অপাংক্তেয়

শেখ জলিল এর ছবি
লিখেছেন শেখ জলিল (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৩/০৩/২০০৮ - ৩:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নিম্ন আয়ের মধ্যবিত্ত দু'টি পরিবার। একই ফ্লোরে পাশাপাশি ফ্ল্যাট। ও পাশে মাঝে মাঝে গেট খোলা থাকে। ভেতরের কথাবার্তা স্পষ্ট কানে আসে। এ পাশে ড্রইং রুমে বসে আছি আমি। হট্টগোলে দরোজায় চুপিসারে কান পাতি। জাহিদ সাহেব আর তার স্ত্রীর বাকবিতণ্ডা জমে উঠেছে।
-বইসা বইসা এই টাকা কয়দিন খাইবা শুনি! তারপর তো ভিক্ষা করন লাগবো। সেইদিকে খেয়াল আছে কোনো?
-তোমার এতো কীসের চিন্তা! যে কয়দিন যায়, যাক না।
- তারপর, তারপর কি করবা?
- দেখা যাক, একটা কিছু তো হয়েই যাবে।
- আর অইছে। ম্যালা তো ঘুরলা। কোনো হানে কিছু অইলো? বইসা বইসা খাইলে রাজার ভাণ্ডারও শ্যাষ অইয়া যায়!
- শেষ হলে তোমার অসুবিধা কি? তখন চিন্তা করা যাবে।
- অসুবিধা নাই! কিচ্ছু অসুবিধা নাই? পোলামাইয়ার চিন্তা করো। অগোরও একটু চিন্তা করো। আমার চিন্তা করন লাগবো না। বাপের বাড়ি যা আছে সারাজীবন চইলা যাইবো।
- তোমার তো আছে একটা জিনিসই- ঢাকায় বাপের জমিদারী। আমার বাপে কিছুই রাখে নাই, তো কি হয়েছে? তাই বলে কি আমি কিছুই করি নাই! সাভারে এক খণ্ড, গ্রামের বাড়িতে যে জমি আছে শেষটায় ওখানেই ঘর বানিয়ে থাকবো।
- রাখো তোমার সাভারের জমি। ঐ গৈ-গেরামে কবে লোকবসতি অইবো? তোমার পোলামাইয়ারা কি ঐখানে যাইবো? গেরামে থাকবো?
- না গেলে নাই, ওরা নিজেরটা করে নেবে। বুড়োবুড়ি দুজন শেষ বয়সে নাহয় গ্রামের বাড়িতে চলে যাবো।
- তুমি বেজায় স্বার্থপর! পোলামাইয়ার জন্য ঢাকায় কিছু করবা না! খালি বইসা বইসা সব ভাইঙ্গা খাইবা আর আণ্ডা পারবা।
- হ, তাই করমু, সব খামু, কারো লাইগা কিচ্ছু রাখমু না। জাহিদ সাহেবের রাগ বাড়ছে। কথায় আঞ্চলিকতা চলে এসেছে। আমি ড্রইং রুমের দরোজা বন্ধ করে দেই। আর শুনতে ইচ্ছে করে না।

