রিমোট সেনসিং গবেষকদের কাছে অনুরোধ - প্রসংগ: সুন্দরবনে তেল নি:সরণ

শেহাব এর ছবি
লিখেছেন শেহাব (তারিখ: রবি, ২১/১২/২০১৪ - ৮:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই লেখাটি মূলত: সুন্দরবনের তেল নি:সরণ নিয়ে আমার এক তরুণ রিমোট সেনসিং গবেষক বন্ধুর সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে প্রায় নিস্ফল ধাক্কাধাক্কির বর্ণনা। আমরা দেখতে চাই যারা আমাদের চেয়ে ভাল মানের স্যাটেলাইট ডেটা নিয়ে কাজ করেন তাদের এ ব্যাপারে উৎসাহী করে তোলা যায় কিনা।

ডিসেম্বরের ৯ তারিখে শ্যালা নদীতে তেল নি:সরণের খবর যখন প্রথম পেলাম তখন কয়েকদিন খুব মন খারাপ করে বসে ছিলাম। এর পর ফেসবুকে দেখলাম আহমেদ তাহমিদ নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশেনোগ্রাফির একজন ছাত্র বান্দরবনের পাহাড়গুলোর টপোগ্রাফির একটি ত্রিমাত্রিক ছবি দিয়েছে। উচ্চতা বেশি বা কমের উপর ভিত্তি করে ছবিতে ভিন্ন ভিন্ন রংও দেয়া আছে। ছবির নিচে কমেন্টের কথাবার্তা পড়ে দেখলাম সে অ্যাস্টার স্যাটেলাইট থেকে পাওয়ার তথ্য ব্যবহার করে ছবিটি তৈরি করেছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম যদি অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ দিয়ে দেয়া যায় তাহলে কি সে যেকোন জায়গার ছবি এভাবে প্রস্তুত করতে পারবে কিনা। সে জানালো চেষ্টা করে দেখবে। তখন আমি তাকে সুন্দরবনের যে জায়গায় তেল নি:সরণ হয় তার অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ (৮৯°৪০'১২.৪৪", পূ, ২২°২১'১৪"উ) দিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল যদি আমরা তেল নি:সরণের আগের ও পরের ছবিগুলো জোগাড় করতে পারি তাহলে একজন ইমেজ অ্যানালিস্ট প্রোগ্রামারকে অনুরোধ করব একটি প্রোগ্রাম লেখার জন্য যেটি সেই ছবিগুলোর তুলনামূলক পার্থক্যের তথ্যটি ব্যবহার করে দেখবে তেল নি:সরণের পর থেকে কোন কোন দিকে বেশি ছড়াচ্ছে আর কোন কোন দিকে কম ছড়াচ্ছে। এটি যদি আমরা ঠিকঠাক মত জানতে পারি তাহলে কি সুবিধা হবে? সেক্ষেত্রে আমরা বেছে বেছে সেসব জায়গায় যন্ত্রপাতি ও জনবল নিয়ে যেতে পারব যেখানে অবস্থা বেশি খারাপ। যেহেতু রিমোট সেনসিংয়ে আমার জ্ঞানের গভীরতা নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খানের কমন সেন্সের গভীরতার সমান কাজেই আমি জানতাম না এটি বাস্তবসম্মত আশা কিনা। গত কয়েকদিনের প্রচেষ্টার পরও আমি এখনও জানি না এটি বাস্তবসম্মত কিনা। এ কারণেই রিমোট সেনসিং নিয়ে যেসব বাংলাদেশী গবেষক দেশে বা বিদেশে কাজ করেন তাদের আগ্রহ তৈরির জন্য এই লেখা।

তাহমিদ এখন পর্যন্ত যা যা পেল তার আগে জেনে নেই যে জায়গা নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তা করছি তার কিছু বৈশিষ্ট্য। তথ‌্যগুলো তাহমিদই আমার জন্য লিখে দিয়েছে। প্রত্যেকটি ছবি ওরই তৈরি করা। কি ভাবে করেছে আমি জানি না, ঠিক যেমন শাহজাহান খানও জানেন না।

