তার বয়সী সব ক্লাসমেটরাই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেছে। অমল, দীপেন, কৃষ্ণা, মঙ সবাই যাচ্ছে ক্লাস করতে। একমাত্র সেই পারে নাই। কেন পারে নাই এর উত্তর নিয়ে সে ভাবছে আজ সারাদিন। যতই ভাবছে ততই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার চিন্তার রেখা। সে ভাবনা বিস্তৃত হচ্ছে শৈশব, কৈশোর ছাপিয়ে সুদূর জন্মসূত্রে। একই প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল বা কলেজে যাদের সাথে লেখাপড়া করেছে সে তারা আজ ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট, শুধু সে-ই না। অথচ ওর মেধা কারোরই চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। প্রতিটি ক্লাসে সবসময় ফার্স্ট বা সেকেণ্ড হতো সে। লেখাপড়ায় কোনোদিনও কাউকে ডিঙাতে দেয়নি তার এই প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান।
বিলাসী পাড়া কলেজ থেকে যেদিন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাসের রেজাল্ট শুনে এলো বাড়ি ফিরলো জহির কত লোকই না তাকে দেখতে এসেছিল সেদিন! উঠোন ভরে গিয়েছিল আত্মীয়স্বজন এবং গ্রামের লোকদের পদভারে। পাঠাকাটা থেকে চাচা-চাচী, চাচাতো ভাইবোন, মশলাপাড়া থেকে ফুপা-ফুপু, ফুপাতো ভাইবোন, আট আনী থেকে খালু-খালা, খালাতো ভাইবোন এবং দূর সম্পর্কের অনেকেই এসেছিলেন সেদিন। একে তো এতদ্অঞ্চলে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা ছাত্রের সংখ্যা ছিল হাতেগোণা দু'একজন তার উপর সে পেয়েছে ফার্স্ট ডিভিশন। লোকে তাকে দেখবে না তো কাকে দেখবে! এই নৈচারধাপ গ্রামে সে যে সবার গর্ব, বাঙালি মুসলমান পরিবারের মধ্যে একমাত্র শিক্ষিত ছেলেও সে।
সারাদিন ভেবে কোনো কূলকিনারা পেলো না জহির। কী করবে সে? সাধারণ ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হবে না আগামী বছর আবার চেষ্টা করবে গৌহাটি ইউনিভার্সিটিতে! এদিকে তাদের সংসারের অবস্থাও খুব খারাপ। টাকা-পয়সার অভাবে জহিরের বাবা-মা মেয়েদের কাউকেই স্কুলে দেয় নি। জহিরের পিঠাপিঠি ছোট বোন বিবিজানের বিয়ে হয়েছে তারই ছোটবেলার বন্ধু ইউসুবের সাথে। বাকি দুবোন প্রায় বিয়ে দেয়ার যোগ্য হয়ে গেছে। এরপর পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাই যায় প্রাইমারি স্কুলে বাকি তিনজন এখনও ছোট, স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। বর্তমানে ছয় ভাই, দুই বোন, বাবা-মা, দাদা মিলে তাদের এগার জনের সংসার চলছে চরম অভাবে। বেশ কিছুদিন ধরে খেয়াল করছে জহির- জমিতে যে ফসল পায় তারা তাতে ছয় মাসেরও আহার জোটে না সবার। বাকি সময় হয় তার বাবাকে দিনমজুরের কাজ করতে হয়, না হয় তার মামাদের কাছে হাত পাততে হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? বাবা-মার বড় ছেলে হিসেবে তার দায়িত্বটা বোঝে সে এখন। সব সময় এ ভাবনা তাড়িত করে তাকে, কুড়ে কুড়ে খায় হৃদয়টাকে।
পূব পাশের কাচারি ঘরটার জানলা-দরজা দিয়ে হুহু করে হাওয়া ঢুকছে। দুপুরের খাবার সেরে এই বিকেল বেলায় তার বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছে জহির। ঘরের পাশের রাস্তা দিয়ে বগড়ি বাড়ি বাজার থেকে ফিরছে মানুষ। জহিরের কানে ভেসে আসছে মানুষের পায়ে চলার শব্দ। অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে যাবে তারা। টিপাই নদী পার হয়ে জহরমুড়া, মশলা পাড়া ছাড়িয়ে হয়তো আরও দূরের কোনো গ্রামে। কিছুক্ষণ চুপচাপ চারপাশ তারপর একটু বিরতিতে মানুষের পায়ের শব্দ আর বাতাসের শনশন শুনতে শুনতে তন্দ্রায় চোখ বুঁজে আসছে তার । ঢুলুঢুলু চোখে তার একটাই স্বপ্ন কীভাবে এই সংসারের মানুষগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, কীভাবে ফিরে পাবে তাদের সেই সোনালি সুখের দিন!
