সভ্যতা শুরুর আগে - ৫

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: বুধ, ২৯/১০/২০০৮ - ৭:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ম্যামথদের অসংখ্য কঙ্কালের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এই জীবাশ্মগুলোর পাঁজরের মাঝখানে ক্লভিস শিকারীদের ব্যবহার করা বর্শার অগ্রভাগ পাওয়া গেছে। এর থেকেও বোঝা যায়, মানুষের আগমন ও স্তন্যপায়ীদের বিলুপ্তির এই সমকালীনতা নিছক কাকতালীয় ঘটনা নয়। সে সময় শিকারীরা দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করেছিলো। পথে তাদের সাথে এমন অনেক প্রাণীর দেখা হয় যারা আগে কখনও মানুষ দেখেনি। এই প্রাণীগুলোকে সম্ভবত শিকারীরা সহজে শিকার করতে পেরেছিলো। এই শিকারের কারণেই হয়তো তারা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। অবশ্য এই বিলুপ্তি নিয়ে আরেকটা তত্ত্ব আছে। এই তত্ত্বে বলা হচ্ছে, শেষ বরফ যুগের সময় জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে না পেরে আমেরিকার বড় বড় স্তন্যপায়ীগুলো বিলুপ্ত হয়েছিলো। শেষ বরফ যুগও কিন্তু ১১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ঘটনা। এসব কারণে আধুনিক জীবাশ্মবিদদের ব্যাখ্যা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি সেই একই কারণে আমেরিকার বড় বড় স্তন্যপায়ী বিলুপ্তির জলবায়ুগত ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারি না, যে কারণে অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির প্রাণীদের বিলুপ্তির ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারিনি। এর আগেও কিন্তু ২২টি বরফ যুগ এসেছিলো। তার প্রতিটির সাথে মোকাবেলা করে এসে আমেরিকার সব স্তন্যপায়ীরা কেন ২৩ নম্বর বরফ যুগের শেষের সময়টাকেই পটল তোলার উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেবে? আপাত নিরীহ মানুষেরা এসেছিলো বলেই কি ২৩ নম্বর বরফ যুগে সবাই এভাবে সরে দাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো? মনে হয় না। তাছাড়া, তারা সব স্থান থেকেই একসাথে বিলুপ্ত হয়ে গেলো কেন? উল্লেখ্য শেষ বরফ যুগের শেষের দিকে যে স্থানগুলোতে বসতি বিকশিত হচ্ছিলো আর যেগুলোতে বসতি সংকুচিত হয়ে পড়ছিলো তার সবগুলো থেকেই স্তন্যপায়ীরা উধাও হয়ে যায়। এসব দেখে আমার মনে হয়, স্তন্যপায়ীদের বিলুপ্তির জন্য ক্লভিস শিকারীরাই দায়ী। অবশ্য এ নিয়ে বিতর্ক চলছেই। যে তত্ত্বই সত্য হোক এ নিয়ে কোন সংশয় নেই যে, স্তন্যপায়ীদের যে প্রজাতিগুলো পরবর্তীতে মানুষের পোষ্য হতে পারতো তারা সবাই একসাথে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো সেই বরফ যুগের শেষ দিকে।

আরেকটা প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এখনও সংশয় আছে। প্রশ্নটা হলো, ক্লভিস শিকারীরাই কি আমেরিকার প্রথম অধিবাসী? একটা বিষয় সব সময়ই ঘটে, কেউ কোন কিছুকে প্রথম বলে সাব্যস্ত করলে সবাই এর চেয়েও প্রাচীন কোন দলীল উদ্‌ঘাটনের কাজে লেগে যান। এক্ষেত্রেও আমেরিকায় প্রাক-ক্লভিস স্থানের অনুসন্ধান চলছে জোড়েশোড়ে। প্রতি বছরই এই গবেষণাগুলো থেকে কিছু দাবী উঠে আসে। এই দাবীগুলোর অধিকাংশকেই প্রথম প্রকাশের সময় খুব সত্যি মনে হয়। কিন্তু তখনই ব্যাখ্যার সমস্যা এসে হাজির হয়। প্রশ্ন করা হয়, সে স্থানে পাওয়া হতিয়ারগুলো কি আসলেই মানুষের তৈরী নাকি সেগুলো নিছক বিভিন্ন আকৃতির প্রাকৃতিক পাথর? তেজস্ক্রিয় কার্বন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে যে বয়স নির্ণয় করা হয়েছে তা কি সম্পূর্ণ সঠিক? তেজস্ক্রিয়-কার্বন ডেটিংয়ের যে অসংখ্য সমস্যা আছে তার কোনটি দ্বারাই কি এটা আক্রান্ত নয়? বয়স যদি আসলেই সঠিক হয়, তাহলে প্রশ্ন আসে, এগুলোর সাথে মানুষের তৈরী জিনিসপত্রের কি আসলেই কোন সম্পর্ক আছে? নাকি মাত্র ৯,০০০ বছর আগে মানুষের হাতে নির্মীত কোন পাথরের হাতিয়ারের পাশে পড়ে থাকা কোন ১৫,০০০ বছর বয়সী কয়লার টুকরা পরীক্ষা করে আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি?

