বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি নিয়ে কিছু কথা — প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: শনি, ২৩/০২/২০১৯ - ৪:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(এই লেখাটির শুরু সচল এস এম মাহবুব মুর্শেদ-এর পোস্ট ‘বড় বনাম ছোট প্রতিষ্ঠান: একটি সাবজেক্টিভ তুলনা’-তে করা আমার মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। আমার মন্তব্য শুধুমাত্র বাংলাদেশের বেসরকারি চাকুরি নিয়ে বিধায় সেটি নিয়ে বর্ধিত আলোচনা ঐ পোস্টে দেবার পরিবর্তে একটি ভিন্ন পোস্ট হিসাবে দিলাম। এতে কোন প্রকার বিধি লঙ্ঘিত হলে তা জানানোর জন্য পাঠকদের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকলো। বিধি লঙ্ঘনের আপত্তি উত্থাপিত হলে পোস্টটি অনতিবিলম্বে মুছে ফেলা হবে।)

১. অবতরণিকাঃ

এই লেখাটি কেবল বাংলাদেশের বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকুরি নিয়ে, তাও আবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকুরি বাদ দিয়ে। অন্য দেশের চাকুরির সাথে দূরে থাক, খোদ বাংলাদেশের সরকারি চাকুরি অথবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকুরির সাথেও এই চাকুরি তুলনীয় নয়, এইজন্য একটি স্বতন্ত্র আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক, বিবিএস-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বশেষ যেসব তথ্য-উপাত্ত সাধারণ্যে পাওয়া যায় তাতে বাংলাদেশের প্রায় ৬ কোটি ৮০ লাখ লোক কোন না কোন প্রকার উপার্জনী কর্মকাণ্ডে জড়িত আছেন। এদের মধ্যে ৬০.৯৪% বা প্রায় ৪ কোটি ১৪ লাখ জন চাকুরি করেন। চাকুরিজীবিদের মধ্য থেকে প্রায় ২৩ লাখ সরকারি চাকুরিজীবি, লাখ পাঁচেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের চাকুরিজীবি আর লাখ ছয়েক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাকুরিজীবিদের বাদ দিলে বাকি যে ৩ কোটি ৮০ লাখ জন (মোট কর্মজীবিদের ৫৬%) বেসরকারি চাকুরি করেন এই আলোচনা তাদেরকে নিয়ে। আলোচনার সুবিধার্থে এখানে তাদেরকে শুধুমাত্র ‘চাকুরিজীবি’ বলে উল্লেখ করা হবে। এই সংখ্যাটা ৩ কোটি ৮০ লাখ থেকে কম বা বেশি হতে পারে, তবে তাতে গোটা অবস্থার বিশেষ কোন পার্থক্য হবে না।

বাংলাদেশে কাজ করে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেদেরকে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বলে দাবি করে। রাষ্ট্র বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের বিধি ঠিক করে দেয়, কিন্তু তাদের জন্য বিশেষ প্রকারের চাকুরিবিধি প্রণয়ন করে না — তার প্রয়োজনও নেই। যেসব বিধি-নীতি-নিয়ম-সংস্কৃতি দেশ নির্বিশেষে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকা কাম্য এখানকার অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সেসবের ধার ধারে না। ঐ প্রকার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের চাকুরি আসলে একটু বেশি বেতনের, অদরকারি দেখনদারী বিষয়সমৃদ্ধ দেশিয় চাকুরি মাত্র। এই সত্যটা বাংলাদেশস্থ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জিজ্ঞেস করলে চট্‌ করে জানা যাবে না। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেন শাক দিয়ে মাছ ঢেকে নিজেদের ফাঁপানো সম্মান বাঁচাতে। কিন্তু যখন তারা চাকুরি ছাড়েন, কেবল তখনই মুদ্রার অন্য পিঠের গল্প জানা যায়। এই লেখাটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিয়ে নয় তাই এই প্রসঙ্গটি এখানেই শেষ করা হলো।

বাংলাদেশের তরুণ-যুবারা এখন সরকারি চাকুরি পাবার জন্য বা বিদেশে চলে যাবার জন্য যে জীবনমরণ সংগ্রামে নামেন সেটা অহেতুক নয়। এর পেছনে তাদের, তাদের অভিভাবকদের, পরিবারের অন্য সদস্যদের বঞ্চনা ও অপমানের করুণ ইতিহাস আছে। অনাদি কাল থেকে এদেশে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামো অথবা কর্তৃত্বকাঠামোর বাইরের মানুষের ক্ষেত্রে নিয়ত বঞ্চনা ও অপমান নির্বন্ধ হয়ে আছে। সুতরাং ঐ দুই কাঠামোর বাইরের জনগোষ্ঠী হিসাবে বেসরকারি চাকুরিজীবিদের কপালে নিয়ত বঞ্চনা ও অপমান থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এদেশে বেসরকারি চাকুরি না করলে শোষণ, বৈষম্য, অনিয়ম, বঞ্চনা, অমানবিকতার বিচিত্র এবং অভিনব সব রূপ সম্পর্কে জানা হবে না।

২. মৌলিক কিছু বিষয়ঃ

একটা চাকুরিতে কিছু মৌলিক বিষয় সংশ্লিষ্ট থাকার কথা। যথাঃ

২.১. নিয়োগপত্র
২.২. চাকুরিবিধি
২.৩. পদ/পদবী
২.৪. কাজের সংজ্ঞা/পরিধি
২.৫. কাজের পরিবেশ
২.৬. কর্মঘন্টা-ছুটি ইত্যাদি
২.৭. বেতন-বোনাস-ইনক্রিমেন্ট
২.৮. বাড়ি ভাড়া-যাতায়ত-দৈনিক ব্যয় ইত্যাদি
২.৯. চিকিৎসা-জীবন বীমা-চিকিৎসা বীমা-দুর্ঘটনা বীমা ইত্যাদি
২.১০. প্রভিডেন্ট ফান্ড-গ্রাচ্যুইটি-পেনশন স্কিম ইত্যাদি
২.১১. পদোন্নতির সুযোগ ও নীতি

বাংলাদেশে কোটি মানুষ চাকুরি করেন কোন প্রকার নিয়োগপত্র ছাড়া। যাদের নিয়োগপত্র থাকে তাদের অনেকেই জানেন না সেই নিয়োগপত্রের আইনগত গ্রহনযোগ্যতা আছে কি না। তাদের কাজের পরিধি কোন প্রকারে সংজ্ঞায়িত থাকুক বা না থাকুক প্রায়ই তাদেরকে এমন কাজ করতে হয় যা তাদের পদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অনেককে মানবেতর পরিবেশে কাজ করতে হয়। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান থাকে যেখানে শৌচাগার পর্যন্ত থাকে না। কর্মঘন্টা নামেই ৮ ঘন্টা হয় বাস্তবে তা ১০/১২ ঘন্টায় ঠেকে, অথচ অতিরিক্ত সময়ের জন্য কোন ভাতা বা মূল্য মেলে না। ছুটি দেবার বিধিবদ্ধ নিয়ম সর্বত্র থাকেনা অথবা থাকলেও তা যথাযথভাবে মানা হয়না। মাসের কত তারিখে বেতন পাওয়া যাবে বা আদৌ বেতন পাওয়া যাবে কিনা তার নিশ্চয়তা থাকে না। প্রতি বছর উৎসবে বোনাস পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। প্রতি বছর বেতনবৃদ্ধি হবে কিনা তার ঠিক নেই, বেতনবৃদ্ধি হলেও তা কর্মদক্ষতা-যোগ্যতা-পারফরম্যান্স-মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি বিবেচনা করে হবে নাকি গড়ে শতকরা ৫/১০ ভাগ হারে হবে তার গ্যারান্টি নেই। প্রতিষ্ঠানের কাজের টিএ/ডিএ বিল জমা দিলে তা কবে এবং কী পরিমাণ পাওয়া যাবে তার ঠিক নেই। চিকিৎসা ভাতা, বীমা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন স্কিম, মহার্ঘ ভাতা ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই। বছরের পর বছর একই পদে কাজ করতে হয় কিন্তু পদন্নোতি হয় না। হঠাৎ করে মালিকপক্ষের পরিবারের বা তাদের পছন্দের কাউকে যোগ্যতা বিবেচনা না করে মাথার উপরে বসিয়ে দেয়া হয়। কোন কারণে বা বিনা কারণে এক কালো দিনে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ ছাড়া সমস্ত বকেয়া বেতন-বোনাস-বিল ছাড়া চাকুরি চলে যায়। এই সবকিছুর ব্যতিক্রম আছে, তবে ব্যতিক্রমও নিয়মেরই অন্তর্ভুক্ত।

চাকুরি নিয়ে একপ্রকার শেষ কথা বলে গেছেন খোদ জীবনানন্দ দাশ —

“মানুষেরই হাতে তবু মানুষ হতেছে নাজেহাল;
পৃথিবীতে নেই কোন বিশুদ্ধ চাকরি।
এ-কেমন পরিবেশে র’য়ে গেছি সবে —“

(জীবনানন্দ দাশ; সৃষ্টির তীরে, সাতটি তারার তিমির; গুপ্ত রহমান এ্যান্ড গুপ্ত; ১৯৪৮; কলিকাতা)

৩. প্রতিষ্ঠানের আকার-আয়তন-প্রকৃতিঃ

বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রথমে ভাগ করা যায় আগের অধ্যায়ে বলা মৌলিক বিষয়গুলোর ভিত্তিতে —

৩.১.১. বিষয়গুলোর বেশির ভাগ মেনে চলে
৩.১.২. বিষয়গুলোর আধাআধি মেনে চলে
৩.১.৩. বিষয়গুলো যত দূর সম্ভব কম মেনে চলে

কর্মীর সংখ্যা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের আকার মাপার বিশ্বজনীন পদ্ধতি এখানে খুব কার্যকর নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে কয়েক শত লোক কাজ করেন কিন্তু পুঁজি অল্প, আবার শ’খানেকের কম লোক কাজ করেন এমন প্রতিষ্ঠানের পুঁজি হাজার কোটি টাকার উপরে হতে পারে। তাই এখানে প্রতিষ্ঠানের আকার মাপতে হয় তার পুঁজির আকার অনুযায়ী —

