হাইস্কুল জীবনে একমাত্র গোবিন্দ স্যারের বাসায় আমার যাতায়াত ছিলো। কোনো স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে পারিনি বলে স্কুল ছাড়া কারো সাথে তেমন দেখাও হতো না। গোবিন্দ স্যার প্রাইভেট পড়াতেন না। কাসের ভালো ছেলেদের প্রতি তাঁর আলাদা নজর ছিলো সবসময়। হরিপুরে আমার জায়গীরের ব্যবস্থাও গোবিন্দ স্যারই করে দিয়েছিলেন। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের পর তাই স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম তাঁর বাড়িতে। স্যার আমাকে দেখে কীযে খুশি হলেন বোঝানো যাবে না! পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। বললেন- স্টার মার্ক পেয়েছিস। আমি খুব খুশি হয়েছি। এবার ঢাকা কলেজে ভর্তি হ। আমি বললাম- ঢাকার কোন্ কলেজে? স্যার বললেন- কেন, ঢাকা কলেজে। আমি বুঝতে না পেরে আবার বললাম- ভর্তি তো হবো স্যার, বলছিলাম ঢাকার কোন্ কলেজে? তখন স্যার বুঝিয়ে বললেন- আরে বোকা ঢাকাতে ‘ঢাকা কলেজ’ নামে এক বিখ্যাত কলেজ আছে। আমার ছেলে অমলও সেখানে পড়ে। অমলদা আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। স্যার আরও বললেন- স্টার মার্ক পেলে আর ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে না। তুই তাড়াতাড়ি চলে যা, ওখানে গিয়ে সরাসরি ভর্তি হয়ে যাবি। দেখবি তোর ভবিষ্যত আরও উজ্জ্বল হবে। ঐ কলেজের ছেলেরা সবসময় ভালো রেজাল্ট করে। স্যারকে পায়ে ছুঁয়ে সালাম করে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলাম। আর মনে মনে চিন্তা করতে থাকলাম- সারাজীবন জায়গীর থেকে পড়ালেখা করলাম। ঢাকায় গিয়ে কোথায় থাকবো? পড়াশোনার খরচ জোটাবো কেমনে?
বাড়িতে ফিরে মা-বাবা, বড়ো ভাইবোনদের আমার ইচ্ছার কথা জানালাম। আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হবো। শুনে সবাই আকাশ থেকে পড়লেন। মা বলেন- ঢাকা গেলে পড়াশোনার খরচ জোটাইবো কেরা? সংসারে তখনও খুব অভাব। একমাত্র উপার্জনক্ষম বড়ো ভাইয়ের অবস্থাও তেমন ভালো না। তিনি চুপ করে থাকলেন। আমি পড়ে গেলাম মহা ফাঁপড়ে। কেউ কেউ বললেন- ঢাকায় গিয়ে জায়গীর থেকে পড়তে পারবি? শহরের মানুষেরা কি জায়গীর রাহে? আমি বললাম- দরকার অইলে তাই করমু। তাও ঢাকা কলেজে পড়মু। বিশেষ করে গোবিন্দ স্যারের পরামর্শ আমার মনে গেঁথে আছে। এদিকে বড়ো ভাইয়ের সেই অবস্থা নেই। যখন লতিফ সিদ্দিকীর আওলিয়াবাদ কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন তখন অনেক সুযোগ ছিলো। প্রাইমারি বৃত্তি পাবার পর লতিফ সিদ্দিকীতো একবার বড়ো ভাইকে বলেই ফেলেছিলেন- তোমার ভাইটিকে আমার কাছে একেবারে দিয়ে দাও, আমি মানুষ করি। কিন্তু বড়ো ভাই দিতে রাজি হননি। বলেছিলেন- আমার সোনার টুকরো ভাই, আমিই মানুষ করবো। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর বড়ো ভাই পড়ে গেলেন বেকায়দায়। লতিফ সিদ্দিকীর অনুপস্থিতিতে কলেজে পলিটিক্স শুরু হলো। একসময় বড়ো ভাইকে হতে হলো সেই কলেজছাড়া। তখনও তিনি নূতন চাকরি খুঁজছেন। তার কাছ থেকে তাই তেমন উৎসাহ পেলাম না ঢাকায় ভর্তির ব্যাপারে।
