১৯৯৩ সালে ঢাকায় ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অভ স্টুডেন্টস (আইইউএস) -এর দক্ষিণ এশীয় অংশ ‘মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা’ বিষয়ক একটা সেমিনার আয়োজন করে। তিন দিনের এই অনুষ্ঠানে ভারত থেকে অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এআইএসএফ), অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট ব্লক (এআইএসবি) আর স্টুডেন্টস ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া (এসএফআই); পাকিস্তান থেকে সিন্ধ ত্বরকি পসন্দ স্টুডেন্ট ফেডারেশন, নেপাল থেকে অল নেপাল ন্যাশনাল ফ্রি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন আর বার্মা থেকে আরাকানী ছাত্রদের একটা গ্রুপের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ থেকে ছয়টি ছাত্র সংগঠন এতে অংশ নিয়েছিল — বাংলাদেশ ছাত্র লীগ, বাংলাদেশ ছাত্র লীগ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ও বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী। তৃতীয় দিনের সমাপনী অনুষ্ঠানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। ঐ অনুষ্ঠানে সিন্ধ ত্বরকি’র নেতা (নাম সম্ভবত আসিফ) তাঁর আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের শুরুতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত সকল অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার অভিজ্ঞতায় সেটি হচ্ছে প্রথম কোন পাকিস্তানীর কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত সকল অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার কথা শোনা। এর আগেও হয়তো কোন কোন পাকিস্তানী তাঁদের কথায় বা লেখায় এই ব্যাপারে ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকতে পারেন। এর পরেও হয়তো কোন পাকিস্তানী ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকতে পারেন। লক্ষণীয়, এই ক্ষমা প্রার্থনাগুলোর সবই ব্যক্তি পর্যায়ে। কোন প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পাকিস্তান আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও তার জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে বলে আমার জানা নেই। এই ব্যাপারে কারো কোন তথ্য জানা থাকলে সেটা জানানোর জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
২০০২ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফরে এসে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল পারভেজ মুশাররাফ জাতীয় স্মৃতিসৌধের মন্তব্যের খাতায় লিখেছিলেন, “আপনাদের পাকিস্তানী ভাই ও বোনেরা একাত্তরের ঘটনাবলীর জন্য আপনাদের বেদনার সাথে একাত্মতা বোধ করে। সেই দুর্ভাগ্যজনক সময়ে যে মাত্রাতিরিক্ত ঘটনা ঘটে, তা দুঃখজনক”। ঐ সফরে রাষ্ট্রীয় ভোজসভার ভাষণে তিনি বলেন, “এই ট্র্যাজেডি, যা আমাদের দুই দেশের ওপর ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে, তার জন্য আমরা দুঃখিত”। লক্ষণীয়, জেনারেল পারভেজ মুশাররাফ এখানে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশের ওপর চালানো জেনোসাইড ও অন্যান্য অপরাধের দায় যেমন স্বীকার করেননি, তেমন সেসবের জন্য ক্ষমা প্রার্থনাও করেননি।
২০১১ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচের প্রাক্কালে জিও টিভিতে পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার ইমরান খান নিয়াজী বলেন যে - ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের বর্বরতার জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানীদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। অগাস্ট ২০১৮ থেকে এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকা কালে তিনি নিজেই এই উচিত কাজটি করেননি। উল্টো ঐ ২০১১ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা বই ‘পাকিস্তান: আ পারসোনাল হিস্ট্রি’তে তিনি লিখেছেন, “পশ্চিম পাকিস্তান একের পর এক ভুল করেছে যা পরবর্তীতে ভারতকে পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগাতে দেয়। তখন নেহেরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে থাকা ভারত বাঙালি বিদ্রোহের সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে”। (Khan, Imran; Pakistan: A Personal History; Bantam Press; 2011; London, UK)
পাকিস্তানীরা মুখে যা কিছুই বলে থাকুন বা্স্তবে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানীদের চালানো জেনোসাইড ও অন্যান্য অপরাধ, শহীদের সংখ্যা, ধর্ষণের সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে কী অবস্থান নেয় সেটা ২০১৩ সাল ও তৎপরবর্তীতে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্তদের সাজার ব্যাপারে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে বিবৃতি প্রদান, সংসদে নিন্দাপ্রস্তাব গ্রহন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রমাণিত। ২০১৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের নেতা শের আকবর খানের আনা ঐ প্রস্তাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ নেতা মাখদুম জাভেদ হাশমী, আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রধান শেখ রাশেদ আহমেদ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কায়দ) নেতা রাজা হায়াত হিরাজ, জমিয়ত-ই-উলামা-ইসলাম-ফযলের নেতা মৌলানা আমির জামান সমর্থন জানান। মুত্তাহিদা কওমী মুভমেন্ট, আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেনি। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যান ইমরান খান বলেন, “বাংলাদেশ জামায়াত-ই-ইসলামী নেতা আবদুল কাদের মোল্লা নির্দোষ এবং তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা”। (“Resolution passed: Abdul Quader Molla was innocent, Imran Khan claims”; The Express Tribune; 16 December 2013; Karachi 75500, Pakistan)
ইমরান খানের দ্বিচারিতা নিয়ে অবাক হবার কিছু নেই। বস্তুত ১৯৭১ প্রসঙ্গে পাকিস্তান ও তার জনগণ কী মনোভাব পোষণ করে সেটি মোটামুটি স্থির। তার একটি লিখিত ভাষ্য পাওয়া যায় পাকিস্তানের স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে। পাঞ্জাব কারিকুলাম এন্ড টেক্সটবুক বোর্ড, লাহোর কর্তৃক প্রকাশিত (প্রকাশকালঃ অগাস্ট, ২০২১) ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণীতে পাঠ্য ‘পাকিস্তান স্টাডিজ’ (مطالعہ پاکستان) বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে। ঐ অধ্যায়টির শিরোনামঃ ‘পাকিস্তান আন্দোলন এবং পাকিস্তানের অভ্যুদয়’ (تحریک پاکستان اور پاکستان کا قیام)। এই অধ্যায়ের যেসব উপ-অধ্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে এই লেখায় সেগুলো আলোচিত হবে।
(খ)
‘পাকিস্তান আন্দোলন এবং পাকিস্তানের অভ্যুদয়’ অধ্যায়টির তৃতীয় উপ-অধ্যায়ের শিরোনামঃ ‘১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন’ (ء کے عام انتخابات1970) । এখানে বলা হয়েছে,
“নির্বাচনের ফলাফলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমলাগণ এই ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন, কারণ আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী মেনিফেস্টোর ভিত্তিতে জয়লাভ করেছে তা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে অগ্রহনযোগ্য ছিল। এই কারণে নতুন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর বিলম্বিত হচ্ছিল, এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে উদ্বেগের ঢেউ ওঠে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা করেন কিন্তু তাতে সফলতা আসে না। এরপর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ভারতপন্থী সংগঠন মুক্তি বাহিনীর সহযোগিতায় বাঙালীরা স্বাধীন রাষ্ট্রের শ্লোগান ধরে। বিদ্রোহ দমন করতে পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা শুরু হয়”।
আটটি বাক্য দিয়ে গঠিত এই অনুচ্ছেদটির পাঁচটি বাক্য সবৈর্ব মিথ্যা।
১. “পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমলাগণ এই ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন, কারণ আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী মেনিফেস্টোর ভিত্তিতে জয়লাভ করেছে তা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে অগ্রহনযোগ্য ছিল।“ — এই প্রকার দাবির ভিত্তি কী? কোন গবেষণা বা পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এই উপসংহার টানা হয়েছে? বাস্তবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোর ব্যাপারে ওয়ালী খানের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, এয়ার মার্শাল আসগর খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক-ই-ইশতিকলাল, এবং জি এম সাঈদের নেতৃত্বাধীন সিন্ধ ইউনাইটেড ফ্রন্টের কখনো কোন আপত্তি ছিল না। নির্বাচন হবার আগে বাকি দলগুলোর কোনটি এই ব্যাপারে নির্বাচিন কমিশন বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোন অভিযোগ করেনি। নির্বাচনে হারার পরে কেউ কেউ হয়তো ছয় দফা নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে মন্তব্য করে থাকতে পারেন তবে সেটিকে সবার মতামত হিসাবে দাবি করার কোন ভিত্তি নেই। নির্বাচনে অংশগ্রহনকারী একটি দলের নির্বাচনী মেনিফেস্টোর ব্যাপারে রাষ্ট্রের কর্মচারীদের (আমলা) আপত্তি থাকার বিষয়টিই আপত্তিকর। কারণ, পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্টের কর্মচারীদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক অবস্থান নিষিদ্ধ।
২. “এরপর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।“ — ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কোন গৃহযুদ্ধ হয়নি এবং ঐ সময়ে কোন গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়, এবং সেটা বঙ্গবন্ধুর সাথে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের আলোচনার আগেই। এই ব্যাপারে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণের বক্তব্য স্মর্তব্য। সেখানে তিনি অন্তত পাঁচ বার নিরীহ বাঙালীদের ওপর চালানো পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের কথা উল্লেখ করেছেন।
"আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।"
"যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি।"
"দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের উপরে গুলি করা হয়েছে, কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে।"
"২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে ওই শহীদের রক্তের উপর পা দিয়ে কিছুতেই মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।"
"আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।"
খোদ পাকিস্তান সরকারের ক্রমাগত দ্বৈত অবস্থান ও কপটতা, এবং পরিশেষে বাংলাদেশের মানুষের ওপর সর্ব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে।
৩. “ভারতপন্থী সংগঠন মুক্তি বাহিনীর সহযোগিতায় বাঙালীরা স্বাধীন রাষ্ট্রের শ্লোগান ধরে।“ — মুক্তি বাহিনী হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মুক্তিকামী জনগণের বাহিনী - এটি পুরোপুরি বাংলাদেশপন্থী একটি বাহিনী। মুক্তি বাহিনী ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে সত্য, কিন্তু মুক্তি বাহিনীর নীতি ও আদর্শে ভারতপন্থা বলে কিছু ছিল না। তাছাড়া মুক্তি বাহিনী গঠিত হয়েছে ২৫শে মার্চের পরে, কিন্তু স্বাধীনতার শ্লোগান, যা এই দেশের আপামর মানুষের শ্লোগান, সেটি ২৫শে মার্চের আগেই উঠেছে।
৪. “বিদ্রোহ দমন করতে পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়।“ — পাকিস্তানী বাহিনী বিনা উস্কানিতে এই দেশের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মম জেনোসাইড শুরু করে। বিদ্রোহ দমনের যে মিথ্যা অজুহাত এখানে দেয়া হয়েছে সেটি ধোপে টেকে না সামরিক বাহিনীর বাঙালী সদস্য, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের হেড কোয়ার্টার্স, এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যদের হত্যাযজ্ঞ থেকে। শিক্ষায়তনগুলো ও সেসবের আবাসিকে চালানো হত্যাকাণ্ডগুলোও প্রমাণ করে বিদ্রোহের কারণে সামরিক অভিযানের পাকিস্তানী দাবিটি সবৈর্ব মিথ্যা।
৫. “এভাবে পূর্ব পাকিস্তানে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা শুরু হয়।“ — ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণের পরে কোন রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা শুরু হয়নি, যা শুরু হয়েছিল সেটা দখলদার হানাদার বাহিনীর নৃশংস আক্রমণের বিরুদ্ধে সাধারণ মুক্তিকামী মানুষের মুক্তিযুদ্ধ।
এখান থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তান সরকার ১৯৭১ সালে তাদের করা নির্বাচন পরবর্তী অসাংবিধানিক কার্যকলাপ বা সাধারণ মানুষের ওপর চালানো জেনোসাইড কোনটাই স্বীকার করে না। তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিবাহিনীকেও স্বীকার করে না।
(গ)
‘পাকিস্তান আন্দোলন এবং পাকিস্তানের অভ্যুদয়’ অধ্যায়টির চতুর্থ উপ-অধ্যায়ের শিরোনামঃ ‘পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়’ (مشرقی پاکستان کی علیحدگی اور بنگلہ دیش کا قیام)। এখানে বলা হয়েছে,
“১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতাসহ জয় এবং তাদের কাছে দেশের শাসনভার হস্তান্তর না করার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেখানে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সেখানকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির চেষ্টা করে কিন্তু মুক্তি বাহিনী নামের সংঘটি দাঙ্গা ছড়াতে থাকায় সেখানে দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। এমন অবস্থায় ১৯৭১ সালের মার্চের ১৫ তারিখে যুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে ঢাকায় সাক্ষাত করেন। আপস আলোচনা কোন ফলাফল ছাড়া শেষ হয়। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হবার দরুণ মিলিয়ন মিলিয়ন বাঙালী ভারতে অভিবাসন শুরু করে। ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালীদেরকে সাহায্য করার ঘোষণা দেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদেরকে অস্ত্র দেয় এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করে যা পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার পরিস্থিতি শোচনীয় করে তোলে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে আরও সেনা পাঠান, ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানকার অধিকাংশ স্থানের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। এমতাবস্থায়, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে। পাকিস্তানী বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনীকে দুই সপ্তাহ ঠেকিয়ে রাখে। যখন তাদের রসদ ফুরিয়ে যায় এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আর কোন সাহায্য আসতে পারে না, তখন ভারত তার ঘৃণ্য পরিকল্পনায় সফল হয়। এভাবে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যায় এবং বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়”।
এই উপ-অধ্যায়টির পুরোটিই মিথ্যাচার, বানোয়াট তথ্য ও কল্পিত কাহিনীতে পূর্ণ।
