সাত নম্বর বিল্ডিং-এর কিউটপ বাসাটা চারতলায়। প্রথমদিন সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠলাম। গ্রামে মানুষ, সিঁড়ি ভাঙার ঘটনা জীবনে প্রথম। বাসায় ঢুকে হালিম ভাইয়ের মামা-মামী মানে আমার আশ্রয়দাতাদের সালাম করলাম। আমাকে দেখে মনে হয় খুশিই হলেন। আমার চেহারার মায়াবী ভাবটা বোধ হয় সবার পছন্দ! ভদ্রলোকের নাম ফজলু সাহেব। প্রথমদিন থেকে তাকে মামা বলে ডাকতে লাগলাম। আর স্ত্রীকে যথারীতি মামী। ভদ্রলোকের সাত সন্তান। তিন মেয়ে, চার ছেলে। সবার বড়ো জয়নূল প্রায় সমবয়সী। তবে আমার নিচের কাসে পড়ে। সামনে এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
কোয়ার্টারের এই বাসাগুলো দুই রুমের। এক রুম আবার সাবলেট দেয়া। সেখানে হালিম ভাই থাকেন। সামনে বারান্দাকে এরা হার্ডবোর্ড দিয়ে আলাদা করে থাকার ব্যবস্থা করেছে। জয়নূলের সাথে আমার সেখানেই থাকার জায়গা দেয়া হলো। রুমে একটা ছোটো খাট, পাশে পড়ার টেবিল- সেখানে আমারও পড়ালেখা করতে হবে। অন্যরা সব বাবা-মায়ের সাথে এক রুমে ঘুমায়। আমাকে জায়গীর নেয়া হয়েছে মূলত জয়নূলকে পড়ানোর করানোর জন্য। তবে মাঝে মাঝে অন্য সবাইকেও পড়া দেখিয়ে দিতে হতে পারে।
জয়নূল সবার বড়ো ছেলে। তার প্রতি বাবা-মায়ের আলাদা টান। খাবারদাবারে সে পেতো স্পেশাল কিছু। আর আমরা অন্যরা পেতাম কম কম। এতে আমার অসুবিধা না হলেও অন্য ভাইবোনেরা এটা সবসময় মানতে চাইতো না। দেখে আমি মনে মনে হাসতাম। আর কী-ই বা করার আছে? ফজলু মামার ছোট্ট চাকরি, অল্প বেতন পান। পিডিবি’র দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। ঘরে সাত ছেলেমেয়ে তার উপর আমি জায়গীর। ঢাকা শহরে একের উপার্জনে দশজনের সংসার চালানো কতো কষ্টের সেটা বুঝতে পেরেছিলাম।
তখন সরকারী কর্মচারীদের জন্য রেশন ব্যবস্থা চালু ছিলো। মাঝে মাঝে ফজলু মামা আমাকে সাথে নিয়ে রেশন তুলতে যেতেন কলাবাগান প্রথম লেনে। কিন্তু ভদ্রছেলে জয়নূলের মুখে সে চালের ভাত উঠতো না। তার জন্য রাঁধতে হতো বাজারের কেনা চালের ভাত। বাকি আমাদের সবাকেই সেই রেশনের চালের ভাত, আটার রুটি পেট পুরে খেতে হতো। বিশেষ করে খাবার নিয়ে উচ্চবাচ্য করার কোনো জো আমার ছিলো না। আমি এসব খাবারে অভ্যস্তও ছিলাম। অল্প বয়সে নিম্নমানের খাবার নিয়ে অভিজ্ঞতার কমতি ছিলো না। চুয়াত্তরের মতো একটি দুর্ভি অন্তত আমি দেখতে পেরেছিলাম। লিকলিকে ক্ষীণস্বাস্থ্যের অধিকারী সেই শরীরটাতে তখনও বোধ হয় তার ছাপ কাটেনি!