মনে মনে আমিই সিদ্ধান্ত নিলাম। যে করেই হোক ঢাকা কলেজে পড়তে হবে। প্রয়োজনে জায়গীর থেকে হলেও। মা-বাবাকে বুঝালাম আমি টিউশনি করে পড়বো। পাশের বাড়ির নুরু বুজির স্বামী দানেশ ভাই তখন ঢাকায় বেকারিতে কাজ করেন। উনি বাড়ি যাবার পর তার সাথে চলে এলাম ঢাকায়। আমার হাতে অল্প কিছু টাকা তুলে দিলেন বাবা। মা খুব চিন্তিত মনে আমাকে বিদায় দিলেন। বারবার বলে দিলেন- ঢাকায় এতো মানুষ, রাস্তায় গাড়ির ভীড়! সাবধানে চলিস বাবা। যদিও বন্ধু রউফের সাথে একবার ঢাকায় এসেছিলাম, জীবনের প্রথম সেটাই ঢাকায় রাত্রিবাস। দানেশ ভাইয়ের সাথে উঠলাম নারিন্দার এক খুপড়ি মেসবাড়িতে। মাথা বাঁচিয়ে সিঁড়ির নিচ দিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। খেয়েদেয়ে এক বিছানায় তার সাথে কোনোমতে রাতে ঘুমালাম। সকালে পাশে ফিসফিসানির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। চেয়ে দেখি মেসের ম্যানেজার সালাম ভাই আর বুয়া। তারা কী করছিলো বুঝে উঠার আগেই সালাম ভাই বুয়াকে বললো- দেখো তো বাথরুমের লাইন হালকা হইছে নাকি? আমি গোসল করতে যামু। একটু পরে আমি যেয়ে দেখি পায়খানা-পেশাব-গোসলের জন্য বিশাল লাইন। একসময় আমিও সুযোগ পেলাম। ততক্ষণে আমার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কোনোমতে টয়লেটে গিয়ে ভারমুক্ত হলাম। গোসল সেরে নাস্তা খেয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম দানেশ ভাইয়ের সাথে। উদ্দেশ্য ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়া।
গাড়ি থেকে নেমে নয়ন ভরে দেখলাম আমার স্বপ্নের কলেজ। গেইটে লেখা ‘ঢাকা কলেজ’ স্থাপিত- ১৮৪১ সাল। মুগ্ধ বিস্ময়ে ভাবলাম- এতো পুরনো নামীদামী কলেজের ছাত্র হতে যাচ্ছি আমি! কলেজে ঢুকে সরাসরি চলে গেলাম ভর্তি অফিস রুমে। আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র মার্কসিট, টেস্টিমোনিয়াল দেখালাম। তখনও সার্টিফিকেট তোলা হয় নাই। কলেজের কেরানী সব ঘেঁটেঘুঁটে ভালো করে পরখ করে দেখলেন। মার্ক দেখে বললেন- কোত্থেকে যে এতো স্টার মার্ক আসে বুঝি না, নিশ্চয়ই নকল করে এতোসব! শুনে আমার মেজাজ গেলো বিগড়ে। কেরানীর সাথে বচসায় লিপ্ত হলাম। দানেশ ভাই কোনোমতে আমাকে থামিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করলেন। কেরানীকে বললেন- বাচ্চা মানুষ, কিছু মনে করবেন না। কিন্তু আমার প্রতিবাদী মন তাতে তুষ্ট হলো না। ভর্তি হলাম শেষে তবে যেরকম খুশি মনে ফেরার কথা তা আর হলো না। দানেশ ভাইয়ের মেসে ফিরে মন খারাপ করে শুয়ে রইলাম। আর চিন্তা করতে থাকলাম- ঢাকা শহরে কিভাবে চলবো, কোথায় থাকবো?