১. “১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতাসহ জয় এবং তাদের কাছে দেশের শাসনভার হস্তান্তর না করার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেখানে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন।“ — বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভারতের সাথে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৯৭১ সালের ২৩শে নভেম্বর সারা পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা জারী করেন, সেটা ১৯৭০-এর নির্বাচন পরবর্তী কোন পরিস্থিতিতে না। একটি সাধারণ বোধগম্য বিষয় হচ্ছে, দেশে তখন সামরিক শাসন চলছে। সামরিক শাসন চললে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির জন্য আলাদা করে জরুরী অবস্থা জারীর প্রয়োজন পড়ে না। জরুরী অবস্থা জারী করা হলে দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাবার কথা। অথচ খোদ প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান তখন পার্লামেন্ট অধিবেশন, সরকার গঠন ইত্যাদি ঘোরতর রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে দেশের তাবৎ রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনা করে যাচ্ছেন। জরুরী অবস্থা থাকলে তো এমনটা হবার উপায় নেই। আসলে বানোয়াট ইতিহাস লিখতে গিয়ে এই বইয়ের লেখকদের মাথায় কোনটা সম্ভব আর কোনটা অসম্ভব সেই খেয়াল আর ছিল না।
২. “পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সেখানকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির চেষ্টা করে কিন্তু মুক্তি বাহিনী নামের সংঘটি দাঙ্গা ছড়াতে থাকায় সেখানে দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে।“ — ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনী কোথাও দাঙ্গা বাঁধিয়েছে এমন দাবি কোন সূত্রে পাওয়া যাবে না। কোন ঐতিহাসিক, লেখক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাঁদের ভাষ্যে এমন কথা বলেননি বা লেখেননি। নির্বাচনের পর থেকে ২৫শে মার্চের আগে পর্যন্ত সময়ে পাকিস্তানী বাহিনীর সরাসরি সহযোগিতায় ‘বিহারী’রা দেশের নানা স্থানে যা করেছে সেসব দাঙ্গা নয়, বরং ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে বাঙালী নিধণ। আর মার্চের ২৬ তারিখের আগে মুক্তি বাহিনী বলেও কিছু ছিল না।
৩. “এমন অবস্থায় ১৯৭১ সালের মার্চের ১৫ তারিখে যুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে ঢাকায় সাক্ষাত করেন। আপস আলোচনা কোন ফলাফল ছাড়া শেষ হয়।“ — জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে বৈঠকের উদ্দেশ্যে যুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন মার্চের ২১ তারিখে, ১৫ তারিখে নয়। ঠিক তার পরের দিন ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্ট কালের জন্য পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করে দেন। ২৪শে মার্চ ইয়াহিয়া-ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক হয়। কিন্তু ঐ সময়ে এই তিন জন একত্রে কোন বৈঠক করেননি। পুরো দাবিটিই বানোয়াট।
৪. “পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হবার দরুণ মিলিয়ন মিলিয়ন বাঙালী ভারতে অভিবাসন শুরু করে।“ — বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণ এবং নির্বিচারে জেনোসাইড চালানোর প্রেক্ষিতে এক কোটির বেশি বাঙালী ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তাঁরা ভারতে ‘অভিবাসী’ হতে যাননি। যদি তাই হতো তাহলে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পরে তাঁরা আর ফিরে আসতেন না। গল্প-কাহিনী বানাতে গিয়ে এই বইয়ের লেখকেরা শরণার্থী আর অভিভাবন প্রত্যাশীদের মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য আছে সেটা বিস্মৃত হয়েছেন।
৫. “ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালীদেরকে সাহায্য করার ঘোষণা দেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদেরকে অস্ত্র দেয় এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করে যা পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার পরিস্থিতি শোচনীয় করে তোলে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে আরও সেনা পাঠান, ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানকার অধিকাংশ স্থানের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। এমতাবস্থায়, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে। পাকিস্তানী বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনীকে দুই সপ্তাহ ঠেকিয়ে রাখে।“— ২৫শে মার্চ রাতে আক্রমণ শুরুর পরে পাকিস্তানী বাহিনী বাংলাদেশের অধিকাংশ জায়গায় মে মাসের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। মুক্তি বাহিনীর সঙ্গবদ্ধ দলগুলোর সাথে লড়াইগুলো শুরু হয় এর পরে। ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধে জড়ায় নভেম্বরের শেষের দিকে। অথচ এই বইয়ে লেখকগণ মুক্তি বাহিনী ও ভারতের ওপর কল্পিত দোষ চাপানোর উদ্দেশ্যে পুরো ভাষ্যটি একেবারে উলটে দিয়েছেন।
