(এই লেখাটি পত্রিকার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু বইমেলার সময় আর বেশি নেই আমি উইথড্র করে এখানে দিয়ে দিলাম।)
এই রিভিউটি যখন লিখছি তখন সুহান রিজওয়ানের "সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ" বইটি বাঁধাই হচ্ছে। আমি খট খট করে ল্যাপটপের কিবোর্ডে একটি একটি করে শব্দ টাইপ করছি আর একটু পর পর সামনে একটি হলুদ খামের উপর রাখা চারশো আটাশ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপিটির দিকে তাকাই। ও এই মুহুর্তে এখান থেকে প্রায় তেরো হাজার মাইল দূরে বাংলাবাজারের কোন একটি প্রেসে আস্তে আস্তে নিজের শরীর আর স্বত্ত্বা পাচ্ছে। কয়েকদিন পরেই ছাপাখানার ধূলো আর কালির ধূসর গর্ভ থেকে সুহানের এই বইটি বাংলা একাডেমীর ঝকমকে আলোমাখা উঠানে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা দিবে। আমি জানি প্রকাশক গর্বের সাথে প্রথম কপি সুহানের হাতে তুলে দিবে, লেখক সুহান তার প্রথম বইটি কাঁপা কাঁপা হাতে ধরে নিজের কান্না লুকানোর চেষ্টা করবে যাতে ক্যামেরায় চলে না আসে! কোন বইয়ের প্রথম কপি হাতে পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়, কিন্তু তার চাইতেও সৌভাগ্যের একটি ব্যাপার আছে। সেটি হল বইটির পাণ্ডুলিপি হাতে পাওয়া। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। কি করে হলাম? সম্ভবত: সুহান জানতো না আমি এর আগে কখনও কোন উপন্যাস রিভিউ করিনি!
এই উপন্যাসটির গল্প বলা ঢং আমাকে আঁকড়ে রেখেছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। বইটি আমার হাতে এসেছে গত বছরের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। আমি তার আগের সপ্তাহে কেবল মাত্র ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হাবিবুল আলম বীরপ্রতীকের লেখা 'ব্রেভ অফ হার্ট' স্মৃতিকথাটি পড়ে শেষ করেছি। সেই ঘোর থেকে বের হওয়ার আগেই ফেসবুকের দরজায় সুহানের ঠক্ ঠক্। মাঝখানে একটি পরীক্ষা (বই রিভিউর ফাঁকে ফাঁকে আমাকে পড়ালেখাও করতে হচ্ছে!) কোনমতে পার করে তারপর ধরলাম সুহানের পাণ্ডুলিপি। চলে গেলাম ঘোর থেকে ঘোরান্তরে! প্রথমবার পড়লাম পাঠক হিসেবে, দ্বিতীয়বার পড়লাম রিভিউ করার জন্য।
একটি উপন্যাস রিভিউ করতে হলে কি কি নিয়ে কথা বলা দরকার? অবশ্যই মূল বিষয় হল লেখকের গল্প বলার ঢং। তার সাথে এটি যেহেতু ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস কাজেই সাহিত্যিকের কল্পনার স্বাধীনতা ব্যবহার করতে গিয়ে ঐতিহাসিক তথ্যের ক্ষেত্রে বড়সড় কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেছে কিনা সেটিও দেখা দরকার। তবে আমি সবসময় এটিকে উপন্যাস হিসেবেই পড়েছি। আমার কাছে এই উপন্যাসের ছদ্মনাম হল "তাজউদ্দীনের জন্য সুহানের ভালবাসা"। আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আর সবার মত আমার নিজের কাছেও পরম শ্রদ্ধার পাত্র - এই উপন্যাস ছিল আমার জন্য একধরণের নিজের ভালবাসাকে নতুন করে আবিষ্কার করার মত। এখন আমি তাজউদ্দীন আহমদকে আরো বেশি ভালবাসি আর বলি,
আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের যুদ্ধদিনের সারথী হওয়ার জন্য। আপনি না থাকলে নয় মাসে আমরা নিজেদের জন্য এই স্বাধীন দেশটি পেতাম না। হয়তো পরবর্তী প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি নিজেও বনে বাদাড়ে লুকিয়ে থাকতাম আর শত্রুকে আক্রমণ করার সুযোগ খুঁজতাম। আপনাকে ধন্যবাদ আমার মাথার উপরে থাকা নিরাপদ নীল আকাশ আর পায়ের তলায় থাকা শক্ত মাটিটুকুর জন্য। বাংলাদেশের মানুষ নানা ভাবে আপনার জন্য সময়ে সময়ে তার ভালবাসা প্রকাশ করে যায়, যেমন সুহান করেছে তার এই ভালবাসায় গাঢ় উপন্যাসটি লিখে, এসব নিশ্চয়ই জীবন নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা আপনাকে স্পর্শ করে!
এই উপন্যাসটির দুইটি খন্ড। প্রথমটি হল পূর্ব খন্ড, যেটি ২৫শে মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের গল্প থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত (আরো নিখুঁতভাবে বলতে গেলে পাকিস্তানের জেল থেকে বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা পর্যন্ত। এই ব্যাপারটিতে লেখক সুহানের সাথে তাজউদ্দীন আহমদের কত মিল! তার কাছে যেমন বঙ্গবন্ধু ফিরে না আসা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি, সুহানের কাছেও ঠিক তেমনি মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে লেখা পূর্ব খন্ড শেষ হয়নি)। দ্বিতীয়টি হল উত্তর খন্ড - মূলত: আমাদের এই ক্ষণজন্মা নেতাদের দেশ গড়ার প্রতিকূল সময়ের গল্প যার সমাপ্তি ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট, তাঁদেরই রক্তস্রোতে।
