"তিমির কাঁপিবে গভীর আলোর রবে"
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ থেকে প্রায় ১৩৭৪.৯ কোটি বছর আগে, মহাবিস্ফোরণের (big bang) মাত্র ৪ লক্ষ বছর পরে মহাবিশ্বের সব বাতি প্রায় ধপ করেই নিভে গিয়েছিল। এর আগে মহাবিশ্ব ছিল একটা ভয়ানক গরম, ফুটন্ত, ছুটন্ত প্লাজমা—প্রোটন, নিউট্রন আর ইলেকট্রনের এক চঞ্চল, ঘন মেঘ। সেইখানে কেউ থাকলে চারিদিকে দেখত শুধু ধোঁয়াশা আর ধোঁয়াশা, তবে একইসাথে সেটা হতো অন্ধ করে দেয়ার মতো উজ্জ্বল।
আনুমানিক ৪ লক্ষ বছর বয়সে প্রসরমান মহাবিশ্বটা এত ঠাণ্ডা হয়ে যায় যে, অবশেষে ইলেকট্রন আর প্রোটন মিলে হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরির সুযোগ পায়—যে ঘটনার নাম পুনর্মিলন (recombination)। সে সময় ধোঁয়াশা দূর হয়, মহাবিশ্ব আরো ঠাণ্ডা হতে থাকে, এবং সবকিছু বেশ দ্রুত অন্ধকার হয়ে যায়। মহাবিস্ফোরণের অকল্পনীয় তেজোলীলা আর তার উত্তরকাণ্ডের পর মহাবিশ্বে এই যে আঁধারের রাজত্ব শুরু হলো, জ্যোতির্বিদরা এর নাম দিয়েছেন অন্ধকার যুগ (dark ages)।
এবং সে ছিল আসলেই বেজায় অন্ধকার। এমনকি প্রথম দিককার নক্ষত্রেরাও সেই আঁধার দূর করতে পারেনি। কারণ, তারা সবচেয়ে বেশি বিকিরণ নিঃসরণ করত অতিবেগুনী তরঙ্গদৈর্ঘ্যে যা আবার হাইড্রোজেনের প্রিয় খাদ্য; হাইড্রোজেন সেই তরঙ্গ শোষণ করে আয়নিত হতে থাকায় নবসৃষ্ট অতিবেগুনী রশ্মি নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারছিল না। তাই বলা যায়, মহাবিশ্ব আদিম উত্তপ্ত ও উজ্জ্বল ধোঁয়াশা'র হাত থেকে মুক্ত হয়ে আবার একটা শীতল ও অন্ধকার ধোঁয়াশা'র হাতে বন্দি হয়েছিল।
এই ধোঁয়াশাও একসময় দূর হয়েছে, কিন্তু কিভাবে হয়েছে তা আজকালকার জ্যোতিঃপদার্থবিদ দের মাথা ব্যথার প্রধান কারণগুলোর একটি। হয়ত এর জন্য দায়ী মূলত প্রথম যুগের নক্ষত্রেরা যাদের তীব্র আলো ঢিমেতালে দীর্ঘ সময় ধরে হাইড্রোজেনের অর্গল থেকে ইলেকট্রনকে মুক্ত করতে থেকেছে—যে ঘটনার নাম 'পুনরায়নীভবন' (reionization)। কিংবা হয়ত আয়নীভবনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি এসেছে দানবীয় কৃষ্ণবিবরের চারদিকে চক্কর খেতে খেতে তার ভিতর পড়তে থাকা উত্তপ্ত গ্যাস থেকে।
পুনরায়নীভবন—বা সংক্ষেপে কেবল 'আয়নীভবন'—কখন এবং কিভাবে ঘটেছে তা বুঝার সবচেয়ে ভালো উপায় মহাবিশ্বের প্রাচীনতম বস্তুগুলোর জন্মের ইতিহাস খতিয়ে দেখা। প্রথম নক্ষত্রগুলো কখন জন্ম নিয়েছিল, তারা দেখতে কেমন ছিল? অনেক নক্ষত্র একসাথে মিলে কিভাবে গ্যালাক্সি তৈরি করেছিল, এবং প্রায় সব গ্যালাক্সির কেন্দ্রে যে অতিকায় কৃষ্ণবিবর পাওয়া যায় তাদের উৎপত্তিই বা কিভাবে হয়েছিল? আর নক্ষত্র থেকে গ্যালাক্সি গঠন এবং গ্যালাক্সির হাতে অতিকায় কৃষ্ণবিবর তৈরির এই কালানুক্রমের ঠিক কোন পর্যায়ে হাইড্রোজেনের আয়নীভবন শুরু হয়েছিল? এবং আয়নীভবন প্রক্রিয়াটা ধীর ছিল, না কি আকস্মিক ছিল?
