উনিশ শ' বিরাশি সাল। এরশাদের সামরিক শাসন সবেমাত্র শুরু হয়েছে। চারদিকে থমথমে গুমোট পরিবেশ। লোকজনের কথাবার্তাতেও নিচু স্বর। রাস্তাঘাটে মহিলাদের চলাচলেও চলছে খবরদারী। পরীক্ষার হলগুলোতে চলছে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। এমতাবস্থায় শুরু হলো আমার এইচএসসি পরীক্ষা। কঠিন সংগ্রামী জীবনের উল্লেখযোগ্য পরীক্ষাও ছিলো এটা। এ পরীক্ষায় ভালোভাবে উৎরাতে পারলেই খুলে যাবে আমার উচ্চশিক্ষার দ্বার। আমিও যথাসাধ্য চেষ্টা করছি ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে।
আমাদের ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সীট পড়েছিলো তিতুমীর কলেজে। ইংরেজি, বাংলা ভালোভাবেই দিলাম। কিন্তু বাধ সাধলো এসে রসায়নে। প্রশ্নপত্র এমন ছিলো যে সব প্রশ্নেই অপঠিত কিছু বিষয় জুড়ে দেয়া ছিলো। কাঙ্ক্ষিত মানের চেয়ে সবার পরীক্ষার মান খুব খারাপ হয়ে গেলো। পরীক্ষা শেষে কোয়ার্টারে ফিরে এসে বন্ধুরা মন খারাপ করে বসে আছি। অনেকেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবার আর পরীক্ষা দেয়া হবে না। আমারও মনোভাব অনেকটা তাই-ই ছিলো। এর মধ্যে হঠাৎ আমার বড়ো ভাইটি এসে হাজির। ও বললো- না, পরীক্ষা চালিয়ে যা, যা হবার হবে। পরে দেখা যাবে মান উন্নয়ন পরীক্ষা দিবি কিনা।
সত্যি সত্যিই পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, জীববিজ্ঞান পরীক্ষাগুলো বেশ ভালো হয়ে গেলো। বন্ধুবান্ধব সবার মনটাই দেখি ভালো হয়ে গেছে। আশায় বুক বাঁধলাম যদি একটা প্রথম বিভাগ কপালে জোটে! তাহলে আর পরীক্ষা দিতে হবে না। এদিকে জায়গীরালয়ে প্রচণ্ড পড়াশোনার চাপ আর গরমে আমি অতিষ্ঠ। শরীরে পুষ্টির অভাবও ছিলো বোধ হয়। থিওরী পরীক্ষার পর খুব করে জ্বর হলো একদিন। ক'দিন পরে শরীরে গোটা গোটা দাগ দেখে বুঝলাম জলবসন্ত হয়েছে। সামনে আমার প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা। তখন চোখে অন্ধাকার দেখছি। কেমন করে পরীক্ষা দেবো? শুরু হলো বন্ধুবান্ধব ও বড়ো ভাইয়ের দৌড়াদৌড়ি। কলেজ কর্তৃপক্ষ আমার এ অবস্থায়ই পরীক্ষা নিতে রাজি হয়ে গেলো।
কলেজের দেয়া নির্দিষ্ট তারিখে প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা দিতে গেলাম। পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষাটা ভালোভাবেই দিলাম। জীববিজ্ঞানের ম্যাডাম আমাকে আলাদা রুমে বসে পরীক্ষা দিতে বললেন। উদ্ভিদবিজ্ঞান ভালোই হলো, কিন্তু দূরে থাকার কারণে প্রাণীবিজ্ঞানের স্লাইডে এসে বেয়ারাদের সাহায্য নিতে পারলাম না। একটা স্লাইড মনে হয় ভুল হলো। ম্যাডাম খুব ভালো থাকার কারণে উতরে গেলাম। তবে বাঁধ সাধলো আমাদের রসায়ন স্যার। উনি বললেন- আমার পরীক্ষার খাতা জীবাণুমমুক্ত করে এনে দিলে হাতে নেবেন, এর আগে না! কিন্তু এক্সটারনাল খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি পটাপট খাতা দেখে কিছু প্রশ্ন করে নম্বর বসিয়ে নিলেন। সেবার পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন প্র্যাকটিকালে কলেজের সর্বোচ্চ নম্বরই পেয়েছিলাম।
