বাংলাদেশ: আশায় নতুন জীবনের বসতি - ৪

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: শনি, ২০/১২/২০০৮ - ১০:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বৃদ্ধ বয়সে নিশ্চয়তার আশায় অধিক সন্তান গ্রহণ

জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে প্রতি ৩০ বছরে এদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তাই সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনার ধারণা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য একটি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। বর্তমানে ঢাকায় জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের যে অশিক্ষিত কৃষক মৌলিক চাহিদা থেকেই বঞ্চিত, তার পক্ষে এটা মেনে নেয়া খুব কঠিন। গড়পড়তা বাঙালিদের অবস্থাও তাই।

"এখানে সবাই অর্থনৈতিক কারণেই বেশী সন্তান চায়, অন্তত অর্থনৈতিক কারণকে অধিক সন্তান গ্রহণের একটি প্রধান কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।"- ঢাকার কলেরা গবেষণা কেন্দ্রে কর্মরত "ইউনাইটেড স্টেট্‌স পাবলিক হেল্‌থ সার্ভিস"-এর এক এপিডেমিওলজি বিশেষজ্ঞ এভাবেই কথাগুলো বললেন। আরেকটু ভেঙে বললে বিষয়টা এরকম দাঁড়ায়,

"এদেশের মানুষেরা চায়, তারা বুড়ো হয়ে গেলে তাদের পুত্ররাই তাদের দেখাশোনা করবে। কিন্তু পুত্র সন্তান হবার সম্ভাবনা শতকরা ৫০ ভাগ। আর কারও যদি পুত্র সন্তান হয়ও, তারপরও সে পুত্রের সাবালক হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতকরা ৫০ ভাগ। সুতরাং হিসাব বলছে, শেষ বয়স পর্যন্ত অন্তত দুইটি পুত্র সন্তানের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করার জন্য তাদের অন্তত আটটি সন্তান নিতে হয়।"

autoএই সহজ সরল মুসলিমেরা: যুদ্ধের ভীতি থেকে বাঁচতে গ্রামে চলে গিয়েছিল। এই সময়ে ঢাকা শহরে লুটপাট চলেছে। যুদ্ধ শেষে তারা আবার তাদের শহরে ফিরে এসেছে। ফিরে আসার পরপরই তাদের ঘরে নতুন বউ এসেছে। আলতোভাবে থুতনি স্পর্শ করে নতুন বউ দেখছে একজন, বরণ করে নিচ্ছে সবাই। পারিবারিকভাবে বিয়ের ব্যবস্থা করার চিরন্তন প্রথা ভেঙে এই বিয়ে হচ্ছে। কলকাতায় গিয়ে ছেলেটি মেয়েটিকে দেখে, সেখানেই প্রেম, ফিরে এসে বিয়ে। কলকাতা হচ্ছে ভারতীয় বাঙালিদের আবাসস্থল। ব্রিটিশ রাজত্বের সময় এই শহর ছিল বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী, সেই প্রদেশে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত ছিল।



কষ্টকর কাজের শেষে মধুর সঙ্গীত

বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশী মানুষ গ্রামাঞ্চলে বাস করে। কিন্তু, সম্প্রতি গ্রাম থেকে অনেক পরিবার বড় বড় শহরগুলোতে চলে আসছে। এর মধ্যে ঢাকায় আসার হার সবচেয়ে বেশী।

ঢাকার স্থাপত্য কখনই এতো মনোমুগ্ধকর ছিল না যে, গ্রাম ছেড়ে মানুষ গণহারে এখানে আসতে শুরু করবে। আর এখনকার অবস্থাতো আরও খারাপ। বস্তিতে ভরা ঢাকা শহরের রূপ বর্তমানে মোটেই আকর্ষণ করার মত নয়। তারপরও এখানে সুখের অভাব নেই, এখানে যেন সুখের গুপ্তধন আছে। সেই গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া সোজা কথা নয়। সমুদ্র সৈকতে ঝিনুকের অক্ষত খোলস কুড়িয়ে পাওয়া যতটা কষ্টকর, ঢাকা শহরের এই গুপ্তধন খুঁজে পাওয়া যেন ততটাই কষ্টকর।