জ্যোতিঃপদার্থবিদরা ১৯৬০ এর দশক থেকেই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু উত্তর দেয়ার জন্য যত শক্তিশালী দূরবীক্ষণ ও কম্পিউটার দরকার তা আমাদের হাতে এসেছে মাত্র সাম্প্রতিক কালে। হালের দূরবীক্ষণ দিয়ে মহাবিস্ফোরণের মাত্র ৫০ কোটি বছর পরে জন্ম নেয়া বস্তু থেকে আসা আলোও সনাক্ত করা যাচ্ছে। আর হালের কম্পিউটার দিয়ে মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্রদের জন্মপ্রক্রিয়া সিমুলেশন করা যাচ্ছে।
মহানক্ষত্র
মাত্র এক দশক আগেও জ্যোতিঃপদার্থবিদরা ভেবে বসে ছিলেন যে, তারা প্রথম নক্ষত্রদের জন্মের কাহিনী জেনে গেছেন। প্রতিষ্ঠিত কাহিনীটা ছিল এরকম: পুনর্মিলনের পরপর পুরো মহাবিশ্ব জুড়ে মোটামুটি সমসত্ত্বভাবে হাইড্রোজেন পরমাণু ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, কিন্তু অদৃশ্য পদার্থ (dark matter)—এমন এক অদৃশ্য কণা দিয়ে তৈরি যা এযাবৎ সনাক্ত করা যায়নি—তখনই জায়গায় জায়গায় দানা বেঁধে প্রচুর 'হেলো' (halo) তৈরি করেছিল; একেকটা হেলো'র ভর ছিল গড়পড়তায় সূর্যের ভরের ১ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ গুণ। এসব হেলো তাদের মহাকর্ষ বল দিয়ে হাইড্রোজেনকে নিজেদের ভিতর নিয়ে আসছিল। এভাবে হাইড্রোজেন জড়ো হতে হতে যখন হেলোগুলোর কেন্দ্রে হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘনত্ব অনেক বেড়ে যায় তখন সেখানে পারমাণবিক বিক্রিয়া শুরু হয় এবং গ্যাসমেঘগুলো ঝিলিক মেরে উঠে—জন্ম হয় মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্রসমষ্টির।
এই প্রথম নক্ষত্ররা—যাদেরকে জ্যোতির্বিদরা '৩য় নক্ষত্রসমষ্টি' (population III stars) নামে ডাকেন—যে গোটা বিশ্বকে আয়নিত করে হাইড্রোজেনের পর্দা উন্মোচন করে দিতে একেবারে অসমর্থ ছিল তা নয়। কিন্তু সবই নির্ভর করছে নক্ষত্রগুলো ঠিক কেমন ছিল তার উপর। তারা যদি যথেষ্ট উজ্জ্বল ও যথেষ্ট দীর্ঘজীবী না হয় তাহলে কাজটা শেষ করতে পারবে না।
এই নক্ষত্রদের বৈশিষ্ট্য বহুলাংশে নির্ভর করে তাদের আকারের উপর। এক দশক আগে জ্যোতির্বিদরা ভাবতেন, সব নক্ষত্র মোটামুটি এক আকারের ছিল—গড়পড়তায় সূর্যের চেয়ে ১০০ গুণ ভারী। কারণ, একটা গ্যাসমেঘ যখন নিজের মহাকর্ষের প্রভাবে নিজের কেন্দ্রের দিকে সংকুচিত হতে থাকে তখন তার তাপমাত্রা বাড়ে, এবং সেই তাপ এক ধরণের 'বিকিরণ চাপ' তৈরি করে যা মহাকর্ষ বলের বিপরীতে কাজ করে; নক্ষত্র যদি তার কিছু তাপ মোচন করতে না পারে তাহলে বিকিরণ চাপের বিকর্ষণের কাছে মহাকর্ষ হেরে যাবে, মেঘের সংকোচন থেমে যাবে, এবং নক্ষত্রের ভ্রুণটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে।
প্রথম দিককার নক্ষত্ররা ছিল মূলত হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি, এবং হাইড্রোজেন তাপমোচনে খুবই অদক্ষ। (আমাদের সূর্যের মতো নক্ষত্রদের ভিতরে সামান্য পরিমাণে অন্যান্য মৌল, যেমন অক্সিজেন ও কার্বন থাকে যা তাদেরকে তাপমোচনে সাহায্য করে।) তাই আদি মহাবিশ্বের ভ্রুণতারারা অনেক হাইড্রোজেন সংগ্রহ করতে পারত, কিন্তু উচ্চচাপ তাদের কেন্দ্রভাগের হাইড্রোজেনকে বেশি ঘন হতে দিত না যার ফলে সেখানে কেন্দ্রীন সংযোজন (nuclear fusion) বিক্রিয়াও শুরু হতে পারত না, যে বিক্রিয়ার শক্তি কেন্দ্রবহির্ভূত সব গ্যাস মহাশূন্যে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। ভ্রুণতারাটি হাইড্রোজেন জমা করতে করতে এক বিশালবপু, অতিভারী, সুবিস্তৃত মেঘখণ্ডে পরিণত হতো, কিন্তু কখনো প্রকৃত নক্ষত্র হতে পারত না।
কিন্তু সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেটোত্তর গবেষক টমাস গ্রাইফ অতিসূক্ষ্ণ সিমুলেশনের মাধ্যমে নক্ষত্র গঠন নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষার পর জানাচ্ছেন, কাহিনীটা এত সরল না। তার সিমুলেশনে মহাকর্ষের পাশাপাশি সংকোচনশীল হাইড্রোজেন গ্যাসের মধ্যে গড়ে উঠা বর্ধিষ্ণু চাপের প্রভাবও ধর্তব্যের মধ্যে নেয়া হয়েছে। সিমুলেশনটি বলছে, আদিম নক্ষত্রগুলো অনেকভাবে গঠিত হয়ে থাকতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে সেসব নক্ষত্রের ভর সূর্যের সর্বোচ্চ দশ লক্ষ গুণও হতে পারে। আবার কখনো সংকোচনশীল মেঘটা ছিন্নভিন্ন হয়ে অনেকগুলো অপেক্ষাকৃত কম ভরের (সৌরভরের বিশ-ত্রিশ গুণ) নক্ষত্রও তৈরি করতে পারে।
নক্ষত্রদের আকার যদি এত বৈচিত্র্যময় হয়ে থাকে তাহলে তাদের আয়ুও অনেক আলাদা আলাদা হতে পারে, এবং সেক্ষেত্রে আয়নীভবন কালও অনেক এদিক ওদিক হতে পারে। সূর্যের চেয়ে ১০০ গুণের মতো ভারী নক্ষত্ররা হচ্ছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের রকস্টার: তারা ঝাকানাকা জীবন যাপন করে এবং অল্প বয়সে মারা যায়। অন্যদিকে ছোটো নক্ষত্ররা অনেক ধীরে সুস্থে জ্বালানি খরচ করে ও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে। তাই, যদি আয়নীভবনের প্রধান কারণ নক্ষত্ররাই হয়ে থাকে, তাহলে পুরো আয়নীভবন ঘটতে অনেক সময়—হয়ত শত শত কোটি বছর—লাগবে, যেহেতু অনেক আদিম নক্ষত্রই অল্প ভরের।