প্রতিটি খন্ডের গল্প আবার কয়েকটি অধ্যায়ে ভাগ করে বলা হয়েছে। এই অধ্যায়গুলোর নামকরণ অদ্ভুৎ সুন্দর। এই নামগুলো আপনাকে বলবে না সেই অধ্যায়ে কি আছে, বরং বলবে সেই অধ্যায়টি পড়া শেষ হলে পাঠকের কেমন লাগতে পারে। প্রথম অধ্যায়ের নামটির কথাই ধরুন - "সীমান্তের সন্ধ্যা"। সন্ধ্যা একটি অদ্ভুৎ সময়, না দিন, না রাত। প্রথম অধ্যায়ের গল্পের সেই সময়টিও অদ্ভুৎ - পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শেষ করে এখন আরো বড় আকারে গণহত্যা শুরু করেছে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছেন, কিন্তু এখনও আমাদের সরকার তৈরি হয় নি, কাজেই আমাদের রাজনৈতিক পরিচয় এখনও পুর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি - ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণেই তাজউদ্দীনের আর্বিভাব। পাণ্ডুলিপি থেকে অল্প একটু করে তুলে দিলাম।
কিন্তু কৌতূহল কিছুতেই দমাতে পারছিলেন না গোলোক মজুমদার। থাকতে না পেরে অবশেষে আরোহীদের দিকে ফিরে তাদের পরিচয় চেয়েই বসলেন তিনি।'আমি আমীর-উল ইসলাম।', তরুণটি বলেন।
'আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একজন প্রতিনিধি মাত্র,' তরুণের সাথে ছোটখাট মানুষটি একটু হাসবার ভঙ্গি করে বলেন। 'আমার নাম তাজউদ্দীন আহমদ।'
জিপ ছুটে চলেছে দমদমের রাস্তায়। ইতিহাস তখনো জানে না - ইতিহাস জানবে আগামী দুইশত বাষট্টি দিনে - এই ছোটখাট মানুষটিই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ভেতরের বাইরের অগণিত শত্রুর সাথে লড়াই করে যাবেন প্রতিনিয়ত, বহুবার স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একক নির্ভুল সিদ্ধান্তে হতাশ করবেন স্বাধীনতার শত্রুদের। বঙ্গবন্ধুর প্রবল ব্যক্তিত্বের আড়ালে চিরকাল অনালোকিত থেকে যাওয়া এই মানুষটিই জাতির সবচেয়ে সংকটের সময়ে নেতৃত্ব দেবেন প্রচারের আড়ালে থেকে।
এই তাজউদ্দীন - হয়ে উঠবেন - ঊনিশশো একাত্তরের নি:সঙ্গ সেনাপতি।
এই জায়গায় অন্য কিছু ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাসের সাথে 'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণের' একটু পার্থক্য আছে। হুমায়ুন আহমেদের 'দেয়ালে' তাজউদ্দীন আহমদ প্রধান চরিত্র নন। সত্যি বলতে কি সেই উপন্যাসে প্রধান চরিত্ররা সবাই কাল্পনিক, বঙ্গবন্ধু আর তাজউদ্দীনের কথা এসেছে মূলত: ইতিহাসের তথ্যনির্ভর কাঠামোটি ধরে রাখার জন্য, ঠিক যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'পূর্ব-পশ্চিম' উপন্যাসটির মত। সে তুলনায় আনিসুল হকের 'যারা ভোর এনেছিল' আর 'ঊষার দুয়ারে' এই দুইটি উপন্যাসে ঐতিহাসিক চরিত্ররাই মূল খেলোয়াড় - তারাই গল্পগুলো এগিয়ে নিয়ে যায়। 'যারা ভোর এনেছিল' আর 'ঊষার দুয়ারে' এই দু'টি উপন্যাসের গল্পের সময়কাল হল পঞ্চাশ ও ষাটের দশক যখন তাজউদ্দীন আস্তে আস্তে ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের স্রষ্টার যোগ্য হওয়ার জন্য পাঠ নিচ্ছেন, প্রস্তুত হচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই এই দু'টি উপন্যাসে তাজউদ্দীনের উপস্থিতি কম, এমনকি চরিত্র হিসেবেও গভীরতা কম। আমি চরিত্রের গভীরতা বলতে বুঝাচ্ছি একটি চরিত্র যখন গল্পের সামনের দিকে এগুনোর পথে কোন বাঁধার সম্মুখীন হয় তখন সে তার মত করে বাঁধা গুলো একের পর এক ডিঙাতে থাকে। এই ডিঙানোর সময়ই চরিত্রটির নানা দিক পাঠকের কাছে আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে থাকে এবং একসময় পাঠক চরিত্রটির পক্ষে বা বিপক্ষে চলে যায়। এভাবেই কোন গল্পে চরিত্রের গভীরতা সৃষ্টি হয়। অল্প পরিসরে তাও তাজউদ্দীন চরিত্রটিকে একটু গভীরতা দিয়েছেন হুমায়ুন আহমেদ তার 'দেয়াল' উপন্যাসে। সেই জায়গাটুকু এখানে দিয়ে দেই।
খন্দকার মোশতাক বললেন, বাজারে চালু গুজবটা কি শুনেছেন?কী গুজব?
তাজউদ্দীনকে নাকি আপনি আবার মন্ত্রীসভার সদস্য করছেন।
কী আশ্চর্য কথা!
খন্দকার মোশতাক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এই গুজব তাজউদ্দীন নিজেই ছড়াচ্ছে। যাতে আবার ফিরে আসতে পারে।
বঙ্গবন্ধু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
খন্দকার মোশতাক বললেন, অন্য কারও বিষয়ে আপনার সাবধান হওযার প্রয়োজন নাই। তাজউদ্দীনের বিষয়ে শুধু সাবধান থাকবেন।
প্রিয় পাঠক, হুমায়ুন আহমেদকে কেন গল্পের জাদুকর বলা হয় তার একটু ধারণা এখান থেকে বুঝা যাবে। 'দেয়াল' উপন্যাসটি তাজউদ্দীনকে নিয়ে নয়, কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ নিশ্চয়ই জানতেন তাজউদ্দীনের সময়ের গল্প তাজউদ্দীনকে ছাড়া করাটা একটু কেমন যেন। হয়তো সে কারণেই সেই সময়ের সবচেয়ে খারাপ মানুষ খন্দকার মোশতাকের জবানীতে তাজউদ্দীনকে একজন সমস্যা হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন। এর ফলে যারাই খন্দকার মোশতাককে চিনে বা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে একটু হলেও জানে তারাই সাথে সাথে মনে মনে তাজউদ্দীনের পক্ষ নিয়ে নিবেন। কারণ সূত্র তো খুবই সহজ - খন্দকার মোশতাকের শত্রু মানে বাংলাদেশের বন্ধু কাজেই আমারও বন্ধু!
