পিটিশন : আপনার আর রাষ্ট্রযন্ত্রের বিকল্প সংযোগ

শেহাব এর ছবি
লিখেছেন শেহাব (তারিখ: মঙ্গল, ২৬/১১/২০১৩ - ৫:২০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগে চলেন ঝটপট আমরা জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১০০ নম্বর ধারাটি পড়ে ফেলি। কার্যপ্রণালী বিধি বা রুলস অফ প্রসিডিউর আপনি পাবেন জাতীয় সংসদের ওয়েবসাইটে। স্ক্রল করে চলে যান ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠায়। আমি নিচে স্ক্রিনশট দিয়ে দিচ্ছি।

তার মানে হল আপনি একজন সাধারণ নাগরিক হলেও আপনারও একটি উপায় আছে কোন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চাইলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত আলোচনার জন্য নিয়ে যাওয়ার। কাজটি একদম ছেলে খেলা না আবার হিমালয় তুলে নিয়ে আসার মত কঠিনও না। আপনাকে কিছু সমমনা মানুষ যোগাড় করতে হবে এবং একজন সংসদ সদস্যকে রাজী করাতে হবে। আমাদের সংসদ সদস্যদের সবাই দন্ডিত যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর মত না। বরং ইদানীং কালে একাধিক সংসদ সদস্য আপনার বয়সীদের সাথেই যোগাযোেগের জন্য সোশ্যাল মিডিয়াতে আসা শুরু করেছেন।

সারমর্ম হল পিটিশনের চেষ্টা করাই যায়। নৈতিক দিক থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, মাত্র টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। অনেকের একটি অভিযোগ হল সরকার কেন এটি নিয়ে সংসদে আলাপ করেনি? খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন। যারা এই অভিযোগ তুলে তাদেরকেও একটি যৌক্তিক প্রশ্ন করা যায় - কার্যপ্রণালী বিধির ১০০ ধারা অনুযায়ী এটি সংসদে আলোচনা হোক এই মর্মে পিটিশন করার নাগরিক দায়িত্বটিও কেন তারা পালন করেন নি? রাষ্ট্র একটি দুই চাকার শকট। রাষ্ট্রযন্ত্র যদি একটি চাকা হয়, জনগণ আরেকটি চাকা। যদি আমরা চাই শকটটি এগিয়ে যাক তাহলে দুটি চাকাই সমান ভাবে ঘুরতে হবে।

এবার দেখি এখন পর্যন্ত এই পিটিশন ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা কি? আমি এই তথ্যগুলো আপনাদের নিরুৎসাহিত করার জন্য দিচ্ছি না বরং তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজটি আরো নিখুঁতভাবে করার জন্য বলছি।

বাংলানিউজ২৪.কমে ২০১১ সালের ১১ই মার্চে প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ৫ম সংসদ থেকে (খবরটি অনুযায়ী এর আগে পিটিশনের বিধান ছিল না) এখন পর্যন্ত ১৪৯টি পিটিশন জমা পড়লেও গৃহীত হয়েছে মাত্র ২০টি। পঞ্চম সংসদে ১৭টি, সপ্তম সংসদে দুটি এবং অষ্টম সংসদে একটি। সর্বশেষ সংসদে ১২টি পিটিশন জমা পড়ে এবং কোনটিরই নিষ্পত্তির জন্য যে বৈঠকটি প্রয়োজন তা হয়নি। এখনই উৎসাহ হারাবেন না। খবরে বিস্তারিত বলা হয়নি পিটিশনের পদ্ধতি ঠিক ছিল কিনা, কিসের ভিত্তিতে বাকিগুলি বাতিল হল। এগুলো জেনে নিতে হবে। তারপর হতাশ না হয়ে ফাঁকফোঁকরগুলো ঠিক করতে হবে।

একটু ভেবে দেখুন গত পাঁচবছরে কি মাত্র ১২টি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যেগুলো সংসদে আলোচিত হওয়ার দরকার ছিল? তাহলে পিটিশন এত কম হল কেন? নিশ্চয়ই আমি বা আপনি ফেসবুকে যেসব স্ট্যাটাস দিয়ে ফেসবুকের সার্ভার কাঁপিয়ে ফেলেছি তার কিছু না কিছু পিটিশনের যোগ্য ছিল। আমরা করলাম না কেন? অন্তত: চেষ্টা করলাম না কেন?

আমার কথাবার্তা পছন্দ না হলে এইবেলায় পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজটি করে ফেলুন। সেটি হল নিজে হতাশ হওয়া, সবার মাঝে সেই হতাশা ছড়িয়ে দেওয়া আর শুধু অভিযোগ করে যাওয়া কিন্তু দায়িত্বটি পালন না করা। কিভাবে করবেন? খুব সহজ: নিচের স্ট্যাটাস সহ এই লেখাটি ফেসবুকে শেয়ার করে দিন।

"খুবই বাস্তবতাবিবর্জিত লেখা। সবাই জানে দুই বড় দল নিজেদের মধ্যে আতাঁত করেই সব করে। এই সব পিটিশন ফিটিশন করে কিছু হবে না। বিদেশের মাটিতে বসে অনলাইনে হোয়াইট হাউসের পিটিশন বাটনে ক্লিক করে যার কাজ হয়ে যায় দেশের পিটিশনকে সোজা মনে করে উপদেশ দেয়া তার জন্য খুবই স্বাভাবিক। যখন এই পিটিশনের জন্য শুধু এম.পি. 'র সই জোগাড় করতেই দুই বছর লেগে যাবে তখন বাছাধন বুঝবে কত স্বাক্ষরে কত পিটিশন। হা হা হা!"