কৃষ্ণ আলো
যত বড়ই হোক না কেন, সব আদিম নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটেছে ভয়ংকর বিস্ফোরণের মাধ্যমে—যে বিস্ফোরণকে বলে অতিনবতারা (supernova)—এবং বিস্ফোরণের পর উপর্যুপরি সংকোচনের মাধ্যমে তারা কৃষ্ণবিবরে পরিণত হয়েছে। এবং আয়নীভবনে সম্ভবত নক্ষত্রদের তুলনায় তাদের সন্তান কৃষ্ণবিবরদের ভূমিকাই বেশি।
কৃষ্ণবিবরেরা দেদারসে আশপাশের সব গ্যাস গিলতে থাকে, এবং গ্যাস বিবরের ভিতরে পড়ার সময় প্রচণ্ড ঘন ও উত্তপ্ত হয়ে উঠে—তাপমাত্রা পৌঁছতে পারে প্রায় কোটি ডিগ্রি পর্যন্ত। তাপটা এতই বেশি যে, অধিকাংশ গ্যাস বিবরে হারিয়ে গেলেও, সামান্য যেটুকু কৃষ্ণবিবরের দুই মেরু থেকে ফিনকির (জেট) মতো নির্গত হয় তাও প্রায় হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূর পর্যন্ত দেখা যায়। জেটবিশিষ্ট অতিকায় কৃষ্ণবিবরের এই বাতিঘর গুলোকেই কোয়েজার (quasar) বলা হয়।
১৯৬০ এর দশক থেকে ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত আসলে আদি মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানার একমাত্র উপায় ছিল কোয়েজার। প্রথমে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুঝতেই পারেননি এগুলো কী। এরা দেখতে নক্ষত্রের মতো, কিন্তু এদের নিঃসৃত আলোর লোহিত সরণ—মহাবিশ্বের প্রসারণের কারণে যাত্রাপথে আলোর অপেক্ষাকৃত লাল হওয়া—অনেক বেশি। লোহিত সরণ বলছিল যে, তারা যেকোনো নক্ষত্রের চেয়ে অনেক অনেক বেশি দূরে অবস্থিত, যার অর্থ তাদের উজ্জ্বলতাও ভয়াবহ রকমের বেশি, কেননা উজ্জ্বলতা বেশি না হলে এত দূর থেকে দেখা যেত না। আবিষ্কৃত প্রথম কোয়েজার—৩সি ২৭৩—এর লোহিত সরণ ০.১৬, যার অর্থ তার আলো আমাদের কাছে আসতে ২০০ কোটি বছর লেগেছে।
এরপর বেশ দ্রুত আরো অনেক কোয়েজার পাওয়া গেছে, কোনো কোনোটার লোহিত সরণ ছিল প্রায় ২, অর্থাৎ তাদের আলো ১০০০ কোটি বছরের ভ্রমণ শেষে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া'র প্যালোমার মানমন্দিরে মার্টিন শ্মিট, জেমস গান এবং ডোনাল্ড শ্নাইডার একত্রে ৪.৯ লোহিত সরণের—১২৫০ কোটি বছর আগের বা মহাবিস্ফোরণের মাত্র ১২৫ কোটি বছর পরের—একটা কোয়েজার আবিষ্কার করেন।
কিন্তু এত প্রাচীন কোয়েজারের আলোতেও হাইড্রোজেন দ্বারা শোষণের কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন থাকলে সে একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে নিত। তার মানে, এই আলো যখন কোয়েজারটি ছেড়ে পৃথিবীর দিকে ধাবিত হওয়া শুরু করেছে তারও আগে মহাবিশ্বের প্রায় সব হাইড্রোজেন নিরপেক্ষ থেকে আয়নিত হয়ে গেছে।
১৯৯০ এর দশকে এর চেয়ে প্রাচীন কোনো কোয়েজার পাওয়া যায়নি বললেই চলে। কারণটা দুরবিনের দুর্বলতা নয়—শক্তিশালী হাবল নভোদুরবিন ও হাওয়াই এর মাওনা কিয়া তে স্থাপিত কেক দুরবিন দুটোই ঐ দশকের শুরুর দিকে কাজ শুরু করেছিল—বরং এত প্রাচীন কোয়েজারের বিরলতা। অতিকায় কৃষ্ণবিবরদের মধ্যে কেবল সবচেয়ে ভারীগুলো থেকেই জেট বেরোয় যাদের সংখ্যা তখন বেশি ছিল না। তাছাড়া কোয়েজার আমরা কেবল তখনই দেখতে পারি, যখন তাদের জেট নির্গমনের দিকটা সরাসরি আমাদের দিকে হয় যা-ও বেশ বিরল।
তার উপর, কৃষ্ণবিবর সক্রিয়ভাবে গ্যাস গিলতে না থাকলে জেট বেরোনর কোনো সম্ভাবনা থাকে না। অধিকাংশ কৃষ্ণবিবর তাদের জীবনের সবচেয়ে সক্রিয় সময়টা পার করেছে ২ থেকে ৩ লোহিত সরণের মধ্যে। কারণ গড়পড়তায় তখনকার গ্যালাক্সিতে গ্যাসের পরিমাণ বর্তমানের চেয়ে বেশি ছিল। এই স্বর্ণসময়ের চেয়ে পিছনে গেলেই কোয়েজার সংখ্যা অনেক কমে যায়। তারপরও তখনকার অন্তত যতগুলো কোয়েজার আছে, সেগুলো আবিষ্কার ২০০০ সালের আগে সম্ভব হয়নি। সে বছর 'স্লোন ডিজিটাল স্কাই সার্ভে' সেযাবৎ নির্মীত সর্বাধুনিক ডিটেক্টর (যা বানিয়েছিলেন সেই জেমস গান) দিয়ে মহাবিশ্বের আবিষ্কারযোগ্য সব কোয়েজারের শুলুক সন্ধানে নামে। এই জরিপে ৫.৫ এর চেয়ে বেশি লোহিত সরণ বিশিষ্ট ৪০ থেকে ৫০ টি কোয়েজার পাওয়া গিয়েছিল।