৬. “যখন তাদের রসদ ফুরিয়ে যায় এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আর কোন সাহায্য আসতে পারে না, তখন ভারত তার ঘৃণ্য পরিকল্পনায় সফল হয়।“ — বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের কোন ‘ঘৃণ্য চক্রান্তের’ ফসল নয়। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির দায় পুরোপুরি পাকিস্তানের, জেনোসাইডের দায়ও তাদের। বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের জান-মাল, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন মাত্র। এই পর্যায়ে এই বইয়ের লেখকগণ সকল ঐতিহাসিক সত্য অস্বীকার করে মনগড়াভাবে ভারতের ‘ঘৃণ্য চক্রান্ত’ আবিষ্কার করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টিকেই অস্বীকার করেছেন।
৭. গোটা বর্ণনায় পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে ৩ মিলিয়নের অধিক মানুষকে হত্যা, চার লক্ষাধিক নারীকে ধর্ষণ, সারা বাংলাদেশ জুড়ে তাদের সশস্ত্র হামলা, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসসাধনের বিষয়গুলো পুরোপুরি চেপে যাওয়া হয়েছে। এই লেখকগণ কেবল নির্লজ্জ মিথ্যুক নন্ সাথে সাথে সত্যকে ধামাচাপার ব্যাপারে কুশলীও বটে।
(ঘ)
‘পাকিস্তান আন্দোলন এবং পাকিস্তানের অভ্যুদয়’ অধ্যায়টির পঞ্চম উপ-অধ্যায়ের শিরোনামঃ ‘পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা্র কারণসমূহ’ (مشرقی پاکستان کی علیحدگی کے اسباب)। এখানে মোট নয়টি কারণের কথা বলা হয়েছেঃ
১. ভৌগলিক দূরত্ব (جغرافیائی فاصلہ):
“পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এক হাজার মাইলের দুরত্ব ছিল। এই দুই অংশের মাঝখানে ছিল ভারত, যে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভাজনের পর থেকেই পাকিস্তানের অখণ্ডতা ক্ষুণ্ন করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। এক হাজার মাইল দূরবর্তী এই দুই অংশের মধ্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন বজায় রাখা খুবই চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল। দুই অংশের একটির সংস্কৃতি অন্যটির থেকে অনেক পার্থক্যপূর্ণ ছিল। পূর্ব পাকিস্তান অন্যান্য প্রদেশগুলোর তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে ছিল। এটি স্থানীয় জনগনের মধ্যে বঞ্চনার ধারণা সৃষ্টি করেছিল, যা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যায়”।
এখানে ভারতকে ভিত্তিহীন দোষারোপ করা ছাড়া বাকি যা কিছু কারণ বলা হয়েছে সেসব সত্য, কিন্তু সেসব কারণ দূরীকরণ বা হ্রাসকরণে পাকিস্তান সরকার আদৌ কোন পদক্ষেপ নিয়েছিল কিনা সেটি বলা হয়নি। বাস্তবে এসব কারণ নিরসনে পাকিস্তান সরকারের কোন সদিচ্ছা ছিল না বলে তাদের দোষ কাটাতে ভারতকে মিথ্যা দোষারোপ করা হয়েছে।
২. ব্যবসায় ও চাকুরিতে হিন্দুদের প্রভাব (تجارت و ملازمت پر ہندوؤں کے اثرات):
“পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবসায় ও সরকারি চাকুরিতে বিপুল সংখ্যায় হিন্দুদের আধিপত্য ছিল, এবং তারা গোপন উদ্দেশ্যের আওতায় বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল"।
১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫% ধর্মবিশ্বাসে হিন্দু ছিলেন। ব্যবসায়ে বা চাকুরিতে তখন হিন্দুদের আধিপত্য ছিল এমন দাবির সপক্ষে কোন পরিসংখ্যান নেই। বরং ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি বড় অংশ এবং সরকারি চাকুরির উচ্চ পদগুলোতে উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানী এবং বিহারীদের আধিপত্য ছিল। এখানে যেমনটা বলা হয়েছে তেমন ঐ সময়ে যদি ব্যবসায় ও সরকারি চাকুরিতে বিপুল সংখ্যক হিন্দু থাকত তাহলেও সেটা কোন আপত্তিকর বিষয় হতে পারে না। পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা কোন গোপন উদ্দেশ্যের সাথে জড়িত ছিলেন এবং বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি জাগিয়ে তুলছিলেন এর সপক্ষেও কোন প্রমাণ পাকিস্তান সরকার এখানে বা অন্যত্র কখনো দিতে পারেনি।
এখানে একটু ঘুরিয়ে যে কথা বলার চেষ্টা করা হয়ছে তা হচ্ছে – বাঙালী হিন্দু = পাকিস্তান বিরোধী + বিচ্ছিন্নতাবাদী + ভারতীয় ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত। একটি রাষ্ট্র যখন খোদ তার নাগরিকদেরকে শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভাজন করে তাদের ওপর গণহারে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা দোষারোপ করে তখন ঐ রাষ্ট্রটি এবং তার নেতৃত্বের দেউলিয়াত্ব স্পষ্ট হয়। হিন্দু মাত্রই ভারতের দালাল, বিচ্ছিন্নতাবাদী, রাষ্ট্রদ্রোহী – এমন দাবি প্রমাণ করে রাষ্ট্র হিসাবেই পাকিস্তান ঘোরতর সাম্প্রদায়িক, বৈষম্যমূলক ও মিথ্যাচারী ছিল।
৩. অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা (معاشی پسماندگی):
“পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ ছিল এবং কোন সরকার এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি” ।
এই পয়েন্টে বলা ভাষ্যটি সঠিক, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দেশের দুই অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে সরকারগুলো কেন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি তার কারণ জানানো হয়নি। এখানে মিথ্যা বলা হয়নি বটে, তবে সত্য গোপন করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে পাকিস্তান সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে।
