জায়গীরনামা- চার

শেখ জলিল এর ছবি
লিখেছেন শেখ জলিল (তারিখ: মঙ্গল, ১৫/০৭/২০০৮ - ৯:১২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাজম মেম্বারের বাড়িতে আমার বেশিদিন থাকা হলো না। একে তো বয়স কম, তার উপর এতো খাটুনি সইবে না- এই ভেবে মা আমাকে জায়গীর বাড়ি যেতে দিলেন না। প্রাইমারি বৃত্তির ফলাফল বাড়ির সবারই একটু বোধ হয় আমার প্রতি মমত্ববোধ জাগিয়েছিলো। বাবা পর্যন্ত আর কিছু বললেন না। কষ্টেসৃষ্টে রয়ে গেলাম বাড়ির মায়ায় আটকে। কিন্তু এ সুখ বেশিদিন সইলো না। একদিন বাবা এসে আমাকে বললেন- আগামীকাল মাকেশ্বরের লতিফ আসবে। ওর সাথে পাহাড়ের কুড়িপাড়া স্কুলে যাবি। ওখানে বেশ আরাম করে জায়গীর থাকতে পারবি।

ঘাটাইল থানার একেবারে পূর্বপাশে কুড়িপাড়া হাই স্কুল। ওখান থেকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া মাত্র কয়েক কিলোমিটার। আমাদের বাড়ি থেকে পঁচিশ কিলোমিটারের মতো হবে। সকাল সকাল চলে এলো লতিফ ভাই। আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। লতিফ ভাইও ওখানে ভর্তি হবে। দু'জন মিলে চললাম অজানা, অচেনা জায়গায় থাকতে। সূত্র- কুড়িপাড়া হাই স্কুলের এক শিক্ষক। নাম সাজাহান স্যার। তিনি আমাদের এলাকার। ছুটিতে বাড়ি এলে তাঁর সাথে কথা হয় লতিফ ভাইয়ের। স্কুলে ভর্তি এবং জায়গীর দুটোরই ব্যবস্থা হবে সেখানে।

দু'জন মিলে সারাদিন হাঁটি। সমতল ছেড়ে যখন পাহাড়ে উঠলাম তখনই দুপুর গড়িয়ে গেলো। পাহাড়ি পথ আর ফুরায় না। সমতলে মানুষ, এরকম পথে অভ্যস্তও তেমন ছিলাম না। মাঝে মাঝে থামি, তৃষ্ণায় বুক ফেটে যায়, পেটে ক্ষুধা। রাস্তার পাশের টিউবওয়েল থেকে পানি খাই আবার হাঁটি। তবে পাহাড়ের প্রকৃতিতে সেই ছোট্টবেলার চোখও আমার জুড়িয়ে যায়। শাল, গজারি, জারুল, কাঁঠাল, আম গাছের এতো বড়ো বন কোনোদিন দেখিনি। রাস্তার যেতে যেতে পাখিদের কিচিরমিচির, কোনো কোনো গাছে বানরদের ছুটাছুটি পথ হাঁটার ক্লান্তি মুছে দেয় কিছুটা। এভাবে এবড়োথেবড়ো, আঁকাবাঁকা পথ ধরে দিনভর হাঁটি। তবু রাস্তা যেন আর ফুরায় না। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করি-কুড়িপাড়া কতো দূর? ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার আগেই ঠিক সন্ধ্যার সময় কুড়িপাড়ার দেখা পাই।

সন্ধ্যার সময়, স্কুলঘর বন্ধ। আশেপাশের বাড়ির সামনের লোকদের জিজ্ঞেস করি আমাদের এলাকার স্যারের কথা। অবশেষে সাজাহান স্যারের দেখা মেলে। উনিও ঐ এলাকায় জায়গীর থাকেন আর মাস্টারি করেন। আমাদের দেখে বোধ হয় বেশ খুশিই হলেন। পাহাড়ী এলাকার দুর্গম স্কুল কুড়িপাড়া। এমন স্কুলে আরো দুজন ছাত্র বাড়ছে। খুশি না হয়ে উপায় আছে? রাতের খাবার এলো। বেশ পেট পুরে খেলাম। আমাদের জন্য বোধ হয় ভালো আয়োজনই ছিলো। সাজাহান স্যার লতিফ অনেক কথা জিজ্ঞেস করেন। দেশগ্রামের কথা, তাঁর বাড়ির কথা, পরিচিত মানুষের কথা। ক্লান্ত শরীর, কথাবার্তা আর ভালো লাগে না। ঘুমাতে দেরি হলো না একটুও। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম সেদিনকার মতো।