এলিফ্যান্ট রোডের এক বাদ্যযন্ত্র নির্মাতার উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। পুরো সকালটাই সেই কারিগরের দোকানে কাটিয়েছিলাম। আঠা ও ভাল কাঠের গন্ধে বাতাস ছিল ভারী। দুই মাস ধরে এই দোকানদার দুই তারের একটি ম্যান্ডোলিন বানাবার চেষ্টা করছেন- যার নাম "দোতারা"। এইমাত্র নির্মাণকাজ শেষ হল। দোতারা দিয়ে মধুর সুর বেরোনর পর তার সুখ যেন আর ধরে না। আনন্দের আতিশয্যে পুরো দুই ঘণ্টা খুশীর বাজনা বাজিয়ে চললেন।

পুরান ঢাকায়ও গিয়েছিলাম। ইসলামপুরের যানজট আর মানুষের ভিড়ের কথা আর কি বলব। প্রতিদিন যেন জট বেড়েই চলেছে। আমার আসলে প্রথমেই ভুল হয়েছিল, ইসলামপুর গিয়েছিলাম গাড়ি নিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অসংখ্য রিকশা এসে আমাদের ছেঁকে ধরল। বের হওয়ারও উপায় নেই। বেকার বসে থেকে রিকশার বেলের শব্দ শুনতে হচ্ছিল। এক ঝাঁক লিলিপুট কোন দানবের উপর চড়াও হয়ে খেলাচ্ছলে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকলে যে অবস্থা হয়, অনেকটা সেরকম আর কি।

ঢাকা শহরে ৩০,০০০ এরও বেশী রিকশা ও পেডিক্যাব আছে। এগুলোর চালক অধিকাংশই তরুণ, বয়স ১৫ বা এর একটু বেশী হবে। এই ছোট্ট জীবনে তাদের যে পরিমাণ শারীরিক কষ্ট করতে হয়েছে, তাদের দ্বিগুণ বয়েসী লোকেরাও জীবনে এত কষ্ট করেনি। তাদেরকে খুব কমই হাসতে দেখা যায়। কারণ একটানা খাটুনির ছাপটা তাদের মুখমণ্ডলেই ফুটে উঠে।

অধিকাংশ রিকশা ও পেডিক্যাবেই রঙ-বেরঙের ছবি আঁকা থাকে, অনেক রকমের ছবি- গ্রামের দৃশ্য থেকে শুরু করে দুর্বোধ্য রূপকথার ছবি সবই দেখা যায়। কিন্তু সবচেয়ে বেশী ছবি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, স্বাধীনতার জন্য এই দেশকে যে কড়া মূল্য দিতে হয়েছে সর্বত্রই তার ছাপ। এরকমই একটি ছবিতে দেখলাম, এক মহিলাকে ধর্ষণ করছে পাকিস্তানী সৈন্যরা, পাশে এক লোককে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে- একই সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গণহত্যা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া ও সাধারণ মানুষের উপর বোমাবর্ষণের দৃশ্য।

বর্ষপঞ্জিতেও এ ধরণের অনেক ছবি দেখা যায়। সংবাদপত্রগুলো নিয়মিতই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার হতাহতের খবর ছাপিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে একজন উচ্চপদস্থ বিদেশী কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফরে আছেন, এটা প্রায় নিশ্চিত যে তাকে একটি গণকবর দেখতে নিয়ে যাওয়া হবে। গণকবরটি এখনও সর্বসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত আছে। বিদ্যালয়গুলোতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হচ্ছে- সবাই যার যার ছবিতে যুদ্ধকালীন নৃশংসতা ফুটিয়ে তুলছে। একের পর এক কবিতা রচিত হচ্ছে। কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে কেবল "এক সাগর রক্ত" আর "যন্ত্রণাক্লিষ্ট আর্তনাদ" এর কথা।

বাংলাদেশ তার অপরিমেয় ভোগান্তির স্মৃতি মুছে ফেলতে চায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক আমাকে বললেন, "কয়েক শতাব্দী ধরে বাঙালিরা আহত হয়ে আসছে, তাই আমরা কিছুক্ষণ আর্তনাদ করতেই পারি।"

এই নতুন জাতির এক সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, অনেক আগে এ স্থানে "বঙ্গ" নামে একটি রাজ্য ছিল। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে "বঙ্গ" শব্দটির উল্লেখ আছে। সেই রাজ্যের অধিবাসীরা ছিল খাটো, তাদের কোঁকড়া চুল ছিল। এই আদিবাসীদের সাথে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে আসা মঙ্গোলয়েড এবং উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা আর্যদের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। গঙ্গার স্রোত অনুসরণ করেই তারা বঙ্গে এসেছিল বলে ধারণা করা হয়।