শ্যালা-পশুর নদীসংস্থান, ভৌগলিক অবস্থান ৮৯°৩৪´পূর্ব-৮৯°৪০´পূর্ব অক্ষাংশ এবং ২২°০০´উত্তর দ্রাঘিমাংশ-২২°২৪´উত্তর দ্রাঘিমাংশ, সুন্দরবন বাস্তুসংস্থানের অন্যতম মূখ্য একটি অংশ। এই জীববৈচিত্র্যপূর্ণ নদীসংস্থান ঘিরে শুধু অসংখ্য সরীসৃপ, শুশুক, হরিণের প্রজাতি নয় রয়েছে অসংখ্য ঝিনুক ও শামুক প্রজাতি (Bivalve & Mollusc) যারা পুরো বাস্তুসংস্থানের প্রাথমিক পর্যায়ের খাদক শ্রেণীর এবং অন্যতম উৎপাদক। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য বৈচিত্র্যময় কাঁকড়া এবং মৃত্তিকাবাসী আণুবীক্ষণিক জীব (Benthic Organisms) যারা মাটির দৃড়তা থেকে শুরু করে পুরো বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশেকল (Food Chain) পরিচালনায় সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শ্যালা নদীতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক অয়েল ট্যাঙ্কার সাউদার্ন স্টার ৭ দূর্ঘটনায় মোট ৩,৫৮,০০০ লিটার ফার্ণেস অয়েল পুরো শ্যালা-পশুর নদীসংস্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এই অয়েল স্পিলের ফলে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ সুন্দরবনের জলজ বাস্তুসংস্থান ও ফুডচেইন। নিচের চিত্রে অয়েল স্পিল পয়েন্ট ও তা ঘিরে থাকা খাল এবং নালা গুলোর অবস্থান দেখে আশেপাশের তেল ছড়িয়ে পড়া সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলগুলো চিন্থিত করা যায়। ছবিগুলো অ্যাস্টার স্যাটেলাইট ডেটা থেকে তৈরি।

এর পরের চিত্রটি শেল্যা-পশুর নদীসংস্থান ঘিরে থাকা মূল ওয়াটারশেড অঞ্চলের অর্থাৎ এই নদীসংস্থানের পানির উপর মূলত কোন অঞ্চলগুলো নির্ভরশীল সেগুলোর। তার পরবর্তী চিত্রটি শেল্যা পশুর নদীসংস্থান ঘিরে থাকা অঞ্চলের ডিজিটাল এলিভেশম ম্যাপ (DEM) যার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই অঞ্চলটির সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ উচ্চতা ৬৭ সে.মি.।

শ্যালা নদীর ওপরেই রয়েছে বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়ন যেটা রপ্তানীযোগ্য চিংড়ী এবং কাঁকড়া উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ এবং এই উৎপাদনের জন্যে প্রয়োজনীয় পানির জন্যে ইউনিয়নের বাসিন্দারা মূলত শ্যালা-পশুর নদীসংস্থানের উপর নির্ভরশীল। এবং এই অঞ্চলের মানুষের পানযোগ্য পানির প্রায় ১৬% আসে শ্যাল্যা-পশুর নদীসংস্থান থেকে। অত্যন্ত খরস্রোতা হওয়ার কারণে এই বিশাল পরিমাণ তেল ছড়িয়ে যেতে খুব অল্প সময় লেগেছে এবং এই তেল শুধু শ্যালা-পশুর নদীসংস্থান নয়, পার্শ্ববর্তী শিবসা নদীসংস্থানকেও সংক্রমিত করছে।

এক কথায়, শুধু সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুসংস্থান নয় আশে পাশের কৃষি এবং মৎস্যজীবী মানুষের জীবিকাও অত্যন্ত ঝুঁকির মুখে পড়েছে ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বরের অয়েল স্পিলের কারণে।