জরিপে ৬ থেকে ৬.৪ লোহিত সরণের মধ্যকার কিছু কোয়েজারও পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু এর চেয়ে অতীত দেখা আর এর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এবং ৬.৪ লোহিত সরণেও নিরপেক্ষ হাইড্রোজেনের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। চিহ্নটা অবশেষে পাওয়া গেছে মাওনা কিয়া তে স্থাপিত 'ইউনাইটেড কিংডম ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ' (UKIRT) দিয়ে পরিচালিত অবলোহিত তরঙ্গের জরিপে। এই জরিপে আবিষ্কৃত ৭.০৮৫ লোহিত সরণের একটা কোয়েজারের আলোতে সামান্য পরিমাণ অতিবেগুনী রশ্মি শোষণকারী নিরপেক্ষ হাইড্রোজেনের চিহ্ন মিলেছে। মহাবিস্ফোরণের মাত্র ৭৯ কোটি বছর পরে অস্তিত্বশীল এই কোয়েজারটির নাম ULAS J1120+0641 (সংখ্যগুলো বস্তুটার স্থানাঙ্ক নির্দেশ করে), এবং এটাই প্রথমবারের মতো মহাবিশ্বের পুনরায়নীভবন যুগ (epoch) সম্পর্কে কিছু বাস্তব ধারণা দিয়েছে। কিন্তু ধারণাটুকু বেশ অপ্রতুল, কারণ এমনকি তারও আগে মহাবিশ্বের অধিকাংশ হাইড্রোজেন ধ্বংস—তথা আয়নিত—হয়ে গিয়েছিল।
কিংবা হয়ত তখনো সব আয়নিত হয়ে যায়নি। হয়ত এই কোয়েজার মহাবিশ্বের এমন একটা অঞ্চলে আছে যেখানে নিরপেক্ষ হাইড্রোজেনের পরিমাণ কম, হয়ত সে সময়কার অন্যান্য স্থানের কোয়েজারের চারদিকে আরো বেশি নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন আছে। কিন্তু উল্টোটাও সত্যি হতে পারে: হয়ত এই কোয়েজারের আশপাশেই নিরপেক্ষ হাইড্রোজেনের পরিমাণ বেশি, এবং অন্যত্র আরো কম; সেক্ষেত্রে আয়নীভবন হয়ত আরো আগে শেষ হয়েছে। তখনকার আরো বেশি কোয়েজারের নমুনা হাতে না থাকায় নিশ্চিত করে কিছুই বলা সম্ভব না।
কিন্তু ULAS J1120+0641 থেকে পাওয়া তথ্যগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রথমত, সে সময় কোয়েজারের সংখ্যা এত কম ছিল যে তারা আয়নীভবনের প্রধান চালিকাশক্তি হতে পারে না। উপরন্তু, কোয়েজারটির আপাত উজ্জ্বলতা ও দূরত্ব থেকে তার প্রকৃত উজ্জ্বলতা মাপা হয়েছে; এই উজ্জ্বলতার জন্য যে পরিমাণ শক্তির দরকার তা যোগান দিতে হলে তার গর্ভে সূর্যের চেয়ে অন্তত ১০০ কোটি গুণ ভারী একটা অতিকায় কৃষ্ণবিবর থাকতে হবে। মহাবিস্ফোরণের পর এত কম সময়ে এত বিশাল কৃষ্ণবিবর কিভাবে তৈরি হলো?
কিন্তু পর্যবেক্ষণ তো বলছে, আসলেই তৈরি হয়েছিল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান আব্রাহাম লোব এর মতে, সূর্যের চেয়ে ১০০ গুণ ভারী একটা নক্ষত্র যদি মহাবিস্ফোরণের বিশ-ত্রিশ কোটি বছর পর কৃষ্ণবিবরে পরিণত হতে পারে, তাহলে অনুকূল পরিস্থিতিতে কৃষ্ণবিবরটির পক্ষে এত কম সময়ে এত ভারী হওয়া হয়ত সম্ভব। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাকে জন্মের পর থেকেই অবিরাম গ্যাস গিলতে থাকতে হবে, যা খুব কঠিন। কারণ, কৃষ্ণবিবর গ্যাস গিলতে গিলতে অনেক উজ্জ্বল হয়ে উঠার পর আশপাশের সব গ্যাস তাড়িয়ে দেয়, যার ফলে নিজের দোষেই একসময় আর তার খাওয়ার কিছু থাকে না, এবং সে সাময়িকভাবে নিভে যায়। এই নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে তার চারদিকে আবার গ্যাস জড়ো হতে থাকে, এবং গ্যাসদের কৃপায় সে আবার জ্বলে উঠার সুযোগ পায়। নিষ্ক্রিয়তা-সক্রিয়তার এই চক্রকে 'কর্মচক্র' (duty cycle) বলে। কর্মচক্রের অমোঘ বিধানের কারণেই কোনো কৃষ্ণবিবরের বিরতিহীন উদরপূর্তির সাধ মিটে না।
অল্প সময়ে আকার বৃদ্ধির আরেকটা উপায় অবশ্য আছে—অন্য কৃষ্ণবিবরদের সাথে মিলিত হওয়া। আরো সুবিধা হয় যদি শুরুতেই তাদের ভর সূর্যের ১০০ গুণের চেয়ে অনেক বেশি থাকে, গ্রাইফের সিমুলেশন যা সম্ভব বলছে। সূর্যের চেয়ে এত বড় নক্ষত্রের ধারণাটা ইদানিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এরা যদি আসলেই থেকে থাকে তাহলে ২০১৮ সালে জেমস ওয়েব নভোদুরবিন কাজ শুরু করার পর ধরা পড়বে, কারণ এদের উজ্জ্বলতা হওয়ার কথা আমাদের গোটা গ্যালাক্সির সমান।
গ্যালাক্সি সন্ধান
দূরের কোয়েজার আবিষ্কারের চেষ্টায় ভাটা পড়লেও, দূরের গ্যালাক্সি আবিষ্কারের চেষ্টায় নতুন জোয়ার এসেছে। এক্ষেত্রে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছিল হাবল নভোদুরবিন দিয়ে তোলা একটা ছবি, নাম 'হাবল ডিপ ফিল্ড'। ১৯৯৫ সালে হাবল নভোদুরবিনের পরিচালনা প্রতিষ্ঠান 'স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউট' এর তদানীন্তন প্রধান রবার্ট উইলিয়ামস এর মাথায় ভূত চেপেছিল। কেবল পরিচালকের জন্য বরাদ্দ বিশেষ সময় কাজে লাগিয়ে তিনি দুরবিনটাকে আকাশের সম্পূর্ণ খালি একটা জায়গার দিকে ৩০ ঘণ্টা ধরে তাক করে রেখেছিলেন। আমাদের চোখের যে সুযোগটা নেই দুরবিনের সেটা আছে, সে তার নেত্রে আগত ফোটন জমা করে রাখতে পারে। তাই সময়ের সাথে সাথে তার ফোটনসংগ্রহ বাড়তে থাকে। এভাবে আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ খালি জায়গাতেও সে জ্যোতিষ্ক আবিষ্কার করে ফেলে। হাবল যেদিকে তাকিয়েছিল সেদিকে অদৃষ্ট কিছু আসলেই আছে কি-না সে নিয়ে অনেক বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরও ঘোর সন্দেহ ছিল। কিন্তু উইলিয়ামস ছিলেন আশাবাদী।
