১২১০ সালে পোলো খেলতে গিয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়ে আয়েবাকের জীবনাবসান হলে দিল্লীর সিংহাসন নিয়ে গোলযোগের বাঁধে। এই সুযোগে ১২১১ সালে আয়েবাকপুত্র আরাম শাহ্কে হঠিয়ে ইলতুৎমিশ দিল্লীর ক্ষমতা অধিগ্রহন করেন। তাঁর শাসনকাল চলে পরবর্তী ২৬ বছর ধরে। ইলতুৎমিশের সময়ে মামলুক সালতানাত তার গৌরবের সর্বোচ্চে পৌঁছায়। সালতানাতের সীমা পশ্চিমে আফগান থেকে পূর্বে বঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
(মানচিত্রের উৎসঃ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়)
ইলতুৎমিশের নয় জন সন্তানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চার জন হচ্ছেন নাসির উদ্ দীন মাহ্মুদ, রুক্ন উদ্ দীন ফিরুয, জালালাত্ আদ্ দীন রাদ্বিয়াহ্ এবং মুয়িয্ উদ্ দীন বাহ্রাম। উত্তরাধিকার নির্বাচনের ব্যাপারে ইলতুৎমিশের চোখ কার দিকে ছিল সেটা বলা একটু মুশকিল। জ্যেষ্ঠ পুত্র নাসির উদ্ দীন মাহ্মুদ ছিলেন ইলতুৎমিশের প্রিয় পুত্র। ধারণা করা হয় যে তিনি নাসিরকে উত্তরাধিকার হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু নাসিরকে রাজধানী থেকে ধীরে ধীরে দূরে পাঠিয়ে দেয়া থেকে আঁচ করা যায় ইলতুৎমিশ তাঁর জীবদ্দশায় নাসিরকে সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। অন্য দিকে মিনহাযের মতো ঐতিহাসিক জানাচ্ছেন (তাবাক্বাত ই নাসিরি), গোয়ালিয়র জয় করে বদায়ুনে ফেরার পর ইলতুৎমিশ তাঁর সচিব তাজ উল মালিক মাহ্মুদকে নির্দেশ দেন তাঁর উত্তরাধিকার হিসেবে রাদ্বিয়াহ্’র নাম লিপিবদ্ধ করতে এবং তাঁর নামের সাথে ক্রাউন প্রিন্সেস হিসেবে রাদ্বিয়াহ্র নাম উল্লেখ করে রৌপ্যমুদ্রা প্রকাশ করতে। মিনহাযের এই তথ্যে কিছুটা ফাঁক আছে। ফাঁকটা কী সেটা পরে বলা হবে।
ইলতুৎমিশপুত্র নাসির উদ্ দীন মাহ্মুদ ছিলেন দক্ষ যোদ্ধা, যোগ্য শাসক। সেনানায়ক হিসেবে নাসির বদায়ুন, কনৌজ, বারাণসী, রোহিলখণ্ড জয় করলে তাঁকে আওধের (অযোধ্যা) প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। ১২২৭ সালে বাংলার প্রশাসক হুসাম উদ্ দীন ইয়াওজ খিলজী বিদ্রোহ করলে নাসির তাঁকেও পরাস্ত করতে ও হঠাতে সক্ষম হন। ফলে বাংলার দায়িত্বও নাসিরের ওপর বর্তায়। নাসির এখানেই না থেমে ১২২৮ সালে অসমের খেন মহারাজা পৃথ্বুকে পরাস্ত ও হত্যা করে সাম্রাজ্য উত্তর-পূর্বে বর্ধিত করেন। এই প্রথম অসমের মাটিতে মুসলিম শাসকদের আবির্ভাব ঘটে। এরপর নাসির তিব্বত আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এর আগে ১২০৬ সালে আরেক তুর্কীস্তানী ইখতিয়ার উদ্ দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজীও অন্য পথে তিব্বত আক্রমণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কিন্তু ১২২৯ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে নাসিরের মৃত্যু হলে তিব্বত পর্যন্ত ভারতীয় সাম্রাজ্যের বিস্তারের চেষ্টা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়।
একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, এইসব ঘটনা যখন ঘটছে বাংলার দক্ষিণাংশে তখনো সেন বংশ টিকে আছে। বাংলার খিল্জীরা বা দিল্লীর মামলুকরা কেন বাংলার দক্ষিণাংশ দখল না করে বার বার উত্তর-পূর্ব ভারত এবং তিব্বতের দিকে নজর দিয়েছে এটা একটা প্রশ্ন। এর একটা উত্তর হতে পারে দক্ষিণ বাংলার নদী ও জলাবহুল অঞ্চলে তুর্কীস্তানীরা স্বচ্ছন্দ্য নয়। পক্ষান্তরে পাহাড়ি এলাকা, বিশেষত তুষারাবৃত পাহাড়ি এলাকাতে তারা স্বচ্ছন্দ্য। তাছাড়া, হিমালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে তিব্বত হয়ে তুর্কীস্তানে পৌঁছানোর একটা তাড়নাও হয়তো তাদের মধ্যে ছিল।
১২৩৬ সালের ২৯শে এপ্রিল ইলতুৎমিশের প্রয়াণের পর তাঁর উত্তরাধিকারের ব্যাপারটি জটিল হয়ে পড়ে তোলে। পরলোকগমনের আগে ইলতুৎমিশ রাদ্বিয়াহ্কে তার উত্তরাধিকার নিয়োগ করে গেলেও একজন নারীকে সুলতানরূপে দেখতে ক্ষমতাচক্রের মালিক-আমীররা সম্মত ছিলেন না। ফলে রাদ্বিয়াহ্’র ক্ষমতায় বসা হয় না। ইলতুৎমিশের দ্বিতীয় পুত্র রুক্ন উদ্ দীন ফিরুয ছিলেন মদ্যপ, লম্পট এবং ফুর্তিবাজ। এমন লোকের হাতে শাসনভার পড়লে সাম্রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী। ফিরুযের মা শাহ্ তুরক্বান (ইনি রাদ্বিয়াহ্র মা আয়েবাককন্যা তুরক্বান খাতুন নন্) প্রথম জীবনে ছিলেন ইলতুৎমিশের ক্রীতদাসী। পরে ইলতুৎমিশ তাঁকে বিয়ে করলে তিনি যথাযথ মর্যাদা লাভ করেন। কিন্তু প্রাসাদের বাকি নারীরা দুটি কারণে তুরক্বানকে প্রায়ই অপমান করতেন। এক, তুরক্বান ছিলেন তুর্কী বংশোদ্ভূত, প্রাসাদের বাকী অভিজাত নারীদের মতো তুর্কীস্তানী নন্। দুই, তুরক্বান প্রাক্তন ক্রীতদাসী। স্বাভাবিকভাবেই তুরক্বান আশা করে ছিলেন কখনো তিনি ক্ষমতার সুযোগ পেলে তাঁকে অপমানকারীদেরকে একহাত দেখে নেবেন। তিনি জানতেন তাঁর পুত্র, অপদার্থ ফিরুযকে ক্ষমতায় বসাতে পারলে তাঁর পক্ষে পর্দার আড়াল থেকে শাসন চালানো সম্ভব, প্রতিশোধ নেয়াও সম্ভব। তাই ফিরুযকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য প্রবল প্রাসাদ রাজনীতি শুরু হয়ে যায়। ফলে অপদার্থ ফিরুযকে সামনে রেখে মালিক-আমীরিদের সহায়তায় আসল ক্ষমতা গ্রহন করেন আরেক নারী শাহ্ তুরক্বান।
ক্ষমতায় বসে রাষ্ট্রীয় সম্পদের কর্তৃত্ব হাতে পেয়ে ফিরুযের মাথা খারাপ হবার যোগাড় হয়। আমোদ-প্রমোদ, অপব্যয় আর বিলাসের স্রোতে তিনি নিজেকে ভাসিয়ে দেন। তাঁর চারপাশ ঘিরে থাকতো গায়ক, ভাঁড় আর চাটুকারের দল। স্বাভাবিকভাবে মালিক-আমীরদের দল তার উপর বিরক্ত হতে থাকেন। ফিরুযের কথিত সমকামী স্বভাবও সম্ভবত তাঁদেরকে আরো বিরূপ করে তোলে। অন্য দিকে তাঁর মা শাহ্ তুরক্বান প্রাসাদাভ্যন্তরে ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ইলতুৎমিশের জীবদ্দশায় যাদের আচরণে তিনি ক্ষুদ্ধ ছিলেন এক্ষণে তাদের কপালে অত্যাচার, নির্যাতন, মৃত্যুদণ্ড জুটতে থাকে। তাঁর অরাজকতা চরমে উঠলে তিনি ইলতুৎমিশের এক পুত্র কুতুব উদ্ দীনকে প্রথমে অন্ধ ও পরে হত্যা করেন। এতে ক্ষুদ্ধ মালিক-আমীররা বিদ্রোহ শুরু করেন। আওধের শাসক ইলতুৎমিশ পুত্র মালিক গিয়াস উদ্ দীন মুহাম্মাদ শাহ্ বিদ্রোহ ঘোষণা করে রাজধানীর দিকে অগ্রসর হন। সাথে সাথে বদায়ুন, মুলতান, কোচি, হংসী, লাহোরের শাসকেরাও বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ফিরুয বিদ্রোহ দমনে এগিয়ে গেলেও তাঁর উযিরে আযম নিজাম উল মুল্ক মুহাম্মাদ জুনায়েদি কিলুঘারীর কাছে তাঁকে পরিত্যাগ করে বদায়ুনের শাসকসহ অন্যান্য বিদ্রোহীদের দলে যোগ দেন। অন্যদের সহায়তায় ফিরুয অল্পস্বল্প বিদ্রোহ দমন করতে পারলেও খবর আসে যে রাজধানীর অবস্থা সংকটাপন্ন। এই সময় ফিরুযের অনুপস্থিতিতে শাহ্ তুরক্বান রাদ্বিয়াহ্কে হত্যার চেষ্টা করেন। সেই প্রচেষ্টা ফাঁস হয়ে গেলে বিরক্ত আমীর-ওমরাহের দলের সাথে সাধারণ মানুষও ক্ষেপে ওঠে। তারা সদলবলে প্রাসাদ অবরোধ করে শাহ্ তুরক্বানকে বন্দী করে। সেনাবাহিনী আর তুর্কীস্তানী অভিজাতরা রাদ্বিয়াহ্’র পক্ষাবলম্বন করলে ফিরুযের কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। এক অর্থে তুর্কীদের ৬ মাসের কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে তুর্কীস্তানীরা আবার ক্ষমতায় আসে। ১২৩৬-এর ১৯শে নভেম্বরে রাদ্বিয়াহ্ দিল্লীর মসনদে আসীন হন। ক্ষমতায় বসে রাদ্বিয়াহ্ ফিরুযকে ধরে আনতে কিলুঘারীতে সেনাবাহিনী পাঠান। বন্দী ফিরুয আর শাহ্ তুরক্বানের ভাগ্যে আসলে কী ঘটেছিল সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে ফিরুয যে বেঁচে ছিলেন না সেটা নিশ্চিত। কোন কোন ভাষ্যকারের মতে ১৯শে নভেম্বর ১২৩৬-এ-ই ফিরুযের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তাঁর মা শাহ্ তুরক্বানের মৃত্যুদণ্ড বোধকরি আরো আগে কার্যকর করা হয়।
ইলতুৎমিশের উত্তরাধিকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে আগে বলা মিনহাযের দেয়া তথ্যের ফাঁকটা দেখা যাক। মিনহাযের মতে গোয়ালিয়র জয় করে বদায়ুনে ফেরার পর, অর্থাৎ ১২৩১ সালে, ইলতুৎমিশ উত্তরাধিকার হিসেবে রাদ্বিয়াহ্’র নাম লিখতে তাজ উল মালিক মাহ্মুদকে (মুশরিফ ই মু’মালিক) নির্দেশ দেন। সেসময় রাদ্বিয়াহ্’র বয়স ২৬ বছর এবং তিনি তখনো অবিবাহিতা। আজ থেকে আটশ’ বছর আগে ২৬ বছর বয়সী একজন মুসলিম সুলতানকন্যা’র এক বারও বিয়ে না হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। তাছাড়া ছোটবেলা থেকে রাদ্বিয়াহ্ বেড়ে উঠেছেন হারেমের বাইরে। ফলে তৎকালীন নারী, বিশেষত মুসলিম নারীদের সহজাত আচার-আচরণের চর্চ্চা তাঁর মধ্যে ছিল না। তিনি পুরুষদের পা’জামা আর পাগড়ি পরতেন, যুদ্ধকালে নেক্বাব পরতেন না, এবং রাষ্ট্রের দাপ্তরিক কাজে অংশ নিতেন। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, ইলতুৎমিশ প্রথম থেকেই রাদ্বিয়াহ্কে মসনদে বসার উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছেন। নাসিরের মৃত্যুতে সৃষ্ট শূন্যতাজনিত কারণে উত্তরাধিকার নির্ণয়ে তাঁর মত পাল্টেছে — ব্যাপারটা এমনটা নয়।
একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, ইলতুৎমিশ কেন অন্য পুত্রদের পরিবর্তে রাদ্বিয়াহ্কে উত্তরাধিকার হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। মিনহায জানাচ্ছেন, রাজন্যবর্গ ও ধর্মীয় গুরুদের প্রশ্নের উত্তরে ইলতুৎমিশ বলেন, “আমার পুত্রেরা যৌবন রসে মত্ত। তাদের কেউ শাসনভার গ্রহনের যোগ্য নয়। আমার মৃত্যুর পর তাদের কেউ দেশ পরিচালনায় সক্ষম হবে না। আপনারা এই দায়িত্বে আমার কন্যার চেয়ে যোগ্য কাউকে খুঁজে পাবেন না”। কে যোগ্য আর কে যোগ্য নয় সেটা তো বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বলা সম্ভব নয়। তাহলে ইলতুৎমিশ রাদ্বিয়াহ্কে প্রথম থেকেই ভিন্ন ভাবে গড়ে তুললেন কেন? একটা সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে, ইলতুৎমিশ যে ‘ইলবারি’ গোত্রের মানুষ, সেই গোত্রের বাসভূমি পন্টিক-কাস্পিয়ান স্তেপ অঞ্চলের নারীরা অন্য অঞ্চলের নারীদের চেয়ে অধিকতর স্বাধীনতা ভোগ করতেন। সুতরাং তাঁর পক্ষে কন্যাকে পুত্রদের ন্যায় শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করা অস্বাভাবিক কিছু নয়, বাকীটা রাদ্বিয়াহ্র কৃতিত্ব। রাদ্বিয়াহ্ স্বীয় মেধা ও পরিশ্রমের বলে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেন। ফিরুযের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময় আমীরদের ও সেনাবাহিনীর যে অংশ রাদ্বিয়াহ্র পক্ষাবলম্বন করেছিল তাদের একাংশ ছিল সেই পন্টিক-কাস্পিয়ান স্তেপ থেকে আগত মামলুক, যারা স্বাধীন নারী দেখে অভ্যস্ত। রাদ্বিয়াপন্থীদের বাকিরা ছিল পূর্ব স্তেপের (পূর্ব তুর্কীস্তান) মঙ্গোল বংশোদ্ভূত ক্বারা-খিতান জাতির। ১১৪৩ সালে ক্বারা-খিতান সম্রাট কুর খানের মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র সন্তান কাওনাইন খাতুন অনেক বছর রাজত্ব করেন। সুতরাং নারী নেত্রীত্ব তাদের কাছেও নতুন বা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
দেখা যাচ্ছে, তুর্কী-মঙ্গোল যাযাবর সমাজে নারীর অধিকতর স্বাধীনতা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহন বিদ্যমান ছিল। তাছাড়া পারস্যের সংস্কৃতিও একই প্রকার ছিল। কায়ানাইন বংশের সম্রাট কাই বাহমানের মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা হুমাই ত্রিশ বছর পারস্যের মসনদে আসীন ছিলেন। সাসানীয় সাম্রাজ্যে দ্বিতীয় খসরুর (৫৯০-৬২৮ সাল) কন্যা আযারমিদোখ্ত ৬৩০-৬৩১ সাল পর্যন্ত এবং বোরানদোখত দুই দফায় ৬২৯-৬৩০ সাল এবং ৬৩১-৬৩২ সাল পর্যন্ত পারস্যের সম্রাট ছিলেন। প্রাক-ইসলামী যুগের এই সংস্কৃতি এই অঞ্চলসমূহে ইসলামের আবির্ভাবের পরেও বিদ্যমান ছিল। ইসলামী যুগে আরব, পারস্য, তুরস্ক, তুর্কীস্তানে নারী নেতৃত্বের বহু উদাহরণ দেয়া সম্ভব। ইসলামে এই ব্যাপারে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা থাকলে ইসলামী আইনে বিশেষজ্ঞ খোদ মিনহায এর বিরোধিতা করতেন। সুতরাং আজকের পরিপ্রেক্ষিতে আটশ’ বছর আগে একজন নারীর মসনদে বসাটা অস্বাভাবিক মনে হলেও তখনকার প্রেক্ষিতে সেটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ইতিহাস লেখার সময় পুরুষ ঐতিহাসিকেরা তাদের সহজাত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বজায় রাখায় ‘সুলতান আল মুয়াজ্জাম জালালাত্ আদ্ দীন রাদ্বিয়াহ্ আদ্ দুনিয়া ওয়া আদ্ দীন’ হয়ে যান ‘সুলতানা রাজিয়া’।