৪. হিন্দু শিক্ষকদের ভূমিকা (ہندو اساتذہ کا کردار):
“পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগ পুরোপুরি হিন্দুদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তারা বাঙালীদেরকে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলেছিল এবং তাদের অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল"।
এই পয়েন্টের ভাষ্য কেবল সবৈর্ব মিথ্যাই নয় বরং চরম সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষপূর্ণ। একটি বিষয় স্মর্তব্য, স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরের মধ্যে ১২ বছরের অধিককাল পাকিস্তান কঠোর সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। যে সময় স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যকলাপ কখনো নিয়ন্ত্রিত এবং কখনো নিষিদ্ধ ছিল। অমন পরিস্থিতিতে হিন্দু শিক্ষকেরা যদি রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে থাকতেন তাহলে অনেক আগেই এটি আলোচনায় আসতো এবং সামরিক শাসনের আওতায় বহু আগেই তাঁদেরকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হতো। বাস্তবে এমন কিছু ঘটেনি। পাকিস্তানের এই প্রকারের মিথ্যাচার প্রমাণ করে নিজেদের দোষ ও ব্যর্থতা ঢাকার জন্য এরা যাকে খুশি তাকে মিথ্যা দোষারোপ করতে কুণ্ঠিত হয় না।
৫. ভাষা সমস্যা (زبان کا مسئلہ):
“যদিও ভাষার বিষয়টি ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালের সংবিধানের আওতায় সমাধা করা হয়েছিল তারপরেও এটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে একপ্রকারের বঞ্চনার অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল। সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই বঞ্চনার অনুভূতিটি দূর করা যায়নি” ।
একথা সত্য যে, পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ২১৪ নং অনুচ্ছেদের ধারা-১-এ এবং ১৯৬২ সালের সংবিধানের ২১৫ নং অনুচ্ছেদের ধারা-১-এ বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা (National Language) হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, কিন্তু কার্যত রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে, সকল প্রকারের দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডে, আদালতে বাংলার ব্যবহার ছিল না। শিক্ষায়তনে পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে উর্দু শেখা বাধ্যতামূলক করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের কোন ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার ছিল না। ফলে পাকিস্তান আমলে বাংলা তার প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি। এখানে সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার দাবিটি ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।
৬. প্রতিনিধিত্বের অনুপাত জনিত সমস্যা (نمائندگی کی شرح کا مسئلہ):
“পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৫৬% এবং তারা তাদের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনুসারে সঠিক প্রতিনিধিত্ব দাবি করছিল। যদিও তারা ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুসারে সমতার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারটি ইতিপুর্বে মেনে নিয়েছিল, তার পরেও তারা তাদের আইনসঙ্গত অধিকার না পাওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়” ।
১৯৫৬ সালে গৃহীত সংবিধান ৭ই অক্টোবর ১৯৫৮ সালে এবং ১৯৬২ সালে গৃহীত সংবিধান ২৫শে মার্চ ১৯৬৯ সালে অকার্যকর হয়ে যায়। অকার্যকর সংবিধানের দোহাই দিয়ে আইনসঙ্গত অধিকার না পাওয়ার কৈফিয়ত দেয়া বিভ্রান্তিমূলক ও অগ্রহণযোগ্য। বাস্তবে দীর্ঘ সামরিক শাসন এবং ১৯৭০ সালের পূর্বে কখনোই সাধারণ নির্বাচন না হবার কারণে পাকিস্তানে সাংবিধানিক বিধিগুলো কার্যকর হবার কোন সুযোগ পায়নি। এই সুযোগে ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তান ও তার জনসাধারণকে তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের (দেশের মোট জনসংখ্যার ৫৬%) মধ্যে যৌক্তিক হতাশা সৃষ্টি হয়। এখানে এই সত্যগুলো গোপন করা হয়েছে।
৭. ভারতীয় হস্তক্ষেপ (بھارت کی مداخلت):
“পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে ভারতের অসঙ্গত হস্তক্ষেপও পরিস্থিতি খারাপ করে তুলেছিল। ভারত মুক্তি বাহিনীর কর্মীদের সমর্থন ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎসাহিত করেছিল” ।
ভারত পূর্ব পাকিস্তানের কোন্ কোন্ বিষয়ে এবং কখন হস্তক্ষেপ করেছিল এখানে তা বলা হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের কোনো বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপের মানে হচ্ছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপ। যদি অমন কিছু আদৌ হয়ে থাকত সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ভারত সরকারকে সতর্ক করতে পারত বা তাদের সাথে আলোচনা করে এসব বন্ধ করতে পারত। কিন্তু পাকিস্তান সরকার সেই পথে না গিয়ে বিনা উসকানিতে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের ওপর নৃশংস জেনোসাইড শুরু করে।