এবং সবুরে মেওয়াও ফলেছে। হাবল প্রায় কয়েক হাজার ছোটো, ক্ষীণ গ্যালাক্সি আবিষ্কার করেছিল যার কোনো কোনোটা ছিল সেযাবৎ দেখা সবচেয়ে দূরের গ্যালাক্সি। এরপর হাবল গভীর মহাশূন্য দর্শন চালিয়ে গেছে। ২০০৯ সালে এক নভোযাত্রার সময় তার ভিতর 'ওয়াইড ফিল্ড ক্যামেরা ৩' নামে একটা নতুন ডিটেক্টর বসানো হয় যা অবলোহিত আলোও ধরতে সক্ষম। এর কর্মদক্ষতা ছিল আগের ডিটেক্টরের চেয়ে ৩৫ গুণ বেশি, এবং যথারীতি সে আরো অনেক গভীর জলের মাছ খুঁজে পেয়েছে। আগে যেখানে ৭ লোহিত সরণের চেয়ে দূরের মাত্র চার-পাঁচটা গ্যালাক্সি চেনা ছিল, সেখানে এখন একশ'রও বেশি পাওয়া গেছে। অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল স্টার্ক ও ক্যালটেক এর রিচার্ড এলিস ২০১২ সালের এক গবেষণাপত্রে অবিশ্বাস্য ১১.২ লোহিত সরণের এক গ্যালাক্সি আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন, অর্থাৎ এটা মহাবিস্ফোরণের মাত্র ৪০ কোটি বছর পর জীবন যাপন করছিল।
কোয়েজারদের মতো এসব আদিম গ্যালাক্সিও তখনকার নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন সম্পর্কে অনেক কিছু জানাতে পারে। দেখা গেছে, এই গ্যালাক্সিগুলোর যতটুকু অতিবেগুনী রশ্মি নিঃসরণ করার কথা ততটুকু আমরা পাচ্ছি না, কিছু অংশ খোয়া গেছে। এটা আত্মঘাতী হাইড্রোজেনের কর্ম, সে ওটুকু শোষণ করে নিজেকে ধ্বংস করেছে। যত বেশি হাইড্রোজেন আয়নিত হয়েছে, অতিবেগুনী শোষণের পরিমাণ ততই কমেছে। তাই মহাবিস্ফোরণ থেকে যত বর্তমানের দিকে আসা যায়, গ্যালাক্সির অতিবেগুনী আলোও তত বেশি পাওয়া যায়, এবং মহাবিস্ফোরণের আনুমানিক ১০০ কোটি বছর পর আর শোষণ করার কেউ থাকে না, হাইড্রোজেনের চাদর সরিয়ে বিশ্বজগৎ একদম স্বচ্ছ হয়ে উঠে।
গ্যালাক্সির গুলি তে হাইড্রোজেন যে ভালভাবেই বিদ্ধ হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই, বন্দুকের ডগায় ধোঁয়া পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পাড়ায় তার একচেটিয়া মস্তানি ছিল সেটা বলা যাচ্ছে না। কারণ এই শ'খানেক গ্যালাক্সি থেকে হিসাব করে গোটা বিশ্বে কতগুলো এইরকম গ্যালাক্সি ছিল তা বের করা হয়েছে, এবং সেই সংখ্যাটা সব হাইড্রোজেনকে আয়নিত করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সেজন্য আরো যত শক্তি দরকার সেটা যে কৃষ্ণবিবর যোগান দিতে পারবে না তা আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি, তারা ওরকম দাপুটে হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময়ই পায়নি।
তবে হয়ত সমাধান হাতের কাছেই আছে। হয়ত আমাদের চোখের আড়ালে এখনো অনেক আদিম গ্যালাক্সি রয়ে গেছে। হাবল তার ডাগর আঁখি যে কয়টার দিকে ফেলেছে সেগুলো ছিল সে সময়কার সবচেয়ে উজ্জ্বল গ্যালাক্সি। কিন্তু তখনকার টিমটিমে হাজারো গ্যালাক্সি হয়ত "সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না" গেয়ে চলেছে। বিধি আরো উদারহৃদয় দূরবীক্ষণ তৈরি না করা পর্যন্ত তাদের তৃষাটুকু পূরানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে তাদের সান্ত্বনা দেয়া যায় এই বলে যে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রায় বিশ্বাস করেই ফেলেছেন, "বিশ্বায়নীভবনে গ্যালাক্সিদের ভূমিকাই প্রধান।"
ভরসা আইনস্টাইন
একেবারে নবজাতক গ্যালাক্সিগুলো দেখতে কেমন ছিল এবং তাদের নক্ষত্রমেলা ঠিক কখন বসতে শুরু করেছিল তা এখন পর্যন্ত অজানা। হাবল যেগুলো দেখেছে সেগুলোকে ঠিক বুড়ো বলা যাবে না—আরো এক দুই শ' কোটি বছর পরের গ্যালাক্সিদের তুলনায় তাদেরকে বেশ নবীনই দেখায়। কিন্তু তদ্দিনেই তাদের ভিতর প্রায় দশ কোটির মতো নক্ষত্র জড়ো হয়ে গিয়েছিল, এবং নক্ষত্রগুলোর রঙও একটু লালচে যেমনটা একেবারে নতুন গ্যালাক্সিতে দেখা যায় না। দেখে মনে হয়, তারা অন্তত দশ কোটি বছর ধরে নক্ষত্র জোগাড় করছিল। সুতরাং, হাবল আমাদেরকে আদিম গ্যালাক্সির সন্ধান দিলেও, আদিমতমদের সন্ধান পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরো সংবেদী জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের।
তবে হাবলের আবেদনও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। তাকে সংবেদন সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য স্বয়ং মহাবিশ্বই হাজির যার প্রাকৃতিক লেন্স অদৃশ্য বস্তুর দিকেও তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। অনেক ভারী বস্তু—এক্ষেত্রে গ্যালাক্সিপুঞ্জ—তার আশপাশের স্থান প্রচণ্ড বাঁকিয়ে দেয় যেটা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। বস্তুটির পিছনের যে আলো আগে তার কারণে আমাদের দিকে আসতে পারছিল না, সেটা এই সুযোগে বাঁকা পথ দিয়ে চলে আসতে পারে। সামনের বস্তুটাকে পুরোবস্তু, আর পিছনেরটাকে পটবস্তু ডাকা যাক। বক্রপথে আসা আলোয় পটবস্তুটাকে বিকৃত দেখায়, এবং তার আকারও স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। তাই, একটু বিকৃতভাবে হলেও অনেক দূরের বস্তু এই পদ্ধতিতে দেখা সম্ভব।
