আমার চিত্রনাট্য বা শ্রুতি নাটক লেখার কোন প্রশিক্ষণ নেই, কিন্তু ইচ্ছে আছে। একবার যখন ইচ্ছে একটু বেশিই চাগিয়ে উঠল তখন আমি সিড ফিল্ডের স্ক্রিনপ্লে বইটি একটানে পড়ে শেষ করলাম।
বিষয় বস্তু খুব বেশি ধরতে না পারলেও ইচ্ছেটা আরো বেড়ে গেল। ঘটনাচক্রে আমার বন্ধু অনার্য তাপস একজন প্রযোজক। তিনি একবার বললেন রাইসুুল ইসলাম আসাদের শিডিউল পাওয়া গেছে কাজেই মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি স্ক্রিপ্ট লিখে দিতে। ওনার ইচ্ছা প্রোডাকশন ছাব্বিশে মার্চ উপলক্ষে রিলিজ দিবেন। সিড ফিল্ডের বইটি পড়ার পর পরই আমি হাবিবুল আলম বীরপ্রতীকের লেখা ব্রেভ অফ হার্ট বইটি পড়ে শেষ করেছিলাম।
রাইসুল ইসলাম আসাদ সেই বইটির একজন গেরিলা। আমি তাই ঠিক করলাম সেখানকারই একটি যুদ্ধের গল্পের উপর স্ক্রিপ্ট লিখব। আমার যে অভিযানটি পছন্দ হল সেটিতে আসাদদের কমান্ডার মানিক শহীদ হয়েছিলেন আর তারপর নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু সেকেন্ড-ইন-কমান্ডার থেকে কমান্ডার হয়েছিলেন।
কথা হল এখানে অভিনেতা একজন। তাই আমি ঠিক করলাম জনরা হবে ড্রামাটিক মনোলগ। আমি জীবনে কোনদিন ড্রামাটিক মনোলগ লিখি নাই। সিড ফিল্ডের বইতেও লেখা নেই কি করে তা লিখতে হবে। তাই গুগোল করলাম 'ড্রামাাটিক মনোলগ রাইটিং ফর ডামিস'। টুকটাক যা পেলাম পড়লাম। তারপর গুগোল করলাম 'বেস্ট ড্রামাটিক মনোলগস'। ভাবলাম যেহেতু নিজের কোন প্রশিক্ষণ নেই কাজেই বিখ্যাতগুলোকেই চোথা হিসেবে ব্যবহার করবো।
তালিকায় সবার উপরে আসল পাল্প ফিকশনের স্যামুয়েল জ্যাকসন
আর জ'সের রবার্ট শ'য়ের মনোলগ।
আমি ভাবলাম তথাস্তু।
এরপর টুকটাক কিছু হোমওয়ার্ক করলাম রাইসুল ইসলাম আসাদের উপর। তারপর ওনার ইউটিউবের ইন্টারভিউগুলো বার বার দেখলাম।
তারপর নিচের স্ক্রিপ্টটি লিখলাম। যেহেতু এটির কপিরাইট আমার, দিতে সমস্যা নেই। কিন্তু প্রোডাকশনের কপিরাইট অনার্য তাপসের প্রতিষ্ঠান রেডিও ২০০৮ এর। কাজেই সেটি আর দিতে পারলাম না। ওটি আপনাদের পয়সা খরচ করে শুনতে হবে।
স্ক্রিপ্ট শুরুর আগে আরো দুটি ছবি দিয়ে দেই। একটি হল রেকর্ডিংয়ের দিনে প্রযোজক তাপসদার সাথে আসাদ ভাইয়ের আর আরেকটি হল বিজ্ঞাপনের ছবি।
আমি বইটি পড়ে যা বুঝতে পারিনি তা হল আসাদ নিজে উঠুলী ব্রিজের অভিযানে ছিলেন না। তিনি অন্য অপারেশনে ছিলেন। তাই রেকর্ডিংয়ে আগে তিনি ফোনে বলেছিলেন বলার ভঙ্গী তিনি নিজে একটু পরিবর্তন করে নিচ্ছেন। যেহেতু আমি ওনার বিশাল বড় এসি, ওনার ফোন কল পেয়েই হার্ট অ্যাটাক হয়ে গিয়েছিল। কি উত্তর দিয়েছি মনে নেই!