৩.২.১. বড় প্রতিষ্ঠান (পুঁজি হাজার কোটি টাকার উপরে)
৩.২.২. মাঝারী প্রতিষ্ঠান (পুঁজি শত কোটি টাকার উপরে তবে হাজার কোটি টাকার নিচে)
৩.২.৩. ছোট প্রতিষ্ঠান (পুঁজি শত কোটি টাকার নিচে)
[টাকার হিসাবটা ২০১৯ সালের প্রেক্ষিতে করা। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই অঙ্কটা পাল্টাবে।]

মালিকানা বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর গঠন এমন হয় —

৩.৩.১. একক ব্যক্তিমালিকানাধীন
৩.৩.২. অংশীদারী মালিকানাধীন এবং লিমিটেড নয়
৩.৩.৩. প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠান
৩.৩.৪. পাবলিক লিমিটেড প্রতিষ্ঠান

চাকুরির আবেদন করার আগে প্রতিষ্ঠানের উপরোক্ত তিন প্রকার বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া আবশ্যক। এই সকল প্রকারভেদের সাথে জড়িত সম্ভাবনা ও ঝুঁকিসমূহও জানা আবশ্যক। এসব না জেনে চাকুরিতে ঢুকে (Caveat Emptor) নিজেকে প্রতারিত ভাবাটা বোকামি।

৪. চাকুরি নেবার আগেঃ

একজন চাকুরিজীবির কাছে চাকুরির যে বিষয়গুলো প্রথমেই বিবেচ্য তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বেতন। এখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা, দক্ষতা, কর্মাভিজ্ঞতা ইত্যাদি বেতনের পরিমাণ নির্ধারণে যথেষ্ট নয়। এখানে প্রথমেই বিবেচ্য ইন্ডাস্ট্রিটা কী। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। বাংলাদেশে একজন স্কুল/কলেজ শিক্ষক তাঁর সমপর্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা, কর্মাভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতা সম্পন্ন অন্য চাকুরিজীবিদের চেয়ে অনেক কম বেতন পান। কারণ, এদেশে ধরেই নেয়া হয়েছে স্কুল/কলেজের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন হতে হবে করুণাকর পরিমাণে। শিক্ষাগত যোগ্যতা – দক্ষতা – কর্মাভিজ্ঞতা যা-ই হোক না কেন একটা নির্ধারিত অঙ্কের উপরে বেতন দেয়া যাবে না এমন নীতিতে বিশ্বাসী ইন্ডাস্ট্রির সংখ্যা প্রচুর। সুতরাং চাকুরি নেবার আগে তো বটেই নিজের পেশা ঠিক করার আগে ইন্ডাস্ট্রির বেতনের সিলিং জেনে নেয়া আবশ্যক।

পেশা ঠিক করার আগে ইন্ডাস্ট্রির আয়ু সম্পর্কে ভাবনা থাকা উচিত। নব্বইয়ের দশকের গোড়াতে যারা পাট শিল্পে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তারা যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে বাজারে আসতে না আসতে বাংলাদেশে পাট শিল্পের বিদায়ের ঘন্টা বেজে গেছে। বৈদ্যুতিক বাতির বাজারে Incandescent Bulb-কে Light-Emitting Diode (LED) Bulb দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার আগে Compact Fluorescent Lamp (CFL)এসেছিল; কিন্তু CFL আগমন আর LED’র আগমনের মধ্যে সময়ের পার্থক্য এতো কম যে যারা CFL-এ বিপুল বিনিয়োগ করেছিলেন তারা বড় ধরা খেয়ে গেছেন। সুতরাং যেখানে নিজের জীবন বিনিয়োগ করতে হবে সেখানে তার ভবিষ্যত নিয়ে একটু ভালোভাবে জেনে নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ।

সম্ভব হলে চাকুরিতে আবেদন করার আগে আরও কয়েকটি বিষয় জেনে নিতে হবে। আগে জানা সম্ভব না হলে চাকুরি পাবার পরে হলেও সেসব জানতে হবে —

৪.১. প্রতিষ্ঠানের মালিকদের পরিচয় কী?
: মালিকদের মধ্যে পেশাদার রাজনীতিবিদ, হঠাৎ করে ধনী হয়ে যাওয়া, অপরাধসংশ্লিষ্ট, বেনামী, সরকারি চাকুরিজীবি, মাদকাসক্ত, জুয়ারী, অপার্থিব বিষয়াদীর চরম ভক্ত, প্রচণ্ড অলস, অতিরিক্ত স্ফূর্তিবাজ থাকলে সতর্ক হতে হবে। মালিকদের এই প্রকার পরিচয় প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ত্ব ও কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর।

৪.২. প্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎস কী?
: প্রতিষ্ঠানের পুঁজির যোগান যদি একই ব্যবসা থেকে আসে তাহলে তা ঠিক আছে। তবে ‘কইয়ের তেলে কই ভাজা’র এমন নীতিতে বিশ্বাসী প্রতিষ্ঠানের বিশেষ উন্নতি হয় না, এবং এদের পক্ষে বিশেষ কোন অভিঘাত সহ্য করবার সক্ষমতা থাকে না। পুঁজির যোগান একই গ্রুপের অন্য ব্যবসা থেকে আসলে দেখতে হবে এই প্রকার পরিতোষণ কতদিন চালানো সম্ভব এবং এই ব্যবসাটি কখনো আদৌ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে কিনা। পুঁজির যোগান যদি কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হয়ে থাকে তাহলে দেখতে হবে সেই ঋণ নিয়মিতভাবে অথবা আদৌ পরিশোধিত হচ্ছে কিনা। পুঁজির উৎস যদি অজ্ঞাত হয় অথবা বেনামী ব্যক্তির কাছ থেকে আসে অতি দ্রুত সেই প্রতিষ্ঠান থেকে সরে আসতে হবে।

৪.৩. প্রতিষ্ঠানটি কি লাভ করছে?
: ব্যবসায় শুরু করার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি কি ব্রেক ইভন পয়েন্ট অতিক্রম করেছে? যদি না করে থাকে তাহলে কবে নাগাদ সেটা করতে পারবে? সেই সময়কালটি কি যৌক্তিক? যদি ব্রেক ইভন পয়েন্ট অতিক্রম করে থাকে তাহলে দেখতে হবে বার্ষিক লাভের পরিমাণ সন্তোষজনক কিনা। প্রতিষ্ঠানটি কোন এক কালে ব্রেক ইভন পয়েন্ট অতিক্রম করেছিল কিন্তু বর্তমানে লোকসান করছে — এমন পরিস্থিতি হলে দেখতে হবে প্রতিষ্ঠান কত বছর ধরে লাভ করছে না এবং লোকসানের পরিমাণ কত। এখান থেকে বুঝতে হবে এই প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকা আর্থিকভাবে নিরাপদ কিনা। একটি পুরনো প্রতিষ্ঠান যদি তার ইতিহাসে কখনোই লাভের মুখ না দেখে থাকে অথবা গত পাঁচ বছর ধরে তার বার্ষিক লোকসানের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে তাহলে তার থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে হবে।

৪.৪. প্রতিষ্ঠান কি সম্পৃক্ত বিন্দুতে (saturation point) পৌঁছে গেছে?
: পূঁজি বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত দিক, ব্যবস্থাপনাগত দিক এবং বিকাশ বিবেচনায় একটি প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত বিন্দুতে বা তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে কিনা তা বুঝতে হবে। প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত বিন্দু বা তার কাছাকাছি পৌঁছে গেলে তার সাথে সম্পৃক্ত না থাকাটা নিজের ক্যারিয়ারের জন্য উত্তম।

৪.৫. চাকুরিটি কি দ্রুত সম্পৃক্ত বিন্দুতে পৌঁছে যাবে?
: এমন কিছু চাকুরি থাকে যেখানে উপরে ওঠার বিশেষ জায়গা নেই বা বিকাশের সুযোগ নেই। এই প্রকার চাকুরি খুব দ্রুত সম্পৃক্ত বিন্দুতে পৌঁছে যায়। সম্পৃক্ত চাকুরিতে থাকা ক্যারিয়ারকে স্থায়ীভাবে স্থবির করে দেয়।

৪.৬. প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাটি কীসের?

৪.৬.১. ব্যবসাটি বৈধ না অবৈধ?
: ব্যবসাটিতে নূন্যতম অবৈধ পণ্য (= goods +/ service) বা বিষয় জড়িত থাকলে নিজে বাঁচতে সেখান থেকে দ্রুত সরে পড়তে হবে। যদি বৈধতা ব্যাপারটি ঘোলাটে বলে মনে হয় তাহলে সহকর্মীদের কাছ থেকে বিষয়টি জানতে হবে। তাদের কাছ থেকে জানার পর তার আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যার জন্য কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করতে হবে। এমন প্রশ্নের উত্তরে তারা ধমকালে বা রাগ করলে বা বিরক্তি প্রকাশ করলে বা হুমকি দিলে বা অপমান করলে বা অর্থহীন লম্বা আলাপ জুড়লে বুঝতে হবে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ে বৈধতার ঘাটতি আছে।

৪.৬.২. ব্যবসাটি বৈধ, তবে পণ্য ভালো নয়।
: যে প্রতিষ্ঠান পণ্যের উন্নতি নিয়ে ভাবে না, পরিবর্তন করে না, অভিযোজন করে না, নিম্নমানের পণ্য নিয়ে ব্যবসা করতে চায়, ভোক্তা সেবা (customer service) দিতে অনাগ্রহী, ভোক্তাকে প্রাপ্য সেবা দেবার বদলে ঠেকাতে বা ফিরিয়ে দিতে আগ্রহী — সেই প্রতিষ্ঠানের পতন অনিবার্য।

৪.৬.৩. যে পণ্যের ব্যবসা করে তার ভবিষ্যত ঘোলাটে।
: প্রযুক্তিগতভাবে বা ক্রেতাচাহিদা অনুযায়ী যে পণ্য ফুরিয়ে যাচ্ছে সেই পণ্য নিয়ে কোন প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে চাইলে তার বিলুপ্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র।

৪.৬.৪. ব্যবসার সব কিছুই ঠিক আছে, কিন্তু এখানে আর কী কী সব যেন বিষয় আছে।
: আজকের দিনে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাকূল বা ব্যবস্থাপককূল কোন বিশেষ গোষ্ঠীর সদস্য হলে বা তাদের ব্যবসাটা কোন বিশেষ গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের অংশ হলে বা প্রতিষ্ঠানটিতে কোন বিশেষ গোষ্ঠীর সহায়ক কর্মকাণ্ড চললে তৎক্ষণাত ঐ স্থান থেকে সরে যেতে হবে। জীবনধারণের জন্য চাকুরি প্রয়োজন বটে, তবে নিজের জীবন বাঁচানো তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

৪.৭. কর্তৃপক্ষ কেমন?

