সারা আসাম রাজ্যে ছেয়ে গেছে এমন স্লোগান সম্বলিত পোস্টার। অহম স্টুডেন্টস পরিষদ ডাক দিয়েছে মুসলমান, দিনমজুর কুলি, বাঙালি হিন্দু, নেপালি ও মারোয়ারিদের দেশ থেকে বিতারণের- যারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে আসামের এতদ্অঞ্চলে বসবাস গড়েছে। জহিরদের বগড়িবাড়ি বাজারেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নানান শংকা, হুমকি ও ভয়ভীতি। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খবর আসছে বাঙালি মুসলমানদের হত্যা, নিপীড়ন ও বোমা হামলার মাধ্যমে তাদের ঘরবাড়ি উড়িয়ে দেবার কথা।
সেদিন ছিলো দোল পূর্ণিমা। বগড়িবাড়ি, মহামায়া পরিপূর্ণ হয়ে গেছে জনতার স্রোতে। নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে সবাই ছুটছে মহামায়ার দিকে। পাহাড়ের কোলে ঘেঁষে এ প্রাণের মেলাতে বইছে আনন্দধারা। জহিরও যাচ্ছে মেলা দেখতে। তবে প্রতিবারের মতো ছোট ভাইবোনদের নিয়ে নয়। বাবা একটু আগে সবাইকে নিয়ে গেছে সে মেলায়। তাই সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পারুলদের বাড়ির পাশে চুপিচুপি চলে এসেছে জহির। আগেই ঠিক করে রেখেছিলো ওরা দুবোন যাবে জহিরের সাথে মহামায়ার মেলা দেখতে।
বাড়ির পিছনে বাঁশঝাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে জহির। দশ-পনের মিনিট অপেক্ষার পর বাড়ির পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো দুবোন। পারুল ও চাঁপা দুজনেই পরেছে আজ বাসন্তী রঙের শাড়ি ও ব্লাউজ ম্যাচ করে। দুর থেকে তাদেরকে ঠিক ডানাকাটা পরীর মতো লাগছে চোখে। খুশিতে জহিরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, সাথে খেলে গেলো একটু হাসি। কাছাকাছি আসতেই তাদেরকে বললো সে- আর দেরি করা ঠিক হইবো না, মেলা শেষ হইয়া যাইবো, চলো তাড়াতাড়ি চলো।
বগড়িবাড়ি বাজার থেকে মহামায়া পায়ে হাঁটার পথ। বয়স্ক নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী সবাই যাচ্ছে মেলায়। ছোটদের হাতে হাত ধরে, কোলে-কাঁখে করে নিয়ে যাচ্ছে বড়রা। বাচ্চাদের কেউ কেউ উঠেছে বাবার কাঁধে। সে এক মনোহর দৃশ্য- যেন গণমানুষের মিছিল! এমন মেলায় যাইরে ভাব বছরে একবারই আসে- শুধু দোল পূর্ণিমার সময়। মেলার এই উদ্ যাপন যদিও ধর্মীয় তবে হিন্দু-মুসলিম-খৃস্টান-বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষের নিকট এখন এটা সার্বজনীন উৎসব। এদিনে কেউ-ই ঘরে বসে থাকে না। সপ্তাহব্যাপী মেলায় অন্তত একদিন হলেও ঘুরে আসে সেখান থেকে।
মহামায়ার যে জায়গাটায় মেলা হয় লোকেরা সেটাকে চেনে মহামায়ার ধাম হিসেবে। পাহাড়ি এলাকায় উঁচু টিলা বলেই হয়তো এই নাম। এখানকার মন্দিরটি বেশ পুরনো ও প্রাচীন পূরাকীর্তির নিদর্শন হিসেবে খ্যাত। মেলা উপলক্ষে প্রতি বছর মন্দিরের দেব-দেবীর মূর্তিকে সাজানো হয় নতুন রং ও সাজে। মন্দিরের ভেতরটাতে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। শুধুমাত্র খেদমতকারীদের প্রবেশাধিকার অনুমোদিত। তবে মন্দিরের সামনের বিশাল প্রাঙ্গন ধর্মনির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত। মেলার দর্শনার্থীরা ঘোরাঘুরির ফাঁকে একবার হলেও দেখে যায় সুন্দর কারুকাজের এই মূর্তিগুলো। কেউ কেউ আসে পূজা দিতে আবার কেউ কেউ আসে শুধু দর্শনার্থী হিসেবে।