ফজলু মামার ছেলেমেয়েদের পড়ানোর পাশাপাশি আমার আর একটি কাজ ছিলো দৈনন্দিন বাজার করা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার করতে যেতাম কাঁঠালবাগানে। আগে বড়োছেলে জয়নূল বাজার করতো। আমি আসার পর সেটা বন্ধ হয়ে গেলো। এতে মনে মনে জয়নূল আমার উপর কিছুটা ক্ষ্যাপা ছিলো। বাজার করতে যেয়ে জয়নূল যে পয়সাটা বাঁচাতে পারতো, একমাত্র আমার জন্যই সেটা বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু মামী আমার বাজার বেশ পছন্দ করতেন। দেখেশুনে কম পয়সায় ভালো বাজার করায় আমার তুলনা ছিলো না। সেই কিশোর মনে কখনও টাকা-পয়সা মারার চিন্তা আসেনি। তাই খুব অল্পদিনেই মামা-মামীর বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পেরেছিলাম।
গ্রীনরোড স্টাফ কোয়ার্টারে জায়গীর থাকি। পায়ে হেঁটে প্রতিদিন ক্লাস করতে যাই ঢাকা কলেজে। কলাবাগান থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত অনেকেই রিক্সায় যায়, বড়োলোকের ছেলেরা যায় গাড়িতে। সেসবে আমার কোনো আফসোস হতো না। এসএসসি পর্যন্ত লুঙ্গি-শার্ট পরেই ক্লাস করতাম। গ্রামের স্কুল বলে খারাপ লাগতো না। তাছাড়া আমার মতো অনেকেই তখন লুঙ্গি পড়তো। ঢাকা শহরে এসে যদিও প্যান্ট-শার্ট জুটলো, কিন্তু যখন দেখতাম আমার পায়ে স্পন্সের স্যান্ডেল আর অন্যদের পায়ে চামড়ার জুতো বা স্যান্ডেল খুব খারাপ লাগতো। আমি যে গ্রাম্য তে, গৈগেরাম থেকে এসেছি- আমার কলেজের ল্যাবরেটরি স্কুল পড়ুয়া ছেলেরা সেটা চিনতে ভুল করতো না। নানাভাবে, নানাকথায় তারা আমাকে টিজ করতো। মাঝে মাঝে আফসোস জাগতো মনে- কেন ধনী ঘরে জন্ম নিলাম না, আমার কেন ভালো শার্ট-প্যান্ট-জুতো হলো না। কতোদিন যে একা একা কেঁদেছি বলতে পারবো না!
তবে শহরেও যে ভালো মনের ছেলেরা আছে তারও পরিচয় পেতাম। ধানমণ্ডি স্কুল থেকে পাস করা ফারুক তো শেষে আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েই গেলো। খারাপ ছেলেদের মন্তব্যে আমার মন খারাপ হলে সে আমাকে সাহস দিতো। কাছে ডেকে বন্ধুসুলভ অনেক কথা বলতো। কলেজে যেতে যেতে পরিচয় হলো গ্রীনরোড স্টাফ কোয়ার্টারের লুৎফর, ইশতিয়াক, মহসিন, বাচ্চু, বাবু, আবুবক্করসহ অনেকের সাথে। ওরাও ছিলো নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। এরপরে ওদের সাথে দল বেঁধে হেঁটে কাস করতে যেতাম ঢাকা কলেজে।
স্টাফ কোয়ার্টারের বন্ধুরা কেউ থাকতো বাবা-মায়ের সাথে। কেউ কেউ বড়ো বোন বা ভাইয়ের সাথে। তাদের বাবা-মা খরচ পাঠাতো নিয়মিত। আমার খরচ দেবার কেউ ছিলো না বাড়িতে। যদিও স্টাইপেন্ড পাবার কারণে কলেজে বেতন তেমন লাগতো না, তবু বই-খাতা-কাগজ-কলম-তেল-সাবান কোথায় পাবো? বাধ্য হয়ে আমাকে টিউশনি ধরতে হলো। জায়গীর বাড়িতে ফজলু মামার ছেলেমেয়েদের পড়ানো আর টিউশনির চাপে নিজের পড়ার খুব একটা সময় পেতাম না। তাছাড়া টিউশনির জন্য হাঁটা পড়তো খুব বেশি, জায়গীর বাড়িতে টুকটাক কাজও করতে হতো। রাতে শরীর বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়তো। পড়াশোনার আগ্রহ বা সাধ্য খুব একটা থাকতো না। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেই এক ঘুমে রাত শেষ হয়ে যেতো। সকালে কোনো কোনোদিন বাজার, তারপর কলেজ এবং বিকেল-সন্ধ্যায় টিউশনি কিংবা জায়গীর বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়ানো- এই ছিলো নিয়মিত ডিউটি আমার।