৪.৭.১. উদ্যোক্তাকূল ও ব্যবস্থাপককূল কেমন মানুষ দিয়ে গঠিত? যদি তাদের বড় অংশ অশিক্ষিত হয় এবং অশিক্ষা নিয়ে গর্ব থাকে তাহলে ঐ প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত নেই। উন্নয়নবিমুখ, প্রযুক্তিবিমুখ, গোঁড়া, বৈষম্যবাদী, অতিরিক্ত লোভী উদ্যোক্তাকূল বা ব্যবস্থাপককূল আছে এমন প্রতিষ্ঠানেরও ভবিষ্যত অন্ধকার।

৪.৭.২. যে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে জুয়া, বাজি, নেশাদ্রব্য, বহুগামিতা, অনৈতিকতা বা বিশেষ প্রকারের ধর্মীয় চর্চ্চার বাড়াবাড়ি থাকে সেই প্রতিষ্ঠান পরিত্যাজ্য। কারণ, যারা ব্যক্তিগত বিষয়াবলীর সাথে ব্যবসাকে পার্থক্য করতে পারে না তাদের ব্যবসায়িক অধঃপতন অনিবার্য।

৪.৭.৩. যে প্রতিষ্ঠান ঠিক সময়ে অফিস শুরু করতে ও ঠিক সময়ে শেষ করতে পারে না তাদের ব্যবসায়িক অধঃপতন অনিবার্য। যাদের কাছে সময়ের মূল্য নেই তারা মূঢ়। যারা আজকের কাজ আজ শেষ করতে পারে না, তারা সেই কাজ আগামীকালও শেষ করতে পারবে না।

৪.৮. সর্বশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা বা চট্টগ্রামের না হলে শিক্ষা শেষে ঐ একই শহরের কোন প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়া বেশিরভাগ সময়ে ঠিক নয়। লোকে ওল্ড স্কুলের মায়ায় পড়ে নিজের ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেয়, কিন্তু টের পায় না।

৪.৯. কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক বা বড় ভাই/বোন সেধে কোন চাকুরি দিতে চাইলে সেটার সব খুঁটিনাটি জেনে আগাতে হবে। চোখ বুঁজে ঐ শিক্ষক বা বড় ভাই/বোনকে নির্ভর করা যাবে না। প্রায়ই হিতাকাঙ্খী মুরুব্বীকূল নিজেদের স্বল্প মেয়াদী লাভের জন্য আবেগে অন্ধ বয়োকনিষ্ঠদেরকে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য জবাই করে দেন।

৪.১০. চাকুরি পাবার ক্ষেত্রে সম্ভব হলে কোন শিক্ষককে রেফারি হিসাবে না রাখা। কোন প্রতিষ্ঠান থেকে আসা খোঁজখবরের ক্ষেত্রে শিক্ষকরা প্রায়ই সাবেক শিক্ষার্থীকে চিনতে বা মনে করতে পারেন না।

৪.১১. চাকুরি একটি কঠোর বাস্তব বিষয়। এখানে আবেগাক্রান্ত হওয়া বা আবেগী ব্যাপারে জড়ানো বোকামী। একারণে প্রতিষ্ঠান বা তার উদ্যোক্তাদের সাথে ব্যক্তিগত ও আবেগী সম্পর্কে না জড়ানো উত্তম। কর্মী শোষণের এটি একটি সুপ্রাচীন ও বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি।

৫. ছোট প্রতিষ্ঠান নাকি বড় প্রতিষ্ঠানঃ

“Here at least
we shall be free; the Almighty hath not built
Here for his envy, will not drive us hence:
Here we may reign secure, and in my choice
to reign is worth ambition though in Hell:
Better to reign in Hell, than serve in Heaven.”

(John Milton; Book I, Paradise Lost; Peter Parker; 1667; London)

কবিতাংশটির শেষ লাইনটি বেশ জনপ্রিয়, লোকে এখানে সেখানে এই লাইনটি ব্যবহার করেন। ছোট প্রতিষ্ঠানে চাকুরি না বড় প্রতিষ্ঠানে চাকুরি এই প্রশ্নের উত্তরে এই লাইনটাকে একটু পালটে বলতে হবে —

Sometimes, it is better to reign in Hell, than serve in Heaven”

অর্থাৎ, কখনো কখনো বড় প্রতিষ্ঠানে চাকর হবার চেয়ে ছোট প্রতিষ্ঠানে বড় কর্তা হওয়া ভালো। এটি খুব খেয়াল করে মনে রাখতে হবে যে লাইনটির শুরুতে ‘Sometimes’ আছে — এটি ‘Always’ নয়। সুতরাং কথাটি সবসময়ের জন্য প্রযোজ্য নয়, বরং বাংলাদেশে ছোট বা অখ্যাত বা অসংগঠিত প্রতিষ্ঠান দিয়ে কর্মজীবন শুরু করাটা শুধু ভুল নয়, সংশোধনঅযোগ্য ভুল। কেননা —

৫.১. নিয়োগকর্তারা যখন সিভি বাছাই করেন তখন কর্মাভিজ্ঞতার গোড়ার দিকে সবার জানা বা স্বনামধন্য বা বড় প্রতিষ্ঠানের নাম দেখলে স্বস্তিবোধ করেন। সিভিতে অজানা প্রতিষ্ঠানের নামের সারি দেখলে তাদের ভ্রু কুঁচকে যায়, তাদের হাত থেকে সিভি ‘সিলেক্টেড ফর ইন্টারভিউ’ ট্রের বদলে ট্র্যাশ বিনের দিকে যেতে চায়।

৫.২. কর্মজীবনে প্রথম প্রতিষ্ঠান একজনের কাছে Alma mater-এর মতো। প্রথম প্রতিষ্ঠানের ছাপ অধিকাংশ মানুষের অবচেতনে স্থায়ী হয়ে থাকে। ছোট প্রতিষ্ঠানের ছাপ অবচেতনে স্থায়ী হলে পরে বড় প্রতিষ্ঠানে অভিযোজনে সমস্যা হয়।

৫.৩. ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক কিছুই কাঠামোবদ্ধ (formatted) থাকে না, অনেক বিধি থাকে না, অনেক কিছু ঢিলেঢালা হয়, নিজস্ব সুগঠিত সংস্কৃতি থাকে না। তাই কর্মজীবনের একেবারে শুরুতে ছোট প্রতিষ্ঠানে কাজ করলে একজনের ভেতরের কিছু জিনিস স্থায়ীভাবে বেডৌল (deformed) হয়ে যায়।

৫.৪. প্রবেশক পর্যায়ের (entry level) চাকুরি ছাড়া বাকি চাকুরি সাধারণত বিজ্ঞাপন দেখে হয় না। অর্থাৎ, চাকুরি পাবার জন্য সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো কর্মজাল (network) থাকতে হয়। ছোট প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা খুব সহজে এই কর্মজালে যুক্ত হতে পারেন না।

৫.৫. ছোট প্রতিষ্ঠানে প্রবেশক পর্যায়ের বা শুরুর বেতন বড় প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি হয়, কিন্তু বছর পাঁচেক পরে বেতন-বোনাস-সুবিধাদি হিসাব করলে দেখা যাবে ছোট প্রতিষ্ঠানের চাকুরি বড় প্রতিষ্ঠানের চাকুরির চেয়ে যোজন যোজন পেছনে পড়ে আছে। এই পার্থক্যটি আর সহসা ঘুচানো যায় না।

তাহলে কি ছোট প্রতিষ্ঠানে একেবারেই কাজ করতে নেই? অবশ্যই না। ‘যথাসময়ে’ ছোট প্রতিষ্ঠানে কাজ করা যাবে। তবে সেই ‘যথাসময়’টিকে বুঝতে হবে। যারা বাংলাদেশে কোন ইন্ডাস্ট্রিতে দ্রুত উপরে উঠতে থাকেন তারা অচিরেই দেখতে পান তার আর উপরে ওঠার জায়গা নেই। তাতে হয় তাকে ঐ পদেই বাকি জীবন কাজ করে যেতে হয় অথবা চাকুরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হতে হয়। চাকুরি না ছাড়লেও সম্পৃক্ততার (saturation) দরুণ কয়েক বছরের মধ্যে চাকুরিটি চলে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আবার অনেকে দেখতে পান প্রতিষ্ঠান পাল্টালেও তার চাকুরিতে বিশেষ উন্নতির সম্ভাবনা নেই। এমন পরিস্থিতিতেও উদ্যোক্তা হওয়াটা ভালো বিকল্প।

যাদের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনায় উদ্যোক্তা হবার ব্যাপারটি আছে তাদেরকে জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে ছোট প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হবে। পরিকল্পনা (planning), উন্নয়ন (development), সংগ্রহণ (procurement), উৎপাদন ব্যবস্থাপনা (production management), সরবরাহ প্রবাহ ব্যবস্থাপনা (supply chain management), বস্তুসঞ্চয় ব্যবস্থাপনা (inventory management), কর্মপরিচালন (operation), স্থিতি ব্যবস্থাপনা (maintenance), আরক্ষণ (security), বিপণন (marketing), বিক্রয় (sales), তকমাকরণ (branding), মেধাসত্ত্ব ব্যবস্থাপনা (intellectual property management), অর্থায়ণ (finance), নীরিক্ষণ (audit), মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা (human resources management), প্রকল্প ব্যবস্থাপনা (project management), শ্রম ব্যবস্থাপনা (labor management), সংঘর্ষ ব্যবস্থাপনা (conflict management), কৌশল ব্যবস্থাপনা (strategic management), রোকড়ী (banking), বীমা (insurance), অর্থ ব্যবস্থাপনা (fund management), পুঁজি পরিকল্পন (capital budgeting), বিনিয়োগ বিশ্লেষণ (investment analysis), আয়কর (income tax), শুল্ক (customs), পণ্য ছাড়করণ (clearing & forwarding), পণ্য পরিচলন (shipping), আবগারী (excise), মূল্য সংযোজন কর (value added tax),পুলিশ (police), আইন ও আদালত (law & courts), অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনা (event management) ইত্যাদির অধিকাংশতে কিছু না কিছু কর্মাভিজ্ঞতা না থাকলে উদ্যোগ গ্রহনের পথে এবং পরে পদে পদে হয় চাকা আবিষ্কার করতে হয় অথবা ঠেকে-দণ্ড দিয়ে শিখতে হয়। বেশির ভাগ ছোট প্রতিষ্ঠানে এই সকল বিষয়ের অধিকাংশ শেখার সুযোগ মোটামুটি অবারিত। জানার ও শেখার আগ্রহ থাকলে ছোট প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক কিছু শিখে নেয়া যায়।