সমস্ত শরীরে গোটা গোটা জলবসন্ত নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলাম। জায়গীরবাড়িতে সেবাযত্নের তেমন কেউই নাই। খালাম্মা এসে মাঝে মাঝে একটু যা খবর নেন। আপন বলতে ঢাকার বাড়িতে ঐ ভাইটি শুধু। সেও আমার সাথে থাকে না। তিন নম্বর বিডিআর গেটের মানচিত্র অফিসের খুপড়িতে থাকে। সারাদিন সীসার টাইপের লেখা কম্পোজ আর মাঝে মাঝে সংবাদ সংগ্রহ তার কাজ। কোনোদিন ফাঁক পেলে আমাকে দেখে চলে যায়। আমার অবস্থা জানিয়ে বাড়িতে খবর দেয়া হলো। বাড়িতে চলে যেতে বললেন সবাই। ওদিকটার অবস্থাও ভালো না। একমাত্র উপার্জনক্ষম সবচেয়ে বড়ো ভাই পটুয়াখালীতে গিয়ে কীসের মামলায় যেন জড়িয়ে পড়েছে। তার চলছে হাজতবাস। সংসারে খুব অভাব-অনটন। বাধ্য হয়ে আমাকে চলে যেতো হলো গ্রামের বাড়িতে। সেখানে সারাদিন টিউশনি করি। ব্যাচ করে পড়াই কাস টেন পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের। অপো করি- কবে বের হবে আমার এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট!
বাড়ি থেকেই খবর পেলাম এইচএসসি-র রেজাল্ট বের হয়েছে। তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে এলাম বড়ো ভাইয়ের কাছে। সেইদিন বিকেলেই চলে গেলাম কলাবাগান স্টাফ কোয়ার্টারে। আমাকে দেখে বন্ধুদের সে কী খুশির বাহার! সবাই আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। আমি প্রায় সত্তর ভাগ নম্বর ও একটি লেটারসহ পাস করেছি। সমস্ত স্টাফ কোয়ার্টারের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে একমাত্র ইশতিয়াক স্টার মার্ক পেয়েছে। তারপরই আমার মোট নম্বর। লুৎফর তো আমকে দেখিয়ে সবাইকে বলতে লাগলো- দেখছিস্, স্যারদের কাছে কোনো প্রাইভেট না পড়েও ও ফিজিক্সে লেটার পেয়েছে! ভালো রেজাল্ট করতে শুধু প্রাইভেটেই কাম হয় না। আমার অবশ্য আফসোস ছিলো কেন এইচএসসিতেও স্টার মার্ক পেলাম না! একটুর জন্য কেন গণিতে লেটারটা হলো না? আবার মনে মনে আল্লাহ্-কে শুকরিয়া জানাই- যাক, প্রথম বিভাগ তো পেয়েছি। এবার উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দেবার সুযোগ অন্তত পাবো।