ক্ষমতায় আসীন হয়ে রাদ্বিয়াহ্ ইলতুৎমিশের আমল থেকে চলে আসা অন্তর্কলহ সাময়িকভাবে প্রশমিত করতে এবং ফিরুযের আমলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুরাবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে সমর্থ হন। তবে যে সাড়ে তিন বছর রাদ্বিয়াহ্ ক্ষমতায় ছিলেন তার মধ্যে খুব কম সময়ই তিনি শান্তিতে শাসন করতে পেরেছিলেন। বিদ্রোহীদের সাবেক নেতা উযিরে আযম নিজাম উল মুল্ক মুহাম্মাদ জুনায়েদি রাদ্বিয়াহ্’র ক্ষমতা গ্রহনকে মেনে নেননি। মালিক আলা’উদ্ দীন জানি, মালিক সাঈফ উদ্ দীন কুচি, মালিক কবির খান আয়াজী, মালিক ইয়াজ উদ্ দীন মুহাম্মাদ সালারের মতো ক্ষমতাবান প্রসাশকেরা জুনায়েদি’র সাথে বিদ্রোহে যুক্ত হন। একমাত্র আওধের প্রশাসক নুসরাত উদ্ দীন তাবাশি মুইজ্জি রাদ্বিয়াহ্’র পক্ষ অবলম্বন করে তাঁর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। তাবাশি’র বাহিনী গঙ্গা পার হয়ে দিল্লীর দিকে অগ্রসর হলে বিদ্রোহীদের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হবার আগেই অসুস্থ তাবাশি মৃত্যু বরণ করেন। দিল্লীতে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। রাদ্বিয়াহ্ তাঁর বাহিনী নিয়ে যমুনার তীরে অবস্থান নেন। এক সময় কবির খান আর সালার পক্ষ ত্যাগ করেন রাদ্বিয়াহ্র পক্ষে চলে আসেন। ফলে ক্ষমতাচক্রের একাংশের সহায়তায় রাদ্বিয়াহ্ বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হন। যুদ্ধে কোচি ও জানি নিহত হলেও জুনায়েদি পলায়নে সক্ষম হন। কিন্তু পরে জুনায়েদিও নিহত হন, কিন্তু কীভাবে তা স্পষ্ট নয়। এভাবে রাদ্বিয়াহ্ প্রথম বিদ্রোহ সফলভাবে দমন করেন।
প্রথম বিদ্রোহের সফল দমনের ফলে অন্যান্য প্রশাসক, যাদের মধ্যে বিদ্রোহ করার সম্ভাবনা ছিল তারা, রাদ্বিয়াহ্র বশ্যতা স্বীকার করে নেন। এতে পূর্বে লক্ষ্মণাবতী (পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা) থেকে পশ্চিমে দেবল (সিন্ধুর শুক্কুর জেলা) ও দামরিলাহ্ (সিন্ধুর থাট্টা জেলা) পর্যন্ত তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য মাঝের কিছু কিছু জায়গা, যেমন গোয়ালিয়র বা রনথম্ভোরে মামলুক শাসন অগ্রাহ্য করে স্থানীয়দের শাসন মোটামুটি অব্যাহত ছিল। ইলতুৎমিশ এবং রাদ্বিয়াহ্ উভয়েই গোয়ালিয়র জয় করলেও তা বার বার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল।
রাদ্বিয়াহ্র শাসনামলের শুরুর দিকে দিল্লীতে শিয়া-সুন্নী বিদ্রোহ চরমে ওঠে। নূর উদ্ দীন নামের একজন শিয়া ধর্মীয় নেতা গুজরাত, সিন্ধু ও দিল্লীর কারামিতাহ্ ও মুলাহিদ্দাহ্ স্কুলিং-এর অনুসারীদের জড়ো করে সুন্নী হানাফী ও শাফীঈ মাযহাবের অনুসারীদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে। এক জুম্মার দিনে নূর উদ্ দীন শিয়াদের দলবল নিয়ে দিল্লী জামে মসজিদ আক্রমণ করে। নূরের দল দুইভাগে বিভক্ত হয়ে একদল উত্তর দিকের হিসার ই নও দিয়ে আর আরেক দল দক্ষিণ দিকে বাজার ই বাজান হয়ে মাদ্রাসা ই মুয়িজ্জি’র (জামিয়া মিল্লিয়া) প্রবেশ পথ দিয়ে মুসল্লীদের ওপর ঢাল-তলোয়ার নিয়ে আক্রমণ করে। বিপুল সংখ্যক নিরস্ত্র মুসুল্লী শিয়াদের হাতে নিহত হন। কিন্তু সেনাবাহিনী দ্রুত দৃশ্যপটে হাজির হয়ে শিয়াদের দমন করতে সমর্থ হয়। ফলে দীর্ঘমেয়াদী শিয়া-সুন্নী বিদ্রোহের সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষত করা সম্ভব হয়।
রাদ্বিয়াহ্’র প্রাক্তন বিশ্বস্ত প্রশাসক কবির খান ১২৩৯ সালে লাহোরে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রাদ্বিয়াহ্ সসৈন্যে লাহোর আক্রমণ করেন। যুদ্ধে রাদ্বিয়াহ্ জয়লাভ করলেও লাহোর অঞ্চলে কবির খানের প্রভাব অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয় না। ফলে, এক পর্যায়ে রাদ্বিয়াহ্ কবির খানের সাথে সমঝোতায় পৌঁছান। কবির খানকে তিনি লাহোরের পাশাপাশি মুলতানের প্রশাসকও নিয়োগ করতে বাধ্য হন। এই ঘটনায় মুলতানের পদচ্যুত প্রশাসক মালিক ইখতিয়ার উদ্ দীন কারাকুশ মনে রাগ পুষে থাকেন। আপাতত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও অন্য এক কারণে আবারও অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে।
জামাল উদ্ দীন ইয়াকুত ছিলেন পূর্ব আফ্রিকার সিদী বংশোদ্ভূত দাস। রাদ্বিয়াহ্’র সাথে তাঁর পরিচয়ের শুরুটা অজ্ঞাত। তবে তাঁদের দুজনের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক আছে এমন কথা ডালপালা মেলতে থাকে যখন রাদ্বিয়াহ্ তাঁকে রাজকীয় অশ্বশালার দায়িত্ব (আমীর ই আখুর) অর্পণ করেন। অচিরেই তিনি পদন্নোতি পেয়ে রাদ্বিয়াহ্র ব্যক্তিগত সহকারী (আমীর উল উমরাহ্) পদে নিয়োগ পান। মুহাম্মাদ কাশিম হিন্দু শাহ্ (তারিখ ই ফিরিশ্তা) জানাচ্ছেন, এরপর রাদ্বিয়াহ্ তাঁর সাথে প্রকাশ্যে মেলামেশা শুরু করেন। রাদ্বিয়াহ্ যখন ঘোড়ায় চড়তেন ইয়াকুত নাকি তখন তাঁর দুই বগলের নিচে হাত দিয়ে তাঁকে ঘোড়ায় চড়তে সাহায্য করতেন। ফিরিশ্তার এই বর্ণনা ভিত্তিহীন। কারণ, অন্য সুলতানদের ন্যায় স্বাভাবিক সময়ে বা যুদ্ধক্ষেত্রে রাদ্বিয়াহ্ হাতির পিঠে চড়তেন, ঘোড়ার পিঠে নয়। সেনাবাহিনীতে পন্টিক-কাস্পিয়ান তুর্কীস্তানীদের প্রাধান্য থাকলেও মোল্লা ও কাযীদের মধ্যে তাজিকদের প্রাধান্য ছিল। তাজিকরা স্পষ্টতই রাদ্বিয়াহ্র বিপক্ষে ছিল। রাদ্বিয়াহ্র পুরুষদের কোট ও পাগড়ি পরিধান এবং নেক্বাব পরিহার করা তাজিক মোল্লাদের ক্ষুদ্ধ করে। ফলে খোদ রাজধানীতেই রাদ্বিয়াহ্ বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে উঠতে থাকে। ইয়াকুতের সাথে রাদ্বিয়াহ্র প্রেমের কথিত গল্প সম্ভবত ফুতুহ্ উস্ সালাতীনের রচয়িতা খাজা আবদুল্লাহ্ মালিক ইসামীর আবিষ্কার। পরে ঐতিহাসিক গালগল্পের লেখক ইবনে বতুতা একশ’ বছর পরে ভারতে এসে সেই প্রেমকাহিনীর বিস্তারিত (রেহ্লাহ্) রচনা করেন। তবে এ’কথা সত্য যে, ইয়াকুতের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতাবৃদ্ধিতে তুর্কীস্তানীরা অচিরে ক্ষমতাচক্রে সিদী বা হাবসীদের প্রাধান্য বিস্তারের সম্ভাবনা দেখতে পায়। তাছাড়া সেনাপ্রধান বা নায়েব ই লস্কর পদে তুর্কীস্তানী নন্ এমন একজন মালিক সাঈফ উদ্ দীনের নিয়োগকেও তারা তুর্কীস্তানীদের প্রাধান্য হ্রাস হিসেবে দেখতে পায়। ফলে, তাদের পক্ষে ইয়াকুতকে নিয়ে এমন গুজব রটানো অসম্ভব কিছু না। তাছাড়া তুর্কীস্তানী অভিজাতদের চোখে ইয়াকুত একজন কৃষ্ণাঙ্গ দাস, সেখানে রাদ্বিয়াহ্’র মতো একজন শ্বেতাঙ্গ ও তুর্কীস্তানী সুলতানকন্যার সাথে তাঁর কোন প্রকার সম্পর্ক হওয়ার সম্ভাবনাকে তারা জাতিচ্যুতির মতো ব্যাপার হিসেবে ভেবেছিলেন। আটশ’ বছর আগে তো বটেই, এখনো ভারতবর্ষের কোথাও কোন প্রভাবশালী নারী একজন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানকে বিবাহ করতে চাইলে অনেকেরই বর্ণবাদী রূপ খোলস ছেড়ে বের হবে।
১২৪০ সালের এপ্রিলে রাদ্বিয়াহ্ লাহোরের বিদ্রোহ দমন করে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তনের পর পর শারহিন্দের (ভাতিণ্ডা) প্রশাসক মালিক ইখতিয়ার উদ্ দীন আলতুনিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রাদ্বিয়াহ্ আবারও বিদ্রোহ দমনে এগিয়ে যান। কিন্তু রাদ্বিয়াহ্ পক্ষের সেনানায়কেরা জামাল উদ্ দীন ইয়াকুত কর্তৃক সেনাবাহিনী পরিচালনা পছন্দ করেননি। এমনিতেই তারা ইয়াকুতের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন, এক্ষণে তাঁর বর্ধিত কর্তৃত্ব তাঁদেরকে আরো ক্ষুদ্ধ করে তোলে। তারা খোদ রাদ্বিয়াহ্’র দেহরক্ষী দলকে (প্রেসিডেন্ট’স গার্ড রেজিমেন্টের অনুরূপ) আক্রমণ করে ইয়াকুতকে হত্যা করেন, এবং রাদ্বিয়াহ্কে বন্দী করে আলতুনিয়ার কাছে পাঠান। দলত্যাগী আমীরদের ভূমিকা এই ঘটনার ৫১৭ বছর পরে পলাশীর প্রান্তরে রাজবল্লভ-রায়দুর্লভদের ভূমিকার কাছাকাছি। সম্ভবত রবার্ট ক্লাইভের মতো আলতুনিয়া ক্ষুদ্ধ আমীরদেরকে আগেই হাত করে রেখেছিলেন। এই অবসরে ইলতুৎমিশের কনিষ্ঠ পুত্র মুয়িয্ উদ্ দীন বাহ্রাম দিল্লীর মসনদ দখল করে বসেন।
বন্দী রাদ্বিয়াহ্র ভাগ্যে আসলে কী ঘটেছিল সেটা কেউ স্পষ্ট করে বলেননি। এ’ব্যাপারে যে সব ভাষ্য প্রচলিত সেগুলো হচ্ছে,
১. বন্দী রাদ্বিয়াহ্কে দেখে আলতুনিয়া প্রেমে পড়ে যান এবং রাদ্বিয়াহ্কে মৃত্যুদণ্ড গ্রহন অথবা তাঁকে পতিত্বে বরণ করার সুযোগ দেয়া হয়। জীবন বাঁচাতে নিরুপায় রাদ্বিয়াহ্ দ্বিতীয় প্রস্তাব গ্রহন করেন।
২. আলতুনিয়া ছিলেন রাদ্বিয়াহ্’র শৈশবের সাথী। তিনি অনেক কাল ধরেই রাদ্বিয়াহ্র প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। বন্দী অবস্থায় রাদ্বিয়াহ্কে তাঁর কাছে আনা হলে তিনি রাদ্বিয়াহ্’র কাছে নিজের অভিলাষ ব্যক্ত করেন। রাদ্বিয়াহ্ও তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট যে, আলতুনিয়ার লক্ষ্য শুধু দিল্লীর মসনদই ছিল না সাথে রাদ্বিয়াহ্ও ছিলেন। আলতুনিয়া তাই যুদ্ধে ইয়াকুতকে হত্যা এবং রাদ্বিয়াহ্কে বন্দী করেন। রাদ্বিয়াহ্ পুরুষ হলে আলতুনিয়া তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রেই হত্যা করতেন। রাদ্বিয়াহ্’র প্রতি আলতুনিয়ার প্রেম থাকলে তিনি রাদ্বিয়াহ্’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা না করে বিবাহের প্রস্তাব পাঠাতেন। রাদ্বিয়াহ্’র কথিত প্রেমিক ইয়াকুত জীবিত থাকলে রাদ্বিয়াহ্কে পাওয়ার আশা দূরাশা মনে করে ইয়াকুতকে হত্যা করা হয়নি। এটা রাদ্বিয়াহ্’র প্রতি অনুরাগবশত নয়, বরং বর্ণবাদী ও মেল শভিনিস্ট আলতুনিয়া ও আমীরের দল এর মাধ্যমে এক ঢিলে কয়েকটা পাখি মেরেছেন।
শুধু কি নিজের জীবন বাঁচাতে রাদ্বিয়াহ্ আলতুনিয়াকে বিবাহে সম্মত হয়েছিলেন? নিঃসন্দেহে, না। একজন নির্ভীক যোদ্ধা রাদ্বিয়াহ্ মৃত্যুভয়ে ভীত হবার কথা না। রাদ্বিয়াহ্ হয়তো চেয়েছিলেন আলতুনিয়ার সহায়তায় দিল্লী আক্রমণ করে মুয়িয্ উদ্ দীন বাহ্রামকে হঠাতে। এর সপক্ষে প্রমাণ হচ্ছে অনতিবিলম্বে আলতুনিয়াকে দিল্লী আক্রমণে বাধ্য করানো। আলতুনিয়ার অজ্ঞাতেই রাদ্বিয়াহ্ ভাতিণ্ডার সেনাবাহিনীকে দিল্লীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়ে দিয়েছিলেন। এই কৌশলগত কারণটি ছাড়াও আরো একটি কারণের সম্ভাবনা আছে। অত্যন্ত কুণ্ঠার সাথে বলতে হচ্ছে যে, রাদ্বিয়াহ্ সম্ভবত আলতুনিয়া কর্তৃক ধর্ষিতা হয়েছিলেন। এমনটা মনে করার কারণ, মিনহাযসহ অন্য ঐতিহাসিকেরা এই পর্বটি যত অল্প কথায় সম্ভব বলে, কোন প্রকার বিস্তারিত তথ্য না দিয়ে শেষ করেছেন। আলতুনিয়া বন্দিনী রাদ্বিয়াহ্র সাথে আসলে কী ব্যবহার করেছিলেন সেটা তাঁরা বলেননি। পিউরিটান ধরনের ঐতিহাসিক মিনহায তাঁর রচনায় (তাবাক্বাত ই নাসিরি) খুনোখুনির ঘটনায়ও সচরাচর ‘হত্যা’ শব্দটিও ব্যবহার করতে চাননি। তাঁর বর্ণনায় যুদ্ধে পরাজিত ও ধৃত ব্যক্তিরা বন্দী হবার পরে অসুস্থ হয়ে মারা যেতেন। অনেকটা নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে পরিচালিত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ চলা কালে বন্দীদের হৃদরোগে মারা যাবার মতো ব্যাপার। দুরাচার ফিরুযের মতো শাসকদের প্রশংসায়ও তিনি পঞ্চমুখ ছিলেন। সুতরাং এমন ঐতিহাসিকের কলমে দিল্লীর সুলতানের ধর্ষিতা হবার কথা সরবে না।তাছাড়া রাদ্বিয়াহ্র চেয়ে মাত্র ১২ বছরের বড় মিনহায ই সিরাজ ইলতুৎমিশ পরিবারের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। রাদ্বিয়াহ্ তাঁকে গোয়ালিয়রের কাজী এবং দিল্লীর মাদ্রাসা ই নাসিরীয়া’র (জামিয়া ই উলুম) অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। সুতরাং রাদ্বিয়াহ্র জন্য অবমাননাকর হতে পারে এমন কিছু তিনি লিখবেন না। মিনহায ব্যতীত অন্য ঐতিহাসিকেরা, যেমন, ফুতুহ্ উস্ সালাতীনের রচয়িতা খাজা আবদুল্লাহ্ মালিক ইসামী অথবা তারিখ ই ফিরুযশাহী’র রচয়িতা জিয়া উদ্ দীন বারানী, কেউই রাদ্বিয়াহ্’র সমসাময়িক নন্। তাই তাঁদের রচনা মূলত মিনহাযের ভাষ্যের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করেছে। ইবনে বতুতা বা নাযির আহমাদ’রা যা লিখে গেছেন সেগুলো ঐতিহাসিক গালগল্প, ইতিহাস নয়। এ’সমস্ত কারণে ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়টি আর প্রকাশিত হতে পারেনি। পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী ঐতিহাসিকদের পক্ষে একদল হীনমনা পুরুষের কুকীর্তি ঢাকতে চাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