সকালে সাজাহান স্যার আমাদের স্কুলে নিয়ে গেলেন। কুড়িপাড়া হাই স্কুল খুব পুরাতন না। বুঝতে দেরি হলো না শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম। আমাদের নতুন আগমনে সবাই খুশি। সাজাহান স্যার আমাকে দেখিয়ে হেডস্যারের কাছে গর্ব করে বললেন- জানেন স্যার, প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় সমস্ত টাঙ্গাইল জেলায় ফার্স্ট হয়েছে এই ছেলে। আমি হেডস্যারের দিকে তাকাই। তাঁর চোখ চকচক করছে। আবার একটু লজ্জাও এসে ভিড় করে মনে। তবে মনে বেশ গর্বও হয় আমার। পাশে দেখি লতিফ ভাইও খুশি। কারণ নতুন স্কুলে আমাকে সাথে করে নিয়ে আসতে পেরেছে সে। একে একে সব স্যারের সাথে পরিচিত হলাম। দু'একটা ক্লাসও করলাম প্রথমদিন।

জায়গীরের জন্য আমাদের বেগ পেতে হলো না। স্কুলের পাশের গ্রামেই দু'জনের থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেলো। বিকেলের দিকে হাজির হলাম জায়গীর বাড়ি। সকালে সাজাহান স্যারের বাসা থেকে খেয়ে বেরিয়েছিলাম। পেটে ক্ষুধা চো চো করছে। অবশেষে ভেতর থেকে কিছু খাবার এলো। সাথে সাথেই গোগ্রাসে খেয়ে নিলাম। কিন্তু একটু পরে লজিং মাস্টারের কাছ থেকে এলো আসল খবর। বালতিতে করে তামাক ক্ষেতে পানি দিতে হবে। তার ছেলে এসে দুটো বালতি হাতে উপস্থিত। শুরু হলো টিউবওয়েল থেকে বালতিতে পানি ভরে তামাক ক্ষেতে ঢালা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পানি ঢালা আর শেষ হয় না। হাতে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে, ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে। পৌষ মাসের শীতের দিন। তবু যখন থামলাম তখন সারা শরীর ঘেমে একাকার।

দিনশেষে নেমে এলো এক কষ্টের রাত। আগেভাগে খেয়েদেয়ে ঘুমাতে গেলাম। লজিং মাস্টার যে ঘরে থাকে সেখানে। কিন্তু দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম আসে না। মাজম মেম্বারের বাড়িতে জায়গীর থাকার কষ্টের কথা মনে হয়। প্রথমদিন এসেই ক্ষেতেখামারে কাজ। মনে মনে ভাবি, এ আবার কোন্ চশমখোরের বাড়িতে এলাম! লজিং মাস্টারের থাকার বিশাল ঘর। একপাশে সস্ত্রীক ঘুমিয়ে আছেন তিনি। আরেক পাশে অন্য খাটে আমি। একদিকে দুশ্চিন্তা, শরীরে, হাতে ব্যথা আবার পেটে ক্ষুধাও মোচড় দিচ্ছে। ঘুমানোর আগে খেয়াল করেছিলাম খেঁজুরের গুড়ের কৌটাটা কোনদিকে রাখা। চুপি চুপি উঠে খুব সাবধানে খেঁজুরের গুড় এনে খাই, বিছানার কাঁথায় হাত মুছি। এভাবে একবার, দু'বার, তিনবার। পেট থেকে ক্ষুধা একেবারে উধাও। ধীরে ধীরে চোখে ঘুম নেমে আসে। ঘুমানোর আগে পাশের খাটে খচখচ, উঁহ আহ্ টের পাই। কিশোর মন অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে। তবে সারাদিনের ক্লান্তি, আমার ঘুম আটকায় না তাতে।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে সে এক করুণ দৃশ্য। জায়গীর প্রভুর বউয়ের মাথায় পানি ঢালছে তার সোমত্ত মেয়েরা। ছোটো মেয়েটির তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা। সারাণ বলছে- মা'র কী হয়েছে, আপু? বড়ো বোনদের কেউ একজন বলছে- মা'র জ্বর এসেছে। আমি দৃশ্যটি মহা মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করি। আর এক বাড়ন্ত কিশোরের উৎসুক চোখে সোমত্ত মেয়েদের সুঠাম শরীরের বাঁক দেখি। এরই মধ্যে কোত্থেকে যেন লতিফ ভাই এসে হাজির। আমাকে কাচারি ঘরে ডেকে নিয়ে বসলো সে। তারপর চুপি চুপি বললো আসল কথা- এখনই সবকিছু গুছিয়ে নে, আজই বাড়ি চলে যাবো। আমি বললাম- ঘটনা কি? লতিফ ভাই বললো- আগে বাড়ি থেকে বের হ, তারপর বলবো।