এদিকে বারো নম্বর বিল্ডিং-এ যেখানে জায়গীর থাকতাম ওরা না করে দিলো। আমার অপরাধ- কেন আমি পরীক্ষা শেষে বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম? এখন নাকি আমার আর প্রয়োজন নাই। বন্ধুদের খবরটা জানিয়ে চলে গেলাম তিন নম্বর বিডিআর গেটে মানচিত্র পত্রিকা অফিসে। ওখানে বড়ো ভাই এবং পত্রিকার আরো ক'জন স্টাফ থাকেন। আমি তাদের সাথে গাদাগাদি করে থাকি। অবসর পেলেই সীসার টাইপে কম্পোজ করা শিখি। ধীরে ধীরে নিয়মিত কম্পোজিটরদের মতো আমার হাতও চালু হয়ে গেলো। এতে পত্রিকার সম্পাদক খন্দকার মাসুদুর রহমান স্যার খুশিমনে আমাকে সেখানে থাকতে দিলেন।
পত্রিকা অফিসে থাকার ব্যবস্থা হলেও পেট চালানোর জন্য আমাকে টিউশনি খুঁজতে হলো। নতুন করে শুরু হলো আরেক সংগ্রাম। মেসে চার-পাঁচজনের ভাত রান্না হয়। কেনোদিন টাকা না থাকলে তাও বন্ধ। এদিকে আরেক অভাগা বন্ধু জুলহাস এসে জুটেছে আমার সাথে। ওর অবস্থা আমারই মতো। সারাদিন দুজন মিলে টিউশনি খুঁজি, পত্রিকায় ভর্তি সংক্রান্ত খোঁজখবর নেই। পকেটে টাকা থাকলে ফুটপাতের ইটালিয়ান হোটেলে খাই। টাকা কম থাকলে ঐসব দোকান থেকে রুটি কিনে ভাগ করে খাই। টাকার অভাবে এমনও দিন গেছে চব্বিশ ঘন্টায় একটা রুটি হয়তো পেটে পড়েছে কোনো কোনোদিন।
কিন্তু বিধি বাম! আমার কপাল খারাপ। তিন নম্বর বিডিআর গেটের ঐ অফিসটিও ছেড়ে দিলেন পত্রিকার সম্পাদক। নতুন করে অন্য জায়গায় অফিস নেবেন। ততোদিন আমি কোথায় থাকি? স্টাফ কোয়ার্টারের বন্ধুরা পরামর্শ দিলো ওখানকার কমিউনিটি সেন্টারে থাকতে। এতে নাকি সবার সাথে যোগাযোগ বাড়বে আর উচ্চশিক্ষার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিটাও ভালো হবে! আমি এবং জুলহাস রাজি হয়ে গেলাম ওখানে থাকতে। লুৎফর, ইশতিয়াকরা কমিউনিটি সেন্টারের সভাপতিকে আগেভাগে বলে রাখলো আমাদের থাকার কথা।
স্টাফ কোয়ার্টার কমিউনিটি সেন্টার মূলত বড়োদের আড্ডার জায়গা। বিয়ে বা পার্বনে হলরুমগুলো ভাড়া দেয়া হয়। দু'চারজন কর্মচারী আছে দেখাশোনার জন্য। তাদের থাকার রুম আছে। আমাদের থাকার শর্ত হলো সন্ধ্যার আড্ডা শেষে যে কোনো রুমে বেঞ্চি বা টেবিল একত্র করে তাতে ঘুমাতে হবে। বিডিআর গেটের মানচিত্র অফিসে অন্যদের লেপ-কাঁথা-বালিশ শেয়ার করতে পারতাম। এখানে আমাদের জন্য তেমন ব্যবস্থা নেই। নিজেরা যা এনেছি তা অপ্রতুল। দুটি কাঁথা আর দুটো বালিশ। দুটো টেবিল একত্র করে সেগুলো দিয়েই দুজন থাকি। সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে তাতেই আরামের ঘুম হয় আমাদের। ঘুমালে দুনিয়ার কোনো খেয়াল থাকে না আর।
কমিউনিটি সেন্টারের সব লোক চলে গেলে অনেক রাতে ঘুমাতে হয় আমাদের। সাধারণত সকাল আটটা-নয়টা পর্যন্ত ঘুমাই। একদিন ঘুমিয়ে আছি কমিউনিটি সেন্টারে। সেদিন আবার জুলহাস নেই। ও গেছে বাড়িতে। খুব ভোরে কার ডাকে যেন ঘুম ভেঙে গেলো আমার। আধবোঁজা চোখে চেয়ে দেখি ফজলু মামা আমার গায়ে হাত বোলাচ্ছেন। আর আমার নাম ধরে ডাকছেন। আমি ধড়মড় করে উঠে বসি।
বলি- মামা, কেমন আছেন?