একই কাজ আনিসুল হকও তার 'ঊষার দুয়ারে' উপন্যাসে খুব সুন্দর করে করেছেন। যে সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ তার সাম্প্রদায়িক নামটি পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ নামটি নিল আর দলের নতুন কমিটি করল (আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে এরকম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কী খুব বেশি আছে?) সেই সভা থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু যখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন তখন রেনুর (বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব) জবানীতে আনিসুল হক জিজ্ঞেস করলেন, তাজউদ্দীন কমিটিতে কি পদ পেয়েছেন। একটি জিনিস মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে যেকোন কাহিনীতে আমার দৃষ্টিতে দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র হলেন তার স্ত্রী রেনু। গল্পের সবচেয়ে প্রধান চরিত্রগুলোর একটির ভাষায় তাজউদ্দীনের খবর জিজ্ঞেস করা মানেই পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেয়া যে হয়তো এই কাহিনীতে নয় কিন্তু ইতিহাসের কোথাও না কোথাও তাজউদ্দীন নামে আরেকটি চরিত্র মহাকাব্যের গভীরতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন - তার গল্প আরেকদিন হবে।
হুমায়ুন আহমেদ আর বেঁচে নেই, হয়তো আনিসুল হক এক সময় তার পরবর্তী পর্ব লিখবেন, কে জানে হতে পারে তাজউদ্দীনকে ঘিরেই! কিন্তু আমরা সৌভাগ্যবান, তার জন্য আমাদের বসে থাকতে হচ্ছে না। সুহান তার ভালবাসার অক্ষরে আমাদের সামনে তাঁকে নিয়ে এসেছেন - একটি ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস যার সবচেয়ে গভীর চরিত্র তাজউদ্দীন।
আমি একটু আগে বলেছি একটি গল্পে কোন চরিত্রের গভীরতা সৃষ্টি হয় যখন সে তার সামনে থাকা বাঁধার পাহাড়গুলো একটির পর আরেকটি ডিঙাতে থাকে। এই এগুনোর পথে চরিত্রটি কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, কিছু কাজ করে। এসব দেখে পাঠক কখনও তার পক্ষ নেয়, কখনও হতাশ হয়, কখনও পাঠক রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে। এভাবে আস্তে আস্তে পাঠক নিজেকে চরিত্রটির জায়গায় নিয়ে যায়। তাই যখন আমি উপন্যাসটি পড়ে শেষ করলাম আমার মনে হচ্ছিল আমি তাজউদ্দীন আহমদের হয়ে একটি যুদ্ধে লড়ছি। এই সুদীর্ঘ সময়টিতে মানুষটির একাকিত্ত্ব আমাকে স্পর্শ করে, আমার মনে হয় আমি এমন এক যুদ্ধক্ষেত্রে আছে যেখানে আমার পক্ষে কেউ নেই, কিন্তু লড়াই চালিয়ে যেতেই হবে। কারণ দেশের জন্য আমার একতরফা ভালবাসাই আমার শক্তি।
তাজউদ্দীন চরিত্রটিকে সুহান এই গভীরতা কী করে দিল? গল্পে তার বাঁধাগুলো কী ছিল? প্রথমবার যখন আমি পাণ্ডুলিপিটি পড়ি তখন আমার মনে হয়েছে ভারত সরকার, পাকিস্তান সেনাবাহিনী, প্রতিকূল সময় সব ছাপিয়ে তাজউদ্দীনের নেমেসিস হলেন দুই জন - মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারে তার সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদ আর মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক শেখ মনি।
তারপর রিভিউ করার জন্য আমি দ্বিতীয়বার পড়তে গিয়ে মনে হল আগের বার তো আমি আসল ব্যাপারটিই ধরতেই পারিনি! এই উপন্যাসের নায়ক তাজউদ্দীনের প্রতিনায়ক তো তাজউদ্দীন নিজেই। কেমন করে? তাজউদ্দীন ব্যক্তিটিকে আমরা যতটুকু জানি তাতে বুঝতে পেরেছি সারাজীবন তিনি তার চারপাশে অনেক মানুষেরই খুব কাছাকাছি থেকেছেন। তার গভীর মমতা আর তীক্ষ্ম বিবেচনাশক্তি তার চারপাশের মানুষকে সবসময় স্পর্শ করে গেছে। একসময়ের তুখোড় মেধাবী এই ছাত্র স্কুলের প্রধানশিক্ষক থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের কমিটির দায়িত্ব পর্যন্ত কত বিচিত্র কাজই না করেছেন। একই সময় তিনি আবার চারটি ফুটফুটে ছেলেমেয়ের বাবা। কিন্তু ঊনিশশো একাত্তর সালে এসে কি হল? এতদিন বাঙ্গালীর রাজনীতির শেষ কথা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ২৫শে মার্চ থেকে তিনি কারাগারে, পরের নয় মাসের জন্য তাজউদ্দীন আহমদ সেই দায়িত্ব নিলেন। এখন আর কোন সিদ্ধান্তে সমস্যা হলে মাথার উপরে মুজিব ভাই নেই। সময় এখন পরীক্ষা নিচ্ছে সেই আগের বিশ বছরে তাজউদ্দীন রাজনীতি কেমন শিখলেন। শেখ মুজিবের অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্বটি এখন তাজউদ্দীনের ঘাড়ে। সবসময় যাদের জন্য তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন তাদেরই কাউকে কাউকে তিনি দেখলেন তার পিঠে ছুরি মারতে। চাইলেই এখন সবার জন্য বুক পেতে দিতে পারেন না, তার আগে শতবার ভাবতে হয়। কারণ তিনি জানেন তাঁর যদি কিছু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে যে সংকট সৃষ্ট হবে তা হয়তো আমাদের স্বাধীনতাকে দশক বা শতক পেছনে নিয়ে যেতে পারে। যুদ্ধক্ষেত্রের মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্টের ভাগ নেয়ার জন্য সংকল্প করলেন যতদিন দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত প্রেমময়ী স্ত্রী আর আদরের সন্তানদের থেকে দূরে নিজ অফিসেই রাতে থাকবেন। এই তাজউদ্দীন তো সেই তাজউদ্দীন নন যিনি পঞ্চাশ আর ষাটের দশকের রাজনীতি করে এসেছেন। এতো নিজের স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব থেকে অদ্ভুৎ অলৌকিক বিচ্যুতি যেটি তাকে কষ্ট দেয় কিন্তু বাঁধা দেয় না। এই নতুন তাজউদ্দীনই আমার চোখে এই উপন্যাসের প্রতিনায়ক। জীবনের চেয়ে বড়, সময়ের চেয়ে বড় এই নতুন তাজউদ্দীন আমাদের বার বার স্মরণ করিয়ে দেয় নিজেকে কত ভাবেই না তিনি কতকিছু থেকে বঞ্চিত করেছে শুধুমাত্র দেশের জন্য যুদ্ধজয় করতে হবে বলে। যার প্রতিনায়ক সে নিজে তার চেয়ে একাকী পৃথিবীতে আর কেউ নেই। এ কারণেই তাজউদ্দীন তার কন্যা সিমিন হোসেন রিমির ভাষায় নি:সঙ্গ সারথী, আমাদের সুহানের ভাষায় যুদ্ধদিনের নি:সঙ্গ সেনাপতি।
নায়ক আর প্রতিনায়কের পর পাঠক হিসেবে আমার কাছে একটি উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ দিক হল তার কথক অর্থাৎ যে গল্পটি বলে যায়। এই ব্যাপারটি ভাল করে বুঝার জন্য আমি একটি ছোট এক্সপেরিমেন্ট করেছি। 'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ' বইটি পড়ার পরপরই আমি ‘দেয়াল’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘মা’, ‘যারা ভোর এনেছিল’, ‘ঊষার দুয়ারে’ - ইতিহাসনির্ভর এই পাঁচটি উপন্যাস আবার ঝটপট পড়ে ফেললাম। আমার কাছে মনে হয়েছে কথক হিসেবে আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে রেখেছেন হুমায়ুন আহমেদ। আর সবচেয়ে বেশি থমকে থমকে গেছি আমি আনিসুল হকের বইগুলি পড়ে। তবে আমি জানিনা সবাইকে এভাবে মাপা যায় কিনা, হয়তো যাবে না। হুমায়ুন আহমেদের কথক একাধিক - কখনও চরিত্র নিজে, কখনও লেখক নিজে যে চরিত্রের বাইরেও ঐ মুহুর্তের জগৎটিকে দেখতে পায়। তবে এই জায়গায় সুহান আর আনিসুল হকের সাথে হুমায়ুন আহমেদের পার্থক্য হল প্রথম দুইজনের গল্পে কথক যখন লেখক থাকেন কখনও কখনও তিনি ভবিষ্যৎ দেখতে পান যেটি কথক হুমায়ুন আহমেদ পাননা (ইচ্ছে করেই, এটি তার নিজস্ব ধরন)। কেন যেন হুমায়ুন আহমদের এই কথকটিকে আমার ভাল লেগে গেছে। তার গল্প বলার ঢঙয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হল চরিত্র বা লেখক নিজে যেই কথক হোন না কেন এক সময় সে পাঠকের সাথেও কথা বলা শুরু করে তাকে গল্পের একটি চরিত্রে পরিণত করে। যে উপন্যাসটি পড়ছি তার একটি চরিত্র হয়ে যাওয়ার চেয়ে আনন্দের আর কী থাকতে পারে?