গ্যালাক্সিপুঞ্জের পিছনে থাকা দূরবর্তী বস্তুর আলো এতটাই বিবর্ধিত হয় যে তাদেরকে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত উজ্জ্বল দেখাতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় গ্যালাক্সি দেখার জন্য হাবল গবেষকদের একটা আলাদা দলই আছে, এবং তারা ইতিমধ্যে ২৫০টি গ্যালাক্সি আবিষ্কার করে ফেলেছে যেগুলো 'ডিপ ফিল্ড' জরিপে হাবলের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। নতুন গ্যালাক্সিগুলোর লোহিত সরণ গড়পড়তায় ৬ থেকে ৮ এর মধ্যে, তবে ১১ লোহিত সরণেও কয়েকটা পাওয়া গেছে। ডিপ ফিল্ড জরিপের গ্যালাক্সিগুলো হাইড্রোজেন-বিশ্বের যে চিত্র তুলে ধরেছিল, মহাকর্ষ লেন্সিং এর মাধ্যমে পাওয়া নতুন গুলো এখন পর্যন্ত তা-ই সমর্থন করছে।
হাবল তার অনুসন্ধানের গভীরতা বাড়িয়েই চলবে। ইতিমধ্যেই 'ফ্রন্টিয়ার ফিল্ডস' নামে একটা নতুন প্রকল্পের ঘোষণা দেয়া হয়েছে যার কাজই হবে মহাবিশ্বের সবচেয়ে ভারী গ্যালাক্সিপুঞ্জ গুলোর মধ্যে ৬টিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা। এই পুঞ্জগুলো তাদের বিশাল বপু দিয়ে পিছনের যা কিছু ঢেকে রেখেছে তার সব বাঁকা পথে আবিষ্কারের চেষ্টা করা হবে। হাবল ৯৫.৬ মিনিটে একবার পৃথিবীকে আবর্তন করে, এবং প্রতি আবর্তনে ৪৫ মিনিট পর্যবেক্ষণের কাজ করা যায়। এরকম ১৪০টা আবর্তনকাল ফ্রন্টিয়ার ফিল্ডস এর জন্য বরাদ্দ।
দমক সন্ধান
তবে সবাইকে ছাপিয়ে আদিম মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানার সর্বোত্তম উপায় হয়ে উঠতে পারে আরেকটা বাতিঘর: গামারশ্মি দমক (gamma-ray burst)—এদিক ওদিক থেকে হঠাৎ ছুটে আসা অত্যুচ্চ কম্পাঙ্কের বিকিরণের দমক। ১৯৬০ এর দশকে আবিষ্কৃত এই ঘটনা যেন আগের সব রহস্যকেও হার মানিয়েছিল। এখন ধারণা করা হচ্ছে, অতিভারী নক্ষত্রের মৃত্যুর সময় এই দমক তৈরি হয়। বিশাল নক্ষত্র অকস্মাৎ ধ্বসে পড়ে কৃষ্ণবিবরে পরিণত হওয়ার সময় ফিনকি'র মতো করে গামারশ্মির তীব্র ঝলক মহাশূন্যে ছড়িয়ে দেয়। এই গামারশ্মি জেট গিয়ে যখন আশপাশের গ্যাসে আছড়ে পড়ে তখন সেই গ্যাস থেকে দৃশ্যমান আলো ও অবলোহিত তরঙ্গে আরেকটা উজ্জ্বল বিকিরণ নিঃসৃত হয় যা সাধারণ দুরবিন দিয়ে দেখা যায়।
মহাকাশের আর ভূমির দুরবিনের যোগসাজশে একই সাথে গামারশ্মি দমক আর দমকপরবর্তী অস্তরাগ সনাক্ত করা যায়। গামারশ্মি যেহেতু বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছতে পারে না, সেহেতু গামারশ্মি দুরবিন স্থাপন করা হয় মহাকাশে। পৃথিবীকে চক্কর দিতে দিতে দুরবিনটি যখনই কোনো দিক থেকে দমক আসতে দেখে তখনই সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, এবং একই সাথে যেদিক থেকে দমকটি এসেছে সেই দিকের স্থানাঙ্ক পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়। তড়িঘড়ি করে জ্যোতির্বিদরা তাদের ভূদুরবিন তখন সেদিকে তাক করেন, যাতে গামারশ্মিটির দমকে গ্যাস থেকে তৈরি হওয়া অস্তরাগ সনাক্ত করা যায়। অস্তরাগটি দেখা গেলে, যে গ্যালাক্সিতে দমকটি তৈরি হয়েছে সেটার লোহিত সরণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়।
গামারশ্মি দমকের কাছে মহাবিশ্বের অন্যসব মহাঘটনা নিতান্তই শিশু। দমক শুরু হওয়ার পর থেকে প্রথম কয়েক ঘণ্টা তার উজ্জ্বলতা থাকে একটা গ্যালাক্সির উজ্জ্বলতার দশ লক্ষ গুণ। এমনকি কোয়েজারের চেয়েও তারা ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি উজ্জ্বল। এদের দেখতে হলে তাই হাবলের মতো অনেকক্ষণ জুলজুল করে তাকিয়ে থাকতে হয় না। ২০০৯ সালে মাওনা কিয়া'র দুরবিন দিয়ে একটা গামারশ্মি দমকের মাতৃগ্যালাক্সি'র লোহিত সরণ ৮.২ নির্ণয় করা হয়েছিল, অর্থাৎ সেটা মহাবিস্ফোরণের ৬০ কোটি বছর পরের ঘটনা।
দমকটা এতই উজ্জ্বল ছিল যে সেটা ৮.২ এ না থেকে ১৫ বা এমনকি ২০ লোহিত সরণে, অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের মাত্র ২০ কোটি বছরেরও কম সময় পরে থাকলেও দেখা যেত। ২০ কোটি বছর পরই প্রথম নক্ষত্রগুলো গঠিত হতে শুরু করেছিল এবং প্রচণ্ড ভারী হওয়ার কারণে সেগুলোই গামারশ্মি দমক তৈরির জন্য সবচেয়ে আদর্শ। এখন পর্যন্ত যত উজ্জ্বল দমক আবিষ্কার করা গেছে, এই প্রথম নক্ষত্রদের দমক তার চেয়েও অনেক বেশি উজ্জ্বল হবে।