না জানার গর্ব নিয়ে যারা বলেন, ‘আমি তো এত কিছু না জেনেই ব্যবসা শুরু করেছিলাম — আমি তো ভালই করছি!” প্রথমত, তারা এই সত্যটা জানেন না যে, কোন না কোন উপায়ে এসবে কিছু কিছু শিক্ষা তাদের মধ্যে ছিল এবং তারপরও তারা নানা বিষয়ে প্রচুর দণ্ড দিয়ে শিখেছেন ও শিখছেন। দ্বিতীয়ত, তাদের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উক্তিতে মোটামুটি শেষ কথাটি বলে দিয়েছেন —

“কৃতকার্য হবার মতো শিক্ষা যাদের নেই, যারা কেবলমাত্র দৈবক্রমেই কৃতকার্য হয়ে ওঠে, তাদের সেই কৃতকার্যতাটা একটা বিষম বালাই”।
(ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠিপত্র- ৫, পত্র- ১)

[প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সচল ফারুক হাসান–এর পোস্ট ‘সদ্যজাত কোম্পানির সফল উদ্যোক্তা কীভাবে হবেন?’-এর লিংক যোগ করা হলো।]

বাংলাদেশে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে আন্তঃবিভাগীয় কোন বিষয় শেখা বা অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ বা আনুভূমিক শিখনের (horizontal learning) সুযোগ খুব কম। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এক বিভাগের কর্মীর অন্য বিভাগের কাজে আগ্রহের অনুমোদন দেয়া হয় না। সেখানে একটি মাত্র বিষয়ে কুশলী হবার পরামর্শ দেয়া হয় বা উল্লম্ব শিখনের (vertical learning) সুযোগ দেয়া হয়। এই প্রক্রিয়াতে ঐ বিশেষ কর্মকৌশলটির (trade) বিশেষজ্ঞ হওয়া যায়, কিন্তু তা দক্ষ স্বাধীন উদ্যোক্তা হবার পথটি বন্ধুর করে তোলে।

শেখা এবং পেশাগত উন্নতি (career progression) সমার্থক বিষয় নয়। শেখা বলতে আনুভূমিক ও উল্লম্ব উভয় প্রকার শিখনকে বোঝায়। আনুভূমিক শিখন ছাড়াও পেশাগত উন্নতি ও দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব তবে সেই উন্নতি একটা পর্যায় পর্যন্ত হয়। ব্যবস্থাপনার উচ্চ পর্যায়ে যেতে গেলে আন্তঃবিভাগীয় জ্ঞান থাকা আবশ্যক। ছোট প্রতিষ্ঠানে এই উভয় প্রকার জ্ঞান লাভের সুযোগ বেশি, কিন্তু ব্যবসায়ের পরিধি সীমাবদ্ধ বলে সেখানে উল্লম্ব শিখনের সুযোগ কম থাকে।

৬. কর্মজীবন-সাধারণ জীবন সুস্থিতাবস্থাঃ

বাংলাদেশে ছোট প্রতিষ্ঠানে অবধারিতভাবে বাড়তি পেমেন্ট ছাড়া সপ্তাহে ছয় দিন মোট ৪৮ থেকে ৭২ ঘন্টা কাজ করতে হয়। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোতে মালিক পক্ষের লোকজন অফিসে যে সময়েই ঢুকুন না কেন, তাদের প্রত্যেকে অফিস থেকে বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত বাকি কর্মীদের কেউ বের হতে পারবেন না — এটা একটা অলিখিত নিয়ম। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাপ্তাহিক কাজের পরিমাণ সাধারণত ৪৮ ঘন্টার মতো, এবং সেটা প্রায়ই বাড়তি পেমেন্ট ছাড়াই ৬০ ঘন্টাকে ছাড়িয়ে যায়। এই যে সপ্তাহে ৪০ ঘন্টার চেয়ে বেশি সময় ধরে কাজ করানো হচ্ছে এর কারণ এটা নয় যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের চাপ বেশি। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটার কারণ ঢিলেঢালাভাবে কাজ করার সংস্কৃতি, কাজ ফেলে রাখার মানসিকতা, কাজ করতে না চাওয়ার প্রবণতা ও অদক্ষতা। এই প্রকার ঐতিহ্য নির্মাণের দায় উদ্যোক্তাকূলের ওপর বর্তায়।

ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণত সরকারি ছুটির দিনগুলোতে ছুটি দেয়া হলেও অর্জিত, নৈমিত্তিক ও অসুস্থতাজনিত ছুটির ব্যাপারে গড়িমসি করে। এই ব্যাপারে তাদের লিখিত বিধান যদি থেকেও থাকে প্রায়ই তারা সেটা মানতে চায় না। অন্যান্য ছুটির ক্ষেত্রে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর আচরণ অপেক্ষাকৃত ভালো। তবে বড় প্রতিষ্ঠানেও এমন উদ্যোক্তা থাকতে পারে যারা ছুটির ক্ষেত্রে ছোট প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের মানসিকতার। নানা অজুহাতে ২১শে ফেব্রুয়ারী, ২৬শে মার্চ, ১৪ই এপ্রিল, ১৫ই অগাস্ট, ১৬ই ডিসেম্বরের মতো দিনগুলোতে অথবা সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে কোন বিশেষ কারণ ছাড়া নিয়মিতভাবে কাজ করানোর সংস্কৃতি ছোট-বড় অনেক প্রতিষ্ঠানের আছে। অথচ এই দিনগুলোতে অফিস বন্ধ রাখলে কোন ক্ষতিই হয় না। কোন কাজে কেউ দ্বিতীয়ার্ধে ছুটি চাইলে বা একটু তাড়াতাড়ি বের হতে চাইলে তার ওপর অদরকারী কাজের বোঝা চাপিয়ে দেয়া, প্রাপ্য পরিমাণের মধ্যেও ছুটি নিলে বেতন কাটা, ছুটিকালীন সময়ে বা অফিসবহির্ভূত ব্যক্তিগত সময়ে ফোন করে কাজ চাপিয়ে দেয়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের আকার নির্বিশেষে এই দেশে বিদ্যমান আছে। ছোট বা বড় যে কোন আকারের প্রতিষ্ঠানে ছুটির ক্ষেত্রে এই প্রকার আচরণের ব্যতিক্রম আছে, তবে তা নগণ্য পরিমাণে।

চরিত্রের দিক দিয়ে আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র আধা ঔপনিবেশিক-সামন্ততান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার। এখানে পুঁজির বিকাশ ঘটেনি, বুর্জোয়াঁ গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটেনি, সামন্ততন্ত্রের অবশেষ এর পরতে পরতে বিদ্যমান। একারণে এখানকার উদ্যোক্তাদের মধ্যে পেশাদারী মনোভাবের অভাব থাকে। এখানকার উদ্যোক্তাদের অনেকেই মূলত লুটেরা মানসিকতার। এই কারণে এখানে একশ’-দেড়শ’ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায় না। যাও বা এক-আধটা পাওয়া যায় সেগুলো পাওয়া যায় ধুঁকতে থাকা অবস্থায়। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় প্রজন্মে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাদের বড় অংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিপুল পরিমাণে ঋণ নেন কিন্তু পরিশোধ করেন না।

যে পেশাদারের সেবা (professional service) উদ্যোক্তারা নিচ্ছেন তিনি যে তার কেনা গোলাম নন্‌ এই বোধটা তাদের খুব কম জনের মধ্যে কাজ করে। এক কালে ব্রিটিশদেরকে কেউ কেউ ‘দোকানদারের জাত’ বলতেন; মননে ‘ব্রিটিশ গোলামদের’ একাংশ তাই বুঝি নিজেদের ভেতর দোকানদারী মানসিকতা ধরে রেখেছেন। কর্মীদের প্রতি নিয়োগকর্তাদের অশ্রদ্ধা এখানে প্রতিষ্ঠানের আকার নির্বিশেষে পরিলক্ষিত হয়। বিশেষত কর্মীদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে নিয়োগকর্তাদের অবজ্ঞাকর মনোভাবের সংস্কৃতির শেকড় এখানে গভীরে প্রোথিত। ফলে বিপুল সংখ্যক কর্মীর কর্মজীবন ও সাধারণ জীবনের মধ্যে সচরাচর সুস্থিতাবস্থা থাকে না। তাদের সংসারে অশান্তি, সম্পর্কে অবনতি, শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্যক্ষয়, হতাশা-আত্মহত্যা প্রবণতা, নৈতিক অবক্ষয়, দক্ষতা হ্রাস পাওয়া — এই সবের পেছনে কর্মজীবন ও সাধারণ জীবনের মধ্যকার অসুস্থিতাবস্থার বিরাট ভূমিকা আছে।

বড় আকারের প্রতিষ্ঠান, যেসব প্রতিষ্ঠানে বিদেশী বিনিয়োগ আছে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান রপ্তানীমুখী সাধারণত সেগুলো ছাড়া বাকিগুলোর অধিকাংশে নারীদের প্রতি মনোভাব, তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, যৌন হয়রানী, অপদস্থ করা, শোষণের যে ঘৃণ্য সংস্কৃতি বিদ্যমান আছে তা বর্ণনা করতে গেলে তা লেভ তলস্তোয়ের রচনাসমগ্রের আকার ছাড়িয়ে যাবে। এদেশের নারীরা যে উন্মাদ না হয়ে গিয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক ভাব বজায় রেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যাচ্ছেন সেটা তাদের অসম্ভব মানসিক শক্তি আছে বলে সম্ভব হচ্ছে।

অত্যন্ত কুণ্ঠার সাথে স্বীকার করতে হচ্ছে যে, খুব অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠানে শারিরীক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন, ভিন্নভাবে সক্ষম, সমকামী, তৃতীয় লিঙ্গ বা জন্মগতভাবে প্রাপ্ত নিরাময়অযোগ্য কোন রোগে আক্রান্ত মানুষের কাজের পরিবেশ বা ব্যবস্থা নেই।

৭. প্রণোদনা ও বিভবের নিয়ামকসমূহ (motivation and hygiene factors):