কারণ যা-ই হোক, ঘটনা এরকম দাঁড়ালো যে, আলতুনিয়া আর রাদ্বিয়াহ্র বিবাহ সম্পন্ন হলো, তার পরপরই তাঁরা দিল্লী আক্রমণ করতে রওয়ানা হন। সালারি, কারাকুশসহ আরো কিছু আমীর তাঁদের বাহিনী নিয়ে দিল্লীর পক্ষ ত্যাগ করে রাদ্বিয়াহ্দের পক্ষে যোগ দেন। কিন্তু তাঁদের এই যোগ দেয়াটা ভাতিণ্ডার যুদ্ধের মত আরেকটা ব্যাপার ছিল। দিল্লীর সেনাবাহিনী তাঁদের মুখোমুখি হলে পক্ষত্যাগী আমীরের দল তো বটেই আলতুনিয়ার পক্ষের অনেকেও পালিয়ে যায়। ফলে যুদ্ধে রাদ্বিয়াহ্দের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়।
পরাজিত রাদ্বিয়াহ্ ও আলতুনিয়াকে অচিরেই জীবন দিতে হয়। কিন্তু সেটা কীভাবে তা নিয়ে মতদ্বৈততা আছে। একটা মত হচ্ছে, ১৩ই অক্টোবর ১২৪০ সালে তাঁরা দিল্লীর সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং পরদিন তাঁদের হত্যা করা হয়। অন্যদিকে খাজা নিজাম উদ্ দীন আহমাদ জানাচ্ছেন (যুবদাত আল তাওয়ারিখ এবং তাবাক্বাত ই আকবরী), পরাজিত রাদ্বিয়াহ্ উত্তরে পালিয়ে গিয়ে খোখারদেরকে দিল্লীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সংগঠিত করেন। একাকী রাদ্বিয়াহ্র পক্ষে খোখারদের দিল্লীর বিরুদ্ধে লড়াইতে নামানো রাদ্বিয়াহ্র বিরল নেতৃত্বগুণের পরিচায়ক। কিন্তু তিন/চার মাস পরে কাইথালের (হরিয়ানা) যুদ্ধে রাদ্বিয়াহ্র বাহিনী দিল্লীর কাছে পরাজিত হলে তাঁকে আবারও পলায়ন করতে হয়। এই দফা পলাতক অবস্থায় রাদ্বিয়াহ্ স্থানীয় এক কৃষক পরিবারে আশ্রয় গ্রহন করেন। আশ্রয়দাতা পরিবারের কেউ একজন মূল্যবান পোশাক ও অলঙ্কারের লোভে ঘুমন্ত রাদ্বিয়াহ্কে হত্যা করে। খাজা আবদুল্লাহ্ মালিক ইসামী’ও দিল্লীর বিরুদ্ধে রাদ্বিয়াহ্র দুই বার যুদ্ধ করার কথাকে সমর্থন করেছেন।
এই ভাষ্যগুলোতে আলতুনিয়ার পরিণতির ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। মিনহাযের ভাষ্য অনুযায়ী আলতুনিয়াকে বন্দী অবস্থায় মনসুরপুরে নিয়ে গেলে স্থানীয় ‘হিন্দু’রা তাঁকে হত্যা করে। দিল্লীর সৈন্যরা তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলে ‘হিন্দু’রা তাঁকে কীভাবে হত্যা করলো সে ব্যাপারে মিনহায কিছু বলেননি। মিনহাযের এই ভাষ্য থেকে ধারণা করা যাচ্ছে যে, খোখারদের নিয়ে দিল্লীর বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে আলতুনিয়া রাদ্বিয়াহ্র সাথে ছিলেন না। এবং আলতুনিয়া রাদ্বিয়াহ্র সাথে নিহত হননি। এখান থেকে এটাও ধারণা করা যাচ্ছে যে, আলতুনিয়াকে বিবাহ করতে বাধ্য হলেও রাদ্বিয়াহ্র মূল লক্ষ্য ছিল দিল্লী পুনরুদ্ধার করা এবং সেখানে আলতুনিয়ার উপস্থিতি আবশ্যিক নয়।
আলতুনিয়া ও রাদ্বিয়াহ্র হত্যাকারীদেরকে ভাষ্যকাররা ‘হিন্দু’ বলে উল্লেখ করলেও ধর্ম বিশ্বাসে তারা হিন্দু ছিল কিনা এটা স্পষ্ট নয়। কারণ, অধিকাংশ ভাষ্যকার ধর্ম নির্বিশেষে স্থানীয় সকলকে ‘হিন্দু’ বলে উল্লেখ করেন। তাছাড়া হিন্দুদের ওপর এই দায় চাপানোর একটি ভিত্তি হচ্ছে রাদ্বিয়াহ্র কাছে পরাজিত রনথম্ভোরের রাজা ভগদত্তের নেতৃত্বে চৌহানরা, এবং তাদের সহায়তায় উত্তর-পূর্ব রাজপুতনার রাজপুতেরা এবং দিল্লী অঞ্চলের মেওয়াটিরা রাদ্বিয়াহ্র শাসনামলের পুরো সময়কালে তাঁর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। কিন্তু সেই সাথে এটা ভুললে চলবে না যে, শেষ যুদ্ধে রাদ্বিয়াহ্র বাহিনীতে খোখারদের সাথে জাঠ এবং উত্তর রাজপুতণার রাজপুতেরাও ছিল। হিন্দুরা যদি তাঁর বিদ্বেষীই হতো তাহলে তারা তাঁর দলে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করে কী করে!
রাদ্বিয়াহ্ কোথায় নিহত হন সেটা খুব স্পষ্ট নয়। সেটা যে স্পষ্ট নয় তা তাঁর সমাধি নিয়ে বিতর্কে তা প্রমাণিত। সে ব্যাপারে পরে বলা হবে, তার আগে রাদ্বিয়াহ্ কীর্তি সম্পর্কে বলে নেয়া দরকার।
রাদ্বিয়াহ্র স্বল্পকালীন শাসনামলে কতগুলি খাতে অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। অমুসলিমদের ওপর ধার্য ‘জিযিয়া’ কর প্রত্যাহারের ব্যাপারে মুঘল সম্রাট আকবরের নাম ইতিহাসে বহুল আলোচিত হলেও আকবরের তিনশ’ বছরেরও আগে রাদ্বিয়াহ্ই প্রথম ‘জিযিয়া’ কর প্রত্যাহার করেন। ঘোরীরা ভারতবর্ষ শাসন করলেও আগাগোড়া তারা বহিরাগতই থেকে গেছে। সে তুলনায় মামলুকেরা অনেক বেশি ভারতীয়। আয়েবাক এবং ইলতুৎমিশ তুর্কীস্তানে জন্মালেও তাঁদের সন্তানেরা ভারতেই জন্মেছেন। আয়েবাক বা ইলতুৎমিশ ভারতকে তুর্কীস্তানের সাথে জুড়তে চাননি। বরং পূর্ব দিকে রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা এবং নানা ধরনের স্থাপত্যকীর্তি নির্মাণ প্রমাণ করে তাঁরা ভারতীয় হবার চেষ্টা করছিলেন। নাসিরের তিব্বত জয়ের চেষ্টা ভারতকে তুর্কীস্তানের সাথে জোড়ার চেষ্টা না-ও হতে পারে। রাদ্বিয়াহ্ই প্রথম স্থানীয়দেরকে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন। যেমন, তিনি উচ্ (বাহ্ওয়ালপুর, পাঞ্জাব)-এর প্রশাসক হিসেবে একজন স্থানীয়কে নিয়োগ দেন। এটি প্রমাণ করে তিনি আরো বেশি ভারতীয় হয়ে উঠছিলেন। বলাই বাহুল্য, জিযিয়া কর প্রত্যাহার ও স্থানীয়দের প্রশাসনে বসানোর কোনটাই ক্ষমতাসীন তুর্কীস্তানী আমীরের দল পছন্দ করেনি। রাদ্বিয়াহ্ প্রথম থেকেই সর্বসাধারণের সাথে সহজভাবে মিশতেন তাই ফিরুযের সময়কালে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হলে স্থানীয়রা ক্ষুদ্ধ হন এবং তাঁর পক্ষাবলম্বন করেন। সেসময়ের প্রেক্ষিতে কোন রাজন্যের পক্ষে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের বিদ্রোহ একটি বিরল ঘটনা। রাদ্বিয়াহ্ সবচে’ উল্লেখযোগ্য কীর্তি হচ্ছে শিক্ষার প্রসার। তিনি অনেক সাধারণ শিক্ষায়তনের পাশাপাশি ইসলাম, দর্শন, প্রকৃতিবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও সাহিত্য বিষয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য গবেষণাগার স্থাপন করেন। এইসব উচ্চতর শিক্ষায়তন অভিজাত মুসলিমদের পাশাপাশি স্থানীয় (হিন্দু) স্কলারদের জন্যও উন্মূক্ত ছিল। পরবর্তী পাঁচশ’ বছরেও দিল্লীর কোন শাসককে শিক্ষা খাতকে এতোটা গুরুত্ব দিতে দেখা যায়নি। রাদ্বিয়াহ্র স্থাপত্য কীর্তির ব্যাপারে নারায়ণ সান্যাল আগ্রা ইতামাদ উদ্ দৌলা, আগ্রা জামে মসজিদ ও হুমায়ুন কা মাক্ববারা’র কথা উল্লেখ করলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলোর নির্মাণ মুঘল আমলে হয়েছে। একটা সম্ভবনা এমন হতে পারে যে, এই স্থাপত্যকীর্তিগুলোর নির্মাণ রাদ্বিয়াহ্ আমলে শুরু হয়েছিল। কিন্তু এই ধারণার সপক্ষে কোন ভাষ্য পাওয়া যায় না।
সাদ্র উদ্ দীন হাসান নিযামী’র ‘তাজুল মাসির’কে দিল্লী সালতানাতের ওপরে লেখা প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ বলে ধরা হলেও সেটা তরাইনের প্রথম যুদ্ধ থেকে শুরু করে সুলতান ইলতুৎমিশ পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। সুতরাং এই গ্রন্থে রাদ্বিয়াহ্ সম্পর্কে বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। মিনহাযের সমসাময়িক মান্সুর মুবারাক শাহ্ আল কুরায়েশী বা ফখর্ আল মুদাব্বিরের ‘আদাব উল মুল্ক ওয়া ক্বিফায়াত আল মামলুক’ গ্রন্থে ইলতুৎমিশের ব্যাপারে যতটা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন রাদ্বিয়াহ্র ব্যাপারে সে তুলনায় কিছুই বলেননি। তাছাড়া মান্সুর মূলত জোর দিয়েছেন ইলতুৎমিশ আমলের যুদ্ধগুলোর ব্যাপারে। তাই রাদ্বিয়াহ্র ব্যাপারে মিনহাযের ভাষ্যকেই মূল ভিত্তি ধরতে হয়। শেষ যুদ্ধে রাদ্বিয়াহ্র বিপক্ষে থাকা গিয়াস উদ্ দীন বলবন পরবর্তীকালে মিনহাযের প্যাট্রন ছিলেন। সুতরাং মিনহায বলবনকে উপরে তুলতে গিয়ে রাদ্বিয়াহ্ কিছু কিছু কৃতিত্ব হয় চেপে গেছেন অথবা অনুল্লেখযোগ্য ভাবে বর্ণনা করেছেন। ইসামী, বারানী, বতুতা’র রচনা সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে।
আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে রোমিলা থাপার প্রাচীন ভারতের ইতিহাস লিখতে গিয়ে রাদ্বিয়াহ্র প্রতি সুবিচার করেননি। তিনি মিনহাযকে ভর করে তিন-চার বাক্যে রাদ্বিয়াহ্র ইতিহাস শেষ করে দিয়েছেন। অথচ রাদ্বিয়াহ্ ভারতের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাসক। এই দিক দিয়ে রাফিক জাকারিয়া বরং এগিয়ে আছেন। তিনি রাদ্বিয়াহ্র ওপর ‘রাযিয়া — ওয়ারিয়র কুইন অভ ইন্ডিয়া’ নামে পূর্ণ ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেখানে আলতুনিয়া কাণ্ডে কিছুটা স্ববিরোধীতা থাকলেও সেটা রাদ্বিয়াহ্ ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত নির্মোহ বিশ্লেষণ।
রাদ্বিয়াহ্র সমাধি কোথায় এই ব্যাপারে এখন পর্যন্ত অন্তত তিনটি দাবি পাওয়া যায়। প্রথম দাবিটি হচ্ছে পুরনো দিল্লীর তুর্কমেন গেটের কাছে শাহ্জাহানাবাদের (সীতারাম বাজার) বুলবুল ই খানা। এখানে আশেপাশের বাড়িঘরের মধ্যে এক জঙ্গলা জায়গায় রাদ্বিয়াহ্, ফিরুয ও তাঁদের বোন সাদ্বিয়াহ্’র সমাধি আছে বলে দাবি করা হয়। হিসেব অনুযায়ী ফিরুযের সমাধি থাকার কথা দিল্লীর কুওত উল ইসলাম মসজিদের কাছে — যেখানে ইলতুৎমিশের সমাধি আছে। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিতপক্ষ ফিরুযকে জয়ীপক্ষ কুওত উল ইসলামের বদলে বুলবুল ই খানাতে সমাধিস্থ করাটা অস্বাভাবিক কিছু না। একইভাবে যুদ্ধে পরাজিতপক্ষ রাদ্বিয়াহ্কেও বুলবুল ই খানাতে সমাধিস্থ করাটা স্বাভাবিক। তবে খোখারদের নিয়ে কাইথালের যুদ্ধের কথা মেনে নিলে বুলবুল ই খানাতে রাদ্বিয়াহ্কে সমাধিস্থ করার ব্যাপারটি একটু কষ্টকল্পনা হয়ে যায়। কারণ, কাইথালে নিহত রাদ্বিয়াহ্র লাশ দিল্লীতে আনার মতো বোকামি বলবন বা বাহ্রাম করবেন না। রাদ্বিয়াহ্র লাশ দেখলে দিল্লীর সাধারণ মানুষ আবেগাক্রান্ত হতে পারতো, তাতে ক্রমাগত পক্ষ পালটানো মালিক আর আমীরের দল বাহ্রামকে ত্যাগ করে নতুন করে বিদ্রোহের সূচনা করতে পারতো। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষও এই সমাধিটিকে রাদ্বিয়াহ্র সমাধি হিসেবে মানেনি।
দ্বিতীয় দাবিটি হচ্ছে হরিয়ানার কার্নাল জেলার কাইথালের কাছে সিওয়ানে। কয়েক বছর আগে সেখানে একটি জেলখানা নির্মাণ করা হয়েছে। রাদ্বিয়াহ্র সমাধি রক্ষার্থে ওয়াক্বফ্ বোর্ডসহ সরকারের নানা সংস্থার দড়ি টানাটানি চললেও এখনো তার মীমাংসা হয়নি, এবং সমাধিটি যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়নি।