আসলেই পিটিশন এর চেয়ে কঠিন। আপনাকে আগের পিটিশন গুলো কেন সফল হয়নি সেটি বুঝতে হবে। আপনার সমমনা অন্য মানুষদের আপনার দাবী বুঝাতে হবে। তারপর একজন সমমনা এম.পি. খুঁজে বের করতে হবে। তারপর নিয়ম কানুন জানতে হবে। সেটির ফলোআপ করতে হবে। প্রয়োজনে সাংবাদিকদের জানাতে হবে যাতে তারা গণমাধ্যমে তাগাদা দিতে পারেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল অনেকেই এটি টের পাবেন না। কেন পাবেন না? কিছু লোক আছে যাদের প্রধান বিনোদন হল দেশের জন্য কাজ করে দিনাতিপাত করা, ঘরের খেয়ে বনের ডাইনোসর তাড়ানো। আর এটাও সত্য যে এটি সবচেয়ে কঠিন কাজ নয়। অন্তত: যারা জীবন দিয়ে এই দেশটিকে আপনার আমার হাতে তুলে দিয়ে গেছেন তাদের ত্যাগ স্বীকারের তুলনায় তো না-ই।

কিছু যখন নিয়মিত পিটিশন করা শুরু করবে তখন আস্তে আস্তে এর নিয়ম কানুনগুলো অন্যান্য মানুষের কাছেও পরিচিত হওয়া শুরু করবে। যত বেশি পিটিশন হওয়া শুরু করবে আস্তে আস্তে সংসদ সচিবালয়ও এর প্রতি মনোযোগী হবে, জনবল বাড়াবে। প্রথম কয়েক বছরের ধাক্কাধাক্কিটা যদি একটু কষ্ট করে পার করে দেয়া যায় তাহলেই হবে। আমরা কিন্তু কিছু পরোক্ষ উপকারও পাব। পিটিশনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আমাদের সাথে সাংসদদের একটি অনানুষ্ঠানিক সংযোগের সংস্কৃতি শুরু হবে। এখন একটি প্রচলিত ধারণা হল সাংসদরা দলীয় প্রধানের কথায় উঠে আর বসে। কিন্তু একজন ভাল ও দক্ষ সাংসদ যদি তার পায়ের নিচে জনসংযোগ ও সমর্থনের শক্ত মাটি পায় তাহলে সে নিজেও জোর গলায় দলীয়প্রধানের মুখোমুখি হয়ে ন্যায়সংগত দাবীগুলো তুলতে পারবে। তাত্ত্বিকভাবে আমাদের সাথে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক মহলের যোগাযোগ হওয়ার কথা যার যার সাংসদদের মাধ্যমে। আমরা যদি সেই হারিয়ে যাওয়া সংযোগ পিটিশনের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করতে পারি তাহলে মন্দ কি?

তো তাহলে পিটিশন করছেন? আগামী সংসদ যখন শুরু হবে টিকফা চুক্তি পুনর্বিবেচনার দাবী দিয়েই শুরু করুন না!

শেহাব,
বাল্টিমোর


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

কীভাবে গ্রহণযোগ্য পিটিশন লিখতে হবে, সে নির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্বও সংসদ সচিবালয়ের ঘাড়ে চাপানো উচিত। একটা টেমপ্লেট পিটিশন প্রস্তুত করে সংসদের ওয়েবসাইটে আপলোড করে দিতে হবে, এই দাবিতে শোরগোল তুলে কাজ শুরু করা যায়।

স্পর্শ এর ছবি

ভালো জিনিস খুঁজে বের করেছেন।

একটা প্রশ্ন: পিটিশন আর আবেদন এর মধ্যে পার্থক্য কী?

মনে করেন আমি আমার এলাকায় একটা লাইব্রেরী চাই। সেটা চাহিয়া পিটিশন করবো নাকি আবেদন করবো?


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পিটিশন সংসদে উত্থাপন ও আলোচনা পর্যায়ে যাবার জন্য যে বাধাগুলো সেগুলো দেখা যাক।
১। প্রস্তাবটি পিটিশন হিসাবে দেয়া যায় কিনা সেটা যাচাই করা। এর জন্য সহজ উপায় হচ্ছে একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ আইনজীবির শরণাপন্ন হওয়া। খরচটা একটু বেশি মনে হলে কোন অগ্র-পশ্চাত বিবেচনা না করে পিটিশন দাখিল করা যেতে পারে।
২। পিটিশনের ভাষা কী হবে সেটা স্পষ্ট নয়। আদালতের ভাষা জানা অনেক প্রফেশনাল আছেন, কিন্তু সংসদের ভাষা জানা প্রফেশনাল কতোজন আছেন? আর এটা তো স্পষ্ট ভাষা ও উপস্থাপন যথাযথ না হলে পিটিশনের আশ্রয়স্থল হবে ট্র্যাশবিন।
৩। পিটিশন দাখিল করার জন্য সচিব সাহেবের কাছে পৌঁছানোর পাশ পাওয়ার উপায় কী? আচ্ছা সচিব সাহেবকে বাদ দিন, মাননীয় সংসদ সদস্যকে কনভিন্স করতে পারলেই কি সেটা সংসদে উত্থাপিত হবে? তিনি যে দলের সদস্য সেই দলের সংসদীয় নেতা/হুইপ সেটা নীরিক্ষণ করবেন, নীরিক্ষণে পাশ হলে সংসদে সেটা উত্থাপিত হতে পারে। তবে এটা খুব উঁচু মাত্রার আশা। কারণ, প্রত্যেক দলের নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা থাকে হুট করে একটা বিষয় তারা তাদের কর্মপরিকল্পনায় ঢোকাবে না। সংসদ সদস্য তার দলের সংসদীয় নেতা/হুইপের কাছে বেশি দেন দরবার করবেন না। কারণ, কে চায় দলের নেতৃবৃন্দকে খেপিয়ে পরবর্তীতে নিজের মনোনয়নলাভের পথকে কঠিন করে তুলতে!

পিটিশন উত্থাপিত হলেও তার ভবিষ্যত কী হতে পারে? সম্ভবত কণ্ঠভোটে বাতিল হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের দাখিল করা পিটিশনের কথা বাদ দিন। নির্বাচিত সংসদ সদস্য, যারা বিরোধী দলের বেঞ্চে বসেন, আজ পর্যন্ত ৯টা সংসদে তাদের উত্থাপিত কয়টা বিল/নোটিশ/সংশোধনী প্রস্তাব আলোচিত হয়েছে? তার মধ্যে কয়টা পাশ হয়েছে? এই ব্যাপারে আমার কাছে পরিসংখ্যান দাবী করবেন না। তথ্য অধিকার আইন অনুসারে সেই তালিকাটা আপনার সংসদ সচিবালয় থেকে পাবার কথা।

কিছু কিছু দোকানে একটা নোটিশ দেয়া থাকে, "আমরা বাকীতে বেচি, তবে বাকী নিতে চাইলে আপনার পিতা-মাতা দু'জনকে সাথে নিয়ে আসতে হবে এবং তাদের দু'জনের বয়স ৯৯-এর বেশি হতে হবে"।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

স্যাম এর ছবি

চলুক
আইন-কানুন প্রায় বুঝিনা বললেই চলে, কিন্তু সচেতন থাকার ইচ্ছা আছে ষোলআনা, লেখাটি দারুণ কাজ করল সে ইচ্ছাতে, ধন্যবাদ আপনাকে, আরো লিখবেন আশা করি। মন্তব্যে চোখ রাখছি, আলোচনা হোক।

হিমেল এর ছবি

এই প্যারাটা

"খুবই বাস্তবতাবিবর্জিত লেখা। সবাই জানে দুই বড় দল নিজেদের মধ্যে আতাঁত করেই সব করে। এই সব পিটিশন ফিটিশন করে কিছু হবে না। বিদেশের মাটিতে বসে অনলাইনে হোয়াইট হাউসের পিটিশন বাটনে ক্লিক করে যার কাজ হয়ে যায় দেশের পিটিশনকে সোজা মনে করে উপদেশ দেয়া তার জন্য খুবই স্বাভাবিক। যখন এই পিটিশনের জন্য শুধু এম.পি. 'র সই জোগাড় করতেই দুই বছর লেগে যাবে তখন বাছাধন বুঝবে কত স্বাক্ষরে কত পিটিশন। হা হা হা!"

একটু বদলে এরকম

"খুবই বাস্তবতাবিবর্জিত লেখা। সবাই জানে দুই বড় দল নিজেদের মধ্যে আতাঁত করেই সব করে। এই সব পিটিশন ফিটিশন করে কিছু হবে না। অনলাইনে হোয়াইট হাউসের পিটিশন বাটনে ক্লিক করার জন্য মানুষে কত শেয়ার কত তর্ক-বিতর্ক করে -- বাংলাদেশে এই জিনিস আছে এটাই কেউ জানেনা। তার মানে এটা ফেসবুক থেকে ক্লিক করে সাইন করা যায় না। গায়ে গতরে খাটতে হবে। যখন এই পিটিশনের জন্য শুধু এম.পি. 'র সই জোগাড় করতেই দুই বছর লেগে যাবে তখন বুঝা যাবে কত স্বাক্ষরে কত পিটিশন। হা হা হা!"

করে এই পোস্টটাও শেয়ার করে দিলেও কিছুটা কাজ হবে আশা করি!

অবশ্য আসলে জানিনা কেমন কাজ হবে!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।