জাহিদ সাহেবের সাথে বন্ধুত্ব পাঁচ বছরের। বিকেলে একসাথে লেকের পাড়ে ঘুরতে যাই। হাঁটতে হাঁটতে তার সাথে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংসারিক নানান বিষয়ে কথা হয়। আজ একটু ভাবগম্ভীর।
- কি জাহিদ সাহেব, কেমন যেন লাগছে আজ আপনাকে!
- আর বলবেন না। ঢাকা শহরে আর ভাল্লাগছে না।
- কেন, কী হয়েছে?
- এই যে ধরুন এই লেকের পাড়। এখন কি আর হাঁটার জো আছে। দখল, বেদখল আর সংস্কারের নামে লেক তো আর লেক নাই।
-হু।
আমি হাঁটি আর সায় দেই।
-ঐ যে ঐ পাড়ে দেখেন 'জাহাজ মার্কা বাড়ি'। লেকের পেটের ভিতর ঢুকে গেছে। কই এখনও ভাঙলো নাতো! আর এ পাশে এতো অ্যাপারমেন্ট আগে ছিলো? একটুখানি পায়ে চলা পথ। তার উপর আবার লোকে লোকারণ্য। স্বস্তিতে হাঁটার, শ্বাস ফেলার জায়গা আছে কোথাও?
- তা অবশ্য ঠিক বলেছেন। দিনদিন এ শহরটা অসহ্য হয়ে যাচ্ছে। তো, কী করবেন এখন?
- ভাবছি গ্রামে চলে যাবো। এ শহরে আর না।
- তো, গ্রাম কি আগের মতো আছে?
- তা অবশ্য নেই। হাটেবাজারে, স্কুলকলেজে এখন নেশার আখড়া হয়। শুনলাম ব্লু ফিল্মও নাকি চলে। সব উচ্ছন্নে গেছে!
- ভিলেজ পলিটিক্স নেই?
- আর বলবেন না! সেতো আছেই। সুদখোর, টাউট,বাটপার আরো বেড়েছে।
-তাহলে যেতে চাইছেন কেন?
- ঐ যে বললাম, একটু স্বস্তির হাওয়া, খোলামেলা জায়গা।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জাহিদ সাহেবের বুক থেকে।

আমি আর কথা বাড়াই না। জাহিদ সাহেব যেন কথায় কিছু একটা লুকিয়ে গেলেন। খুব মায়া হলো তার মুখ দেখে। হাজার হলেও বন্ধু মানুষ। আসল সমস্যাটা আমি জানি। দুপুরে যে সব শুনেছি বুঝতে দিলাম না তাকে। পাঁচ বছর ধরে আছি পড়শি হয়ে। আলাপে আলাপে জাহিদ সাহেবের টাকাপয়সা, সহায়সম্পতির বিষয় সব জানা হয়ে গেছে আমার।

জাহিদ সাহেব হাঁটে আমার পাশে। আমি হাঁটি ভাবনার জগতে। সারাজীবন চাকরির টাকায় ভাড়া টানে মধ্যবিত্ত পরিবার। আর সে টাকায় নতুন বাড়ি করে উচ্চবিত্তরা। ঐ সব মধ্যবিত্ত পরিবার এক সময় গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়। মাঝপথে থেমে যায় ছেলেমেয়ের লেখাপড়া। এই ঢাকা শহরে তাদের কোনো উত্তরাধিকার নেই, স্থায়ী ঠিকানা নেই। গ্রামে গিয়েও নিজেদের খাপ খাইয়ে চলতে পারে না এরা। আসলে জাহিদ সাহেবরা না গ্রামের, না শহরের। কোথাও ঠাঁই নেই তাদের। অপাংক্তেয় এরকম হাজার জীবন হারিয়ে যায়, গত হয়ে যায় নাগরিক ভিড় থেকে। কে-ই বা কার রাখে খোঁজ!
১২.০৩.২০০৮


মন্তব্য

নজমুল আলবাব এর ছবি

গল্পগুলো সবি এক। শুধু বয়ান হয় ভিন্ন ভাষায়।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

শেখ জলিল এর ছবি

একমত।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

কনফুসিয়াস এর ছবি

ঠিক কথা। চেনা মানুষের চেনা গল্প।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

শেখ জলিল এর ছবি

আমরা গল্প-উপন্যাস যাই লিখি না কেন সবখানেই চেনা চরিত্র, চেনা মুখ। এমন কি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর অচেনা গ্রহের অচেনা প্রাণীর আদলও পৃথিবীর কোনো জীবজন্তুর মুখ-হাত-পা-শরীরের সাথে মিল যায়!

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

রায়হান আবীর এর ছবি

অপাংক্তেয় এরকম হাজার জীবন হারিয়ে যায়, গত হয়ে যায় নাগরিক ভিড় থেকে। কে-ই বা কার রাখে খোঁজ!