ভিড়ের চাপে জহির, পারুল, চম্পা আর পাশাপাশি হাঁটতে পারছে না। এবার তারা হাঁটছে আগেপিছে একে অপরের হাত ধরে। জহিরের বাম হাত পারুলের ডান হাতে আর পারুলের বাম হাত চম্পার ডান হাতে। পারুলের কোমল হাতের স্পর্শে বাড়ন্ত কিশোর জহিরের শরীরে খেলে যাচ্ছে ঢেউ। এ ঢেউ বাম হাতের আঙুল থেকে ধীরে ধীরে পৌঁছে যাচ্ছে বুকের গভীরে হৃদয় নামক এক ছোট্ট কুঠুরিতে। হাতে হাত রেখে এই নির্ভার পথচলা যেন জানিয়ে দিচ্ছে আগামী কোনো শুভক্ষণের বার্তা। আর সে শুভক্ষণ চিন্তা করে স্বপ্নীল রোমান্টিকতায় ভরে যাচ্ছে জহিরের মন।
ভিড় বাড়ছে তো বাড়ছেই। হঠাৎ পেছন থেকে জোরে এক ধাক্কায় পারুল এসে পড়লো জহিরের গায়ে। সহসাই নিজের অজান্তে দুহাতে আঁকড়ে ধরলো তাকে। ওদিকে পারুলের হাত ছুটে যাওয়ায় চম্পার কাঁদোকাঁদো অবস্থা। ততক্ষণে পারুলকে বুকে সামলে জহির চট করে ধরে ফেলেছে চম্পার হাত। এ যেন এক দারুণ সুখের পরশ। বাড়ন্ত কিশোরীর ভয়মাখা উচ্ছাস এসে থেমেছে জহিরের খরায় পোড়া বুকে। একবার চোখাচোখি হতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো পারুল। অনেকক্ষণ আর চোখ ফেরাতে পারলো না তার দিকে। জীবনের প্রথম কোনো নারীর পরশে জহিরের মন ভরে গেলো অনাবিল সুখের আনন্দে।
বেলা বাড়ছে। সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই অবস্থা। এখনও মহামায়ার ধাম বেশ খানিকটা হাঁটার পথ। দূর থেকে ভেসে আসছে ঢাক-ঢোল-খোল-কর্তালের আওয়াজ। আর একটু পরেই পেয়ে যাবে তারা মন্দির প্রাঙ্গন যেখানে চলছে দোল পূর্ণিমার মেলা। পারুল ও চম্পার আবদার আজ তারা উঠবে নাগরদোলায়। পাশে জহির থাকবে তাদের সাহসের কাণ্ডারি হয়ে। দুবোন নির্ভয়ে আজ মজা করে মেলা দেখবে। এমন সময় হঠাৎ করেই পুলিশের গাড়ির সাইরেন। কে যেন উচ্চস্বরে বলে উঠলো- বোমা! বোমা ফাটবে, ভাগো সবাই।
পেছনে তাকিয়ে দেখলো জহির প্রাণের মায়ায় সবাই ছুটছে দিগ্বিদিক। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না, খুঁজছে নিরাপদ স্থান। তারা তিনজন মিলেও দৌড়াতে থাকলো কাছাকাছি এক বাড়ির দিকে। গেটের কাছাকছি হতেই জহির হঠাৎ করে খেয়াল করলো চম্পার হাত আর পারুলের হাতে নেই। ভিড়ের চাপে কোথাও হয়তো ছিটকে পড়েছে সে। পারুলকে কোনোমতে বাড়ির ভেতর ঢেলে দিয়েই আবার পেছনে দৌড়াতে থাকলো জহির। যে পথ দিয়ে এসেছে তারা সেখানে দিয়ে চিৎকার করতে লাগলো চম্পা, চম্পা বলে। কোনো প্রত্যুত্তর পেলো না জহির। একবার মনে হলো তার দূর থেকে কে যেন ডাকছে জহির ভাইয়া, জহির ভাইয়া বলে। কিন্তু লোকের চেঁচামেচিতে সে শব্দ হারিয়ে গেলো আরও দূরে।
সেদিন বোমা ফাটার আতংক ছড়িয়ে পড়েছিলো সারা বগড়িবাড়ি-মহামায়া এলাকায়। জনমানবহীন হয়ে পড়েছিলো সারা মেলা। বগড়িবাড়ি-মহামায়া পথের ধারে একটা নির্দিষ্ট এলাকা ঘেরাও করে রেখেছিলো পুলিশ। পরে সেখানকার মাটির নিচ থেকে তারা উদ্ধার করেছিলো বিশাল আকৃতির এক টাইম বোমা। কৌশলে রাস্তার পাশে পুঁতে রেখেছিলো দুষ্কৃতকারীরা। বোমা পূঁতে রাখার দায়ে অহম স্টুডেন্ডস পরিষদের কিছু সদস্যদের গ্রেফতার করে পুলিশ। সে যাত্রায় ভাগ্য ভালো ছিলো এলাকার মানুষের। সেটা ফাটলে উড়ে যেতো বাঙালি অধ্যুষিত সারা বগড়িবাড়ি-মহামায়া এলাকা।