ঘুমের ঘোরে পুরনো দিনে ফিরে গেলো জহির। প্রাণের প্রাণ, জানের জান বন্ধু ইউসুবকে নিয়ে সে ঘুরছে সারাটা গ্রাম। ও বাড়ি থেকে ও বাড়ি, এ বাগান থেকে ও বাগান, এ গাছ থেকে সে গাছ। চুরি করে গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়ার মজাই আলাদা! ওদিকে ছুটির পর বিকেলে পাড়ার সমস্ত দুষ্টু ছেলেরা জড়ো হয়েছে খেলার মাঠে। কেউ বা খেলছে গোল্লাছুট, কেউ বা দাঁড়িয়াবান্ধা আবার কেউ বা খেলছে কানামছি ভোঁ ভোঁ। রাস্তার ওপর ইউসুবকে নিয়ে জহির খেলছে মার্বেল টিপ। খেলা শেষে সমস্ত মার্বেল হারিয়ে ইসুবের সে কী রাগ ও কান্না! শেষে জহির তাকে কিছু মার্বেল ফিরিয়ে দিলে তার কান্না থামে। এরপর দুই বন্ধু আবার মেতে ওঠে ডাংগুলি খেলায়। সন্ধ্যা অব্দি চলে সে খেলা। বাশঝাঁড়ে আঁধার নামছে ধীরে ধীরে,এখন বাড়ি ফিরতে হবে তাদের। স্কুলের পড়া রেডি করতে হবে সব। না হলে, বাবার হাতে মার বেসামাল- কঞ্চির আঘাতে পিঠটা হবে লাল।
একটা স্বপ্ন খুব বেশি স্থায়ী হচ্ছে না চোখে, আবার চলে যাচ্ছে অন্য স্বপ্নে। এবার দেখতে পাচ্ছে ইউসুবকে নিয়ে হারমোনিয়ে গান গাইছে সে। এখন তারা গাইছে মিলাদের গান- ইয়া নাবী সালাম আলাইকা, ইয়া রাসুল সালাম আলাইকা। বেশ জোরেসোরে সুরেলা গলায় দুজন গাইছিলো হারেমোনিয়ামে তোলা নতুন গান। এমন সময় কাচারি ঘরের দরজায় জোরেসোরে লাঠির আঘাত। গলা থেকে গান বন্ধ হয়ে গেলো দুজনের। ভাগ্যিস্ দরজাটা বন্ধ ছিলো। ইউসুব দরজায় ফাঁক দিয়ে দেখে ফিসফিস্ করে জহিরের কানে বললো- চাচা। আর যায় কোথা? ঘরের চারদিকে ছিল পাটশোলার বেড়া। দুজন মিলে এক ঝটকায় পেছনের বেড়া ভেঙে ভোঁ দৌড়। নিজেরা বাঁচলেও তাদের হারমোনিয়ামটা পোড়া গিয়েছিলো সেদিন জহিরের বাবা বিশা শেখের রাগের অগ্নিশিখায়। অনেক অনুরোধেও জহিরের মা বাঁচাতে পারেনি সেটাকে। এরপর জহির ও ইউসুব নাকে খত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলো- হারমোনিয়ামে গান গাইলেও অন্তত মিলাদ-মাহফিলের গান গাইবে না আর ভুলেও কোনোদিন।
এবার জহিরের মনে পড়ছে পারুলের কথা। পারুলরা থাকে আমবাড়ি গ্রামে। নৈচারধাপের ঠিক পশ্চিম পাশের গ্রাম আমবাড়ি। এই গ্রামটার পাশে এসে টিপাই নদী উত্তর-পশ্চিমে বাঁক ঘুরে চলে গেছে দক্ষিণে। নদীর পাড় ঘেঁষে ঠিক পূর্ব তীরে পারুলদের বাড়ি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় টিনের চালা,খড়ের