ফজলু মামা বললেন- তুমি এখানে থাকো কবে থেকে? ফজরের নামাজ পড়ে যাচ্ছিলাম। জানালা দিয়ে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছো। আমি তো অবাক! মশারী নেই, খুব মশা খাচ্ছিলো তোমাকে। দেখে খুব মায়া হলো।
তারপর বললেন- চলো বাসায় যাই। এখানে এমন কষ্ট করে থাকতে হবে না। আজ থেকে তুমি আমার বাসায়ই থেকো। তারপর কোথাও ভর্তি হলে চলে যেও। তুমিতো একসময় আমার বাসায়ই ছিলে। এখানে থাকলে লোকে আমাকে খুব খারাপ বলবে।
একে তো খালি গা। তার উপর শুয়ে আছি মশারী ছাড়া এমন জায়গায়। খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি। ফজলু মামার কথাগুলো শুনছিলাম। আমার চোখ তখন ছলোছলো। মাথা নিচু করে খানিকটা চুপ করে রইলাম।
তারপর নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বললাম- না মামা, অসুবিধা হচ্ছে না। এইতো আর ক'টা দিন। তারপর তো ভালো কোনো জায়গায় ভর্তির সুযোগ পেলেই চলে যাবো। এ কমিউনিটি সেন্টারে বেশিদিন থাকবো না।
ফজলু মামা আমার মুখের দিকে খানিণ চেয়ে রইলেন। হয়তো আমার অভিমানী মনটা উনি বুঝেছিলেন।
তারপর বললেন- বাসায় এসো, কথা আছে। তার যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইলাম আমি ।
ভাবলাম- এখনও পৃথিবীতে এতো ভালো মানুষ আছে! সেই মুহূর্তে আমার বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। আর টপটপ করে চোখের পানি পড়তে থাকলো বিছানায়।
ইতোমধ্যে আমার মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গারই ভর্তি পরীক্ষা হয়ে গেলো। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষাটা অতো ভালো হয় নাই। তবে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় আমার ভাইভা বোর্ডে প্রথম হলাম। লিখিত পরীক্ষা মোটামুটি হলো। একে একে শেষ করলাম- খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও বাংলাদেশ কৃষি বিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। সেগুলোও খুব ভালো হলো। আমি টিকে গেলাম ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ, খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও বাংলাদেশ কৃষি বিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। ভাগ্য খারাপ, বুয়েটে হলো না আমার। একমাত্র ইশতিয়াক ছাড়া স্টাফ কোয়ার্টারের আর কেউ সুযোগ পেলো না বুয়েটে ভর্তি হবার। প্রিয় বন্ধু লুৎফর সুযোগ পেলো স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ, মিটফোর্ড-এ।
ভর্তি হবো হবো করে শেষ হয়ে গেলো খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির শেষ দিন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ইচ্ছে নেই। বাকি রইলো ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ও চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। আমার ইচ্ছা ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হওয়ার। কিন্তু আমার বড়ো ভাই ও বাড়ি থেকে চাচ্ছে মেডিক্যাল-এ ভর্তি হই। বন্ধুবান্ধবরাও মতামত দিলো মেডিক্যালের। বিশেষ করে লুৎফর তো মেডিক্যাল ছাড়া অন্য কোথাও ভর্তি ঠিক না জানিয়েও দিলো। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর চেয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যালে পড়ার নাকি আলাদা সম্মান আছে- এটা বলতেও ভুললো না। এতো করে বুঝানোর পর আমি কিছুটা নরম হলাম ডাক্তারী পড়ার ব্যাপারে। তবু বড়ো ভাইয়ের সন্দেহ গেলো না আমি আসলেই মেডিক্যালে ভর্তি হবো কিনা!