ভিড় কমলে সেই বাড়ির ভেতর খেকে যদিও পারুলকে পেয়েছিলো জহির চম্পাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি গভীর রাত অব্দি। অবশেষে থানা-পুলিশের সহযোগিতায় একেবারে ভোররাতের দিকে খোঁজ মিলেছিলো চম্পার। মহামায়ার পাশে এক জঙ্গল থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় তাকে। সেখান থেকে সরাসরি স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে জরুরী চিকিৎসা দেওয়া হয়। জ্ঞান ফেরার পর সবার দিকে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো সে। অনেকদিন কারও সঙ্গে কথা বলেনি ভালো করে। বেশ কিছুদিন পর একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করলেও সেদিন সে রাতে কোথায় ছিলো, কী হয়েছিলো সে ব্যাপারে কারও কাছে কিছুই বলেনি কোনোদিন।
০৫.০৩.২০১৩ ....(চলবে)
মন্তব্য
এই পর্বটা ছোট হয়ে গেল।
- সময়কালটা কি কোনভাবে কোথাও উল্লেখ করা যায়? তাহলে পাঠকের পক্ষে ঘটনা অনুধাবন করতে সহজ হতো। অবশ্য আগের কোন পর্বে সময়কাল উল্লেখ করেছিলেন কিনা সেটা মনে করতে পারছি না।
- যে কালের কথা বলছেন সেটা ঠিকভাবে বোঝার জন্য দোল পূর্ণিমার মেলার বিস্তারিত বিবরণ দরকার ছিল। মেলার পসরা, খাবার, ইভেন্ট, খেলা এসব বর্ণনা থাকলে জনপদটি, তার মানুষ, তাদের কালচারের অনেক কিছুই স্পষ্ট হতো। যেহেতু এমন একটা ঐতিহাসিক পটভূমি নিয়ে লেখা শুরু করেছেন যেটা নিয়ে বাংলা ভাষায় আগে কেউ লিখেছেন বলে মনে হয় না, তাই এখানে বিস্তারিত বর্ণনা, সমসাময়িক অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর ছায়া ও প্রতিক্রিয়া - এগুলো আসা জরুরী।
- সমান্তরাল বর্ণনায় সমসাময়িক কোন (এক বা একাধিক) ঐতিহাসিক চরিত্রের আমদানী করতে পারেন, যার কর্মকাণ্ড উপন্যাসের চরিত্রদের ভবিষ্যত অবস্থার জন্য নিয়ামক হবে বা তাতে প্রভাব ফেলবে।
- উপন্যাসের নাম যেহেতু 'দেশান্তরী উপাখ্যান' তাই সামনে কোন মাইগ্রেশন/এক্সোডাসের আশংকা করছি। এই পর্যন্ত বলা গল্পেও একটা বৈরী পরিবেশের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। তাই উপন্যাসের কোন পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চরিত্রদেরকে যদি সত্যি সত্যি মাইগ্রেট করতে হয় তাহলে তাদের ভবিষ্যতের বাসস্থানের এখনকার গল্পও কিছু কিছু বলতে পারেন। তাহলে দুই ভূমির সমান্তরাল অবস্থান ও তাদের বিবর্তনের ধারাটাও বোঝা যাবে। অবশ্য উপন্যাসে অমন কোন মাইগ্রেশনের ব্যাপার না থাকলে এই অনুরোধটা অগ্রাহ্য করতে পারেন।
- উপন্যাসে মানচিত্র দেয়ার কোন রীতি আজ পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু এই উপন্যাসটিতে মানচিত্রের আবশ্যকতা অনুভব করছি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ধন্যবাদ ষষ্ঠ পাণ্ডব অনেকগুলো দিক-নির্দেশনা তুলে ধরার জন্য। আগামী পর্বগুলোতে এসব বিষয়ে খেয়াল রাখবো।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
নতুন মন্তব্য করুন