পরদিন কলেজে চলে এলাম। ব্রাহ্মণশাসন থেকে আসার সময় আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র রফিক ভাইয়ের ঠিকানা, রুম নম্বর কাগজে টুকে এনেছিলাম। উনি ঢাকা কলেজের উত্তর ছাত্রাবাসে থাকতেন। উঠলাম গিয়ে তার রুমে। আমার সব অবস্থা জানালাম। একই স্কুলে হওয়াতে রফিক ভাই অবশ্য কিছুটা জানতেন। তাকে বললাম- আমি জায়গীর থাকবো। যার জন্য ভর্তির সময় ছাত্রাবাসে থাকার অপশন দেইনি। শুনে রফিক ভাই খুব আশ্চর্য হলেন। বললেন- তুমি জায়গীর থাকবে কেন? হস্টেলে থেকে টিউশনি করলেই তো চলে। আমার চোখ তখন ছানাবড়া। বললাম- না, রফিক ভাই আমি জায়গীরই থাকবো। তা নাহলে আমার পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব হবে না। তিনি বেশি কিছু না বলে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন- ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করবো জায়গীরের ব্যবস্থা করতে।
রফিক ভাইয়ের সাথে হস্টেলে থেকে বেশ ক’দিন কাস করলাম। এদিকে আমার হাতের টাকা শেষ হয়ে আসছে। খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। এরপরে খাবো কি? হস্টেলের বিল তো আর টানা সম্ভব না। বাড়ি থেকে টাকা আসারও কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রতিদিন বিকেলবেলা পরিচিত লোকদের কাছে যাই। জায়গীরের কথা বলি। কিন্তু সবাই শুধু টিউশনির ব্যবস্থার কথা বলে। শহরে জায়গীর পাওয়া দুষ্কর। এরমধ্যে হঠাৎ করেই একদিন কপাল গেলো খুলে আমার। রফিক ভাইয়ের গ্রামের এক ভাই খবর নিয়ে হাজির। নাম আবদুল হালিম, ঢাকায় চাকরি করেন। রফিক ভাই বোধ হয় আগের থেকেই উনাকে বলে রেখেছিলেন। তার এক মামা থাকেন গ্রীনরোড স্টাফ কোয়ার্টারে। সেখানে জায়গীরের ব্যবস্থা হয়েছে। জায়গীরপ্রভু ভদ্রলোক পিডিবিতে চাকরি করেন। তার ছেলেমেয়ে পড়ানোর বিনিময়ে আমাকে জায়গীর রাখবেন। সেইদিন বিকেলেই হালিম ভাই আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন কলাবাগানে। শুরু হলো আমার তৃতীয় জায়গীরজীবন। গ্রীনরোড স্টাফ কোয়ার্টারের সাত নম্বর বিল্ডিং-এর কিউটপ নম্বর বাসায়।
১৩.০৭.২০০৮
জায়গীরনামা- এক
জায়গীরনামা- দুই
জায়গীরনামা- তিন
জায়গীরনামা- চার
মন্তব্য
খুব ভাল লাগলো।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আলমগীর।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
গল্পের নায়ককে শ্রদ্ধা। সাবলীল লিখেছেন।
একটা গোপন কথা ফাঁস করে দেই কাকু, আমি কিন্তু এইচএসসিতে নকল করেই স্টার পেয়েছিলাম।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
কাকু আপনাকেও শুভেচ্ছা। গোপন কথাটা ফাঁস হলেও স্টার মার্কের জন্য অভিনন্দন।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
চলুক কবির জীবনকথা..
--------------------
অর্থ নয়, কীর্তি নয় ,স্বচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
ধন্যবাদ রাফি। আপাতত কয়েকটি পর্ব চালানোর ইচ্ছে আছে।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
জলিল ভাই, আপনার সাথে অনেক কিছুই দেখি মিলে যাচ্ছে আমার, দেশের বাড়ি আমারো টাঙ্গাইল, ঢাকা কলেজে পড়ার সময় পুরোটাই থেকেছি উত্তর ছাত্রাবাসে।
আপনার এই সিরিজটা অসাধারণ হচ্ছে বললেও কম বলা হয়। দারুণ সহজিয়া গদ্য। মুগ্ধ পাঠক হয়ে আছি। চালিয়ে যান।
ধন্যবাদ ফারুক হাসান। আপনার মন্তব্য লেখায় উৎসাহ জাগাবে।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
চলুক এই নিরহংকারি মানুষটার উত্থানপর্বের কাহিনী।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
চলুক, চলুক, চলুক...
অপেক্ষায় থাকলাম।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
দারন লিখছেন ভাই...অসাধারণ...
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
আমরা তথাকথিত সভ্য মানুষেরা শিখেছি নিজের অতীত আর পূর্বপুরুষের পরিচয় লুকিয়ে রাখতে। এমনটি করে হয়তো তথাকথিত সভ্য হতে পারি ঠিকই- মানুষ হতে পারি না।
জলিল ভাই, পড়ছি কিন্তু। বাকি পর্বের অপেক্ষায়।
এই সুযোগে "বই" বিভাগে পৃষ্ঠাগুলো জুড়ে দিতে পারতেন। পিডিএফ বই হয়ে যেত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
ধন্যবাদ ফারুক ওয়াসিফ, সংসারে এক সন্ন্যাসী, রায়হান আবীর ও জুলিয়ান সিদ্দিকী।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
নতুন মন্তব্য করুন