তৃতীয় দাবিটি হচ্ছে রাজস্থানের টংকে। এখানে প্রাপ্ত দুটি কবরের সমাধিলিপি স্থানীয় অধ্যাপক সৈয়দ সাদিক আলী পাঠোদ্ধার করে জানিয়েছেন তার একটিতে লেখা “শাহীদ ই মুহাব্বাত ক্বুয়াতুল মুল্ক জামাল উদ্ দীন ইয়াকুত” এবং অন্যটিতে “সুলতান উল হিন্দ রাদ্বিয়াহ্”। সাদিকের ভাষ্য সঠিক বলে ধরলে এই সমাধি দুটি রাদ্বিয়াহ্ ও ইয়াকুতের হয়। কিন্তু ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বিশ্লেষণে রাদ্বিয়াহ্ ও ইয়াকুতের সমাধি একই স্থানে হবার দাবিটি ধোপে টেকে না। কারণ, না তাঁরা একই সময়ে নিহত হয়েছিলেন, না তাঁরা একই স্থানে নিহত হয়েছিলেন। টংক জায়গাটা দিল্লীর দক্ষিণ-পশ্চিমে আর ভাতিণ্ডা হচ্ছে দিল্লীর উত্তর পশ্চিমে। তার মানে, ভাতিণ্ডা বা তার আশে পাশে ইয়াকুত এবং কাইথাল বা দিল্লীতে রাদ্বিয়াহ্ নিহত হয়ে থাকলে তাঁদের কাউকে অত দূরের টংকে সমাহিত করার কোন কারণ নেই। তবু কোন কারণে ইয়াকুতকে টংকে সমাহিত করা হয়ে থাকলেও তৎকালীন পরিস্থিতিতে পরবর্তীতে নিহত রাদ্বিয়াহ্র লাশ টংকে নিয়ে সমাহিত করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ইয়াকুতের সমাধিলিপিতে ‘শাহীদ ই মুহাব্বাত’ ধরনের রোমান্টিক উপাধি লেখার মতো বা রাদ্বিয়াহ্র সমাধিলিপিতে ‘সুলতান উল হিন্দ’ ধরনের সেই সময়ে অপ্রচলিত উপাধি লেখার মতো উর্বর মস্তিষ্কের এবং অদরকারী সাহসসম্পন্ন কাউকে ত্রয়োদশ শতকে পাওয়া যাওয়ার কথা না।
সবদিক বিবেচনায়সমাধি হিসেবে কাইথালের দাবিটিকে অধিকতর গ্রহনযোগ্য বলা যায়। কেউ কেউ এমনটাও দাবি করেন যে, রাদ্বিয়াহ্কে প্রথমে কাইথালে সমাহিত করার পরে কোন এক সময় দিল্লীতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই দাবির পক্ষে কোন যুক্তি বা প্রমাণ কেউ হাজির করতে পারেননি। তবে সাধারণ বোধ দিয়ে বোঝা যায় যে, দাবিটি ভিত্তিহীন।
কুরুক্ষেত্র জায়গাটি কাইথাল থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে, আর দিল্লী থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে। পৌরাণিক কালে কুরুক্ষেত্রে ব্যাসদেবের বংশধরেরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ভাতৃঘাতী যুদ্ধে নেমেছিল, আর ত্রয়োদশ শতকে দিল্লীর মামলুকেরা বহুধা বিভক্ত হয়ে ভাতৃঘাতী লড়াই করে গেছে। মামলুকদের এই লড়াইগুলোর নিয়তি নির্ধারিত হয়েছে ক্ষমতাবান মালিক ও আমীরের দল কখন, কার পক্ষ অবলম্বন করছে তার ওপর। বস্তুত মামলুক সালতানাত আসলে এক প্রকার মালিকশাহী-আমীরশাহী ছিল। তাবাক্বাত ই নাসিরিতে প্রবল ক্ষমতাধর মালিকদের ওপর বিস্তারিত বর্ণনাতে তাঁদের ক্ষমতার সীমা সম্পর্কে বোঝা যায়। মালিক-আমীরদের বার বার পক্ষ ত্যাগের দরুণ মামলুক সুলতানদের মধ্যে সবচে’ বেশি বার প্রতারিত হয়েছেন রাদ্বিয়াহ্। ক্রমাগত প্রতারণার ফলে এক সময় তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তবে ভালো করে ভেবে দেখলে দেখা যাবে, রাদ্বিয়াহ্ সারা জীবনই নিঃসঙ্গ ছিলেন। শৈশব থেকে হেরেমের বাইরে বেড়ে ওঠায় তাঁর জীবন পরিবারের অন্য নারীদের মতো হয়নি। তাই তাঁর কোন প্রিয় সঙ্গীসাথীর কথা জানা যায় না। পরিবারের ভেতরে সম্ভবত পিতা ছাড়া আর কারো নৈকট্য লাভ করেননি, কারণ ভাইদের সাথে তাঁর বৈরী সম্পর্ক ছিল। সাধারণ মানুষের সাথে মেশার চেষ্টা তাঁকে জনপ্রিয় করেছে, কিন্তু তাঁর একাকীত্ব ঘোচায়নি। বিদ্যমান সামাজিক ও ধর্মীয় রীতির বাইরে জীবন যাপন করায় তাঁর বিদ্বেষীর সংখ্যা কেবলই বেড়েছে। ইয়াকুতের সাথে তাঁর কথিত সম্পর্ক কি তিনি ক্ষমতাসীন হবার পরে শুরু হয় নাকি আগে থেকেই ছিল সেটা স্পষ্ট নয়। তবে সবার কাছে সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তিনি ক্ষমতাসীন হবার পর ইয়াকুতের ক্রমাগত ক্ষমতাবৃদ্ধিতে। ইয়াকুত আমৃত্যু তাঁর সঙ্গী ছিলেন, তবে তার দৈর্ঘ্যও সাড়ে তিন বছরের বেশি নয়। রাদ্বিয়াহ্ যদি কোন ক্ষমতাবান মালিককে বিবাহ করতেন তাহলে বোধকরি এতো তাড়াতাড়ি তাঁকে মরতে হতো না। অবশ্য সেক্ষেত্রে ইলতুৎমিশের মামলুক সালতানাতের তখনই ইতি ঘটে অন্য কোন মামলুক সালতানাতের উদ্ভব ঘটতো। ইলতুৎমিশ তাঁকে বিবাহ দেবার চেষ্টা করেননি। বিবাহ দিলে ‘সুলতান রাদ্বিয়াহ্’ বলে ইতিহাসে কেউ থাকতেন না।
সারা ভারত জুড়ে অসংখ্য অখ্যাত-কুখ্যাত অথবা লড়াইয়ের ময়দানে কাপুরোষচিতভাবে মারা পড়া শাসকের সমাধি শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে থাকলেও রাদ্বিয়াহ্র মতো উল্লেখযোগ্য শাসকের সমাধির খোঁজ না পাওয়াটা প্রমাণ করে যে, প্রথম থেকেই রাদ্বিয়াহ্কে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। ফিরুয শাহ্ তুঘলকের আমলে দিল্লীর সুলতানদের যে নামের তালিকা তৈরি করা হয় সেখানে রাদ্বিয়াহ্র নাম রাখা হয়নি। নারী বলে তাঁকে ইতিহাসে বিশেষ স্থান দেবার প্রয়োজন ছিল না, কারণ তিনি এমনিতেই বিশেষ স্থান পাবার যোগ্য। বরং নারী বলে তাঁকে ইতিহাসে অনুল্লেখযোগ্য করে রাখা হয়েছে। খোদ মিনহায তাঁর সম্পর্কে শুরুতেই যা বলেছেন সেটা মেজর এইচ জি র্যাভের্টি’র অনুবাদে এরকমটা দাঁড়ায়,
“Sultán Raziya was a great monarch. She was wise, just, and generous, a benefactor to her kingdom, a dispenser of justice, the protector of her subjects, and the leader of her armies. She was endowed with all the qualities befitting a king, but she did not attain the destiny, in her creation, of being computed among men, of what advantage were all these excellent qualifications unto her?”
রাফিক জাকারিয়ার অনুবাদে একই অবতারণিকা লেখা হয়েছে এভাবে,
“Sultán Raziya was a great monarch. She was wise, just, and generous, a benefactor to her kingdom, a dispenser of justice, the protector of her subjects, and the leader of her armies. She was endowed with all the qualities befitting a king, but she was not born of the right sex, and so in the estimation of men all these virtues were worthless.”
মিনহাযের ভাষা সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে র্যাভের্টি’র অনুবাদটি সঠিক বলে ধরা যায়। তবে মিনহাযের উক্তির অন্তর্নিহিত অর্থ ধরলে জাকারিয়ার অনুবাদও সঠিক। অনুবাদ যেভাবেই করা হয়ে থাকুক না কেন, মূল কথা কিন্তু একটাই — যেহেতু রাদ্বিয়াহ্ পুরুষ নন্ তাই তাঁর যোগ্যতা মূল্যহীন, কীর্তি বিস্মরণযোগ্য। এবং এই কারণে প্রথম বারের মতো জিযিয়া কর প্রত্যাহার, প্রশাসনের ভারতীয়করণ, শিক্ষা ব্যবস্থার বিস্তার, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গবেষণার ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও এগুলোর কোন কৃতিত্ব তাঁকে দেয়া হয় না। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হলের নাম ‘সুলতানা রাজিয়া হল’। রাদ্বিয়াহ্ সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অবজ্ঞা কোন পর্যায়ে গেলে রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠানের এমন ভুল নাম হতে পারে এবং তা যুগের পর যুগ চলতে পারে এটি তার প্রমাণ।
হীনমনারা রাদ্বিয়াহ্কে যতই বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেবার চেষ্টা করুক অথবা তাঁকে হেয় করার চেষ্টা করুক সত্য একদিন তার স্বমহিমায় প্রকাশিত হবে। ভারতবর্ষ তো বটেই গোটা পৃথিবীর ইতিহাসেও রাদ্বিয়াহ্ স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন।
দোহাইঃ
১. ব্যক্তির নামের বানানের ক্ষেত্রে আরবী ও ফারসী উচ্চারণরীতি যথাসম্ভব অনুসরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
২. আগ্রহী পাঠকের জন্য সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী যোগ করা হলো। পাঠক নিজ দায়িত্বে বই যোগাড় করার চেষ্টা করবেন।
গ্রন্থপঞ্জীঃ
1. Menhaj-e Seraj Juzjani, Tabaqat-e Naseri, 2 Volumes, London, 1881, English translation by Major H. G. Raverty
2. Muhammad Kasim Hindu Shah , Tarikh-i-Firishta, translated into English by John Briggs under the title ‘History of the Rise of the Mahomedan Power in India’, 4 Volumes, New Delhi Reprint, 1981
3. Khwaja Abdullah Malik Esami, Fotuh al-Salatin, 2 Volumes, London, 1977, English translation by A. M. Husain
4. Ebn Battuta, Rehla, Baroda, 1976, English translation by M. Husain
5. Zia-ud Din Barni, Tarikh-i-Firoz Shahi, Lahore, 2006, English translation by H. M. Elliot & John Dowson
6. Nazeer Ahmed, Islam in Global History – from death of Prophet Muhammed to First World War, New York, 1997
7. Khawajah Nizamuddin Ahmad, Tabaqat-I-Akbari, 3 Volumes, Calcutta, 1973, English translation by Brajendranath De
8. Sadar ud Din Hassan Nizami, Tajul Maasir,
9. Fakhr i Mudabbir, Adab al-Muluk wa Kifayat al-Mamluk, Tehran, 1976, English translated by Muhammad Sarwar
10. Romila Thapar, Early India: From the Origins to AD 1300, New Delhi, 2002
11. Rafiq Zakaria, Razia – Warrior Queen of India, London, 1966
12. A. B. M. Habibullah, The foundation of Muslim rule in India: a history of the establishment and progress of the Turkish sultanate of Delhi, 1206–1290 A.D. Allahabad, 1961
13. T. Daryaee, Sasanian Persia: The Rise and fall of an Empire, London, 2009
14. S. Joseph, Encyclopedia of Women & Islamic Cultures, Leiden, 2006
15. Abolqasem Ferdowsi, The Shahnameh, London, 2007, English translation by Dick Davis
16. P. Jackson, Sultan Raḍiyya bint Iltutmish in Women in the Medieval Islamic World: Power, Patronage, and Piety, New York, 1998
প্রথমেই নিবিষ্টভাবে পাঠ ও বিস্তারিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। এমন পাঠক আর মন্তব্যকারী পেলে লেখক লিখতে উৎসাহ পায়। লেখা নিয়ে যদি আলোচনাই না হয় তাহলে লেখার আনন্দটা কি একটু কমে যায় না!
১. প্রথমে একটা খারাপ কথা বলি। আমার লেখাতে আমি রাদ্বিয়াহ্কে মানুষ এবং দিল্লীর মসনদের জন্য যোগ্যতর প্রার্থী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিক তাঁকে মূলত 'পুরুষ' বা 'নারীর শরীরে জন্মানো পুরুষ' হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। একদম সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর ওপরে করা গবেষকদের বিশ্লেষণেও অমনটাই উঠে এসেছে। যেমন, Alyssa Gabbay'র ভাষায়,
"It will argue that despite medieval Muslim India’s assigning to women a status separate from and inferior to that of men, a metaphorical space existed in which women could identify or be identified as men. As in many non-Muslim societies, such identification could become a means for a daughter to enter into male sociopolitical spheres."
অথবা Valerie R. Hotchkiss-এর ভাষায়,
"Redefining the female role, without radically displacing the androcentric archetype of the hero, the cross-dressed woman compels authors and audiences to confront her as a sexual being, a socially defined gender, an ‘opposite’ sex, and a fellow human."
২. তাঁর নামের বানানটা আসলেই সংশোধন হওয়া দরকার। অন্তত তাঁর নামের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জুড়ে দেয়া 'সুলতানা'কে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা দরকার। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় 'রোকেয়া'র নাম বলা যায়। তাঁর নাম থেকেও 'বেগম' শব্দটাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা দরকার।
৩. একটা সাধারণ ধারণা হচ্ছে, মানুষ দিনে দিনে প্রতি ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করছে। কিন্তু চিন্তার জগতে মানুষ যে পিছু হঠতেও পারে সেটা আর বিবেচনা করা হয় না। সেই ভ্রান্ত ধারণা থেকে আজকে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া'র নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা বিরাট অর্জন বলে মনে হয়। এবং তখন মনে হয়, "বাপরে! আটশ' বছর আগে সুলতানা রাজিয়া দিল্লীর সিংহাসনে বসছিল"!