এইচএসসি পাস করা ছেলেমেয়েরা কে কোথায় ভর্তি হচ্ছে স্টাফ কোয়ার্টারে সেটা জানাজানি হতে বেশিক্ষণ লাগে না। আমারটাও জানাজানি হলো। সাত নম্বর বিল্ডিং-এর কিউটপ বাসায় যেতেই মামী বললেন- তুমি নাকি ময়মনসিংহ মেডিক্যালে ভর্তি হচ্ছো? ওখানে তো আমাদের সেলিমও পড়ে। ভালোই হলো।
আমি বললাম- ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেও সুযোগ পেয়েছি। তবে মেডিক্যালেই বোধ হয় ভর্তি হওয়া লাগবে।
মামী বললেন- না, ডাক্তারীতেই ভর্তি হও। দেশ ও দশের সেবা করতে পারবা। আমাদেরও কাজে লাগবো।
কী যেন চিন্তা করে মামী আবারও বললেন- তোমার ভর্তির কথা শুনে সালমার আব্বা-আম্মা খুব খুশি হয়েছে। সালামাও নাকি তোমাকে খুব পছন্দ করে। ওর বাবা তোমাকে মেডিক্যালে পড়ার খরচ দিতে চায়। তুমি যদি সালামাকে বিয়ে করতে রাজি হও...।
মামীর কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। সালমাদের বাসার সেই ঘটনা মনে পড়ে গেলো। সুর্য কোন্ দিক থেকে ওঠে এখন! সালমা আমাকে পছন্দ করে?
মামীকে বললাম- মামী বলেন তো সালমা আসলে কাকে পছন্দ করে? আমাকে না আমার বড়ো ভাইকে?
মামী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন- এইটা কী বললা তুমি?
আমি বললাম- না মামী, বামন হইয়া আমি আকাশের চাঁদ পেতে চাই না। ওকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাছাড়া ছাত্রাবস্থায় পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য বিয়ে করবো না আমি। টিউশনি করে পড়বো। মনে হয় ময়মনসিংহেও কোনো সমস্যা হবে না।
আমার কথা শুনে মামী বোধ হয় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। আর কোনো কথা বাড়ালেন না। এরপর অন্য প্রসঙ্গে গেলেন। ফজিলার বাচ্চা হবে দু'মাস বাদে, সেলিমের সাথে ফিরুর বিয়ে সামনে এইসব কথা।
অবশেষে ময়মনসিংহে ভর্তির দিনক্ষণ এলো। এবার আমার ঢাকা ছাড়ার পালা। বড়ো ভাই ও কোয়ার্টারের বন্ধুরা একত্র হয়েছে বিদায় জানানোর জন্যে। তারা আমার সাথে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত যাবে। আমি একাই যেতে পারতাম, না গেলেও চলতো। কিন্তু তাদের ভয়- ট্রেনে করে আমি যদি চট্টগ্রাম চলে যাই আবার! কারণ তখনও চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির সময় আছে। ময়মনসিংহগামী বলাকা এক্সপ্রেসে আমাকে তুলে দিলো ওরা। সবার মনই কম বেশি খারাপ। তাদের প্রিয় বন্ধু চলে যাচ্ছে ঢাকা ছেড়ে। তবুও হাসিমুখে হাত নাড়ছে সবাই।
মন আমারও ভীষণ খারাপ। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। গাড়ী খুব ধীরে ধীরে ঢাকা শহর অতিক্রম করছে। কমলাপুর- মহাখালী থেকে এয়ারপোর্ট-টঙ্গীর পথে। জানালার পাশে বসে আছি আমি। ঢাকা শহরের উজ্জ্বল আলো চোখে এসে লাগছে। সাথে কোনো বন্ধুবান্ধব নেই, আমি যাচ্ছি একা। চোখে ভাসছে ঢাকার জীবন, আমার জায়গীর স্মৃতি। স্মৃতির পর্দায় আরও দূরের আলো পড়ছে। উনিশ শ' পঁচাত্তর থেকে উনিশ শ' বিরাশি। আমার সাত বছরের জায়গীর জীবন। হাটকয়েড়ার মাজম মেম্বারের বাড়ি থেকে স্টাফ কোয়ার্টারের বারো নম্বর বিল্ডিং। বালিকা শিউলী থেকে কিশোরী ফিরোজা, ঝুনু, লিমা কিংবা ফজিলার মুখায়ব। বন্ধুবর রউফ, মোখলেছ থেকে লুৎফর, ইশতিয়াক। প্রিয় শিক্ষক জয়নূল স্যার, গোবিন্দ স্যার, জায়গীরদাতা মাজম মেম্বার, ফজলু মামার আশির্বাদের মুখ।
গাড়ির জানালার ফাঁক দিয়ে ঢাকা শহরের আলো আসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দূরে চারদিকের প্রকৃতিতে অন্ধকার নামছে। নিভে গেছে আমার জায়গীর জীবনের শেষ শিখাটি। কিন্তু আরেক নতুন প্রদীপ হাতে ডাকছে ময়মনসিংহ শহর। যেখানে জ্বালতে যাচ্ছি আমার উচ্চশিক্ষার আলো!
০৩.০৮.২০০৮
জায়গীরনামা- এক
জায়গীরনামা- দুই
জায়গীরনামা- তিন
জায়গীরনামা- চার
জায়গীরনামা- পাঁচ
জায়গীরনামা- ছয়
জায়গীরনামা- সাত
জায়গীরনামা- আট
জায়গীরনামা- নয়
মন্তব্য
আপনার লাইফটা সেইরকম!!! অনেক কষ্টকরে বড় হইসেন!!!!
থাকলে আরো, চলুক...পড়তে ভালো লাগে...
-টিকটিকির ল্যাজ
সবচেয়ে ভাল পর্ব। খারাপ লাগছে শেষ হয়ে গেল বলে।
তো আপনি শেষমেশ ডাক্তারি পড়েছিলেন তো, নাকি ফিরতি ট্রেনে চট্টগ্রামে চলে গিয়েছিলেন?
ধন্যবাদ আলমগীর।
বাধ্য হয়েই শেষ করে দিলাম। বেশি টানাটানি ভালো লাগছিলো না।
...না, ফিরতি ট্রেনে আর চট্টগ্রাম যাই নি।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
এই সিরিজের অনিয়মিত পাঠক আমি। সবগুলো না পড়ে মনে হলো বিশাল ভুল করলাম। আজকের পর্বটা অসাধারণ, অসাধারণ।
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
আত্মসম্মানের সঙ্গে জীবনে টিকে থাকাটাই বড় কথা। আপনাকে স্যালুট জলিল ভাই। কষ্ট করেছি জীবনে ঠিকই। কিন্তু মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারলাম না।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
জলিল ভাই, খুব ভালো লাগলো খুব!
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
- মামু, মামীর সঙ্গে পরিচয় এবং পরিণয় নিয়ে আমাদের জানাবেন না?
লেখা নিয়ে কিছু বলবো না!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
মামু হাসাইলেন।
সেটেল ম্যারেজের আবার পূর্ব পরিচয়, পরিণয় কিসে?
তবে সময় সুযোগে অবশ্যই জানাবো।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
আসলে আপনি কী ? ডাক্তার না ইঞ্জিনিয়ার ? আমার তো মনে হয় আপনি ভাষার ইঞ্জিনিয়ার। শব্দের কলকব্জা নিযয় আপনার কাজ।
আপনি তো পারেন ভালো , খুবই ভালো। লেখা পড়াইয়া মানুষকে কান্দাইতে পারেন। হইবো, আপনাকে দিয়ে লেখালেখিটা ভালোই হইবো বলে মনে হয়।
যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
শেষ পর্ব মানে কী?