জয়নূলের পিঠাপিঠি ছোটো তিন বোন- ফজিলা, ফিরোজা ও ফাতেমা। তারপর আবার তিন ভাই- জাহিদ, জাকির, জাহাঙ্গীর। ফিরোজাকে ওরা ফিরু এবং ফাতেমাকে ডাকতো আসমা বলে। একটা ব্যাপারে আমাদের ভাইদের সাথে ওদের নামের মিল ছিলো। সব ভাইদের নামের আদ্যর জ। আমার মেঝ ভাইয়ের নামও জয়নূল। তবে ভাইবোনদের সংখ্যায় ওদের চেয়ে আমরা এক ধাপ উপরে- ছয় ভাই, তিন বোন। ফজলু মামার গ্রামেরবাড়ি আবার টাঙ্গাইলেই- বাশাইলের কাউলজানী। সেজন্য কথাবার্তা, চালচলনে আমার সাথে বেশ মিলতো। ফজলু মামা মানুষটাকে আমার খুব ভালো লাগতো। তাকে নিজের মামার মতোই ভাবতাম। আর আফসোস হতো মনে- ঢাকা শহরে এরকম একজন মামা যদি আমার থাকতো! তাহলে হয়তো আমাকে জায়গীর থেকে এতো কষ্ট করতে হতো না।
ফজলু মামা খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। বাসার সবাইকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হতো। আমাকেও একই নির্দেশ দেয়া হলো। স্কুল বোর্ডি-এ থাকাকালীন জীবনে একবার পড়েছিলাম জয়নূল স্যারের হাতে। তাঁরও কড়া নির্দেশ ছিলো নামাজের ব্যাপারে। এবার পড়লাম ফজলু মামার হাতে এসে। আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি নামাজ পড়েছি বোধ হয় এই স্টাফ কোয়র্টার জায়গীর জীবনেই। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে খারাপ লাগতো না। শরীর, মন বেশ সতেজ থাকতো। তাছাড়া একটা শৃঙ্খলার মধ্যে জীবনকে বেঁধে ফেলতে সাহায্য করতো। তবে আমার খুব অসুবিধা হতো রমজানের সময়। সারাদিন রোজা থাকার পর সন্ধ্যায় মাগরিব, তারপর রাতের খাবার খেয়ে তারাবীহ্। কী এক শৃঙ্খলার মধ্যে যে পড়ে গিয়েছিলাম বোঝাতে পারবো না!
এমনিতেই দুর্বল, ক্ষীণকায় শরীর নিয়ে রোজা থাকা, তার উপর খতম তারাবীহ্র লম্বা নামাজ। কোনো কোনোদিন এমন হতো নামাজে দাঁড়িয়ে ক্লান্তিতে, ঘুমে ঝিমাতাম। কোনোদিন হয়তো সেজদায় গিয়ে একটুখানি ঘুমিয়েও পড়তাম। পাশ থেকে কেউ ঠেলা দিলে আবার কাতারে দাঁড়াতাম। মাঝে মাঝে কিছু অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যেও পড়তে হতো আমাকে। ইমাম সাহেব হয়তো খতম তারাবীহর লম্বা সুরা পড়ছেন- এদিকে আমার আবার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এসব ব্যাপার কতোণ আর চাপা দিয়ে রাখা যায়? পেশাব বা পায়খানার চাপে জামাত ছেড়ে সবার সামনে দিয়েই হঠাৎ করে দৌড়ে বের হয়ে যেতাম। নামাজে দাঁড়িয়েও এ অপকাণ্ড আড়চোখে দেখতেন ধর্মপ্রাণ মানুষদের কেউ কেউ। আমার খুব লজ্জা লাগতো তখন। রাগে-দুঃখে অপমানে মনে মনে বলতাম- হায়রে প্রকৃতির ডাক, তোর আর সময় পেলি না আমাকে ডাক দেবার!
