নৈচারধাপ গ্রামে জহিরদের চার মামার বসবাস। আসাদ আলী, নূর মোহাম্মদ, আব্দুল আলী এবং আজগর আলী মামাদের বাড়ি এক সারিতে। গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী খালের পূব এবং পশ্চিম পাশে দুই দুই মামাদের বাড়ি। বড় মামা আসাদ এবং সেজো মামা আব্দুল থাকেন পশ্চিম পাড়ে। মেঝো মামা নূর এবং ছোট মামা আজগর থাকেন পূব পাড়ে। পূব পাড়ে আজগর মামার বাড়ি ঘেঁষে সবচেয়ে পূবের বাড়িটি হলো জহিরদের। জহিররা এ গ্রামে এসেছে মামাদেরও পরে। তার দাদা তাদের আদি বসবাস পাঠাকাটা থেকে এখানে এসেছে প্রায় পনের বছর। অবশ্য জহিরের জন্ম এ গ্রামেই তার নানা বাড়িতে। নৈচারধাপ গ্রামের বৈশিষ্ট হলো এ গ্রামটি ব্যবসাস্থল বগড়ি বাড়ি বাজারের কোল ঘেঁষে এবং ঠিক দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে টিপাই নদী। মশলাপাড়া থেকে জহিরের ফুপা-ফুপু, ফুপাতো ভাইবোনদের এই নদী পাড় হয়েই বগড়ি বাড়ি আসতে হয়। দৈনন্দিন বাজারঘাট, চাল-ডাল কেনবেচা এবং নিত্য প্রয়োজনীয় নানান জিনিস কিনতে সবাই আসে এই বাজারে।
জহিরের বাবা বিশা শেখের জন্ম পাঠাকাটায়। তাদের আদি বাড়ি পাঠাকাটা ও আশেপাশে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জহিরদের পূর্ব পুরুষেরা। মূলত জহিরের প্রপিতামহ বাবর আলী শেখ এবং নায়েব আলী শেখ ছিলেন আপন ভাই। বাবর আলী শেখ থেকে বেড়েছে জহিরদের বংশধর এবং নায়েব আলী শেখ থেকে বেড়েছে তার মামাদের বংশধর। অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে তিন দেশ মিলে মূলত দেশ ছিল একটা। সে সময় জীবিকার তাগিদে পূর্ব পাকিস্তানের সিরাজগঞ্জ থেকে জহিরদের পূর্ব পুরুষেরা এখানে এসে স্থায়ী বসবাস গড়ে। জহিরের মায়ের জন্মও এই পাঠাকাটা এলাকাতেই। তার বাবার একমাত্র ছোট ভাই লালচান চাচা এখনও পাঠাকাটাতেই থাকেন। সেখানেও রয়েছে তার চাচাতো, মামাতো, ফুপাতো ও আরও দূরের ভাইবোনেরা। তবে চাচাতো-মামাতো ভাইবোনদের মধ্যে জহিরই সবার বড়।
ঊনিশ শ পয়ষট্টি সনে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর আসামের এই এলাকার বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে নেমে আসে দূরাবস্থা। আদিবাসী অহমিয়া জনগণের চোখে বাঙালি মুসলমান, হিন্দু, মারোয়ারী এবং নেপালিরা হয়ে ওঠে চক্ষুশুল। তাদের চলনে, বলনে, আচরণে সবসময় জানিয়ে দিতো এরা সবাই বহিরাগত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। মাঝে মাঝেই লেগে যেতো অহময়িা ও বাঙালিদের মধ্যে দাঙ্গা-মারামারি। যদিও বাঙালিরা আসামের এই অঞ্চলে ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ তবু তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হতো বেশি। কারণ প্রশাসন, রাজ্য সরকার তাদের দখলে ছিলো। এমন কি কেন্দ্রিয় সরকারও বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করে সেই ব্রিটিশ আমলে আগত ও অভিবাসিত এই জনগোষ্ঠিকে। জন্মসূত্রে আসামী ভারতীয় অনেককেই দেয়া হয় কুইট ইন্ডিয়া নোটিশ। বিশেষ করে মুসলমানদের মধ্যে এই নোটিশ প্রাপ্তির হার ছিল খুব বেশি।
ছয় ভাই, তিন বোন মিলে জহিরেরা এখন নয় জন। ছোট ভাইবোনদের মুখের দিকে তাকালে কেমন যেন উদাস হয়ে যায় জহির। তার নিজের শৈশব আর ওদের শৈশবের তুলনা করলে আরও বেশি খারাপ লাগে তার। মা'র মুখে আর আগের মতোন হাসি নেই। সারাক্ষণ কী যেন চিন্তার রেখা ফুটে থাকে তার কপালের ভাঁজে। আর দিনদিন বাবাও যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে! আগের মতোন ছেলেমেয়েদের দিকেও খেয়াল নেই, সংসারের প্রতিও মন নেই তার। অথচ বাবার মুখে কতো গল্পই না শুনেছে জহির! তার শৈশব-কৈশোরে জড়ানো স্বর্ণালি দিনের কথা, তারও আগে বাবার যৌবনে অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশবিরোধী নানান সংগ্রামের কথা, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কথা।