দৃশ্য ১
শব্দ: কিছুটা বিষাদ মাখা আবহ।
কথক:
কখনও ভাবিনি একদিন এখানে এসে, অনেক মানুষের কাছে আমার এই গল্পটি বলতে পারব। আমার তো চুয়াল্লিশ বছর আগেই হারিয়ে যাওয়া কথা ছিল। এই ভূখন্ডেই কোন এক জায়গায় মাটিতে মিশে থাকতাম! নিথর শরীরটি কেউ খুঁজে পেতো অথবা পেতো না। প্রতি বছর দু'বার, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে কেউ কবরে এসে ফুল দিতো অথবা দিতো না। ঠিক যেমন হয়েছে শহীদ রুমীর, যেমন হয়েছে শহীদ আলতাফ মাহমুদের, যেমন হয়েছে আমার কমান্ডার মানিক ভাইয়ের।
দৃশ্য ২:
শব্দ: কিছুটা রণসংগীত টাইপ।
কথক:
এখনও মনে হয় গতকালকের ঘটনা! ১৯৭১ সাল। গোটা দেশ তখন উত্তাল! আমরা ছাত্ররা তখন প্রতিবাদে মুখর। অনেক হয়েছে, আর না! এবার চাই সত্যিকারের স্বাধিকার! বঙ্গবন্ধু তখন ইয়াহিয়া খান আর ভুট্টোর সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন কি করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু আমাদের কেন যেন ওই পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিশ্বাস হতো না। সেই দেশভাগের সময় থেকে তো দেখে আসছি। শুধু ভাষার জন্যই কতজন মারা গেল! এরপর আসল মিলিটারীর শাসন। এদের সাথে আলোচনা কি করে হয়। এদের বিশ্বাস করা যায়! এরা দিবে গণতন্ত্র! আমরা যা ভয় পাচ্ছিলাম সেটিই সত্যি হল। একদিকে এরা আলোচনা চালালো আর আরেকদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রাতের অন্ধকারে সৈন্য আর গোলাবারুদ নিয়ে আসল। তারপর ২৫শে মার্চ রাতে তারা এই পৃথিবীতে, এই ছোট্ট সবুজ শ্যামল ভূখন্ডে নরকের আগুন জ্বালালো।
দৃশ্য ৩:
শব্দ:
কথক:
ঢাকা শহরের অবস্থা তখন ভয়াবহ চলছে। কিছুক্ষণ পর পর কারফিউ। একটু তরুণ বা যুবক পেলেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যাকেই নিয়ে যাওয়া হয় সে আর ফিরে আসে না। কোনমতে লুকিয়ে একটু বের হলেই রাস্তায়, অলি গলিতে চোখে পড়ে লাশ! কী বিভৎস্য দৃশ্য! কোন মৃতদেহ হয়তো এক সপ্তাহ ধরে পড়ে আছে, কোনটা হয়তো আগের রাতের। দেখে মনে হচ্ছে পাঞ্জাবীদের কোন মানুষ দরকার নেই, খালি মাটি হলেই চলবে। সবাই সুযোগ পেলেই পালিয়ে চলে যাচ্ছে একটু দূরের দিকে। আর যারা পারছে না তারা মৃত্যুর প্রহর গুনছে লাশের শহরে বসে। আমি বড় হয়েছি পল্টনে। ঢাকা আমার নিজের শহর। এই শহর থেকে আমাকে পালাতে হল। আবার কবে ফিরব জানি না। যাওয়ার পথে যতবার একটি করে মৃতদেহ চোখে পরেছে ততবার শিউরে উঠেছি। মানুষ কিভাবে পারে এভাবে গোটা একটি জাতিকে শেষ করে ফেলতে?
দৃশ্য ৪:
শব্দ:
কথক:
প্রত্যেক মানুষই নিজের সময়কে পাল্টে দেয়ার এক অদ্ভুৎ সামর্থ্য নিয়ে জন্মায়। কেউ তার জীবনে সেই সামর্থ্যের খোঁজ পায়, কেউ পায় না। আমার কেন যেন মনে হয় ১৯৭১ সাল আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছিল। জীবনে কোনদিন ভাবিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করব। কোনদিন ভাবিনি বিস্ফোরক দিয়ে নিজের প্রিয় শহরেরই একটির পর একটি স্থাপনা উড়িয়ে দিব। সেসময় একদিন বেশি বেঁচে থাকাই ছিল একটি অর্জন। কেন যুদ্ধে গিয়েছি সেটি কখনও আলাদা করে ভাবিনি। শুধু মনে হয়েছিল বুকের ভিতরে দাউ দাউ করে জ্বলা এক টুকরো আগুন আরো অনেকের মত আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ট্রেনিং ক্যাম্পে। ভারতে ট্রেনিং শেষে মেজর খালেদ মোশাররফ আর ক্যাপ্টেন হায়দার আমাদের পাঠালেন ঢাকার উত্তরাঞ্চলের দায়িত্ব দিয়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে নৃশংস সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা একদল গেরিলা! কমান্ডার ছিল মানিক ভাই। সহযোদ্ধা ছিল নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, শাহাবুদ্দীন, তৌফিক, আলতাফ, মর্তুজা, শাহার, নেহাল, আরিফুল মাওলা, নিজামসহ আরো অনেকে। আমাদের মূল লক্ষ্য গোপন স্থান থেকে ঘন ঘন অতর্কিত আক্রমণ করে শত্রুর মনোবল ধ্বংস করে দেয়া। হিট এন্ড রান। ধরা পড়লেই নিশ্চিত মৃত্যু!
দৃশ্য ৫:
শব্দ:
কথক:
যারা সাভার এলাকাটি ভালো করে চেন তারা নিশ্চয়ই শিবালয় থানার নাম শুনেছ। আজকের গল্পটি সেই জায়গায়। জায়গাটার কাছেই একটি নদী। তার উপর ছিল একটি সেতু। এই সেতুর কিন্তু অনেক গুরুত্ব ছিল। এশিয়ান হাইওয়ে গেছে তার উপর দিয়ে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিয়মিত অস্ত্র ও সৈন্য আনা নেওয়ার কাজে এই সেতু ব্যবহার করে। এটি ছিল তাদের ঢাকার সাথে যোগাযোগের একটি পথ। কোন একবার ওই দিক দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম। পথে এই সেতুটি আমাদের নজরে আসল। মানিক ভাই আর বাচ্চু সাথে আলাপ করে মনে হল যদি কোনভাবে এই সেতুটি ধ্বংস করে দেয়া যায় পাকিস্তানীদের জন্য সেটি হবে একটি বেশ বড় আঘাত। নিচের নদীটি অত ছোট না যে তারা তাড়াতাড়ি বিকল্প ব্যবস্থা করে ফেলবে। তারপর আমরা চিন্তা করতে লাগলাম কি করে কাজটি করা যায়। সমস্যা হল ওই এলাকা সম্পর্কে আমরা অত ভাল জানতাম না। সেতুটি আদৌ পাহারা দেয়া হয় কিনা, দিলে কতজন দেয়, তারা কতক্ষণ পর পর আসে, তাদের অস্ত্রশস্ত্র কি কি এই ব্যাপারগুলো জানা দরকার। মেলন আর নিজামের সাথে আরো দু'জন দিয়ে আমরা একটি রেকি টিম করলাম। এদের কাজ হবে দূর থেকে সাবধানে সেতুটি পর্যবেক্ষণ করা। দরকার হলে গোপনে খোঁজখবরও নিতে হবে।
দৃশ্য ৬:
শব্দ:
কথক:
কাজটি অত সোজা ছিল না। প্রায় পাঁচদিন পর আমরা জানতে পারলাম যেহেতু এটি একটি হাইওয়ের অংশ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দিন আর রাতে টহল দেয়। এটা তো একটা বড় সমস্যা। কারণ এর মানে হল আমরা যে সময়ই আক্রমণ করি না কেন টহলদলের এসে পড়ার একটি ঝুঁকি সবসময়ই থেকে যাচ্ছে। কিন্তু সেই ঝুঁকি নেয়া ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। রেকি টিম সেতুর কিছু মাপজোকও নিয়ে আসল। সেগুলো নিয়ে বসে আমরা হিসেব করলাম কি পরিমাণ বিস্ফোরক লাগবে, প্রাইমার কর্ড কত লম্বা হবে। সেতুটি রাস্তা থেকে কতদূরে, গার্ডার কতদূরে এসবও হিসেব করতে হল। এইসব হিসেব যখন করতাম খুব মায়া হত। ভাবতাম নিজের দেশের সম্পদ - কতটা নিরুপায় হয়ে আমরা ধ্বংস করতে বাধ্য হচ্ছি। একদিন আবার এসব আমাদেরই গড়ে তুলতে হবে। শুধু জানতাম না কবে আসবে সেই দিন।
দৃশ্য ৬:
শব্দ:
কথক:
দুই তিন সপ্তাহ আগে আমরা এলাকার তরুণকে রিক্রুট করে সাভারেই প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। এবার তারা আমাদের কাজে আসল। কয়েকজনকে আমরা বাছাই করলাম। তাদের কাজ হবে বালির বস্তা নিয়ে জায়গামত বসানো। বিস্ফোরক বসানো অনেক ঝুঁকির কাজ। এটি যেহেতু কারিগরীভাবে একটু জটিল তাই বেশ নিখুঁত ভাবে করতে হয়। যদি ঠিকমত বসানো না হয় তাহলে বিস্ফোরণের পরেও সেতুটি ধ্বংস না হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে আনা এসব বিস্ফোরক তো আমরা নষ্ট করতে পারি না। কাজেই এখানে হেলাফেলার কোন সুযোগ নেই। বালির বস্তা ব্যবহার করা হবে বিস্ফোরকগুলো ঠিক জায়গায় ঠিকমত সেই বিশেষ মুহুর্ত পর্যন্ত বসিয়ে রাখার জন্য। মেলাঘরে ক্যাপ্টেন হায়দার ভীষণ যত্ন করে আমাদের এই ট্রেইনিং দিয়েছেন। এবার ছাত্র হিসেবে কি শিখেছি সেটি আমাদের প্রমাণের পালা।
দৃশ্য ৭:
শব্দ:
কথক:
মানিক ভাই আর বাচ্চু মিলে ঠিক করল আমরা চারটি দলে ভাগ হয়ে অভিযানটি করব। প্রত্যেক দলের আলাদা আলাদা দায়িত্ব। প্রথম দলের কাজ হল বিস্ফোরক ঠিক ঠাক লাগানো। এগুলো প্রেসার চার্জ। যেভাবে হিসেব করা হয়েছে ঠিক সেভাবেই স্প্যান আর গার্ডারে লাগাতে হবে। একটু ভুল হলেই দেখা যাবে ধোঁয়া সরে যাওয়ার পরও সেতুটি দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিতীয় দলের কাজ হল প্রত্যেকটি বিস্ফোরকের সাথে ঠিক মাপের ফিউজ কর্ড লাগানো। তৃতীয় দলের কাজ হল বালির বস্তাগুলো নিয়ে বিস্ফোরকগুলোর উপর ঠিকঠাক মত চাপা দিয়ে আসা। আর চতুর্থ দল পাহারা দিবে হাইওয়ের দুই প্রান্তে। যদি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কোন টহল দল এসে পড়ে তাহলে তারা কাভারিং ফায়ার দিবে। প্রত্যেকটি দলেরই কাজই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারো একটু ভুলচুকের প্রায়শ্চিত্ত আমাদের করতে হতে পারে জীবনের বিনিময়ে। "জীবনের বিনিময়ে" কথাটি আমি যত সহজে বলে ফেললাম, সেসময় মৃত্যু আসলেই ছিল ততটা সহজ। প্রত্যেকটি মুহুর্তে আমরা আলাদা আলাদা করে বাঁচতাম। একটি নতুন নি:শ্বাস যেন একটি নতুন দিন।
দৃশ্য ৮:
শব্দ:
কথক:
তারপর একসময় সেই নির্দিষ্ট দিনটি ঘনিয়ে এল। ঠিক রাত বারটায় আমরা গোপন আস্তানা থেকে সাপের মত নি:শব্দে বেরিয়ে আসলাম। কাছেই ছিল একটি স্কুল ভবন। তার পাশ দিয়ে আমরা চুপিসারে এগুলাম। সেই সময় রাতে কোন বেসরকারী যানবাহন চলা নিষিদ্ধ ছিল। দূর থেকে যদি হাইওয়ের কোন এক প্রান্তে এক জোড়া হেডলাইট দেখা যায় তাহলে নিশ্চিতভাবেই হবে সেটি পাকিস্তানী মিলিটারীর গাড়ি। এর অর্থ হল অনিবার্য সংঘর্ষ। ভরসা একটাই। এই নিস্তব্ধ রাতে আরো অনেক দূর থেকেই হয়তো ইঞ্জিনের শব্দ পাওয়া যাবে। একে চারটি গ্রুপই তাদের কাজ শুরু করল। অর্ধেকের একটু বেশি বিস্ফোরক যখন বসানো হয়ে গেছে তখন দক্ষিণ দিক থেকে কেমন যেন গাড়ির ইঞ্জিনের একটি হালকা গুড়গুড় শব্দ ভেসে আসল।
দৃশ্য ৯:
শব্দ:
কথক:
বাচ্চু আর সাবু চিৎকার করে বললো যেন আমরা তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করি। আমার তখন বুক ধুকপুক করছে। এই রাতের অন্ধকারেও আমি স্পষ্ট দেখলাম পাশের জনের ঘাম কপাল থেকে গড়িয়ে বিস্ফোরকের উপর পড়ছে। তৌফিক আর সাবু চিৎকার করে জানালো বেশ কয়েকটি গাড়ির আস্ত একটি কনভয় সেতুর দিকে এগিয়ে আসছে। আমি এখান থেকেই হেডলাইটের আবছা আলোগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। সাবু, মানিক ভাই আর বাচ্চু তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিল অ্যাম্বুশ করে গাড়িবহরটি আগেই থামিয়ে দিতে হবে। আমরা তখনও জানতাম না কয়টি গাড়ি বা কি তাদের অস্ত্র শস্ত্র। কিন্তু তখন আর সময় নেই।
দৃশ্য ১০:
শব্দ:
কথক:
যারা সড়ক পাহারা দিচ্ছিল তারা দুইটি ফ্ল্যাংকে ভাগ হয়ে রাস্তার দুই ধারে পজিশন নিল। আমি সেতু থেকে দেখছিলাম আর মনে হচ্ছিল কোন দু:স্বপ্ন দেখছি। এখনই ঘুমটি ভেঙে গিয়ে দেখব সব ঠিক আছে। আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। আস্তে আস্তে হাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ বাড়লো। হঠাৎ একটি গাড়ি দেখে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে আতংকের স্রোত নেমে আসল। এটি একটি পাঁচটনী ট্রাক। ওপরে একটি লাইট মেশিনগান বসানো। আস্তে আস্তে গাড়িগুলো আমাদের ফায়ারিং রেঞ্জের মধ্যে আসল। আমাদের দলের সদস্যরা রাস্তার দুই পাশ থেকে এক সাথে গুলি শুরু করলো। পরের পনের বিশ মিনিট ধরে এক নাগাড়ে চলল গুলি। এদিকে গুলি শুরুর সাথে সাথেই তারা সবগুলো গাড়ির আলো নিভিয়ে দিল। তারপর তারা আস্তে আস্তে প্রায় বিশ তিরিশ গজ পিছিয়ে গিয়ে থামল। এরপর আমরা গুলি বন্ধ করলাম আর চুপচাপ দেখতে থাকলাম ওরা কি করে। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত, কিছুই বলতে গেলে দেখা যাচ্ছিল না। বেশ অনেক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন কোন শব্দ পেলাম না বুঝলাম আমাদের গুলি থেকে যারা বেঁচে গেছে তাদের নিয়ে শত্রুরা পালিয়ে গেছে। বুক থেকে মনে হল একটি পাথর নেমে গেল। নতুন উদ্যমে আমরা বিস্ফোরক বাঁধার কাজ শুরু করলাম। এবার একেবারে শেষ করেই ছাড়ব। যারা পাহারা দিচ্ছিল তারা আবার রাস্তায় অবস্থান নিল। এমন সময় হঠাৎ একসাথে অনেকগুলো হেডলাইট জ্বলে উঠল।
দৃশ্য ১১:
শব্দ:
কথক:
আলোয় আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সাথে সাথে শুরু হল তুমুল গুলিবর্ষণ। এত কিছুর মধ্যেও আমি আলাদা করে লাইট মেশিনগান আর ওদের জিথ্রী রাইফেলের গুলির শব্দ বুঝতে পারছিলাম। মনে হল রাতের নৈ:শব্দ্যকে উপহাস করে নরক নেমে এসেছে। সাঁই সাঁই করে মাথার উপর দিয়ে বুলেট যাচ্ছে। যেকোন সময় একটি হয়তো আমার খুলির এক টুকরো নিয়ে সেতুতে বা কে জানে হয়তো বিস্ফোরকেই গেঁথে যাবে। বেশ কয়েক মিনিট পর আমরা বুঝতে পারলাম শত্রু আসলে আমাদের ফাঁদে ফেলেছে। তারা কখনই পালিয়ে যায়নি। পুরোটা সময় তারা বাতি নিবিয়ে এখানেই বসে ছিল। বাচ্চু আর মানিক ভাইয়ের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম এখন যদি বাঁচতে চাই আমাদের একটাই উপায় আছে। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে পালাতে হবে। এর ভেতর আমাদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ল। মানিক ভাই সবাইকে নদীতে ঝাঁপ দিতে নির্দেশ দিলেন। তারপর তিনি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ভাল করে একদম নাকের ডগায় বসে গুলি চালাতে থাকা শত্রুদের দেখে নিলেন। তারপর তিনি সাবুকে বললেন, "সাবুরে! আমি তো সাঁতার জানি না!" । সাবু তখনও হাত থেকে অস্ত্র ফেলেনি। সে পাল্টা চিৎকার করে জবাব দিল, "মানিক ভাই! আল্লাহর ওয়াস্তে ঝাঁপ দেন। আমরা আপনাকে ধরব। বাঁচলে সবাই একসাথে বাঁচব আর মরলে সবাই একসাথে মরব।"
দৃশ্য ১২:
শব্দ:
কথক:
সেই দৃশ্যটি এখনও স্পষ্ট আমার চোখে ভাসে। আমি দেখলাম মানিক ভাই শেষবারের মত শত্রুদের দেখে নিল তারপর একবার নিচে তাকাল। তার পর পর আমিও ঝাঁপ দিলাম। আমার এখনও মনে হয় সেটি মানিক ভাইয়ের ঝাঁপ দেয়া ছিল না। কেমন যেন হাল ছেড়ে দিয়ে এক ধরনের পড়ে যাওয়া ছিল।
দৃশ্য ১৩:
শব্দ:
কথক:
সাঁতরে আমরা একে একে সবাই নদীর অন্যপাড়ে উঠলাম। কেবল মানিক ভাই আসল না। অনেক খুঁজেও আমরা তাকে পেলাম না। তারপর আর কিছু করার নাই দেখে গোপন আস্তানায় ফেরত আসলাম। তার প্রায় এক ঘন্টা পর সহযোদ্ধা মাওলানা মানিক ভাইয়ের নিষ্প্রাণ শরীরটি নিয়ে আসল। আমি তখনও ঘোর থেকে বের হতে পারিনি তাই জিজ্ঞেস করলাম না কিভাবে তাকে পাওয়া গেল। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড বাচ্চুর অবস্থাও আমার মত। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অবশ্য সে নিজের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল। মানিক ভাইয়ের জায়গাটি এখন তাকেই নিতে হবে। মিলন আর তুন্নির উপর দায়িত্ব পড়ল মানিক ভাইয়ের পরিবারে খবরটি পৌঁছে দেয়ার। ওরা নয়া পল্টনের ছেলে, মানিক ভাইয়ের বাড়িও সেখানেই।
দৃশ্য ১৪:
শব্দ:
কথক:
আমাদের বাকিদের নিয়ে বাচ্চু বসল। বলল, এখন আর এটি আর দশটা অভিযানের মত নয়। মানিক ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হলে আমাদের সফল হতেই হবে। বাচ্চু আমাদের নতুন কমান্ডার।
দৃশ্য ১৫:
শব্দ:
কথক:
ভোরের একটু আগে আগে করে আমরা আবার সেতুর কাছে ফিরে গেলাম। শত্রুরা ততক্ষণে ওখান থেকে চলে গেছে। আলো ফুটলেই মানুষের চলাচল শুরু হবে। তার আগেই আমাদের কাজ শেষ করতে হবে। যখন সব বিস্ফোরক বসানো শেষ হল সূর্য প্রায় উঠি উঠি করছে। একটি বিকট বিস্ফোরণে ভোর হওয়ার আগেই আমরা আকাশে কমলা রংয়ের ফুলকি ছড়িয়ে দিলাম। আশে পাশে কয়েক গ্রাম দূর থেকে নাকি সেই শব্দ শোনা গিয়েছিল। এলাকার মানুষ জানল মুক্তিবাহিনী তাদের আশে পাশেই আছে, পাকিস্তানের দিন আর খুব বেশি নেই।
দৃশ্য ১৫:
শব্দ:
কথক:
এই অভিযানের পর বাচ্চু আরো একটি বড় সিদ্ধান্ত নিল। সে ঠিক করল ঢাকার আসে পাশে অনেক হয়েছে। এবার আরো ভেতরে যাওয়ার পালা। আমাদের যেতে হবে একেবারে শত্রুদের নাকের ডগায়। সে আমাকে আরো কয়েকজনের উপর দায়িত্ব দিয়ে ঢাকায় পাঠালো ঢাকা টেলিভিশন ভবনসহ আরো কিছু জায়গায় গেরিলা আক্রমণের জন্য। সে গল্প তোলা থাকলো অন্য কোনদিনের জন্য।