এখন তাহলে আমি ফিরে যাই সীমিত রিসোর্স দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে এখন পর্যন্ত কি করা গেছে।

৯ তারিখ তেল নি:সরণ হল। ১১ তারিখে ল্যান্ডস‌্যাট থেকে একটি স্যাটেলাইট ইমেজ নামানো গেছে যাতে দুইটি বড় স্পট চিহ্নিত নামানো গেছে । তাহমিদের ধারণা তেলের ভাসমান স্তর। মূল ছবিটি মেঘের কারণে বেশ অস্পষ্ট ছিল তাই ওকে প্রসেস করতে হয়েছে। আমি অবশ্য সাদা চোখে বুঝতে পারিনি।

তাহলে আমাদের এখন কি দরকার? আমরা যদি ১০, ১২, ১৩ তারিখের ছবিগুলো পাই তাহলে আমরা হয়তো প্রোগ্রাম লিখে বিশ্লেষণ করে জানতে পারব পরের দিনগুলোতে তেল কোন দিকে ছড়াবে। দু:সংবাদ হল তাহমিদ দেশে থাকে, এখনও ছাত্র তাই বিনে পয়সায় পাওয়া স্যাটেলাইট ইমেজই ভরসা। বিনে পয়সায় পাওয়া এই ছবিগুলোর সমস্যা হল আমরা যখন ইচ্ছা পাবো না। ওদের যখন সুবিধা ওরা দিবে। তাহমিদ পায় ৯ দিন পর পর। তার উপর আগের ছবিটি হল ৩ তারিখের সেটি আবার করাপ্টেড। ২০ তারিখ সে আরেক সেট তথ্য পাবে। কিন্তু এর মাঝে আমরা অনেক তথ্য হারিয়ে ফেলব। নিচে হল ল্যান্ডস্যাট ৭ থেকে পাওয়া ফ্রি ছবি দিলাম।

বিনে পয়সায় এর চেয়ে ভাল রেজ্যুলশনের ছবি পাওয়া যায় না। অভিযাত্রী ও পরিবেশকর্মী তানিম আশরাফ এখানে আগের দিন তেলের পাতলা স্তর দেখেছেন। আমাদের হাতে যে মানের ছবি আছে তাতে সেটি বুঝা যাচ্ছে না। আরো ভাল মানের ছবি থেকে সেটি বুঝা যায় কিনা কেউ জানালে খুব ভাল হত।

দেশের বাইরে যারা রিমোট সেনসিং নিয়ে কাজ করেন ও আরো ভাল ও ঘনঘন স্যাটেলাইট ছবি পান তারা কি একটু দেখবেন কিছু করা যায় কিনা?


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

আহমেদ তাহমিদকে সচলায়তনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের অনুরোধ করছি।

সুলতান এর ছবি

জাতিসংঘের একটি সহযোগী সংস্থা রিমোট সেন্সিং ইমেজ ব্যবহার করে সুন্দরবনের তেল নিঃসরণের ম্যাপ করেছে। তারা Radarsat-2 SAR ইমেজ সহ আরও কিছু ইমেজ ব্যবহার করেছে। নিচের লিংকে ম্যাপটি দেওয়া আছে।

https://www.unitar.org/unosat/node/44/2130

শেহাব এর ছবি

ওই ছবিগুলোর তো অনেক দাম।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

শেয়ার করলাম।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

স্যাম এর ছবি

দারুণ !
কোন সাড়া পাওয়া গেল?

অতিথি লেখক এর ছবি

রিমোট সেনসিং নিয়ে মাস্টার্সে কিছু কাজ করেছিলাম। দরকারি ও চমৎকার তথ্যবহুল দিক নির্দেশনা মূলক লেখা।
আফসোস সবই থেমে গেল। বিষয়টির সুরাহা হল না।

মহান অতন্দ্র।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।