আনিসুল হক আর সুহানের কথক, যিনি কখনও কখনও ভবিষ্যৎ দেখতে পারেন, তার কিন্তু আবার অন্য ধরণের একটি সুবিধা আছে। সেটি কি? এটাকে বলা হয় ক্লিফহ্যাংগার বা এর-পর-কি-হবে-কি-হবে আশংকা! প্রত্যেকটি অধ্যায়ের শেষে এই ক্লিফহ্যাংগারটিই হল লেখক হিসেবে সুহানের অব্যর্থ মারণাস্ত্র। কিরকম? তার একটি নমুনা দেই। পূর্ব খন্ডে একটি অধ্যায় হল 'কাঁটার মুকুট'। এই অধ্যায় শেষ হল কি ভাবে? আমি তুলে দিচ্ছি।
আনিসুজ্জামান একদৃষ্টিতে দাবার বোর্ডের নড়বড়ে এই অদ্ভুৎ মন্ত্রীটির চোখেরদিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাজউদ্দীনও তীব্র লাল চোখে তাকিয়ে আছেন আনিসুজ্জামানের চোখে। দুজনের কেউই চোখ সরিয়ে নিচ্ছেন না।
এখানেই অধ্যায়টি শেষ! পাঠক হিসেবে আমার অবস্থার কথাটি একবার ভাবুন! আমি জানি না এর পড়ে কত নম্বর পৃষ্ঠায় গিয়ে আবার তাজউদ্দীন আর আনিসুজ্জামানকে এক সাথে পাব, আমি জানি না তাজউদ্দীন নড়বড়ে হতে হতে ভেঙে পড়বেন না কোনভাবে টিকে যাবেন, আমি শুধু জানি এই বই শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার নাওয়া খাওয়া বন্ধ। আমাকে জানতেই হবে তাজউদ্দীন কিভাবে জিতে গিয়েছিলেন। এই ক্লিফহ্যাংগারের ম্যাজিক সুহানের মনে হয় হাতযশ, এটি যে তার প্রথম উপন্যাস! একই রকম চেষ্টা করার পরও 'ঊষার দুয়ারে' উপন্যাসে আনিসুল হকের ক্লিফহ্যাংগার আমাকে তেমন টানেনি। অল্প কিছু জায়গায় তার মূল কথক ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী আমাকে গল্পের ভিতর ঢুকাতে পেরেছে, বেশিরভাগ সময়ই আমার মনে হয়েছে তারা বিটিভির খবর পড়ছে। তবে যেহেতু আনিসুল হক নবীন লেখন নন আমার কেন যেন মনে হয় এটা তার এক ধরনের এক্সপেরিমেন্ট। কে জানে আমার ভাল না লাগলেও অন্য কারো হয়তো লেগেছে।
এক ধাক্কায় যখন কয়েকটি ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস পড়ে ফেললাম তখন আরেকটি ব্যাপার আমার চোখে লাগল। কেন যেন মনে হয় ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস লেখা লেখকের জন্য অনেকটা সরু সুতোর উপর দিয়ে হাঁটার মতো। অনেকেই গল্প করতে করতে এক সময় এর ভিতরে সরাসরি ডকুমেন্টেশন ঢুকিয়ে দেন। এই দিক দিয়ে আমার কাছে পড়তে সবচেয়ে আরাম লেগেছে সুহানের 'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ' ও সুনীলের 'পূর্ব-পশ্চিম'। কোনটাতেই ধুম করে কোন ঐতিহাসিক বক্তব্য বা সংবাদ একদম পাঠ্যবইয়ের স্টাইলে দেয়া নেই। তাই বলে কি এই দু'জন লেখক সেগুলো এড়িয়ে গেছেন? একদমই নয়। তারা সেগুলো একাধিক চরিত্রের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে গল্পে ঢুকিয়েছেন। সেই তুলনায় আনিসুল হকের 'যার ভোর এনেছিল' আর 'ঊষার দুয়ারে' আরেকটু কম আরামদায়ক। তিনি মাঝে মাঝে পত্রিকার রিপোর্ট বা আদালতের জবানবন্দী ধুপ করে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আর সবচেয়ে অস্বস্তি লেগেছে হুমায়ুন আহমেদের দেয়াল পড়ে - প্রত্যেক অধ্যায়ের পরে আবার ঐতিহাসিক ডকুমেন্টেশন পড়ে মনে হচ্ছে আমি একবার গল্প পড়ছি আরেকবার ইতিহাস বই পড়ছি আর একটু পরেই পরীক্ষা দিতে হবে! আমি পরে চিন্তা করলাম কেন সুহান বা সুনীলের লেখার এই দিকটি আমার কাছে বেশি আরামদায়ক লেগেছে। তখন বুঝলাম, একটি গল্পে পাঠককে ধরে রাখার সবচেয়ে বড় উপায় হল তাকে সবসময় টেনশনে রাখা। এই টেনশন অনেকভাবে তৈরি করা যায়। তার মধ্যে একটি ভাল বুদ্ধি হল একাধিক চরিত্রের কথন প্রতিকথনের মধ্য দিয়ে দরকারী তথ্য তুলে ধরে ইতিহাসের কাঠামোটি ধরে রাখা। এতে পাঠক সবসময় ব্যস্ত থাকবেন ওই কথোপকথনের ফলাফল কি হবে সেই টেনশনে কিন্তু অবচেতন মনে তার মধ্যে ডকুমেন্টেশনটি হয়ে যাবে।