১৯.০৭.২০০৮
জায়গীরনামা- এক
জায়গীরনামা- দুই
জায়গীরনামা- তিন
জায়গীরনামা- চার
জায়গীরনামা- পাঁচ
মন্তব্য
জীবনের অভিজ্ঞতা বেশির ভাগই দুঃখজনক। আর তাই বুঝি অন্যকে ছুঁয়ে যাবার ক্ষমতাও এর বেশি।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
জুলিয়ান ভাই কামডা করলেন কী? আমার আগেই কমেন্ট কইরা ফেললেন?
লেখা জব্বর।
উদ্ধৃতি
জীবনের অভিজ্ঞতা বেশির ভাগই দুঃখজনক। আর তাই বুঝি অন্যকে ছুঁয়ে যাবার ক্ষমতাও এর বেশি।
...কথাটি মনে গেঁথে রইলো।
ধন্যবাদ।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
জীবনের অভিজ্ঞতা বেশির ভাগই দুঃখজনক। আর তাই বুঝি অন্যকে ছুঁয়ে যাবার ক্ষমতাও এর বেশি।
কবি বলেই এমন করে বলতে পারলেন জুলিয়ান ভাই !
আর জলিল ভাই , জায়গীর-গল্পগুলো যে অসাধারণ হচ্ছে, সে ও আপনি কবি বলেই । ভালো লাগছে খুব ।
---------------------------------------------------------
আমার কোন ঘর নেই !
আছে শুধু ঘরের দিকে যাওয়া
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
লেখা বরাবরের মতই ভাল। একটা নির্দিষ্ট কালের প্রতিনিধিত্ব করে স্মৃতিচারন সবসময়েই তথ্যবহুল হয়। এক্ষেত্রেও হয়েছে।
সবার জীবনের সেরা গল্পগুলো বোধহয় কষ্টের হয়।
ভাল থাকবেন।
আপনার জায়গীরনামা-র একজন অনুরাগী পাঠক আমি। খুব ভালো লিখছেন। অকপট স্বীকারোক্তি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের তাজ শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের জীবনেও জায়গীর এবং মেছ উপাখ্যান আছে।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
আমার ব্লগে আপনার মন্তব্য! খুব খুশি লাগছে রিটন ভাই। ধন্যবাদ।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
খুব ভাল লাগল আপনার জয়গীর নামা।
আমারও অনেক সময় মনে হতো " যদি কোন আত্মীয়-স্বজন এই শহরে থাকতো!"
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখার মত একটি সিরিজ। পুরোটা শেষ হলে পিডিএফ আপলোড করে দিয়েন একটা। অনেকের কাছে গল্প করি আপনার লেখাগুলো নিয়ে। তখন হার্ডকপি বিলানো যাবে। সাথে সাথে এটাও জানিয়ে রাখি, নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় আপনার লেখাগুলো পড়ে। বিলাস আর অপচয়েই দিন কাটাই। অন্যদিকে কী কষ্টের ছিল আপনাদের জীবন।
রাজাকার রাজা কার?
এক ভাগ তুমি আর তিন ভাগ আমার!
সরল, অকপট বর্ণনার এই সিরিজটি মুগ্ধ করেই চলেছে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
নতুন মন্তব্য করুন