কোয়েজার ও গ্যালাক্সিদের তুলনায় গামারশ্মি দমক বেশি সম্ভাবনাময়। কোয়েজার তৈরির জন্য লাগে অতিকায় কৃষ্ণবিবর যা আদিম যুগে বেশ বিরল। আর গ্যালাক্সিদের মধ্যে কেবল উজ্জ্বলগুলোর দিকেই হাবলের চোখ যায়, যাদের সংখ্যা টিমটিমে গ্যালাক্সিদের তুলনায় অনেক অনেক কম। কিন্তু গামারশ্মি দমক উজ্জ্বল, টিমটিমে যেকোনো গ্যালাক্সিতে তৈরি হতে পারে এবং যেখানেই হোক না কেন তাকে দেখা যাবেই। সুতরাং গামারশ্মি দমক আবিষ্কার করে তখনকার মহাবিশ্বের গড়পড়তা অবস্থা অনেক ভালো বুঝা সম্ভব।
তবে সমস্যা হচ্ছে, ৯৯ শতাংশ গামারশ্মি দমকই সরাসরি আমাদের দিকে লক্ষ্য করে আসে না। আর যেগুলোও বা আমাদের দিকে আসে সেগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকটা অনেক বেশি লোহিত সরণের, অর্থাৎ অনেক দূরের। তাই প্রতিদিন গড়ে একটা করে গামারশ্মি সনাক্ত করা গেলেও তাদের দিয়ে আদিম মহাবিশ্বের একটা নির্ভরযোগ্য চিত্র দাঁড় করাতে অন্তত এক দশক লাগবে। যে 'সুইফ্ট গামা-রে বার্স্ট মিশন' বর্তমানে কাজ করছে তা ততদিন টিকবে না। তাই শীঘ্রই আরেকটা গামারশ্মি নভোদুরবিন পাঠাতে হবে, যাতে সে নতুন গামারশ্মি দমকের স্থানাঙ্কগুলো জেমস ওয়েব নভোদুরবিনে বা ভবিষ্যতের অন্যান্য শক্তিশালী ভূদুরবিনে পাঠাতে পারে। আগামী দশকেই ৩০ মিটার ব্যাসের তিনটা ভূদুরবিন কাজ শুরু করবে। ভবিষ্যতের এই দুরবিনগুলো কাজ শুরু করার পর কোয়েজার শিকারী, গ্যালাক্সি জরিপকারী, এবং গামারশ্মি সন্ধানী সবাই নতুন করে পালে হাওয়া পাবেন। মহাবিশ্বের সেই সময়টা সম্পর্কে আরো স্পষ্ট ধারণা পেতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
এর মধ্যে আরো একটা অস্ত্র নিয়ে রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ময়দানে হাজির হতে শুরু করেছেন—নিম্ন কম্পাঙ্কের রেডিও দুরবিন। কোয়েজার-গ্যালাক্সি-গামারশ্মি দমক দিয়ে তো হাইড্রোজেনের হত্যাকারীদের সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু স্বয়ং হাইড্রোজেনই ২১ সেন্টিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে একটা বিকিরণ নিঃসরণ করে। পুনরায়নীভবন যুগের হাইড্রোজেন থেকে এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যে বিকিরণগুলো নিঃসৃত হয়েছিল তারা লোহিত সরণের কারণে বর্তমানে ১.৫ থেকে ৩ মিটারের মতো লম্বা হয়ে গেছে, অর্থাৎ বর্তমানে তাদের কম্পাঙ্ক ১০০ থেকে ২০০ মেগাহার্জ। যে তরঙ্গটা ১.৫ মিটার লম্বা, অর্থাৎ যার কম্পাঙ্ক ২০০ মেগাহার্জ তার লোহিত সরণের পরিমাণ আনুমানিক ৬, অর্থাৎ পুনরায়নীভবনের একেবারে শেষদিকে সে হাইড্রোজেন ছেড়েছিল। আর যার দৈর্ঘ্য ২ মিটার সে তারও আগের, যারটা ৩ মিটার সে আরো আগের। যত বর্তমানের দিকে আসা যাবে, অক্ষত হাইড্রোজেনের পরিমাণ তত কমবে, এবং এই বিকিরণটাও তত কমবে, যেহেতু হাইড্রোজেন থেকেই সে নিঃসৃত হয়। তাই এই বিকিরণ বিশ্লেষণ করে আয়নীভবনের পুরো ইতিহাসটা বলে দেয়া যাবে।
কিছুদিন আগ পর্যন্তও এত কম কম্পাঙ্কের রেডিও বিকিরণ সনাক্ত করার কেউ ছিল না। ২০১২ সালে নেদারল্যান্ডের রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থা 'অ্যাস্ট্রন' প্রায় ২৫,০০০ এন্টেনার সমন্বয়ে 'লোফার' (LOFAR—LOw Frequency ARray) নামে এক দানব-দুরবিন তৈরি করেছে যা বর্তমানে পুনরায়নীভবনের হাইড্রোজেন সনাক্ত করার একেবারে দ্বারপ্রান্তে আছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় স্থাপিত মার্কিন দুরবিন 'PAPER' এবং অস্ট্রেলিয়ায় স্থাপিত দুরবিন 'MWA' ও একই উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছে। আর ২০২৫ সাল নাগাদ SKA (Square Kilometer Array) নামে একটা দুরবিনের কাজ শেষ হবে যার হাজার হাজার এন্টেনা'র কিছু থাকবে অস্ট্রেলিয়াতে আর কিছু থাকবে দক্ষিণ আফ্রিকাতে। এই লক্ষচোখা দানব আদিম ইতিহাসের প্রতিটি ধাপের হাইড্রোজেনের বিস্তৃত মানচিত্র তৈরি করে ফেলতে পারবে।
আদিম মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানার এই জোয়ার শুরু হয়েছিল ১৯৬৫ সালে, মহাবিস্ফোরণের ৪ লক্ষ বছর পরে অর্থাৎ পুনর্মিলন যুগে তৈরি হওয়া মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ (পটকিরণ) আবিষ্কারের মাধ্যমে। তবে ইতিহাসটা এখনো বেশ ধোঁয়াটেই রয়ে গেছে। ২০২৫ এ, পটকিরণ আবিষ্কারের ৬০ বছর পূর্তিতে, হয়ত অবশেষে মহাবিশ্বের মতো আমাদের ধোঁয়াশারও অবসান ঘটবে।
ইহা সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান এর এপ্রিল ২০১৪ সংখ্যায় মাইকেল ডি লেমোনিক এর লেখা The First Starlight প্রবন্ধ অবলম্বনে লিখিত। লেমোনিক বিজ্ঞানী নন, বিজ্ঞান সাংবাদিক। তবে তিনি সব কথা প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানীদের সূত্র দিয়ে বলেছেন।
উল্লেখিত বিজ্ঞানী: Richard Ellis, Thomas Greif, James Gunn, Abraham Loeb, Maarten Schmidt, Donald Schneider, Daniel Stark.
