কবি সমুদ্র গুপ্ত আর নেই! আমরা তাঁকে বাঁচাতে পারিনি। আমরা ব্যর্থ। ব্যর্থ আমাদের সমস্ত শক্তি। মরণব্যাধি ক্যান্সার তাঁকে কেড়ে নিয়ে গেছে। তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ, শ্রদ্ধাঞ্জলি আজ হয়তো অনেকেই লিখবেন। কিন্তু কবি আর ফিরে আসবেন না কোনোদিন! জীবিতকালে যাঁর জন্য আমরা করতে পারিনি কিছুই- তাঁকে নিয়ে লেখা কি ঠিক হচ্ছে? হয়তো না। তবুও কিছু লিখে বাংলা কবিতায় তাঁর ঋণ শোধ করবার তাগিদ অনুভব করছি। যে ঘটনা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তা হলো-
আমার পূর্বতন সংস্থার তখন রমরমা অবস্থা। মুক্তিযুদ্ধের ছড়া, কবিতা, উপন্যাস, গবেষণা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড! সংস্থায় কাজ করছেন অনেক নামকরা কবি, কথাসাহিত্যিক, চিত্রশিল্পীগণ। বিশাল বিশাল প্রজেক্ট হাতে নিয়ে দেদারছে টাকা কামাচ্ছেন তারা। ঠিক এমন সময় আমার পূর্বপরিচিত গণসংস্কৃতির কর্মী অভিনেতা জহিরুজ্জামান ভাই ফোনে জানালেন- কবি সমুদ্র গুপ্তকে নিয়ে উনারা একটি প্রজেক্ট জমা দিতে চান আমাদের সংস্থায়। যদিও আমি ঐ বিভাগের কেউ না তবুও বললাম- ঠিকাছে, আসুন একদিন। জহিরুজ্জামান ভাই যথারীতি একদিন কবি সমুদ্র গুপ্তকে নিয়ে অফিসে আমার রুমে হাজির। তখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম- কোন্ বিষয়ে প্রজেক্ট করবেন? জবাবে সমুদ্র দা বললেন- নদী ও জীবনবৈচিত্র নিয়ে; যেমন নদীর সাথে সম্পৃক্ত শিল্প, সংস্কৃতি ও সংগ্রাম। আমি বললাম- এখানে তো বেশিরভাগ প্রজেক্ট মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। সংস্থার চেয়ারম্যান মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রজেক্টগুলোতে বেশি জোর দিচ্ছেন।
সংস্থার চেয়ারম্যানের কাছে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দাদাসহ চলে গেলোম তার রুমে। যাবার আগে সমুদ্রদাকে বললাম- দাদা, যে প্রজেক্ট-এর কথাই বলেন না কেন মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট যেন হয়। কথা শুরু করলাম আমি, সমুদ্র দা আর জহিরুজ্জমান ভাই। চেয়ারম্যান সাহেবকে বললাম- সমুদ্র দা একটি নতুন প্রজেক্ট করতে চান। উনি সমুদ্র দাকে বোধ হয় আগে থেকেই চিনতেন। তবুও চেয়ারম্যান বলে কথা! একটু ভাবগম্ভীর হয়ে বললেন- বলুন দাদা, কী প্রজেক্ট করবেন? সমুদ্র দা তখন বললেন- এমন কোনো নদী কি আছে বাংলায়- যে নদী মুক্তিযোদ্ধারা পাড়ি দেয়নি? দাদার এমন প্রশ্নে আমরা সবাই বিস্মিত হলাম। আশেপাশের আমরা সবাই তখন কথাটি ভাবছি। চেয়ারম্যান সাহেব তো অনেকণ তাঁর দিকে চেয়েই রইলেন। সমুদ্র দাকে বললেন- ঠিকাছে দাদা, আপনাকে প্রজেক্ট দেবো। আমি, সমুদ্র দা আর জহিরুজ্জমান ভাই খুশি মনে বেরিয়ে এলাম।