দ্বন্ধের ব্যাপারটি যখন এলো তখন আরেকটি ব্যাপারও বলে ফেলি। হুমায়ুন আহমেদ কেন দুর্দান্ত লেখক? একটি কারণ হতে পারে তিনি তার কাহিনীর এক একটি ভাঁজ খুলেন চরিত্রগুলোর কথোপকথনের মাধ্যমে। সুনীলও তার ব্যতিক্রম নন। ঠিক এই ব্যাপারটি সুহানও ধরে ফেলেছেন। পুরো উপন্যাসটির গল্পের একটি একটি মোড় নিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর কথোপকথনের মাধ্যমে। দুইটি চরিত্রের মধ্যে আলাপচারিতা যখন পড়ছি তখন অবচেতন মনেই আমি কোন না কোন চরিত্রের পক্ষে চলে যাই আর অপেক্ষা করতে থাকি আমার প্রতিপক্ষ (আসলে ওই চরিত্রের প্রতিপক্ষ) কি বলে আর তখন আমাকে কি করতে হবে। প্রথম উপন্যাসেই যে লেখক এই ব্যাপারটি রপ্ত করে ফেলেন তার পাণ্ডুলিপির পাঠককে সৌভাগ্যবান বলতেই হয়! ঘটনাচক্রে আনিসুল হকের 'যারা ভোর এনেছিল' উপন্যাসে এই কথোপকথন ব্যাপারটি নেই বললেই চলে। এ কারণে আমার মনে হয়েছে প্রত্যেকটি চরিত্র আর আমার মাঝখানে আনিসুল হক দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হয়েছে তার চরিত্রগুলোর নিজস্ব কোন প্রাণ নেই, কোন স্বত্ত্বা নেই - তারা তাই করছে যেটি লেখক তাদের করাতে চান। কাহিনীর দ্বিতীয় পর্ব 'ঊষার দুয়ারে' উপন্যাসটিতে অবশ্য আমি সেই সমস্যাটি খুব একটা অনুভব করিনি। আমার খুব ভাল লাগছে দেখে যে সুহানের গোড়া থেকেই এই ব্যাপারটিতে ভাল দখল আছে।
পাঠক হিসেবে আমার একটি সমস্যা আছে। যেকোন উপন্যাসে আমি খুঁজে দেখি লেখক প্রকৃতিকে কিভাবে বর্ণনা করেছেন। প্রিয় পাঠক, আপনি ঠিকই ধরেছেন, যাদের বই পড়ে ছোটবেলায় আমার অভ্যাস তৈরি হয়েছে বিভূতিভূষণ তাদের মধ্যে একজন। কাজেই গল্পের মধ্যে নিসর্গের বর্ণনা আলাদা করে খোঁজার এই রোগ আমার কোনদিন সারবে না। সুহানের লেখার হাত আমাকে এ রোগ ধরে রাখার প্রশ্রয় দেয়। এই অংশটি বইটির উত্তর খন্ড থেকে নেয়া।
অনেকটা ঠিক প্রভাতফেরির মতোই। সূর্য আকাশে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি এখনো, শত বছরের পুরোনো চার্চবাড়ির মতোই ঝুরঝুরে নরম আলো অন্ধকার চারপাশে। সামান্য নড়াচড়াতেই যেন স্বপ্নদৃশ্যের মতো ভেঙ্গে যাবে সবকিছু।অথচ এমন আলোতেই দেখো, সাতমসজিদ সড়কের মাইল খানেক দূর হতেই একুশের প্রভাফেরির মতো মানুষের কেমন দীর্ঘ সারি। তারা নীরবে ঢুকছেন নীচতলার ঘরটিতে, শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন তাদের প্রিয় একজন মানুষকে, মাথা নীচু কর বেরিয়ে আসছেন টলমল চোখে।
আমি শুধু পড়ি আর অবাক হয়ে ভাবি আগের চারশো পৃষ্ঠা জুড়ে তিল তিল করে যে চরিত্রটি সুহান তৈরি করলেন তাকে এখানে এসে মেরে ফেলার পরও সুহান কী করে প্রকৃতির এই অদ্ভুৎ অপরুপ বর্ণনা দিতে পারেন? সুহানের চোখ দিয়ে কি একটুও জল গড়ায়নি? আমার চোখ যদি এখানে এসে ঝাপসা না থাকত আমি হয়তো দেখতাম হুমায়ুন আহমেদের গল্পের কথক যেভাবে পাঠকের সাথে কথা বলে বলে প্রকৃতি নিয়ে তার সেটি একটু একটু করে তৈরি করেন সেটি সুহানের লেখায় নেই। কিন্তু তাতে কী? তাজউদ্দীনের মৃত্যুর গল্প বলার মধ্য দিয়ে সুহান যে হাহাকার আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলেন সেটি কি একটুও কম হয়েছে? না কম হয় নি। পুরো বইটি জুড়ে একধরণের ভালবাসা মাখা বিষাদের গোপন সুর বাজতে থাকে। এর রেশ আপনি বইটি বন্ধ করে শেলফে রেখে দেয়ার পরও থেকে যাবে।
যেহেতু এটি ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস কাজেই পাঠক নিশ্চয়ই আশা করেন ঐতিহাসিক তথ্য উপস্থাপনের ব্যাপারে যদি কোন ভুল থাকে সেটি আমি বলব। সত্যি বলতে কী প্রথম বার পাণ্ডুলিপিটি পড়ে আমি সুহানকে যে ১৫টি খটকা / প্রশ্নের কথা জানিয়েছিলাম সেগুলোর বেশিরভাগই মামুলি বানান ভুল টাইপের। ঐতিহাসিক সত্য নিয়ে খটকা ছিল কেবল দু'টি - ক্র্যাক প্লাটুনের কাজী কামালউদ্দীন যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তল্লাশীর মাঝখান থেকে পালিয়ে সহযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীকের বাড়িতে যান তখন তাকে কাপড় দিয়েছিলেন আলমের বোন যদিও সুহান লিখেছেন মা। তবে আমার মনে হয় না এটা আদৌ কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন কোন পাঠকের কাছে বরং আরেকটি ব্যাপার খটকা লাগতে পারে। মেজর খালেদ মোশাররফের বিখ্যাত উক্তি, "স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না", তিনি জিপ থেকে নেমেই বলেননি বরং নামার পরে বেশ কিছুক্ষণ বক্তৃতা দিয়ে তার মাঝখানে বলেছিলে। সুহানের সাথে কথা বলে বুঝলাম সে গল্পের সৌন্দর্য রক্ষার জন্যই এটি করেছে। আমি শুরুতেই বলেছি, সুহান হল ক্লিফহ্যাংগারেের জাদুকর। খালেদ মোশাররফের এই কথাটি দিয়েই সে সেই অধ্যায়টি শেষ করেছে।