একথা সত্য যে, ভারত মুক্তি বাহিনীকে সমর্থন দিয়েছিল এবং তাদের মাটিতে মুক্তি বাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবির চলতে দিয়েছিল। কিন্তু এটা তখনই ঘটেছিল যখন পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের জনগণের ওপর আক্রমণ করে জেনোসাইড চালানো শুরু করে ফলে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। স্বাধীন বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়া বা সাহায্য করার জন্য ভারতের পাকিস্তানের কাছ থেকে অনুমতি নেবার প্রয়োজন নেই এবং এই ব্যাপারে পাকিস্তান আপত্তি তুলতে পারে না।
৮. শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা (شیخ مجیب الرحمن کے چھے نکات):
“আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফাও বিচ্ছিন্নতাকে উৎসাহ জুগিয়েছিল” ।
আওয়ামী লীগের ছয় দফা ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে লাহোরে ঘোষিত হয়। পরবর্তীতে ছয় দফার ভিত্তিতে গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। ছয় দফা বাস্তবায়ন করা ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে পরিণত হয়। ছয় দফা যদি আদৌ বিচ্ছিন্নতাবাদের উৎসাহজনক কিছু হতো তাহলে পাকিস্তানের সামরিক শাসকগন বহু আগেই এটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করত; এবং আওয়ামী লীগ কিছুতেই এটি তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারত না। পাঁচ বছরের অধিক কাল ধরে চলা একটি রাজনৈতিক কর্মসূচীকে হঠাৎ করে দোষারোপ করার পেছনে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার অপপ্রয়াস আছে।
৯. ১৯৭০-এর নির্বাচন (ء کے عام انتخابات1970):
“১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পরিস্থিতিকে নতুন মোড় দেয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের পূর্ণ বিজয়ের পর মানুষ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করতে শুরু করে” ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরে উচিত ছিল নূন্যতম সময়ে মধ্যে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে দেশের ক্ষমতাভার অর্পণ করা এবং সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা। কিন্তু বাস্তবে সেটি না করে পাকিস্তান সরকার পার্লামেন্টের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়ে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর সামরিক অভিযান চালিয়ে নির্বিচারে নৃশংস জেনোসাইড চালিয়ে, নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে এক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ স্বাধীনতা ঘোষণা করতে এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু করতে বাধ্য হয়। এখানেও পাকিস্তান সরকারের সদিচ্ছার অভাব এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে ধামাচাপা দিয়ে কাল্পনিক যুক্তির অবতারণা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
(ঙ)
১৯৭১ সালের পরে আজ পর্যন্ত অনেক সুযোগ এসেছে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কৃতকর্মের জন্য বাংলাদেশ ও তার জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারত, কিন্তু পাকিস্তান তা করেনি। পাকিস্তান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও তারা সেটি করেনি। তারা বাংলাদেশে আটকা পড়া পাকিস্তানীদেরকে নিয়ে যায়নি। তারা বাংলাদেশের প্রাপ্য সম্পদ ফিরিয়ে দেয়নি। পাকিস্তান আজ পর্যন্ত এমন কিছু করেনি বা বলেনি যাতে তারা এটা স্বীকার করে যে, তারা বাংলাদেশে জেনোসাইড চালিয়েছিল, নির্বিচারে ধর্ষণ করেছিল, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছিল এবং তারা তাদের কৃত কর্মের জন্য লজ্জিত, দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে পাকিস্তান তার নিজের মনোভাব ও অবস্থান এক বিন্দু পরিমাণে পরিবর্তন করেনি। অর্থাৎ, ১৯৭১ প্রশ্নে তাদের অবস্থান এখনো ১৯৭১ সালেই দাঁড়িয়ে আছে।
নিজেদের কৃত জঘন্য সব অপরাধ, কাপুরুষতা, এবং মুক্তিযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়কে অস্বীকার করার জন্য ১৯৭১ নিয়ে পাকিস্তান একটি মিথ্যায় পূর্ণ ন্যারেটিভ দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। অর্ধ শতাব্দী ধরে পাকিস্তানে নানা প্রকারের, নানা রাজনৈতিক দলের সরকার এবং সামরিক শাসন চললেও এই ন্যারেটিভটি তারা পরিবর্তন করেনি। অর্থাৎ, দল-মত নির্বিশেষে পাকিস্তানীরা এই মিথ্যাচারটি প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট।
