গল্প প্রচেষ্টা-২৬

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৩/১০/২০১৯ - ১:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মিষ্টিমুখ

বিশাল এই ঘরটাতে খুব কম সময়ে উজ্জ্বল আলো জ্বালানো হয়, বাকি সময় কেমন একটা আবছা আলো-আঁধারী তৈরি করে রাখা হয়। কক্ষটাতে মূলত ছয়টা বিশেষায়িত বিছানা – যেগুলোর তিন দিকে নানা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, মাথার কাছে নানা রকমের মনিটর। দেয়াল আর ছাদজুড়ে নানা রকমের পাইপ, তার; মেঝেতে নানা রকমের নিকাশের ব্যবস্থা। ছয়টা বিছানার তিনটা খালি। কেবল ১, ৩ আর ৪ নাম্বার দখল করে তিনজন শুয়ে আছে। তাদের মুখে নিঃশ্বাস নেবার মুখোশ, গলায় আর হাতে ডজন খানেক সূঁচ ফুটিয়ে শরীরে কখনো রক্ত, কখনো শর্করা, কখনো অ্যান্টিবায়োটিক, কখনো হেপারিন দেয়া চলছে। কখনো আবার মাংশপেশীতে সূঁচ ফুটিয়ে ইনস্যুলিন দেয়া হচ্ছে। তাদের বাহুতে রক্তচাপ মাপার, বুকে পিঠে হৃদযন্ত্রের অবস্থা পরিমাপ করার, আঙুলে হৃদকম্প আর ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ পরিমাপ করার ব্যবস্থা লাগানো। ক্ষতস্থানগুলোতে নিকাশী নল আর মূত্রনালীতে ক্যাথেটার লাগানো। মাথার দিকে বিছানা তুলে আধশোয়া করে সম্পূর্ণ নগ্ন শরীরের ওপরে নীল রঙের মোটা চাদর দিয়ে লজ্জা নিবারণ করা হয়েছে।

ঘরের এক কোনে কাচ দিয়ে ঘিরে অবেদনবিদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে চেয়ার-টেবিল থাকলেও দায়িত্বরত অবেদনবিদ মূলত সেখানে পাতা বিছানায় শুয়ে থাকেন। নূন্যতম বারো ঘন্টার ডিউটি প্রায়ই চব্বিশ বা ছত্রিশ ঘন্টায় পরিণত হয় বলে বেশিরভাগ সময় অবেদনবিদের শুয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। অবশ্য নির্ধারিত সময় পর পর অথবা জরুরী প্রয়োজনে তাঁর কর্মতৎপরতা প্রশংসনীয়। একই কথা দায়িত্বরত তিনজন সেবিকার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শ্রেণীবদ্ধ কাজ অথবা জরুরী সময়গুলোর বাইরে দীর্ঘসময়ের ডিউটির একঘেঁয়েমি কাটাতে তারা বসে বসে গল্প করেন। কখনো সুযোগ হলে একজন ঘরের আরেক কোনের পর্দাঘেরা বিছানায় বিশ্রাম নেন।

শয্যাশায়ী তিনজনের ১-নং সারাদিন নির্জীব হয়ে পড়ে থাকেন, বেশিরভাগ সময়ে চোখ নির্মিলীত। ৩-নং একটু পর পর খাবার চান, জল চান, নেমে শৌচাগারে যেতে চান; কিন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণের বাইরে খাবার বা জল দেয়া হয় না, শৌচাগারে যাবার কোন উপায় নেই। খাবার নিয়ে অভিযোগ ৪-নং-এরও, সাথে কেবলই গরম লাগার অভিযোগ। হঠাৎ হঠাৎ তীব্র, অসহনীয় যন্ত্রণায় কেউ চিৎকার করে ওঠেন। কারো হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। কেউ হাঁসফাঁস করেও ফুসফুস ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারেন না। সেবিকাদের ছোটাছুটি লেগে যায়। বৈকালিক সাক্ষাতের অত্যাল্প সময়ে পরিবারের সদস্যরা ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে আসেন। তারা শুধু বার বার একটা কথা বলেন – তুমি ভালো আছো তো? ঠিক আছো তো? উত্তরে তারা প্রায় কিছুই বলেন না। সেবিকারা অতিথিদের তাড়া দিয়ে বিদায় করে দেন।