১৯৪৬ সাল ছিলো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার বছর। বাবার কাছে শুনেছে জহির সে দাঙ্গায় অনেক লোক মারা গিয়েছিলো প্রতিপক্ষের হাতে। ভারতকে পূর্ব-পশ্চিম-মধ্য তিন ভাগে ভাগ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্ন ভেঙে গেছে অনেক আগেই। ডিভাইড এন্ড রুল থিওরির প্রবক্তা ব্রিটিশ শাসকের ষড়যন্ত্রে ভারতবিভক্তির রপরেখা এখন ধর্মভিত্তিক দাবীতে অবিচল। এক্ষেত্রে দাবীর দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের লাল বাহাদুর শাস্ত্রী- জওহরলাল নেহরু গং; সাথে সুর মিলিয়েছে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দল। যে করেই হোক হিন্দু এবং মুসলিম ধর্মের মানুষের জন্য চাই আলাদা আলাদা রাষ্ট্র; প্রয়োজনে হোক ভোটাভুটি- এমনই চলছে সব নেতাদের মতামত। এর প্রেক্ষিতে শুরু হয় মুসলিমদের স্বতন্ত্র দেশ পাকিস্তান বাস্তবায়ন আন্দোলন। এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আসামের বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে।
জহিরদের এলাকা ধুবড়ি, বগড়িবাড়িতে বাঙালিদের বসবাসের ইতিহাস ছিলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তপ্রসূত ও জীবিকার তাগিদে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে বাংলার ময়মনসিংহ, রংপুর, কুচবিহার, ত্রিপুরা ও সিলেট থেকে লক্ষ লক্ষ ভূমিহীন কৃষক আসামের জঙ্গলে ভাসান চরে বসবাস করতে শুরু করে। মূলত ওই কৃষকদের কারণেই এই জঙ্গল বসবাসের উপযোগী হয়ে ওঠে। এই কারণে প্রথম দিকে আসামের সরকার কৃষকদের অভিনন্দন জানায়। কিন্তু যখন লোকসংখ্যা বেড়ে যায় তখন সরকার বহিরাগতদের উপর পীড়াপীড়ি শুরু করে। শুরু হয় সরকার-জনগণ, অহমিয়া-বাঙালি সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষ নিবারণের জন্য আসাম সরকার ভাসান চরে লাইন প্রথা প্রবর্তন করে। সরকার সেই সাথে গো হত্যা নিষিদ্ধ করে। লাইন প্রথার সাথে যুক্ত হলো ধর্মীয় আন্দোলন। ভাসানীর নেতৃত্বে এ আন্দোলনে যুক্ত হয় সকল বাঙালি। ১৯৩৫ সালে ভাসানীর ডাকে লক্ষ লক্ষ বাঙালি সমবেত হয়। ভাসান চরের লাইন প্রথা ভেঙে দিলেন তিনি। অসামান্য নেতৃত্বের জন্য এই চরের জনগণ তাঁর নামের সাথে ভাসানী যুক্ত করে দেয়।
বিশা শেখ তখন তাগড়া যুবক। তার স্পষ্ট মনে আছে মাওলানা ভাসানী ১৯৪৭ সালের ৩ মার্চ ‘বাংলা–আসাম মুজাহিদ স্মমেলন’ ও ‘সাহিত্য সম্মেলন’ করেন। ৪ মার্চ করেন ‘নওজোয়ান সম্মেলন’ ও ‘ন্যাশনাল গার্ডস’ সম্মেলন। জহিরের বাবা গোড়া থেকেই এ সমস্তের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাঁশের লাঠি, সড়কি, বল্লম, ঢাল আর শিঙা ছিলো ন্যাশনাল গার্ডসদের অস্ত্র ও বার্তার সরঞ্জাম। যখন কোনো বিপদের বা শত্রুপক্ষের আক্রমনের খবর আসতো তখন শিঙায় ফুঁকে বার্তা পৌঁছে দেয়া হতো এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ভাসানী একই দিনে একই সময়ে ধুবড়ি, তেজপুর, গৌহাটি তিন জায়গায় মিটিং-এর ডাক দেন। এর কিছুদিন পরে বস্তুত আন্দোলন-সংগ্রামের কারণেই তাঁকে কারাগারে আটকে রাখা হয় এবং ভারত-পাকিস্তান দেশ গঠনের পর ১৯৪৮ সালে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়।
মাওলানা ভাসানী ছিলেন মজলুম জননেতা। জহিরের বাবা বিশা শেখের কাছে মহান মানুষ ও রাজনৈতিক জীবনের একমাত্র আদর্শ। ভাসানী সারাজীবন আন্দোলন করেছেন কৃষকদের নিয়ে, মেহনতি মানুষকে নিয়ে। আসামের ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, কোচবিহার এবং পূর্ব বাংলার রাজশাহী, রংপুর,পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষকদের নয়নমণি ছিলেন তিনি। ভুমিহীন কৃষকদের প্রতি যেখানেই অন্যায় অবিচার দেখতেন সেখানেই তিনি রুখে দাঁড়াতেন তাদের সংঘবদ্ধ করে। বস্তুত ভাসানীর এতো জনপ্রিয়তা দেখেই মাওলানা আকরাম খাঁ তাঁকে মুসলিম লীগে টেনে নেন। দেশ বিভাগের পরে ভাসানীর নেতৃত্বে গড়ে নতুন দল আওয়ামী মুসলিম লীগ।
২৭.০২.২০১৩ ...(চলবে)
মন্তব্য
ইতিহাস দারুন লাগছে
ধন্যবাদ।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
এই উপন্যাস লেখার পটভূমিটা না জানা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না। এখন তো আর সেই উপায় নেই যে সকাল বেলা বঙ্গবন্ধু মিউজিয়ামের সামনে আপনাকে পাকড়াও করতে পারবো। চা খেতে খেতে পটভূমিটা শুনে নেবো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ধন্যবাদ। আড্ডায় নাই হোক,একদিন হঠাৎ করেই জানা হয়ে যাবে পটভূমি।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
নতুন মন্তব্য করুন