আটশ' বছর আগে কোন প্রক্ষিতে এবং কাদের কাছে রাদ্বিয়াহ্র সুলতান হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল এবং কারা সেটার বিরোধীতা করেছিল তা কিন্তু আমি ব্যাখ্যা করেছি। যে তাজিক মোল্লার দল আর তাদের অনুসারীরা সেদিন বিরোধীতার বীজ বুনেছিল আজকে তাদের মানসিক বংশধরেরা ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়েছে।
৪. নাসিরের মৃত্যুর ব্যাপারটা আমি আমার পক্ষে সম্ভব এমন সব সোর্স থেকে চেক করেছি। কিন্তু পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে কোন তথ্য পাইনি। এজন্য বিষ প্রয়োগে হত্যার গুজবটা জানা থাকলেও উল্লেখ করিনি।
প্রশ্নটা যদি এমন হয়, নাসির ও রাদ্বিয়াহ্ দু'জনেই উত্তরাধিকারের জন্য যোগ্য এবং দু'জনকেই সেভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, তাহলে নাসিরের তরফ থেকে ভয় করার কারণ কী আর রাদ্বিয়াহ্কে নিরাপদ ভাবার কারণ কী? তাহলে উত্তরটা হচ্ছে, নাসিরকে যখন একের পর এক বিদ্রোহ দমনে পাঠানো হচ্ছিল তখন হয়তো তাঁর কোন আচরণে বা অন্য কোন কারণে ইলতুৎমিশের মনে হয়েছিল নাসির তাঁর জীবতাবস্থায়ই বিদ্রোহী হতে পারেন। তাই সম্ভবত তাঁকে দূরে বাংলায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। যাতে নাসির বাংলা থেকে দিল্লীর দিকে অগ্রসর হতে গেলে ইলিতুৎমিশ তাঁকে প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট সময় ও সুযোগ পান। পক্ষান্তরে, ইলতুৎমিশের জীবদ্দশায় রাদ্বিয়াহ্ কিন্তু কোন ভূখণ্ডের প্রশাসক নিযুক্ত হননি। তখন তাঁর যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও সীমিত। পক্ষান্তরে নাসিরের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল ব্যাপক এবং তিনি আওধের প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন। রাদ্বিয়াহ্র ভূমিকা বরং মন্ত্রণালয় পর্যায়ে বেশি ছিল। সুতরাং, যোগ্য হলেও রাদ্বিয়াহ্র অধীনে কোন সেনাবাহিনী-মালিক-আমীর না থাকায় তাঁর তরফ থেকে ইলতুৎমিশের জীবদ্দশায় তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সম্ভাবনা ছিল না। এখানে ছেলে-মেয়ের বিভাজনটা সঠিক নয়।
৫. গিয়াস উদ্ দীন মুহাম্মাদ শাহ্কে আসলে কোন পক্ষই উত্তরাধিকার হিসেবে ভাবেনি। এখানে মালিক-আমীরের দল কে কার পক্ষে, কোন সন্তান কোন মায়ের গর্ভে জন্মেছে এমনসব হিসেব আছে। এজন্য আরো পাঁচ ভাই-বোন জীবিত থাকলেও মুয়িয্ উদ্ দীন বাহ্রামের মতো অপদার্থ রাদ্বিয়াহ্র স্থান দখল করতে পারে। আমি আগেই বলেছি, “মামলুক সালতানাত আসলে এক প্রকার মালিকশাহী-আমীরশাহী ছিল”। এ’কথাটার আরো বড় প্রমাণ পাওয়া যায়, মুয়িয্ উদ্ দীন বাহ্রাম, তারপর আলা’ উদ্ দীন মাসুদ (ফিরুযপুত্র), তারপর নাসির উদ্ দীন মাহ্মুদ (নাসিরপুত্র)-এর আমলে এবং তারও পরে গিয়াস উদ্ দীন বলবন কর্তৃক ক্ষমতা দখলে।
৬. ‘সাঈফ উদ্ দীন কুচি’ সঠিক।
৭. নীতাকে বিয়ে না দেয়া আর রাদ্বিয়াহ্কে বিয়ে না দেয়ার কারণ কাছাকাছি, কিন্তু এক নয়। নীতাকে বিয়ে দিলে তার বাবা-মা-দুই ভাই-এক বোনের সংসার চলাটা দুরূহ হতো। কিন্তু রাদ্বিয়াহ্ সুলতান না হলেও ইলতুৎমিশের মামলুক সালতানাত টিকে থাকতো। হয়তো এমন স্বল্প সময় ধরেই, তবুও টিকতো। রাদ্বিয়াহ্কে বিয়ে দিলে তাঁর পক্ষে আর সুলতান হওয়া হতো না, সে বোধ ইলতুৎমিশেরও ছিল। তাই বিয়ের ব্যাপারে নীতার সাথে রাদ্বিয়াহ্র একটা পার্থক্য থেকেই যায়।
৮. শাহ্ তুরক্বান আসলে সুলতান হতে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি নিতান্ত ব্যক্তিগত সুখ বৃদ্ধি আর ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। সে কারণে তিনি ফিরুযের পথের কাঁটাগুলো দূর করতে চেয়েছেন। শাহ্ তুরক্বানের পক্ষে কোন মালিক-আমীর ছিল না। সুতরাং তিনি আসলে কারো দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হননি। ঘষেটি বেগম নিজ পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর হাতে ফিরুযের মতো কোন বিকল্প না থাকায় তাঁকে মীর জাফরদের দলে ভিড়তে হয়েছিল।
৯. চাঁদ সুলতানার ওপর পড়াশোনা শেষ হয়নি। কখনো মোটামুটি শেষ করতে পারলে বোঝা যাবে আসলেই উনাকে নিয়ে লেখার দরকার আছে কিনা।
প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় 'রোকেয়া'র নাম বলা যায়। তাঁর নাম থেকেও 'বেগম' শব্দটাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা দরকার।
প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আরো একটি নাম বলা যায়- "বেগম জিয়া", এ ব্যাপারে কি বিধান?
ঘষেটি বেগম নিজ পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন।
ঠিক বুঝলাম না কার কথা বলতে চেয়েছেন, যতদূর জানি তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। সিরাজের অনুজ এক ভাইকে তিনি দত্তক নিয়েছিলেন, সিরাজের বদলে তাকেও সিংহাসনে বসানোর চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু সে ছেলের অকাল মৃত্যু সে পথ বন্ধ করে দিয়েছিল।
আমার ভুল হয়েছে। 'নিজ পুত্র'র জায়গায় 'শওকত জং' হবে। শওকত জং-এর মৃত্যুর সাথে অবশ্য তার বাজেয়াপ্ত হওয়া টাকাপয়সার হিসেবটাও যুক্ত হওয়া উচিত। শওকত জং-ই তার 'ফিরুয শাহ্' ছিল। শওকত যুদ্ধে মারা যাওয়ায় তিনি মীর জাফরদের দলে যোগ দেন।
শওকত জং-এর সাথে ঘসেটির জীবন অতটা সম্পর্কযুক্ত ছিল বলে মনে হয় না। আসলে আলীবর্দি যেমনটাই ভাবেন না কেন, সিংহাসনের দিকে তার দুই জামাই পুর্নিয়ার নায়েব নাজিম সাইয়িদ আহমেদ আর ঢাকার নায়েব নাজিম নওয়াজেস আহমেদ, দুজনেরই দৃষ্টি ছিল। ঢাকার নায়েব নাজিম হিসেবে নওয়াজেস ছিলেন যথেষ্ট ধনবান, সে ধন তিনি অকারনে কুক্ষিগত না রেখে বিভিন্নভাবে জনতুষ্টিতে ব্যায় করতেন, সে কারনে সর্বমহলে নওয়াজেসের ছিল অসম্ভব জনপ্রিয়তা। আলিবর্দী খান যতই সিরাজকে তার উত্তরাধীকার মনোনীত করুন না কেন, তার অবর্তমানে নওয়াজেসের ঐশ্বর্য এবং জনপ্রিয়তার কাছে সিরাজ যে তৃণের মত উড়ে যাবেন সে ব্যাপারে কারও সন্দেহ ছিল না। এ নিয়ে আলিবর্দী খানেরও দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না, কিন্তু সে দুশ্চিন্তার অবসান হয় নওয়াজেসের অকস্মাৎ অকাল মৃত্যুতে। একই ঘটনা ঘটে সাইয়িদের ক্ষেত্রেও, তিনিও আলিবর্দী খানের মৃত্যুর আগেই ধরাধাম ত্যাগ করেন। সিরাজের বিরুদ্ধ পক্ষ তখন সিরাজের বিকল্প হিসেবে একাধিক সম্ভাবনা নিয়ে অগ্রসর হন। আলিবর্দীর কন্যা ও নওয়াজেসের বিধবা পত্নী ঘসেটি বেগমের মধ্যেও নবাবীর আকাঙ্খা ছিল, তার সে যোগ্যতাও কিছুটা ছিল। নওয়াজেস ও ঘসেটি বেগমের কোন পুত্র সন্তান ছিল না, তারা সিরাজের ছোট ভাই মির্জা মেহেদিকে দত্তক নিয়েছিলেন। মির্জা মেহেদিও নওয়াজেস বেঁচে থাকাকালেই অকালে মৃত্যুবরন করেন। মেহেদির একটি নাবালক পুত্রসন্তান ছিল। ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভ এই নাবালক সন্তানটিকে সিংহাসনে বসিয়ে তার নামে ঘসেটি বেগমকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার প্রানপনে চেষ্টা করতে লাগলেন। সে চেষ্টা সফল হলে অষ্টাদশ শতকে এই বাংলাতেও হয়ত দেখা মিলত আর এক চাঁদ সুলতানার। কিন্তু সে প্রচেষ্টা সফল হওয়ার আগেই সিরাজ তাঁর বিধবা খালাকে(ঘসেটি বেগম) মতিঝিল প্রাসাদ থেকে নিজের জিম্মায় নিয়ে আসেন(কার্যতঃ বন্দী করেন)। তখন সাইয়িদ আহমেদের পুত্র শওকত জংয়ের পক্ষে অন্য একটি প্রচেষ্টা শুরু হয়। বেশ কিছু অর্থ নজরানা দিয়ে শওকত জং মোগল দরবার থেকে তার নামে নেজামত সনদ(বাংলার নবাবী সনদ) হাসিল করে ফেলেন, কিন্তু সিরাজ যথাসময়ে অভিযান পরিচালনা করে শওকত জং কে পরাজিত এবং নিহত করে সে চেষ্টাও ভন্ডুল করে দেন। শওকত জং এর পক্ষে কোন ভূমিকা রাখার সৌভাগ্য ঘসেটি বেগমের কখনই হয় নি, তার সেরকম কোন ইচ্ছা ছিল বলেও জানা যায় নি।
কয়েকটা বিষয়ে একটু একটু দ্বিমত করি। ঘষেটি বেগম নিঃসন্তান ছিলেন বলে তাঁর বোনের সন্তানদের প্রতি তাঁর স্নেহ যথেষ্টই ছিল। সিরাজের তুলনায় শওকতের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্বটা বেশি ছিল। এ'কারণে সিরাজ তাঁর ওপর ক্ষুদ্ধ ছিলেন। রাজবল্লভদের ঢাকা থেকে ক্যু করার চেষ্টার কথাটি ঠিক নয়। গোলমাল বেঁধেছিল টাকাপয়সার হিসেব নিয়ে। সিরাজ চাইছিল রাজবল্লভদের করা আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ঘষেটি বেগম পর্যন্ত নিয়ে নওয়াজিশের রেখে যাওয়া সম্পদ কেড়ে নিতে। কৃষ্ণবল্লভ পালিয়ে না গেলে ধনসম্পদের সাথে তার প্রাণটাও যেতো।
শওকত এক কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে বাংলার দিওয়ানীর সনদ লাভ করেছিল। পক্ষান্তরে সিরাজ গায়ের জোরে দিওয়ানী দখল করেছিল। পূর্ণিয়ার যুদ্ধে শওকত জিতলে ঘষেটি বেগমের পরিণতি হয়তো এমনই হতো, তবু সেটি যেহেতু প্রমাণিত হবার কোন উপায় ছিল না তাই তাঁর পক্ষপাতিত্বটা বদলায়নি। নিজের সব আশার স্থল আর সম্পদ হারিয়ে তিনি বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন।
বোনের ছেলেদের প্রতি ঘসেটির স্নেহ আসলেই যথেষ্ট ছিল, এমনকি শৈশবে সিরাজও সেই স্নেহের ফল্গুধারায় যথেষ্ট আপ্লুত হয়েছেন। তবে স্থানিক দূরত্বের কারনে শওকত জং এর ভাগ্যে সে স্নেহের সুধারস ততটা বর্ষিত হতে পারে নি। সিরাজের সাথে ঘসেটির বিদ্বেষের সম্পর্ক সূচিত হয় নবাবীর উত্তরাধিকার নিয়ে। স্বামী নওয়াজিস বেঁচে থাকাকালে স্বামীকেই সিংহাসনের ন্যায্য দাবীদার মনে করতেন, স্বামীর মৃত্যুর পর নিজেকে। সে সময় শওকত জং এর পক্ষে নয়, নিজের পক্ষে তিনি গুটি চালাচালি করেছেন, আর তাঁর পক্ষে সত্যিকারের ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছেন রাজবল্লভ। নওয়াজিস কর্তৃক ঢাকার দেওয়ান হিসেবে নিযুক্তি লাভের কারনে তাঁর হয়ত একটা কৃতজ্ঞতাবোধ কাজ করেছে, তাছাড়া নওয়াজিসের মৃত্যুর পর রাজস্বের বিপুল অর্থ মুর্শিদাবাদে না পাঠিয়ে নিজে আত্মসাৎ করতে হলে সিরাজের বিনাশ ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। রাজবল্লভের এই উদ্যোগের স্বপক্ষে অক্ষয় মৈত্রেয় তাঁর লেখায় বিভিন্ন প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছেন।
শওকত জং এর সাথে সিরাজের যখন সংঘাত শুরু হয়, ততদিনে ঘসেটি সিরাজের জিম্মায় চলে গেছেন, সে অবস্থায় শওকতের জন্য তাঁর আর কিছু করার ছিল না।
আমার মেধাহীন প্রশ্নগুলোর উত্তর এতটা যত্ন করে দিয়েছেন দেখে ব্যাপক আপ্লুত হলাম!
প্রতিটা উত্তর তুখোড় হয়েছে অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা ভাইয়া।
***
একটা আবদার করে যাই, সম্ভব হলে রাখবেন। ঈস্ট ইণ্ডিয়াকোম্পানী তো একটা কোম্পানীমাত্র(যদিও তার পেছনের কুশিলবেরা অনেক ক্ষমতাধর ছিলেন) তারপক্ষে ভারতের মত একটা বিশাল দেশকে কব্জা করা কিভাবে সম্ভব হলো?
এ বিষয়টা নিয়ে লিখবেন? এ বিষয়ে পড়েছি খুব সামান্যই। এক্ষেত্রে আপনার পয়েন্ট অব ভিউ জানার আগ্রহ হচ্ছে। আব্দুলাহভাইয়ের মত আরো কিছু মানুষের আলোচনা থেকে হয়ত নতুন কিছু জানা যাবে এই লোভটা থেকেই বলছি।
ভেবে দেখবেন ব্যাপারটা। ভালো থাকবেন।
কারণ তো একটা নয়। ভারতে ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস প্রাচীন। ব্রিটিশরা এখানে আধুনিক অর্থে এবং ব্যাপক মাত্রায় উপনিবেশ স্থাপন করতে পেরেছিল বলে আমরা শুধু তাদের কথা বলি। এসব নিয়ে পণ্ডিতেরা মোটা মোটা বই লিখে গেছেন, আমি আর কী বলবো!
পড়েছিলাম প্রথম দিনই, মন্তব্য করা হয়নি - এরকম লেখায় মন্তব্য করতেও সেরকম কিছু বিদ্যা থাকা দরকার।
আজ পড়লাম আয়নামতির মন্তব্য আর আপনার উত্তর - এক কথায় "দারুণ" !
পড়ে কেমন লাগলো, কোথাও কোন খটকা লাগলো কিনা, কোন অস্পষ্টতা থেকে গেলো কিনা - অন্তত এসবও তো বলতে পারেন।
দারুণ
এত বিশাল পোস্ট দেখে ভয়ের চোটে পড়া হয়নি এদ্দিন
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
অনেক পরিশ্রম করে লেখা বলে মনে হচ্ছে। অসাধারণ লাগলো। আহা, স্কুলের ইতিহাস পাঠ্যগুলোকে যদি এভাবে গল্পের ছলে তুলে ধরা যেত!!