ফ্রেডেরিক হার্যবার্গের সেই পুরনো প্রণোদনা-বিভব তত্ত্বটি মনে করা যাক। তত্ত্বটি এখনকার ব্যবস্থাপনা তত্ত্ব ও কৌশলের আলোকে সেকেলে হলেও গোড়ার ব্যাপারগুলো বোঝার জন্য এর গুরুত্ব এখনো ফেলনা নয়।

৭.১. প্রণোদনার নিয়ামকসমূহ বা সন্তোষের নিয়ামকসমূহঃ

৭.১.১. অর্জন (Achievement)
৭.১.২. স্বীকৃতি (Recognition)
৭.১.৩. খোদ কাজটি (The work itself)
৭.১.৪. দায়িত্ব (Responsibility)
৭.১.৫. অগ্রসরতা (Advancement)
৭.১.৬. প্রবৃদ্ধি (Growth)
৭.১.৭. সুযোগ (Opportunity)

৭.২. বিভবের নিয়ামকসমূহ বা অসন্তোষের প্রভাবকসমূহঃ

৭.২.১. প্রতিষ্ঠানের নীতি (Company policies)
৭.২.২. তত্ত্বাবধান (Supervision)
৭.২.৩. তত্ত্বাবধায়ক ও সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক (Relationship with supervisor and peers)
৭.২.৪. কাজের পরিবেশ (Work conditions)
৭.২.৫. বেতন (Salary)
৭.২.৬. পদবী ও মর্যাদা (Status)
৭.২.৭. নিরাপত্তা (Security)
৭.২.৮. সুবিধাদি (Benefits)

প্রতিটি বিভাগে নিয়ামক বা প্রভাবকের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। প্রতিষ্ঠানের আকার যাই হোক প্রণোদনা বা বিভবের নিয়ামকসমূহের উপস্থিতি, মান ও মাত্রা পুরোপুরি নির্ভর করে উদ্যোক্তাদের মানসিকতা এবং তাদের সৃষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির ওপর।

বাংলাদেশে ছোট প্রতিষ্ঠানের চাকুরি মূলত ‘স্বল্প বিভব + স্বল্প প্রণোদনা’ গোত্রের এবং বড় প্রতিষ্ঠানে চাকুরি মূলত ‘উচ্চ বিভব + স্বল্প প্রণোদনা’ গোত্রের। উভয় প্রকার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অল্প কিছু আছে যারা ‘স্বল্প বিভব + উচ্চ প্রণোদনা’ গোত্রের। ‘উচ্চ বিভব + উচ্চ প্রণোদনা’ গোত্রের চাকুরির কথা হয় গল্পে শোনা যায়, নয়তো যিনি দাবি করেন তার চশমার পরকলা পাল্টাতে হবে।

৮. সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও রাজনীতিঃ

পয়েন্ট ৩.৩-এ মালিকানা বিবেচনায় চার ধরনের প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছিল। বাংলাদেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও রাজনীতি ঘোরতরভাবে মালিকানার প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে।

৮.১. একক ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানঃ
এখানে মালিক হচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের ঈশ্বরতুল্য। তার কথাই আইন, তার ইচ্ছাই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, তাকে খুশি রাখাটাই রাজনীতি।

৮.২. অংশীদারী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কিন্তু লিমিটেড নয়ঃ
এখানকার অবস্থা বহু দেবতাসম্পন্ন ঐ ধর্মের মতো যেখানে দেবতারা নিজেদের মধ্য অবিরাম দ্বন্দ্বে লিপ্ত। যখন যে দেবতার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় তখন তিনিই সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-রাজনীতির নিয়ামক। তবে “All animals are equal, but some animals are more equal than others”-এর মতো যে অংশীদারের শেয়ারের পরিমাণ বেশি, ক্ষমতার পাল্লা তার দিকে ঝুঁকে থাকে।

৮.৩. প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠানঃ
এর অবস্থা পয়েন্ট ৮.২.-এর মতোই, তবে সাংগঠনিক গঠন একটু বেশি সবল হওয়ায় বেশি শেয়ারের মালিক বেশি ক্ষমতাবান নাও হতে পারেন। এই প্রকার প্রতিষ্ঠানে পরিচালকদের মধ্যে দলাদলি থাকতে পারে। অমন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এই দলগুলোতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দলের বাইরে থাকলে সব পক্ষের বিরাগভাজন হবার এবং বিপদে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

৮.৪. পাবলিক লিমিটেড প্রতিষ্ঠানঃ
প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠানের মতো এই প্রকার প্রতিষ্ঠানেও পরিচালকদের মধ্যে দলাদলি থাকতে পারে এবং কর্মীরা এই দলগুলোতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর বাইরে কর্মীদের মধ্যে নানা প্রকার দল ও গ্রুপ থাকে। এই সকল দলের বা গ্রুপের বাইরে থাকলে সব পক্ষের বিরাগভাজন হবার এবং বিপদে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

বাংলাদেশে গ্রুপ অভ কোম্পানিজ/ইন্ডাস্ট্রিজগুলোতে একই সাথে অনেক প্রকার প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে — যেখানে গঠন ও মালিকানার প্রকৃতি বিভিন্ন প্রকারের হয়। এতে অন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক ও আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। গ্রুপভেদে এই রাজনীতির অবস্থা অনন্য। সুতরাং এখানে টিকে থাকার জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। এখানে প্রতিনিয়ত সবদিক বিবেচনা করে পদক্ষেপ দেয়া ছাড়া উপায় নেই।

৯. তাহলে কী উপায়?

বাংলাদেশে একজনকে প্রথমে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে তিনি বেসরকারি চাকুরি করতে চান কিনা। তারপর জিজ্ঞেস করতে হবে তিনি বাকি জীবন কেবল বেসরকারি চাকুরি করে কাটাতে চান কিনা। যে কোন দেশে বেসরকারি চাকুরি মানে চাকুরিতে অনিশ্চয়তা, সামান্য কারণে বা বিনা কারণে যে কোন সময়ে চাকুরি চলে যাওয়ার আশংকা, কোন কারণে প্রাপ্য আর্থিক বা অন্যান্য সুযোগ না পাওয়ার সম্ভাবনা, অন্তর্বর্তীকালীন বেকারত্ব ইত্যাদি। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ব্যাপারগুলো বেশ প্রকট। যেহেতু একজন বেসরকারি চাকুরিজীবির পদ-পদবী দিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বোঝা সম্ভব নাও যেতে পারে তাই তার সামাজিক অবস্থানটি সবসময় স্পষ্ট হয় না। তিনি ক্ষমতাকাঠামো ও কর্তৃত্বকাঠামোর বাইরের লোক বলে তার সামাজিক মর্যাদা উচ্চ নয়। তাকে কাউকে ঘুষ আর কাউকে চাঁদা দিয়ে চলতে হয়। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে তাকে নিয়মিত আয়কর, মূসক, হোল্ডিং ট্যাক্স, ভূমি কর, কর্পোরেশনের ট্যাক্স ইত্যাদি করাদি পরিশোধ করতে হয় কিন্তু তার অসুস্থতায়, বৃদ্ধাবস্থায়, অক্ষমতায়, দুর্ঘটনায়, বেকারত্বে রাষ্ট্র তার কোন দায়িত্ব নেয় না। তার বর্তমান যেমন অনিশ্চিত, ভবিষ্যতও তেমন অনিশ্চিত। আপাতদৃষ্টিতে আজকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের যে অঙ্ক মোটাসোটা বলে মনে হচ্ছে বছর কুড়ি পরে সেই অঙ্ককে হাওয়াই মিঠাই বলে মনে হবে।

বাংলাদেশে বেসরকারি চাকুরি করলে দুর্নীতি না করেও মোটামুটি স্বচ্ছল জীবনযাপন করা সম্ভব। প্রাচুর্য হয়তো থাকবে না, কিন্তু টিকে থাকা যাবে। অনেকগুলো বাড়ি-ফ্ল্যাট, বিদেশের ব্যাংকে অনেক টাকা হবে না কিন্তু আত্মমর্যাদার সাথে মাথা উঁচু করে থাকা যাবে। বেসরকারি চাকুরিতে সব ইন্ডাস্ট্রি মিলিয়ে খুব অল্প কয়েকজন বিপুল অঙ্কের বেতন পান, অসম্ভব সব সুবিধা পান — তাদের গল্প সারা দেশ করে। সেই গল্প শুনে অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষী বা অযথা হতাশ না হয়ে পেশাদারী মনোভাব নিয়ে কাজ করলে এক সময় ভালো অবস্থানে পৌঁছানো সম্ভব।

নিজে উদ্যোক্তা হবার অভিলাষ থাকলে বেসরকারি চাকুরি করে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করার সুযোগ থাকে। সরকারি চাকুরিতে একজন যত উচ্চপদে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হন না কেন তাকে কখনো পুঁজি যোগাড় করতে হয় না (স্মর্তব্য, বাজেট বরাদ্দ করণ আর পুঁজি যোগানো এক নয়), আর পুঁজি যোগাড় ও গঠন (capital formation) না জানলে উদ্যোক্তা হওয়া যায় না। বেসরকারি চাকুরিতে কেউ একটু উচ্চ পদে কাজ করলে পুঁজি গঠন প্রক্রিয়ায় তাকে অংশগ্রহন করতে হয়। সরকারি কাজ মুনাফাকেন্দ্রিক নয়, পক্ষান্তরে বেসরকারি কাজের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে মুনাফা। মুনাফা অর্জনের প্রক্রিয়াতে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা না থাকলে উদ্যোক্তা হওয়ার পথ কঠিন হয়ে যায়। সরকারি কোন কাজে বা প্রকল্পে একজন কর্মকর্তা ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে কিছু বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হয়তো নেয়া হতে পারে, বেসরকারি চাকুরিতে এমন পরিস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তো নেয়া হবেই সাথে চাকুরিচ্যুতির শিকার হবার সম্ভাবনাও থাকে। অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতার চর্চ্চার দরুন বেসরকারি চাকুরির অভিজ্ঞতা একজন পেশাদারের মধ্যে অধিকতর দক্ষতা তৈরি করে।