সতর্ক পাঠকদের কেউ কেউ মনে মনে ভাবছেন একজন পাঠকের একটি বইয়ের সবকিছুই একটু ভাল বা বেশি ভাল লাগতে পারে না, কিছু না কিছু থাকবেই যেটি তার ভাল লাগে নি, এই ব্যাটা এখনও সেদিকে যাচ্ছে না কেন? আমি স্বীকার করছি এই উপন্যাসে একটি ব্যাপার আমি ভয়াবহ রকম মিস করেছি। সেটি হল জোহরা তাজউদ্দীনকে। কোন জোহরা তাজউদ্দীন? ব্যক্তি জোহরা তাজউদ্দীন? না তাকে নয়, আমি মিস করেছি সেই জোহরা তাজউদ্দীনকে যাকে তার বর তাজউদ্দীন আহমদ ভালবাসতেন। আমাদের মু্ক্তিযোদ্ধারা মাঠে ঘাটে বনে বাদাড়ে খেয়ে না খেয়ে যুদ্ধ করছেন আর তিনি কলকাতায় বসে আছেন (যদিও সেটি কম বড় যুদ্ধ নয়) এই ব্যাপারটি তাজউদ্দীন আহমদকে ভীষণ পীড়া দিত। এ কারণেই তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যুদ্ধে না জেতা পর্যন্ত পরিবার থেকে আলাদা থাকবেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এই ত্যাগের সাথে তাজউদ্দীনের এই ত্যাগের সম্পর্ক কোথায়? নিশ্চয়ই জোহরা তাজউদ্দীন ছিলেন তার জীবনের এমন কেউ যার থেকে আলাদা থাকা তার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। এই অশেষ প্রেমকে জিম্মি করেছিলেন তাজউদ্দীন নিজের কাছে নিজে। অনেকে বলতে পারেন সে সময় তো তাজউদ্দীন জোহরার কাছ থেকে আলাদাই ছিলেন, বলতে গেলে দেখাই হতো না, তাহলে গল্পে আসবে কি করে? প্রিয় পাঠক, আমি আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, আমি ব্যক্তি জোহরাকে চাই না, আমি চাই প্রেমিকা জোহরাকে যাকে তাজউদ্দীন তার যুদ্ধজয়ের পথে কখনও কখনও মিস করতেন। যখন তার একাকী সময় থাকতো তিনি কি একবারও তার স্ত্রীকে ভাবেননি? মোটা চশমার আড়ালে কি একবারও অশ্রু জমেনি? কখনও কোন সংকটে তিনি কি একবারও ভাবেননি এই সময় জোহরা তার পাশে থাকলে কি পরামর্শ দিত? দায়িত্বের সাথে প্রেমের এই মহাকাব্যিক দ্বন্ধ যদি সুহান তার কলমে আনতে পারতেন তাহলে এই উপন্যাসে আমার কষ্টের ভাগটুকু হয়তো আরো বাড়ত, কিন্তু তাজউদ্দীনকে আমরা যখন ভালবাসি তখন এটা জেনেই ভালবাসি যে তিনি আমাদের ট্র্যাজিক হিরো, কষ্টের আগুনে তিল তিল করে পোড়াই যার জীবনের গল্প। আরেকটি ব্যাপার - বঙ্গবন্ধুর রেনুর সাথে কিন্তু জোহরা তাজউদ্দীনের একটি বড় পার্থক্য আছে। যেসময় মিলিটারী স্বৈরশাসক (আফসোস তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন!) জিয়াউর রহমান তলোয়ারের খোঁচায় সব দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিচ্ছেন, এই জোহরা তাজউদ্দীনই কিন্তু তখন আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন। যেসময় মুক্তিযুদ্ধের ফসল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এসব মূলনীতি দেশের সংবিধান থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেই কোনমতে টিকে আছে - জোহরা তাজউদ্দীন তখন ছিলেন গোটা দেশের সবচেয়ে উজ্জ্বল দীপশিখা। এই মানুষটির সাথে তাজউদ্দীনের প্রেম যে লেখক তার কলমে ধরতে পারবেন তিনি নিশ্চয়ই অসাধারণ মেধাবী হবেন। কে জানে সুহান বা অন্য কেউ তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সেটি রেখে দিয়েছে কিনা!
আমি 'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ' পাণ্ডুলিপিটি পড়েছি, বইয়ের ঘ্রাণটি এখনও পাইনি। যেহেতু দেশের বাইরে থাকি কাজেই অনলাইনে কেনার পর যখন হাতে এসে পৌঁছুবে তখন সেটি আমার কাছে বইমেলা ২০১৫ এর সব নতুন বইয়ের গন্ধই নিয়ে আসবে। আমি তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। প্রকাশক শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদ টুটুলের জন্য আসলে কি বলব বুঝতে পারছি না। একজন মানুষ যে ব্যবসার ঝুঁকি নিয়ে আনকোরা একজন লেখকের চারশো চল্লিশ পাতার বিশাল প্রথম বই প্রকাশ করে তার সাহস বেশি বলব না তাজউদ্দীনের জন্য ভালবাসা বেশি বলব জানি না।
সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ
সুহান রিজওয়ান
শুদ্ধস্বর, কাঁটাবন, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি,২০১৫
প্রচ্ছদ: স্যাম
মূল্য : ৪৫০ টাকা (বইমেলা চলাকালীন)
মন্তব্য
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
একাডেমিক রিভিউ আর সাহিত্যের রিভিউতে ফারাক থাকে।
সাহিত্যের রিভিউ তে আবেগ দুষ্টু শিশুর মত কোলছাড়া হবার জন্য আকুপাকু(চন্দ্রবিন্দু হবে মনে হয়)করতে থাকে।
একে বশে রাখা কঠিনসাধ্য ব্যাপার বটে; আর লেখক যদি হন পরিচিত কিংবা সহব্লগার তবে তো হয়েই গেলো!