____________________________
পাণ্ডবদা লেখাটা কয়েকদিন ধরে পড়ে শেষ করেছি। ২য় প্যারায় বলছেন:
ভারতে ঘোরীদের সাম্রাজ্য বিস্তারের বড় কৃতিত্ব কুতুব উদ্ দীন আয়েবাকের। আয়েবাক এক কালে মুহাম্মাদ ঘোরীর দাস ছিলেন। সে অবস্থা থেকে তিনি ঘোরীর আস্থা অর্জন করে ধীরে ধীরে দিল্লীসহ উত্তর ভারতের অনেকাংশের প্রসাশক নিযুক্ত হন। এই সময় তুর্কীস্তানী মামলুকরা কুতুব উদ্ দীন আয়েবাকের নেতৃত্বে উত্তর ভারতে ক্ষমতা সংহত করতে শুরু করে। আয়েবাক তাঁর দাস শামস্ উদ্ দীন ইলতুৎমিশকে শারহিন্দ (ভাতিণ্ডা), গোয়ালিয়র আর বারানের প্রসাশক নিযুক্ত করেছিলেন। ১২০৫ সালের দিকে ইলতুৎমিশ খোখার বিদ্রোহ দমনে কৃতিত্ব দেখালে মুহাম্মাদ ঘোরী তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করেন। তার পরের বছর আততায়ীর হাতে মুহাম্মাদ ঘোরী নিহত হলে আয়েবাক দিল্লীর মসনদ দখল করেন অর্থাৎ তিনি ভারতে আফগান ঘোরীদের শাসনের অবসান ঘটিয়ে তুর্কীস্তানী মামলুকদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষমতায় বসে আয়েবাক ইলতুৎমিশকে বদায়ুনের প্রশাসক নিযুক্ত করেন। বদায়ুনের প্রশাসক নিযুক্ত হবার আগের বছর, অর্থাৎ ১২০৫ সালে বদায়ুনেই ইলতুৎমিশের কন্যা রাদ্বিয়াহ্ জন্ম গ্রহন করেন, যিনি পরে ‘সুলতান জালালাত্ আদ্ দীন রাদ্বিয়াহ্’ নামে পরিচিত হবেন। আমরা তাঁকে চিনি ‘সুলতানা রাজিয়া’ নামে। ভারতের ইতিহাসে দিল্লীর সিংহাসনে বসা একমাত্র নারী। আটশ’ বছর আগের বাকি দুনিয়ার কথা বিবেচনায় নিলে তিনি এক অবিশ্বাস্য চরিত্র।
১। ইলতুৎমিশ কি তাহলে ছিল একজন দাসের দাস? সেসময়ে দাসরা কি দাস রাখতে পারত?
২। ইলতুৎমিশ ছিলো আয়েবাকের দাস, তাহলে ঘোরী তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করলেন কেন?
৩। ইলতুৎমিশ মুক্ত হলেন ১২০৫ এ, পরের বছর মানে ১২০৬ এ আয়েবাক দিল্লীর মসনদ দখল করেন। ইলতুৎমিশ কোন সময়টায় দাস ছিলেন?
মানে কে কখন কার দাস ছিল ঘুলিয়ে গেছে আমার, দয়া করে যদি বুঝিয়ে বলতেন?
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
১. + ২. ইলতুৎমিশ মুহাম্মাদ ঘোরীর দাস ছিলেন, কিন্তু আয়েবাকের অধীনস্থ ছিলেন। ঘোরী তাঁকে আয়েবাককে উপহার দেন।
৩. ১২০৫ পর্যন্ত ইলতুৎমিশ দাস ছিলেন। আর ১২০৬ সালে আয়েবাক দিল্লীর মসনদে বসেন।
মামলুক দাসেরা স্বাধীন মানুষের অনেক সুবিধাই ভোগ করতেন। মামলুকদের সম্পর্কে এখানে কিছু জানা যাবে।
বেশ কিছুদিন সচলে আসা হয় নি, এই আশ্চর্য রত্নসম লেখাটা মিস হয়ে যাচ্ছিল আরেকটু হলেই।
এই রাদ্বিয়াহ আর ইলতুৎমিসকে আমার তো প্রায় টাইম ট্রাভেলার বলে মনে হয়, এক অন্ধকার যুগের মধ্যে অদ্ভুত ব্যতিক্রমী উন্নত চিন্তার অধিকারী, যেন ভবিষ্যৎ দুনিয়া থেকে আসা উদার মুক্ত যুগের মানুষ, নতুন ধরনের ভালো কিছু প্রবর্তনের চেষ্টা করছেন।
পাঠ্য ইতিহাসে খুব কমই পেয়েছি এঁদের কথা, কিন্তু আমাদের সহায়ক পাঠে রাদ্বিয়ার (রাজিয়া নামে ছিল)কাহিনি সামান্য কিছুটা বিস্তারিত ছিল, তখন থেকেই এই ব্যক্তি সম্পর্কে আকৃষ্ট হই। ইতিহাসের আর এক জন নারী সম্পর্কেও খুব জানতে ইচ্ছে করে ডিটেলে, শাহজাদী জাহানারা। এঁর কথাও তো বিশেষ পাই নি কোথাও।
আর একটা কথা বিশেষ করে বলতে চাই, এই দাসপ্রথা। শুনলেই কেমন যেন লাগে আর সেই ভয়াবহ রোমান গল্পগুলো মনে পড়ে। যাই হোক, ঐ লিংকটা থেকে মামলুক ক্রীতদাস বিষয়ে জেনে বুঝলাম এরা রোমান ক্রীতদাসদের মতন নয়, এদের বরং আবশ্যিক সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষ কর্মচারী বলা যায়। জেনে খানিকটা রিলিভড হলাম, নইলে কেবলই শেকলবাঁধা রোমান দাসদের কথা মনে পড়ে শিউরে উঠি।
লেখাটা পড়ে খুবই সমৃদ্ধ হলাম, অনেক ভালো লাগলো।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
মন্তব্য
কলম্বাসের "আমেরিকা আবিষ্কার"-এর বদলে "আমেরিকায় পদার্পণ" লিখলে ভালো হতো না?
ঠিক! আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়া দুইটাই ঠিক করলাম। আচ্ছা ডাচ অভিযাত্রী Willem Janszoon'র নামের সঠিক বাংলা উচ্চারণটা কী হবে?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ভিলাম ইয়ানযুন।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
যা মনে হলো, মিনহায মোটামুটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোশকতায় ইতিহাস লিখে গেছেন।
অলস সময়
খুব অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আজ পর্যন্ত যা কিছু ইতিহাস লেখা হয়েছে তার সবই রাষ্ট্র বা ক্ষমতাবান কারো পৃষ্ঠপোষকতায় লেখা হয়েছে। ফলে সেগুলোতে সত্যের সাথে মিথ্যা এবং আংশিক সত্যের মিশ্রণ ঘটেছে। এর বাইরেও ভ্রান্তির সুযোগ আছে। আবু জায়েদ খালদুনের ভাষায়,
All records, by their very nature, are liable to error...
1....Partisanship towards a creed or opinion...
2....Over-confidence in one's sources...
3....The failure to understand what is intended...
4....A mistaken belief in the truth...
5....The inability to place an event in its real context
6....The common desire to gain favor of those of high ranks, by praising them, by spreading their fame...
7....The most important is the ignorance of the laws governing the transformation of human society....
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
'ইতিহাস'-ও তো তাইলে দেখি 'ঐতিহাসিক গালগপ্প'-ই হইলো! তাইলে আমার প্রিয় ভ্রমণলেখক ইবনে বতুতা কি দুষ করল???
****************************************
ইতিহাসকে ভুলভাবে বিশ্লেষণ করা, কাউকে অহেতুক মহিমান্বিত করা বা খাটো করা, কোন কোন ঘটনা চেপে যাওয়া এগুলো ইতিহাসের ত্রুটি। একাধিক ঐতিহাসিকের ভাষ্য পাঠ করলে এবং বিশ্লেষক একাধিক প্রেক্ষিত থেকে ঘটনা পর্যালোচনা করলে সেই ত্রুটি অনেকটা কাটিয়ে ওঠা যায়। আর ঐতিহাসিক গালগল্প হচ্ছে একেবারে ডাহা বানোয়াট গল্প ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেয়া। আবু আবদুল্লাহ্ মুহাম্মাদ ওরফে ইবনে বতুতা এই কাজটা হরহামেশা করেছেন। খোদ সচলেই একবার কার লেখায় যেন ইবনে বতুতার এমন ভাষ্য এসেছিল যে, চতুর্দশ শতকে পূর্ববঙ্গে সেচের জন্য নাকি পানচাক্কি ব্যবহার করা হতো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বিষয়টা আমি উল্লেখ করেছিলাম সত্যপীরের কোন একটি লেখায়। আসলেই ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনীতে এই তথ্য আছে। তিনি চট্টগ্রাম থেকে সিলেট যাওয়ার পথে নদীর দুই ধারে প্রচুর পানচাক্কি(ওয়াটার হুইল) দেখেছেন। এটা একটা প্রশ্ন বটে যে, তখন যদি পানচাক্কি থাকতে পারে, তবে পরবর্তীতে তা উধাও হয়ে গেল কি ভাবে, এমন তো নয় যে পরে আর জমিতে সেঁচের প্রয়োজন হতো না। তবে এটা বতুতার কোন শোনা কথা নয়, তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, বলেছেন। এমন হতে পারে, তিনি আসলে ওয়াটার হুইল নয়, সেঁচের জন্য ব্যবহৃত অন্য কোন ব্যবস্থা দেখেছিলেন, যাকে তিনি অথবা তাঁর লেখার কোন অনুবাদক ওয়াটার হুইল হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
স্বচক্ষে দেখা তো দূর অস্ত্, তিনি হয়তো স্বদেহে বঙ্গদেশে আদতে আসেনই নাই! অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন এই অংশটা নিতান্তই চাপা। বতুতার বিবরণের বিভিন্ন জায়গা নিয়ে এরকম যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ আরও আছে। বতুতা এখানে এসেছিলেন সিলেটের বিখ্যাত পীর হযরত শাহজালালকে দেখতে। তার কাহিনিতে তিনি বলেছেন তিনি সিলেটে শাহ জালালুদ্দিন তাব্রিজির সাথে সাক্ষাৎ করেন। শুধু তাই না, তিনি ৩ দিনের জন্য তার আতিথ্যও গ্রহণ করেন। অথচ বাস্তবতা হলো তিন-তিনটি দিনের জন্য সশরীরে যার আতিথ্য তিনি গ্রহণ করলেন, তিনি আসলে বতুতা এখানে আসার ১২০ বছর আগেই ধরাধাম ত্যাগ করেছেন! শুধু তাই না, তাব্রিজি আসলে আমাদের সিলেটের শাহ জালালই নন!
তাহলে বতুতা কার সাথে দেখা করলেন? ভূতের সাথে? নাকি তিনি নিরেট অসত্য ভাষণ করেছেন? যেসব ঐতিহাসিক বতুতার প্রতি এতটা রূঢ় হতে পারেন না, তারা বলেন তাঁর আসলে স্মৃতিবিভ্রম ঘটেছিল। তিনি আসলেই হয়তো সিলেটের প্রকৃত হযরত শাহ জালাল অর্থাৎ শাহ জালাল আদ-দ্বীন আল-মুজাররাদ আল-ইয়ামানি-র সাথে ১৩৪৫ সালে দেখা করেছিলেন, তবে অনেক কাল পরে দেশে ফিরে ভ্রমণকাহিনি লেখার সময় লিখতে গিয়ে মুজাররাদ-কে তাব্রিজির সাথে গুলিয়ে ফেলেছিলেন।
আমি জানি না আসলে কি ঘটেছিল। তবে পরের সম্ভাবনাটাকেও যদি সঠিক বলে ধরে নেই, তাহলেও বলতে হয় এত বড় স্মৃতিবিভ্রম যার ঘটে, যে বিভ্রমের বশে সোয়াশ' বছর আগে মরে ভূত হয়ে যাওয়া লোকের সাথে তিন-তিনটা দিন সশরীরে যার আতিথ্য গ্রহণ করলেন, যার খেলেন ও যাকে স্বচক্ষে দেখলেন তাঁকে গুলিয়ে ফেললেন - এমন মানুষের তথাকথিত স্বচক্ষে দেখা অসম্ভাব্য স্মৃতির উপর সমসাময়িক সূত্রের সাথে ক্রস-ভেরিফিকেশন ছাড়া আমি ভরসা করতে পারিনা।
আর মিথ্যা হলে তো কথাই নাই!
****************************************
বিস্তারিত বিবরণে না গিয়েও বলা যায় এ রকম সমস্যা বাংলায় আগত সকল পর্যটকের ক্ষেত্রেই কমবেশি আছে। সে কারনে কোন পর্যটকই ক্রস-ভেরিফিকেশন ছাড়া গ্রহণীয় নন, আমিও বতুতার বক্তব্য বিনা প্রশ্নে গ্রহণযোগ্য বলে মতামত দেই নি। প্রসঙ্গক্রমে তাঁর বয়ানটা উদ্ধৃত করেছি মাত্র।
এইখানে আব্দুল্লাহ এ.এম. ভাইয়ের একটা প্রতিমন্তব্য ছিল মনে হয়। গেল কৈ?!!!
================================
আপডেটঃ আমি উপ্রের কমেন্টটা করার ২-৩ ঘন্টা পর এসে দেখছি "প্রতিমন্তব্য"-টার আবার শুন্য থেকে পুনরাবির্ভাব ঘটেছে। এ দেখি ইবনে বতুতার ১২০ বছর আগে মরে ভূত হয়ে যাওয়া লোকের সাথে সাক্ষাৎ করার চেয়ে কম ভুতুড়ে আর মজাদার নয় !
****************************************
বতুতা=এন(মুসা)
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
এতো দেখা যায় বিশাল ইতিহাস।
আমাদের সময় সম্ভবত ক্লাস এইটের ইতিহাস বইতে "সুলতানা রাজিয়া" নামে দুই পৃষ্ঠা ছিলো।
...........................
Every Picture Tells a Story
এক কালে এই দেশের স্কুলপাঠ্য ইতিহাস বইয়ে আপনার বলা দুই পৃষ্ঠা বা তার চেয়ে কম জায়গা রাদ্বিয়াহ্র জন্য বরাদ্দ ছিল, এখন তাও নেই। উচ্চতর শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে যাও আছে তার প্রায় সবটাই গালগল্পে ভরা। সেখানে রাদ্বিয়াহ্র অবদানগুলো নিয়ে কিছুই বলা থাকে না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
রাজিয়া যে 'সুলতানা' নন, বরং সুলতানই ছিলেন তা আগেই জানতাম। জানতাম আরও কয়েক লাইন হয়তো। তবে এত্ত বিস্তারিত ইতিহাস জানা ছিল না। অনেক কিছু জানা হল। খুটিনাটি সমেত দারুন একটা প্রবন্ধের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ!
শুধু দু'তিনটি জায়গায় ইষৎ দ্বিমত। কিম্বা দ্বিমত না বলে দ্বিধা বা প্রশ্ন বলাই ভাল হয়তো --
১।
এই লাইনটা পড়ে মনে হচ্ছে আপনি এখানে অত আগে সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে ও এত শক্তিশালী একটা ভূমিকায় একজন নারী থাকাকে বৈশ্বিক পরিসরে খুবই অসম্ভব বা অবিশ্বাস্য মনে করছেন। কিন্তু আসলেই কি তাই? পৃথিবীর ইতিহাসে রাজিয়ারও বহু আগেই তার মতই বা তার চেয়েও বহুগুনে প্রতিভাবান, ব্যক্তিত্ববান, সাহসী, সক্ষম, এমনকি পরাক্রমশালী নারী শাসক কি আসেননি? আমার ইতিহাস জ্ঞান 'দুই পাতার' । তারপরও এই মুহূর্তে দুইজনের কথা মনে পড়ছে - রাজিয়ারও প্রায় তিন সহস্রাব্দ আগে আসা মিশরীয় নারী নৃপতি হাৎশেপ্সুৎ (ইনিও, তখনই, সুলতানা নন সুলতানই ছিলেন, অর্থাৎ পুরুষুবাচক 'ফারাও'), এবং প্রায় অর্ধ-সহস্রাব্দ (৭-৮ম শতাব্দী) আগের চীনা 'সম্রাট' (হুয়াংদি) ঊ জেইটান। আরও অনেকেই ছিলেন। এখানে দুটো বিরাট তালিকা পেলাম - ১ এবং ২। এদের অনেকেই তো মনে হয় বিভিন্ন দিক থেকেই মাপে রাজিয়ার চেয়ে বড় বৈ খাটো হবেন না। তার সব যোগ্যতা সত্ত্বেও রাজিয়াকে তাই বিশ্ব-পর্যায়ে অবিশ্বাস্য বললে বোধহয় অতিরঞ্জনই হবে - এবং অন্য এত এত প্রতিভাবান নারী শাসকদের বোধহয় খাটোই করা হবে। যার আসলে দরকার নেই।
তাই এখানে 'বাকি দুনিয়া' না বলে 'বাকি ভারত' বললেই হয়তো সঙ্গত হত। আমি এটুকুই বুঝলাম - ভুলও হতে পারে অবশ্য।
২।
এইখানে ইবনে বতুতার প্রতি আপনি বোধহয় একটু অবিচার করলেন। বোধহয় বতুতার উপ্রে কোন কারনে নাখোশ আছেন!