উপরি পাঠ:
হার্ভার্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের বর্তমান প্রধান আব্রাহাম লোব এর লেখা ২টা বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। মজার ব্যাপার হলো বই দুইটা প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনী থেকে বের হওয়া সত্ত্বেও লোব দুইটার পিডিএফ ই তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে রেখে দিয়েছেন—
১। How Did the First Stars and Galaxies Form?
২। The First Galaxies in the Universe.
৩। ভারতের 'রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউট' এর জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিমান নাথ এর লেখা মহাবিশ্বের প্রথম আলো।
মন্তব্য
হাঁ করে একটানে পড়লাম।
সামনের মূলবস্তুর পাশ দিয়ে পেছনের পটবস্তুর আলো কিভাবে দেখা যাচ্ছে সেটার দুয়েকটা ছবিটবি দিলে ভালো হোত।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
হ্যাঁ, মহাকর্ষ লেন্স আরেকটু ব্যাখ্যা করা দরকার ছিল। একটা ছবি যোগ করেছি লেখাতে। দেখলে আশাকরি বুঝতে পারবেন।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
যারা গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর সাথে পরিচিত নয়, তাদের জন্যে একটু বোঝার অসুবিধে হবে মনে হয়। একটা ছবি দিয়ে দিতে পারিস, এই যায়গাটায়।
ঠিক।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
একটু বিদঘুটে শোনালেও, যথার্থতার খাতিরে মহাবিস্ফোরণ না বলে 'মহাস্ফীতি' বললেই কি সঠিক হত না? যদ্দুর মনে পড়ে হকিং-এর বইতে পড়েছিলাম এই প্রপঞ্চটা 'ইনফ্লেশান', এক্সপ্লোশান না। আর ইনফ্লেশানের বাংলা বোধহয় স্ফীতি, এক্সপ্লোশানের - বিস্ফোরণ। তাছাড়া উইকিপিডিয়াতে "বিগ ব্যাং" সংক্রান্ত ভুক্তিতে দেখছি একে বিশেষ এক ধরণের "এক্সপানশন" বলা হচ্ছে, যার পূর্ণ নাম "মেট্রিক এক্সপানশন অফ স্পেস"। উইকিতে এই "মেট্রিক এক্সপানশন অফ স্পেস" সংক্রান্ত ভুক্তিটা পড়ে একে 'বিস্ফোরণ'-এর বদলে বরং খুব বেশি করে 'স্ফীতি'-ই মনে হচ্ছে। বিশিষ্ট স্ফীতি। উইকিতে এই স্ফীতি অর্থাৎ "মেট্রিক এক্সপানশন অফ স্পেস"-কেই আবার 'ইনফ্লেশান' বলা হচ্ছে। মোদ্দা কথা - ঘুরেফিরে সেই "স্ফীতি" শব্দটাই আসছে। আপনি কি বলেন?
****************************************
আসলে ঐতিহাসিক কারণে big bang (মহাবিস্ফোরণ) ও cosmic inflation (মহাস্ফীতি) দুটো ভিন্ন ব্যাপার। মহাস্ফীতি অনুকল্প প্রস্তাবের আগেই মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব আধুনিক বিশ্বতত্ত্বের প্রমিত মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্থানের মেট্রিক সম্প্রসারণ মহাবিস্ফোরণ মডেলের একটি বৈশিষ্ট্য কেবল। মেট্রিক সম্প্রসারণ দিয়ে মহাস্ফীতি বুঝানো হয় না; মেট্রিক সম্প্রসারণ হচ্ছে মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের একটি প্রস্তাব। মহাবিস্ফোরণ মডেলের ২টা বড় সমস্যা সমাধানের জন্য মহাস্ফীতি প্রস্তাব করা হয়েছিল। মেট্রিক প্রসারণ শুরুর আগে মহাবিশ্বের অত্যল্প সময়ে ফুলে ফেঁপে বিশাল বড় হয়ে উঠাকেই বলা হয় মহাস্ফীতি। নিবন্ধের নিচে ছবিটাতে কিন্তু মহাবিস্ফোরণ ও মহাস্ফীতি দুটো আলাদা ব্যাপার হিসেবে দেখানো হয়েছে।
সুতরাং মহাস্ফীতির সাথে মহাবিস্ফোরণ গুলিয়ে ফেলা যাবে না। এখন প্রশ্ন হতে পারে বিগ ব্যাং এর বাংলা কেন মহাবিস্ফোরণ করলাম। আসলে এর আরেকটা বাংলা মহাগর্জন যা আমি আগে ব্যবহার করতাম। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে যারা বাংলায় লিখেন তারা শুরু থেকেই বিগ্যব্যাং এর বাংলা মহাবিস্ফোরণ করে আসছেন। তাদের লেখার সাথে যাতে মিলানো যায় সে কারণেই মহাগর্জনের বদলে মহাবিস্ফোরণ ব্যবহার করছি। হুমায়ুন আজাদ তার বইয়ে মহাগর্জন লিখেছিলেন, কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম, চল নয়।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
অনেক কিছুই বুঝিনি, তারও বেশী মনে রাখতে পারিনি। তবু আপনার এ লেখা পড়তে অত্যন্ত ভালো লেগেছে। আর, বিশেষ মুগ্ধ হয়েছি আপনার ধৈর্য্য দেখে - এত যত্নে এত লম্বা লেখা!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ।
এই লেখার সব বুঝা আসলেই কঠিন। মনে রাখা তো সম্ভবই না, আমারই এখন মনে পড়ছে না ঠিক কি কি লিখেছি। সেই কারণেই লেখার শেষে ছবিটা যোগ করা। "মহাবিশ্বের প্রথম ১০০ কোটি বছর" ছবিটা মাথায় থাকলেই চলে, বাকিটা মনে রাখার দরকার নাই। এই ছবিটাকেই বলা যায়, "take away message".
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন