এয়ারপোর্ট থেকে পাওলো কোহেলোর একটি বই কিনতে কিনতে কি মনে করে মত পালটে এই বইটি কিনলাম। লেখক সিআইএ'র সর্বোচ্চ পদক পেয়েছেন তার অবদানের জন্য। বইটি পড়তে খারাপ লাগে না, রীতিমত রগরগে গোয়েন্দা কাহিনী। কিন্তু গুডরিডে তিনের বেশি দিতে পারিনি কারণ তারা তাদের অভিযানকে রীতিমত পবিত্র ধর্মীয় কার্যক্রম হিসেবে দেখিয়েছে। ড্রোনের গুলিতে যখন বাচ্চা মারা যায় সেটি কিভাবে তাদের নৈতিকতায় মিলানো হয় সেই হিসেবটি বুঝতে পারি নি। তিন দিবো না তো কী দিবো?
একটু সিনিয়র হবার পর লেখকের কাজের জায়গা ছিল দক্ষিণ এশিয়া। মোটামুটি আল কায়েদাকে সাইজ করাই তার প্রধান কাজ ছিল। ভাল লেগেছে যে একবারও বাংলাদেশের কথা আসে নি। তবে সিআইএ'র কিছু কিছু কাজের পদ্ধতি দেখে কাদের মোল্লার ফাঁসির আগের দুই দিনের কথা মনে পড়ল।
সিআইএর মূল কাজ নাকি মাইরপিট করা না, যারা মাইরপিট করবে তাদের জন্য তথ্য সংগ্রহ করা। তথ্য কিভাবে সংগ্রহ করে তার একটি নমুনা দেই। একবার জাতিসংঘের কি একটা অনুষ্ঠানে কোন দেশের সরকারপ্রধান নিউইয়র্কে এসেছিলেন। তো সিআইএ নাকি হোটেল রুমের মূল রিমোট কন্ট্রোল পাল্টে হুবহু আরেকটি রিমোট কন্ট্রোল রেখে দিয়েছিল যেটি রিমোট কন্ট্রোলের পাশাপাশি রুমের কথাবার্তা রেকর্ড করে বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারে। আমার খুব জানার ইচ্ছা বাংলাদেশে আমেরিকান সরকারের তথ্য সংগ্রহের যে জাল সেটি কেমন। যেহেতু এটি আমার পেশাগত আগ্রহের মধ্যে পড়ে না কাজেই আমি কখনই খুব বেশি জানতে পারব না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল পেশাগত কারণে যাদের জানা জরুরী তারা জানে তো?
কাদের জানা জরুরী? বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, সাংবাদিক আর ব্যবসায়ীমহল। গোয়েন্দা সংস্থার জানা জরুরী কারণ কোন ঝামেলা হলে সবার আগে সরকারের দোষ খুঁজব আমরা। সাংবাদিকদের জানা জরুরী কারণ সত্য সবার সামনে তুলে ধরা তাদের পেশাগত অবস্থান, ব্যবসায়ীদের জানা জরুরী কারণ তারা আমেরিকায় তাদের পণ্য ও সেবা বিক্রি করতে চান।
বাংলাদেশে আমেরিকা যে সিআইএর মাধ্যমেই সবসময় খোঁজ নেয় সেটি হওয়ার কথা না। আরো অনেক মাধ্যম হওয়ার কথা। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা বাংলাদেশের আইন ভঙ্গ না করছে আমরা হয়তো কিছু করতেও পারব না। বেশিরভাগ সময় তারা কূটনৈতিক পাসপোর্টে থাকে কাজেই আমরা বড়জোর পশ্চাদ্দেশে লাথি মেরে বের করে দিতে পারব। কিন্তু আমরা খবর রাখি তো? বিশেষ করে যারা সিভিলিয়ান কিন্তু এটি তাদের পেশাগত আগ্রহের মধ্যে পড়ার কথা সেই সাংবাদিক বা ব্যবসায়ীরা জানেন তো?
একটি কেইস স্টাডি দেই। কাদের মোল্লার ফাসির আগের দিন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি শেখ হাসিনাকে ফোন করে ফাঁসি বন্ধ করার অনুরোধ করেছিলেন। ফোন করার আগে নিশ্চয়ই তার অফিসের লোকজন মূল্যায়ন করেছিল অনুরোধ রাখার বা না রাখার সম্ভাবনা কতটুকু। না রাখলে সেটিকে কিভাবে সামলানো হবে। এই মূল্যায়ন হয়েছে নিশ্চয়ই কিছু তথ্যের ভিত্তিতে। সেই তথ্য এসেছে কোথা থেকে? আওয়ামী লীগ আর সরকারের ভিতরের সূত্র থেকে। সেই সূত্রগুলো কি কি? আমাদের সাংবাদিক আর ব্যবসায়ীরা কি জানেন? একদম সুনির্দিষ্ট করে জানার কথা না। কিন্তু মোটামুটি কি ধারণা আছে? তথ্য সংগ্রহের এই ব্যাপারটি দুই দেশের মধ্যে দড়ি টানাটানির মত। মাঝখানে বেঁধে রাখা রুমালটি কি আমাদের দিকে নাকি ওদের দিকে? সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী মহলদের কারো কারো সাথে হয় দূতাবাসের ব্যক্তিগত যোগাযোগ আছে। এর বাইরে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ তো হয়ই। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক যেসব যোগাযোগ হয়, আমরা নাগরিকরা তার কতটুকু জানি? জানার দরকারতো নিশ্চয়ই আছে তাই না? নিজের দেশ বলে কথা।
এটা নিশ্চিত যে বাংলাদেশের সামরিক স্থাপনাগুলোতে বাগ বসানো আছে কিনা সেটি নিয়মিত গোয়েন্দারা সুইপ করে বের করেন। বেসরকারী মহলে যাদের সাথে দূতাবাসের লোকজনের পীরিত আছে সেটিও মনে হয় তারা জানেন ফোন টেপ বা বাগিং করে। সেই আইনী কর্তৃত্ব সম্ভবত তাদের আছে। কিন্তু গণভবনের কোন লোকটি দূতাবাসের কারো সাথে বারিধারার চিপায় বিয়ার খান বা জামাত মার্কিন দূতাবাসে দিনে কয়মণ তেল সাপ্লাই দেয় সেটির ব্যাপারে আমাদের সাংবাদিকরা আদৌ কতটুকু জানেন? সেই বারই ডিসেম্বর ফাঁসি হল কিন্তু এখনও একটি পরিষ্কার ফলোআপ রিপোর্ট দেখলাম না আসলে প্রতি ঘন্টায় পরিস্থিতি কি করে পরিবর্তিত হচ্ছিল সেদিন?
দুইটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। প্রথম যখন পাটের জিনোম সিকুয়েন্স বের করার খবর শেখ হাসিনা সংসদে দিলেন নিরাপত্তার কারণে সেই কাগজের কপি নাকি তিনি নিজেই ফটোকপি করেছিলেন। কোন সাংবাদিক এখন পর্যন্ত বের করলেন না সেখানে ঠিক কারা ঝুঁকি ছিল? তাদের নামগুলো কি? তারা কেন ঝুঁকি? কত বড় ঝুঁকি?
দেশে আসার আগের বছর কানাডার রাষ্ট্রদূত রবার্ট ম্যাকডুগালের স্ত্রী ক্যাথেরিন লোওদার ঘটনাচক্রে আমার আর আমার বউয়ের ঘনিষ্ট পারিবারিক বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। ভদ্রমহিলা ছিলেন একইসাথে ফটোগ্রাফার আর ওয়েব ডেভেলপার। আমি তার সুসে সার্ভার দাঁড় করানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে সাহায্য করতাম। প্রায় প্রতি শুক্রবার সকালে রান্নাঘরে চা দিয়ে আমার দিন শুরু হত। সেখানে চায়ের আলমারির গায়ে রবার্ট ম্যাকডুগালের সেই সপ্তাহের ক্যালেন্ডার দেয়া থাকত (বুঝাই যাচ্ছে গোপন কিছু না)। একবার আমি আবিষ্কার করেছিলাম টানা তিনদিন নাইকোর কোন লোকের সাথে তার মিটিং।
আমাদের সাংবাদিকরা বিদেশী মেহমানদের পাকনামীর ব্যাপারে আমাদের কতটুকু জানাতে পারছেন? আমরা সব খবর রাখছি তো? পাচ্ছি তো?
মন্তব্য
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজি হলে আম্লীগ বিম্পির জ্যেষ্ঠ নেতারাই গড়গড়িয়ে রাষ্ট্রদূতদের কাছে অনেক কিছু বলে দিতে পারেন, কিছুই বলা যায় না।
যে দেশে সংসদ ভবনের ভেতরে কে বা কাহারা হেগে থুয়ে যায়, সে রহস্য অনুদ্ঘাটিত থাকে, সে দেশে সিআইএর মোকাবেলা কী দিয়ে হবে?
মোকাবেলা করবে মাসুদ রানা।
ইউক্লিড
ব্লগেও হয়ত নজরদারি আছে তাদের।
ইউক্লিড
খুব শীঘ্রই অফিশিয়ালি নামবে মনে হয় , কারণ আজকে একটা রিপোর্টে দেখলাম বাংলাদেশ নাকি আগামী দশকে ১১ টি ইমার্জিং এর মাঝে একটি ।
বাগ না বসায়া উপায় আছে?
কোন একটা বইতে একটা ঘটনার কথা পড়েছিলাম (অ্যান্থনি মাস্কারেনহাসের "বাংলাদেশঃ রক্তের ঋণ" অথবা সাবেক আমলা সৈয়দ নাজমুদ্দিন হাশেম-এর "অশ্লেষার রাক্ষসী বেলায়"; বই দুটির কোনটাই এখন হাতের কাছে নাই)। জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে ফিদেল কাস্ত্রো এবং জোসেফ টিটো তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক ক্যু-এর পরিকল্পনার তথ্য দিয়ে তাঁকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিউবা এবং যুগোস্লাভিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা যে ক্যু-র কথা জানত, আমাদের দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সে সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিল না। বিডিআর বিদ্রোহের আগাম তথ্য সরবরাহেও আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা ছিল ব্যর্থ। ডিজিএফআই-এনএসআই-এর একমাত্র কাজ হল (জামাত এবং ক্যান্টনমেন্টের দুটি দল ছাড়া) সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নজরদারি এবং হয়রানি করা।
Emran
ব্যক্তি স্লেডেনই আমেরিকাকে নেংটা করে ছেড়েছে। নিরাপত্তা ব্যাপারটাই আমার কাছে অদ্ভূত লাগে। বেহুলার বাসরঘরের মতই সেটা "নিরাপদ"।
-সুষুপ্ত পাঠক
দারুণ গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট।
নতুন মন্তব্য করুন