ছাউনিতে গড়া তিনটি ঘর কিছু গাছ-গাছালি নিয়ে একটি টিলার মাঝে যেন সটান দাঁড়িয়ে রয়েছে টিপাই নদীর বুক বরাবর। নদী থেকে ভেসে আসা ফুরফুরে বাতাস বুক ভরিয়ে দেয় এ গৃহবাসী সবার। যখনই জহির বেড়াতে গেছে পারুলদের বাড়ি অনেকক্ষণ বসে থেকেছে ঐ নদীর পাড়ে। মনে মনে কতো যে সুখ-দুঃখের কথা বলেছে টিপাই নদীর সাথে তার ইয়ত্তা নেই!
দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে পারুলই সবার বড়। বগড়িবাড়ি হাই স্কুল থেকে এবার সেকেন্ডারি পাস করলো পারুল। বিলাসীপাড়া কলেজে যাবে উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে। গোড়া থেকেই পারুল খুব ভালো ছাত্রী। তার বাবা-মার ইচ্ছা ডাক্তার বানাবে ওকে। এলাকায় পারুলদের সুনাম রয়েছে ভদ্র ও ভালো ছাত্র হিসেবে। তাছাড়া শিক্ষিত স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত হিসেবে পারুলের বাবা আইজুদ্দিন সাহেবের এলাকায় বেশ নামডাক গুণিজনদের মাঝে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজের জমির আবাদে ভালোভাবেই চলে তাদের সারা বছর। লক্ষ্মী দু্ই মেয়ে আর শান্ত এক ছেলে নিয়ে যেন তাদের সোনার সংসার।
জহিরের মায়েরও পছন্দ এই মেয়েটিকে। একবার এক ঈদের দিন ওদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার পথে তার মা তো বলেই ফেললো- দেখিস্, একদিন এই মেয়েটিকেই ছেলেবউ করে ঘরে তুলবো। শুনে তো জহিরের লজ্জায় লাল হবার উপক্রম। অবশ্য মনে মনে সে বেশ পুলকিতও হয়েছিলো সে। সেই থেকে শ্যামাঙ্গী গড়ন, টানা চোখ আর দীঘল কালো চুলের মেয়েটি গেঁথে আছে তার হৃদয় জুড়ে। কতো গল্পকথা, কতো ঘুরে বেড়ানো সেই নদীতীর। জীবিকার তাগিদে হয়তো একদিন তাকে ছেড়ে যেতে হবে দূরে কোথাও। কী করে ভুলবে তার কথা! স্কুলের অনুষ্ঠানে যখন কবিতা আবৃত্তি করতো মনে হতো জীবনানন্দ বাবুর নাটোরের 'বনলতা সেন' যেন সে। টানা চোখ তুলে হয়তো হঠাৎ একদিন সামনে এসে বলবে তাকে 'এতোদিন কোথায় ছিলেন?' (চলবে..)
০৬.০২.২০১৩
মন্তব্য
দারুন লাগলো!!
'তুঙ্গে যখন আন্দোলন
গল্প তখন ফেলনা ধন।'
....অনেক অনেক ধন্যবাদ একমাত্র অতিথি মন্তব্যকারী আমার।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
বাহ! আপনাকে আমার দেশের লোক মনে হচ্ছে, তাই! পুরোটা পড়বার আগ্রহ রইল।
তাই!
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
নতুন মন্তব্য করুন