এই ন্যারেটিভে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ২৩ বছর ধরে চলা বৈষম্য, দীর্ঘ সামরিক শাসনের কারণে গণতান্ত্রিক চর্চ্চা গড়ে না ওঠা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ষড়যন্ত্রের সংস্কৃতি, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, বিহারীদের দিয়ে বাঙালীদের নিধণ, বাংলাদেশের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে জেনোসাইড চালানো, অকল্পনীয় মাত্রায় বীভৎস ধর্ষণকাণ্ড চালানো, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ষড়যন্ত্র ও কাপুরুষতা, তাদের শোচনীয় পরাজয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করা, বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা, পাকিস্তানের নাগরিকদের একাংশকে বাংলাদেশে ফেলে রাখা – এর সবই গোপন করা হয়েছে। কয়েক প্রজন্ম ধরে এই ন্যারেটিভটি বিদ্যায়তনে শেখানোতে পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকেরাও এটিকে সত্য বলে মানতে স্বস্তি বোধ করে। মুক্ত তথ্যের এই যুগে প্রকৃত সত্যটি তাদের সামনে আসলেও তারা এই মিথ্যা ন্যারেটিভের চর্চ্চা বন্ধ করার দাবি তোলে না। এটি প্রমাণ করে যে, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া আপামর পাকিস্তানীরা এই মিথ্যচারটিই চালু রাখতে আগ্রহী। যতদিন পর্যন্ত না পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই মিথ্যাচার বন্ধ না করবে, নিজের দেশের মানুষসহ সারা দুনিয়ার সামনে সত্য ইতিহাস স্বীকার করবে, নিজেদের কৃত জঘন্য অপরাধসমূহের দায় স্বীকার করবে — ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ ও তার জনগণের কাছে কোন পাকিস্তানীর ক্ষমা চাওয়া বা দুঃখপ্রকাশ কোন অর্থ বহন করবে না।
মন্তব্য
পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের এই বিবরণ দেখে আমি অবাক হইনি। পৃথিবীর সব জাতি তাদের পাঠ্যপুস্তকে নিজেদের ইতিহাসের গৌরবটাই দেখাতে চায়। কিন্তু পাকিস্তানীদের কাছে এটা একটা বড় সমস্যা। পাকিস্তানের ৭৫ বছরের ইতিহাসের মধ্যে গৌরব করার মতো কোন বিষয় তো নেই, একের পর এক কেলেঙ্কারির ঘটনা। তার উপর ১৯৭১ তাদের ইতিহাসের জন্য একটা বিষফোঁড়া হয়ে আছে। আমার ধারণা প্রতিটি পাকিস্তানী সরকার এই বছরটা নিয়ে একটা বড় ধরণের অস্বস্তিতে ভোগে। যদি সুযোগ থাকতো টাইম মেশিনে ফিরে গিয়ে ১৯৭১ সালটাকে ডিলিট করে দিতো। পাঠ্যপুস্তকের এসব আবোলতাবোল ইতিহাস তাদের সেই কলঙ্ক ঢাকার একটা রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া।
ব্যক্তিগতভাবে পাকিস্তানের মতো ইতর ভণ্ড অসভ্য একটি রাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা আমি কখনো আশা করি না। বর্তমান পাকিস্তান বাংলাদেশের করুণার পাত্র হবার উপযুক্ত। তারা শুধু যুদ্ধে পরাজিত নয়, তারা আমাদের কাছে সার্বিকভাবে পরাজিত হয়েছে। সেই পরাজিত শত্রু ক্ষমা চাইলেও ত্রিশ লাখ শহীদ তাদের ক্ষমা করবে না। অভিশপ্ত এই রাষ্ট্রটি বহুকাল ধরে তাদের অপকর্মের মূল্য দিয়ে যাবে। পাকিস্তানীরা ক্ষমা চাইলেও আমাদের ভাই হয়ে যাবে না। কিন্তু ক্ষমা বা দুঃখপ্রকাশ কিছু না করেও পাকিস্তানীরা এখনো যাদের ভাই হয়ে আছে, তাদের ভাই হয়ে থাকবে। শুধু তাই না, আমার আশঙ্কা কোন এক ভবিষ্যতে এদেশীয় ভাইয়েরা হয়তো পাকিস্তানের কাছে ক্ষমা চেয়ে বসবে ১৯৭১ সালে এক লাখ সৈন্যকে বেদম পিটুনি দিয়ে ভারতে হাতে তুলে দেবার জন্য।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
এড়িয়ে যাওয়া বা লঘু করা এক জিনিস আর নির্জলা মিথ্যাচার আরেক জিনিস। জাপান, জার্মানী, ইতালি প্রভৃতি দেশের পাঠ্যপুস্তক কি এমন মিথ্যাচারে পূর্ণ? সেখানে কি হলোকাস্ট ডিনায়াল, জেনোসাইড ডিনায়াল আছে?
সত্যের মুখোমুখি হওয়া, সত্য গোপন না করা, প্রকৃত দোষীকে চিহ্নিত করে শাস্তি না হোক অন্তত তিরস্কার করা - এইটুকুও যদি পাকিস্তান করত তাহলে জাতি হিসাবে তারা সবার সাধুবাদ পেত। নিজেদের আত্মমর্যাদাও বাড়ত। সেসব কেন হয়নি তা পাকিস্তান ভালো জানে। আমরা শুধু জানি, পাকিস্তান সেসব কিছু করেনি।
ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টির একটি ভিন্ন গুরুত্ব আছে। একটি হত্যা মামলায় হত্যাকারীর ফাঁসি হলেও আসলে নিহত ব্যক্তি জীবিত হয় না বা তাঁর প্রিয়জনদের ক্ষতির লাঘব হয় না। কিন্তু হত্যা মামলার বিচার সমাজে ও মানুষের মনে এটা প্রতিষ্ঠিত করে নিহত 'দবির' অন্যায়ের স্বীকার হয়েছিল, হত্যাকারী 'সাবেত' অন্যায় করেছে, শাস্তি পাবার যোগ্য, এবং তাকে দণ্ড প্রদান করা গেছে। এই চর্চ্চাটি না থাকলে ন্যায়বিচারের ধারণাটিই লোপ পাবে। পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে গেলে তাদেরকে জেনোসাইডের ব্যাপারটি স্বীকার করতে হবে। তখন জেনোসাইডের বিচারের পথ সুগম হবে।
পাকমনপিয়ারুদের নিয়ে আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ আছে। কখনো সময় সুযোগ হলে সেটা নিয়ে লিখতে পারি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এই বিশ্লেষণমূলক লেখার জন্য আপনার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা
পোস্ট পরা ও মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখা!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
হয়তো। তবে লোকে পড়েনি, তাই আলোচনাও নেই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অনেকদিন পর সচলায়তনে এসে আপনার লেখাটা মন দিয়ে পড়লাম, ভালো লাগলো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন