বাংলা চিত্রনাট্য: মিত্র মনো ফন্ট

শেহাব এর ছবি
লিখেছেন শেহাব (তারিখ: বুধ, ০৫/০৭/২০১৭ - ৮:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: আমার চিত্রনাট্য লেখার উপর কোন আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। যেহেতু এটি আমার বর্তমান পেশা না কাজেই আমি চিত্রনাট্যকারদের সাথে খুব বেশি আড্ডাও দেইনি। তাই বন্ধুদের সাথে সাথে ঘুরে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগও হয়নি।

আমি আগের লেখায় বলেছিলাম চিত্রনাট্য লেখার জন্য বাংলা মনোস্পেস বা ফিক্সডপিচ ফন্ট আমি খুঁজে পাইনি। আমার সে সমস্যার সমাধান হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলা ক্যালিগ্রাফি গ্রুপ মাত্রায় জিজ্ঞেস করার পর সেখানকার একজন সদস্য আমাকে মিত্র মনো ফন্টটির খোঁজ দেন। আমি সেটি ব্যবহার করে চিত্রনাট্য লেখার অভিজ্ঞতার কথা এখানে বলব।

অনেকে সত্যজিৎ রায়ের নিচের উদাহরণগুলি দিয়ে বলবেন এই ব্যাটা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে মনো স্পেস ফন্ট নিয়ে এত ঘ্যান ঘ্যান করে যাচ্ছে কেন?

সত্যজিৎ রায় প্রথমে পথের পাঁচালীর লিখিত চিত্রনাট্য খসড়া করেছিলেন। এটির দু'টি সংস্করণ আছে। সন্দীপ রায় সম্পাদিত পথের পাঁচালী স্কেচবুকে বলা হয়েছে, সত্যজিৎ রায় পরে স্টোরিবোর্ডের দিকে ঝুঁকে যান কারণ তার বাংলা নাকি চিত্রনাট্য লেখার মত সমৃদ্ধ ছিল না। এটির অর্থ আমি অবশ্য বুঝিনি। যে বাংলায় এতগুলো বই লিখল সে বাংলা ভাল পারবে না কেন কে জানে!

পরে সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালীর গল্পটি স্টোরিবোর্ড বা খেরোখাতায় লিখেন এবং সেখান থেকেই চলচ্চিত্রটি বানান।

কোন সংস্করণেই কম্পিউটারের কোন ব্যাপার নেই। ফন্ট তো অনেক দূরের ব্যাপার। আমি নিশ্চিত নই আমার কোন ভাল যুক্তি আছে কিনা। আসলে আমি চিত্রনাট্য সম্পর্কে প্রথম জানি সিড ফিল্ডের স্ক্রিনপ্লে আর ক্রিস্টোফার রিলের দ্য হলিউড স্ট্যানডার্ড বইদুটি থেকে। কাজেই, খুব সম্ভবত: মূল কারণ মগজ ধোলাই। এর বাইরেও কিছু ব্যবহারিক কারণ আছে যার কথা আগের লেখায় বলেছি।

শিবের গীত শেষ! এখন ধান ভানি! ফন্ট নির্বাচন চিত্রনাট্যের প্রায় সব আঙ্গিককে প্রভাবিত করে। এর কারণ কি? যে কোন ফন্টের প্রস্থ বা পিচ এবং দৈর্ঘ‌্য বা পয়েন্ট বলে দেয় প্রতি পেজে গড়পড়তা কি পরিমাণ লেখা থাকবে। নিয়ম হল প্রতি পেজে এক মিনিটের গল্প থাকবে। কাজেই হলিউডে তার জন্য কুরিয়ার দশ পিচ আর বারো পয়েন্টের ফন্ট ব্যবহার করা হয়। এর ফলে প্রতি ইঞ্চি প্রস্থে দশটি অক্ষর আর প্রতি ইঞ্চি দৈর্ঘ‌্যে ছয় লাইন লেখা থাকে।

মোটামুটি একটি চিত্রনাট্যের ফরম্যাটে নিচের নিয়মগুলো অনুসরণ করা হয়। আমি এটি নিয়েছি দ্য হলিউড স্ট‌্যানডার্ড বইটি থেকে।

১। পাতায় পাঞ্চমেশিন দিয়ে তিনটি ছিদ্র করা থাকবে। পাতার মাপ সাড়ে আট ইঞ্চি বাই এগার ইঞ্চি, সাদা, বিশ পাউন্ড, বন্ড।
২। শট হেডিং: বাম মার্জিন ১.৭", ডান মার্জিন ১.১"। প্রতি লাইনে ৫৭ অক্ষর।
৩। পরিচালনা: বাম মার্জিন ১.৭", ডান মার্জিন ১.১"। প্রতি লাইনে ৫৭ অক্ষর।
৪। সংলাপ: বাম মার্জিন ২.৭", ডান মার্জিন ২.৪"। প্রতি লাইনে ৩৪ অক্ষর।
৫। সংলাপের উপরে থাকা চরিত্রের নাম: বাম মার্জিন ৪.১"।
৬। ব্র্যাকেটের ভেতরের চরিত্র নির্দেশনা: বাম মার্জিন ৩.৪", ডান মার্জিন ৩.১"। প্রতি লাইনে ১৯ অক্ষর।
৭। দৃশ্যান্তর: বাম মার্জিন ৬"।
৮। দৃশ্যক্রম: বামপাশের ক্রমিক নম্বর হবে পাতার বাম কিনারা থেকে ১" ভিতরে। ডানপাশের ক্রমিক নম্বর হবে পাতার বাম কিনারা থেকে ৭.৪" ভিতরে।
৯। পৃষ্ঠাক্রম: পাতার বাম কিনারা থেকে ৭.২" ভিতরে ও উপরের কিনারা থেকে ০.৫" ভিতরে।
১০। ফন্ট: কুরিয়ার অথবা কুরিয়ার নিউ, ১২ পয়েন্ট।
১১। কাগজের দৈর্ঘ্য: ৬০ লাইন (পৃষ্ঠাক্রম সহ), উপরে ও নিচে ০.৫" মার্জিন।

আমি চাই যেই মনোস্পেস ফন্টই ব্যবহার করি কিনা উপরের মানদণ্ডটি বজায় রাখতে। আমার মনে হয় না মিত্র মনো আমি সেটি করে আমি সেটি পুরোপুরি করতে পেরেছি।

প্রথমে আমি কি কি করতে পারিনি এবং কেন পারিনি সেটি বলি। আমি লিনাক্সে কাজ করি, আমার উইন্ডোজ কম্পিউটার নেই। ইংরেজী ভাষায় চিত্রনাট্য লেখার জন্য সেল্টেক্স ওয়েবসাইটটি খুব কাজের কিন্তু তাতে বাংলার কোন সুবিধা নেই। আমি তাই লিনাক্সের ওয়ার্ড এডিটর লিবারঅফিস ব্যবহার করেছি।

এই এডিটর ব্যবহার করতে গিয়ে দুটি সমস্যায় পড়েছি। প্রথমত: যদি আমি রিচ টেক্সট ফরম্যাট বা মাইক্রোসফট ওয়ার্ড ফরম্যাটে সংরক্ষণ করি তাহলে সেটি ঠিকমত কাজ করে না। কাজেই আমি ওডিটি ফরম্যাট ব্যবহার করেছি। দ্বিতীয়ত: লিবারঅফিসের রুলারে সূক্ষ্মতার দৌড় বড়জোর ০.২৫" পর্যন্ত। কাজেই দশমিকের পরে কোন ইঞ্চি থাকলে সেটিকে আমি কাছের ০ বা .২৫" তে নিয়ে গিয়েছি। আমি জানি এসব অমার্জনীয় অপরাধ। শেষমেশ আমাদের এমন সফটওয়্যার লাগবে যেটি বাংলা চিত্রনাট্যের জন্য এসব সূক্ষ্মতা নিশ্চিত করবে।

তাহলে দেখা যাক আমার চিত্রনাট্যটি দেখতে কেমন হয়েছে। আমি যখন লিখেছিলাম যখন আমার ধারণা ছিল গল্পটির দৈর্ঘ্য পাঁচ মিনিট। কিন্তু ফরম্যাটের মোটামুটি সব শর্ত মেনে লেখার পর হয়েছে সাত পৃষ্ঠা। আমার অত অভিজ্ঞতা নেই যেটি থেকে বলব আসলেই গল্পটি সাত মিনিটের কিনা!

আরো একটি ব্যাপার জানিয়ে দেই। ইংরেজী চিত্রনাট্যের কোথায় কোথায় বড় হাতের অক্ষর ব‌্যবহার করতে হয় তার সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে। বাংলায় বড় হাতের অক্ষর নেই। তার জায়গায় আমি আন্ডারলাইনড লেখা ব্যবহার করেছি। কেন করলাম? আমার ধারণা বড় হাতের অক্ষর দিয়ে লেখা স্লাগলাইন বা শট হেডিং কাগজে একটি অনুদৈর্ঘ্যিক পার্টিশন তৈরি করে। এই ব্যাপারটি আমি উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করে অর্জন করতে পারিনি। কিন্তু আন্ডারলাইন্ড করার পর মনে হচ্ছে সেই কাজটি করা গেছে।

আমি চিত্রনাট্যটি ছবি হিসেবে দিলাম যাতে ফরম্যাটটি দেখা যায়।

পৃষ্ঠা ১:

পৃষ্ঠা ২:

পৃষ্ঠা ৩:

পৃষ্ঠা ৪:

পৃষ্ঠা ৫:

পৃষ্ঠা ৬:

পৃষ্ঠা ৭:

পৃষ্ঠা ৮:

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

চিত্রনাট্য ভালো লাগলো।

বাংলা মনো ফন্টের প্রধান দুর্বলতা হলো 'কার'গুলোর জন্য একটা আলাদা জায়গা নেয়া, যুক্তাক্ষর একটা জায়গা নেয়, কিন্ত ফলা (এমনকি রেফ) আলাদা যায়গা নেয়। আমার মনে হয়, কোন টুল বা প্লাগইন থাকলে ভালো হতে যেটা প্রতি লাইনে নির্ধারিত শব্দ সংখ্যার চেয়ে বেশি থাকলে লাইনব্রেক ঢুকিয়ে দেবে।

আপনার নিয়মনিষ্ঠতার প্রসংশা না করে পারছি না।

ভালো থাকুন, শুভেচ্ছা হাসি

শেহাব এর ছবি

ধন্যবাদ!

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

যে কোন ফন্টের প্রস্থ বা পিচ এবং দৈর্ঘ‌্য বা পয়েন্ট বলে দেয় প্রতি পেজে গড়পড়তা কি পরিমাণ লেখা থাকবে। নিয়ম হল প্রতি পেজে এক মিনিটের গল্প থাকবে। কাজেই হলিউডে তার জন্য কুরিয়ার দশ পিচ আর বারো পয়েন্টের ফন্ট ব্যবহার করা হয়। এর ফলে প্রতি ইঞ্চি প্রস্থে দশটি অক্ষর আর প্রতি ইঞ্চি দৈর্ঘ‌্যে ছয় লাইন লেখা থাকে।

বাংলার ক্ষেত্রে ভাষার কোন শব্দ কী পরিমাণে ব্যবহৃত হয় এর ফ্রিকোয়েন্সি অ্যানালাইসিস করে এক পাতায় কত মিনিটের দৃশ্য হচ্ছে এর একটা গড় মান পাওয়া যাবার কথা। গড়ের সাথে সাথে স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশানও বের করা যাবে। এবং আমার ধারণা স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশান হলিউডের চেয়ে খুব একটা ভিন্ন হবে না। কারণ এক পাতার চিত্রনাট্য নিশ্চয়ই একেবারে এক মিনিটই হয় না। হয়ত পাঁচ দশ সেকেন্ড কম বেশিও হতে পারে। আবার পরিচালক নিশ্চয়ই প্রয়োজন অনুযায়ী এগুলা অল্প স্বল্প অদল বদলও করেন। যদি এই কথাগুলো সত্যি হয় আর একটা স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যানালাসিস আমরা করতে পারি তাহলে মনে হয় মনো ফন্টের প্রয়োজন কতটা এটার একটা পরিমাপযোগ্য মান পাওয়া সম্ভব।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

শেহাব এর ছবি

এভাবে চিন্তা করে দেখিনি।

স্পর্শ এর ছবি

মজার ব্যাপার হলো সচলের মন্তব্য সেকশনে লেখার সময় আমার কম্পিউটার-ব্রাউজারে এই টাইপের একটা ফন্টই আসে বাই ডিফল্ট!
ফন্ট টা দৃষ্টিকটু।এবং প্রায় আনরিডেবল। ইংরেজী কুরিয়ার ফন্টের যে ক্লারিটি আছে এই বাংলা মনস্পেস ফন্টে তা নেই। আমার মনে হয় তৃমাত্রিক কবির প্রস্তাবটাই শ্রেয়। এযুগে 'টাইপ রাইটারের' নীতি মানার চেয়ে একটা কম্পিউটার স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলা সহজ। যেকোনো ফণ্টে লেখার পরে, ফরম্যাটিং এবং শব্দের ডিস্ট্রিবিউশন অনুযায়ী, মিনিট হিসাবে পেজব্রেক করে দেবে। অন্যান্য ফরম্যাটিং গুলোও হ্যান্ডেল করবে।
http://imgur.com/a/aB8AU


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

মেঘলা মানুষ এর ছবি

মজার ব্যাপার হলো সচলের মন্তব্য সেকশনে লেখার সময় আমার কম্পিউটার-ব্রাউজারে এই টাইপের একটা ফন্টই আসে বাই ডিফল্ট!

-আমার কাছে এরকম ফন্ট আসলে আমি মন্তব্য করাই ছেড়ে দিতাম রেগে টং । আপনার উপর শ্রদ্ধা বেড়ে গেল!

আপনি কি লিনাক্স থেকে ব্রাউজ করছেন? সোলায়মান লিপি বা এরকম কোন একটা ফন্ট ডাউনলোড করে সেটা ব্রাউজারে যুক্ত করে নিন।

শুভেচ্ছা হাসি

হিমু এর ছবি

চিত্রনাট্য আর স্টোরিবোর্ড (দৃশ্যমালা) একে অন্যের বিকল্প নয়, বরং পরিপূরক। দৃশ্যমালার কাজ হচ্ছে চলচ্চিত্রের গল্পের প্রাগদৃশ্যায়ন, যেটায় গল্পটাকে ক্যামেরার চোখে কেমন দেখাবে, তা বর্ণনা করা হয়। সত্যজিৎ চিত্রনাট্যের বিকল্প হিসেবে দৃশ্যমালা এঁকেছিলেন কি?

শেহাব এর ছবি

জানি না। অনেকেই স্ক্রিপ্ট না লিখে সরাসরি স্টোরিবোর্ড করে।

মন মাঝি এর ছবি

আমিও তো এমনটাই জানি!

****************************************

সুমন চৌধুরী এর ছবি

জান্তেছি।
জানাইতে থাকেন।
চলুক

স্বরূপ আনন্দ এর ছবি

চিত্রনাট্য বিষয়ক আপনার দু’টি লেখা পড়লাম। আমি যার পর নাই আবেগাপ্লুত। আমি এমনটা ভাবছি অনেকদিন। আনু্ষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি কখনো। ১ বাংলায় চিত্রনাট্যের ফরম্যাট, ২ চলচ্চিত্রের পারিভাষিক শব্দকোষ; বাংলা চলচ্চিত্রে পেশাদারিত্ব তৈরীতে এই দুটোর বিকল্প নাই বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস। ফরম্যাটের ক্ষেত্রে আপনি মনে হচ্ছে অনেকদুর এগিয়েছেন। যদি কোনোভাবে জানতে পারতাম তাহলে অনেক উপকৃত হতাম। জানিনা কিভাবে আপনার সাথে যোগাযোগ হতে পারে, তবে আমার ই-মেইল অ্যাড্রেস যদি আপনি দেখতে পান তাহলে একটা উপায় হতে পারে যোগাযোগের। ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।