দৃশ্য ১৬:
শব্দ:
কথক:
মানিক ভাইয়ের বাবা পরদিন সকালে এসে ছেলের মৃতদেহ নিয়ে যান। তোমরা যদি কখনও আজিমপুর গোরস্তানে যাও একটু খুঁজে দেখলেই পাবে কোথায় উনি শুয়ে আছেন। জীবন কত অদ্ভুৎ! মৃত্যুও কী কম অদ্ভুৎ? মাঝে মাঝে ভাবি মানিক ভাই যখন নিশ্চিত মৃত্যু জানার পরও নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই কয়েক মুহুর্ত তার মনের মধ্যে কি চলছিল? তিনি কি তার বাবা-মা'র কথা ভাবছিলেন? কোন মিষ্টি মেয়ের চেহারা কি তার চোখে ভাসছিল? নাকি আমাদের পরের অপারেশনে তিনি থাকতে পারছেন না বলে তার ভীষণ ভীষণ আফসোস হচ্ছিল? নাকি কিছুই ভাবছিলেন না? হয়তো শুধু একদৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছিলেন কিভাবে নিকষ কালো পানি তার দিকে ভীষণভাবে ধেয়ে আসছে?
দৃশ্য ১৭:
শব্দ:
কথক:
মানুষ যখন আমাকে গেরিলা বলে, বাচ্চারা যখন দূর থেকে দেখে বলে আমি যোদ্ধা আমি জানি না আমার কী অনুভূতি হওয়া উচিৎ। শামসুর রাহমান একাত্তরে তার গেরিলা কবিতায় লিখেছিলেন,
"দেখতে কেমন তুমি?
অনেক প্রশ্ন করে,খুজে কুলিজি তোমার আতিপাতি!
তোমার সন্ধানে ঘোরে ঝানু গুপ্তচর,সৈন্য,পাড়ায় পাড়ায়।
তন্ন তন্ন করে খোঁজে প্রতি ঘর।
পারেলে নীলিমা চিরে বের করতো তোমাকে ওরা,
দিতো ডুব গহন পাতালে।"
শুধু কী শত্রুরাই আমাদের খুঁজেছে? আমরা নিজেরা কি নিজেদের খুঁজে খুঁজে ফিরিনি? এতদিনেও কি খুঁজে পেয়েছি? শুধু বুঝি একাত্তরের জন্যই আমার জন্ম হয়েছিল, একাত্তরেই আমি নিজেকে জেনেছি, একাত্তরই আমাকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি একাত্তরের, একাত্তর আমার।
দৃশ্য ১৮:
শব্দ:
কথক:
শামসুর রাহমানের কথা ধার করেই বলি, "আমি আর একাত্তর যাচ্ছি হাত ধরে পরস্পর।"
মন্তব্য
চমৎকার একটি কাজ শেহাব। পয়সা খরচ করে শুনবো নিশ্চয়ই।
--মোখলেস হোসেন
নাপিতের সার্জারি প্রচেষ্টা
আবহ সঙ্গীতের জন্য পরামর্শঃ
দৃশ্য-১: বেহালা বা চেলোতে মৃদু করুণ সুর (রাগ শিবরঞ্জনী)
দৃশ্য-২: বিঠোফেনের ফিফ্থ সিম্ফনির মতো সুর
দৃশ্য-৩: তবলাবিহীন শুধু সেতারে ধীর লয়ের তান (রাগ মারওয়া)
দৃশ্য-৪: শুধু তবলার দ্রুত তান (রাগ ভৈরবী)
দৃশ্য-৫: পিয়ানোতে মৃদু তান (বিঠোফেনের মুনলাইট সোনাটার মতো)
দৃশ্য-৬: সরোদে তানের ক্রম উত্থান (রাগ খামাজ)
দৃশ্য-৬ (এটা আসলে ৭ হবে, দুইবার ৬ লিখে ফেলেছেন): পিয়ানোতে মৃদু তান (শ্যপাঁ’র মার্চ ফুনেব্রে’র মতো)
দৃশ্য-৭: মাদলের তান (কোন সাঁওতালী ধুন)
দৃশ্য-৮: ড্রামের ক্রমবর্ধমান তান (সুইস আর্মি ট্রিপলেট)
দৃশ্য-৯: মোজার্টের ৪০-নং সিম্ফনি’র মতো
দৃশ্য-১০: কোন আবহ সঙ্গীত না
দৃশ্য-১১: কোন আবহ সঙ্গীত না
দৃশ্য-১২: কোন আবহ সঙ্গীত না
দৃশ্য-১৩: বাঁশীতে করুণ সুর (রাগ কৃষ্ণধ্বনি)
দৃশ্য-১৪: কোন আবহ সঙ্গীত না
দৃশ্য-১৫: তবলায় মৃদু তান (রাগ হংসধ্বনি)
দৃশ্য-১৫ (এটা আসলে ১৬ হবে, দুইবার ১৫ লিখে ফেলেছেন): কোন আবহ সঙ্গীত না
দৃশ্য-১৬: বাঁশীতে মৃদু সুর (রাগ আহির ভৈরব)
দৃশ্য-১৭: কোন আবহ সঙ্গীত না
দৃশ্য-১৮: ভিভালদি’র ফোর সিজনস্-এর উইন্টার পার্টের মতো (আলেগ্রো এফ মাইনর)
২০২৭ সালে এসে এই কমেন্ট বোঝার চেষ্টা করব! হি হি!