শেহাবভাইয়ের অবস্হাটা বুঝতে তাই কষ্ট হয় না।
তবে পাঠক হিসেবে আমি যখন শুধুই "সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ" বা তার লেখককের ব্যাপারে পড়তে/জানতে ভীষণ রকম আগ্রহী
তখন হুমায়ুন আহমেদের "দেয়াল" আনিসুল হকের উল্লেখিত দুটি উপন্যাস বা সুনীলের "পূর্ব পশ্চিম" নিয়ে আলোচনাটা
কিছুটা ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটিয়েছি। তবে শেষদিকে স্বস্তি ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন রিভিউয়ার। গল্প-উপন্যাসের রিভিউ আসলে ঠিক কেমন হতে হয় সঠিক জানা নেই। তাই ভুল কিছু বলে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।
-----------
সচলে সুহানের 'একাত্তরের সেনাপতি'সহ কিছু কিছু পড়া আছে বলেই জানি, নির্মোহভাবে সুহান লিখতে জানেন।
সুহানের প্রথম বই'য়ের জন্য অভিনন্দন! তার বইটা খুব খুব খুবব করে পাঠকপ্রিয়তা পাক, শুভকামনা।
------------
ইচ্ছা আর ঈর্ষা নাকি দুই জমজ বোন। সে দুইবোন এখন সই হয়ে বসেছে পাশে।
ইচ্ছা রাখি প্রচণ্ড, বইটি দেশ থেকে আসবে, এবং পড়বো।
ঈর্ষা করছি আপনাকে, আগেভাগেই কেমন পাণ্ডুলিপি পড়ে ফেলেছেন বলে
-----------
অদ্ভূৎ, রুপ, দ্বন্ধ 'র মত দু একটা টাইপো চোখে লেগেছে ভাইয়া।
আমি এর আগে কখনও ফিকশন রিভিউ করি নাই। কিকরে করতে হয় আমিও জানি না।
অদ্ভূৎটি কেন যেন খুঁজে পাচ্ছিনা, আবার দেখব। বাকিটা ঠিক করলাম। অনেক ধন্যবাদ! ইর্ষা আর ইচ্ছার একটা ছোট বোন আছে। তার নাম ইটা। আপনি বইটা পড়ার জন্য ইটা রেখেছেন। নিশ্চয়ই আপনার স্বপ্নপূরণ হবে!
সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ
সুহান রিজওয়ান
শুদ্ধস্বর, কাঁটাবন, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি,২০১৫
প্রচ্ছদ: স্যাম
মূল্য : ৪৫০ টাকা (বইমেলা চলাকালীন)
বইটা পড়ার জন্য এমনিতেই হাত নিশপিশ করছে, রিভিউটা পড়ে আরও উদগ্রীব হয়ে গেলাম। শেহাব ভাইকে ধন্যবাদ তার রিভিউ এর জন্য।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...
দারুণ রিভিউ। বইটি পড়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
শুধু আপনার ব্যাখাতেই রিভিউটা অসাধারণ হয়ে উঠেছিলো। আনিসুল হককে আলোচনায় এনেছেন কিন্তু তার লেখার কোন সাক্ষ্য দেননি। এছড়া একজনের লেখাকে আরেকজনের লেখার সাথে একাডেমিক (বই টু বই) তুলনা করে বিচার করা কতটা যুক্তিক সেটা ঠিক আমার বোধগম্য নয়। সুহান ভাইয়ের প্রতি শুভকামনা, বইটির জন্যে আমিও অপেক্ষা করছি।
(মডুদের কাছে অনুরোধ এই পোষ্ট স্টিকি করা হোক)
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
দুইটা বেশ ভালো পয়েন্ট।
আমি প্রফেশনালি পপুলার ম্যাথ বই রিভিউ করি। হয়তো সেটার প্রভাব পড়েছে এই প্রজেক্টে।
শেহাব ভাই আপনার রিভিউ অসাধারণ হয়েছে কোন সন্দেহ নেই। তবে শুধু বই টু বই তুলনাটা ব্যাক্তিগত ভাবে আমার কাছে খটকা লেগেছে, হয়তো অন্য কারো কাছে এটিই বেশি ভালোলাগবে। কয়েকটি জায়গায় দারুণ মুগ্ধ করেছে আপনার ব্যাখা। যেমন এই ব্যাখাটা অনন্য লেগেছে।
এটিই বোধহয় উপন্যাসের চরিত্র বিশ্লেষনের মূল তত্ত্ব।
যদি কখনো কিছু লিখতে পারি আপনাকে দিয়ে রিভিউ একখান লেখিয়ে নিবো বিনে পয়সায় । ভালোথাকুন
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
অনেক অনেক অনেক ভাল লাগল রিভিউটা। প্রত্যেক জাতির উচিৎ তাদের ইতিহাস জেনে নেওয়া, ইতিহাসের নায়কদের চেনা। ইতিহাস শুধুমাত্র রাজনীতি করলে পড়তে হবে এমন ধারণা নিয়ে অনেকে থাকে। সে ক্ষেত্রে আমার ধারণা, সেই রাজনৈতিক আদর্শই প্রধান ও সত্য হয়ে ওঠে ইতিহাস এর থেকে। কিন্তু প্রকৃত সত্যকে জানার জন্য আমি মনে করি কাঠখোট্টা ইতিহাস পড়ার থেকে ঐতিহাসিক উপন্যাস ও চলচ্চিত্র দেখা খুব বেশি প্রয়োজন, যদি সেটি আসলেই প্রকৃত সত্যকে ধারণ করে। আমার বিশ্বাস সুহান ভাইয়ের লেখায় প্রকৃত তাজউদ্দীন আহমদকে খুঁজে পাবো, অতিরঞ্জিত কাউকে না। যেভাবে আনিসুল হকের "উষার দুয়ারে" -তে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করেছেন অতিমাত্রায়, আমার ভাল লাগে নি। আর মনেও হয়েছে সেটা "অসমাপ্ত আত্মজীবনী" থেকে কিছুটা কপি-পেস্ট টাইপের। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত মত, আশা করি সুহান ভাইয়ের লেখায় সেরকম কিছু পাবো না।আর
কথাটা ভাল লেগেছে।
সুহান রিজওয়ান ও আপনার জন্য শুভকামনা।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
ভালো লাগলো রিভিউটা। পড়তে হবে বইটা।
স্বয়ম
রিভিউ ভাল লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আপনার এই রিভিউ যখন পড়েছি তার ঠিক ৭ ঘন্টা আগে ২য় বার এর মতো পূর্ব পশ্চিম পড়ে শেষ করেছি।এমনিতে চরিত্রগুলোকে বিশ্লেষন করতে গেলে নিজেকে মিশিয়ে ফেলা ছাড়া আমার কোনো উপায় থাকে না কারন চরিত্রের গভীরতাকে মাপা খুব সহজ নয় । মনের ব্লকিং অবস্থা নিয়ে যখন আপনার এই লেখাটা শেষ করলাম তখন শুধু দীর্ঘশ্বাসের সাথে বাস্তব জগতে ফিরে আসার প্রচন্ড চেষ্টা। একটা দারুন রিভিউর জন্য অনেক অভিনন্দন।বইটা কখন হাতে আসবে সেই অপেক্ষায় রইলাম ।
---------
রাধাকান্ত
অত্যন্ত চমৎকার একটা রিভিউ । উপন্যাসটি পরার আগ্রহ তৈরি করেছেন আপনি । ধন্যবাদ ।
মহাবিশ্বের পরিব্রাজক
দারুন রিভিউ শেহাব ভাই! লেখকদের তুলনার ব্যাপারটি আমার ভাল লেগেছে। আর জোহরা তাজউদ্দিনের প্রসংটিতেও আমি একমত!
আশা করি পড়ে ফেলব!!