****************************************
২. ইসামী স্যার যে গল্পের চারা লাগিয়ে গিয়েছিলেন বতুতা স্যার সেটাকে বটবৃক্ষ বানিয়ে ছিলেন। আর নাযির আহমেদ স্যারের গল্প পড়লে তো কচুগাছে ফাঁস লাগিয়ে মরতে ইচ্ছে করে। আবু আবদুল্লাহ্ মুহাম্মাদ কোন ঐতিহাসিক নন্। তাঁর লেখা থেকে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ নেয়া যেতে পারে মাত্র। তাও তিনি যা নিজের চোখে দেখেছেন। স্যারের উপ্রে আমার নাখোশ হওয়ার কোন কারণ নেই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ঠিক তাই!
এর থেকে খুব বেশি কিছু তিনিও কি দাবি করেছেন? যদি না করে থাকেন, বিশেষ করে নিজেকে যদি আধুনিক অর্থে 'ঐতিহাসিক' বা ইতিহাস-বিষয়ক একাডেমিশিয়ান দাবি না করে থাকেন, তাহলে তার উপর সেই অনাহুত প্রত্যাশার ভার চাপিয়ে দিয়ে তারপর সেই প্রত্যাশা ভঙ্গের জন্য তাকে দায়ী করলে মনে হয় তার প্রতি ঠিক সুবিচার করা হয় না। তিনি একজন পর্যটক / পরিব্রাজক এবং ভ্রমণকাহিনি লেখকই ছিলেন। 'রিহ্লার' মানেটাও বোধহয় তাই - 'ভ্রমণ' বা এইরকম কিছু - ইতিহাস না। আর একজন ভ্রমণকারী তার কাহিনিতে নিজের চোখে দেখা বিষয় ছাড়াও, অন্যের কাছে শোনা কথা (আনভেরিফাইড), কান কথা থেকে শুরু করে গুজব-টুজব সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত করার অধিকারী। এটা তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধির বিবরণ আর গুজব, শোনা কথা, কান কথা - সবই সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অন্তর্ভূক্ত এবং সে হিসেবে তার বিবরণের উপকরণ হওয়ার যোগ্য।
তাছাড়া ভ্রমণকাহিনিতে কিছু অতিরঞ্জন, অতিকথন, টুকলিবাজি ঢুকিয়ে দেয়া বা চমকপ্রদ উড়ো কথা নিজের দেখা বা ভেরিফাই না করে সত্য বলে চালানোটা বোধহয় দস্তুর ছিল সে যুগে। সে যুগে সবাইই বোধহয় এটা কমবেশি করেছেন নিজেদের লেখায়। এক বৃটিশ গবেষক এমনকি এও দাবি করেছিলেন একবার যে, মার্কো পোলো নাকি আদৌ চীন যাননি! পুরোটাই চাপাবাজি! আর ট্রাভেলার্স ইয়ার্নের কথা কি বলবো, খোদ 'ইতিহাসবিদ্যার জনক' মহামহিম মহামতি হেরোডোটাস কি করেছেন? তিনি তো না দেখেই স্রেফ শোনা কথার উপর ভিত্তি করেই বলে দিয়েছিলেন যে - কাইল্লা ইন্ডিয়ানরা এতই কাইল্লা, এতই কাইল্লা, যে তাদের নুনু থেকে বেরুনো বীর্য পর্যন্ত কাইল্লা হয়!!!!
'ইতিহাসবিদ্যার জনক'-এরই যদি এই দশা হয়, তাহলে একজন সামান্য সফরনামা লেখক মুসাফিরের কি দোষ!
শত শত বছর পর ইতিহাস রচনার জন্য এইসব কাহিনিকে সেই ইতিহাসের কাঁচামালের সোর্স হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়োজন ও তাগিদটা যদি আমাদের হয়, তাহলে ঐ কাঁচামালে মিশ্রিত অসত্য বা অর্ধসত্য থেকে সত্য, রটনা থেকে ঘটনা, কল্পনা বা অতিরঞ্জন থেকে অরঞ্জিত বাস্তবতা ফিল্টার করে বের করে নেয়ার দায় ও দায়িত্বটাও আমাদেরই। মূল ভ্রমণকাহিনিকারের এজন্যে কোন ক্ষোভ প্রাপ্য না বলেই মনে করি।
যাজ্ঞে, আপনার পোস্টের মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে সাইড বা অফ টপিকে অনেক কথা বলে ফেললাম। এটা এখানেই শেষ করি। আপনার গপ্পবাজ আবু আব্দাল্লাহ্ স্যারের একজন কঠিন ভক্ত হিসেবে তাঁর ডিফেন্সে এইটুকু উকালতি না করে পারলাম না আরকি!
****************************************
ঠিক! আমি আসলে ইবনে বতুতা'র ওপর ক্ষুদ্ধ না। নিঃসন্দেহে দায়টা তাঁর নয়। রেহ্লাহ্-কে আপনি যেভাবে ব্যাখ্যা করলেন সেটা সঠিক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখনকার ঐতিহাসিকরা ইবনে বতুতার মতো পর্যটকদের ঘাড়ে ঐতিহাসিক হবার দায়টা চাপিয়ে দিয়ে তাঁদের দেয়া তথ্যের (!) ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করতে চান। তাই ইতিহাস পুনর্পাঠকালে আমি ইবনে বতুতা, স্যুয়াঙ চ্যাঙ, ফা শিয়ান, মার্কো পোলো'র রচনাকে ট্রাভেলগ হিসেবে বিবেচনা করবো এবং তাঁদের বলা গল্পকে ঐতিহাসিক গালগল্প হিসেবে দেখাবো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
১. সময়ের সাথে সাথে ইতিহাসের প্রেক্ষিত পালটায়। ধরুন, একবিংশ শতকেও দুনিয়ার কোন কোন জায়গায় মধ্যযুগ বা তারও আগের রীতি, বিবেচনা, আইন কেমন করে হাজির হয়েছে তার সাক্ষী তো খোদ আমরাই। তাই আগের গোটা ইতিহাসকে না টেনে আমরা বরং একটা নির্ধারিত পিরিয়ডের মধ্যে থাকি। আমার ভাষ্য লক্ষ করুন। আমি কিন্তু বলেছি, 'আটশ' বছর আগের বাকি দুনিয়া'। তারমানে আপনাকে ত্রয়োদশ শতকের প্রথম ভাগে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। এবার আপনার দেয়া লিস্ট চেক করে দেখা যাক। দেখা যাচ্ছে এলেনর ছাড়া আর কেউই রাদ্বিয়াহ্র একশ' বছর আগের সীমায় নেই। তাও এলেনর না ছিলেন সম্রাট, না ছিলেন রাজা।
কাউকে উপরে তুলতে গিয়ে খামোখা কাউকে খাটো করবো কেন। খোদ আমার লেখাতেও তো আগের আমলের কয়েকজন নারী সম্রাট/সুলতানের নাম এসেছে। এখন দ্বাদশ/ত্রয়োদশ শতকে অমন কারো নাম যদি আমরা পেয়ে যাই তাহলে রাদ্বিয়াহ্ সাথে তাঁর নামও আমরা উচ্চারণ করবো। আমার একটা gut feeling-এর কথা বলি। আমার মনে হয় ব্রহ্মপুত্র নদীর পূর্ব পাড় থেকে দক্ষিণ চীন সাগরের উপকূল পর্যন্ত খোঁজ করলে এমন আরো কাউকে কাউকে পাওয়া যেতে পারে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
"কিন্তু ইতিহাস লেখার সময় পুরুষ ঐতিহাসিকেরা তাদের সহজাত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বজায় রাখায় ‘সুলতান আল মুয়াজ্জাম জালালাত্ আদ্ দীন রাদ্বিয়াহ্ আদ্ দুনিয়া ওয়া আদ্ দীন’ হয়ে যান ‘সুলতানা রাজিয়া’।" সেইটাই! তবু আশা রাখি, যেমন আপনি বলেছেন, "হীনমনারা রাদ্বিয়াহ্কে যতই বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেবার চেষ্টা করুক অথবা তাঁকে হেয় করার চেষ্টা করুক সত্য একদিন তার স্বমহিমায় প্রকাশিত হবে। ভারতবর্ষ তো বটেই গোটা পৃথিবীর ইতিহাসেও রাদ্বিয়াহ্ স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন।"
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ইতিহাস লেখার পদ্ধতি, ভাষা সময়ের সাথে সাথে পালটায়। তার সাথে আরো পালটায় ইতিহাসকে দেখার ও বিশ্লেষণ করার পদ্ধতি। সেই বিবেচনায় রাদ্বিয়াহ্ নিজ কর্মগুণেই এক সময় স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হবেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তুর্কিস্তানী বলতে কি কাজাখস্তানের তুর্কিস্তান বুঝিয়েছেন? তুর্কি আর তুর্কিস্তানীদের মধ্যে কি কোন পার্থক্য আছে??
সাইদ
এই হচ্ছে তুর্কীদের দেশ, আর এই হলো তুর্কীস্তানীদের দেশ। ভৌগলিক, নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত, ইতিহাস, ঐতিহ্যগত সব দিক দিয়ে আলাদা দুটি দেশ, ভিন্ন জাতি। ইংলিশে প্রথমদের Turkish বলে আর পরেরদেরকে বলে Turk। বাংলা ভাষায় যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তাঁদের অনেকে গড়ে উভয়কে 'তুর্কী' বলে গেছেন। এটা ভুল।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আগ্রহ জাগানিয়া এই চমৎকার লেখাটির জন্য অভিনন্দন!
মিনহায এবং সমসাময়িক অন্যরা কি তাঁদের গ্রন্থে নামটি "রাদ্বিয়াহ্" হিসেবে উল্লেখ করেছেন? যদি তাই হয়, তাহলে কার কিংবা কাদের বদৌলতে তিনি রাজিয়া হয়ে গেলেন? এ অঞ্চলে এই নামের উচ্চারণ তো রাজিয়া হিসেবেই প্রচলিত, বহু নারী এই নাম ধারন করেছেন, করে আছেন। এই পার্থক্যটা কি আরবি শব্দ উচ্চারণে- ওলাদ্দোয়াল্লিন/ওলাজ্জোয়াল্লিন, গাদ্দাফি/গাজ্জাফি, কাদ্দিবান/কাজ্জিবান এ জাতীয় বিরোধগুলোর মত?
রোহিলাখন্ড এবং লক্ষনাবতী নাম দুটি নিশ্চয়ই পরবর্তীকালের নাম, এগুলো সময়ের নামে চিহ্নিত করলে ভাল হত।
উপরে মন মাঝি ভাইয়ের দ্বিমতের বিষয়ে- লেখাটি পড়ে আমার তো মনে হয় নি ষষ্ঠ পাণ্ডব অত আগে সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে ও এত শক্তিশালী একটা ভূমিকায় একজন নারী থাকাকে বৈশ্বিক পরিসরে খুবই অসম্ভব বা অবিশ্বাস্য মনে করছেন। তিনি বরং এমন একটি ধারনা যে আমাদের মাঝে প্রচলিত, সে বিষয়টিই তুলে ধরেছেন। আর ঘোরি কিংবা বাবুর, কিংবা শেরশাহ ভারতের ইতিহাস হয়ে বিশ্ব ইতিহাসে যদি বিশিষ্টতা অর্জন করতে পারেন, তাহলে রাজিয়া বা রাদ্বিয়াহ্ কেন নয়?
রোহিলাখন্ড হচ্ছে মোটামুটিভাবে বেরেলী আর তার আশপাশ এলাকা। আর লক্ষ্মণাবতী তো বলেছিই যে মালদহ জেলা।
রাদ্বিয়াহ্ নামটি আরবী। আরবী বানানের 'দ্বোয়া' কে 'দ্ব' দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছি, এবং শব্দের শেষের 'হা' কে প্রতিস্থাপন করেছি 'হ্' দিয়ে। নামটা 'রাজিয়া' হলে আরবীতে এটা 'জাল' দিয়ে লিখতে হতো আর শেষের 'হা' বাদ যেতো। আমি ভিন্ন ভাষার শব্দ (বিশেষত বিশেষ্য) যখন বাংলায় লেখা হবে তখন সেটা যথাসম্ভব মূল উচ্চারণানুগ রাখার পক্ষপাতী। রাদ্বিয়াহ্'র ভাষা বাংলা/হিন্দী ছিল না। সুতরাং তাঁকে 'রাজিয়া' নামে উল্লেখ করাটা আমি ঠিক মনে করিনি। দয়া করে এখানে বাংলা একাডেমি'র নিয়মের দোহাই দেবেন না। একাডেমি'র স্যারদের বেঁধে দেয়া নিয়মের সাথে 'কাইজ্জা' করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। তবে উচ্চারণানুগ করার জন্য বর্তমান দুনিয়ায় যাদের নাম 'রাজিয়া' আছে তাদের নাম পাল্টানোর কোন দরকার দেখছি না।
মনমাঝির উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর যথাস্থানে দিচ্ছি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমার একটি লিস্ট আছে, পান্ডবদা, যেখানে মাঝেমধ্যে কিছু নাম বা বিষয় লিখে রাখি, সুযোগ পেলে এগুলো সম্পর্কে জানব, এই অভিপ্রায়ে। সুলতানা রাজিয়া (সুলতান রাদ্বিয়াহ্ না) নামটিও এই লিস্টে ছিল। অবশেষে কয়েকশ বছর আগে একজন মুসলিম নারী কি করে এই অসম্ভব সম্ভব করলেন, তা জানার কৌতূহল এই লেখাটি মিটিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু মুসলিম নারী শাসকের নামও আমার কথিত লিস্টে ঢোকানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
প্রিন্সেস ডায়না ও দোদি আল-ফায়েদের কথা মনে পড়ল।
অথচ আপনার যুক্তিটির ধার না ধেরে অনেকে ইসামী বা বারানীদের ভাষ্য দিয়ে মিনহায ভাষ্যকে শক্তিশালী করার হাস্যকর চেষ্টা করতে পারে! এটি একটি ফ্যালাসি নিঃসন্দেহে!
আপনি 'সুলতানা'র কথা বলছেন? নাকি 'রাজিয়া'র কথা বুঝিয়েছেন? দ, য হওয়ার নজীর তো আছে, যেমনটা আপনার দোহাইতে উল্লেখ করেছেন যে আপনি কি রীতি প্রয়োগ করেছেন। আর সুলতানার ব্যাপারে আপনার আপত্তি কি 'সংসদ নেতা, সংসদ নেত্রী না' ধরনের?
চ্যালেঞ্জ নয়, বরং চরম কৌতূহল থেকেই কথাটা বলছি, পাঁচশ বছরের মত দীর্ঘ একটি সময়ের তুলনা শিক্ষা খাত সংক্রান্ত অবদানের আরও সবিস্তার উল্লেখ দাবী করছিল কিন্তু।
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
'রাজিয়া' ভুল আর 'সুলতানা' ডাহা ভুল। রাজিয়া কোনক্রমে মানা গেলেও সুলতানা মানার কোন কারণ নেই। সুলতানা মানে হচ্ছে সুলতানের স্ত্রী। রাদ্বিয়াহ্ যতদিন মামলুক সালতানাতের শাসক ছিলেন ততদিন তিনি কোন সুলতানের স্ত্রী হওয়া দূরে থাক, কারো স্ত্রীই ছিলেন না।
ইউরোপিয়দের আগমনের আগের ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা একটি বিশাল ও সময়সাপেক্ষ কাজ। কখনো সুযোগ পেতে সেটা নিয়ে লিখবো হয়তো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সুলতানা যদি ভুল হয় তাহলে সমজাতিয় ক্ষেত্রে রানীও তো ভুল হওয়া উচিত? রানী হল রাজার স্ত্রী, কিন্তু নাটোরের রানী ভবানী, ঝাসির রানী লক্ষ্মীবাই, সেবার রানী বিলকিস, এরকম আরও বহু রানী কোন রাজার স্ত্রী হিসেবে রানী নন, তাঁরা আসলে মহিলা রাজা। একই কারনে ভিকটোরিয়া কিংবা এলিজাবেথকে King না বলে Queen বলাটাও কি ভুল নয়?
আমরা বরং বাংলা অভিধান আর English dictionary দেখে নেই।
রানি [rāni] বি. রাজপত্নী, রাজ্ঞী। [সং. রাজ্ঞী]। n. a queen.
রাজ্ঞী [rājñī] বি. রাজমহিষী, রানি। [সং. রাজন্ + ঈ]। n. a queen; a queen-consort.
সম্রাজ্ঞী [samrājñī] বি. (স্ত্রী.) 1 মহারানি, বহু রাজ্যের অধিকারিণী; 2 সম্রাটের পত্নী। [সং. সম্ + রাজ্ঞী]। n. an empress; a sovereign queen.
Queen: noun: 1. a female sovereign or monarch. 2. the wife or consort of a king.
Empress: noun. 1. A female emperor. 2. The wife or widow of an emperor.
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অভিধানগুলো দেখলাম রানীর প্রতি যতটা আগ্রহী, সুলতানার প্রতি ততটা নয়, অধিকাংশ অভিধানে বোধ হয় সুলতানা শব্দটিই নেই। বাংলা একাডেমী এবং সংসদ বাঙ্গালা অভিধানে সুলতানাকে সুলতান শব্দের স্ত্রীবাচক শব্দ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, পরিষ্কার নয় যে সেটা সুলতানের স্ত্রী নাকি রাজ্যের শাসক। তবে উইকি এ বিষয়ে মজার তথ্য তুলে ধরেছে-
The term Sultana (Arabic: سلطانه) is an Islamic title reserved for a few Muslim women rulers in history. It is sometimes mistaken for the title of the chief wife of a Sultan.............. [url=http://en.wikipedia.org/wiki/Sultana_(title)]লিঙ্ক এখানে[/url]
উইকি'র এই ভুক্তিটা সঠিক বলে মনে হচ্ছে না। রাদ্বিয়াহ্র উদাহরণটা ভুলভাবে দেয়া। সাফিয়াতউদ্দিন সিয়াহ্'র উদাহরণটাও ভুল। তাছাড়া বাহাসাতে ভীনদেশী শব্দ গ্রহন করার সময় তার বানান, উচ্চারণ, অর্থ তাদের মতো করে ঠিক করে নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে বাহাসা সুলতানা আর আরবী সুলতানা এক না হবারই কথা।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বোঝাই যাচ্ছে, ইতিহাস নিজে নিজে বা নিজের ইচ্ছায় তৈরি হয়, আর ইতিহাস রচিত বা লিখিত হয় অন্যের ইচ্ছায় ! হা হা হা !
আচ্ছা, রাদ্বিয়াহ্ শব্দটার অপভ্রংশ হিসেবে কি রাজিয়া শব্দের আগমন ঘটতে পারে না ?
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
অন্য ভাষার যেসব নাম বাংলায় ঢুকে গেছে সেগুলোতে কিছুটা পরিবর্তন স্বাভাবিক। সে হিসেবে রাদ্বিয়াহ্ > রাজিয়া হয়ে গেছে। তাই এখন যারা 'রাজিয়া' আছেন তাদের নাম ভুল নয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ইতিহাসে কোন চিপায় কোন ঐতিহাসিক কাকে চাপা দিয়ে রেখেছেন কে জানে। চমৎকার লেগেছে লেখা।
এত গবেষণা করে লেখেন কিভাবে?
একজন ঐতিহাসিক বিশেষ কাউকে হয়তো চাপা দিয়ে রাখতে পারেন, তাতে বিশেষ সমস্যা হয় না। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই যখন ঐ বিশেষ কাউকে একের পর এক ঐতিহাসিক চাপা দিয়ে রাখেন।
এখানে গবেষণার কিছু নেই। আমি রাদ্বিয়াহ্র ওপরে তথ্য আছে অমন কয়েকটা বই পড়েছি, তারপর লিখেছি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তাহলে এই সেই নারী যাকে আমরা ক্লাস সেভেনে পড়েছিলাম রাজিয়া সুলতানা নামে। ব্যাপার যে এত কঠিন সেটা ইতিহাস বইয়ের দুই পাতায় বোঝা সম্ভব ছিল না। মনে হলো আনকোড়া ইতিহাস পড়লাম। বিশদ লেখার জন্য কৃতজ্ঞতা।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমাদের ইতিহাস বইগুলোতে ব্যক্তিকে গুরুত্ব দেবার ক্ষেত্রে তিন ধরনের ঘটনা ঘটে। এক, যে যত বেশি বছর রাজত্ব করেছে (বা উচ্চ পদে কাজ করেছে বা প্রচুর টাকা কামিয়েছে) তার গুরুত্ব ততো বেশি। দুই, পূর্ববর্তী ঐতিহাসিকেরা যাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে তাকেই কোন নতুন বিচার-বিবেচনা ছাড়া আবারও বেশি গুরুত্ব দেয়া। তিন, আলু-পটল-ঝিঙ্গা-চিচিঙ্গা-সাপ-ব্যাঙ-কচু-ঘেঁচু সবার জন্য তিন লাইন করে বরাদ্দ করা। বলাই বাহুল্য, গুরুত্ব দেবার এই তিনটা পদ্ধতিই ভুল।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আপনার বিশ্লেষণ নিয়ে কথা নাই; ইতিহাস নিয়ে কথা বলার বিদ্যাও নাই
কিন্তু পরিচিত নামের 'অপরিচিতকরণ' নিয়ে কিছু কথা আছে আমার
আমরা বহুক্ষেত্রে শত শত বিদেশিদের কিংবা দেশিদের বিদেশি না নেই বলি রাখি; এসবের কোনোটাই কিন্তু আদি উচ্চারণ>বাংলা বানান>বাংলা উচ্চারণ সূত্র ফলো করে না
বরং আদি উচ্চারণ>বাংলা উচ্চারণ> বাংলা বানান/উচ্চারণ এই সূত্রই ফলো করে। এই এই সূত্রেই আমরা বলি আর লিখি আর চিনি প্লেটো-সক্রেটিস-শাহপরান- র্যাবো... এইসব
এখন কেউ যদি আমাদের ঘাড়ে আদি গ্রিক-আরবি-ফরাসি উচ্চারণ চাপিয়ে দিয়ে বলে ওইগুলা হবে -প্লাতোন-সক্রাতুস-শাহফারান আর খ্যাম্বো... তাইলে কিন্তু একখান ঝালেমা হয়
সেই হিসাবে আমার মনে হয় রাজিয়ার মূল উচ্চারণ 'রাদ্বিয়াহ্'এইটা আপনি ধরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু ব্যবহার করা উচিত 'রাজিয়া'যা আমরা চিনি...
উচ্চারণ বিষয়ে সহমত। আমরা বিদেশী ব্যক্তি বা দেশের নামের যেসব উচ্চারণে অভ্যস্ত সেই উচ্চারণগুলো ইংরেজ আমলের প্রভাবে প্রচলিত। রাজিয়া সুলতানাও ইংরেজী উচ্চারণে প্রভাবিত। এটাকে ভুল মনে করা উচিত হবে না। ইংরেজের আলেকজান্ডার এবং আরবীর সিকান্দার একই ব্যক্তি। দেশ ভেদে উচ্চারণ ভিন্ন হতেই পারে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আপনার এই যুক্তি আমি মানি। কিন্তু 'রাদ্বিয়াহ্'র ক্ষেত্রে কেস ভিন্ন। প্রথমত, তাঁকে সুলতান থেকে সুলতানা বানানো হয়েছে। এটা ইচ্ছাকৃত, এবং বিকৃত মানসিকতা থেকে করা। দ্বিতীয়ত, বাংলায় লেখা ইতিহাস বইয়ে তাঁর নাম লেখার সময় মূল উৎস (যেমন, তাবাক্বাত ই নাসিরি) অনুসরণ না করে সাহেবদের করা ইংলিশ অনুবাদ অনুসরণ করা হয়েছে। বাংলায় ইতিহাস লেখকগণ ভারতীয় ঐতিহাসিক মিনহায/ইসামী/বারানী'র ঝাল র্যাভের্টি/এলিয়ট/ড'সনের মুখে খেতে গেলেন কেন? আমার আশঙ্কা এখানেও ইচ্ছাকৃত অশ্রদ্ধা কাজ করেছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
চমৎকার লেখা। সুলতান রাদ্বিয়াহ্কে নিয়ে জানার যে কমতি ছিল, সেটা কিছুটা হলেও মিটল।
বানানের ব্যাপারে একটা কথা বলার আছে। মিনহায/ইসামী/বারানী তো মনে হয় ইতিহাস রচনা করেছিলেন আরবী অথবা ফার্সি ভাষায়। বাংলায় যারা ইতিহাস লিখেছেন, তাদের মধ্যে কয়জন এই দুটি ভাষা জানেন? আমার তো মনে হয় 'রাদ্বিয়াহ্'র নাম বিকৃত করার মূল কারণ ভাষাজ্ঞানের অভাব (অশ্রদ্ধা অবশ্যই থাকতে পারে, তবে সেটাকে মূল কারণ বলে মনে হয় না)। আরবী উচ্চারণ এবং বানানে যেটা 'রামাদান', বাঙ্গালী মুসলমানেরা সেটাকে সবসময় 'রমজান' বলে উচ্চারণ এবং বানান করেছে। তার মানে তো এই না যে 'রামাদান' মাসকে বাঙ্গালী মুসলমানেরা শ্রদ্ধা করে না।
Emran
দেখুন, বাংলা ভাষায় যাঁরা প্রথম পর্যায়ে ইতিহাস রচনা করেছেন তাঁদের বেশিরভাগ জনের আরবী-ফারসী ভাষাজ্ঞান যথেষ্ট থাকার কথা। এমনকি পরবর্তী পর্যায়েও যাঁরা লিখেছেন তাঁদেরও ঐ দুই ভাষাতে কাজচলতি জ্ঞান থাকার কথা। সুতরাং তাঁরা সঠিক উচ্চারণ জানতেন না, এই কথাটা মানা যাচ্ছে না। আপনি অনেককে ইংলিশ বা হিন্দীতে দেখবেন ইলতুৎমিশকে আলতামাস, বা আলতুনিয়াকে আলতুনপা লিখতে দেখবেন। সেখানে বাঙালী ঐতিহাসিকেরা কিন্তু সঠিক উচ্চারণ 'ইলতুৎমিশ'ই লিখছেন। পিতার নামের ক্ষেত্রে যে সতর্কতা তাঁরা দেখিয়েছেন, কন্যার নামের ক্ষেত্রে তা করেননি কেন?
'রমজান' বনাম 'রামাদ্বান' তুলনাটা এখানে সঠিক বলে মনে করিনা। ১২৪০ সালে ভারতবর্ষের কয়টা মেয়ের নাম 'রাজিয়া' থাকা সম্ভব ছিল?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অভিনন্দন কিংবা উত্তম জাঝা যেন কম হয়ে যায় এমন একটা লেখার জন্য!
নারীকে সেকেণ্ড সেক্সের বৃত্ত থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে দেখলে ভালো লাগে।
যাক এসব আবেগের কথা...
****
আপনার এ'লেখা ইতিহাসের ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য একটা মূল্যবান নথি হিসেবে বিবেচিত হবে বলে বিশ্বাস।
নইলে ভুলভাল যা লিখা আছে পাঠ্যতে তাই উগলেই রাদ্বিয়াহ্ সম্পর্কে অনেক জেনে'ছির তৃপ্তিতে থাকতে হবে তাদের।
নামের বিকৃতিটা শুধরানো প্রয়োজন। ঢাকা,রেডক্রস, বোম্বে ইত্যাদির নাম পরিবর্তন হতে পারলে তাঁরটা করা ফরজ।
নইলে জানা সত্ত্বেও করা হয়নি একারণে ইতিহাস ক্ষমা করবে না।
****
[quoteআজকের পরিপ্রেক্ষিতে আটশ’ বছর আগে একজন নারীর মসনদে বসাটা অস্বাভাবিক মনে হলেও তখনকার প্রেক্ষিতে সেটা স্বাভাবিক ছিল। ]
আজকের প্রেক্ষাপটে কে বা কারা রাদ্বিয়াহ্'র মসনদে বসাকে অস্বাভাবিক ভাবছেন?
(আজকে যারা নারী নেতৃত্ব নিয়ে এলার্জিতে ভোগেন তাদেরই বলেছেন কি?)
আর সেসময়ে স্বাভাবিক হলেও তাঁর ক্ষমতা গ্রহণ তো মনে হয় একই কারণেই মানতে চাওয়া হয়নি- নাকি?
***
ইলতুৎমিশের প্রিয় পুত্র নাসিরের মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না নাকি? কোথাও পড়েছিলাম তাকে বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলা হয়।
এখন ঠিক মনেও নেই উৎস। যাক ব্যাপার সেটা নয়, নাসির ইলতুৎমিশের পছন্দের তালিকায় থাকলেও তাকে ক্ষমতার ক্ষেত্রে হুমকি ভেবে দূরে সরিয়ে দেয়াটা একটা অজুহাত মনে হয় না আপনার? হুমকিটা কেন? তাঁর বেঁচে থাকা অবস্হাতেই পুত্র বিদ্রোহী হয়ে ক্ষমতা দখল করতে পারে সেজন্য? মেয়ে কে তিনি যতোই অন্যভাবে তৈরি করে থাকেন আদতে সে একজন নারী এবং সে কারণে বাবার হুকুম মানতে বাধ্য; যা পুত্রের কাছ থেকে পাবেন না আশংকা ছিল হয়ত। কেন জানি মনে হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক এই চিন্তাটাও ইলতুৎমিশের মাথায় ছিল। নইলে মরে গেলে ক্ষমতাবান বংশধর ক্ষমতা নেবে সে তো সুখেরই কথা। ঠিক মত গুছিয়ে বলতে পারিনি প্রশ্নটা আসলে
****
অপদার্থ ফিরুযের বিরুদ্ধে ইলতুৎমিশের বিদ্রোহী পুত্র গিয়াস উদ্ দীন মুহাম্মদ শাহকে দিল্লীর মসনদে বসতে সাহায্য
করতে আগ্রহ দেখায়নি কেন আমীরেরা? যখন তারা প্রথমে রাদ্বিয়াহ্'কে ক্ষমতায় না বসিয়ে ফিরুযকেই বসায়?
***
মালিক সাঈফ উদ্ দীন কুচি/কোচি দু'ভাবে এসেছে নামটা
***
ইতিহাস পড়ে তো এটা স্পষ্টই যে ইলতুৎমিশ মেয়ে রাদ্বিয়াহ্ কে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়েই রচনা করতে চেয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে ২৬ বছর বয়সে বিয়ে না দেয়াটা খুব বেশি বিস্মিত করার বিষয় মনে হচ্ছে না আমার। কারণ স্বার্থপরতা এমন একটা
ব্যাপার যা অনেক কর্তব্যকেই ভুলিয়ে রাখতে পারে বা বাধ্য করে। শক্তিপদ রাজগুরুর 'মেঘে ঢাকা তারা' বা ঋত্ত্বিক ঘটকের একই নামের সিনেমায় উপার্জনক্ষম নিতাকে মা বিয়েই দিতে চান না...সেটা কেন বলুন?? বিষয় দুটো কোথাও যেন সম্পর্কিত আমার মনে হয়! গল্প সিনেমা যদিও; তারপরও সেসব তো মানুষের জীবন ঘেটেই নেয়া। ইতিহাসও মানুষের কৃতকর্মের সত্যিটুকু ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে থাকে ( কি কইলাম নিজেই বুঝিনাই, আপ্নে বুঝবেন কেম্নে খোদায় জানেন ) ভুল ভাবনা?
***
পুরুতান্ত্রিক মনোভাবের পুরুষ(সবাই নন) নারীকে কুটনামিতে সঙ্গী করতে যতটা উৎসাহী কূটনীতি/ক্ষমতায় দেখতে অতটাই নিরুৎসাহী। শাহ তুরকান, ঘষেটি বেগমের পৃষ্ঠপোষকতা এমন কথাই বলে।
***
আচ্ছা চাঁদ সুলতানা নামের একজন আছেন না ইতিহাসে? তাঁর সম্পর্কে কিছু জানেন?
***
দীর্ঘ মন্তব্যের জন্য বিরক্ত না হবার বিনীত অনুরোধ থাকলো ভাইয়া। ভালো থাকবেন