শয্যাশায়ীরা চুপ করলে বা ঘুমিয়ে পড়লে সেবিকারা নিচু কণ্ঠে গল্প করেন। সেসব টুকরো টুকরো গল্প থেকে তাদের জীবনের গল্পগুলোও স্পষ্ট হয়। তাদের সবাই কর্মোপলক্ষে দূরের গ্রাম থেকে এই মহানগরে এসেছেন। গ্রামের জন্য প্রতিনিয়ত তাদের মন পোড়ে কিন্তু সেখানকার ভাতের অভাব তাদেরকে আর ফিরে যেতে দেয় না। তাদের অপুষ্টিকাতর শরীর, দীর্ঘ ডিউটিতে বসে যাওয়া চোখ, শুষ্ক ত্বক, মলিন জুতো দেখে বোঝা যায় এখানে ভাতের অভাব হয়তো অমন করে নেই তবে আরও দশটা অভাব ঠিকই আছে। রেললাইনের ধারের কাঁচাবাজার – যেখানে মূলত ফেলে দেবার মতো সবজী, মশলা, মাছ আর ফল বিকোয় সেখান থেকে কে, কবে সস্তায় ভালো জিনিস কিনতে পেরেছে তাদের আলাপে সে কথা ঘুরে ফিরে আসে। কখনো কুড়ি টাকায় সাতটা পুরবিহীন পুরি, ষোল টাকায় দুইশ পঞ্চাশ মিলিলিটারের কোমল পানীয় অথবা পনের টাকায় তিনটা আমড়া কিনে সবাই মিলে খাওয়া হয়। বাড়তি আয়ের আশায় কে অন্য কোথাও বাড়তি কাজ নিচ্ছে, কে চাকুরি পাল্টানোর কথা ভাবছে, কার বাচ্চা কতো বড় হলো, কার এখনো বিয়ে হচ্ছে না কেন ইত্যাকার গল্পও বার বার ফিরে আসে। তিন বিছানায় শুয়ে থাকাদের আস্তে আস্তে সেবিকাদের নামের সাথে সাথে তাদের জীবনের গল্পও মুখস্থ হয়ে যায়।

রাত বাড়লে আলো আরও কমে আসে। অবেদনবিদ তার বিছানার আলো নিভিয়ে দেন। একজন সেবিকা আরেক কোনের বিছানায় ঘুমাতে যান। বাকি দুজনের একজন পায়ে মেহেদী লাগাতে বসেন আর অন্য জন খুব নিচু কণ্ঠে ফোনে কারও সাথে গল্প করতে থাকেন। শয্যাশায়ীদের মধ্য যিনি ভাগ্যবান তিনি নিঃসাড়ে ঘুমান। যার ভাগ্য প্রসন্ন নয় তিনি নানা প্রকার শারিরীক কষ্টের মধ্যে ঘুম-জাগরণের এক দোলাচলে থাকেন।

ভোর ছয়টায় সেবিকাদের প্রাতঃকালীন তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। এখন শয্যাশায়ীদের ঘুম থেকে তুলে দাঁত ব্রাশ করানো হবে, মুখ মোছানো হবে, রক্তের শর্করা মাপা হবে, তারপর প্রাতঃরাশ করানো হবে। ১-নং শয্যাশায়ীর রক্তের শর্করা মেপে দায়িত্বরত সেবিকা আঁতকে ওঠেন। রক্তের শর্করা প্রতি ডেসিলিটারে দুই মিলিমোলের নিচে নেমে গেছে। এমন অবস্থায় শর্করাহীনতার জন্য প্রাণসংশয় হতে পারে। একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় পড়ে সেবিকা তাকে জিজ্ঞেস করেন – আপনার কাছে কি চিনি হবে? এমন প্রশ্নে শয্যাশায়ী জন কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেলেন। যার গায়ে পোশাকটা পর্যন্ত নেই তার কাছে চিনি থাকবে কী করে! প্রশ্নটা যে বোকার মতো হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পেরে সেবিকা হন্তদন্ত হয়ে কক্ষের বাইরে ছুটে যান। কয়েক মিনিট পরে কোথা থেকে যেন দুই চামচ পরিমাণ চিনি জোগাড় করে নিয়ে আসেন। আধা গ্লাস জলে চিনি গুলিয়ে শয্যাশায়ী জনের ঠোঁটের কাছে ধরেন।