মোট কর্মজীবির ৫৬% মানে হচ্ছে ‘অধিকাংশ’। অর্থাৎ, বাংলাদেশের কর্মজীবিদের অধিকাংশ জন বেসরকারি চাকুরিজীবি। তাই ইচ্ছে থাকুক আর না থাকুক, বেসরকারি চাকুরি করাটা এদেশের ‘অধিকাংশ’ মানুষের নির্বন্ধ। এই বিষয়টিকে ভয় না পেয়ে সাহসের সাথে সামলানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।
সঙ্কটের কল্পনাতে হয়ো না ম্রিয়মাণ।
মুক্ত করো ভয়,
আপনা-মাঝে শক্তি ধরো,
নিজেরে করো জয়।

পাঠকের প্রতি বিনীত অনুরোধঃ
লেখাটিতে কোন প্রকার তথ্য বিভ্রান্তি, অস্পষ্টতা, অসম্পূর্ণতা বা ব্যাখ্যার অবকাশ থাকলে তা নির্দ্বিধায় জানানোর অনুরোধ থাকলো। পাঠকের পরামর্শ অনুসারে লেখাটিতে কোন প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন বা সংশোধন আবশ্যক হলে তা অনতিবিলম্বে সম্পাদন করা হবে।


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

এরকম পোস্টের জন্যে "সেরা সন্দেশ" ফিচারটা সচলায়তনে ফিরিয়ে আনা দরকার।

তিথীডোর এর ছবি

গুরু গুরু
মডুদের নিকট পোস্ট প্রিয়তে রাখার অপশনটি ফিরিয়ে আনার দাবি রইল।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

তাহসিন রেজা এর ছবি

নিজে বেসরকারি চাকুরি করি। লেখার অনেকগুলি বিষয়ই মিলে গেল একদম।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

পাণ্ডবদা,
অনেক অনেক ধন্যবাদ তথ্য সমৃদ্ধ এই লেখাটি জন্য। আমার অভ্যেস খারাপ তাই সমালোচনাটা আগে করে নিই তারপর ভালো দিকগুলো বলছি। আর একেবারে বড় মন্তব্য না করে খুবলে খাবলে বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করবো। আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এ জন্য।

চাকুরী নেবার আগে সাতটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। খুবই ভালো উপদেশ। কিন্তু এতোগুলো ফ্যাক্টর যাচাই করা সম্ভব হবে না একজন এমপ্লয়ির জন্য। প্রথমতঃ প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের অনেক তথ্যই অজানা। দ্বিতীয়তঃ একটা খারাপ প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারি হলে কিভাবে আপনার প্রশ্নগুলো এপ্লিকেবল হবে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ (যেমন একটা সৎ ও সাধু গার্মেন্টেসে চাকুরী, যার মালিক অসাধু উপায়ে অন্যান্য ব্যবসা করে থাকেন)। আপনার সাতটি উপদেশ একটা ভেন ডায়াগ্রামে বসিয়ে দেখলাম কি অবস্থা হয়।

নতুন চাকরী খুঁজতে গেলে আমি সাতটির বদলে তিনটা বিষয় সাজেস্ট করি।
১। সাধু ব্যবসা - ব্যবসাটি সৎ উপায় উপার্জন করছে কিনা।

২। মূলনীতি ও কর্ণধার - ব্যবসার মূলনীতিগুলো কর্মচারী বান্ধব কিনা ও কর্ণধার সেটাকে সাপোর্ট দেয় কিনা।

৩। সম্পৃক্ত বিন্দুর তুলনায় প্রার্থীর লক্ষ্য মেলে কিনা - ধরা যাক প্রতিষ্ঠানটি দুইবছরে সম্পৃক্ত বিন্দুতে পৌঁছাবে। আপনার লক্ষ্য যদি হয় প্রতিষ্ঠানটিতে এক থেকে দুই বছর থাকার তাহলে তেমন সমস্যা হবার কথা না। তাছাড়া এস কার্ভটার কোথায় প্রতিষ্ঠানটি আছে সেটা বুঝে রাখা ভালো।

প্রতিষ্ঠান লাভ করছে না ক্ষতি করছে অনেক ক্ষেত্রে এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেমন স্টার্টাপ প্রতিষ্ঠান অনেক বছর ক্ষতির মধ্যে দিয়ে যায়। নেটফ্লিক্স এখনও লাভের মুখ দেখেনি। অ্যমাজন বছর কয়েক আগেও তেমন লাভ করেনি।

অন্যান্য বিষয় বাংলাদেশের প্ররিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ হলেও অনেক ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারে।

হিমু এর ছবি

চাকরিপ্রার্থীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে চাকরিদাতাদের রেটিং করার জন্যে একটা স্বাধীন মাননির্ধারণী প্রতিষ্ঠান কি গড়ে তোলা সম্ভব?

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

সম্ভব। ইতিমধ্যেই গ্লাসডোরের মতো সাইটগুলো আমেরিকাতে এই ভূমিকা রাখছে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

হয়তো সম্ভব, তবে তাতে অন্তত বাংলাদেশে বিশেষ লাভ হবে না। কারণ, বাংলাদেশে ক্রেডিট রেটিং-এর ব্যাপারটা যেমন কেবল নিয়ম রক্ষার ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, বাস্তবতা বিবেচনায় ঋণদাতারা তাতে বিশেষ আস্থা রাখেন না এখানেও তেমনটা ঘটতে পারে। নামী কোম্পানিগুলো নিজেদের র‍্যাংকিং উচ্চ রাখার জন্য অসততার আশ্রয় নিতে পারে; আবার রেটিংকারী প্রতিষ্ঠান এখানকার মার্কেট রিসার্চ প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো আচরণ* করতে পারে।

* এখানে মার্কেট রিসার্চ প্রতিষ্ঠানগুলোতে কয়েকটি সাধারণ আচরণ লক্ষ করা যায়। যথা, (ক) গ্রাহকের মনযোগানো ফলাফল দেয়া (খ) দবিরের জন্য বানানো রিপোর্ট একটু এদিক সেদিক করে সাবিতকে গছানো (গ) হার্ট শেয়ার বা মাইন্ড শেয়ারকে মার্কেট শেয়ার বলে চালানো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মুর্শেদ, পরিশ্রমী মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি আপনার সুবিধা মতো আলোচনা করুন। এটা নিয়ে ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। আমরা আলোচনা করতে পেলেই হলো।

অনলাইন রাইটার্স ফোরামে লেখালেখি করার অনেকগুলো কারণের একটা হচ্ছে পাঠকের সমালোচনা পাওয়া। যে কেউ চাইলে পিঠচাপড়ানো মন্তব্য করতে বা অহেতুক গালি দিতে পারেন। সঠিক সমালোচনা করা একটু কষ্টকর। তাই নির্দ্বিধায় সমালোচনা করুন। ত্রুটিগুলো তুলে ধরুন, পরামর্শ দিন। আখেরে আমাদের সবার লাভ হবে।

চাকুরি নেবার ক্ষেত্রে প্রথমে আমাদের এখানকার পরিস্থিতিটি ব্যাখ্যা করি। এখানে অল্প ব্যতিক্রম ছাড়া বাকি সব চাকুরিপ্রার্থী যে প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছেন তার সম্পর্কে কিছু না জেনেই চলে আসেন। এক-আধজন প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট দেখে আসেন — ঐ অতটুকুই। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে যে ভেতরের খবর কিছুই থাকবে না সেই বিবেচনাটা করেন না। অনেকে গ্রুপের নাম শুনেই চলে আসেন, কিন্তু গ্রুপের ভেতর ঐ প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে কিছু জানার কথা ভাবেন না। এরা ‘শমশের আলীর ভুনা খিচুরী’র দোকান কোথায় সেটা জানার জন্য যতটুকু খোঁজখবর নেন চাকুরিদাতা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে অতটুকু খোঁজ নেন না। বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিগুলো ছোট, এখানে সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রির লোকজনদের সাথে কথা বললে, বাজারে হাঁটলে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। গ্ল্যামারের পর্দা সরিয়ে আসল রূপটা দেখার ব্যাপারে অনেকেই অবগত নন্‌। ফলে অনেকে চাকুরিতে ঢোকার সাত দিন যেতে না যেতে চাকুরি পাল্টানোর জন্য হন্যে হয়ে ওঠেন। এমনটি চাকুরিদাতা ও চাকুরিপ্রার্থী উভয়ের জন্য ক্ষতিকর।

আমি বলেছি, “আগে জানা সম্ভব না হলে চাকুরি পাবার পরে হলেও সেসব জানতে হবে”। চাকুরি পাবার পরে এই কাজটি করার ব্যাপারে অনেকেই অনীহ থাকে। পরে যখন বিপদ ঘটে তখন আফসোস করতে হয়।

খারাপ গ্রুপের ভালো সাবসিডিয়ারির ব্যাপারে আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, মূল উদ্যোক্তা(গণ) যদি অসাধু হন বা গ্রুপের কোথাও অসাধুতার স্বতঃসংস্কৃতি থাকে তাহলে আজ হোক, কাল হোক গোটা গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানে তার ছোঁয়া লাগবেই।

চাকুরি নেবার আগের খোঁজখবরের ব্যাপারে আপনি যে প্রধান তিনটি পয়েন্টের কথা বলেছেন তাতে আমি থার্ড ব্রাকেটে আমার বলা পয়েন্টগুলোর মিলিয়ে সম্ভাব্যতাগুলো আবার যাচাই করি।

১. সাধু ব্যবসা [= উদ্যোক্তাদের পরিচয় + আয়ের উৎস + পণ্যের বিষয়ে (বৈধতা – মান – ভবিষ্যত – স্পষ্টতা)] => এটার অধিকাংশ চাকুরি নেবার আগে খোঁজ নেয়া সম্ভব।

২. মূলনীতি = কর্মীবান্ধব নীতি ও তাতে উদ্যোক্তার(গণের) সমর্থন => এটার ব্যাপারে বাজারে খোঁজ নেয়া যায় — তথ্য পাওয়া যেতে পারে নাও যেতে পারে।
(কৃষণ চন্দর একবার একটা জায়গায় চাকুরির ইন্টারভিউ দেবার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁর শৌচাগারে যাবার প্রয়োজন হলো। শৌচাগারের ভেতরের দেয়ালে দেখা গেলো লেখা আছে, “এই অফিসের সবকিছু ভালো, শুধু নিয়মিত বেতন মেলে না”। শৌচাগার থেকে বের হয়ে কৃষণ চন্দর আর ইন্টারভিউ না দিয়ে সোজা বের হয়ে গেলেন।)