আর কিছু বলবেন না?
পর্বগুলো নিয়মিত পড়ে আসছি আমি। অপ্রাপ্তি রয়ে গেলো কিন্তু!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
ধন্যবাদ রাফি।
এ সিরিজটি আসলেই শেষ হয়ে গেলো। আশা করি সময় করে সম্পূর্ণ পড়ে মতামত দেবেন!
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
আমার ধারণা আধুনিক ঢাকা শহরের শেষ জায়গীর আপনি
স্যালুট স্যার
পুরো পর্বটা চোখের উপর দিয়ে শেষ হয়ে গেলো...
০২
হিংসা হচ্ছে জীবনে জায়গীর থাকিনি বলে
০৩
একটা পুরো উপন্যাসের মাল মসলা রেডি
এইবার উপন্যাসটা গেঁথে ফেলেন স্যার
উপমহাদেশের জায়গীর সংস্কৃতির শেষ মাইলফলক হয়ে থাক
এখন আর কেউ জায়গীর রাখে না
না আছে জায়গা
না আছে বিশ্বাস
লিখে ফেলেন
বইয়ের সবগুলো কেরানি কাজ আমি করব
জীবনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা গল্পগুলো কি অসম্ভব দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন, জলিল ভাই।
সত্যি অনেক কষ্ট করে বড় হতে হয়েছে আপনাকে।
সবগুলো পড়া হয়ে ওঠেনি। পড়ে নেবো অবশ্যই।
কিন্তু আপনি আসলে কি বলেন তো?
ডাক্তার, না ইন্জিনিয়ার?
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
...হতে চেয়েছিলাম ইঞ্জিনিয়ার। পড়তে পারিনি।
যা পড়েছি তাতে সায় ছিলো না মনেপ্রাণে। উচ্চশিক্ষার সমস্ত সময় ব্যয় করেছি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ঘুরেফিরে।
তবে আটকে যাইনি কোথাও। শেষ পর্যন্ত মেডিক্যালে গ্রাজুয়েশন আর জনস্বাস্থ্যে মাস্টার্স।
তবে পেশাজীবনে পুরোপুরি অসফল মানুষ আমি। হতে পেরেছি শুধু শব্দের কারিগর। এতেই খুশি আমি।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
জীবনে অনেক কষ্ট কইরা বড় হইছেন আপনি। আপনার এই সিরিজটা খুউব ভাল্লাগছে। বিশেষ কইরা এই পর্বটা। টুকটাক বানান ভুল আছে। ওইগুলা ঠিক করে নিয়েন। আপনার লেখায় বানান ভুল কেমন যেন সৌন্দর্যহানি ঘটায়। কিন্তু এখানেই শেষ করে দিলেন!