মধুমেহের রোগী হবার পর থেকে এমন চিনিজল বা শরবত পানের সুযোগ হয়নি। তাই প্রথম চুমুকটা জীভে একটা বিচিত্র অনুভূতি আনে। কক্ষের দেয়াল শব্দ নিবারক হলেও এমন সময় খুব হালকাভাবে মাইকে বাইরের একটা ঘোষণা শোনা যায় —

সম্মানিত এলাকাবাসী! সম্মানিত এলাকাবাসী!!
রসুলবাগিচা জামে মসজিদে ঈদুল আযহার জামা’ত সকাল সাতটায় অনুষ্ঠিত হবে!
আপনারা সবাই অবিলম্বে নামাজের জামা’তে শামিল হন!

জীভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে চাটতে শয্যাশায়ী জন ভাবেন, আহা! আজ তাহলে ঈদ! প্রতি বছর ঈদুল আযহার ভোরে আগের রাতে বানানো মিষ্টান্ন মুখে দিয়ে দিন শুরু হতো। আজও মিষ্টি মুখে দিয়েই দিন শুরু হলো – তা যেভাবেই হোক। মাইকের শব্দ আবারো ভেসে আসে —

আল্লাহু আকবার! আল্লাহু আকবার!
লাইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হাম্‌দ!

(অনিবার্য কারণবশত এই গল্পের লেখক পাঠকদের মন্তব্যের উত্তর দিতে অক্ষম। এই প্রকার ধৃষ্টতার জন্য লেখক সবার নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করে সবাইকে মন্তব্য করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছেন। ভুল বানান আর বাক্যের ভুলের জন্যও ক্ষমাপ্রার্থী।)


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ
মাধ্বীর্নঃ সন্তোষধীঃ।
মধু নক্তম্‌ উতোষসো মধুমৎ পার্থিবং রজঃ
মধুমান্নো বনস্পতির্মধুমাং অস্তু সূর্যঃ।
বায়ু মধু বহন করছে, নদীসিন্ধুসকল মধু ক্ষরণ করছে। ওষধি বনস্পতিসকল মধুময় হোক, রাত্রি মধু হোক, উষা মধু হোক, পৃথিবীর ধূলি মধুমৎ হোক, সূর্য মধুমান হোক। (রবীন্দ্রকৃত অনুবাদ)

তোমার আগের গল্প-প্রচেষ্টা পড়ে বলেছিলাম - মধু, মধু, মধু।
এবারেও মধু-র মধুর স্বাদ পাওয়া হল।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

এক লহমা এর ছবি

সচলে তোমার লেখা দেখার সাথে সাথে মনটা খুশী হয়ে উঠল। 
নিজেকে নিয়ে লেখা শ্লেষাত্মক বা অতিনাটকীয়  কোনটাই না করে নিটোল সরস গল্প করে তোলার মত কঠিন কাজ করেছো। 
আবার এই লেখা পড়ে তোমার দুই খণ্ডে এর আগের গল্প প্রচেষ্টাটাও আবার পড়ে এলাম - আমি আজও ওটাতে মজে আছি। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

গল্প কিংবা গল্প প্রচেষ্টা বিষয়ে বলার তেমন কিছু নেই, আসলে এ বিষয়ে বলার মত তেমন যোগ্যতাই আমার নেই। শুধু তিনজন নার্স, একজন অ্যাাপ্রেন্টিস(?) আর তিনজন শয্যাশায়ীর জন্য এক ধরনের বিষাদে ভরে উঠলো মনটা।

সচলে আপনার লেখা এল প্রায় দীর্ঘ সাত মাস পরে, ভাল আছেন তো? আর যে অনিবার্য কারনটি আমাদের সাথে আপনার মিথষ্ক্রিয়ার পথটি রুদ্ধ করে দিয়েছে, তার আশু অবসান কামনা করছি।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ভালো লাগল

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।