প্রিয় ওমর শেহাব, আপনার পোস্টে আবহ সঙ্গীত বিষয়ে অযাচিত পরামর্শ দেবার জন্য ক্ষমা চাইছি। লেখাটাতে দুটো দৃশ্যের পর আবহ সঙ্গীতের কোন নির্দেশনা না থাকায় পড়ার সময় আমার বার বার মনে হচ্ছিল সেখানে কেমন আবহ সঙ্গীত হতে পারে। তাই পরে ভেবে এই পরামর্শটা (আসলে প্রস্তাব) দেই। দেখা যাচ্ছে বিষয়টা আপনার বিরক্তির কারণ হয়েছে। আবারও দুঃখিত। আমার পক্ষে উপায় থাকলে কমেন্টটা মুছে দিতাম।
আরে ধুর! আমিই ঠিক মত এক্সপ্রেস করতে পারিনি। আসলে আপনার কমেন্ট আমার মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে। এই শব্দগুলো আমার ভোকাবুলারিতেই নেই।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
দারুণ!
আপনি স্ক্রিপ্ট পড়ার সুযোগ দিলেন, তাপসদাও নিশ্চয়ই নাটকখানা শোনার সুযোগ করে দেবেন
দু্টি অনাবশ্যক কৌতূহল
১। নাটকের প্রচার সময় কত মিনিট/ঘন্টা? একটি পর্বেই থাকছে, নাকি ভাগ করা হয়েছে?
২। যতটুকু বুঝেছি এটা বিশেষ কোনো বয়সী শ্রোতা গ্রুপের জন্য না, সেক্ষেত্রে কথক তুমি সম্বোধন না কইলেই ভালো ছিল না?
আপনার ও তাপসদার জন্য শুভকামনা থাকলো
প্রোডাকশন ষোল মিনিটের। আমি ভেবেছিলাম চ্যাংড়া পোলাপান ছাড়া আর কেউ মোবাইলে কল দিয়ে নাটক শুনেনা।
চমৎকার লিখেছেন শেহাব ভাই।
অসাধারণ শেহাব ভাই। মুক্তিযোদ্ধা রইসুল ইসলাম আসাদের কণ্ঠেই পড়লাম যেন মনে মনে।
এটা কি রিসেন্টলি লিখেছেন? আপনি নেক্সট জেনারেশন এর জাফর স্যার হয়ে উঠছেন।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
কয়েকবছর আগে লিখেছিলাম। গোঁফটা উঠে গেলেই স্যারকে রিটায়ারমেন্টে পাঠিয়ে দিব।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
শিরোনাম দেখে কৌতুহল হল। সিড ফিল্ডের বইটার খোঁজ দেবার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
আর অতিথি লেখককে ধন্যবাদ সঙ্গীত বিষয়ক মন্তব্যের জন্য।
অরূপের ব্লগ @ http://etongbtong.blogspot.com
অরূপের ফ্লিকার @ http://www.flickr.com/photos/harvie-krumpet
বাংলাদেশের বাইরে থেকে মনে হয় শোনা যাবেনা। অগত্যা আসাদের কণ্ঠ কল্পনা করে নিলাম।
...........................
Every Picture Tells a Story
নতুন মন্তব্য করুন