---------------------------------
এসো খেলি নতুন এক খেলা
দু'দলের হেরে যাবার প্রতিযোগিতা...

শেখ জলিল এর ছবি

ধন্যবাদ।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

দ্রোহী এর ছবি

নজমুল আলবাব লিখেছেন:
গল্পগুলো সবি এক। শুধু বয়ান হয় ভিন্ন ভাষায়।

সহমত..................


কি মাঝি? ডরাইলা?

শেখ জলিল এর ছবি

আমিও...

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

জাহিদ হোসেন এর ছবি

এই জাহিদ সাহেবও ঐ দুঃখে ঢাকা ছেড়ে ভেগে গিয়েছেন বহু আগে।_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

শেখ জলিল এর ছবি

তাই নাকি!

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

বাংলাদেশের একটা বড় সমস্যা সবকিছুই ঢাকাকেন্দ্রিক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বৈষম্য দিয়ে শুরু, প্রতিটা ক্ষেত্রেই 'বেটার লাইফ' এর জন্য সবার পছন্দ ঢাকা। আসলে বেটার লাইফ আর হয় না। মাঝখান থেকে টাকা পয়সার গচ্ছা। ফলাফল, হতাশা।

এ অবস্থা থেকে উন্নয়নের কোনো চিন্তা-ভাবনা পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। কতোটা বেকুব হলে যে টাকায় একটা নতুন শহর গড়া যায়, সে টাকায় ঢাকায় পাতাল রেল গড়ার পরিকল্পনা করে আমাদের নীতি-নির্ধারকেরা। অবশ্য তারা ঠিক বেবুকও না। কারণ, এই বাজেটের বৃহৎ অংশ তাদের পকেটেই যাবে। নাহ, তারা বেকুবই। আগুন লাগলে তার ছোঁয়াচ সবার গায়েই লাগবে এই সহজ সত্যটা তারা বুঝে না।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

শেখ জলিল এর ছবি

..পাশাপাশি সবকিছুকে ঢাকাকেন্দ্রিক রাখার প্রবণতাও থামাতে হবে আগে।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

পরিবর্তনশীল এর ছবি

সাধু

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- বলাই ভাইয়ের সঙ্গে সহমত। ঢাকা কেন্দ্রিক চিন্তাধারাটা সম্ভাবনার অন্যসব মুখে পাথরচাপা দিয়ে রেখেছে। আর সামঞ্জস্যহীনভাবে বাড়ন্ত এই ঢাকাতে মানিয়ে নেওয়া অনেক জাহিদ সাহেবের পক্ষেই সম্ভব নয় এখন আর। ঢাকাকে চাপমুক্ত রাখতে জনগণের ভার কিছুটা কমানো দরকার এখনি। বাবা-মা'র চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো পড়াশুনার অনেক ভালো ভালো উদাহরণ আছে ঢাকার বাইরের বড় শহর কিংবা মফস্বল গুলোতে।

লোকজন স্বইচ্ছায় সরতে না চাইলে বরং পেঁদিয়ে খেদানো হোক ঢাকা থেকে। এতে করে ঢাকাও বাঁচবে আর বাইরের শহরগুলোও পাদপ্রদীপে আসবে।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

শেখ জলিল এর ছবি

লোকজনকে প্যাদানির আগে বড়ো বড়ো অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানাও ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করা উচিত।
..জেলা শহরে তেমন কর্মসংস্থান কোথায়?

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

রাকিব হাসনাত সুমন এর ছবি

[i]অপাংক্তেয় এরকম হাজার জীবন হারিয়ে যায়, গত হয়ে যায় নাগরিক ভিড় থেকে। কে-ই বা কার রাখে খোঁজ!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

অসংখ্য দরজায় কান পাতলে এসব আলাপ শোনা যাবে এখন । শিক্ষা - জীবিকার জন্য শহরমূখী মানুষের শেষ ঠিকানা কোথায়?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।