মাকে হারিয়েছি দু'বছর হলো। মা দিবসের প্রাক্কালে আজ তাঁর মুখচ্ছবিই ভাসছে দু'চোখে। শেষ সময়ে মা আমার বাসাতেই ছিলেন। মা প্রতি রোজায়ই ঢাকাতে আমার বাসাতে কাটান। সেবারও কাটালেন। শবে কদরের আগের দিন মা চলে গেলেন গ্রামের উদ্দেশ্যে। উপজেলা সদরে এক ভাইয়ের বাসা হয়ে যাবেন গ্রামের বাড়িতে। সাথে করে নিয়ে গেলেন আমার কিনে দেয়া কিছু কাপড়-চোপড় এবং যাকাতের টাকা।
মা প্রতিবারই আমার দেয়া যাকাতের টাকা-কাপড় দরিদ্রদের মাঝে বিলি করতেন নিজ হাতে। বাছাই করে করে গ্রামের দরিদ্রদের মাঝে প্রতিবার। আমিও মা'র হাতে যাকাত তুলে দিয়ে আশ্বস্ত থাকতাম। কারণ প্রতিবার ঠিক ঠিক মানুষের হাতে পৌছে যেতো তা। কিন্তু মা সেবার পারলেন না। ঈদের আগের দিন ২৪ অক্টোবর মা চলে গেলেন আমাদেরকে এতিম করে। রেখে গেলেন তাঁর কিছু অসমাপ্ত কাজ, ইচ্ছা।
আমার গ্রামে হিন্দু-মুসলিমের বসবাস প্রায় আধাআধি। ছোটোবেলা থেকেই আমাদের মাঝেও গড়ে উঠেছে মিলেমিশে থাকার সংস্কৃতি। ঈদ, পূজাসহ বছরের আনন্দের দিনগুলো নিজেদের মাঝে ভাগাভাগি করেই সহাবস্থান করি আমরা। একে অপরের খোঁজ-খবর নেই। এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে বেড়াই, মজা করি, একসাথে খাই। আর এ সংস্কৃতি বাবা-মা, বড়ো ভাই থেকে ছোটোদের মাঝে চলে এসেছে পাকাপোক্তভাবেই। মিশ্র সংস্কৃতির এ গ্রাম আমার পরম প্রিয়।
মা'র ইচ্ছার সূত্র ধরে ঈদের দিন নামাজের পর চলে গেলাম সেই হিন্দু বুড়ির বাড়ি। যার সাথে মা'র সখ্যতা ছিলো সবচেয়ে বেশি। সবাই তাকে নাইল্যার মা বলে ডাকেন। বুড়ির সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে নাইল্যা মারা গিয়েছে ক'বছর আগে। বুড়িকে দেখাশোনার তেমন কেউ-ই নেই তখন। ছেলেবউ এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে খায়। সংসারে বেশ অভাব-অনটন, খাবারের অভাব। সেইজন্যই মা রোযার ঈদের সময় আমার কাছ থেকে যখন যাকাতের টাকা নিয়ে যেতেন তখন আলাদা করে কিছু টাকা অথবা একটা শাড়ি নিয়ে যেতেন প্রতিবার। ঈদের খুশির দিনে প্রিয় পড়শী বুড়ি নাইল্যার মাকে খুশিমনে দেখতে চাইতেন আমার মা।
বুড়ির বাড়ি গিয়ে দেখি- বারান্দায় চটের উপর বুড়ি বসা। চট, কাথা, বালিশ থেকে বেশ দুর্গন্ধ বেরুছে। কতোদিন যে ধোয়া হয়নি কে জানে? দেখলাম বুড়ির দরিদ্র মলিন চেহারা, স্বাস্থ্য একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। ছেলে বেঁচে থাকাকালীন যা দেখেছিলাম শরীর-স্বাস্থ্য তার ছায়টিও নেই । চোখের নিচে ফোলা, শরীরে ক্লান্তি আর অবসাদ ঘিরে আছে তাকে। আমাকে দেখেই কাঁদতে লাগলেন বুড়ি। আমি তার পাশে চটেই বসে পড়লাম। যদিও আমাকে দেখে তার ছেলেবউ টুল এনে দিতে চাইলেন, কিন্তু আমার নিতে ইচ্ছে করছিলো না। শুনলাম- ঢাকা থেকে নিয়ে আসার পরই লাঠিতে ভর করে আমার মাকে দেখে এসেছেন বুড়ি। আমি ব্যস্ততার জন্য খেয়াল করিনি তখন।
আমি বুড়ির মাথায় হাত রাখলাম। মনে পড়লো মা'র কথা। যে মা আমার হারিয়ে গেছেন ঈদের ঠিক একদিন আগে। বুড়িও মা'র কথা বলতে লাগলেন। কতো স্মৃতিচারণ! মা যে তাকে খুব ভালোবাসতেন সে কথা। আমার খুব খারাপ লাগতে লাগলো। আমি বুড়ির হাতে কিছু টাকা দিতেই তার কান্নার মাত্রা আরও বেড়ে গেলো। আমার মাথায় হাত বোলাতে থাকলেন। আমার চোখেও পানি এসে গেলো। আর থাকতে পারলাম না। চলে এলাম সেখান থেকে। আসার সময় মনে হলো- এ বুড়িও হয়তো চলে যাবেন আমাদের ছেড়ে। সবার অগোচরেই পরপারের ডাক আসবে একদিন তার। পৃথিবীর কোনো দুঃখ, কষ্ট, কায়-ক্লেশ তখন আটকিয়ে রাখতে পারবে না তাকে!
পূনশ্চ: মা'র প্রিয় মানুষ নাইল্যার মা মারা গেছেন এর ঠিক দু'মাস পর। আমিও হারিয়েছে আমার মায়ের সেই স্মৃতিচিহ্ন। গ্রামের দরিদ্র মানুষের জন্য মা'র ছিলো অপরিসীম সহানুভূতি আর ভালোবাসা।
মন্তব্য
অসাধারণ লাগলো লেখাটা।
সৈয়দ আখতারুজ্জামান
ধন্যবাদ সৈয়দ আখতারুজ্জামান।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
- আপনার এই লেখাটায় মন্তব্য করার সাথে সাথে ঠিক করে নিলাম আজকের দিনে 'মা'কে নিয়ে লেখা আর কোনো লেখাই পড়বো না। যদিও দুইটা পড়ে ফেলছি ইতোমধ্যে, কিন্তু আর না মামু।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
গতকাল প্রথম আলোর 'ছুটির দিনে' -মা দিবস সংখ্যা পড়ে আমারও একই অবস্থা। মাকে নিয়ে লেখা আর পড়তে ইচ্ছে করছে না।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
চোখে পানি এসে গেলো
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
........
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
খুব প্রাণ-ছোঁয়া লেখা।
কী দারুণ হতো, গোটা দেশে এরকম পরিস্থিতি থাকলে!
আমার লেখাপড়া-না-জানা, গ্রামবাসী, ধর্মপ্রাণ নানার মেয়ে হলেও আমার মা'র ধর্ম মা ছিলেন এক হিন্দু মহিলা। এই যুগে কি তা সম্ভব হতো?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আমি তুষ্ট আত্মপ্রেমেই। এর সুবিধে হলো, প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
অসাধারণ জলিল ভাই! আপনার মতো আমি নিজেও মা-হারা।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
সহমর্মিতার জন্য ধন্যবাদ তীরন্দাজ ভাই।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
মা- শব্দটি আমার কাছে এমনিতেই জল দিয়ে গড়া, তাকে নদী হয়ে বয়ে যেতেই হলো ...
খুব কষ্ট হলো লেখাটি শেষ করতে।
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
(পুরাটা পড়তে পারলাম না)
ধন্যবাদ শাহীন হাসান ও আনোয়ার সাদাত শিমুল।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
কেন লিখেন এই লেখা?
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
নতুন মন্তব্য করুন