৩. সম্পৃক্ত বিন্দু [=প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ত বিন্দুতে পৌঁছানোর কাল + ক্যারিয়ারের সম্পৃক্ত বিন্দুতে পৌঁছানোর কাল] => প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ত বিন্দুতে পৌঁছানোর কাল অপেক্ষা প্রার্থীর প্রতিষ্ঠানে অবস্থানের লক্ষ্য কাল কম হলে চাকুরিটা নেয়াই যায়, তবে চাইলেই আরেকটা জুতমতো চাকুরি নাও পাওয়া যেতে পারে সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু ঝুঁকির হয়ে যায়। তাছাড়া কোন চাকুরিতে ক্যারিয়ারের সম্পৃক্ত বিন্দুতে পৌঁছানোর কাল দ্রুত কিনা সেটা অবশ্যই আগেভাগে জেনে নিতে হবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আমি চাকুরিপ্রার্থীকে অবশ্যই ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপারে (বেতনের সিলিং - ইন্ডাস্ট্রির আয়ু - ক্যারিয়ার প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা) খোঁজ নিয়ে ক্যারিয়ার নির্বাচনের পরামর্শ দেবো।

স্টার্টআপের মুনাফা নিয়ে আপনি যা বলেছেন আমি কিন্তু সে ব্যাপারে দ্বিমত করিনি। আমি বলেছিলাম, “ব্যবসায় শুরু করার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি কি ব্রেক ইভন পয়েন্ট অতিক্রম করেছে? যদি না করে থাকে তাহলে কবে নাগাদ সেটা করতে পারবে? সেই সময়কালটি কি যৌক্তিক?” — এই যৌক্তিক সময়কালের দৈর্ঘ্য অনেকগুলো নিয়ামকের ওপর নির্ভর করে। সেটা বুঝতে হবে। আরও বুঝতে হবে উদ্যোক্তাদের মুনাফা অর্জনের ব্যাপারে চাড় আছে কিনা। উদ্যোক্তাদের চাড় না থাকলে প্রতিষ্ঠান এস-কার্ভের বাম-অর্ধে থেকেই এক সময় লাল বাতি জ্বালাবে।

নিঃসন্দেহে দেশে দেশে, কালে কালে নানা নিয়ামকের গুরুত্ব নানা রকম। আপনার বলা উত্তর আমেরিকার প্রেক্ষিত থেকে ভিন্ন বলেই তো আমি বাংলাদেশের প্রেক্ষিত থেকে এই লেখা লিখলাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

আপনার এই সুবিশাল পরামর্শ পত্রটি এ দেশের চাকুরী প্রার্থীদের আদৌ কোন কাজে আসবে কি না সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ হয়, কারন তাঁরা এটা পড়ে দেখার কষ্টটুকু স্বীকার করতে প্রস্তুত আছেন বলে আমার অন্তত মনে হয় না। এ দেশে এখন বিডিজবস এবং অনুরূপ আরও দুচারটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে অনলাইনে চাকুরিপ্রার্থীদের একটি চাকুরীর শূন্যপদ সম্পর্কে জ্ঞাতকরন এবং সে উপলক্ষে তাদের নিকট থেকে চাকুরীর দরখাস্ত ও জীবন বৃত্তান্ত গ্রহন করার জন্য। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, একটি সুনির্দিষ্ট জব ডিস্ক্রিপশন সম্বলিত পোষ্টের বিপরীতে এমন শত শত দরখাস্ত জমা হয় যে যারা কোন ভাবেই সেই চাকুরীর প্রাসঙ্গিক নন। যে দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকেরা চাকুরীর বিজ্ঞপ্তিটি পর্যন্ত ভালভাবে পড়ে দেখার এবং সেই অনুযায়ী চাকুরীর দরখাস্ত করার আবশ্যকতা অনুভব করেন না, তাদের কাছে আপনার এই উপদেশ পত্রটির কী মূল্য তা নিয়ে আমি যথেষ্ট শঙ্কাগ্রস্থ! বড় দুঃখে পড়ে কথা কয়টি বললাম, মার্জনা করবেন। যদিও এ কথা অনস্বীকার্য যে, যদি কেউ সত্যি সত্যি এই পরামর্শ গুলো মেনে চলেন, নিঃসন্দেহে তিনি উপকৃতই হবেন।

লেখায় উল্লেখিত একটি বিষয়ের সাথে দ্বিমত পোষন করি, শিক্ষকতার চাকুরী এখন আর হেলাফেলার কোন বিষয় নয়। এ দেশে সিংহভাগ শিক্ষকেরা গ্রাম কিংবা মফস্বল শহরে নিজ বাড়ীতে বসবাস করে শিক্ষকতার চাকুরী করে থাকেন। এখন নূন্যতম যে বেতন তাঁরা পান, তা দিয়ে ঘরের খেয়ে বেশ সচ্ছলতার সাথেই জীবনধারন সম্ভব। সে কারনে গ্রামের হাইস্কুলের একটি শিক্ষকের চাকুরীর জন্য দশ-পনের লাখ টাকা খরচাপাতি করতে কেউ আর কুণ্ঠিত হচ্ছেন না।

তিথীডোর এর ছবি

বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, একটি সুনির্দিষ্ট জব ডিস্ক্রিপশন সম্বলিত পোষ্টের বিপরীতে এমন শত শত দরখাস্ত জমা হয় যে যারা কোন ভাবেই সেই চাকুরীর প্রাসঙ্গিক নন।

হ।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

তিথী, তোমার অভিজ্ঞতাগুলো গরম গরম লিখে রাখো। আমার মতো দুই দশক পার হয়ে গেলে পরে বেশিরভাগ জিনিসই আর মনে থাকবে না। এক বছরের অভিজ্ঞতার নোট একসাথ করলে দেখবে ছাপার যোগ্য জিনিস দাঁড়িয়ে গেছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আবদুল্লাহ্‌ ভাই, এই লেখাটির পরিকল্পনা যখন মাথায় আসে তখন থেকেই জানি ভবিষ্যতে কখনো লেখাটি সমাপ্ত ও প্রকাশিত হলে খুব নগণ্যসংখ্যক পাঠক এটি পড়বেন। একই কথা আমার অন্য আরও দশটি লেখার জন্যও প্রযোজ্য। আমার দায়িত্ব লেখার, তাই লিখে যাই। সচল পাঠক হিসাবে আপনাদের মতো কেউ কেউ লেখা পড়ে সুচিন্তিত মন্তব্য রেখে যান – সেটা আপনাদের দায়িত্ববোধ সঞ্জাত। আমি আসলে আমার উপলদ্ধিগুলো লিখেছি, কাউকে উপদেশ বা পরামর্শ দেবার অভিপ্রায়ে নয়।

আমার কর্মজীবনে এই পর্যন্ত কয়েক হাজার চাকুরিপ্রার্থীর সাক্ষাতকার নেবার সুযোগ হয়েছে। সেই সুবাদে আমি জানি, এদেশের চাকুরিপ্রার্থীদের মধ্যে এক অযুতাংশও এই লেখাটি পুরো পড়তে রাজী হবেন না। তারা চাকুরির বিজ্ঞাপনটি ঠিকভাবে পড়তে, বিজ্ঞাপনের নির্দেশ অনুযায়ী যথাযথভাবে আবেদন করতে, চাকুরিদাতা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে, সাক্ষাত/পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে আগ্রহী নন্‌। তাদের বেশিরভাগ জনকে কাজ সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন করলে যেমন উত্তর পাওয়া যায় না, তার পড়াশোনা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশ্ন করলেও উত্তর পাওয়া যায় না। তাদের সোজা কথা — আমি যোগ্য লোক, আমাকে চাকুরি দিয়ে দেখেন, কাজ করে প্রমাণ করে দেবো। তারা এটা বুঝতে চান না এই একই দাবি বাকি চাকুরিপ্রার্থীদেরও বটে। তাদের কথা মানলে তাহলে নির্বাচক কীসের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন করবেন?

কীভাবে সিভি বানাতে হয়, কীভাবে দরখাস্ত লিখতে হয়, আবেদনের প্রক্রিয়া কীভাবে অনুসরণ করতে হয়ে, কীভাবে সাক্ষাতকার দিতে হয়, কী পোশাক পরতে হয়, কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় ইত্যাদি বিষয়ে কোটি কোটি লেখা, ভিডিও আছে। কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আছে। এরপরেও কতজন সেসব মোটামুটি ঠিকঠাক অনুসরণ করেন? ৫% জনও করেন বলে মনে হয় না। মার্গারেট থ্যাচার নাকি একবার এমন বলেছিলেন যে, ব্রিটিশ ছেলেমেয়েরা চাকুরি পায় না কারণ তারা চাকুরি পাবার উপযুক্ত না। ম্যাগি কথাটি বলে থাকুন বা না থাকুন এদেশে চাকুরিপ্রার্থীদের অধিকাংশের সাক্ষাতকার নিতে বা পরীক্ষার খাতা দেখতে গিয়ে কথাটির সত্যতা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। বিষয়গুলো এমন কেন সেটি নিয়ে আমার ভিন্ন ভাবনা আছে। তদানুসারে আমি দোষের অধিকাংশ চাকুরিপ্রার্থীদের ঘাড়ে চাপাতে পারি না।

শিক্ষকদের বেতন প্রসঙ্গে। আমার জানা মতে, সর্বশেষ বেতন স্কেল অনুযায়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের বেতন ১০ম গ্রেডে অর্থাৎ মাসে সর্বমোট সর্বোচ্চ ৩৮,৬৪০ টাকা এবং জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষকের বেতন ৯ম গ্রেডে অর্থাৎ মাসে সর্বমোট সর্বোচ্চ ৫৩,০৬০ টাকা। ১০ম গ্রেডের বেতনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে বেশিরভাগ জনের চাকুরির আয়ু ফুরিয়ে আসে। ঐ শিক্ষকের সমান শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্মাভিজ্ঞতা থাকলে বাংলাদেশে এমন অনেক ইন্ডাস্ট্রি আছে যেখানে এর কয়েকগুণ বেতন পাওয়া যায়। তাহলে ঐ পদে চাকুরির জন্য এতো বিপুল অঙ্কের ঘুষের লেনদেন হয় কীভাবে? কারণ, একজন মানুষের বেতন আর আয় এক কথা নয়। একজন শিক্ষকের বেতন কম হতে পারে কিন্তু তার আয় কম নাও হতে পারে। কীভাবে একজন শিক্ষকের আয় তার বেতনের কয়েকগুণ হতে পারে সেটি আমরা জানি, তাই না!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা এর ছবি