এই সমস্যাগুলোর স্বরূপ বোঝানোর জন্য একটা প্রাক-ক্লভিস স্থান খুঁজে পাওয়ার দাবীর উদাহরণ দেয়া যাক। এমন একটা উদাহরণ যা হরহামেশাই ব্যবহৃত হয়। "পেদ্রো ফুরাদা" নামে ব্রাজিলের এক পাথরের আশ্রয়স্থলে জীবাশ্মবিদরা এমন কিছু গুহাচিত্র পেয়েছেন যেগুলো নিঃসন্দেহে মানুষের হাতে আঁকা। এছাড়া সে স্থানের একটি খাড়া পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল পাথরের স্তূপের মধ্যে এমন কিছু পাথর পাওয়া গেছে যেগুলোকে অশোধিত হাতিয়ার বলে মনে হয়। পাশাপাশি সেখানে পুড়ে যাওয়া কাঠ-কয়লার জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। তেজস্ক্রিয়-কার্বন পদ্ধতিতে এই কয়লার বয়স নির্ণয় করা হয়েছে। বয়স পাওয়া গেছে ৩৫,০০০ বছর। পেদ্রো ফুরাদার এতো শত চমকপ্রদ তথ্য নিয়ে যে গবেষণাপত্র লেখা হয়েছিলো তা "নেচার" এর মতো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সবাই একে বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েছে।

কিন্তু সেখানকার খাড়া পাহাড়ের পাদদেশে যে তথাকথিত অশোধিত হাতিয়ার পাওয়া গেছে তা যে মানুষেরই তৈরী, সেটা স্পষ্ট করে বলা যায় না। ক্লভিস অঞ্চলের হাতিয়ার বা ক্রো-ম্যাগননদের অশোধিত হাতিয়ার নিয়ে কিন্তু এ ধরণের কোন সংশয় নেই। প্রাকৃতিকভাবেও এমন অশোধিত হাতিয়ার আকৃতির পাথর গঠিত হতে পারে। হাজার হাজার বছর ধরে খাড়া পাহাড়ের উপর থেকে হাজার হজার পাথর গড়িয়ে পড়ছে, এর মধ্যে অনেকগুলোই নিচের শক্ত পাথরগুলোর সাথে লেগে ভেঙে যাচ্ছে। এই ভেঙে যাওয়া পাথরগুলোর মধ্যে মানুষের হাতে তৈরী অশোধিত হাতিয়ারের মতো গড়ন তৈরী হওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক না। পশ্চিম ইউরোপ বা আমাজোনিয়ার মত অন্যান্য স্থানের ক্ষেত্রে জীবাশ্মবিদরা গুহাচিত্র অংকনে ব্যবহৃত সত্যিকারের কণাগুলোর বয়স নির্ণয় করেছিলেন। কিন্তু পেদ্রো ফুরাদার ক্ষেত্রে এরকম কিছু করা হয়নি। পেদ্রো ফুরাদা ও আশপাশের বনাঞ্চলে মাঝেমধ্যেই আগুন লেগে যায়। এই আগুনে বিপুল পরিমাণ কাঠ-কয়লা উৎপাদিত হয় এবং বাতাসের তোড়ে এরা উড়ে গিয়ে গুহার ভিতর জমা হয়। একেই আমরা গুহাবাসীদের জ্বালানি ভেবে ভুল করি। পেদ্রো ফুরাদায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত গুহাচিত্রের সাথে ৩৫,০০০ বছর আগের কাঠ-কয়লার কোন সম্পর্কই স্থাপন করা যায়নি। পেদ্রো ফুরাদা যারা খনন করেছিলেন তারা তাদের সেই পুরনো দাবী নিয়ে এখনও বসে আছেন। সেই খননের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন না, কিন্তু প্রাক-ক্লভিস স্থান খুঁজে পাওয়া ব্যাপারে আগ্রহী এমন একদল গবেষক সম্প্রতি পেদ্রো ফুরাদা থেকে ঘুরে এসেছেন। তাদের কাছেও এ দাবীকে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।