বইটা পড়ার জন্য মুখিয়ে ছিলাম আগে থেকেই। এখন রিভিউ পড়ে বই পড়ার ইচ্ছাটা আরো হাজার গুণ বেড়ে গেল। বই টু বই তুলনার ব্যাপারটা আমার তেমন একটা ভাল লাগেনি, কিন্তু শুধু সুহান রিজওয়ানের লেখনীর রিভিউয়ের অংশটুকু অসাধারণ লেগেছে।
------------------------------------------------------------------
It is impossible to be a mathematician without being a poet in soul.
পরের দিনের তালিকায় যোগ করে নিলাম
দেবদ্যুতি
ক। রিভিউ যেভাবেই লিখুন, ভাল লেগেছে।
পাণ্ডুলিপির পাঠক হিসেবে আপনাকে ঈর্ষা!
খ। সুহান রিজওয়ানের সব লেখাই পড়েছি, বহুবার ভয়াবহভাবে মুগ্দ্ধ হয়েছি। এই বইটার জন্য আগ্রহজনিত অপেক্ষা অনেকদিনের। দেশের বন্ধুবান্ধবদের কাছে অনুরোধ করে রেখেছি, নয়তো অনলাইনে কিনে আনাব। যতো দ্রুত সম্ভব পড়তে চাই।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
১। অসাধারণ রিভিউ! আপনি রিভিউ করার পাশাপাশি আরও কয়েকটি বইয়ের তুলনামূলক বিচারও করে ফেলেছেন একই সাথে -এটা আরও বেশি ভালো লেগেছে। এটা সচরাচর করা হয় না, তবে এ ধারায় আলোচনাটা বেশ জমজমাট লেগেছে।
(এই তুলনা করার কারণটা আপনি উপরে লিখে দিয়েছেন অবশ্য)
২। সুহান রিজওয়ানকে ধন্যবাদ -কষ্ট করে এমন একটা বই লেখার জন্য।
শুভেচ্ছা
প্রথমেই ওমর শেহাব ভাইয়াকে একটা বিশা-আ-আ-আল ধন্যবাদ দিয়ে শুরু করি। তার পরীক্ষা ছিলো, নানাবিধ কাজকর্ম ছিলো; সেগুলো ছেড়ে তাকে দীর্ঘ একটি সময় ব্যয় করতে হয়েছে এক নবীন লেখকের পাণ্ডুলিপির বিশ্লেষণে। ইনবক্সে বহু বহু বার টোকা দিয়ে তাকে বিরক্ত করার ব্যাপারটা ছেড়েই দিলাম।
নিজের লেখা প্রসঙ্গে অন্য কারো পাঠ প্রতিক্রিয়ায় মন্তব্য করাটা বেশ কঠিন কাজ, খুব সচরাচর এই সুযোগ ঘটে না সবার- সম্ভবত। তারপরেও বলি, ওমর ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া আমার কাছে ভালো লেগেছে। অকপট প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বলেই যে লেখাটি ভালো লেগেছে, কেবল তা নয়। আমার মনে হয়েছে লেখক হিসেবে উপন্যাসে আমার যে দুর্বলতাগুলো ছিলো, এই লেখাটা অনেকটা বীজগণিতের ভেনচিত্রের মতো সেই দুর্বলতাগুলো ফুটিয়ে তুলেছে আমার সামনে।
হুমায়ূন আহমেদ বা সুনীল গাঙ্গুলীর সাথে একই বাক্যে নাম আসাতে যথেষ্ট সংকুচিত বোধ করেছি অবশ্য। তবে স্বীকার করি, পাঠক হিসেবে আমি সেইসব পূজনীয় লেখকদের একনিষ্ঠ বলে ওমর ভাইয়ের তুলনামূলক আলোচনা হৃদয়ঙ্গম করা আমার জন্যে সহজ হয়েছে। একজন মনোযোগী পাঠকের কাছে জোহরা তাজউদ্দীনের তুলনামূলক অনুপস্থিতি যে বেশ দৃষ্টিকটু, খেয়ালে নিলাম তা এই প্রতিক্রিয়া পড়ে।
সচলায়তনে খুটখুট করে কীবোর্ড চেপে ব্লগিং করে করে লেখালেখিতে হাতেখড়ি আমার, সেই সচলের পাতাতেই এতোটা মনোযোগ দিয়ে কেউ আমার উপন্যাসের রিভিউ দেবে- একরকম অভাবনীয় তা আমার জন্যে। কিন্তু আমি জানি, এতোটা মনোযোগ এই উপন্যাসের যদি প্রাপ্য হয়, তবে তার সবটাই হচ্ছে উপন্যাসের বিষয়বস্তুর জন্যে- লেখকের ক্লিফহ্যাঙ্গার জনিত যাদু বা বর্ণনার ভাষ্যের কারণে নয়।
তাজউদ্দীনকে বাংলাদেশের মানুষ কতটা ভালোবাসে, আরো একবার সেই প্রমাণ পাওয়া গেলো সচলের পাতায়। সেজন্যে রিভিউয়ার ওমর ভাই, সাথে এই লেখার যাবতীয় পাঠক আর মন্তব্যকারীদের আবারো ধন্যবাদ।
তাজউদ্দীন আহমদ নিজে অসম্ভব বিনয়ী ছিলেন বলে জানা যায়,
তাঁকে নিয়ে লেখা ঔপন্যাসিকও বিনয়ী হবেন সেটা অস্বাভাবিক নয়
অভিনন্দন, 'লেখক' সুহান রিজওয়ান
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আপনাকে বুঝতে হবে, আমিও নবীন ফিকশন রিভিউয়ার! হি হি!
বেশ ভাল রিভিউ হয়েছে
বইটা পড়ার আশা রাখি, সুহান আমার প্রিয় লেখক
-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...
বইটি তো অনেক বড় বিষয়, তার রিভিউ পড়েই ভাবনার অন্য এক দুয়ার খুলে গেল- ধন্যবাদ!
রিভিউ পড়ে বইটি পড়ার জন্য ছটফট করছি কিন্তু দেশের বাইরে আনার ব্যাবস্থা নেই শুনেছি। লেখক ও আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মহান অতন্দ্র।
বইটি পড়া হয়নি এখনো। আমার জেলাতে এটি এখনো আসেনি। তবে সচলে কয়েকটি লিখা পড়েছি এই বই নিয়ে। যাই হোক বইয়ের পাঠকদের অনুভুতি বা রিভিউ( যাই বলি না কেন) পড়ে বইটি কত ধারালো তা বুঝতে বিন্দু মাত্র বিলম্ব হয়নি। স্বাধীনতার ইতিহাসে যিনি(তাজউদ্দীন আহমেদ) সব সময়
আড়ালে থেকে গেছেন,তাঁকে খুব সুন্দর করে যথা মর্যাদায় সামনে আনা হয়েছে বইটিতে । পড়ার অপেক্ষায় আছি,অনেক অজানাকে জানার বাকী।
এ্যনি মাসুদ
নতুন মন্তব্য করুন