্যমতে, সে গ্লিসারিন নাইট্রেট ট্যাবলেট নিয়েও এসেছিলো। সমস্যা করছে সাইকেলওয়ালা আর একশ টাকার নোট।

একশ টাকার নোটের একটা সহজ ব্যাখ্যা দেয়া যায়। বাবার মৃত্যুর প্রথম এক সপ্তাহ ইফতেখার এমন ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছে যে কখন একশ টাকার একটা নোট পকেটে রেখেছিলো তার পরিষ্কার মনে নেই। নিশ্চয়ই এই সময়ে তাকে বেশ কিছু টাকাপয়সা চাড়াচাড়া করতে হয়েছে, বিনা পয়সায় তো আর মৃতের সৎকার হয় না!

সাইকেলওয়ালার সাথে কথোপকথনটা এমনভাবে লিখেছেন, "লামাপাড়ার শহীদ" ছাড়া তাকে অন্যকিছু ভাবার কোন সুযোগ পাঠকের হাতে নেই। সম্পাদনার সময় কিছু ধোঁয়াটে লাইন কি জুড়ে দেয়া সম্ভব? না হলে এটাই মেনে নিতে হবে, জনৈক অশরীরি তার একশভাগ ভৌত সাইকেল নিয়েই ইফতেখারকে সঙ্গ দিয়েছিলো, কি আর করা। হাসি

স্যাম এর ছবি

বাবার মৃত্যুর প্রথম এক সপ্তাহ ইফতেখার এমন ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছে যে কখন একশ টাকার একটা নোট পকেটে রেখেছিলো তার পরিষ্কার মনে নেই।

- কিন্তু প্যান্ট টা তো ঐ ৭ দিন পরেইনি চিন্তিত

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

হ্যাঁ তাই তো দেখছি। তাইলে এইটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্রেতাত্মারই কাজ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

চাইলে শহীদের ব্যাপারেও যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। সেটা অসম্ভব কিছু নয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দীপ্ত এর ছবি

আপনার গল্প সবসময়ই আগ্রহ নিয়ে পড়ি। চরিত্র, ঘটনা, পরম্পরা নিয়ে শেখার চেষ্টা করি।
এটাও ভালো লেগেছে। কিছুটা অন্যরকম। পড়া শেষে ভাবলাম একশ টাকার রহস্য কি? মন্তব্য পড়ে দেখি, বিভিন্ন জনে বিভিন্ন ভাবে ভেবেছেন। একাধিক উপসংহার করা যায়, না?
এই গল্পটা ডিটেইলস কম ছিল কিন্তু পড়তে অনেক মসৃণ লেগেছে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গল্প পড়া ও মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ। গল্পের ব্যাখ্যা বা উপসংহার সম্পূর্ণ পাঠকের এখতিয়ারে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনার গল্প দেখলে হাতে যথেষ্ট না থাকলে ঢুকি না। কারণ এই গল্পকার নিজেও মাথা খেলায়, সাথে পাঠকের মাথাও।
তবে এই গল্পটার ভিন্নতা এই কারণে এটা ঝরঝর করে পড়ে ফেলা গেছে, যেটুকু মাথা চুলকেছি পড়তে পড়তেই চুলকানো গেছে, থামতে হয়নি বলে পড়ে আরাম লেগেছে। আমার মতে রহস্য গল্পের মধ্যে এর চেয়ে বেশী ডিটেলিং না থাকাই ভালো।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গল্প পড়া ও মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ বস্‌। আপনাদের মাথা খেলাতে পারলে আমারও ভালো লাগে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মর্ম এর ছবি

"এ যদি বেড়াল হয় তবে আমার মাংস কই? আর এ যদি মাংস হয় তা'লে বেড়াল কই?!"

মোহাম্মদ নাসির আলী'র 'ভিনদেশী এক বীরবল'-এ পড়া হোজ্জার এ কথাটা অনেকদিন পর মনে হল গল্প পড়ে চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

"গল্পের এই ব্যাখ্যাটাই ঠিক, অন্যগুলো ভুল" - এমন নীতিতে আমি বিশ্বাসী নই। গল্প সাবলীল কিনা, লজিকের ভুল আছে কিনা, স্ববিরোধীতা আছে কিনা, ব্যাকরণগত ভুল আছে কিনা, পাঠকের বিরক্তি উৎপাদন করবে কিনা - এগুলো লেখক বিবেচনা করবে। গল্পের ব্যাখ্যা পাঠকের নিজস্ব ব্যাপার।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নির্ঝর অলয় এর ছবি

ডিটেইলের প্রতি আপনার সজাগ দৃষ্টি প্রশংসনীয়।

নোটের ফেরত আসা আর স্ট্রিপের গায়েব হয়ে যাওয়াটা স্পষ্ট ভূতুড়ে লক্ষণ!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

নোটের ফেরত আসা আর স্ট্রিপের গায়েব হয়ে যাওয়াটা স্পষ্ট ভূতুড়ে লক্ষণ!

- লৌকিক সম্ভাব্যতাগুলো নিয়ে ভাবুন, সমাধান পেয়ে যাবেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।