এতো কষ্ট করে জীবনে টিকে থাকা (আমি ইচ্ছে করেই বড় হওয়া বলছি না। আপনি আরো অনেক বড় হবেন সেই আশায়) মানুষ জয়ী না হয়ে পারে না।
লীলেনের কথাটায় আমারও সায় আছে। উপন্যাসের বহু উপাদান আপনার ব্যক্তিজীবনেই রয়েছে।
ওতে আরো কিছু ‘ছুইট-ছাওয়ার আর স্পাইছ’ যোগ করে লিখে ফেলুন একটা উপন্যাস। (উত্তমপুরুষে না লিখলে ভালো হয়।)
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
অনেক অনেক ধন্যবাদ রিটন ভাই।
....লীলেন এমন একজন লেখক যার কথায় অনুপ্রাণিত না হয়ে পারা যায় না। উনি প্রথম থেকেই আমাকে উপন্যাসের কথা বলে আসছেন। তারপর আজকে আপনার মন্তব্য পেয়ে মনে আরও আশার সঞ্চার হচ্ছে। জায়গীরনামায় নিজের জীবনের কথাগুলো গটগট করে লিখে ফেলেছি সরল বর্ণনায়। ঠিক এই সময়ে নিজেকে উপন্যাস লেখার উপযোগী ভাবতে ভয় হচ্ছে। আপনাদের উপদেশ সময় সুযোগ মতো অবশ্যই ভাববো।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
শেষ হয়ে গেল প্রিয় একটা সিরিজ।
নিজের সঙ্গে, পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে যে-সংগ্রাম আপনাকে করতে হয়েছে ঢাকায় টিকে থাকতে আর পড়াশোনা করতে, আমি কি অতোটা পারতাম? নিজেকে এই প্রশ্ন করে উত্তর পেয়েছি নেতিবাচক।
পুনশ্চ. গত পর্বে আমার মন্তব্যে আপনি কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছেন, বোধ করি। মতামতটি ছিলো নেহাত আমার ব্যক্তিগত এবং লেখা-সংশ্লিষ্ট। ব্যক্তিগতবিদ্বেষপ্রসূত তা একবারেই নয় - আপনি সে-কথা বিশ্বাস করলেই আমি স্বস্তি পাবো।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
সংসারে এক সন্ন্যাসীর মতো বিদগ্ধ পাঠক ও সুলেখকের মন্তব্য আমার লেখা আরও শানিত করবে বলে আশা রাখি। পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশের সময় এ বিষয়গুলো অবশ্যই খেয়াল থাকবে।
...আসলে আশ্চর্য হয়েছিলাম মন্তব্যের পৌনঃপুনিকতায় ও অনুরণনে। তাছাড়া কৈশোর জীবনের অনুসন্ধিৎসু ভাবনা ও অকপট ভুলগুলোকে পুরুষালি বলে অভিহিত করায়।
এরপর অবশ্য সবই ভুলে গেছি। নতুন করে পোস্ট দিয়েছি জায়গীরনামার শেষ পর্ব।
আপনার গঠনমূলক মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
দুর্ধর্ষ একটা সিরিজের শেষ দেখে কষ্ট লাগলো। কত সুযোগ-সুবিধা হেলায় হারাচ্ছি, সেটাই মনে পড়ে শুধু আপনার লেখাগুলোর পড়লে। আমিও এই লেখা উপন্যাস হিসেবে দেখবার অপেক্ষায় রইলাম।
এবার ঝটপট উচ্চশিক্ষানামা শুরু করে দেন। আর, যেমনটা আগেও বলেছি, অধমের মত পাঠকের জন্য একটা পিডিএফ আপলোড করে দিতে পারেন। এই সিরিজটা কালেকশন পিস।
রাজাকার রাজা কার?
এক ভাগ তুমি আর তিন ভাগ আমার!
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
দুর্দান্ত একটা সিরিজ শেষ হয়ে গেল !
অকুন্ঠ শ্রদ্ধা জায়গীরনামা'র "জায়গীর" জলিল ভাই ।
লীলেন ভাইয়ের কথাটা আমিও বলছি "এইবার উপন্যাসটা গেঁথে ফেলেন , উপমহাদেশের জায়গীর সংস্কৃতির শেষ মাইলফলক হয়ে থাক"
শুভ কামনা
চুপি চুপি পড়ে যাই। মন্তব্য করতে কষ্ট হয়। আপনার সংগ্রামী জীবনকে স্যালুট।
লেখাটা এতো তাড়াতাড়ি শেষ? মেডিক্যালের কিছু বল্লেন না যে।
....আপনাকে কেরানি না উপদেষ্টা হিসেবে পেলে ভালো লাগবে স্যার!
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
চোখ ভিজে উঠলো। আনন্দে। স্যালুট!
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
নতুন মন্তব্য করুন