প্রচুর পরিশ্রমে নানা দিক বিবেচনায় এনে চমৎকার ভাবে গুছিয়ে লেখা একটি দলিল - পথনির্দেশিকা। মুস্কিলটা এই যে, প্রবল জনসংখ্যার দেশে, যেখানে সাধারণ অবস্থাটা হচ্ছে - যে কোন একটা কিছু ত আগে পাই, সেখানে এই দলিলে উল্লিখিত সতর্কতাগুলি এমনকি পড়ে দেখার মত মন-মানসিকতা হয়ত অনেকের-ই থাকবে না। আর পড়ার পরেও, সেই অনুসারে এগোনোর মত সময়-সু্যোগ - সেটাও অনেক চাকুরীপ্রার্থীর জন্য প্রায় অসম্ভব আশা। তবু, কিছু সংখ্যক চাকুরীপ্রার্থীও যদি এই লেখা পড়ে নিজের লড়াইটাকে একটা সুসংহত ছকে নিয়ে আসতে পারেন তবে সেই মানুষগুলি তাঁদের সময়ে সামগ্রিক অবস্থাটি আরও আশাব্যঞ্জক দিকে উত্তরণের জন্য সহায়ক হয়ে উঠবেন। অন্ততঃ, সেরকম-ই আশা করতে ইচ্ছে হয়।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কয়েক কোটি মানুষের কয়েক শতাব্দীর নিরলস পরিশ্রমে এক একটা ভূমিতে রেনেসাঁ ঘটে। প্রচেষ্টার এই প্রক্রিয়াতে বেশিরভাগ জনের শ্রম কোন ফল বয়ে আনে না। শ্রীমদ্ভগবতগীতাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ফল লাভের আশা না করে কর্ম করার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন এখানে তাই করে যেতে হবে। তাহলে হয়তো কয়েক শতাব্দী পরে এই ভূমিতে রেনেসাঁ হবে।

পুনশ্চঃ চাকুরি গাছের ফল না যে ঢিল ছুঁড়ে যেতে থাকি এক সময় একটা না একটা পড়বেই। ঝড়ে পড়ে যেসব চাকুরি মেলে সেগুলো কখনো যোগ্যতানুগ হয় না। দারিদ্র্য, অধিক জনসংখ্যা, উচ্চ বেকারত্বের হার, স্বল্প কর্মখালি ইত্যাদি বিবেচনা করলেও ব্যক্তিগত অযোগ্যতার অজুহাত হয় না। লোকে হাহুতাশ করে, পরচর্চ্চা করে বা স্রেফ আলসেমি করে যে পরিমাণ সময় নষ্ট করে তার এক ভগ্নাংশ ব্যয় করলে এসব অযোগ্যতা দূর করা যায়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মন্তব্যের বদলে আলাদা পোস্টই ভাল হয়েছে! চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এই বিপুল আয়তনের পোস্ট যাদের উদ্দেশ্যে দেয়া তাদের কত শতাংশ পড়বে জানি না, কিন্তু যাদের অন্তত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা আছে এবং কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করার অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাদের জন্য অতি চমৎকার একটি গাইডলাইন। আমি যদিও পুরানপাপী, তবু পোস্ট পড়ে মনে হলো পঁচিশ বছর পেছনে গিয়ে ক্যারিয়ার জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করি। আমাদের সময় প্রাইভেট চাকরীতে সেই ঢুকতো যার অন্য কোন গতি ছিল না।

আমার মনে পড়ে নিদারুণ কম বেতনের অংক নিয়ে প্রথম চাকরী পাবার পর আত্মীয় প্রতিবেশী সবাই কী করুণাময় উপদেশ বর্ষণ করেছিল আরেকবার চেষ্টা করে বিসিএস ভাইবা কেন উৎরে যাবার চেষ্টা দিলাম না। যদিও আমি প্রাইভেটে গিয়েও সমসাময়িক সরকারী চাকরী পাওয়া বন্ধুদের চেয়েও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, আমাকে নিয়ে আমি সন্তুষ্টই ছিলাম, তবু প্রতিবেশী এক মুরব্বী মুখ ফুটে বলেই দিয়েছিল, আহা দিনরাত কত কষ্ট তোমার, অমুককে বলে তমুক সরকারি অফিসে একটা কেরানির চাকরীও জোটাতে পারলে কত আলগা ইনকাম হতো। আমি যে আলগা ইনকামে বিশ্বাসী নই সেটা মুরব্বী বিশ্বাসই করতে চাইল না। তো, এই দেশে একসময় অমন লোকেরাই ছিল ক্যারিয়ার কাউনসিলর। যার ফলে দেশে কম বেতনের সরকারী চাকরীর জন্যও লাখ লাখ টাকা বাজেট করা হয়।

দেশে বেসরকারী চাকরীর বাজার গত দশ বছরে যেভাবে বেড়েছে তাতে এমন একটি ক্যারিয়ার পরামর্শক পোস্ট খুব প্রয়োজনীয় ছিল। আমি যদি কখনো ওই কাজে নামি, মানে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং করি, তাহলে আপনার এই পোস্টটা বগলদাবা করবো নিশ্চিতভাবে। আবার এটাও মানি যে যাদের জন্য লেখা এই কথা, তারা হয়তো ঠিক মনোযোগ দিয়ে শুনবে না। উপরে আবদুল্লাহ ভাইও সেটা বলেছেন।

চাকরীর বাজার খুব কঠিন এটা সত্যি। আবার চাকুরীদাতারাও বলেন সঠিক পদের জন্য প্রার্থী পাওয়াও কঠিন। আমি নিজে কয়েকবার ইন্টারভিউ বোর্ডে বসে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি যে অধিকাংশ প্রার্থী কিছু না জেনে, না বুঝে মরিয়া হয়ে চাকরীর দরখাস্ত লেখে এবং ইন্টারভিউ বোর্ডে হাজির হয়। কয়েকবারের অভিজ্ঞতায় ইন্টারভিউতে লিখিত পরীক্ষার কিছু সহজ প্রশ্নের উত্তরে প্রার্থীরা যা লিখেছে দেখে আমি নিজেই লজ্জিত বোধ করেছি।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রথম দুই অনুচ্ছেদের জন্য আপনাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে বস্‌! এখনকার কথা জানি না, আমাদের সময়ে যে বেসরকারি চাকুরিতে ঢুকতো তার মানে দাঁড়াতো সে - ১। বিদেশে পড়তে যেতে পারেনি ২। সারকারি চাকুরি পায়নি ৩। ব্যবসা করার টাকা নেই।

তারপর দেশে মোবাইল ফোন অপারেটর আর নতুন নতুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এসে চাকুরির বাজার তছনছ করে দিলো। এই দুই সেক্টরে ঢোকার জন্য লাইন পড়ে গেল। যারা এই দুই লাইনে গেলো না তারা হচ্ছে - আগের তিন পয়েন্ট + মোবাইল কোম্পানি/ব্যাংকে চাকুরি পায়নি। এরপর মোবাইল ফোন কোম্পানির বাবল্‌ ফাটলো। বাজার ভরে গেলো ঊচ্চ বেতন-ভাতা পাওয়া, ঊঁচু পদে কাজ করা বেকার ম্যানেজারে। এদের অনেকে নানা চক্‌মকে স্টার্ট-আপ নিয়ে আসলো যেগুলোর খুব কমই ব্রেক ইভেন পার করতে পারলো। যারা ব্যাংকে ঢুকেছিল তাদের বেশিরভাগ এখনো সম্মানের সাথে টিকে আছে। তবে ব্যাংকের বাবল্‌ যে ফাটতে যাচ্ছে সেকথা সবাই জানেন। এখনই যে চরম অবস্থা তাতে আগামী দিনের কথা ভাবলে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

দেশে বেসরকারি চাকুরির বাজার খারাপ। কারণ, নতুন উদ্যোগের পরিমাণ খুব কম, পুরনো উদ্যোগে এক্সপানশন আরও কম। মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে টাকা এসেছে অসম্ভব পরিমাণে। কিন্তু সেই টাকা ব্যবসা-শিল্পে বিনিয়োগ হয়নি। ১/১১ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা অনুযায়ী এখন লোকে দেশে বিনিয়োগের চেয়ে দেশের বাইরে টাকা পাঠিয়ে দিতে বেশি আগ্রহী। সেই তথ্যও কিছু দিন পর পর খবরে আসে। সরকারি কাজের পরিমাণ বেড়েছে, তবে তার বেশিরভাগ হচ্ছে সরবরাহের কাজ। সেখানে স্থানীয়ভাবে নিয়োগের পরিমাণ কম। নির্মাণজাতীয় কাজে সেনাবাহিনীকে পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে, ফলে বেসরকারি নিয়োগ হচ্ছে না। বেসরকারি খাতে এন্ট্রি লেভেলে চাকুরি থাকলেও মিড আর আপার লেভেল স্যাচুরেটেড অবস্থায় আছে। এই পর্যায়ে কেউ বেকার হলে তার কপালে অসীম দুর্ভোগ আছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হিমু এর ছবি

রাজশেখর বসুর এক প্রবন্ধ-সংকলন পড়া শুরু করেছি, "লঘুগুরু" নাম। ভদ্র জীবিকা শিরোনামে একটি প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে আপনার এই লেখাটার কথা মনে হলো। আশি বছর আগে প্রকাশিত বইয়ের প্রবন্ধ যদি আজও প্রাসঙ্গিক ও প্রযোজ্য মনে হয়, সেটা কি বসুসাহেবের কালোত্তীর্ণ বিচক্ষণতার প্রমাণ, নাকি আমাদের দশকের পর দশক ধরে চলমান বেয়াক্কেলপনার স্মারক, সেটাই ভাবছি।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পরাধীন ভারতে জন্মানো ও বেড়ে ওঠার ফলে শ্রীযুক্ত বসু মহাশয়ের পক্ষে দুই দফা স্বাধীনতা লাভ করা দেশের চাকুরির বাজার, চাকুরিপ্রার্থীদের অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব হবার কথা না। তিনি যা বলেছেন তা যদি আজও প্রাসঙ্গিক ও প্রযোজ্য বলে মনে হয় তাহলে বুঝতে হবে আমরা যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই আছি। চাকুরির ক্ষেত্রে 'উমেদারি করা' শব্দটা আজ আর ব্যবহৃত হয় না, কিন্তু উমেদারি করা আজও প্রবলভাবে বিদ্যমান।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।