মুসলিমদের বঙ্গ অধিকারের পরের ইতিহাস অপেক্ষাকৃত ভালভাবে জানা যায়। ১২০০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমরা বঙ্গ দখল করে নিয়েছিল। সেই সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই অঞ্চলের ইতিহাস হল ঝড়-ঝঞ্জা আর রক্তপাতের ইতিহাস। আজ বাঙালিরা হারানোর বেদনায় যেভাবে আর্তনাদ করছে, কয়েক শতাব্দী পূর্বে বিদ্রোহী বাঙালিদেরকে যখন হাতির পদতলে পিষ্ট করে মারা হয়েছিল তখনও বোধকরি তারা এভাবেই আর্তনাদ করেছিল।

autoআমরা সংখ্যায় কম ছিলাম: কিন্তু আমাদের চেতনায় ছিল স্বদেশ; মুক্তিবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করা যুবকেরা বলল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা সচক্ষে তাদের অধ্যাপকদের নিহত হতে, তাদের ছাত্রাবাস তছনছ হতে এবং তাদের বইগুলো পুড়ে যেতে দেখেছে। তারা ভারতে পালিয়ে গেছে। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে এসে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছে, সেতু ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস করেছে, পাক-সেনাদের অ্যামবুশ করেছে। যুদ্ধ শেষে তারা আবার পড়াশোনা শুরু করেছে। কিন্তু চারিদিকে কেবল হতাশা, পাশ করা ছাত্রদের জন্য এই গ্রামপ্রধান দেশে যে পর্যাপ্ত চাকরির ব্যবস্থা নেই।

[চলবে...]

১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব


মন্তব্য

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

চমৎকার গতিশীল অনুবাদ। পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হয় না একবারের জন্যও। চলুক।


যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই

রায়হান আবীর এর ছবি

চলুক

=============================

হিমু এর ছবি

লেখার শেষে পুরনো পর্বগুলো নিচের ফরম্যাটে জুড়ে দিলে কেমন হয়?


পর্ব ১ এর লিঙ্ক | পর্ব ২ এর লিঙ্ক | ... পর্ব n এর লিঙ্ক |


হাঁটুপানির জলদস্যু

বিপ্লব রহমান এর ছবি

লেখার শেষে পুরনো পর্বগুলো নিচের ফরম্যাটে জুড়ে দিলে কেমন হয়?

আমিও একথা বলতে চেয়েছি। এতে পাঠের বিষয়টি অনেক সহজ হয়।

---
চমৎকার হচ্ছে@ শিক্ষানবিস। চলুক

অনুগ্রহ করে এই ছোট্ট পোস্টটি
দেখার অনুরোধ জানাই। জয় হোক!


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

শিক্ষানবিস এর ছবি

পোস্টটা দেখলাম। যত বেশী মানুষকে জানানো যায় ততই উত্তম। আপনার উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
প্রথম পর্বের ভূমিকা অংশটুকুতে আহ্‌মেদ উল্লাহ পরিকার ও এম এম আর জালাল এর প্রতি কৃতজ্ঞতার অংশটুকু যোগ করে দেয়ার কথা ছিল। এই মাত্র যোগ করে দিলাম। দেখতে পারেন ঠিক হয়েছে কি-না।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

গ্রেট! চলুক


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

শিক্ষানবিস এর ছবি

ভাল হয়। সবগুলোর লিংক নিচে জুড়ে দিচ্ছি।

ফারুক হাসান এর ছবি

শুরুতেই পরের পর্বের লিংকগুলো দিয়ে দিতে পারেন। তাহলে পরের পর্বে সরাসরি যেতে সুবিধা হতো। অনুবাদে চলুক
-----------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী,
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

নিবিড় এর ছবি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

শিক্ষানবিশ... চলতে থাকুক...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বিপ্রতীপ এর ছবি

চলুক...পড়ে গেলাম... চলুক
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
খুঁজে যাই শেকড়ের সন্ধান...

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

মূল লেখাটি যেমন চমত্কার, অনুবাদও তেমনি।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একলা পথে চলা আমার করবো রমণীয়...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

স্বপ্নাহত এর ছবি

কি বলবো। কিছু বলার তো বাকি নাই। আমি তোমার মুগ্ধ পাঠক। বরাবরের মতই....

---------------------------------

বিষণ্ণতা, তোমার হাতটা একটু ধরি?

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।