স্কুলে যাবার নাম করে দু'জনে বেরিয়ে পড়লাম একসাথে। সাথে বইপত্র, কাপড়চোপড়। বেশ দূরে যখন পাহাড়ি পথ ধরলাম তখন লতিফ ভাই বললো- শালার এই পাহাইড়াদের বাড়িত আর জায়গীর থাকমু না। আমারে কামলা পাইছে! আইয়া সারতে পারলাম না ক্ষেতে কাজ করতে কয়। ভাবলাম আমারও তো একই অবস্থা। লতিফ ভাইকে বললাম- কাইল আমিও তামাক ক্ষেতে পানি দিছি। আসলে আমাদের দু'জনের দুঃখবোধ এবং প্রতিজ্ঞা একই। জায়গীর থাকা যাবে না এতো দূরে, এমন দূরের পাহাড়ে। পেছনে পড়ে থাকলো মধুপুর গড়, কুড়িপাড়া হাই স্কুল। শেষ করে এলাম সেই একদিনের জায়গীরবাস।

জায়গীরনামা- এক
জায়গীরনামা- দুই
জায়গীরনামা- তিন


মন্তব্য

আলমগীর এর ছবি

ভাল লাগল আবার শুরু করেছেন। সচল হওয়ার অনেক আগেই পূর্ব পর্বগুলো পড়েছিলাম।

শেখ জলিল এর ছবি

আলমগীরের মতো পাঠক পেয়ে আমারও খুব ভালো লাগছে।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

অসম্ভব ভালো, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম ।

------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমার অন্যতম প্রিয় সিরিজ এটি। নতুন পর্ব দেখে ভাল লাগলো। এক টানে পড়লাম। এবার ঘুম আসলে হয়!


রাজাকার রাজা কার?
এক ভাগ তুমি আর তিন ভাগ আমার!

পুতুল এর ছবি

আমার লজিং থাকার কথা মনে পড়েগেল!
তবে আমার শুরু হয়েছিল ক্লস সেভেনে।
সে এক কাহিনী বটে! ধনের বোঝা বইতে বইতে বেটে হয়ে গেছিলাম।
শেরালী নিয়ে ফেঁসে গেছি; তা না হলে আমার অভিজ্ঞতা আপনার সাথে শেয়ার করতে পারতাম।
ধন্যবাদ "জীবন থেকে নেয়া" কথা পোষ্ট করার জন্য।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

শেখ জলিল এর ছবি

পুতুল বলেছেন-
আমার লজিং থাকার কথা মনে পড়েগেল!
তবে আমার শুরু হয়েছিল ক্লস সেভেনে।
সে এক কাহিনী বটে! ধনের বোঝা বইতে বইতে বেটে হয়ে গেছিলাম।
...............লিখে ফেলুন না অজানা কাহিনী!

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍আমার খুব প্রিয় একটি সিরিজ।
এই লেখাগুলোয় আপনার জীবন-সংগ্রামের কাহিনী পড়ে বিস্মিত হই, মুগ্ধ হই, দুঃখে আচ্ছন্ন হই।
দুর্দান্ত।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

শেখ জলিল(অফ লাইন) এর ছবি

সিরিজটায় ফিরতে পেরে আমারও ভালো লাগছে। আরও কয়েকটি পর্ব ছাড়ার ইচ্ছে আছে।
ধন্যবাদ সবাইকে।

হযবরল এর ছবি

অনেক দিন বাদে আবার শুরু হলো এবং যথারীতি সাবলীল একটা বহমানতা আছে। শুকরিয়া।

শেখ জলিল এর ছবি

হুম, অনেকদিন ঝিমাচ্ছিলাম, কী লিখবো!
সাবলীল বহমানতা আছে শুনে আশ্বস্ত হলাম।
ধন্যবাদ।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।