কিন্তু সমুদ্রদা’র সেই প্রজেক্ট আর জমা হয়নি সংস্থায়। চেয়ারম্যান সাহেবও আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন তাঁর কথা। জহিরুজ্জামান ভাইকে অনেক ফোন করে প্রজেক্ট-এর কোন হিল্লা করতে পারিনি। সময় করতে পারেননি সমুদ্র দা, সময় হয়নি জহিরুজ্জমান ভাইয়েরও। অথচ কতোজনে যে কতোভাবে এমন প্রজেক্ট করে সংস্থা থেকে কামিয়েছেন তার ইয়ত্ত্বা নেই। এমনই ছিলেন কবি সমুদ্র গুপ্ত। কোথাও তিনি স্থির থাকেননি, নিয়মিত কোনো চাকরিও করেননি কোথাও। বন্ধুবৎসল হাসিমুখ এই মানুষটি নিজের জন্য কিছুই করেননি। নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন কবিতার জন্য, মানুষের জন্য। বাইরে থেকে তাঁর সংসারের অভাব, দৈন্যতা আমরা হয়তো অনেকেই বুঝিনি। ধীরে ধীরে তিনি এগিয়ে গেছেন মরণব্যাধি ক্যান্সারের দিকে। কিন্তু যাবার তিনি রেখে গেছেন কবিতায় তাঁর কীর্তি-
পৃথিবীর রাজপথে চিৎপাত শুয়ে থাকা
এ রকোম কুকুরের লাশ যেন বাংলাদেশ
আসলে তো, বাংলাদেশ মানেই হলো
জীবনের মুখোমুখি বুলেটের অসভ্য চিৎকার
শোক চিহ্ন কালোব্যাজ পৃথিবীর শহীদ মিনার.....সমুদ্র গুপ্ত
কবি সমুদ্র গুপ্ত আজ আর আমাদের মাঝে নেই! সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি রইলো আমাদের সকলের সমবেদনা।
২০.০৭.২০০৮
মন্তব্য
অসাধারণ ।
কেউ একজন অপেক্ষা করে
সমুদ্র গুপ্তের এই কবিতাটি আমার খুব পছন্দের।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
উদ্ধৃতি
এমন কোনো নদী কি আছে বাংলায়, যে নদী কোনো মুক্তিযোদ্ধা পাড়ি দেয়নি?
ম্যাজিকলন্ঠণের কবিতা আড্ডায় যেদিন তিনি কবিতা পাঠ করতেন না, সেদিন আমরা তার মুখনিসৃত কোনো ঘটনা বা কোনো অভিজ্ঞতার কথা শুনতে বায়না। ধরতাম।
হয়তো ম্যাজিকলন্ঠণ আছে। থাকবে। কিন্তু সেই আড্ডায় শামিল হবেন না সমুদ্রগুপ্ত। কিন্তু আমাদের ভালোবাসায় তিনি উপস্থিত থাকবেন দীর্ঘকাল।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
এভাবে কোনোদিন ভাবিনি! সত্যিই তো। এই লেখাটা না লেখা হলে সমুদ্র গুপ্তর অসাধারণ পর্যবেক্ষণটি কোথাও লিপিবদ্ধ হতোই না হয়তো। ধন্যবাদ আপনাকে।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
কবিকে শ্রদ্ধা
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
কত মানুষের কাছে আমরা এভাবে ঋণী হয়ে আছি। নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে একদিন এই মানুষগুলো নিরবে সমুদ্র গুপ্তর মতো চলে যান। কবির প্রতি রইলো শ্রদ্ধাঞ্জলি।
জুবায়ের ভাইয়ের মতো আমি ও এরকম চমকে উঠেছিলাম । কি ভীষন সত্য-অথচ কোনদিন ভাবনায় ও আসেনি ।
কবিরা বোধ হয় এভাবেই আলাদা কিছু,আলাদা কেউ ।
-------------------------------------
"এমন রীতি ও আছে নিষেধ,নির্দেশ ও আদেশের বেলায়-
যারা ভয় পায়না, তাদের প্রতি প্রযোজ্য নয় "
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
এমন কোনো নদী কি আছে বাংলায়-
যে নদী মুক্তিযোদ্ধারা পাড়ি দেয়নি?
আসলেই তো ! এভাবে কখনো ভাবা হয় নি।
কবি সমুদ্র গুপ্তের এ কথাটি বেশ ভাবায়।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
নতুন মন্তব্য করুন