উত্তর আমেরিকায় বর্তমানে প্রাক-ক্লভিস স্থান হিসেবে যেটাকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে তা হলো পেনসিলভ্যানিয়ার মিডোক্রফ্ট (meadowcroft) এর পাথুরে আশ্রয়স্থল। অবশ্য এটা পুরো প্রমাণিত না। এই স্থানে মানুষের সাথে সম্পর্কিত কিছু জিনিসের বয়স পাওয়া গেছে ১৬,০০০ বছর। মিডোক্রফ্টে খননের মাধ্যমে যে মানুষের ব্যবহৃত অনেক উপকরণ পাওয়া গেছে, এ ব্যাপারে কোন জীবাশ্মবিদের মনেই দ্বিধা নেই। কিন্তু তেজস্ক্রিয়-কার্বন পদ্ধতিতে নির্ণেয় বয়সের কোন অর্থ করা যাচ্ছে না। কারণ এই উপকরণের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পর্কিত প্রাণী বা উদ্ভিদ প্রজাতিগুলো কিন্তু আধুনিক পেনসিলভ্যানিয়ার মৃদু জলবায়ুতে বাস করে। আজ থেকে ১৬,০০০ বছর আগের তুষারযুগে এদের থাকবার কথা নয়। তাই অনেকে সন্দেহ করতেই পারেন, এখানে ১৬,০০০ বছর আগের যে কাঠ-কয়লার নমুনা পাওয়া গেছে তা আসলে ১৬,০০০ বছর আগের মানুষের হাতে তৈরী হয়নি। বরং ক্লভিস থেকে আসা মানুষের হাতে তৈরী কাঠ-কয়লার মধ্যে পুরাতন কাঠ-কয়লার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। দুইয়ে মিলে আজকের এই নমুনা গঠন করেছে। এবার দক্ষিণ আমেরিকার কথায় আসা যাক। দক্ষিণ আমেরিকায় প্রাক-ক্লভিস স্থান হিসেবে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে আছে চিলির "Monte Verde"। দাবী করা হয়েছে, এখানে অন্তত ১৫,০০০ বছর আগে মানুষের উপস্থিতি ছিল। অনেক জীবাশ্মবিদই এটা নিয়ে আশাবাদী। কিন্তু আগে যেভাবে হতাশ হতে হয়েছে তাতে সবাইকে আরেকবার সতর্ক করে দিতেই হচ্ছে।

[চলবে...]

<< গত পর্ব


মন্তব্য

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দুর্দান্ত অনুবাদ! চলুক... চলুক

শিক্ষানবিস এর ছবি

আবারও ধন্যবাদ। পড়ছেন বলেই চালিয়ে যেতে পারছি।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

প্রমাণ করা অন্যদের কাজ
তবে এই ফ্যান্টাসিগুলো (দুঃখিত) মজাই লাগে পড়তে

শিক্ষানবিস এর ছবি

ফ্যান্টাসি কিন্তু বলা যায় না। এজন্যই বোধহয় ব্র্যাকেটে দুঃখিত-টা লিখে দিয়েছেন।
আমি তো জীবাশ্মবিজ্ঞান গবেষণাকে ফ্যান্টাসির বদলে ইতিহাস রচনার মাধ্যম হিসেবে দেখি। কারণ এটা সুস্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছে। মাটির নিচে স্তর আর স্তরের মধ্যে জীবাশ্ম। জীবাশ্মের বয়স নির্ণয় করেই সব পাওয়া যাচ্ছে।

পথে হারানো মেয়ে এর ছবি

অবশেষে...
অনেক ধন্যবাদ। ঃ)

শিক্ষানবিস এর ছবি

আবারও বলি, পড়ছেন বলেই চালিয়ে যেতে পারছি।

দিগন্ত এর ছবি

একটা অনুরোধ - বিষয়বস্তুর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছবি থাকলে লেখার সাথে দিতে পারেন। কিছু ম্যাপ হলে আরো ভাল হত ... লেখার খুবই ভাল হচ্ছে ... আগ্রহ নিয়ে পড়ছি।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

শিক্ষানবিস এর ছবি

আসলে বইয়ে কোন ছবি না থাকায় আমার মাথায়ও ছবি দেয়ার চিন্তাটা আসেনি। দেখি পরের পর্বে ছবি দেয়া যায় কি-না। অবশ্য আর একটা কিস্তিতেই বোধহয় শেষ হয়ে যাবে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।